#গল্পঃ_ও_চোখে_বৃষ্টি_এলে
#পর্ব: একাদশ
# Tuhina pakira
১১.
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ঘরে কোথাও পিয়ালকে দেখতে পেলো না সাম্য। সাম্য ঘরে গিয়েই ড্রেস চেঞ্জ করার জন্যে ওয়াশরুমে যাবার আগেই পিয়ালকে বলে গিয়েছিল, চুপ করে বিছানায় বসতে। দুই মিনিটের মধ্যেই মেয়েটা হাওয়া। আজ পিয়াল সাম্যকে খুব উত্যক্ত করেছে। সাম্য মাথার চুলগুলো চেপে ধরলো, পাশের টেবিলে রাখা জলের গ্লাস থেকে ঢকঢক করে জল টুকু খেয়ে নিলো।
অপরদিকে সাম্যের বাবাকে নিজের ঘরে যেতে দেখে পিয়াল মুচকি হেসে সাম্যের ঘরে ঢুকতেই কেউ ওর হাত গুলো টেনে ধরলো। রীতিমতো চমকে গিয়ে সাম্যের পরনের টি-শার্টের কলারের নীচে টেনে ধরলো। সাম্য নিজের সঙ্গে পিয়ালকে মিশিয়ে দাঁড় করিয়ে ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
-” কাকে বলে এসেছো এখানে?”
এতক্ষণ ভয়ের চোটে চোখ বন্ধ রাখলেও এবার পিয়াল চোখ খুলে সাম্যের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ হলো সাম্য ফ্রেশ হয়ে এসেছে তাই ওর মুখে মিশে রয়েছে এক শুদ্ধ ভাব, যা খুব করে পিয়ালকে টানছে। পিয়াল অপলক দৃষ্টিতে সাম্যের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ওর কাছে তো পুরো সময়ই থমকে গেছে। কিন্তু সময় তো কখনো থমকে দাঁড়ায় না, তা তো বহমান। পিয়ালের ঘোরের মাঝেই সাম্য পুনরায় একই প্রশ্ন করলো, তবে কিছুটা ধমকে।
-” কী হলো, কথা বলছোনা যে! ”
-” আমার ওই বাড়িতে ভালো লাগছিল না, তাই চলে এসেছি।”
পিয়াল যতই কিউট ভাবে সাম্য কে বোঝাক না কেনো, সাম্যের প্রশ্নের উত্তর খুব একটা ভালো লাগলো না। কী দরকার ছিল পিয়ালের এখানে আসার। সাম্য তো ওর বাবাকে চেনে, যদি আবোল তাবোল কিছু বলে দিতো! এই মেয়ে তো তা সহ্য করতে পারতো না। যদিও বা কিছু বলেছে কি সাম্য জানে না। আর পিয়াল ভুলেও ওকে এটা কখনোই বলবে না ওর বাবা কিছু বলে থাকলে। কিন্তু নিরবে কষ্টটা ঠিক অনুভব করবে।
-” আসার আগে আমাকে বলে এলে কী খুব ক্ষতি হতো।”
পিয়াল খুব আশা নিয়ে সাম্যের দিকে তাকিয়ে বললো,
-” আপনি কি তবে আমাকে এখানে আসতে দিতেন!”
-” না ।”
পিয়ালের মুখটা আশাহত হয়ে গেল। পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যারা কোনো কিছুতে ‘ না ‘ ঠিক করতে পারে না। আগেই তাদের ভাবনা হয়, সামনের মানুষটা যদি কিছু মাইন্ড করে! কিন্তু কিছু ব্যাক্তি আছে যারা মুখের উপর ‘ না ‘ বলতে কয়েক সেকেন্ড সময় ও নেয় না। আমি যদি তাকে বলি এটা করবে, কী ওখানে যাবে? সঙ্গে সঙ্গে যেনো তাদের ঠোঁটের গোড়াতেই একটা শব্দ থাকে ‘না’। সেই সব মানুষদের যদি হ্যাঁ কিংবা না সংক্রান্ত প্রশ্ন দেওয়া হয়, তারা যে সব উত্তরেই না লিখে আসবে, তা বলতে লাগে না। আর সাম্যও সেই গোত্রের লোক।
পিয়াল তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল, ” তাহলে আপনি এখানে কেনো এলেন?”
