কখনো কুর্চি পর্ব-০৪

0
6

কখনো কুর্চি (পর্ব ৪)

মনেমনে দোয়া দরূদ যা মনে পড়ছে, একবার পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে নিল কুর্চি। এবারে এসপার কী ওসপার। ভালোটাই ভাববে সে। খারাপ চিন্তা, পরাজিত মনোভাব মন থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করবার চেষ্টা করবে। ভেবে নাও তুমি উপস্থাপনা করতে গেছ কোথাও, গিয়ে শোনো যে গানের শিল্পী আসবে না বলে দিয়েছে। তখন তুমি কী করেছ? তোমার সাধ্যমতো কি সামাল দাওনি কখনো? নিজেকেই মোটিভেট করতে থাকল কুর্চি। মনের মধ্যে ক্ষীণ একটা ভাবনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইল। হয়ত একদিন ও মোটিভেশনাল স্পিকার হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। কথাটা মনে আসতেই সেটাকে থাবড়া মেরে দমিয়ে দিল। এখন এসব ভাববার সময় না।
ফোকাস! ফোকাস করো, কুর্চি।
নড়েচড়ে গুছিয়ে বসে আত্মবিশ্বাসের হাসি হাসল। আরিয়ানকে বলল
— আমি রেডি।
জবাবে মাথা ঝাঁকাল আরিয়ান। তাতে ওর সিল্কি চুলগুলি দুলে উঠল। আজ মাথায় রাবার ব্যান্ড বেধে আসেনি আরিয়ান। ওর চুল দেখে মোহিত হয়ে গেল একেবারে কুর্চি। চুলে কী ব্যবহার করলে এত রেশমি, এত মোলায়েম, এত ঝরঝরে হয়?
একবার জিজ্ঞেস করে দেখবে?

পরমুহূর্তেই ভাবনার গতিপথ রোধ করে দিল ও। কারণ দরজা খুলে ঢুকেছে নিরালা আকাশ।
— হাই, আমি নিড়ালা আকাশ। গ্ল্যাড টু মিঠ ইউ।
নিরালা আবার নিড়ালা হল কবে থেকে? কিন্তু এ প্রশ্ন কুর্চির মনেই রয়ে গেল। কারণ নিরালা আকাশকে দেখে ততক্ষণে ও ভিমরি খেয়েছে।
মহিলা দেখি চলন্ত জুয়েলারি শপ। রুবেল বলেছিল তার অনলাইন জুয়েলারি শপ রয়েছে। তাই বলে পুরা দোকান গায়ে চড়িয়ে আসতে হয়? ঝনঝন করছে হাঁটতে গেলে। উপরন্ত যে পরিমাণ মেকাপ করেছে, তাতে তাকে বাঙালি বলে আর চেনা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে ফেস পেইন্ট করা এক জাপানি গেইশা। মানে ল্যাহেঙ্গা পরা গেইশা!
বাপ রে বাপ! বিস্ময় সামলে নেবার চেষ্টা চালাল কুর্চি। আরিয়ান উঠে দাঁড়িয়ে তার সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল
— আমি আর জে আরিয়ান। আর ও আর জে কুর্চি।
তড়াক করে উঠে দাঁড়াল কুর্চি। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল
— হাই, নিরালা আকাশ।

কুর্চিকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে ওকে পুরাই উপেক্ষা করল নিরালা আকাশ। আরিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলল
— তোমার নাম শুনছি লুবনার কাছে। লুবনা কই?
মধুর হাসল আরিয়ান। এখন আপাদমস্তক বাটারিং না করলে উপায় নাই বুঝে বলল
— নিজেকে খুব সম্মানিত মনে করছি, নিরালা আকাশ। তবে দুঃখের সাথে জানাতে হচ্ছে, লুবনা আজ থাকতে পারবে না। ওকে খুব জরুরী কাজে থাইল্যান্ড যেতে হয়েছে কাল গভীর রাতে। তবে কুর্চি থাকবে আমাদের সাথে। সে লুবনার চাইতে কম না।
অসন্তস্ট গলায় জবাব দিল নিরালা আকাশ
— কিন্তু আমি লুবনাকে এক্সপেক্ট করতেছিলাম। ওরসাথে কথা হইসে, আমরা কী নিয়ে আলোচনা করব, সেনিয়েও প্রস্তুতি নিসি। ধামাকা হবে, ধামাকা। এখন বলে লুবনা থাকব না। আমি এটা লাইক করতাসি না।
— তুমি প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করতে চাও? নাহলে আরেকদিন ডেট ফেলা যায়।

