#গল্পঃ_ও_চোখে_বৃষ্টি_এলে
#পর্ব: দশম
# Tuhina pakira
১০.
-” তোমার মা-বাবা কেমন আছে অভি?”
মা – বাবার কথা শুনে পিয়াল শান্ত চোখে ওর দাদার দিকে তাকালো। এতক্ষণ ও সামান্তা এর সঙ্গে কথা বলছিল। অভি বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বললো,
-” আসলে আঙ্কেল আমাকে জন্ম দিয়ে মা মারা যায়। তারপর মামা – মামী আমাকে বড়ো করে তোলে।”
খুব ছোটো বেলায় মা হারানোয় অভির তো মায়ের কথা মনেও পড়ে না। মামা – মামী যাকে নিজের ছেলের মতো মানুষ করেছে তার আর কি চাই। মা কে ওর মাঝে মাঝে মনে পড়ে কিন্তু ও কখনো তার জন্যে কষ্ট পায় না। ও চায় না ওর মা ওই আকাশ থেকে ওকে এইভাবে দেখে কষ্ট পাক। ছোটবেলায় একদিন ওর মামী বলেছিল, ‘অভি বাবা মায়ের জন্যে মন খারাপ করলে কখনো কাঁদবি না, প্রাণ খুলে হাসবি। তুই হাসলেই তোর মা মেঘের ওপারে ভালো থাকবে, হাসবে।’ সেই কথাটা অভি এখনও মেনে আসছে। তবে ও ছোটো বেলায় পিয়ালের মা বাবাকে মা – বাবা বললেও বড়ো হওয়ার পর যখন জানলো তারা ওর মামা – মামী সেই থেকে আর তাদের মা – বাবা বলেনি। ও চায় ওর মা একজনই থাক।
এখানে উপস্থিত সকলে ওর দিকে করুন চোখে তাকিয়ে রয়েছে, এতে ওর কিছু মনেই হয়নি। ও বেশ নর্মাল ভাবেই কথাটা বললো।
-” তোমার বাবা! কিছু মনে করো না। মনে হলো তাই, ”
-” না না আঙ্কেল কি মনে করবো। বাবার মনে হয় দুটো ছেলেমেয়ে রয়েছে। সে তার জীবনে আর আমি আমার জীবনে ভালোই আছি। সবাই মন প্রাণ দিয়ে কাউকে ভালো বাসতে পারে না। যদি পারতো, তাহলে নিশ্চয় মা মারা যাবার কয়েকদিনের মধ্যেই অন্য কাউকে বিয়ে করে আনতো না। আর না আমার পরিচয় হতো অনাথ। আসলে কি বলুন তো, এই পৃথিবী থেতে যে চলে যায়, তার জন্যে অপেক্ষা তো করা যায় না। তেমনি অনেকেই তাকে মনে করে এক ফোঁটা চোখের জল ও ফেলে না। যে যায় সে কেবলই চলে যায়। একদিন এই পৃথিবী থেকে তার স্মৃতিও মুছে যায়।”
পিয়াল এতক্ষণে কেঁদে ফেলেছে। চোখের জল টা মুছে বললো,
-” খবরদার দাদা ভুলেও নিজেকে অনাথ বলবিনা। বাবা কী বলে মনে নেই তুই আমার একমাত্র দাদা। আমরা তাদের একমাত্র ছেলে আর মেয়ে।”
অভি হেসে দিল পিয়ালকে দেখে।
-” আরে তুই কাঁদছিস কেন! আঙ্কেল জানতে চাইলো তাই বললাম। ”
-” দাঁড়া না বাবা কে একবার খালি বলবো, তুই আমার শ্বশুর বাবার কাছে বলেছিস তুই অনাথ। তাহলে তোর যে কী অবস্থা করবে বুঝবি।”
-” কেনো আমাকে বলেছে তো কী হয়েছে! ”
” কী আবার হবে আপনারা তো দুই জন দুই জনের জাত শত্রু।”
সাম্যের বাবা গলা খাকরি দিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই সাম্যের মা ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে হলরুমে এলো। এতক্ষণ তিনি তার ঘরে গিয়েছিলেন।
-” পিয়াল আমার কাছে এসো, আমি তোমার মাথার ব্যান্ডেজ টা ঠিক করে দিই। জলে ভিজে গেছে তো।”
-” আসলে মা আমি ভুল করে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে ফেলেছি।”
সাম্যের বাবা গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
-” যাও মা, ব্যান্ডেজ করে উদ্ধার করো। আমার গর্দভ ছেলে তো ঠিক মতো ব্যান্ডেজ করতেও শেখেনি। ”
