কখনো কুর্চি (পর্ব ৩)
পরদিন।
সময়ের একটু আগে ইন্টার্ভিউ দিতে হাজির হয়ে গেল কুর্চি। উৎসাহ উদ্দীপনার চোটে গতরাতে ভালোমতো ঘুমই হয়নি।
সকালে উঠে রেডি হতে গিয়ে লাকি ক্লিপটার দিকে নজরে পড়তে একটু ভাবল ও। গতকালকে যা ঘটেছে তারপর সাহস করে ক্লিপটা আবার পরা ঠিক হবে কি?
কিন্তু এটা তো ওর লাকি ক্লিপ। কুর্চির স্থির বিশ্বাস এ ক্লিপের জোরেই ও ইন্টার্ভিউ এ ফেল করতে করতে বিশেষ বিবেচনায় আবারো সুযোগ পেয়েছে। শুধু তা না, আর জে আরিয়ানের সুনজরে পড়ে লিস্টের প্রথমদিকে জায়গা করে নিয়েছে।
তাহলে?
অনেক্ষণ ক্লিপটার দিকে তাকিয়ে রইল কুর্চি। তারপর ড্রয়ার খুলে চেন বের করল। তাতে ক্লিপ দুইটা লকেটের মতো সেট করে গলায় পরে নিল।
সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না। অর্থাৎ ক্লিপটা চুলে পরা লাগল না, এদিকে সাথেও থাকল। দেখতে খারাপ লাগছে না, বরং ইউনিক কিছু মনে হচ্ছে।
যাক, এখন নিশ্চিন্তে ইন্টার্ভিউ এর জন্য রওনা দেয়া যায়।
পুরা রাস্তা নির্বিঘ্নে যেতে পারল কুর্চি। ভয়েভয়ে ছিল ও, কে জানে আবার কী হয়! কিন্তু না, আজ একেবারে সবকিছু নিয়মমাফিক ঘড়ি ধরে ঘটল।
যাক! সো ফার সো গুড।
গ্লাসডোর ঠেলে অফিসে পৌঁছে রিসেপশান ডেস্কে বসা মেয়েটিকে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল
— আর জে আরিয়ান আমাকে আসতে বলেছে।
মেয়েটার চেহারায় কেমন দ্বিধা ফুটে উঠল। বলল
— আজকে আসতে বলেছে? আমাকে তো কিছু বলেনি।
বলে চোখের কোণ দিয়ে একবার তাকাল।
মেয়েটির দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকাতে কুর্চিও আশ্চর্য হয়ে গেল।
কাচের দরজা দিয়ে সে ঘরের ভেতরটা দেখা যাচ্ছে। সেখানে আরিয়ান হাত পা নেড়ে একজনের ওপরে খুব হম্বিতম্বি করছে। এক পর্যায়ে ছেলেটার কাঁধ চেপে ধরে তাকে ঝাঁকাতে দেখে কুর্চি যাকে বলে আঁতকে উঠল।
ওর আর জে হবার খুব শখ, একথা সত্য। আর জে আরিয়ানের সাথে কাজ করবার শখ খুব, একথাও সত্য। তাই বলে সেজন্য এমন ব্যবহার মেনে নেওয়া কি ঠিক হবে? মানে সবকিছুরই একটা লিমিট আছে। কাজ পছন্দ না হলে যদি দুই চারটা চড় চাপড় মেরে বসে?
কুর্চি নিজের বাবা মায়ের হাতেও যেখানে কখনো মার খায়নি সেখানে এমন এবিউজ সহ্য করা কি ওর পক্ষে সম্ভব হবে?
ঠিক সেসময়ে আরিয়ান মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই ওকে দেখতে পেল। সাথেসাথে ছেলেটাকে ছেড়ে দিয়ে দরজা খুলে মাথা বের করে বলল
— তুমি এসেছ? ভেরি গুড!
কুর্চি ততক্ষণে খানিকটা দমে গেছে। এরমধ্যে গুডের কী হল আবার? ও তো ব্যাড ছাড়া কিছুই দেখছে না। উপরন্ত তুমি!
এটাই বা কখন থেকে হল!
হাত তুলে এবারে ইশারা করল আরিয়ান
— এসে পড়ো। আমাদের হাতে সময় একদম নাই। তোমাকে ব্রিফিং দিয়েই আমরা প্রোগ্রাম শুরু করে দিব।
দোনোমোনো ভাব নিয়ে আরিয়ানকে অনুসরণ করে রুমে গিয়ে ঢুকল কুর্চি। দেখা যাক কী হয়।
কুর্চি বসতে আরিয়ান প্রশ্ন করল
— রেডিওতে কখনো কাজ করেছ?
বিমুঢ় হল কুর্চি
— না তো। গতকালকেই তো বললাম। তবে আমি উপস্থাপনা করেছি প্রচুর। আবৃত্তিও করেছি।
— হুম। অন্যমনস্কের মতো টেবিলে আঙুল বাজাতে থাকে আরিয়ান। — কখনো কারো ইন্টার্ভিউ নিয়েছ? নার্ভ কেমন? শক্ত আছে?
ঠিক বুঝতে পারল না কুর্চি। ও যা ভেবেছিল, তার সাথে কিছু মিলছে না। প্রশ্নগুলিও কেমন খাপছাড়া। আরিয়ান কি ওরসাথে ঠাট্টা করছে? ফাজলামি করবার জন্য ডেকে এনেছে? গতকালকের ঘটনার প্রতিশোধ?
কেমন গোঁ চেপে গেল কুর্চির। সে এর শেষ দেখে ছাড়বে। কিছুতেই বুঝতে দেবে না ও কতটা ঘাবড়ে গেছে। ঠান্ডা গলায় বলল
— নার্ভ একদম পাথরের মতো শক্ত। কোনোকিছু আমাকে বিচলিত করতে পারে না। ইন্টার্ভিউ কারো নেইনি তবে প্রয়োজন পড়লে নিতে পারব। আপনি পরীক্ষা করে দেখুন।
জবাবে ওরদিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল আরিয়ান। তারপরে যে ছেলেটিকে ধরে ঝাঁকাচ্ছিল এতক্ষণ, তার সাথে চোখাচোখি করল। ছেলেটি বলল
— ট্রাই করা যায়।
— এতখানি রিস্ক নেয়াটা ঠিক হবে?
কাঁধ ঝাঁকাল ছেলেটি।
— এক ঘন্টা ধরে ডেড এয়ার থাকার চাইতে বেটার হবে। তাছাড়া নিরালা আকাশ কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পড়বে। তার ইন্টার্ভিউ না নিয়ে বিদায় করে দিলে কী না কী ফেসবুকে ছড়িয়ে দিবে, লোকজন তখন আমাদের মারতে না আসে।
চোখ গোলগোল করে ফেলল আরিয়ান
— নাম কী বললে? নিরালা আকাশ? কে সে? এ খবর কে দিল?
— এইমাত্র লুবনা আমার গোটা পঞ্চাশেক মেসেজের উত্তরে এক লাইন লিখে পাঠাল। বলেছে নিরালা আকাশ আজকের গেস্ট। আমরা যেন ব্যপারটা ট্যাকেল করি। তারপরেই ফেসবুক ছেড়ে উধাও হয়ে গেছে!
এক প্রস্থ গালাগাল বেরুল আরিয়ানের মুখ দিয়ে। দুহাতে চুল খামচে ধরে বলল
— কিন্তু নিরালা আকাশ জিনিসটা কী? মানুষ নাকি কোনো বস্তু? এভাবে এত রিস্ক নিয়ে কেউ অন এয়ারে যায়?
— মিলন সার্চ করছে। আশাকরি কিছু ইনফর্মেশান বের করতে পারবে সে আসার আগে। নাহলে আমন্ত্রিত অতিথিকেই প্রশ্ন করতে হবে- আপনি কে? কী করেন?
রাগে গরগর করে উঠল আরিয়ান
— লুবনা একবার ফিরে আসুক। ওকে আমি যে কী করব!
