কখনো কুর্চি পর্ব-০৭

0
7

কখনো কুর্চি (পর্ব ৭)

মাসখানেক পরের কথা। কুর্চি ওর চাকরিটা প্রচন্ড উপভোগ করছে। সারা সপ্তাহ ক্লাস করে শুক্র শনিবারে অফিসে চলে আসে। অবশ্য সপ্তাহের মাঝখানে কয়েকবার আরিয়ানের সাথে যোগাযোগ তো হয়ই। পরেরবার কোন অতিথি আসবে, কে এলে তাদের রেপুটেশান ভালো হয় সে নিয়ে আলোচনা হয়, কেমন প্রশ্ন করা যায় সেনিয়েও কথা হয়। অনেকসময় ব্যাকগ্রাউন্ড ইনফো জোগাড়ের দায়িত্ব ওর ওপরেই চাপিয়ে দেয় আরিয়ান। কুর্চির তাতে আপত্তি দূরে থাক, সানন্দে অতিরিক্ত কাজটুকু করে দেয়। এতে ধীরে ধীরে ওর অভিজ্ঞতা বাড়ছে, আত্মবিশ্বাসের সাথে ইন্টার্ভিউ নিতে পারছে।
ওর ধারণা এ পর্যন্ত ওর কাজ নিয়ে আরিয়ান মোটামুটি খুশিই। সময়ে কাজ ডেলিভারি দেয়, কখনো কাজে দেরী করে আসে না, অন্যান্যদের সাথেও সহযোগীতাপূর্ণ মনোভাব বজায় রাখে। কাজেই সন্তস্ট হবারই কথা আরিয়ানের।

যদিও আরিয়ানের মুখ দেখে কিছু বোঝা যায় না। প্রথমদিন যেমন সহজ স্বাভাবিক আচরণ করেছিল ওরসাথে, এখনো তাই। এরচাইতে এক কদম এগোয়নি, পিছায়ওনি। এতে কুর্চি মনে করেছে সে স্বভাবের দিক দিয়ে খানিকটা রিজার্ভড, পোলাইট কিন্তু বসসুলভ দূরত্ব বজায় রাখতে চায়। এমনকি কাজ নিয়েও যখন গভীর রাত পর্যন্ত চ্যাট করে, তখনও কাজের বাইরে কোনো ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে না, অপ্রাসঙ্গিক আলাপ করে না, গল্পগুজব তো দূরের কথা।
কুর্চিও এজন্য আরিয়ানের সাথে সহজ সম্পর্ক রাখলেও অতিরিক্ত কথাবার্তা একেবারেই বলে না। এই একমাসে আরিয়ানের চাইতে ও রুবেল, মিলন বা রিসেপশনিস্ট সিঁথির সাথে বেশি ঘনিষ্ঠ হয়েছে। দিব্যি কাজের ফাঁকে ফাঁকে দেদারসে গল্প চলে ওদের মধ্যে।

দ্বিতীয় দিন যখন কাজে গেছিল তখন আরিয়ান ওকে নিয়ে অফিসের এম ডি রাকীব সাহেবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। রাকীব সাহেব এ অফিসের মালিক। আরো অনেক বিজনেস রয়েছে তার। তবে এ অফিসটাতে তিনি বসেন। যারজন্য সবসময় অফিসটা গমগম করতে থাকে, অনেক লোক তারসাথে দেখা করতে আসে। রিসেপশনিস্টও রাখা হয়েছে সেজন্য। নাহলে ড্রিমজ রেডিওর বয়স বেশিদিন না। স্টুডিও এখানে বসাতে কর্মচারিরা সব তরুণ বয়সের। রিসেপশনিস্ট সিঁথি ওরই বয়সী, হাসিখুশি চটপটে একটা মেয়ে। পড়ছে , আবার চাকরিও করছে। রুবেলই ওকে এনেছে, বলল সিঁথি। রুবেল ওর ডিপার্মেন্টের ছেলে, তবে সিনিয়ার। এমনকি আরিয়ানও সবে পাশ করে বের হল। অফিসের সবচাইতে কমবয়সী ছেলে হচ্ছে মিলন। কেবল এইচ এস সি দিয়ে ইউনিতে ঢুকেছে।

