কখনো কুর্চি (পর্ব ৮)
কুর্চি মুখ তুলে তাকালো, তাকিয়েই মেয়েটাকে চিনতে পারল।
এ অফিসের ওয়েটিং এরিয়াতে বড় বড় পোস্টারে আরিয়ান আর ওর হাসিমুখের ছবি দেয়ালে সাঁটা রয়েছে।
আরিয়ান লুবনা জুটির লুবনা!
লুবনা ফিরে আসতে পারে, কুর্চি কখনো ভাবেনি। মানে এমন পরিস্থিতির কথা ও মাথাই আনেনি। ভেবেছে না বলে একদিন সকালে উধাও হয়ে গেছে, নিশ্চয় আর ফিরে আসবে না।
একে একে স্টুডিওর অন্য সবার মুখের দিকে একবার করে চোখ বুলিয়ে নিল কুর্চি।
ওর হাতের ডানদিকে বসা রুবেল, এমনিতে রুবেলের মুখে সবসময় হাসি লেগেই থাকে। এ মুহূর্তে ওর মুখটা হাসি নিয়েই পুরা ফ্রিজ হয়ে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে জোকারের মুখের হাসি।
সামনে বসা আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখল কুর্চি। আরিয়ানের চেহারা প্রথমে সাদা হয়ে গেছিল, তারপর ধীরে ধীরে ওর ফর্সা মুখটা লাল হতে আরম্ভ করল। দেখতে দেখতে টকটকে লাল হয়ে গেল।
কুর্চি বুঝল আরিয়ান প্রচন্ড রেগে গেছে।
আশ্চর্য ব্যপার। এই একমাসে আরিয়ানকে কখনো রাগতে দেখেনি কুর্চি। অথচ এখন রেগে আগুন হয়ে গেছে। রাগের উত্তাপ ও দুইহাত দূরে বসেও টের পাচ্ছে।
ঘরের ভিতরের তাপমাত্রা যেন আচমকা কমে গেল। এক ঠান্ডা শিরশিরে ভাব ভেসে বেড়াতে লাগল ঘরের বাতাস জুড়ে।
সবাইকে চুপ থাকতে দেখে লুবনাও থমকে গেল
— কী ব্যপার? খুশি না মনেহয় আমাকে দেখে তোমরা?
বহুকষ্টে রুবেল নিজের ফ্রিজ হয়ে যাওয়া চেহারা আনফ্রিজ করল। কাষ্ঠ হাসি হেসে প্রশ্ন করল
— কেমন আছ, লুবনা?
— ভালোই।
তাচ্ছিল্যভরে জবাব দিল লুবনা। যেন রুবেলকে ও গোণার মধ্যে ধরছে না। ওর দৃষ্টি এবারে কুর্চির ওপরে লেজারের মতো গিয়ে পড়ল।
— হু আর ইউ?
সৌজন্য হাসি হাসল কুর্চি
— আমি কুর্চি।
সৌজন্যের ধার ধারল না লুবনা। অভব্যের মতো প্রশ্ন করল
— এখানে কী করছ?
থতমত খেয়ে গেল কুর্চি
— ইন্টার্ভিউয়ের প্রিপারেশান নিচ্ছি।
— কেন?
এর আর কী জবাব হতে পারে?
— ইন্টার্ভিউ নিব বলে। আমি আর জে কুর্চি। তোমার প্রোগ্রাম শুনতাম আমি। অনেক বড় ফ্যান। নাইস টু মিট ইউ।
লুবনা সৌজন্যের ধার দিয়ে যাওয়া দূরে থাক, ওর কথাকে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনল না। বলল
— ওয়েল, আমি আর জে লুবনা। আই এম ব্যাক নাউ। নো নিড ফর ইউ।
ওর চোখ এবার গিয়ে পড়ল আরিয়ানের ওপরে
— হাই আরিয়ান। কেমন আছ?
