কখনো কুর্চি (পর্ব ৫)
মিষ্টির বাক্স হাতে নিয়ে সেদিন বাসায় ফিরে দন্ত বিকশিত করে মা’কে খবর দিল কুর্চি
— মা, রেডিওতে আমার চাকরি হয়ে গেছে।
— ওমা, তোকে আবার চাকরি দিল কে? কার খেয়ে দেয়ে কাজ নাই!
এর উত্তরে আর কী বলবে কুর্চি। ওর কপালটাই এমন। সবার মা একরকম, ওর মা’টাই সৃষ্টিছাড়া! ওর ধারণা হাসপাতালে নিশ্চয় আদল বদল হয়ে গেছিল। নাহলে এরকম হতে পারে না।
মা হবে সিনেমার মায়েদের মতো। ওর মা’কে কোনোমতেই সে কাতারে ফেলা সম্ভব না।
তবে বাবা খুব উৎসাহ দিলেন। সাথেসাথে বাক্স খুলে চট করে আস্ত এক মিষ্টি মুখে চালান করে দিয়ে বললেন
— বাহ! চমৎকার মিষ্টি।
— হতেই হবে। ৮০০ টাকা কেজি!
— তাহলে তো আরেকটা খেতেই হচ্ছে। খুব ভালো চাকরি পেয়েছিস রে, বিবলিন।
— ভালো চাকরি কিনা জানি না, তবে আমার স্বপ্নের চাকরি, বাবা।
— গুড। ভেরি গুড।
ওদিকে মা হাঁ হাঁ করে উঠেছে
— তুমি দুই দুইটা কোলবালিশ সাইজের মিষ্টি গপাগপ খেয়ে ফেললে? তোমার না খেতে মানা? সেদিনই তো ব্লাড টেস্ট করার পর ডাক্তার মানা করল।
সম্প্রতি কিছু শারীরিক অসুবিধা দেখা দেয়ায় নাসিম সাহেবকে ধরে বেঁধে ডাক্তারের কাছে নিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন শিউলি রহমান। ডাক্তার সাহেব তখন দেড় মাইল লম্বা নানান টেস্টের এক ফর্দ হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তারমধ্যে থেকে বেরুল যে নাসিম সাহেবের সুগার লেভেল বর্ডারলাইনে ঝুলে রয়েছে, এই ক্রস করল বলে। সেটাকেই অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে শিউলি রহমান তার খানা খাদ্যের ওপরে কঠোর বিধিনিষেধ জারি রেখেছেন। বলতে গেলে নাসিম সাহেব এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন। পছন্দের সব খাবারই তার জন্য নিষিদ্ধ। কিন্তু ফাঁক পেলে এটাসেটা অপকর্ম করে বসেন। এখন যেমন করলেন।
— ছোঃ। তাচ্ছিল্যের শব্দ করে কথাটাকে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করলেন নাসিম সাহেব।— ডাক্তারে কী না বলে আর মোক্তারে কী না খায়।
— ডাক্তারে কী না বলে? বানিয়ে বানিয়ে বলেছে ডাক্তার?
— হুম। তোমার কাছ থেকে টাকা খেয়ে আবোল তাবোল বকেছে!
— আমি!
কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারলেন না শিউলি রহমান।— আমি ডাক্তারকে টাকা খাইয়ে এসব বলিয়ে নিয়েছি। তাতে আমার লাভ?
শিউলি রহমানের গলার স্বর উত্তরোত্তর চড়ে যাচ্ছে দেখে বেগতিক বুঝে বাড়ি ছেড়ে পালালেন নাসিম সাহেব। বললেন বন্ধুর খুব বিপদ, তখুনি যেতে হবে।
কথাটা অবশ্য শিউলি রহমান একেবারেই বিশ্বাস করলেন না। পাকা গোয়েন্দার মতো জেরা করতে আরম্ভ করলেন
— কোন বন্ধু? নাম কী? কোথায় থাকে?
— ফিরে এসে বলব! বলে পত্রপাঠ ভেগে গেলেন নাসিম সাহেব। শিউলি রহমান তখন কুর্চিকে নিয়ে পড়লেন
— বললি না চাকরি কে দিল তোকে?
কুর্চি বিরক্ত
— আরে মহা জ্বালা দেখি। চাকরি আবার কে দিবে? আমি রীতিমতো কঠিন ইন্টার্ভিউ দিয়ে কত কষ্ট করে চাকরিটা জোগাড় করলাম, বলে কিনা কে দিল! আচ্ছা মানুষ তো তুমি। আমার দ্বারা কিছু হবে না, তাই মনে করো নাকি?
— মনে না করার মতো প্রমাণ এখনো পাইনি। যেদিন পাব, বিশ্বাস করব।
— কিসে প্রমাণ পাচ্ছ না তুমি, একটু খোলাসা করে বললে আমার জন্য ভালো হয়।
— তাহলে তো আমার মোটা ডায়রিটা আনতে হয়। সেখানে সব লেখা রয়েছে। দাড়া, একটা মনে পড়েছে। বাড়ির কোনো কাজ তোকে দিয়ে হয় না। উল্টে তোকেই ধরে বেধে তোয়াজ করে খাওয়াতে হয়।
— তারপর?
