কখনো কুর্চি (পর্ব ৬)
পৃথিবীতে অনেক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। কাকতালীয় ঘটনাও ঘটে। তারমধ্যে একটি হচ্ছে কুর্চির আরিয়ানের অফিসে চাকরির ইন্টার্ভিউ দিতে আসাটা।
কারণ আরিয়ান হচ্ছে সেই ছেলে যার মা আদিবা চাঁদনি চকে বাজার করতে গিয়ে কুর্চিকে এক দেখাতেই পছন্দ করে ফেলেছিলেন ও ছেলের বৌ বানাতে হন্যে হয়ে গেছেন।
তবে কুর্চির রূপ দেখে মোহিত হবার চাইতে মায়ের সাথে কুর্চির কথোপকথন শুনে তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে এমন বৌ তার চাই। কারণ নিজের ছেলের সাথেও তার এমনই মজার সম্পর্ক। কুর্চিকে যেমন মায়ের পিছে সারাক্ষণ লেগে থাকতে দেখলেন, আরিয়ানও তেমনি সবসময় তার পিছে লেগে থাকে। এমন এমন কথা বলে যে পেট ফেটে হাসি আসে। কে বলবে দুজনে মা ছেলে।
একটা উদাহরণ দেয়া যায়।
এক ছুটির দিনের সকালে নাস্তার টেবিলে তারা তিনজন নাস্তা খেতে খেতে গল্প করছিলেন, আদিবা হঠাত বলে উঠলেন
— ইশ, কতদিন ইলিশ পোলাও খাই না।
আরিয়ান একটু অবাকই হল। মা ইলিশের ভক্ত জানত না। কাঁটার ভয়ে এড়িয়ে চলে দেখে এসেছে।
— তুমি তো ইলিশ তেমন খাও না।
— খাই না তবে…
— তবে কী?
— সকালে পরাটা ভাজতে গিয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠল এক থালা গরম ধোঁয়া ওঠা ইলিশ পোলাওয়ের দৃশ্য। মা রান্না করত। আমরা ভাই বোনেরা সার দিয়ে বসে খেতাম দাদাবাড়িতে। মার বিখ্যাত রেসিপি।
— বাপ রে, মা! তুমি দেখি সেই লেভেলে পৌঁছে গেছ। আজকাল পরাটার মধ্যেও নির্বাক ছায়াছবি দেখছ। তোমার পা বাড়িয়ে দাও দেখি। সালাম করি!
— মারব থাপ্পড়।
আদিবা হেসে ফেলেছিলেন ছেলের দুষ্টুমিতে। কথাটা সেখানেই শেষ হয়ে গেছিল। আদিবার স্বামী ইমরান সাহেব খুব কম কথার মানুষ। তিনি নীরবে খেয়ে উঠে গেলেন।
কিন্তু দুপুর বারোটার দিকে বেশ বড় সাইজের ইলিশ বাসায় চলে এল। আদিবার চোখ কপালে উঠে গেল।
— এই ইলিশ তুমি কিনলে?
— কিনলাম।
ইমরান সাহেব অযথা কথা খরচ করবার মধ্যে নাই। খুব সম্ভব ইলিশ কিনেই তার রিসোর্স ফুরিয়ে গেছে।
— কেন কিনলে?
— তুমি ইলিশ পোলাও খেতে চেয়েছিলে!
পুরাই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন আদিবা। সম্বিত ফিরতে ছুট লাগালেন রান্নাঘরের দিকে। তাজা ইলিশ, আজকেই রান্না করতে হবে।
ব্যপার দেখে আরিয়ান হেসে বাঁচে না। এক ফাঁকে মা’কে খোঁচাতে এল।
— ভদ্রলোককে এতখানি খাটাতে তোমার লজ্জা করল না? ছুটির দিনে কোথায় আরাম করবে, তা না বৌয়ের জন্য আকাশ বাতাস এক করে ইলিশ কিনতে দৌড় দিল। ছিঃ! কেমন বৌ তুমি?
