কখনো কুর্চি (পর্ব ১)
মাস দুয়েক ধরে লোকটাকে নজরে রেখেছে কুর্চি।
রোজ সকালে বাস ধরতে যখন বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়ায়, কিছুক্ষণের মধ্যে লোকটাকেও দেখা যায়। কেদাদুরস্ত শ্যার্ট প্যান্ট, লম্বা চুল মাঝে সিঁথি করে ঘাড়ের কাছে রাবার ব্যান্ড দিয়ে বাধা, চৌকা মুখ, চোখে ডার্ক সানগ্লাস। সবকিছু ঠিক আছে কিন্তু ডার্ক সানগ্লাসটাই যত সন্দেহের জন্ম দিচ্ছে। কেন যেন ডার্ক সানগ্লাস চোখে দেয় যারা, তাদেরকে সুবিধার লোক বলে মনে করে না কুর্চি। মনে হয় মতলববাজ।
চোখ দেখতে পায় না বলেই হয়ত।
এ ব্যাটাকেও সন্দেহের তালিকায় তুলে দিয়েছে। নির্ঘাত ব্যাটা ও জিনিস চোখে ঠেসে ওরদিকে আড়চোখে চেয়ে থাকে। নাহলে ও এসে দাঁড়ালেই কুর্চি অস্বস্তিবোধ করে কেন? কেন মনে হয় কেউ ওকে লক্ষ করছে।
আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখেছে কুর্চি। কেউ তাকিয়ে নেই, সবাই নির্বিকারমুখে বাসের অপেক্ষায় রয়েছে। তারমানে ব্যটাই কালপ্রিট!
হুহ! দেখে নেবে কুর্চি। ওকে চেনে না! নরম সরম ললিত লবঙ্গলতা ও মোটেই না। কারাতে ব্রাউন বেল্ট।
এয়সা কারাতে প্যাঁচ কষবে যে বাপ বাপ করে পালাবে!
আজ শুক্রবার। ইউনিভারর্সিটিতে ক্লাস নাই। ও যাচ্ছে একটা ইন্টার্ভিউ দিতে। মিডিয়াতে কাজ করবার ওর অনেকদিনের শখ। ভয়েসও সুন্দর ওর। কোনোমতে একবার যদি রেডিওতে চান্স পায়, খুব ইচ্ছা আর জে হবে। নিজের প্রোগ্রাম থাকবে।
হাই লিসেনার্স, আমি আপনার আর জে কোকিলকন্ঠি কুর্চি। আজ আমরা কথা বলব …
হ্যাঁ, নিজেকে কোকিলকন্ঠি কুর্চি নামেই প্রতিষ্ঠিত করবার ইচ্ছা আছে। তাতে তাড়াতাড়ি পরিচিতি পাওয়া যায়। প্লেন কুর্চি শুনলে কেউ কি মনে রাখবে? অবশ্য কাকতাড়ুয়া কুর্চি হলে ব্যপারটা আরো শকিং হত কিন্তু নিজেকে খুব খেলো করা হয়ে যায় তাতে। ‘জংলি জুলির’ লেভেলে নিজেকে না নামানোই ভালো। টের পেলে মা ওকে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে নেবে তাহলে!
থাক, ধীরে সুস্থে আগানো যাক। ওর তো কিছুটা অভিজ্ঞতাও আছে। স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটিতে সবসময় উপস্থাপনা করে এসেছে। কবিতা আবৃতি করেছে। সবাই ওর ভয়েসের অনেক প্রশংসা করে। সুযোগ পাওয়া কি এতটাই অসম্ভব হবে?
ইশ, যদি এ লাইনে পরিচিত কেউ থাকত তো কত ভালো হত।
কুর্চির কল্পনার জাল ফুঁড়ে অতিকায় বাসটা সামনে ঘ্যাঁচ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে হেল্পারের উচ্চস্বরে কলতান!
— এই ফারঙ্গে, ফারঙ্গে। শাহবাগ! সায়দাবাদ!
একটু ভাবল কুর্চি। ইউনিভভার্সিটিতে ও এরচাইতে উন্নতমানের বাসে চড়ে যায়। এসব মুড়ির টিনে কখনো ওঠে না। কিন্তু আজ শুক্রবার সকাল বলেই কি বাসের পরিমাণ কম? এতক্ষণে একটা বাস এল মাত্র। এটা ছেড়ে দিলে যদি পেতে দেরী হয়? যদি ইন্টার্ভিউ এ পৌঁছাতে দেরী হয়?
