#গল্পঃ_ও_চোখে_বৃষ্টি_এলে
#পর্ব: অষ্টম
# Tuhina pakira
৮.
বাইরে থেকে আসা ঝড়ো হাওয়ায় ঘরের জানালা গুলো অনবরত নড়ে চলেছে। বিদ্যুতের ঝলকানি সাম্যের চোখে এসে পড়তেই, সাম্য হড়বড় করে চোখ খুলে উঠে বসলো। বোধগম্য হলো বৃষ্টি হবে। ঘরে আলো নেভানো, বাইরে বসার ঘরের আলো এসে ঘরে কিছুটা আলো দেখা যাচ্ছে। সাম্য সেই আলোয় হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে ফোনটা নিয়ে সময় দেখলো। তারপর হাত বাড়িয়ে ঘরের লাইটটা জ্বালিয়ে বিছানা থেকে নামলো। হঠাৎই চোখে পড়লো পাশের জায়গাটা খালি, পিয়াল কী তবে ওয়াশরুমে! সাম্য ওয়াশরুমে গেলেও দেখলো সেখানে পিয়াল নেই। কী মনে করে ঘরের বাইরে চলে গেল সাম্য।
রান্নাঘরের লাইট জ্বলছে দেখে সাম্য সেই দিকে এগিয়ে গেলো। কিছুটা যেতেই সাম্যের চোখে পড়লো পিয়ালকে, শাড়িটা কোমরে পেঁচিয়ে, খোঁপা বেঁধে কিছু একটা করছে। সাম্য আস্তে আস্তে গিয়ে পিয়ালকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। আচমকা ব্যাপারটা ঘটায় পিয়াল চমকে সাম্যের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো। পিছন ঘুরতে গিয়েও ঘুরলো না, পিছনে ঘুরলেই আজ তাকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না।
-” আরে এটা আমি ভয় পেয়ো না। ”
পিয়াল কিচ্ছু বললো না চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। ভয়ে এখন ওর হাত পা ভীষণ ভাবে কাঁপছে।
-” কী করছো তুমি? তুমি জানো না তোমার শরীর খারাপ! চলো ঘরে চলো।”
সাম্যের কথার কোনো উত্তরই পিয়ালের কাছে নেই। আর ও চেয়েও যেতে পারছে না।
-” আপনি যান আমি আসছি।”
পিয়ালের মুখে আপনি শুনে শুনে সাম্যের কান ঝালাপালা হয়ে গেছে, তাই বেশ মলিন মুখেই বললো,
– ” এই তুমি কি সবসময়..”
কিন্তু সাম্যের কথা শেষ হলো না, তার আগেই পিয়ালের হাতের সংস্পর্শে মনে হলো হাতে তরল জাতীয় কিছু লেগেছে। পিয়ালকে ছেড়ে সাম্য সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিজের হাত দেখে থমকে গেলো, ‘ রক্ত ‘ কোথা থেকে এলো?
-” পিয়াল তুমি!”
সাম্য পিয়ালকে নিজের দিকে ফিরিয়ে দাঁড় করিয়ে থমকে গেলো। কপাল থেকে ব্লিডিং হচ্ছে। আর এই মেয়ে চুপ করে তাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঠিক সময়ে ভাগ্যিস সে এসেছিল।
-” এই সব কি! কী করে হলো! তোমাকে আমি বারণ করেছিলাম, কতবার বলেছি যা দরকার আমাকে বলবে। কিন্তু না তুমি তো সে মেয়ে না। এখন হলো তো। চলো আমার সঙ্গে।”
সাম্য তাড়াতাড়ি করে পিয়ালকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিল। ছুটে গিয়ে ফাস্টের্ড বক্সটা নিয়ে এসে পাশের টেবিলে রাখলো। সাম্যের নিজেকে খুব রাগ ধরছে, কেনো যে ও এই অবেলায় ঘুমাতে গেল! তাহলে তো এই সব কিছু হতো না।
পিয়াল তখন নিজের কপালের এক দিকটা ধরে চোখ কুচকে বসে রয়েছে, বড্ড জ্বলছে ক্ষতস্থানটা। সাম্য নিজের রাগকে কন্ট্রোল করতে দ্রুত কয়েকবার জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে পিয়ালের মলিন মুখের দিকে তাকালো। পুরোনো ব্যান্ডেজটা খুলে আস্তে আস্তে নতুন ব্যান্ডেজ করতে লাগলো। পিয়াল চুপ করে সাম্যের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, এখন যদি ও ব্যাথা লাগছে বলে চিৎকার করে তাহলে ওর যে কী হাল করবে, কে জানে ?