সিঁথির কাছে শুনল এদের মধ্যে লুবনা আরিয়ানের ইউনিভার্সিটির ফ্রেন্ড। সেই আরিয়ানকে এনেছিল। কাজকর্মও সেই বেশি করত কারণ তার চেনাজানা বেশি ছিল। গেস্টদের নির্বাচন, তাদের সাথে কথাবার্তা সেরে নেয়া, তাদের দেখভাল করা, এগুলি লুবনা খুব ভালো পারত। আরিয়ান মূলত ব্যাকগ্রাউন্ড ওয়ার্ক বেশি করত। তবে ইন্টার্ভিউএর সময় আরিয়ানই মূখ্য ভূমিকা নিত। লিসেনার্সরা আরিয়ান আর লুবনার কেমিস্ট্রিটা দারুণ এঞ্জয় করত। ওদের দুষ্টুমি, খুনসুটি লুফে নিত, তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করত। ওদের কান্ড দেখে গেস্টও চট করে সহজ হয়ে যেত, যারফলে ইন্টার্ভিউ উপভোগ্য হত। অল্প সময়ের মধ্যে ড্রিমজ রেডিও তরুণদের মধ্যে বেশ ভালোই সাড়া ফেলে দিয়েছে। তারমধ্যেই তো ঘটল এ ঘটনা। এক সকালে লুবনা উধায়। আগের রাত্রি সে কাউকে কিছু না বলে ইলোপ করেছে! সিঁথির ধারণা ঝোঁকের মাথায় কাজটা করেছে সে।
তারপরে তো কুর্চি এসে পড়ল। হয়ত ওকে কফি আনানেয়ার কাজ বা ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করার কাজ দিত কিন্তু লুবনা ইলোপ করায় কুর্চি অভাবনীয় একটা সুযোগ পেয়ে গেল। সরাসরি ইন্টার্ভিউ নিতে শুরু করে দিল।

সত্যি বলতে কী, কাজটা ও যে খুব খারাপ করছে, তা মনে হচ্ছে না। প্রত্যেক ইন্টার্ভিউ এর শেষে রুবেলের মুখের হাসি দেখেই আন্দাজ করা যায়। মিলন তো ওকে প্রশংসা করতে করতে অস্থির। শুধু আরিয়ান তেমন কিছু বলে না। স্মিত হেসে সংক্ষিপ্তভাবে জানায়
— গুড ওয়ার্ক।
তাতেই কুর্চি যেন ফুলে ফেঁপে বাতাসে ভাসে সারাদিন। ওর সমস্ত মনোযোগ থাকে আরিয়ানের প্রশংসায়। আরিয়ান কেমন করে ইন্টার্ভিউ নেয়, ওর শব্দচয়ন, ওর স্টাইল সবকিছু কুর্চি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করে। আর মনের গোপনে আশা পোষণ করে একদিন সেও আরিয়ানের মতো সহজ সাবলীলভাবে হেসেখেলে ইন্টার্ভিউ নিতে পারবে।

রাকীব স্যারও ওকে ওয়েলকাম জানিয়েছিলেন। আরিয়ান ওকে সাথে নিয়ে যখন স্যারের রুমে ঢুকল, স্যার তখন গম্ভীরমুখে একটা ফাইল পড়ছিলেন। আরিয়ান পরিচয় করিয়ে দিল
— স্যার, এ হচ্ছে কুর্চি। রেডিওতে নতুন জয়েন করেছে।
ফাইল থেকে মুখ তুলে চশমার ওপর দিয়ে একবার তাকালেন ওরদিকে। ভারী গলায় বললেন
— বসো।
দুজনে বসল।
— আজ থেকে জয়েন করেছ?
কুর্চি উত্তর দেবার আগে আরিয়ানই বলল
— গতকাল থেকেই শুরু করেছে, স্যার। যদিও গতকাল ওর ইন্টার্ভিউ ছিল কিন্তু ও আসামাত্র ইন্টার্ভিউ বাদ দিয়ে সরাসরি ব্রডকাস্টিং এ বসিয়ে দেয়া হয়েছিল।
সাথেসাথে মুখভাব গম্ভীর হয়ে গেল রাকীব স্যারের। কুর্চি ঠিক বুঝল না, শংকিত হয়ে পড়ল। ইন্টার্ভিউ নেয়নি বলে কি রাকীব স্যার রাগ করছেন? কিন্তু সে তো গতকাল বলতে গেলে ওদের বিরাট উপকার করেছে।
আরিয়ানের পরের কথাতেও তার প্রতিফলন পাওয়া গেল।
— একচুয়ালি স্যার, ও আসাতে আমরা বিরাট বাঁচা বেঁচে গেছিলাম। ও আসবার পরপরই গেস্ট এসে পড়েছিল। কুর্চিকে বিনা ট্রেনিং এ ইন্টার্ভিউ নিতে হয়েছিল, তারপরে একবার শুরু করতে আমার মাইক খারাপ হয়ে গেল। খুব বিপদে পড়েছিলাম বলা চলে। ও সবকিছু সুন্দরভাবে সামলে নিয়ে ইন্টার্ভিউ নিল এবং ভালোভাবে নিল।