এতক্ষণে মুখ খুলল আরিয়ান। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল
— নিজেকে তুমি কী মনে কর কি, লুবনা? ইচ্ছা হল গায়েব হয়ে যাবে, ইচ্ছা হল ফিরে আসবে?
শ্রাগ করল লুবনা
— গায়েব কই হলাম? বিয়ে করেছিলাম। বাবা বিয়েতে রাজি হচ্ছিল না, ইলোপ করা ছাড়া উপায় ছিল না। এটুকু তো ব্যপার।
— এটুকু ব্যপার? তুমি জানো সেদিন তোমার এটুকু ব্যপার আমাদের কতখানি বিপদে ফেলে দিয়েছিল? নেহাত কুর্চি সেদিন সময়ের আগে এসে পড়েছিল, তাই রিস্ক মাথায় নিয়ে আমরা ওকে তোমার জায়গায় বসিয়েছিলাম।
আবারো শ্রাগ করল লুবনা
— ওয়েল, যা হয়েছে, হয়ে গেছে। আমি ফিরে এসেছি। ওকে আর দরকার নাই।
আরিয়ানের যেন কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে
— ওকে আর দরকার নাই? এত সেলফিশ কেন তুমি? প্রয়োজনে ব্যবহার করব, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে বিদায় করে দিব, এ মটো নিয়ে হয়ত তুমি চলতে পারো, আমি না।
আরিয়ানের রাগ দেখে আপোষের সুর ধরল এবারে লুবনা। সামান্য হেসে বলল
— আহা, বিদায় করবার কথা কে বলছে? ও থাকুক না, অন্যকিছু করুক। ইন্টার্ভিউ তুমি আর আমি যেমন নিচ্ছিলাম, তেমনই নিব।
কঠিনমুখে আরিয়ান জবাব দিল
— এনিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। তুমি রাকীব স্যারের সাথে এনিয়ে আলাপ কোরো। কুর্চি একয়দিনে ভালো কাজ করেছে। আমাদের রেটিং তুমি অনুপস্থিত থাকাতে কোনো হেরফের হয়নি। লিসেনার্সরা ওকে পছন্দ করে। এখন রাকীব স্যার যা বলবেন, আমি মেনে নেব। তবে আগে তুমি তার সাথে কথা বলে দেখো।
এবারে লুবনারও মুখটা লাল লাল দেখালো।
— ঠিক আছে। বলছি কথা তোমার রাকীব স্যারের সাথে।
মোজাইক করা মেঝেতে হাই হিলের খটাখট শব্দ তুলে লুবনা এগিয়ে গেল তার রুমের দিকে।
লুবনা চলে যেতে স্টুডিওর তাপমাত্রা আরো কয় ডিগ্রী নেমে গেল যেন। সবাই চুপ করে রইল, কেউ কোনো কথা বলল না।
কুর্চি হাতের কাগজপত্র অযথা নাড়াচাড়া করতে থাকল।
মিনিট পাঁচেক পর সিঁথি দরজা খুলে জানালো যে রাফি এসে পড়েছে। এখন রিসেপশানে অপেক্ষা করছে। আরিয়ান উঠে দাঁড়াল
— এসো কুর্চি, আমরা গিয়ে রাফিকে নিয়ে আসি। প্রোগ্রাম শুরু করতে হবে।
দ্বিধা নিয়ে উঠে দাঁড়াল কুর্চি। রুবল উঠে গিয়ে কাচের ওদিকের বুথটায় চলে গেল।
ওয়েটিং এরিয়ায় এসে দেখল আরিয়ান নিজেকে স্বাভাবিক করে ফেলেছে ইতোমধ্যে। রাফির সাথে হাত মিলিয়ে সৌজন্য আলাপ করছে হাসিমুখে। কুর্চি এগিয়ে যেতেই রাফি হাসিমুখে বলল
— হাই কুর্চি। কেমন আছ?
— ভালো আছি। তুমি ভালো আছ?
