#ওহে প্রেয়সী ভালোবাসি
মারিয়া মীম (ছদ্মনাম)
পর্ব-৮
.
সারাদিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রম শেষে রাতটুকুই থাকে একটু শান্তির জন্য। একটু আরামের জন্য ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দেয় বিছানায়। অথচ আজ! ঘুম নেই কারো চোখে। প্রতিটি মানুষ রাত জেগে বসে আছে। এর মাঝে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়ক। বাবা চাচ্চুরা অনেক বেশিই রেগে আছে প্রিয়কের উপর। মামনি আর ফুফাকেও ডাকা হয়েছে। এখানের সবাই নিরব দর্শকের ভুমিকা পালন করছে। প্রিয়ক একবার দৃষ্টি তুলে আমার দিকে চাইতেই তার চোখের কোনে জল জমা দেখতে পেলাম। আমি মায়ের সাথে দাঁড়িয়ে আছি৷ এর মাঝে হঠাৎ কান্নায় চমকে উঠে সকলে। নিরবতা ভেঙে কান্নার আওয়াজ আসতেই রিক্তা আপু সেদিকে চলে যায়। চাচ্চু তখন বলেন,
“সবাই যে যার ঘরে যাও। চুপ করে ঘুমিয়ে পড়ো সকলে। বাকি কথা কাল হবে। ”
বড়চাচ্চুর এ কথার পর কারও কথা বলার সাহস হবে না। তাই সবাই চুপচাপ সে জায়গা প্রস্থান করে। সেই সাথে আমিও। আসার আগে আরো একবার প্রিয়কের দিকে তাকালাম। মানুষটা কি রাত এখানেই কাটাবে? ভাবতেই কষ্ট লগছে। আম্মু আমাকে রুমে দিয়ে নিজেও নিজের রুমে চলে যায়। বিছানায় শুয়ে থাকলেও ঘুম নামে না দুচোখে। বড্ড অস্থির লাগছে। হঠাৎ করেই খুব কান্না পেয়ে গেল। বার বার প্রিয়কের গালে পড়া বড় চাচ্চুর চড়ের আওয়াজ কানের মাঝে বাজছে। সবটা শুনার পরপরই বড় চাচ্চু খুব জোরে আঘাত করে প্রিয়ককে। যে ভাগ্নের গায়ে সামান্য ফুলের টোকা লাগতে দেয়নি কখনও। সেই ভাগ্নের গায়ে এমন আঘাত সবার জন্যই অকল্পনীয়। ভেবেছিলাম সবাই রাগ করবে প্রিয়কের উপর। কিন্তু সব এলোমেলো হয়ে গেল।
গেইট খোলার আওয়াজে চুপ করে রইলাম। ঘুমের ভ্যান করে থাকি৷ একটুপরই বুঝত পারি প্রিয়ক এসে শুয়েছে আমার পাশে। একসময় আমাকে তার বুকের মাঝে টেনে নিয়ে শক্ত করে জরিয়ে ধরে। কেন জানি আজ নিজেকে ছাড়ানোর কোনো ইচ্চাই হলে না। চুপচাপ সেভাবেই রইলাম। প্রিয়ককে বলতে শুনলাম,
“এতো অবুঝ কেন রে তুই? কেন বুঝতে পারলি না? এখনতো ছোট না তুই। তবুও কেন বুঝছিস না।”
প্রিয়ক কাঁদছে। না দেখেও বুঝতে পারছিলাম। জানিনা কাল কি সিদ্ধান্ত নেবে সবাই মিলে। তবুও ভয় হচ্ছে। প্রিয়ক আবারও বলল,
“এত চিন্তা করিস না। যা হবে ভালোই হবে। যত যাই হোক অন্যায় তো করেছি আমি। শাস্তি তো পেতেই হবে। তাই এসব না ভেবে ঘুমিয়ে পড়।”
বলা শেষ হতেই আমার চুলে বিলি কেটে দিতে লাগল। আর আমি ভাবছি প্রিয়ক বুঝলো কি করে আমি ঘুমাই নি? ভাবছিলাম আমি? এসব ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ি আমি। তবে আমার মন বলছিল সারারাতে দুচোখের পাতা এক করেনি প্রিয়ক।