-” তোমার আমাকে জ্বালাতে খুব ভালো লাগে না! ”
সাম্য শান্ত গলায় কথাটা বলতেই পিয়াল করুণ দৃষ্টিতে সাম্যের দিকে তাকিয়ে রইল। পিয়ালের মনে চলছে অন্যকিছু, সাম্য এখানে ‘জ্বালাতে’ বলতে কি সেই দিনের কথা বলছে!
পিয়ালকে চুপ করে থাকতে দেখে সাম্য ধমক দিয়ে বলল, ” কী হলো কি বলছি, তোমার কি আমাকে জ্বালাতে খুব ভালো লাগে! ঠিক মতো দেখেশুনে না হেঁটে সেইদিন তো ছাদ থেকে পড়ে গেলে, আর আজ , কী করলে এটা! কপালে কিভাবে লাগলো? তুমি কি বাচ্চা, দেখে চলতে পারো না? তোমাকে কে বলেছে রান্নাঘরে যেতে! আমি বলেছি? সবেতে এক্সট্রা পাকাপনা কে করতে বলেছে?”
সাম্যের কথা গুলো শুনে পিয়ালের খুব খারাপ লাগছে। ওর মন বারবার বলছে সাম্য ওকে এটাই বলতে চাইছে, ওর জন্যে ওর আর মৈত্রীর বিয়েটা হয়নি। ইশ, সেই দিন কেনো যে ও পরে গেলো, আর পরেই যদি গেলো মরে গেলেই তো হতো। আর যাই হোক এই মানুষটাকে জ্বালাতে তো আসতো না। আর পিয়াল তো জানে এই মানুষটা ওকে ভালোবাসে না, কোথায় ও আর কোথায় মৈত্রী। দুজনের মধ্যে কম্পারেশন করলেও সেখানে পিয়ালকে ঠিক মানায় না। পিয়াল তো জানে, ও বড্ড আদুরে, এক কথায় ন্যাকা। কথা গুলো ভাবতেই নিজের প্রতি এক তাচ্ছিল্যের হাসি এলো পিয়ালের।
পিয়ালকে চুপ করে থাকতে দেখে সাম্য এবার ধমক দিয়ে বলল, ” কী হলো বলো!”
শেষের কথাটায় পিয়াল প্রায় চমকে উঠলো। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। পিয়াল যথা সম্ভব নিজেকে শান্ত করে সাম্যের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল,
-” সরি, আসলে আমি বুঝতে পারিনি। আপনি ঘুমাচ্ছিলেন দেখে আমি রান্না ঘরে গিয়েছিলাম।”
একেই সাম্য রেগে ছিল, তার উপর আবারো পিয়ালের মুখে ‘ আপনি ‘ সম্বোধন শুনে যেনো ও আরও রেগে গেল। পিয়ালের দুই বাহু ধরে ধমক দিয়ে উঠলো,
-” এই মেয়ে, কী আমাকে সবসময় আপনি বলে যাচ্ছো! সেই দিন ফোনেও আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করে ছিলে। কী চাইছো তুমি! নিজেকে আঘাত করে, আমাকে কষ্ট দিতে! কী চাইছো?”
