কখনো কুর্চি (পর্ব ৯)
কেকের ওপরে “শুভ জন্মদিন, শিউলি ও মা” লিখতে বলে দিয়ে মলে আনমনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল কুর্চি। আজ মায়ের জন্মদিন। ভাবছে বাসায় ফিরে কেক কাটবে বাবাকে নিয়ে। বাবার তো এসব কখনোই মনে থাকে না। সেজন্য ফোন করে তাকে বেলুন আর কার্ড আনতে বলে দিয়েছে।
শিউলি বয়সের দিক দিয়ে একজন প্রমাণ সাইজের মেয়ের মা হওয়া সত্ত্বেও মনের দিক দিয়ে খানিকটা কাঁচাই রয়ে গেছেন। এসব কেক কাটাকাটি, বেলুন, কার্ড, চকোলেট উপহার পেলে ছেলেমানুষের মতো খুশি হন। সেজন্য কুর্চির ওপরে ভার থাকে যথাসময়ে বাবাকে দিনটি সম্পর্কে মনে করিয়ে দেবার। শিউলি খুব সম্ভব চাতুরীটুকু ঠিকই ধরতে পারেন কিন্তু শুধুশুধু সেটা প্রকাশ করে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারেন না। কেক, বেলুন, কার্ড পেয়ে যথাযোগ্য বিস্ময় প্রকাশ করেন প্রতিবার। তারপর নাসিম সাহেবের চোরচোর মুখ দেখে মওকা বুঝে দামী গিফট আদায় করে নেন যথাসময়ে।
বিমনার মতো মলে ঘুরে বেড়াচ্ছিল কুর্চি। মনে করতে চেষ্টা করল ওর নিজের কিছু জরুরী কেনাকাটা আছে কিনা। কিছুই মনে পড়ল না।
আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করল গত একমাসে ওর মলে ঘুরে বেড়ানো, এমনকি কেনাকাটা করা একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। কিছুদিন আগে মাইনেও তো পেল। কিন্তু কিছু কেনেনি। এই এক কেক ছাড়া। কিছু কিনবে কি?
ভেবে দেখল কিছুই কিনতে ইচ্ছা করছে না। তাহলে মায়ের জন্মদিন উপলক্ষে কিছু কিনবে? প্রথম মাইনে পেলে নাকি বাবা মা’কে কিছু দিতে হয়, উপরন্ত আজ মায়ের তো জন্মদিন।
ভাবতে না ভাবতেই চোখ ঝলসে যাবার উপক্রম হল কুর্চির। কারণ সামনে দিয়ে আপাদমস্তক রূপালি গহনা, সাথে সাদার ওপরে রূপার ঝিরিঝিরি ডিজাইনের ভয়াবহরকমের ঝিকিমিকি শাড়িতে লোকজন পরিবেষ্টিত হয়ে নিরালা আকাশ হেঁটে যাচ্ছে। ওকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল এবং ওকে আশ্চর্য করে দিয়ে শাড়ির সাথে সামঞ্জস্য রেখে ঝকঝকে হাসি হাসল
— কেমন আছ?
নিরালা আকাশ ওকে মনে রেখেছে এ বিস্ময় কাটতেই তো আজ সারারাত যাবে! তাড়াতাড়ি মুখের অবাক ভাব দূর করে কুর্চি হাসল
— ভালো। তুমি?
ও এতোই আশ্চর্য হয়েছে যে গতবার আপনি করে সম্বোধন করেছিল, ভুলেই গেল।
— আমিও ভালো। এই দোকানের উদ্বোধন করতে আইসি। নতুন খুলসে, আমারে খুব ধরসে।
দোকানের দিকে তাকিয়ে আরেক দফা চোখ ঝলসে যাবার উপক্রম হল কুর্চির। সব ঝিকিমিকি টুম্পা শাড়ি ডিসপ্লেতে। নিলারা আকশের পরণের শাড়িটিও দোকান থেকেই আসার সম্ভবনা খুব প্রবল। হয়ত তাদের শাড়ি পরে উদ্বোধন করতে হবে এমন শর্ত ছিল। দোকানের সামনে যারা ভীড় করে রয়েছে, তারাও কিছু কম যাচ্ছে না। সবমিলিয়ে একটা বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা।
এ অবস্থায় কুর্চি কী আর বলবে। বলতে তো পারে না যে এমন দোকান উদ্বোধন না করে আগুন দিয়ে দিলে একটা জনহিতকর কাজ করা হয়! লোকজন ট্রমার হাত থেকে বাঁচে!