পরদিন সকাল বেলা। হালকা পাতলা নাস্তা করেই সবাই বসেছে আমাদের ঘরের বারান্দায়। ফুফা আর মামনি ও এসে গিয়েছে ততক্ষণে। সবটা শুনে মামনি প্রিয়কের গালে এলোপাতাড়ি কতগুলো চড় বসালেন। প্রিয়ক একটু টু শব্দ পর্যন্ত করেনি। প্রায় ঘন্টাখানেক চলল সেই বিচার। যেবিচারে ভিক্টিম হলাম আমি আর অপরাধী প্রিয়ক। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো আমাদের বিয়ে ভেঙে ফেলে হবে৷ অর্থাৎ ডিভোর্স। বাবা যখন এ কথা বলছিল তখন প্রিয়ক বাবার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে ছিল। হয়তো শাস্তি চেয়েছিল তবে এরকম নয়। তার সেই করুন দৃষ্টি একবার আমার দিকেও পড়েছিল। হুট করেই আমার কি হলো জানি না। সবার মাঝে বলে বসলাম,
“আমি ডিভোর্স চাই না। ”
আমার কথায় প্রিয়কের ঠোটের কোণে একচিলতে হাসি দেখেছিলাম। কিন্তু বাব আমার কথা শুনে রেগে গেলেন। রাগী গলায় আম্মিকে বললেন,
“আয়রা, তোমার মেয়েকে সামলাও। বেশি বুঝতে যেন না যায়। আমরা যা বলবো তাই করতে হবে ওকে।”
মামনি হয়তো আমার কথায় একটু ভরসা পেয়েছিল। মামনি বলল,
“দেখ ভাই, যা হয়েছে হয়েছে। মানছি ছেলেটা অনেক বড় ভুল করেছে। কিন্তু তাই বলে ডিভোর্স! ভাই একটা সম্পর্ক ভাঙা যত সহজ, গড়া কিন্তু তার থেকেও কঠিন। আর একবার ভেবে দেখ। আমি জানি আমার ছেলে কেমন। প্রিয়তার কোনো ক্ষতি হবে তা কখনই চাইবে না ও। প্রিয়তা ভালো থাকবে ওর কাছে। বিশ্বাস কর। ”
“তোর উপর বিশ্বাস আছে আমার। যেখানে তুই আছিস সেখানে প্রিয়তাকে নিয়ে একটুও চিন্তিত নয় আমি। প্রিয়ককে নিয়েও ছিলাম না। অথচ ওই আমাদের সবচেয়ে বড় আঘাতটা দিলো। সমাজের কাছে বদনাম হলাম আমরা। তারপর কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। ”
বাবার কথা শেষ হতেই মামনিও চুপ করে রইলো। হয়তো আর কোন কথা খুজে পেল না। তবে এই পুরো সময়টা প্রিয়ক নিবর ছিল৷ যেন একজন জীবন্ত লাশ দাঁড়িয়ে আছে এখানে। সবসময়ের চঞ্চল আর নিজের শক্ত অবস্থান ধরে রাখা মানুষটার এমন নিস্তেজ হয়ে পড়া যেন মেনে নিতে পারছিলাম না। একছুটে নিজের রুমে চলে আসি আমি। ফোন হাতে নিয়ে তন্নিকে ফোন দেয়। তন্নি ফোন রিসিভ করতেই ওকে সবটা খুলে বলি। সব শুনে ও বলে,
“আগে নিজে শান্ত হ, প্রিয়। এরকম হুট করেই কোনো ডিসিশন নিবি না। এখন সবাই রেগে আছে প্রিয়ক ভাইয়ার উপর। এই মুহূর্তে তোর কোনো কথায় তাদের কাছে ঠিক মনে হবে না। তাই দুইটা দিন সময় দে সবাইকে সবটা বুঝে নিতে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তখন তুই তোর ডিসিশন জানাবি। বিয়ে কোনো পুতুল খেলা নয় রে প্রিয়। যে এই জুরলাম ভালো লাগলো না, ভেঙে ফেললাম। আর আমার মনে হয় তোর আগে এই ব্যাপারে প্রিয়ক ভাইয়ার সাথে কথা বলা উচিত। উনি কি চায় সেটা জানতে হবে তোকে। তারপর দুজনে মিলে ঠিক করবি কি করবি? সারাটা জীবন একসাথে থাকবি নাকি ডিভোর্স নিবি। আর আমার কি মনে হয় জানিস?”