কুর্চির দিকে তাকালেন রাকীব সাহেব
— শুনে খুশি হলাম। আগামীতেও এমন ভালো কাজ করবে আশা করি।
প্রশংসা করলেও কুর্চির মনে হল রাকীব স্যারের মুখে কে যেন একদলা কালি ঢেলে দিয়েছে। যেন এ খবরে তিনি খুশি না। কিন্তু খুশি না হবার কারণ কী হতে পারে? নাকি উনি এরকমই, খুশির খবরেও মুখ কালো করে ঘুরে বেড়ান? কে জানে বাবা!
কিছুটা কনফিউশান নিয়েই রাকীব স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে এল কুর্চি। আরিয়ানও বেশ গম্ভীর। সেজন্য ওকেও কিছু জিজ্ঞেস করতে দ্বিধাবোধ করল কুর্চি।
আরিয়ান এরপরে ওকে মিলনের সাথে ভিড়িয়ে দিল। মিলন ওকে পুরা অফিস ঘুরিয়ে দেখাল, কোথায় কী আছে, কীভাবে কী কাজ করে, সেনিয়ে নিরন্তর কথা বলল। ফাঁকে ফাঁকে অফিসের সাথে কোনো সম্পর্ক নাই, এমন বিষয়েও প্রচুর কথা বলা বাদ দিল না। এত কথার মাঝে কুর্চি কিছুক্ষণ পরে ব্যপারটা ভুলেই গেল।

আজ ও কাজে এসেছে ফুরফুরে মন নিয়ে। কারণ আজ এক অসম্ভব ঘটনা ঘটেছে। মা ওর চুল, ওর জামাকাপড়, বেসিকালি ওরমধ্যে কোনো খুঁত খুঁজে তো পায়ইনি, উপরন্ত ওকে প্রশংসা করেছে। বলেছে কুর্চি সুন্দরভাবে জব, পড়াশোনা সামলে নিচ্ছে। বলতে গেলে বাতাসে ভেসেই কুর্চি অফিসে পৌঁছে গেছে।
আজকে ইন্টার্ভিউ আছে গুরুত্বপূর্ণ একজন গায়কের সাথে। সেজন্য একটু আগে আগেই পৌঁছেছে ও। আরিয়ানের সাথে বসে লাস্ট মোমেন্টে কিছু জিনিস ঝালিয়ে নিতে হবে। এতটুকু এদিক ওদিক হতে পারবে না আজ। গায়ক রাফি তরুণদের হার্টথ্রব, এজন্য আজ ওদের লিসেনার্সদের সংখ্যা নর্মালের চাইতে বেশি হবে আশা করছে সবাই। রাফিকে কমফর্টেবল ফিল করাতে হবে, ইন্টার্ভিউতে সে যেন গতানুগতিক কথার বাইরে স্কুপজাতীয় কিছু বলে, সেজন্য সাবধানে এগোতে হবে। সামনে রাফি যেন তাদেরকে আবার সময় দেয়, সে ব্যাপারেও কনফার্ম করতে হবে।

সবটুকুই নির্ভর করছে নিখুঁত প্ল্যানিং এর ওপরে। আর সেজন্যই আজ সাবধানে এগোতে হবে।
তবে দিনটা যেভাবে শুরু হয়েছিল, সেভাবে শেষ হল না। আরিয়ান আর ওর মিটিং এর মাঝেই এক মেয়ে ঝড়ের বেগে ওদের রেকর্ডিং রুমের দরজা খুলে বলল
— হাই গাইজ, আই এম ব্যাক!
(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে