কখনো কুর্চি (পর্ব ১০)
পাশাপাশি দাঁড়িয়ে শিউলি রহমান আর নাসিম সাহেব, শিউলি জন্মদিনের কেক কাটছেন, কুর্চি ভিডিও করছে। দুজনের পরণে কুর্চির আনা ম্যাচিং শাড়ি আর পাঞ্জাবি। ম্যাচিং কাপড় দেখে আহ্লাদে আটখানা হয়েছেন শিউলি, নিজের অনেকদিনের একটা শখ পূরণ করতে পারলেন। জানেন তিনি কিনে আনলে নাসিম সাহেব বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাবেন, মেয়ে এনেছে তাই কিছু বলতে পারবেন না। যদিও ব্যপার দেখে তার চোখে আতংক ফুটে উঠেছিল। মনেমনে ভাগবার প্ল্যান করেও ফেলেছিলেন হয়ত, নেহাত আপত্যস্নেহে পড়ে গিয়ে প্ল্যানকে কাজে পরিণত করতে পারেনি।
নাসিম সাহেব মনে নতুন আতংক নিয়ে কেক কাটছেন। তার বিচ্ছু শালী, বকুলও আজ উপস্থিত রয়েছে। শশুরমশায়ের মাশাল্লাহ অনেকগুলি মেয়ে। একটার পর একটা মেয়ে জন্মেছে আর তিনি মনের আনন্দে ফুলের নামে তাদের নাম দিয়ে গেছেন পরপর। এখন টগর, চম্পা, চামেলী, জবা কেউ ঢাকা শহরের বাইরে, কেউ আবার একেবারে দেশেরই বাইরে। রয়ে গেছে সবচাইতে বিপজ্জনক শালিটা।
বকুল!
বকুলকে নিয়েই তার সবচাইতে বেশি চিন্তা। কুর্চি তো ভিডিও করে নেটে ছেড়ে দেবে, তারপরে এই বিচ্ছু বকুল কী কী যে কমেন্ট করবে, কতজনকে ডেকে ডেকে এনে দেখাবে, ভাবতেই তার টাক মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠল। সারাজীবন তিনি সিম্পল জামাকাপড় পরে এসেছেন, আজ মেয়ের কল্যাণে আস্ত কলাগাছ বুকে নিয়ে ভিডিও করছেন! শুধু তাই না, তার স্ত্রীর বুকেও অনুরূপ কদলী বৃক্ষ। অর্থাৎ দুজনেই কলা গাছ সেজে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছেন!
কোন জাতের কলা কে জানে? যদি চিনিচম্পা হয় তাহলেই শেষ। তিনি তার এভারেজ হাইট নিয়ে খুব স্পর্শকাতর। বকুল হয়ত সেইটাই হাইলাইট করবে! ওকে বিশ্বাস নাই!
কেক কাটা শেষ, সবাই হাততালি দিয়ে উঠল। বকুল খালা চেঁচিয়ে উঠলেন
— নাসিম ভাই, আপুকে কেক খাইয়ে দাও।
এসবে খুবি বিব্রতবোধ করেন নাসিম সাহেব। কোনহাতে ছুরি ধরবেন, কোনহাতে কেক ধরবেন, কিভাবে খাওয়াবেন, কখনোই বুঝে উঠতে পারেন না। এসব করতে গিয়ে বেশিরভাগ সময় ছু্রিটা হাত থেকে খসে গিয়ে শিউলির পায়ের ওপরে পড়বার উপক্রম হয়, শিউলি তখন অভিমানভরে বলে
— যাও, খাওয়াতে হবে না। মনে ইচ্ছাই নাই তোমার।
আসলে ইচ্ছার অভাব না, এসবে ঠিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না বলেই উল্টাপাল্টা হয়ে যায়।
আজ অবশ্য সফলভাবেই ছোট এক পিস কেক স্ত্রীর মুখে তুলে খাইয়ে দিতে পারলেন। যাক, শিউলির একটা শখ পূরণ করা গেল। বেচারির অনেক শখ। কোনোটাই তিনি শিউলির মনের মতো পূরণ করতে পারেন না। আজ কলাগাছ বুকে নিয়ে কেক খাইয়ে দিলেন, ভিডিওতে প্রমাণিত হয়ে থাকল যে স্বামী হিসাবে তিনি একেবারে ফেলে দেবার মতো না। দশে আট অন্তত পাবার আশা করাই যায়!
কুর্চি ভিডিও করছিল। বাবা আর মা দুজনকেই এত চমৎকার লাগছে। বাবার চেহারায় বিব্রত গর্বিতভাব, মায়ের চেহারায় লজ্জা লজ্জা ভাব, দুজনের ম্যাচিং শাড়ি পাঞ্জাবিটাও দুজনকে চমৎকার মানিয়েছে। কে জানত বাবা, ঐ ভয়াবহ দোকানের স্টকে এত ছিমছাম কাপড় থাকবে।
মা তো দেখে খুশিতে আটখানা হয়েছে। বাবাও আজ মায়ের কথামতো চলছে, তাতে এই জন্মদিন মায়ের সারাজীবন হয়ত মনে থাকবে।
অদ্ভুত আনন্দে মনটা ভরে গেল কুর্চির। ও ভিডিও করতে থাকল। আজ কী সুন্দর করে বাবা মা’কে কেকের পিসটা খাইয়ে দিচ্ছে।
হঠাত কুর্চির চোখ ঝাপসা হয়ে এল। নাকি ক্যামেরার লেন্সটার কিছু হয়েছে? পরপর কয়েকবার চোখের পলক ফেলে ঝাপসাভাবটা দূর করার চেষ্টা করল ও।
আরে! একী!