মনে হল আরিয়ানও এবারে দমে গেছে। ঠিক বুঝতে পারছে না কিভাবে নিরালা আকাশকে হ্যান্ডেল করবে। এতখানি রিস্ক নিয়ে সে ইন্টার্ভিউ শুরু করতে দ্বিধা করছে।
একটু ভাবল নিরালা আকাশ। তারপর বলল
— নাহ। রেডি যখন হইয়া আইস্যা পড়সি, তখন আর শুভ কাজে দের কিস বাত কা? হো জায়ে শুরু!
তারপর বসতে বসতে বলল
— পাঁচ লাখ দিয়া ল্যাহেঙ্গা কিনসি কি এমনি এমনি?
পাঁচ লাখ! কুর্চির মুখ ফসকে বের হয়ে গেল
— কিন্তু এটা তো রেডিও। এখানে কিছু দেখা যাবে না। শুধু শোনা যাবে।
স্তম্ভিত হয়ে গেল নিরালা আকাশ। তারপরে মাথায় থাপ্পড় মেরে বলল
— হায় রে হায়। আমি তো একদম ভুইল্যা গেসিলাম। মনে করসি টিভি ইন্টার্ভিউ হইব। হুদাই এত টাকা খরচ করলাম।
এ কথার জবাব আরিয়ান বা কুর্চি কেউ দিল না। তারা নিজেদের সমস্যায় বাঁচে না, নিরালা আকাশের ল্যাহেঙ্গাজনিত সমস্যার মধ্যে মাথা গলাতে চাইল না।
অন্য রুম থেকে রুবেল তাড়াতাড়ি বলল
— নিরালা আকাশ, তুমি এক কাজ করতে পার। এখন ছোট্ট একটা লাইভ করে তোমার ফলোয়ার্সদের জানিয়ে দিতে পার যে তুমি রেডিওতে ইন্টার্ভিউ দিচ্ছ। তাতে তোমার ভিউয়ার্সরা তোমাকে দেখতে পেল, তোমার পাঁচ লাখ টাকার ল্যাহেঙ্গা দেখল, আবার তোমার ইন্টার্ভিউ এর কথাও জানতে পারল।
— গুড আইডিয়া।
চট করে ফোন বের করে নিলারা আকাশ লাইভে চলে গেল। রুবেলের কথার অন্তর্নিহিত খোঁচা ধরতেই পারল না। আরিয়ান রুবেলের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল। কাঁধ ঝাঁকিয়ে চোখ টিপল রুবেল।