মুখে ফেক হাসি এনে বলতে বাধ্য হল
— বাহ! খুব ভালো।
— বাজার করতে আইসো?
— ন…নাহ। আজ আমার মায়ের জন্মদিন, কেকের অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করছিলাম।
— ওহ। মায়ের কথা শুনে কেমন মুষড়ে পড়ল যেন নিরালা আকাশ। চোখ দুটো কি ছলছল করছে নাকি শাড়ির রূপালি ঝিলিক চোখে রিফ্লেক্ট করছে? নাক টানল সে
— আমার মা আমার লগে কথা কয় না। ফোন করলে বোনকে ফোন ধরায় দেয়, হেয় কথা বলে না।
— সে কী! কেন?
নিরালা আকাশের চেহারায় অপরাধবোধের ছাপ পড়ল। আড়চোখে একবার সাথে লোকদের দেখে নিল। ওদের বলল
— তোরা যা। আমি হের সাথে কথা কইয়া আসতাসি। হেরে চিনোস?
কুর্চিকে চেনার ওদের কথাই না। তারা আকাশ পাতাল খুঁজেও চিনতে না পেরে হে হে হাসল
— হ্যাঁ হ্যাঁ। চিনসি তো!
— গুল মারিস না! হের সাথে আমারি হেইদিন পরিচয় হইল, তোরা চিনবি কি? যা তো, মিছা কথা কইস না, দোকানে যা। আমি আইতাসি।
লোকজন পালিয়ে বাঁচল!
নিরালা আকাশ সেধে ওরসাথে কথা বলার জন্য সাথের লোকজনকে ভাগিয়ে দিল! কুর্চি কি অজ্ঞান হয়ে যাবে? কিন্তু নিরালা আকাশ একটু লজ্জালজ্জা মুখ করে বলল
— সব বেডিরেই চিনি। হ্যাগো সামনে কইলে সাথেসাথে মা’র কানে চইল্যা যাইব, তারপরে আনামের কানেও। কিন্তু তোমারে আমি বিশ্বাস করি, তোমারে কওন জায়। তোমার জন্যই তো এত ঘটনা!
নিরালা আকাশকে লুকিয়ে নিজের হাতে চিমটি কাটল কুর্চি। নাহ, জেগে আছে তো। তবে কি ভুলভাল শোনবার রোগে ধরেছে ওকে?
— আ…আমার জন্য?
— হ। ঐদিন ইন্টার্ভিউ এর পর বাসায় ফিরা দেখি মায়ের ফুন। মা আমারে এই মারে তো সেই মারে। হেও সব শুনসে, বলে আমি নাকি তার ইজ্জত ধুলায় মিশাইসি। ঢাকা শহরে এসব চলতে পারে কিন্তু ছোট শহরে চেনা লোকদের সামনে তার মাথা কাটা যাইতাসে, লজ্জায় চোখ তুইল্যা তাকাবার পারতাসে না।
— কিন্তু কেন?
— প্রাক্তন তুই চায়া থাকের জন্য। আমার নাকি এমন খুললাম খুল্লা বই লেখা উচিত হয় নাইক্কা। আনামুলের সাথে আমার প্রেমটা গুপনেই হইতেছিল। এখন বই লিখ্যা, ইন্টার্ভিউ দিয়া আমি নাকি পরিবারের সুনাম নষ্ট করসি। এদিকে আনামুল নাকি শহরে চাউর কইরা দিসে আমার অনেক কয়টা প্রেম আসিলো। তাই হেয় আমারে বিয়া করে নাই। কইসে এমন মাইয়া কেডা বিয়া করব!
আতংকিত হয়ে তাকিয়ে রইল কুর্চি। এর মধ্যে ওর ভূমিকা কী, বুঝতে পারছে না। কিন্তু এত প্যাঁচালো জিনিসে ওর নামটা যদি জড়িয়ে যায় তবে ওরও নিরালা আকাশের মতোই অবস্থা হবে। শিউলিও ওরসাথে কথা বলা বন্ধ করে দেবেন!