— আমার ব্যপারটা ভালো লাগেনি, আরিয়ান। তোমরা দুজনে একসাথে কাজ করো। কাকে ডাকছ, দুজনেরই জানা উচিত না?
— আরে আমি তো ছুটিতে গেছিলাম। এর মধ্যে লুবনা কাজ এগিয়ে রাখছে ভেবে খুশি হচ্ছিলাম। ফিরে এসে গতকালকে ওরসাথে এনিয়ে আলোচনা করব ভেবে রেখেছিলাম। আমাকে বলেছিল এমন একজনের সাথে কথা চলছে, যে খুব ফেমাস। কিন্তু কাজটা কনফার্ম না করা পর্যন্ত নাম গোপন রাখতে হবে। এই নিরালা আকাশের না কী, তারই নাকি বুদ্ধি এটা।
— তার বুদ্ধির চোটে তো আমরা এখন ডুবতে বসেছি। তিক্ত স্বরে বলল রুবেল।— দেখো, কেউ বিয়ে করলে তাকে শুভেচ্ছা জানাতে হয়। লুবনা আমাদের এমন ফাঁসিয়ে দিয়েছে, মন থেকে দোয়া তো আসছেই না, ইচ্ছা করছে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকাই। জংলি একটা! এভাবে কেউ ইলোপ করে? কতগুলি মানুষকে বিপদে ফেলে দিল! একটা বিবেচনা থাকবে না ইলোপ করার আগে?
— সেটাই তো। থাইল্যান্ডে ও কোথায় আছে এ মুহূর্তে জানলে গিয়ে কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে আসতাম!
দরজা খুলে গেল। লম্বা শুকনা মিলন নামের ছেলে মাথা গলিয়ে বলল
— পেয়েছি, আরিয়ান। নিরালা আকাশ একজন ইনফ্লুয়েন্সার। তার বিশাল অনলাইন শপ রয়েছে। গয়নার।
— অ্যাঁ! আঁতকে উঠল আরিয়ান।— এখানে আমি কী কথা বলব? ব্যাকগ্রাউন্ডও জানি না যে দুই চারটা কথা বলে তাকে বলতে লাগিয়ে দিব। আজকের প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করে দেবে, রুবেল? বলবে অনিবার্য কারণবশত আজকের সেশান স্থগিত, পুরানো কিছু দিয়ে চালিয়ে দেবে?
রুবেল কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই দরজা আবার খুলে গেল। এবারে রিসেপশনিস্ট মাথা গলাল
— আরিয়ান, নিরালা আকাশ নামে একজন এসেছে। বলছে আজকের অতিথি সে। আসতে বলব?
দুর্বল গলায় রুবেল বলল
— চলে এসেছে তো। এখন স্থগিত ঘোষণা দেব? এসব ইনফ্লুয়েন্সারদের পাওয়ার অনেক। কিভাবে নেবে, কে জানে!
ঝুলে পড়া মুখ নিয়ে পরাজিত সৈনিকের মতো বসে রইল খানিক আরিয়ান। এদিকে কুর্চির মাথায় কিছুই ঢুকছে না টেনশানে। হচ্ছেটা কী!
এক মিনিট গেল, দুই মিনিট গেল। নিশ্ছিদ্র নীরবতা বজায় রইল পুরো ঘরে। তারপরেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠল আরিয়ান। চোখে মুখে কঠিন সংকল্প। কুর্চির দিকে তাকিয়ে বলল
— হাতে সময় নাই, তাই খুব সংক্ষেপে জানাচ্ছি তোমাকে। আমি আর লুবনা দুজনে একসাথে কাজ করি রেডিওতে।
থামিয়ে দিল ওকে কুর্চি
— আর জে লুবনাকে চিনি তো। মানে প্রোগ্রাম শুনেছি।
— গুড গুড। কিন্তু আজ সকাল থেকে লুবনা মিসিং।
কুর্চি পুরাই হাঁ।
— মিসিং মানে? কিডন্যাপড?