অবশেষে সবাই গুছিয়ে বসতে আরিয়ান অন এয়ারে চলে গেল।
ধরি মাছ না ছুঁই পানি কায়দায় আরম্ভ করল।
— আজ আমাদের সাথে রয়েছেন জনপ্রিয় ইনফ্লুয়েন্সার নিরালা আকাশ। আপনারা তো তাকে সবাই চেনেন। তাই আমি আর কী বলব। নিরালা আকাশকেই বলবার অনুরোধ করছি। আচ্ছা, নিরালা আকাশ, তোমার নিজের সম্বন্ধে, কাজের সম্বন্ধে লিসেনার্সদের একটু জানাবে?
— শিওর। হাই এভ্রিবডি। আমি নিড়ালা আকাশ। ইয়োর মোস্ট পপুলার ইনফ্রুয়েন্সার। সবাই আমাকে চেনে, আমার জুয়েলারি শপের কথা জানে। বাট আমি আজ জুয়েলারির কথা বলতে আসিনাই। আইসি অন্য একটা এনাউন্সমেন্ট দিবার লাইগা।
— ইয়ে, নিরালা আকাশ। তোমার জুয়েলারি শপের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক নাহয়।
— সেসব লিসেনার্সরা অনেক শুনসে। এক কথা কয়বার কপচামু। আমি এখন বলি আসল কথাটা।
হতাশ হয়ে আরিয়ান রুবেলের দিকে আবার তাকাল কাচের জানালা দিয়ে। রুবেল না দেখার ভান করে রইল।
— আচ্ছা বল।
— আমি আজ বলব প্রাক্তন তুই চায়া থাক নিয়া!

নিরালা আকাশকে কথা বলতে দিয়ে আরিয়ান সবে পানির বোতলের ছিপি খুলে এক ঢোঁক পানি খাচ্ছিল। একথা শুনে বিষম খেল। মুখ থেকে পানি ছিটকে গিয়ে পড়ল ওর মাইকের ওপরে। পুরা মাইক পানিতে সয়লাব।
আরিয়ান কাশতে থাকে। বহুকষ্টে কাশি দমন করে বলল
— কী নিয়ে কথা বলবে আজ ?
— প্রাক্তন তুই চায়া থাক!
বোকার মতো প্রশ্ন করল আরিয়ান
— তোমার গয়নার দোকানের নাম এটা?
ওদিক থেকে রুবেল দুইহাত তুলে প্রাণপণে আরিয়ানের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। সেদিকে তাকাতে রুবেল ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল যে ওর মাইক কাজ করছে না। খুব সম্ভব পানি পড়ে কিছু গোলমাল হয়েছে।
হতভম্বের মতো নিজের মাইক খানিক্ষণ নাড়াচাড়া করল আরিয়ান। কয়েকবার থাবড়া দিল। তারপর হতাশ হয়ে একবার রুবেল, একবার নিরালা আকাশের দিকে তাকাল। তারপর কুর্চিকে ইশারা করল চালিয়ে নিতে।

কুর্চির চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। এতক্ষণে সে শুধু একটাই কথা বলেছে
— নিরালা আকাশ, আপনি কেমন আছেন?
আর এখন পুরা ইন্টার্ভিউ ওকে চালিয়ে নিতে হবে? ভয়েভয়ে একবার রুবেলের দিকে তাকিয়ে দেখল। রুবেল দুইহাত মাথার ওপরে তুলে প্রাণপণে ইশারা করছে যাতে ডেড এয়ার না থাকে। নিরালা আকাশের দিকে তাকাল কুর্চি। সে তখন সবাইকে দেখছে, তারপর মেকাপে সয়লাব চোখ ঘুরিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করল। সামলে নিল নিজেকে কুর্চি। প্রশ্ন করল
— নিরালা আকাশ, আপনি কী নিয়ে কথা বলবেন আজকে, আবার একটু বলবেন?
— বললাম না, প্রাক্তন তুই চায়া থাক!
— প্রাক্তন তুই চায়া থাক?
— হ্যাঁ।
— কেন প্রাক্তন চায়া থাকবে?
— কারণ ইনকাম আমার মাসে বারো লাখ!
— বুঝলাম না, আপু।
বিরক্ত হল নিরালা আকাশ
— এতে না বোঝার কী আছে? মাসে বারো লাখ টাকা ইনকাম আমার!