পিয়ালের নাক ফুলিয়ে থাকায় সাম্যের এবার হাসি পেলো। ডান হাতে পিয়ালের নাকটা খানিক টেনে দিয়ে পুনরায় ওকে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিয়ে বললো,
– ” এই যে ম্যাডাম নিজের জামাকাপড় গুলো নিয়ে চলে এসেছেন, কিন্তু টেবিলের উপরে যে তার অতি মূল্যবান ঔষধ গুলো নিয়ে আসেননি সে কি আপনার জানা আছে! যদিও বা আমার জানা মতে, সে ওটা ইচ্ছে করেই ওখানে রেখে দিয়ে এসেছে।”
পিয়াল চোরের ন্যায় এইদিক সেইদিক তাকাতে লাগলে সাম্য মুচকে হেসে ফেললো।
-” পাগলী টা। ”
আজ পুরো একটা মাসের কিছুটা বেশি সময় পর পিয়াল সাম্যের এই হাসি মুখ দেখতে পেলো। এই হাসির মধ্যে মিশে রয়েছে কিছু আনন্দ, ভালোলাগা, তৃপ্তি। তবে মাঝে যেই দিন ওদের রেস্টুরেন্টে দেখা হয়েছিল, কেনো যেনো পিয়ালের মনে হয়েছিল এই হাসিটা একটু অন্যরকম। পুরোনো চেনা মানুষের সাথে সেই দিনের হাসি মুখটা পিয়ালের কাছে অন্যরকম লেগেছিল।
পিয়াল যখন সাম্যের হাসি নিরীক্ষণ করতে ব্যস্ত, সেই মুহূর্তে নিজের গালে সাম্যের হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠলো পিয়াল। কেমন যেনো একটা শূন্য দৃষ্টিতে ওর চোখ চলে গেল সাম্যের চোখের মণি কোটায়। কিন্তু সাম্য ততক্ষনে ঝুঁকে পড়ল পিয়ালের দিকে, পিয়ালের গালে সাম্যের ঔষ্ঠ্যদ্বয় জোড়ার ছোঁয়া লাগতেই পিয়াল কেঁপে উঠল। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সাম্য কে, মিশে গেলো সাম্যের মধ্যে। সাম্য হেসে দিয়ে পিয়ালকে যত্ন করে আগলে নিলো। ফিসফিস করে বলে উঠলো,
-” ওহে প্রাণনাশিনী প্ৰণয়িণী চিরকালের জন্যে থেকে যেও, আমার এই ছোট্ট বুকের মধ্যে। খুব যত্ন করে আগলে রাখতে চাই। যতটা আগলে রাখলে হারানোর ভয় করবে না, প্রতিনিয়ত কেবল তোমার স্থানটা শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ হবে।”
সাম্যের কথা গুলো পিয়ালের বুকে গভীরের চোরা কুঠুরিতে গিয়ে যখন আবদ্ধ হচ্ছিল, পিয়ালের চোখ দিয়ে তখন ঝরে পরছিল জলের ধারা।
-” #ও_চোখে_বৃষ্টি_এলে আমার সারাটা বেলা কালো আঁধারে ছেঁয়ে যায় যে প্রাণায়িণী। ”
ππππππππππππ
দুই দিন পর,
আজ সাম্য দের বাড়িতে এসেছে পিয়ালের বাবা আর অভি। মূলত পিয়ালকে দেখতে এসেছে তারা।কিন্তু এসেও যে শান্তি নেই, দুই বাবার মধ্যেই শুরু হয়েছে কথাকাটাকাটির লড়াই। কলেজ লাইফে এই দুই জন ছিলেন খুবই ডেঞ্জারাস লোক। দুই জনে ছিল ছাত্র লীগের সঙ্গে জড়িত। তবে তা আলাদা গোষ্ঠীর। নানারকম কর্মকান্ডের দিক দিয়ে কারোরই কাউকে সহ্য হতো না, যার প্রভাব এখনও রয়েছে। কিন্তু পার্থক্য তারা কেউ আর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নেই। যেই চ্যাপ্টার তারা আজ থেকে তিরিশ- বত্রিশ বছর আগে ছেড়ে এসেছে।
দুই বাবা মাঝে মাঝে চুপ করছে, তো পরক্ষণে একে অপরকে নিয়ে বকেই চলেছে। বেশিরভাগ কথাই হচ্ছে সাম্য – পিয়ালের বিয়ে নিয়ে। এই সব কিছুর মধ্যে সাম্য বাড়িতে নেই, ওকে আজ অফিস যেতে হয়েছে।