— উফ, কথা বোলো না তো। পুরাটা শোনো আগে। গতকাল আমি ভ্যাকেশান থেকে ফিরে এসেছি। লুবনা গতকাল কাজে আসেনি। কোনো খবরও দেয়নি। আমরা ব্যপারটাকে পাত্তা দেইনি। কারণ রেকর্ডিং ছিল না। আজ সকালে আমাকে আর রুবেলকে মেসেজ দিয়ে জানিয়েছে সে ইলোপ করেছে, থাইল্যান্ডে চলে গেছে হানিমুন করতে। কেমনটা লাগে বল দেখি? এদিকে আমাদের মাথায় হাত। রেকর্ডিং রয়েছে। ভেবেছিলাম রেকর্ডিং শেষে দুজনে তোমার ইন্টার্ভিউ নিব। তুমি তাড়াতাড়ি চলে আসাতে এখন আমাদের অন্যকোনো উপায় নাই।
কুর্চি আবারও কনফিউশানে পড়ল। ও কি ঘড়ি ভুল দেখেছে? আগে চলে এসেছে?
— কী উপায় নাই?
— তোমাকে নিরালা আকাশের ইন্টার্ভিউ নিতে হবে।
আকাশ থেকে পড়ল কুর্চি
— আমি? আমি তো কখনো ইন্টার্ভিউ নেইনি। তাও নাহয় নিতাম। কিন্তু আমি এই নিরালা আকাশকে চিনিও না। কী প্রশ্ন করব? কিছু না জেনে সরাসরি অন এয়ারে?
— সেসব নিয়ে টেনশান কোরো না। আমি আছি। রুবেলও থাকবে অন্য সাইড থেকে। আমিই ম্যাক্সিমাম প্রশ্ন করব নাহয়। তুমি মাঝেমধ্যে দুই একটা প্রশ্ন কোরো যেমন আপনার হবি কী? কাজকর্ম কিভাবে শুরু করলেন— এসব হাবিজাবি।
রুবেলও সাহস দিল
— কোনো ভয় নাই তোমার। লিসেনার্সরা সবসময় একজন ছেলে একজন মেয়ে আর জে তে অভ্যস্ত বলেই বলছি। সামান্য দুই চারটা প্রশ্ন করলেই চলবে। আমরা তো আছিই। যদি ভুলভালও কিছু বলো, অসুবিধা নাই। আমরা সাথেসাথে সামলে নেব।
— পারবে? আরিয়ান একরাশ আশা নিয়ে প্রশ্ন করল।
দ্রুত ভেবে নিল কুর্চি। তারপর মাথা ঝাঁকাল
— পারব! আপনারা হেল্প করলে মনেহয় পারব।
জোর দিয়ে বলল কুর্চি। কোথা থেকে এমন জোর পেল, নিজেও জানে না।
পারতে ওকে হবেই। এটাকে ইন্টার্ভিউ হিসাবে ধরে নিয়ে আগাবে ও। ওরা একটা বিপদে পড়েছে। এসময়ে যদি মাথা ঠান্ডা রেখে ও ভালো কাজ দেখাতে পারে তো সেটা নিশ্চয় একটা প্লাস পয়েন্ট হিসাবে দেখবে এরা।
— ভেরি গুড! তবে একটা কথা।
— কী?
— এখানে সবাই সবাইকে তুমি বলে। বিশেষ করে অন এয়ারে। তুমিও আমাকে আর রুবেলকে তুমি বলবে। আমাদের টার্গেট মূলত ইয়াং জেনেরেশান। তারা তুমিতে অভ্যস্ত।
কী আর করা। বলবে নাহয় তুমি। নীরবে মাথা হেলিয়ে সায় দিল কুর্চি।
— গুড। ভেরি গুড!। নাও, এবারে একটু গুছিয়ে বসো। আমরা অন এয়ারে চলে যাই।
রুবেল এগিয়ে এসে ওর সামনে রাখা মাইক্রোফোনটা সেট করে দিল। তারপরে অন্য সাইডের দরজা খুলে নিজের জায়গায় গিয়ে বসল।
আরিয়ান ইঙ্গিত করতে রিসেপশানিস্ট গিয়ে নিরালা আকাশকে সাথে করে নিয়ে এল।
(চলবে)