— আচ্ছা! দ্বিধাগ্রস্থ হল কুর্চি। শুনে তো গহনা সম্পর্কিত কিছু বলে মনে হচ্ছে না। একবার আরিয়ানের দিকে তাকালো। আরিয়ান মাথা ঝাঁকিয়ে ওকে উৎসাহ দিল। আরিয়ানের উৎসাহ পেয়ে খানিকটা ধাতস্ত হল কুর্চি।
— এটা নিয়ে একটু বিস্তারিত বলবেন কি? মানে নাম শুনে গয়না বলে মনে হচ্ছে না। নাকি এ আপনার নতুন গয়নার লাইন?
ঝকঝকে হাসি হাসল নিরালা আকাশ
— বলব বলেই তো আইলাম। এখানেই নিউজটা প্রথম বাইর হইব। তারপরে আমার পেজে খবর যাইব। প্রাক্তন তুই চায়া থাক আমার বই। আমার জীবনী।
— ওহ! বলে থেমে গেছিল কুর্চি। রেডিওতে আছে মনে পড়তে সাথেসাথে যোগ করল
— অভিনন্দন আপনাকে, নিরালা আকাশ। ইনফ্লুয়েন্সার ও রাইটার, এমন কম্বিনেশান আগে হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। হলেও আপনাকে শুভেচ্ছা। এটা কি আপনার প্রথম বই?
— প্রথম বই এবং শেষ বই। আমার এত সময় আছে নাকি যে বইটই লিখুম? বই লিখব যাদের হাতে কাজকর্ম নাই, তারা! আমি এত ফেমাস, এত বিজি কিন্তু এ বই আমি লিখছি আমার মতো আরো শতশত নারীকে কী যেন বলে?… উদবুদ্ধ, হ্যাঁ উদবুদ্ধ করতে। তারা যেন প্রাক্তনের উস্টা খায়া নিজের জীবন বরবাদ না করে। দাঁতে দাঁত চাইপ্যা নিজেরে গুছাইয়া নেয়। একদিন সফলতা আইবই। তখন তারাও প্রাক্তন তুই চায়া থাকের মতো আরেকটা মাস্টারপিস লিখতে পারব।

মাস্টারপিস শুনে কুর্চি হাঁ!
— মাস্টারপিস? এ বইয়ে কী রয়েছে যাতে আপনি একে মাস্টারপিস বলছেন, নিরালা আকাশ?
— জীবনী হইলেও বইয়ে আমি জন্ম, বড় হওয়া নিয়ে কিছু বলিনাই। আমি শুধু ফোকাস করসি আমার জীবনের শয়তান ব্যাটাটার ওপরে। হের নাম আনামুল ইসলাম। ব্যাটা বদের বদ, শয়তানের লাঠি। প্রেম করার সময় কত মিষ্টি মিষ্টি কথা। এই করুম, সেই করুম। কিন্তু বিয়া করার সময় মা মইরা যাইতেসে, মায়ের কথামতো বিয়া করতে হইব এসব হাবিজাবি বলে ভাওতা দিসে আমারে!

শুনে কুর্চির চক্ষু চড়ক গাছ!
— তাহলে আপনি প্রতিশোধ নিতে এ বই লিখেছেন, নিরালা আকাশ?
— তা নয়ত কি? ব্যাটা সুখে শান্তিতে সংসার করব আর আমি চায়া চায়া দেখুম? আজ প্রি অর্ডার শুরু হইল। বই প্রকাশ পাইলে তার বউরে এক কপি পাঠামু। পইড়া বুঝব কার সাথে বিয়া হইসে হের। ব্যাটা ভন্ড!
কুর্চি একটু দম নিল, একবার আরিয়ানের দিকে তাকাল। নিরালা আকাশ কথা শেষ করে অল্প অল্প হাঁপাচ্ছে। মনে হচ্ছে উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় এ লাইনে আরো প্রশ্ন করা ঠিক হবে কি?
আরিয়ান সেটা বুঝতে পারল না। সে কুর্চিকে উৎসাহ দিতে বুড়া আঙ্গুল দেখিয়ে ইশারা করল। তারমানে ইন্টার্ভিউ ভালো হচ্ছে। মাথা ঝাঁকিয়ে বোঝাতে চাইল কুর্চি যেন চালিয়ে যায়। তাতে ওর চুল আবারো দুলে উঠল, সেদিকে সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে রইল কুর্চি।