— পার্ফেক্ট। আজকের ইন্টার্ভিউএর জন্য একদম তৈরী।
— আমরাও তৈরী। আশা করছি আজকে দারুণ এক ইন্টার্ভিউ নিতে পারব।
— গ্রেট।
— চলো রেকর্ডিং স্টুডিওতে যাই। হাতে সময় বেশি নাই।
আরিয়ান সবাইকে ইঙ্গিত করল স্টুডিওর দিকে রওনা দিতে।
ঝটপট ইন্টার্ভিউ শুরু করে দিল আরিয়ান। কুর্চি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করল যে এই একমাসেই ও আরিয়ানকে খুব ভালো চিনে গেছে। আরিয়ান ইন্টার্ভিউ শুরু করেছে ঠিকই কিন্তু ওরমধ্যে একটা খুব সুক্ষন কাঠিণ্য চলে এসেছে। এসির মধ্যে বসেও ওর কপালে ঘামের আভাস চিত্তচাঞ্চল্যের সাক্ষ্য দিচ্ছে। বুঝে নিয়ে ওর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে নিজেই কথা আরম্ভ করল রাফির সাথে। রাফিও আগ্রহভরে উত্তর দিতে শুরু করতে বেশ সাবলীলভাবেই ইন্টার্ভিউ এগিয়ে যেতে লাগল। একসময়ে জমে উঠল দুজনের কথোপকথন। ওরকাছ থেকে স্কুপ পেতে ওকে ঘিরে এক নামকরা অভিনেত্রীর সাথে প্রেমের গুঞ্জনের ব্যপারে খেলাচ্ছলে প্রশ্ন করল কুর্চি। রাফির চোখ প্রথমে বড়োবড়ো হয়ে গেল, ঠোঁটে অভ্যাসমতো প্রতিবাদের জবাব তৈরি ছিল। কিন্তু কী ভেবে দুষ্টু হাসি ফুটে উঠল ওর মুখে।
— সত্যি জানতে চাও?
— অবশ্যই। তবে সত্যিটাই জানাতে হবে কিন্তু। আমাদের লিসেনার্সরা সেটাই ডিজার্ভ করে।
— অবশ্যই সত্যিটা বলব।
— তাহলে জানাও প্লিজ লীরার সাথে তোমার সম্পর্কটা কি শুধুই বন্ধুত্ব নাকি বন্ধুত্ব ছাড়িয়ে অন্যকিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। কিছুদিন আগে তোমাদের দুজনকে এক অভিজাত রেস্তোরায় অন্তরঙ্গভাবে ডিনার খেতে দেখা গেছে। এরপিছে আমরা কি অন্যকিছু ধরে নেব?
কথার ফাঁকে ফাঁকে আরিয়ানের ওপরে নজর রাখছিল কুর্চি। প্রশ্নের ধরণ শুনে আরিয়ান ঠোঁটে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে রাখলেও ও স্পষ্ট বুঝতে পারছে যে আরিয়ান অন্যমনস্ক হয়ে রয়েছে। ওর মনোযোগ ইন্টার্ভিউএর মধ্যে একেবারে নাই। হুট করে ওকে প্রশ্নের ভার দিলে ও খেই হারিয়ে ফেলবে।
কুর্চি মনেমনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। আজকের ইন্টার্ভিউ ভালো হতেই হবে। ও একাই চালিয়ে নেবে। রাফি খুব ভালো মুডে আছে। সব প্রশ্নের উত্তর দেবার মুডে আছে। এ ইন্টার্ভিউ অলরেডি জমে গেছে, এভাবে যদি ও চালিয়ে নিয়ে যায়, তবে আজকে ওরা চমৎকার রেটিং পাবে। ওদের পেতেই হবে। এর পিছে ও কম খাটুনি তো দেয়নি।