-” আঙ্কেল এখানে সাম্যের দোষ নেই। সাম্য তো বাড়িতেই ছিল না। ও নিজেই ব্যান্ডেজ করে একা একা এখানে এসেছে। আমিও তো ওর কাছে যাচ্ছিলাম। ও ফোন করে বলল, সাম্যের বাড়ি চলে আসতে। ”
-” খবরদার, এটা সাম্যের বাড়ি বলবে না। এটা সাম্যের বাড়ি না। যে ছেলে বাপের সম্মান রাখে না, সে এই বাড়ির কেউ না।”
কথাটা বলতেই চৌধুরী বাবুর চোখ গেলো তার স্ত্রীর দিকে। তিনি অত্যন্ত কঠোর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তাই ভয়েই তিনি চুপ করে গেলেন। সামান্তা কথা ঘুরিয়ে বললো,
-” মা বক্সটা দাও আমি ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি। ”
সকলের অজান্তে পিয়াল ওর চোখের জলটা মুছে ফেললো। তবুও যেনো চোখটা ছলছল করে উঠছে। সামান্তা পিয়ালের মাথার পুরোনো ব্যান্ডেজ টা খুলে ক্ষতটা দেখে বললো,
-” খুব গভীর ভাবেই কেটেছে। ”
-” আস্তে আস্তে কর। লাগে না যেনো। ওর বাবা কে তো জানিস না, একটা ঘুষি মারবে সোজা নিজের শ্বশুর বাড়ি চলে যাবি।”
সাম্যের বাবার কথা শুনে সাম্যের মা ও পিয়াল হেসে দিল। হাসলো না কেবল সামান্তা আর অভি। সামান্তা আড়চোখে একবার অভির দিকে তাকালো, সেও ওর দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। সামান্তা সঙ্গে সঙ্গে নিজের চোখ সরিয়ে ফেললো।
-” আহ্, লাগছে। ”
-” এই তো বৌদি একটু, তুলোর কিছু অংশ কাটা জায়গায় আটকে গেছে, তাই তোমার লাগছে।”
-” তুই ছাড়, আমি করছি।”
সাম্যের রাগী গলা শুনে পিয়াল চমকে উঠলো। সাম্যের মা তো খুব খুশি হয়েছে।
সাম্য নিজেই পিয়ালের মাথায় ব্যান্ডেজ করে দিল। এইবার রীতিমতো ভয়েই পিয়াল এতটুকুও টু শব্দ করলো না।
-” বাবা কেমন আছিস?”
-” আমি ভালো আছি মা। তুমি কেমন আছো?”
-” আমিও ভালো আছি। তুই বোস, দুপুর থেকে কিছু খাওয়া হয়নি নিশ্চয়!”
-” না মা আমি কিছু খাবো না। আমি পিয়ালকে নিয়ে যেতে এসেছি।”
-” সাম্যের মা ছেলেকে বলে দাও যেতে হলে যেনো নিজে একা যায়, এই মেয়ে কোথাও যাবে না।”
-” যাবে না মানে, অবশ্যই যাবে। এই মেয়ে তুমি এখানে কেনো এসেছো! চলো এখান থেকে।”
বাপ ছেলের মুখে ‘ এই মেয়ে ‘ শুনে পিয়াল বলে উঠলো,
-” আমার নাম পিয়াল, আর আমি এখান থেকে কোথাও যাবো না, মানে যাবো না।”
সাম্য কোনো ভাবেই পিয়ালকে নিয়ে যেতে না পেরে নিজের হাল ছেড়ে দিয়েছে। এখন আপাতত সে মায়ের হাতে খাবার খাচ্ছে। আর ওর বাবা গম্ভীর মুখে ছেলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আর পিয়াল একবার তার স্বামী তো একবার তার বরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অপরদিকে সামান্তা গেছে অভিকে গেস্ট রুম দেখিয়ে দিয়ে আসতে।
πππππππππππππππππππ
-” আপনি রেস্ট নিন, আমি আসছি।”
অভি কে রুমে পৌঁছে দিয়ে সামান্তা চলে যেতে গেলে অভি বললো,
-” গত সপ্তাহেও তুমি আমাকে ‘ তুমি ‘ বলে ডাকতে। আজ হঠাৎ কি হলো।”
-” কী হবে কিছুই না।”
-” আর তো আমাকে প্রতিদিন সকালে ‘ শুভ সকাল অভি বাবু ‘ এসএমএস পাঠাও না। কিংবা ছুটির দিনে আমার বাড়ির কাছের লেকে এসে আমাকে ডিস্টার্ব করো না। এমনকি আগের মতো ফলোও করো না। কেনো জানতে পারি?”