পিয়াল অনেকক্ষণ ধরে সেই এক কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মাথা ব্যথাটা বেড়েছে। ওর শরীর এখনও পুরোপুরি ঠিক হয়নি। বেশিক্ষণ ও এখানে দাঁড়াতে পারছে না। তাই আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল।
ঘরে গিয়ে কোনমতে মাথা ব্যথার ঔষধটা খেতে না খেতেই ওর ফোনটা বেজে উঠলো। আননোন নম্বর হলেও, কেনো যেনো পিয়ালের মনে হলো এই নম্বরটা ও জানে। আগেও হয়তো কখনো ওর ফোনে এই নম্বর থেকে কল এসেছিল। ফোনটা রিসিভ করতেই ফোনের অপর দিক থেকে ভেসে এলো বহু পরিচিত একটা কণ্ঠ। পিয়াল সেই কণ্ঠ শুনেই বুঝেছে আজ তার ভাবনা গুলো আরও একটু মিললো। নাহলে ওর নেওয়া সিদ্ধান্তের মাঝে এই ফোন কলটা আসতো না।
-” সেই দিন তো ভালোই ছাদ থেকে পড়ার নাটক করে সাম্য কে নিয়ে গেলি, কিন্তু তাকে কতদিন আটকে রাখবে। না সে তোমাকে ভালোবাসে আর না তার পরিবার তোমাকে পছন্দ করে। জীবনে কোনদিন করবেও না। আঙ্কেল কতো আশা নিয়ে আমাকে তার ছেলের বউ করতে চেয়েছিল, শুধু তোমার জন্যে পারলো না। সাম্য তোমার সঙ্গে ব্রেকআপের সময় যেনো কী বলেছিল,* তুমি তো আদুরে, ন্যাকা টাইপ। ” আরও কিছু বলেছিল, ঠিক মনে পড়ছে না। সে যাই হোক, তোমার শরীরের ক্ষত দেখিয়ে তাকে ছিনিয়ে নিলেও তুমি কোনোদিন সুখী হবে না। আর আঙ্কেল তো বলেছিল,তোমাকে তার প্রাণ থাকতে মেনে নেবে না।”
পিয়াল পরপর কয়েকবার নিশ্বাস নিলো। যেনো ওকে দেখলে মনে হবে ওর শ্বাসকষ্টের রোগ আছে। চোখের জল গুলোও কেমন যেন একটা হয়ে গেছে, ছলছল করে তার অস্তিত্বের জানান দিলেও তা ঝরে পড়ছে না। নীচ থেকে চিৎকারের শব্দ আসছে। সব কিছু মিলিয়ে পিয়াল আর নিতে পারছে না। সাম্যের কিনে দেওয়া নতুন মোবাইল টা ওর থেকে দূরে ছুড়ে মেরে নীচে পা বাড়ালো।
অপরদিকে সামনে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মৈত্রী চোখ তুলে তাকালো। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, ” শায়ন। ”
πππ
পিয়াল সিঁড়ির কাছে আসতেই পা জোড়া ওর থেমে গেলো। বারে বারে মনে হচ্ছে ও আর হয়তো সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না, হয়তো এক্ষুনি এখান থেকেই নীচে পরে যাবে। কিন্তু পিয়াল যথাসম্ভব নিজেকে সামলে নিলো। এই মুহূর্তে ও এমন কিছু শুনলো, যার জন্যে ওর মনে হচ্ছে এখন যদি ও পরে যায় ও কোনোদিন আয়নায় ওর চোখের সাথে চোখ মেলাতে পারবে না। নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিয়ে হয়তো মেরে ফেলবে।
-” আমি তো গ্যারেন্টি দিয়ে বলতে পারি আপনার মেয়ে সেইদিন ইচ্ছে করে পড়ে গিয়েছিল, যাতে আমার ছেলেকে ফাঁসাতে পারে। বলা যায় না, আপনি হয়তো শিখিয়েছেন।”
সাম্যের বাবা রাগের মাথায় যে কী বললেন, তা তার বোঝার মতো মানুষিকতা নেই। তিনি বুঝতেও পারলেন না, তিনি কি বললেন।
সাম্যের বাবার কথায় পিয়ালের বাবা কিছু বলতে যেতেই, সাম্যের বাবার চোখ গেলো, পিয়ালের দিকে,
-” এই মেয়ে তুমি সেইদিন ইচ্ছে করে পড়ে গিয়েছিলে না, যাতে সাম্য বিয়েটা না করে!”