— আমি বলেছি তাকে কিনতে?
— মুখে না বললেও ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছ। ভদ্রলোক মোহাব্বতে পড়ে কিনে এনেছে।
চোখ পাকাল তাতে আদিবা।
— তা আমার বর আমাকে মোহাব্বাত করে, তোর এত জ্বলে কেন রে?
— বাহ! আমার জ্বলবে কেন? মোহাব্বাত ভালো জিনিস। একটাই মুশকিল, অনেক টাকা খরচ করায়। এনার্জিও!
— নিজের বৌয়ের জন্য টাকা এনার্জি খরচ করা কি খারাপ?
— আহা, তুমি শুরু থেকেই এমন ডিফেন্সিভ হচ্ছ কেন? আমি বলেছি খারাপ?
— না বললেও তোর গলার টোন তাই বলছে!
— গলার টোনের কথা বাদ দাও, মা। রেডিওতে চাকরি করি তো। গলার টোনে নানান ভ্যারিয়েশান আনতে হয়!
নীরবে কিছুক্ষণ হাড়ির পোলাও নাড়লেন আদিবা। তারপরে হাসতে হাসতে বললেন
— মুরোদ থাকে তো বিয়ে করে নিজের বৌকে যতখুশি মোহাব্বাত দেখা না! কে মানা করছে!
— মুরোদ নাই আপাতত। অল্প কয়টা টাকাই ভরসা। ইলিশ কিনতে হলে এখন আমাকে থালা নিয়ে রাস্তায় বসতে হবে।
— আহা। এখন নাই, পরে হবে। আগে থেকেই নেগেটিভ মন কেন? তোর বাবার এমন নেগেটিভ ভাবনা হলে বিয়ের সাহস করতে পারত? তার অবস্থাও তো তখন থালা হাতেই ছিল।
হাসাহাসি করলেও বিয়ের কথাটা তখনি মাথায় গেঁথে গেছিল আদিবার। আরিয়ানের বিয়ে দেবেন তিনি। টুকটুকে বৌ আসবে ঘরে, সারাদিন হাহাহিহি চলবে। সেজন্য হাসিখুশি মেয়ে চাই যে আরিয়ানের জোকগুলি বুঝবে। আর এজন্যই কুর্চিকে প্রথম দেখাতেই পছন্দ করে ফেলেছিলেন।
সেদিন চাঁদনি চক থেকে বাড়ি ফিরেই আরিয়ানকে পাকড়াও করলেন তিনি।
— এই মেয়েটাকে দেখ।
আরিয়ান দেখল।
— কার ছবি এটা? কোথায় জায়গাটা?
— চাঁদনি চকে গেছিলাম, সেখানে মেয়েটাকে দেখলাম। ভালো লাগল। তোকে দেখাতে ছবি তুলে নিয়ে এলাম!
চক্ষু চড়ক গাছ হবার দশা আরিয়ানের।
— মা তুমি বাজারে গিয়ে র্যা নডম মেয়ের ছবি তুলে বেড়াচ্ছ? কোনদিন তোমাকে পুলিশে ধরবে। নাহ, আজ থেকে তোমার একলা বাইরে ঘোরাফেরা বন্ধ।
— শোন, এই মেয়ের সাথে তোর বিয়ে দেব। যদি মেয়ে রাজি হয়। বেশ তেজি আছে!
তাতে আবার আঁতে ঘা লাগল আরিয়ানের।
— কেন রাজি না হবার কারণ কী? আমি কি ফেলনা নাকি?
— ফেলনা না হলেও কনের চাইতে যখন বরের চুলের বাহার বেশি হয়, তখন কনে বিয়েতে রাজি নাও হতে পারে।
নাক সিটকাল আরিয়ান
— তাহলে এমন হিংসুটি মেয়েকে বিয়ে করতে আমার দায় পড়েছে। ওর নজরে নজরেই আমার চুলগুলি ঝরে যেতে পারে। সেইটাই কি তুমি চাও?