সামান্তা চলেই যাচ্ছিল, কিন্তু অভির কথা শুনে ঘুরে তাকালো ওর দিকে। অভির মুখে এই কথা কেনো? তবে কি ও সামান্তাকে মিস করে! পরক্ষনেই সামান্তার মনে হলো, অভি কেনো ওকে মিস করবে ওর তো ভালোই হয়েছে। এই মেয়েটা আর ওকে ডিস্টার্ব করে না।
গত দুই বছর ধরে সামান্তা অভিকে ভালোবাসে। কতবার ছেলেটাকে বলেওছে। কিন্তু ছেলেটা প্রতিবার ওকে ইগনোর করে গেছে। বলতে গেলে রোজ সামান্তা অভিকে ডিস্টার্ব করেছে। কখনো ওকে ফোন করে, কখনো ওকে ফলো করে, কখনো ওর পথ আটকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বকে বকে। কিন্তু তাও অভির দিক থেকে কোনো সাড়া আসেনি। এই কয়েকদিন হলো সামান্তা আর অভির ধারে কাছেও যায়নি।
-” কী হলো বললে না!”
-” আসলে আমি আপনাকে এতদিন ডিস্টার্ব করার জন্যে সরি। আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে আমার জন্যে আর কোনো রকম অসস্তিতে পড়তে হবে না।”
-” হঠাৎ এই কথা!”
ভ্রু কুঁচকে অভি কথাটা বলতেই সামান্তা যেনো অভির মাঝে হারিয়ে গেলো। এই ছেলেটার সব লুকেই ও ঘায়েল। সামান্তাকে চুপ করে থাকতে দেখে অভি ওর দিকে সামান্য ঝুঁকে হাত নেড়ে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করলো।
-” সরি, আসলে আপনাকে ভোলার চেষ্টা করছি।”
অভি ঠোঁট চেপে হেসে সামান্তার দিকে তাকিয়ে বললো,
-” আমি অনাথ তাই কি আমাকে ভোলার কারণ!”
কথাটা সামান্তার শ্রুতিগোচর হওয়া মাত্রই ও অভির মুখে হাত দিয়ে ওর কথা বলা বন্ধ করে দিলো।
-” এই সব কি বলছেন!”
অভি নিজের মুখ থেকে সামান্তার হাত সরিয়ে দিলো।
-” তাহলে আমাকে ভোলার চেষ্টা কেনো?”