হুশ ফিরতে একটু ভাবল, তারপর নতুন প্রশ্ন করল
— নিরালা আকাশ, ব্যপারটা কি একটু বেশি বেশি হয়ে গেল না? এভাবে সবার সামনে তাকে অপদস্থ না করে আপনি তাকে ধন্যবাদ জানাতে পারতেন। ঘটনা যাই হোক, তার জন্যই তো আপনি আজ এ অবস্থানে এসেছেন। আপনি এখন তাকে ধন্যবাদ জানাতে চান? অন এয়ারে?
— না! একরকম চিল্লায়ে উঠল নিরালা আকাশ। আচমকা খুবি খেপে গেল সে।
— এ বই নারী স্বাধীনতার বই। নারীদেরকে যুগ যুগ দমায়ে রাখলেও তারা একদিন তেড়েফুড়ে বাইর হইবই, আমি তার প্রমাণ। আনামুল ইসলামের মতো গুবরে পোকাগুলি আমার মতো শতশত নারীর জীবনে আইলেও আমাদের কেউ দমাইয়া রাখতে পারব না। এ কথাটা সব্বাইরে জানাইবার জন্যি আমি বইটা লিখসি।

কুর্চি খানিকটা কুঁকড়ে গেল। কথা খুঁজে পেল না, নিরালা আকাশ দেখি নিজের ওপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবার উপক্রম করছে। অসহায়ের মতো আরিয়ানের দিকে তাকাতে সে আবার ইঙ্গিত করল আরো প্রশ্ন করতে। কিন্তু কী প্রশ্ন করবে সেটাই বুঝে পেল না ও।
ওকে বাঁচিয়ে দিল রুবেল
— আমরা এবারে লিসেনার্সদের কাছ হতে কিছু কোয়েশ্চেন নিতে পারি। তাতে নিরালা আকাশের বই নিয়ে আরো খানিকটা জানতে পারব। প্রথম প্রশ্ন করবেন… আপনার নামটা বলবেন প্লিজ?
খরখরে এক পুরুষ গলা শোনা গেল। তারপরেই বাজ পড়ল যেন
— আমার নাম তো একটু আগেই হুনলেন। আনামুল ইসলাম। আমি হইলাম গিয়া আপনাদের নিরালা আকাশ না কী কয়, হের প্রাক্তন প্রেমিক। তয় তখন তার নাম নিরালা আকাশ আছিল না। কুলসুম বেগম ঢাকা শহরে আইয়া হইসে ইনফুলুয়েনসার! তার আগে মফস্বল শহরে দুজনের লগে আশনাই চালাইতেছিল, হেয় বলসে? এইজন্যই তো হেরে বিয়া করি নাই! এখন রেডিওতে আইসা আমারে হুমকি দেয়! দেইখ্যা নিমু তরে, কুলসুম। তুই একবার আয় আমাগো শহরে!

প্রশ্নের বহর শুনে সবার চোখ ছানাবড়া! চিৎকার করে উঠল নিরালা আকাশ
— হালার পুত আনাম, এত্ত বড় মিথ্যা কথা তুই আমার নামে কইলি? কইতে পারলি? আমার আশনাই আছিল নাকি তুই মায়ের কথায় ইন্দুরের মতো গর্তে লুকাইলি?
তারপরে আরো কী কী বলল, কুর্চি তার অর্ধেক কথাই বুঝতে পারল না। শুধু বুঝল কথার ফাঁকে ফাঁকে প্রচুর গালিগালাজও চলছে।
গালিগালাজ পর্ব শেষ হতে নিরালা আকাশ ভ্যা করে কেঁদে দিল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে রুম থেকে বের হয়ে গেল। পিছনে সবাই হতবাক হয়ে বসে রইল।
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ।
রুবেল অন্য রুম থেকে দরজা খুলে বের হয়ে এ রুমে ঢুকল। আরিয়ান মুখ লাল করে শুধু বলল
— লুবনাকে সামনে পেলে ওকে আমি খুন করে ফেলব!