পিয়াল তীব্র ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠলো। তা দেখে সাম্য ওর হাতটা ছেড়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। পিয়াল ছলছল চোখে একবার সাম্য কে দেখে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো,
-” আপনাকে চিন্তা করতে হবে না আমাকে নিয়ে। আমি চলে যাবো এখান থেকে। আপনাকে আমার জন্যে আর কোনো কষ্ট করতে হবে না।”
পিয়ালের কথা শুনে সাম্য মাথা তুলে পিয়ালের দিকে তাকালো। এতক্ষণ ও মাথা নীচু করে বসে ছিল। রাগী গলায় পিয়ালকে কিছু বলবে তার আগেই পিয়ালের দিকে তাকিয়ে থেমে গেল সাম্য। পিয়াল আর কিছু না বলে ব্যালকনির দিকে পা বাড়ালো। সাম্য পিয়ালের হাত ধরে ওকে আটকে দিলো।
-” ওই দিকে কোথায় যাচ্ছো? দেখছো না বাইরে ঝড় উঠেছে। ”
-” আমার হাতটা ছাড়ুন।”
-” ও তোমার হাত ছাড়তে হবে তাইতো! যদি না ছাড়ি, কী করবে? ”
পিয়ালের হাতটা টেনে নিজের বুকে টেনে নিলো সাম্য। পিয়ালকে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে দুই হাতের মধ্যে যত্ন করে আগলে রেখে বললো,
-” তুমি বাইরে যাবে না পিয়াল, দেখো বৃষ্টি এসে গেছে। বিদ্যুৎ ও চমকাচ্ছে।”
পিয়াল নিজেকে সাম্য এর থেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বললো, ” প্লিজ ছাড়ুন। আমার ভালো লাগছে না এখানে। ”
-” আমি না ছাড়লে পারবে আমার থেকে নিজেকে ছাড়াতে। দেখছোনা কতো যত্ন করে তোমাকে আগলে রেখেছি। এই বাঁধন থেকে কেউ কোনোদিন আমাদের আলাদা করতে পারবেই না। ”
পিয়াল হালকা হেসে সাম্য এর জামার কলারটা হালকা করে টেনে ধরলো। সাম্য অবাক হয়ে পিয়ালের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল।
-” আপনি তো আমাকে অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছেন। নতুন করে আর কি আগলে রাখবেন। ঠিকই তো বলেছেন আপনি না চাইলে কেউ আমাদের কোনো দিন আলাদা করতে পারবে না। নিজেই তাই আমাকে আলাদা করে দিয়েছেন। তাইনা মিস্টার সাম্য, উডবি হাসব্যান্ড অফ মৈত্রী। উফফ, সরি একটা ভুল হলো – ভুল করে আমাদের বিয়েটা হয়ে গেছে। ”
পিয়ালের কথা গুলো শুনে সাম্যের হাত আলগা হয়ে গেল। পিয়ালকে ছেড়ে সাম্য হনহন করে ঘরের বাইরের দিকে এগিয়ে গেল। ঘরের দরজা টা খুলে পিছন ফিরে একবার পিয়ালকে দেখে পাশের দেওয়ালে একটা ঘুষি মেরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। পিয়াল ওর যাবার দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো।
-” এতো সহজে ছেড়ে দিলে সাম্য। এটা তোমার ভালোবাসা না আমার ব্যর্থতা!”
———-
পিয়াল বেলকনিতে রাখা ছোটো সোফাটায় হেঁটুতে মাথা রেখে জড়সরো হয়ে বসে রয়েছে। আশেপাশের পুরো এলাকাই অন্ধকার, কিছুক্ষণ হলো কারেন্ট গিয়েছে। এই অন্ধকারের মধ্যেও পিয়ালের দৃষ্টি বাইরের বর্ষণ ধারা ঠিকই বুঝতে পারছে।
আকাশের মন খারাপ হলে সে কি সুন্দর ভাবে গর্জন করে ওঠে। মেঘমালার বৃষ্টি রূপে ঝড়ে যায়। কিন্তু ওর বুকের ভিতরের যে তীব্র বেদনা, যে মনখারাপ তা কী করে ভালো হবে? তা পিয়ালের জানা নেই। পিয়াল খুব করে কাঁদতে চায়, কিন্তু কিছুতেই চিৎকার করে কাঁদতে পারছে না। তীব্র মাথা ব্যথায় চোখের জল গুলো ওর সঙ্গে শত্রুতা করছে।
আচমকা কেউ ছুটে এসে পিয়ালের পাশে বসে ওকে জড়িয়ে ধরলো। পিয়াল নিভু নিভু চোখে সাম্যের দিকে তাকিয়ে মলিন মুখে বললো,
-” কিছু বলবেন?”