“কি?”
“প্রিয়ক ভাইয়া তোকে ভালোবাসে। একটু বেশিই ভালোবাসে তোকে। ”
“এরকম কিছুই না। ”
“আমার মনে হওয়াটা তোকে বললাম। বাকিটা তুই বুঝে নিস।”
সূর্যের উত্তাপ কিছুটা কমে আসতেই প্রিয়ক চলে যায় এ বাড়ি থেকে। চলে যায় বললে ভুল হবে। অনেকটা বের করে দেওয়া হয়েছে। চলে যাওয়ার আগে অবশ্য একবার এসেছিল আমার কাছে। তবে কিছু বলে নি। নিরব চাহনিতে তাকিয়ে ছিল শুধু। নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছিল বারবার। মনে হচ্ছিল সবাইকে সত্যিটা জানালেও পারতাম। কিন্তু নিজের উপর এই মিথ্যা অপবাদ যে আর সহ্য হচ্ছিল না। এক দিকে এই মিথ্যা অপবাদ থেকে মুক্তি অপট দিকে প্রিয়কের এমন অবস্থা। কিচ্ছু ভালো লাগছিল না। আব্বু আর চাচ্চুরা আমাকে প্রিয়কের সাথে যেতে দেয় নি। শুধু যে তা তাও ও নয়। আব্বু এই প্রথম আমার সামনে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চেয়েছিল। আব্বুর এই নত মাথা ও ছিল আমাকে অপরাধী করার আরেক কারন। সবকিছু বিরক্ত লাগছিল আমার কাছে। মামনি যাওয়ার সময় আমাকে বুকে জরিয়ে ধরে বলল,
“মারে মাফ করে দিস তোর মামনিকে। তোর এই মা টা তোর খেয়াল রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রিয়ককে তুই মাফ করবি কি না সেটা তোর ইচ্ছা। তবে ওকে মাফ করতে পারব না আমি। আজ ওর জন্য ভাইয়াদের সাথে সম্পর্ক খারাপ হলো।
তোর এত বড় ক্ষতিটা হলো। ওর জন্য এতদিন এক মিথ্যা বদনাম বয়ে বেরিয়েছিস তুই। এখন আবার আরেক বদনাম জুড়বে তোর নামের সাথে। সেটাও ওরই জন্য। কখনই ক্ষমা করতে পারব না। যে জন্যই করুক না কেন এই কাজ।কাজটা ঠিক করে নি ও। আমার সাথে কথা বলতে পারত একবার। তাও করে নি। আজ ওর জন্য সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। এতকিছু হওয়ার পর কোনোভাবেই ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য নয়। সেই সাথে প্রিয়ক তোরও যোগ্য নয়।”
কথায় আছে সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সে নিজের মত বয়ে চলে। ঠিক তেমনি আমাদের সময়ও বয়ে চলেছে নিরন্তর। প্রায় ২সপ্তাহ হতে চলল সেই ঘটনার। আমি এখন আমাদের বাড়িতেই আছি। ওবাড়িতে যাওয়া হয় নি আমার। হয়নি বলতে যেতে দেওয়া হয়নি আমাকে। কলেজে নিয়মিতই যাচ্ছি আমি। তন্নি, মুনি, হাসি, রিমন ওদেরও সাথেও দেখা হচ্ছে প্রতিটা দিন। আমাকে খুশি রাখতে ব্যস্ত থাকে ওরা। সবকিছু থাকলেও কোথাও একটা শূন্যতা অনুভব করতে থাকি আমি। প্রিয়কের সাথে এর মাঝে আর দেখা হয়নি আমার। জানিনা মানুষটা কেমন আছে? সবার কাঠিন্যরুপ ঠিক