সামান্তা কোনো মতে নিজের চোখের জল ধরে রেখে বলল,
-” আমি মৈত্রী হতে চাই না। আমার ভালবাসা আপনি, আপনিই থাকবেন। কিন্তু আমি তা সকলকে জানিয়ে আপনাকে ছোটো আর করবো না। আপনি ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকবো। আপনাকে জোর করে আমি চাইব না। জোর করে আর যাই হোক ভালোবাসাটা পাওয়া যায় না। ”
সামান্তা বাইরের দিকে পা বাড়ালো। কিন্তু যেতে পারলো না। তার আগেই অভি ওর হাত ধরে নিজের কাছে নিয়ে এলো।
-” কিন্তু এখন যদি বলি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। ”
সামান্তা যেনো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কিছুক্ষণ অবাক চোখে অভির দিকে তাকিয়ে রইল।
-” হ্যাঁ সামান্তা আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি।”
সামান্তার মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো,
-” আমি বৌদিকে সেই দিন রক্ত দিয়েছি, তাই আপনি আমাকে ভালোবাসেন বলছেন, তাইনা। আপনি হয়তো ভাবছেন আমি আপনার জন্যে রক্ত দিয়েছি। বিশ্বাস করুন সেই রকম কিছু না। আমি তো জানতামই না আপনি বৌদির দাদা। সেই দিন সেখানে আপনাকে দেখে আমি নিজেই অবাক হয়েছিলাম।”
অভি সামান্তার দুই বাহু ধরে নিজের কাছে এনে বললো,
-” আমি এতটাও স্বার্থপর না সামান্তা। হ্যাঁ আমি হয়তো কখনো তোমাকে মেনে নিই নি, তবে সেই দিন সন্ধ্যা বেলা যখন নিজের চোখে সাম্য আর পিয়ালের অবস্থা দেখলাম, তখনই বুঝেছি, আমি আমার সত্যি কারের ভালোবাসাকে নিজের হাতে দূরে সরিয়ে আসছি প্রতিনিয়ত। তুমি যখন প্রতিদিন আমার সঙ্গে দেখা করতে, প্রথম প্রথম বিরক্ত হলেও পরে তোমাকে রোজ দেখতে চাইতাম। কেনো তা তখন জানতাম না। সাম্য আর পিয়ালের জন্যেই আমি এত তাড়াতাড়ি তোমার ভালবাসটা বুঝলাম। নাহলে হয়তো আজও তোমাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিতাম। ”
সামান্তা অদ্ভুত ভাবে অভির দিকে তাকিয়ে রইল।
-” সত্যি ভালোবাসো!”
-” তিন সত্যি।”
πππππππππππ°°
-” এই মেয়ে এখানে না বসে থেকে ঘরে গিয়ে ঘুমাতে পারছো না।”
পিয়াল টিভির চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে বললো,
-” আমি কেনো যাবো, আপনিও তো পারেন গিয়ে একটু ঘুমাতে। কিন্তু তা না করে বসে বসে কী করছেন, টিভি দেখছেন।”
-” আমি এই সময় টিভি দেখি, ঘুমাই না।”
-” আজ থেকে এখন ঘুমাবেন, আর না হলে বই পড়বেন। কিন্তু টিভি দেখবেন না। সন্ধ্যে বেলা টিভি দেখবেন। ”
-” সাম্য তুমি এই মেয়েকে কোথায় পেয়েছো? শ্বশুরের মুখে মুখে কথা বলে।”
সাম্যের মা হেসে বলল, ” ওই পারবে তোমাকে শায়েস্তা করতে। যাও ঘরে যাও।”
-” যাবো না।”
-” তাহলে আমিও যাবো না।”
-” পিয়াল কী হচ্ছে, চলো ঘরে চলো। তোমার এখনও মেডিসিন নেওয়া বাকি।”
-” হ্যাঁ হ্যাঁ, যাও তো।”
-” আপনি না গেলে আমি এখন থেকে নড়বনা।”
শ্বশুর, বৌমার মধ্যে কিছুক্ষণ কথা কাটাকাটি হলে সাম্যের বাবা হার মেনে বললো, ” যাচ্ছি। তুমিও যাও।”
-” চলুন।”
পিয়াল সাম্যের সঙ্গে উপরের দিকে পা বাড়ালো। পিয়ালকে যেতে দেখে সাম্যের বাবা রিমোট হাতে বসে গেলো। তা দেখে তার স্ত্রী বললো,
-” তুমি না ঘরে যাবে বললে!”
-” যাবতো, এই একটা সিরিয়াল দেখে নিই, তারপর।”
এই যে তিনি একটা সিরিয়াল বললেন, এটা যে কতগুলো সিরিয়াল হবে তা একমাত্র তিনিই জানেন।
-” ধুর টিভি চলছেনা কেনো, রিমোট কী খারাপ হলো নাকি?”
উপরে সাম্যের ঘরের সামনের রেলিঙে হাত দিয়ে পিয়াল বললো,
-” কারণ রিমোটের ব্যাটারি আমার কাছে।”
নিজের বৌমার কান্ড দেখে চৌধুরী বাবু হাঁ করে উপরে পিয়ালের দিকে তাকিয়ে রইল। সাম্যের মা ‘ঠিক হয়েছে’ বলে নিজের ঘরে গেলো। সারাদিন অনেক তার খাটা খাটনি গিয়েছে, একটু রেস্ট নিতে হবে তাকে।
( চলবে)
{বিঃ : ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। হ্যাপি রিডিং।। }