পিয়ালের মুখে নিজের হাত দিয়ে সাম্য ওকে থামিয়ে দিল। পিয়ালের মাথায় ভালবাসার পরশ দিয়ে ওর চোখের দিকে তাকালো। অন্ধকারের মধ্যেও তারা দুজনে একে অপরকে ঠিকই অবলোকন করতে পারছে।
-” আরেক বার আপনি বললে কী করবো জানো?”
পিয়াল নিজের মুখে থাকা সাম্যের হাতের দিকে তাকিয়ে ইশারায় সাম্য কে কি বোঝালো। সাম্য হেসে উঠে দাঁড়ালো সোফা থেকে। তারপর পিয়ালকে কোলে তুলে নিয়ে ব্যালকনির রেলিঙের দিকে এগিয়ে গেল। বৃষ্টির ফোঁটা আস্তে আস্তে ওদের ভিজিয়ে দিচ্ছে। পিয়াল নিভু নিভু চোখে সাম্য কে দেখে রেলিঙের দিকে তাকালো।
-” চিন্তা নেই তোমাকে ফেলবো না। তোমাকে ফেলার আগে আমি নিজেকেই না ঐখান থেকে ফেলে দিই।”
-” যদি আমাকে ফেলে না দেবেন তাহলে কি করবেন?”
-” এই তুমি আবারও আমাকে আপনি বললে! দেখাচ্ছি কী হবে। ”
সাম্য পিয়ালকে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলো। পিয়াল সাম্যের দিকে মলিন চোখে তাকিয়ে রইল। সাম্য পাশের ড্রয়ার থেকে ক্যান্ডেল গুলো বের করে জ্বালিয়ে দিল।
পিয়ালের চোখে পড়লো পাশের টেবিলে রাখা খাবার গুলোর দিকে। সাম্য পিয়ালের বানানো চাওমিন এর সঙ্গে নিজের হাতে চিলি চিকেন বানিয়ে নিয়ে এসেছে।
-” হাঁ করো!”
-” তুমি,”
-” হ্যাঁ এতক্ষণ ধরে তোমার জন্যে আমি রান্না করেছি। নাও খেয়ে নাও। ”
সাম্য খাবারটা পিয়ালের মুখে তুলে দিয়ে ওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
-” আপনি খাবেন না?”
-” তোমার মুখে তুমি ডাকটাই সুন্দর। আপনি বলে পর করে দিও না। ”
পুরোটা সময় পিয়াল কেবল সাম্য কে দেখেই কাটিয়ে দিল। দুজনের খাওয়া শেষে সাম্য পিয়ালকে ঔষুধ খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বাইরে প্লেট গুলো রেখে এলো।
পিয়াল চোখ বন্ধ করতেই মনে হলো কেউ ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরেছে। চোখ খুলতেই সঙ্গে সঙ্গে সাম্য পিয়ালের চোখে ভালোবাসার পরশ দিয়ে নিজের বুকের সঙ্গে পিয়ালকে সাবধানে জড়িয়ে ধরলো।
-” এই ভাবেই ঘুমাতে হবে, আমার বাহুডোরে। বলেছিলাম না শাস্তি আছে। নাও ভোগ করো শাস্তি।
পিয়ালের কানে ফিসফিস করে কথা গুলো বলতেই, লজ্জায় পিয়াল সাম্যের বুকের মধ্যে আরও মিশে গেলো।
( চলবে)
{বিঃ : ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। হ্যাপি রিডিং।। }