বাসটা চলতে আরম্ভ করবে করবে করছে, এক দৌড়ে গিয়ে কুর্চি বাসের সিঁড়িতে পা রাখল।
— এতক্ষণ ডাকতেসিলাম, ম্যাডাম। আপনে হুনেন নাই?
ইঁচড়ে পাকা হেল্পারটা সরে জায়গা দিতে দিতে অসন্তস্টি প্রকাশ করল। পাত্তা না দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল কুর্চি। ভালো ভিড়। বসতে পাবার আশা নাই। বাসের মাঝবরারবর গিয়ে থেমে গেল।
আরেহ! মতলববাজ লোকটা পেছনের দরজা দিয়ে উঠেছে দেখি, এখন ওরদিকেই এগিয়ে আসছে। সাথেসাথে থেমে গিয়ে সামনের দিকে মুখ করে দাঁড়াতে গেল কুর্চি। ওকে পাত্তা দেবার কোনো মানে হয় না।
ভাবতে ভাবতেই ড্রাইভার এমন টান দিল। নিজেকে রাজপুত্র ভাবে খুব সম্ভব। বাসটা ওর পংখিরাজ ঘোড়া।
ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলল কুর্চি। ভয় পেয়ে চোখ বুজে ফেলল। আল্লাহ জানে বাসের মধ্যে পড়ে গেলে ওর কী দশা হবে। হাতে পায়ের নুনছাল উঠে যাবে, জামাকাপড়ও ছিঁড়তে পারে।
কিন্তু বাসের মেঝেতে পড়ে না গিয়ে পিছের জনের চওড়া বুকে আছড়ে পড়ল ও। চোখ বন্ধ করা অবস্থায়ই টের পেল যার গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল, সে নারী না, পুরুষ।
বাংলা সিনেমা হবার আর কিছু বাকি নাই। জঘন্য একটা ব্যপার হল। আবার মাথায় ঠোকাঠুকিও খেয়েছে!
ছিঃ! ছিঃ!
চোখ বন্ধ রেখেই কুর্চি কোনোমতে বলল
— সরি! সরি! এমন টান দিল। ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি।
বলেই সরে দাঁড়াতে চাইল। তখুনি ভয়ংকর ব্যপারটা যাকে বলে অনুধাবন করল।
লোকটার মাথার সাথে ওর মাথা কোনো কারণে আটকে গেছে! কিছুতেই আলাদা করা যাচ্ছে না। এদিকে ড্রাইভারও সমানে টেনে চলেছে। যারজন্য এখনো বলতে গেলে ও লোকটার বুকের মধ্যে লুটোপুটি খাচ্ছে!
এম্ব্যারাসমেন্টে মরে গেল কুর্চি। বাসের মধ্যে পিনপতন নিঃশব্দ।
ছিঃ ছিঃ। এটা কেমন ব্যপার হল। নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার জন্য মাথা একবার ডানে একবার বায়ে এলোপাথারি নাড়াতে লাগল। তাতে চুল টুল ছিঁড়ে শেষ। এতক্ষণে একটা জিনিস বুঝতে পারল ও। খুব সম্ভব এমন অঘটনের জন্য সে নিজেই দায়ী!
মানে ও দায়ী না, ওর ক্লিপ দায়ী!
ওর লাকি ফর্গেট মি নট ক্লিপ!
যখনি ক্লিপ দুটো মাথায় দিয়ে কোনো জরুরি কাজে গেছে, সফল হয়েছে।
সে ভেবে আজও চুলে সাইড সিঁথি করে একপাশে দুইটা লাগিয়েছিল। ঘন চুল ওর, এক ক্লিপে সব চুল আঁটে না। ওর খুবি পছন্দের ক্লিপ। বয়সে বড়ো খালাতো বোন বাইরে থাকে, সেখান থেকে পাঠিয়েছিল। ক্লিপ দুটোতে মেটালিক তিনটা ফর্গেট মি নট ফুল রয়েছে। এত উজ্জ্বল নীল রঙ! খুবি ক্লাসি।
অথচ আজ লাকি ক্লিপই ওকে ডোবাল!
নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার বৃথা চেষ্টায় আরেকবার মাথাটা জোরে ঝাঁকাল কুর্চি। সাথেসাথে একদম কানের কাছে ভরাট গলা শুনতে পেল।
— এভাবে মাথা ঝাঁকাবেন না। আমাকে করতে দিন। আমি মনেহয় বুঝতে পেরেছি সমস্যাটা কোথায়।
একহাত ওর কাঁধে রেখে নিজের ব্যালান্স কোনোমতে ঠিক করল লোকটা। অন্যহাত দুজনের চুলে চালিয়ে দিয়ে অপরাধী ক্লিপ থেকে নিজের চুল ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করল।
কুর্চি আর নিতে পারল না। এত মোলায়েমভাবে চুলে আঙুল চালালে ওরা সারাদিনই বাসের মধ্যে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকবে। অন্যান্যরা নিশ্চয় ঠোঁট টিপে সকাল সকাল ফ্রি সিনেমা দেখে নিচ্ছে।
জঘন্য! যা তা! ক্যাডাভেরাস অবস্থা একেবারে!
অন্ধের মতো লোকটার হাতে এক চাপড় মেরে হাত সরিয়ে দিল কুর্চি। তারপর বিশ্বাসঘাতক ক্লিপটাকে ধরে এমন হ্যাঁচকা টান দিল যে একদলা চুলসহ হাতে চলে এল সেটা।
লোকটা আর্তনাদ করে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করল কুর্চি।
তাও ভালো। দুজনের মাথা আলাদা হয়েছে এতক্ষণে। মাথা তুলল কুর্চি। তুলেই ভয়াবহভাবে চমকালো।
লোকটা আর কেউ না। সেই কালো চশমাধারী!
অবশ্য চশমা এখন বাঁকা হয়ে অর্ধেকটা কপালে উঠে গেছে। তাতে এক চোখ দেখা যাচ্ছে। অন্য চোখটা এখনো কালো চশমায় ঢাকা। অনেকটা পাইরেটস অফ দা ক্যারিবিয়ানের জ্যাক স্প্যারোর মতো লাগছে। আর তার চুলের পরিপাটি ঝুঁটির যা অবস্থা, কহতব্য নয়।
কুর্চি হাসতেও পারল না, বুঝল লোকটার চুলের অবিকল প্রতিফলন ওর নিজের চুলেও ঘটেছে। চুলের অবস্থা নিয়ে শোক করবে নাকি মাথা ফিরে পাওয়ায় শোকর করবে, বুঝতে পারল না।
লোকটা গরগর করে উঠল
— এসব জঘন্য জিনিস পরে বাসে উঠে পাবলিক হ্যাজার্ড তৈরী করেন কেন?
বারুদের মতো জ্বলে উঠল কুর্চি। লোকটার এক চোখের দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠল
— আপনিই বা আমার পিছে এসে দাঁড়াতে গেলেন কেন? মেঝেতে পড়ে যেতাম, এত ঝামেলা হত না!
অসহ্য রাগে জবাব দিতে পারল না আরিয়ান। মেয়েটাকে বাসের বদলোক থেকে রক্ষা করবার জন্যই ওর পিছে এসে দাঁড়িয়েছিল ও।
খুব ভালো হয়েছে। আর পরোপকার করতে যাবে কখনো?
কুর্চি সাথেসাথে ফিরে সামনের দিকে পাথর মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল। যখনি স্টপ লাইটে বাস থামে, হাত দিয়ে যতটা পারছে চুল ঠিক করে নিচ্ছে। ইন্টার্ভিউএ ঢোকবার আগে আয়নার সামনে যাওয়া ফরজ কাজ এখন।
বদ্ধ উন্মাদ মেয়েকে তো আর কেউ চাকরি দেবে না!
চুল ঠিক করবার চেষ্টা করছে আরিয়ানও। রাবার ব্যান্ড থেকে অর্ধেক চুল বেরিয়ে গেছে। দুহাতে ঠিক করতে গিয়ে কী যেন হাতে ঠেকল। চুলে আটকে রয়েছে। ছাড়িয়ে নিয়ে না দেখেই পকেটে চালান করে দিল। নেমে দেখবে।
(চলবে)