— তারপর ধর নিজের ঘরটাও পরিস্কার রাখতে পারিস না। একদিন মিনু কাজে না এলে চোখে সর্ষেফুল দেখিস। তারপরে ধর…
— আরো আছে নাকি?
— আসলটাই তো বলিনি।
— বলে ফেল। চান্স যখন পেয়েছ!
— তোকে বললাম সেদিন দোকানে যে মহিলার সাথে আলাপ হল, সে তার ছেলের জন্য তোকে খুব করে চাইছে, তো কানেই নিলি না।
— আশ্চর্য করলে, মা। খুপরি দোকানে পাওয়া বিয়ের প্রস্তাব আমি সিরিয়াসলি নিব, এখনো এতোটা ডাউনমার্কেট হইনি!
— খুপরি দোকান থেকে জামার কাপড় তো ঠিকই কিনতে চাইলি!
— তুমি যে কী না! জামার কাপড় কেনা আর জামাই বাছাই করা এক হল?
অবলীলাক্রমে শিউলি রহমান বললেন
— বিয়ে একবার হয়ে গেলে সবই সেম। তোর বাবা’কে দেখিস না?
ব্যপার হচ্ছে এই যে মাস দুয়েক আগে মা’কে সাথে নিয়ে কুর্চি গেছিল চাঁদনি চকের এক পরিচিত দোকানে। দোকান ঘুপচি হলেও কাপড় ভালো রাখে তারা। সেখানে এক সম্পূর্ণ অপরিচিত মহিলা বলতে গেলে গায়ে পড়ে ওদের কথার মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। কুর্চি আশ্চর্য হয়ে তাকাতে ওর হাতেধরা জামার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন
— সুন্দর রঙ।
কুর্চি কী বলবে ভেবে পেল না। ভদ্রতা করে বলেছিল
— জি, সুন্দর।
— তোমাকে খুব মানাবে।
এর উত্তরও কুর্চির কাছে নেই।
— জি।
ভদ্রমহিলা তখন শিউলি রহমানকে উদ্দেশ্য করে বললেন
— আপনার মেয়ে বেশ সুন্দর। সবকিছুতেই মানাবে।
এসব ক্ষেত্রে মা’রা সাধারণত যা করে, শিউলি রহমানও তাই করলেন। তিনি গলে হালুয়া হয়ে গেলেন এবং কুর্চির সৌন্দর্যের পুরা ক্রেডিটটা নিজে নিয়ে নিতে চাইলেন
— ধন্যবাদ, আপা। সবাই বলে ও আমার মতো হয়েছে!
কুর্চি উঠে দাঁড়াল। চাঁদনি চকের খুপরি দোকানে বসে খাজুরে আলাপের মাজেজা বোঝা ওর কর্ম না। পাশের দোকানের দিকে যেতে যেতে বলল
— মা, আমি এই দোকানে যাচ্ছি।
পাঁচ মিনিটের মাথায় হাসিহাসি মুখে সেখানে শিউলি রহমানের আগমন ও তাকে বগলদাবা করে বাসার দিকে প্রস্থান!
কুর্চি যতোই বলে আগের দোকানে গিয়ে জামাটা ও কিনবে, শিউলি রহমান কানেই তুললেন না। তার মুখের হাসিরও কোনো হেরফের হল না।
পরে শুনল সেই দোকানের ছোট টুলে বসে দোকানীদের এক হাত দূরত্বে রেখে ভদ্রমহিলা নাকি নিজের ছেলের জন্য কুর্চিকে পছন্দ করেছেন, এখন বিয়ের কথা বলবার জন্য বাসায়ও আসতে চাইছেন।
বিয়েটা লেগে যায় কিনা, জানার জন্য দোকানীদের চোখও আগ্রহে ফেটে পড়বার উপক্রম হয়েছিল। তারা কাজকর্ম বাদ দিয়ে হাঁ করে প্রতিটি কথা গিলছিল।
শুনে কুর্চি শুধু বলেছে
— উনি যদি আসেন তো আমি বাড়ি ছেড়ে পালাব, বলে দিলাম কিন্তু। তখন আবার বলতে এসো না যে মেয়ের জন্য তোমার মান সম্মান গেছে।
কুর্চির কঠিন মুখ দেখে শিউলি রহমান ভদ্রমহিলাকে বাড়িতে ডাকতে সাহস করেননি, আবার সরাসরি না করেও দেননি। আগড়ুম বাগড়ুম কিছু একটা বলে ঠেকিয়ে রেখেছেন। তবে প্রায়ই এ প্রসঙ্গ তুলে কুর্চিকে ঠেস দেন।
কুর্চি যথাসম্ভব গায়ে না মাখার চেষ্টা করে। এবং ওর আবারও মনেহয় হাসপাতালে কিছু একটা ঘাপলা হয়েছিল নিশ্চয়। আসল মা হলে ভদ্রমহিলার কথা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিত। বলত
— আমার মেয়ে এখন বিয়ে করবে না, আপা। পড়াশুনা শেষ না হলে কিসের বিয়ে? তাছাড়া ওর স্বপ্ন আর জে হবার। আপনার চেনা পরিচিত কেউ থাকলে একটু বলবেন!
(চলবে)