চেহারা হাসিহাসি করে নতুন প্রসঙ্গ টেনে আনল কুর্চি
— তারপরে রাফি, আগামীতে তোমার কী প্ল্যান আমরা জানতে কিন্তু খুবি আগ্রহী।
ইন্টার্ভিউ শেষ হয়ে গেল। ওরা দুজনেই উঠে রাফিকে মেইন দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেল। বিদায় নেবার সময় রাফি যেকোনো সময় যোগাযোগ করতে বলে ওদের অবাক করে দিল। এ তো অভাবনীয়। তারমানে সামনে আবার রাফি আসতে আগ্রহী। রাফিকে আনা মানেই ওদের ভালো পাবলিসিটি।
স্টুডিওতে ফিরে এসে টেবিলে বসলে রুবেলও ওদের সাথে জয়েন করল।
— একসেলেন্ট ওয়ার্ক, কুর্চি। ওয়েল ডান।
আরিয়ানের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত প্রশংসা পেয়ে কুর্চির মনে হল একরাশ বুদবুদের প্রজাপতি যেন ওর পেটে ওড়াওড়ি করছে। খুশিতে আটখানা হয়ে বলল
— থ্যাঙ্কস।
— আজকের ইন্টার্ভিউটা আমাদেরকে অনেকখানি এগিয়ে দিল, কুর্চি। তোমাদের দুজনের কথোপকথনও খুব সাবলীল ছিল, লিসেনার্সরা খুব এঞ্জয় করেছে, ওদের লাইভ প্রশ্ন শুনেই বোঝা গেছে।
রুবেল ফোন ঘাটতে ঘাটতে বলল
— আজকে সবচাইতে বেশি কমেন্ট এসেছে। আমি অর্ধেকই এখনো পড়তে পারিনি।
— মিলনকে বোলো সব কমেন্টের যেন উত্তর দেয়।
— অলরেডি বলে দিয়েছি।
— গুড, ভেরি গুড।
এই প্রথম আরিয়ানের ঠোঁটে সত্যিকারের হাসি দেখা দিল। কুর্চি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। ওদের কাজের পরিবেশ, পরস্পরের সাথে কাজ করার ধরণ একদম রিলাক্সড ও বন্ধুত্বপূর্ণ। কেউ কারো ওপরে মাতব্বরি ফলায় না, সবাই নিজের নিজের কাজ প্রয়োজনের অতিরিক্ত করে। সেখানে আজ আরিয়ানকে আড়ষ্ট দেখে ও খুব দমে গেছে।
সিঁথি দরজায় মাথা গলিয়ে জানালো
— আরিয়ান, তোমাকে রাকীব স্যার দেখা করতে বলেছেন।
সাথেসাথে আরিয়ানের মুখভাব পালটে গেল। চেহারায় তিক্ততা ফুটে উঠল। চোখ লাল করে সিঁথির দিকে তাকাল
— আমাকে?
— হ্যাঁ, তোমাকেই। আমাকে খুন করে লাভ নাই, আরিয়ান। আমি স্রেফ খবরটা দিতে এলাম।
অন্যসময় হলে এ জোকে আরিয়ান হাসত, পাল্টা জোক করত। আজ গুম হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল। তারপর ঝট করে উঠে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল।
আরিয়ান উঠে যেতে রুবেল ও কুর্চি পরস্পরের দিকে তাকাল। অপ্রস্তুতভাব ঢাকতে রুবেল চিৎকার করে উঠল
— মিলন! মিলন!
দুই তিনবার চিৎকার করবার পর মিলন ছুটতে ছুটতে এল
— রুবেল ভাই, ডাকছ আমাকে?