মায়ের কথাকে তেমন পাত্তা দেয়নি আরিয়ান। মা’র মাথায় দিনরাত আজগুবি ভাবনা চলছে। এটাও তেমন একটা। দুদিনেই ভুলে যাবে।
তবে আদিবা ভুললেন না। জনে জনে দেখিয়ে বেড়াতে লাগলেন হবু বৌয়ের ছবি। তারমধ্যে তার বর ইমরান সাহেব ও বাসার সাহায্যকারিনী মুক্তার মা’ও ছিল। মুক্তার মা এতে খুব তাল দিলেও ইমরান সাহেব স্বভাবমতো নীরব রইলেন। কিন্তু একদিন আরিয়ানের রুমে এসে ছেলেকে ডাক দিলেন
— আরিয়ান, একটা কথা বলব ভাবছিলাম।
— বলো, বাবা।
— তোমার মা দেখলাম তোমার বিয়ে নিয়ে খুব এক্সাইটেড।
— বাবা, মা’র মাথায় একসাথে একশটা প্রজেক্ট চলে। এটা তারমধ্যে একটা।
— কিন্তু এটাতে তার ফোকাস বেশি। পড়াশোনা শেষ, চাকরি করছ, বিয়ের কথা ভাবতেই পারে সে। কিন্তু এখানে আমার একটা কথা আছে, আরিয়ান।
— বলো, বাবা।
— চাকরি করছ ঠিকই কিন্তু সলিড একটা চাকরি না হলে বিয়ে নিয়ে সিরিয়াসলি কিছু ভেব না, বুঝলে?
— বাবা, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। মা যতটা এক্সাইটেড, আমি তার কানাকড়িও না। এ অবস্থায় বিয়ের কথা মাথায়ই আনছি না।
ইমরান সাহেব কম কথার মানুষ, ছেলেকে যথেষ্ট জ্ঞানদান করা হয়েছে ভেবে প্রস্থান করলেন। আরিয়ানও বাবার কথাকে সবসময় গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। কাজেই কথাটাকে সে মাথায় গেঁথে নিল।
তবে দুদিন পরে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছেই দেখে এক দারুণ চমক অপেক্ষা করছে ওরজন্য। ফটোর সেই মেয়েটা জলজ্যান্ত রূপ ধরে বাসের অপেক্ষায় রয়েছে। তারপর থেকে বাসে যাওয়া আসা শুরু করল আরিয়ান, তখন প্রায়ই ওকে দেখত। কখনো একলা, কখনো বান্ধবীদের সাথে।
বাপ রে বাপ! মেয়েরা যে এত কথা বলতে পারে! টপিক ছাড়া বকবক করেই যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে। তবে মেয়েটার গলার স্বর মিষ্টি, উচ্চারণ স্পষ্ট। এজন্য শুনতে ভালো লাগত।
আরও দুইদিন যেতে মেয়েটা ওকে লক্ষ করল। তখন থেকে কালো চশমা পরে আসত আরিয়ান।
মা’কে বিশ্বাস নাই। হয়ত ওর ফটো এতদিনে ওদিকে চলে গেছে!
ওকে চিনতে পেরে যদি ভাবে পিছু নিয়েছে!
তবে বাসের ঘটনা ঘটার পরে বুঝল কুর্চির ওর সম্বন্ধে কোন আইডিয়া নাই, চেনবার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না ওরমধ্যে।
তারপরে তো এল ওর অফিসে ইন্টার্ভিউ দিতে। সে আরেক মহাভারত।
আস্তে আস্তে আরিয়ানের ইন্টারেস্ট বাড়ছে। দেখা যাক সামনে কী হয়!
(চলবে)