কতটা সহনীয় তার জন্য জানতে ইচ্ছা হয় খুব। তবুও কোথাও থাকা একটা কিন্তু সবকিছু আটকে দেয়। আবিরের সাথে মাঝে মাঝে কথা হলেও তেমন একটা ভালোলাগা কাজ করে না। আগে যেমানুষটার মাঝে নিজের জন্য সবসময় ভালোবাসা দেখতাম সেই মানুষটার সবকিছু সেরকম থাকলেও মনে হয় কিছুই নেই। হয়তো তন্নির কথায় ঠিক। তবে এর মাঝে আবিরের পাগলামি আগের থেকেও বেড়ে গেছে। যেদিন শুনেছে বাসার সবাই আমাদের ডিভোর্সের কথা ভাবছে সেদিন থেকে আবিরও উঠে পড়ে লেগেছে আমি যেন ডিভোর্স দেয়। ওভালোবাসে আমাকে। আমিও জানি তা৷ তবুও কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারছি না।
আজ ক্লাস শেষ করে বাইরে আসতেই অনাকাঙ্ক্ষিত একটি মানুষকে দেখতে পেলাম। গাড়ির সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই দৃষ্টিতে কাউকে এক পলক দেখার তৃষ্ণা যেন। তার দৃষ্টি আমাতে পড়তেই এক পলকের জন্য তার দৃষ্টিতে দৃষ্টি পড়ে আমার। সে এগিয়ে আসে আমার দিকে। যত কাছে আসছে বুকের মাঝে যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে আমার। সে কাছে আসতেই হাসি, মুনি ওরা তাকে সালাম দিয়ে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে। সেই মলিন হাসি দিয়ে তার জবাব দেয়। তন্নি আমাকে কিছু কথা বলে বিদায় নেয়। ওরা চলে যেতেই মানুষটা ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“আমার সাথে একটু আসতে পারবি? কিছু কথা ছিল। ”
আমি নিরবে সম্মতি দিতেই সে আমার হাত ধরে সাবধানে রোড ক্রস করে গাড়িতে নিয়ে বসিয়ে নিজেও উঠে পড়ে। গাড়ি চলতে থাকলে তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাই আমি। চোখ দুটো ফুলে আছে তার। চোখের নিচে কালি জমেছে। সেই সাথে চেহারাটাও মলিন। নিজের যত্ন নেওয়ার কথা হয়তো ভুলেই গেছে মানুষটা। সব সময় পরিপাটি থাকা পুরুষটা আজ একদম এলোমেলো।
“এভাবে দেখার কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি।”
হঠাৎ আওয়াজে চমকে উঠি আমি। তার দিকে তাকিয়ে অন্যত্র দৃষ্টি সরিয়ে নেই। কিছুটা রাগী গলায় বলি,
“দেখতেই পারছি কতটা ঠিক আছো?”
আমার কথায় হালকা হাসি ফুটে ওঠে মানুষটার গালে৷ সেই হাসি বজায় রেখেই বলল,
“বউয়ের মতো অধিকার দেখিয়ে কথা বলছিস। ভালোই লাগছে।”
বউ! আসলেই কি তাই! মানুষটার বউ আমি। আমাদের বিয়ে হয়েছে ২সপ্তাহ হয়ে গিয়েছে। এর মাঝে কখনই এমন ভাবে কথা বলা হয়নি। আজ তার মুখে বউ ডাকটা শুনতেই লজ্জায় লজ্জাবতী গাছের মত মিইয়ে গেলাম। আর কোন প্রতিত্তোর না করে বাইরে তাকিয়ে রইলাম।
.
.
চলবে..??