— হ্যাঁ, আজকে যত কমেন্ট আসবে, সবগুলির উত্তর দিতে হবে কিন্তু।
বিস্ময় ফুটে উঠল মিলনের চোখে।
— একবার তো বললে। তোমার মেসেজ পেয়েছি আমি।
উঠে দাঁড়াল রুবেল।
— কয়টা স্পেশাল কমেন্ট আছে। এগুলি সাবধানে হ্যান্ডেল করতে হবে। এসো আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।
রুবেল কাচের পার্টিশানের ওপারে নিজের জায়গায় চলে গেল। কুর্চি চুপ করে বসে রইল। সাধারণত এসময়টা ও আর আরিয়ান, রুবেলের সাথে পরের গেস্ট কাকে নির্বাচন করা যায়, সেনিয়ে আলাপ করে। আজকেও মিটিং হবে কিনা বুঝতে পারছে না।
সজোরে দরজা খুলে গেল। আরিয়ান স্টুডিওতে ঢুকেই কোনো কথা না বলে নিজের ব্যাকপ্যাকটা তুলে নিয়ে আবার দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল। কাচের পাল্লা দিয়ে কুর্চি ওকে মেইন ডোর দিয়ে বের হয়ে যেতে দেখল। আরিয়ানের চেহারা আবারও টকটকে লাল হয়ে ছিল। কুর্চি বুঝে নিল রাকীব স্যারের রুমে যা বলাবলি হয়েছে, তার কিছু আরিয়ানের পছন্দ হয়নি।
রুবেল ব্যাকপ্যাক হাতে স্টুডিওতে ঢুকে বলল
— চলো, বের হই।
কুর্চি কিছু একটা ভাবছিল। চমকে বলল
— কোথায়।
— দেখা যাক কোথায় যাওয়া যায়। আপাতত বের হই তো। আজ কারো কাজ করার মুড নাই। আরিয়ান তো চলে গেল। আমরাই বা বসে থেকে কী করব।
— সত্যি সত্যি চলে যাব?
— সত্যি না তো কি? মিলন ওদিকেই ছিল। বলল রাকীব স্যারের রুম থেকে চিল্লাচিল্লির আওয়াজ পেয়েছে। তারমানে লুবনা মহা গণ্ডগোল বাঁধিয়েছে স্যারের রুমে গিয়ে। ফলাফলে স্যার কিছু বলেছে যা আরিয়ানের পছন্দ হয়নি। দেখলে আরিয়ানের চেহারা কেমন হয়েছিল?
কুর্চী বলবার মতো কিছু খুঁজে পেল না। উঠে পড়ল।
বাইরে বেরোতেই কড়া রোদে চোখ ঝলসে যাবার মতো অবস্থা।
— চা চাই আমার।
— এই কড়া রোদে চা খাবে?
— হুম। কড়া রোদেই চা খেতে হয়। সাথে সদ্য কড়াই থেকে তেল ছেঁকে তোলা শিঙাড়া। চলো আজ তোমাকে ঢাকা শহরের বেস্ট শিঙাড়া খাওয়াই। নাক শিটকাতে পারবে না কিন্তু।
— নাক শিটকাবো কেন?
— তোমার স্ট্যান্ডার্ডের দোকান না, তাই।
হাসতে বাধ্য হল কুর্চি।
— আমার স্ট্যান্ডার্ড বলে আলাদা কিছু আছে নাকি? আমি যেকোনো জায়গা থেকে খেতে পারি। গরমাগরম চুলা থেকে নামলে অসুবিধা কি? তবে হ্যাঁ, কাপ পিরিচ নোংরা হলে অসুবিধা হয়। তেমন হলে নাহয় আরেকবার ধুয়ে দিতে বোলো।
— নোংরা না। খালাম্মা নিজেই খুব পরিষ্কার। তার দোকান ঝকঝক করে। শুধু পশ না।
— তাহলে তো কথাই নাই। খাব আমি ঢাকার বেস্ট শিঙাড়া। প্লিজ।
রুবেল দোকানের নিয়মিত খরিদ্দার বোঝা গেল। দোকানের সামনে যে মাঝবয়সী মহিলা শিঙাড়া ভাজছিলেন, ওকে দেখে বহুপরিচিতের মতো হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন
— খবর সব ভালো?