শুধু কথা বলা বন্ধ না, এ বয়সে মারধরও খেতে পারে ও।
— তুমি ঠিক কইসিলা। হেরে এত ইম্পট্যান্স দেওনের দরকার আসিলো না। তাছাড়া হের কারণেই তো আজ আমি সাফল্যের মুখ দেকতাসি। যাউজ্ঞা, বই বাইর হই গেসে, কিসু করার নাই। কিন্তু বই বাইর হইবার পর আমারে বহু জায়গা থিকা ইন্টার্ভিউ দিবার লগে ডাক পারসিলো, আমি যাইনাই। নিজের পরিশ্রমে আমি এদ্দুর আইসি, হুদাই হেরে প্রমোট করবার দরকার নাই।
এতক্ষণে খুশির হাসি হাসল কুর্চি
— শুনে খুব খুশি হলাম, নিরালা আকাশ। কিছুদিন যেতে যাও। দেখবে সবাই ভুলে যাবে বইয়ের কথা, মারও রাগ পড়ে যাবে, ঠিকই কথা শুরু করবে।
— হাছা কইতাছ?
আবারো মনে হল নিরালা আকাশের চোখটা যেন ছলছল করে উঠল। চোখে অতিরিক্ত মেকাপ থাকার কারণে কুর্চি ঠিক শিওর হতে পারল না।
— হ্যাঁ। আর যদি রাগ না পড়ে তো সরাসরি বাড়ি চলে যাবে। সামনাসামনি দেখলে উনি রাগ করে থাকতেই পারবেন না।
— এইডা একটা কথার মতো কথা বলসো। যামু আমি বাড়িত। কতক্ষণ রাগ কইরা থাকতে পারে দেখুমনে।
নিরালা আকাশের জন্য জেনুইনলি খুশি লাগছে কুর্চির। ফোনে সময় দেখে নিয়ে বলল
— আমি তাহলে আসি, নিরালা আকাশ। কেক রেডি হয়ে গেছে মনেহয়।
— যাইবা? মা’র লগে কী কিনসো?
— শুধু কেক।
— ছোঃ! তাচ্ছিল্যের শব্দ করল নিরালা আকাশ।— একটা গিপ্ট মিপ্ট দিবা না?
— ভাবছিলাম কিন্তু বুঝতে পারছি না কী দিব। সেদিন প্রথম মাইনেও পেলাম। দেয়া উচিত আমার।
খপ করে ওর হাত ধরে ফেলল নিরালা আকাশ।
— আমার লগে আসো। দোকান উদ্বোধন করি, তারপরে হেগো বলি তোমার লাইগ্যা শাড়ি দেখাইতে। হেরা কাপল সেটও বিক্রি করে।
কুর্চির চোখের ওপরে ভেসে উঠল ঝিলমিলি শাড়ি আর পাঞ্জাবী পরে ওর বাবামা কেক কাটছে! বকুল খালা হাসাহাসি করছে আর ছবি তুলছে, তারপর সেটা আপলোড করছে ফেসবুকে! মান সম্মানের আর কিছুই বাকি থাকবে না এ জিনিস বাড়ি নিয়ে গেলে। আতংকের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেল কুর্চি
— না না, নিরালা আকাশ। আমার মাবাবা একটু সাধাসিধা কাপড় পরে। মনে হচ্ছে না এখানে সেরকম কিছু পাওয়া যাবে।
কানেই নিল না সেকথা নিরালা আকাশ। ওকে টানতে টানতে দোকানের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল
— জানি তো। তোমারে চকরা বকরা জিনিস দিমু ভাবসো? এদের কাছে ভালো জিনিসও আসে। বিক্রি কম হয় বইল্যা সামনে রাখে না। দেইখো, ভালো লাগবেনে তোমার। ভালো ডিসকাউন্ট দিতে কমুনে।
দোয়া দরুদ যা মনে আছে, সব পড়তে পড়তে দোকানে গিয়ে ঢুকল কুর্চি।
(চলবে)