সামনে বাবামা দাঁড়িয়ে নেই, দাঁড়িয়ে রয়েছে ও আর আরিয়ান। আরিয়ান ওকে কেকের পিস মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে, সেও লজ্জালজ্জা মুখ করে সেটা খাচ্ছে।
এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড।
চোখের ঝাপসাভাব দূর হয়ে গেল। কোথায় কী! ওই তো বাবামা দাঁড়িয়ে রয়েছে।
স্তম্ভিত হয়ে গেল কুর্চী। এসবের মানে কী! কেন এমন দেখল ও? ওরপাশে আরিয়ানকেও বা কেন দেখল? ওর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি?
তবে কি… তবে কি… ও আরিয়ানকে নিজের পাশে মনেমনে কল্পনা করছে? আরিয়ানকে ভালোবেসে ফেলেছে?
একসাথে কাজ করতে করতে কখন মনেমনে এভাবে ভাবতে শুরু করে দিয়েছে, ও জানেও না।
কিন্তু আরিয়ানের মধ্যে সেরকম লক্ষণ তো…
ভিডিও ক্যামেরা আরেকজনের হাতে দিয়ে বাথরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিল কুর্চি। ওর নির্ঘাত মাথাখারাপ হয়েছে।
আরিয়ান!
সত্যি কি ও আরিয়ানের প্রেমে পড়েছে?
মনে পড়ে গেল লুবনা ফিরে আসার পরে সিঁথির সাথে এনিয়ে আলাপ হচ্ছিল। সিঁথি ওকে জানিয়েছিল
— লুবনার জেদেই রাকীব স্যার স্টুডিওটা বানিয়ে দিয়েছিলেন। নাহলে এ অফিসটা রাকীব স্যার শুধুমাত্র নিজের কাজের জন্য ব্যবহার করতেন। লুবনা আবদার ধরল, লুবনার আবদার ফেলতে না পেরে স্যার পুরা অফিস রিডেকোরেট করলেন। রিসেপশান এরিয়া বসালেন, স্টুডিও বানালেন। সব কাজের আইডিয়া লুবনার ছিল।
— স্যার বুঝি লুবনার সব কথা শোনেন?
— হ্যাঁ, স্যার লুবনার কোনো কথা ফেলতে পারেন না। তবে এভাবে স্যারের অমতে পালিয়ে বিয়ে করাতে স্যার আগের মতো আর লুবনার কথা শুনবেন কিনা কে জানে। স্যার ভালোমানুষ কিন্তু ঘাউরাও কম না। তার প্ল্যান হয়ত বিফলে চলে গেল লুবনা পালিয়ে বিয়ে করায়।
— প্ল্যান? স্যারের প্ল্যান ছিল লুবনার বিয়ে নিয়ে?
সাথেসাথে ঠোঁটে আঙুল ধরে চুপ থাকবার ইশারা করল সিঁথি
— এই, এসব কথা কাউকে বোলো না, প্লিজ। আমি আবোলতাবোল ভেবেছি, সত্যি কিনা জানি না। লুবনা বা স্যার শুনতে পেলে আমাকে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে।
— না না, কাউকে বলব না। প্রমিজ।
সিঁথি তাও ইতস্তত করল খানিক। কিন্তু ওরও বলবার ইচ্ছা ষোল আনা। শেষে বলেই ফেলল
— তোমাকে তো বলেছি আরিয়ান আর লুবনা ক্লাসমেট। আরিয়ানকে লুবনাই এনেছে। তারপর তো আরিয়ান আর লুবনা জুটি হিট করে গেল। ওদের দুজনের কেমিস্ট্রিটা এত চমৎকার যে আমরা সবাই ধরেই নিয়েছিলাম যে ওরা কাপল।
তাই লুবনা যখন কাউকে কিছু না বলে ইলোপ করল, আমি আকাশ থেকে পড়েছিলাম। কখনো ভাবিনি লুবনা এমনকিছু করতে পারে। আরিয়ানও নিশ্চয় লুবনার এমন বিশ্বাসঘাতকতায় খুব ভেঙে পড়েছিল। শোয়েরও ভরাডুবি হতে চলেছিল। ভাগ্যিস তুমি এসেছিলে, কুর্চি।
সেকথায় কান না দিয়ে কুর্চি প্রশ্ন করল
— কিন্তু স্যারের প্ল্যান কী ছিল?
— কিছু না, মানে এটা সম্পূর্ণ আমি বানিয়েছি।
— কী বানিয়েছ, তাই বলো না।
— আমার ধারণা স্যার আরিয়ানকে জামাই বানাবার প্ল্যান করে রেখেছিলেন মনেমনে। আরিয়ান তো একেবারে ফেলে দেবার মতো ছেলেও না। স্যারও খুব পছন্দ করেন ওকে। হয়ত সামনে এমনকিছু হবে, মনেমনে ভেবে রেখেছিলেন স্যার। কিন্তু লুবনা পালিয়ে গিয়ে স্যারের প্ল্যান পুরাই পানিতে ফেলে দিল। যে ছেলেটার সাথে পালালো, তার সাথে বিয়ে দিতেও তো স্যার রাজি ছিলেন না। তারমানেই লাফাঙ্গা কেউ হবে। এখন লুবনা ফিরে এসে ভেবেছে আগের মতোই সবকিছু থাকবে। কে জানে কী হয়। স্যারকে যতটুকু দেখেছি আমি, তাতে স্যারকে খুব স্নেহশীল মনে হলেও বেশ কড়াও লাগে।
নিজের রুমে অস্থিরভাবে পায়চারী করতে থাকে কুর্চি।
কী যে একটা ভ্যাজালে পড়ল ও, কিছু ভালো লাগে না!
কিন্তু আরিয়ান কেন ওকে কেক খাওয়াল!!!
(চলবে)