— ভালো, খালাম্মা। আমার সহকর্মীকে নিয়ে এলাম ওকে ঢাকা শহরের বেস্ট শিঙাড়া খাওয়াব বলে। কড়া করে দুই কাপ চা আর চারটে শিঙাড়া পাঠিয়ে দেন লতিফের হাত দিয়ে।
— আচ্ছা।
খুব সাধারণ দোকান। কাঠের চেয়ার টেবিল। বসতে না বসতেই চা শিঙাড়া চলে এলো। আগুন গরম শিঙাড়ায় এক কামড় বসালো কুর্চী
— চমৎকার। সত্যি বেস্ট। বাসার জন্য নিয়ে যাব আমি।
— বললাম না ঢাকার বেস্ট শিঙাড়া? খালাম্মার হাতে জাদু আছে।
কিছুক্ষণ নীরবে দুজন খেতে থাকে। সকালের ঘটনায় কুর্চির মন এখনো ভারী হয়ে আছে। কিন্তু লুবনার কাছ থেকে এমন আচরণও মেনে নেয়া যায় না। কাউকে না বলে উধাও হয়ে যাওয়া চরম আনপ্রফেশনাল কাজ। ওর চাকরিই থাকবার কথা না। সেখানে উল্টে সেই বলছে ওকে সরিয়ে দিতে। আশ্চর্য! লুবনাকে ও চেনে না, শুধু ওর প্রোগ্রাম শুনেছে কিন্তু এমন ব্যবহার আশা করেনি।
রুবেল ওকে লক্ষ করছিল। এখন বলল
— মন খারাপ কোরো না, কুর্চি। এমনটা হয়ে থাকে। আরিয়ানেরও হাত বাধা। ও কিছুই করতে পারবে না।
অবাক হয়ে তাকাল কুর্চি
— বুঝলাম না আমি, রুবেল। কিসের কথা বলছ?
— সকালের কথা বলছি। লুবনা ফিরে এসেছে, এখন ও নিজের জায়গায় ফিরে যেতে চাইবেই। ইচ্ছা থাকলেও আরিয়ান কিছু করতে পারবে না।
কেমন বিদ্রোহী হয়ে উঠল কুর্চির মন। একমাস ধরে ও জানপ্রাণ দিয়ে খেটেছে। সেসবের কি কোনোই মূল্য নাই? আরিয়ান কি অন্ধ? বলেও ফেলল সেকথা
— আর আমি যে একমাস ধরে জান দিয়ে খাটলাম, প্রথমদিন এসেই অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও অন এয়ারে গেলাম, সেগুলি কিছু না? বুঝলাম লুবনা পরিচিত মুখ কিন্তু আমিও একমাসে কি একটা ভালো রেপুটেশান গড়ে তুলিনি? ইচ্ছা হল আর বিদায় করে দিল, এ কেমন ব্যপার?
চোখ সরু করে ওরদিকে খানিক তাকিয়ে রইল রুবেল।
— তুমি মনেহয় পুরা ব্যাপারটা জানো না।
— কী জানি না?
ঝাঁঝিয়ে উঠল কুর্চি। ওর সত্যি খুব রাগ ধরছে।
— সিঁথি তোমাকে বলেনি? দুজনে এত কথা বলো, একথা সিঁথি তোমাকে জানায়নি?
— উফ কী কথা সেটা বলবে তো?
চিন্তিতমুখে শিঙাড়ায় এক কামড় বসালো রুবেল, ধীরে ধীরে চিবুতে লাগল। এদিকে দমবন্ধ করে কুর্চী বসে রয়েছে। অবশেষে রুবেল জানালো
— লুবনা যে রাকীব স্যারের মেয়ে, একথা জানো না? এ স্টুডিও তো স্যার লুবনার কথাতেই বানিয়ে দিয়েছেন।
বাস! মুখভর্তি শিঙাড়া ক্যোঁৎ করে গিলে ফেলল কুর্চী। পেটে গিয়ে সেটা জগদ্দল পাথর হয়ে বসে রইল।
এতক্ষণ ধরে যে শিঙাড়া খুব মজা করে খাচ্ছিল সে শিঙাড়াই এখন বিষের মতো লাগছে।
কুর্চী বুঝল ওর এত সাধের চাকরিটা এখন খুব নাজুক সূতায় ঝুলে রয়েছে।
(চলবে)