পিয়াল আস্তে করে নীচে নেমে গেল। এতসব কান্ডের মধ্যে সাম্য বাড়িতে আসতেই, বাবার কথায় থমকে দাঁড়ালো। পিয়াল সাম্যের বাবাকে কিছু বললো না, সোজা চলে গেল সাম্যের সামনে। সাম্য পিয়ালের চোখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল, কিছু বলার ভাষা তার নেই।
-” আপনি বলেছিলেন, আমাকে ভালোবাসেন না আর। সময়ের ফারাকে আমি ফ্যাকাশে হয়ে গেছি। আমি আপনাকে যেনো কখনই না ডিস্টার্ব করি। আপনার নিশ্চয় মনে আছে, আমি যাইনি আপনার কাছে। শুধু নিজেকে সামলাতে না পেরে কেবল আপনার বিয়ের দিন আপনাকে অভিনন্দন জানিয়ে ছিলাম। আসলে ভালোবাসা তো তাই কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু এই কথাটা আপনাকে বলার ছিল, আমি ইচ্ছে করে ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে, আপনাকে নিজের কাছে ডেকে আনার চেষ্টা তো দূর কল্পনাতেও তা আনিনি। সেইদিন যে কী হয়েছিল, কেমন পাগল পাগল লাগছিল। চারিদিকে আপনাকে দেখছিলাম। আর সেই মুহূর্তে কখন যে পরে গেলাম, মনেই নেই আমার। তবে এটা সত্যি যে আমার কারণেই আপনাদের বিয়েটা ভেঙে গেছে। সব ঠিক করতে হয়তো পারবো না। যেটুকু পারি, কেবল নিজেকেই নাহয় আপনার কাছ থেকে সরিয়ে নিলাম। ”
পিয়ালের কথায় উপস্থিত সকলে মায়া নিয়ে ওর দিকে তাকালো। পিয়াল ও সাম্যের বাবার মুখটা ততক্ষনে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
-” আমাদের সম্পর্ক টা না চাইতেও জুড়ে গেছে। কিন্তু এই বিয়েতে কারোরই মত নেই। এই সম্পর্কে এই ভাবে দুঃখ কুড়াতে তো পারলাম না সাম্য। আমার তবে যাওয়া উচিত। ”
পিয়াল এলোমেলো পায়ে বাইরের দিকে যেতে গেলে সাম্য ওর হাত টেনে ধরলো।
-” তোমাকে সব থেকে বড় কষ্টটা নিজের অজান্তে আমিই দিয়েছি। কিন্তু তা বলে ছেড়ে যেও না।”
পিয়াল পিছন ফিরল না, ওইভাবেই বললো,
-” তুমি হয়তো আমাকে ভালোবাসো, কিন্তু তোমার আমার ভালোবাসাটা এইটুকুই ঠিক আছে। বাকিটা যে তা সুখকর হবে না। ”
সাম্য পিয়ালের হাতটা ছেড়ে দিল, চাইলেই আটকাতে পারে ও। কিন্তু এখনও কিছুটা সময় যে তাদের মিলনের বাকি। তাই হয়তো আজ সাম্য ওর হাত টা ছেড়ে দিল।
তীব্র মাথাব্যথায় এলোমেলো পায়ে পিয়াল বেরিয়ে গেলো। তা দেখে অভি বাইরে ছুট লাগালো। তার আগে দুই বাবাকে বলে গেলো,
-” আনন্দ লাগছে না খুব! ”
সাম্য পিয়ালকে যেতে দেখেই ও ওর ঘরে চলে গেল। হাঁটু ভাঁজ করে মেঝেতে বসে বিড়বিড় করে বললো,
-” আমি কি তোমায় হয়তো ভালোবাসি পিয়াল! তোমার কি তাই মনে হলো?”
(চলবে)