নিঃস্পৃহভাবে জবাব দিল রুবেল। যেন এতক্ষণ যে নাটক চলছিল, সেটা খুব স্বাভাবিক ব্যপার।
— চিন্তার কিছু নাই। আমি বহু আগেই ব্রডকাস্টিং বন্ধ করে দিয়েছি। বলেছি টেকনিকাল ডিফিকালটিজ। এখন “বন্ধু, তুই লোকাল বাস!” গান শুনছে সবাই!
কুর্চি আর নিতে পারল না। প্রথমে হো হো করে হাসতে আরম্ভ করল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সে হাসি হাউমাউ কান্নায় রূপান্তরিত হয়ে গেল। ওর কাণ্ড দেখে বাকি দুজন আতংকিত হয়ে ওরদিকে তাকিয়ে রইল। এমন করছে কেন মেয়েটা?
আরিয়ান গাধার মতো রুবেলকে প্রশ্ন করল
— ও কাঁদছে কেন?
কাঁধ ঝাঁকাল রুবেল
— তার আমি কী জানি? কাঁদবার মতো কিছু হয়েছে নাকি? থামাও তো ওকে। আমি আর ড্রামা নিতে পারছি না। একদিনের জন্য যথেষ্ট হয়েছে।
— কেমন করে থামাব?
— কীজানি। জড়ায় ধরতে পারো।
ভীষণ অপ্রস্তুত হল আরিয়ান
— গবেট! জড়ায় ধরব কেন?
— কীজানি! মনে হল, তাই বললাম!
— ষ্টুপিড! যাও, ওরজন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে আসো।

রুবেল পালাতে পেরে বেঁচে গেল যেন। ও বের হয়ে যেতে আরিয়ান সাবধানে কথা আরম্ভ করল
— ইয়ে কুর্চি, তুমি কাঁদছ কেন?
নাকের জলে চোখের জলে এক হয়ে কুর্চি জবাব দিল
— আজকেও আমার ইন্টার্ভিউ ভালো হয়নি। এখানে আমার চাকরি হবে না। অথচ আমার এত ইচ্ছা…
— কে বলেছে ইন্টার্ভিউ ভালো হয়নি? বিনা প্রিপারেশানে, কিছু না জেনে, কোনো অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও যা তুমি করেছ, আমি সত্যি ইম্প্রেসড, কুর্চি।
ওমনি কান্না বন্ধ হয়ে গেল কুর্চির।
— সত্যি বলছ?
টিস্যু বক্স থেকে ট্যিসু নিয়ে ওরদিকে এগিয়ে দিল আরিয়ান।
— নাও।
টিস্যু নিয়ে চোখ মুছল, নাক ঝাড়ল কুর্চি।
— দেখো, তোমার চিন্তার কোনো কারণ নাই। তুমি খুবি ভালো করেছ। এনিয়ে মনে কোনো সন্দেহ রেখো না। আজ বাড়ি যাও। কাল থেকে এসো। আমরা নতুন করে বসব। তোমার চাকরির টার্মস এন্ড কন্ডিশান্স নিয়ে কথা বলব।
মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল কুর্চির।
— সত্যি বলছ? আমার চাকরি হয়ে গেছে?
— হুম, হয়ে গেছে তো।
মৃদু হেসে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল আরিয়ান। সামনে শুধু চাকরি না, আরো অনেককিছুই হতে পারে। এজন্য তো ও প্রতিদিন বাস স্টপে দাঁড়িয়ে থাকত। কিন্তু কীভাবে আলাপ করবে বুঝতে পারছিল না। কেমন করে যেন কাকতালীয়ভাবে সব সুন্দরভাবে মিলে গেল!
একটা ক্লিপের কারণে এতকিছু হবে, কে জানত!
(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে