ওপারে আকাশ পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
681

#ওপারে_আকাশ: (শেষ পর্ব)

পাঁচ
রাতে ইশতির সাথে বেশ ঝামেলা চলল সুবহার। ঝামেলাটা একটা আলমারি কেনা নিয়ে। এ মাসে একটা তিন তাকের আলমারি আনার কথা ছিল ইশতির। কিন্তু ইশতির বাবা হঠাৎ ফোন করে টাকা চাওয়ায় সেটা সম্ভব হয়নি। ইশতির বাবা গ্রামেন
স্থানীয় একটা দোকান কিনেছে হঠাৎ করেই। এভাবে নিজের অনেকদিনের শখে জল পড়তে দেখে সুবহাও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ঝগড়া শেষে দুজনই দুদিকে মুখ দিয়ে শুয়ে আছে। সুবহা আশা করে আছে, ইশতি মুখ ঘুরিয়ে কাছে এলেই সব মিটমাট করে নেবে। কিন্তু সেটা আর হলো না। গভীর রাত পর্যন্ত ইশতির অপেক্ষায় থেকে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ঘুমাল সুবহা।

সকালে ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হলো। উঠেই দেখে সারা বাড়িতে ইশতি নেই। না বলেই কাজে চলে গেছে। অনেকক্ষণ মন খারাপ করে বিছানায় পড়ে রইল সুবহা। তারপর প্রথমবারের মতো চয়নকে আগবাড়িয়ে নক করল। মনখারাপের কথা বলে সময় করে একবার বাসায় আসতে বলল।

দুপুরের দিকটায় চয়ন এল বাসায়। চয়ন এলে মনের দুঃখগুলো উগড়ে চোখের পানি ফেলতে লাগল সুবহা। অন্যান্যদিনের মতো চয়ন চঞ্চল আচরণ করল না। সে চুপচাপ সুবহাকে শুনে যাচ্ছে। আচমকা একটা কাজ করে বসল চয়ন। দুহাতে জাপ্টে কাছে টেনে নিজের ঠোঁট দিয়ে সুবহাকে ছুঁয়ে দিতে লাগল। তারপর দ্রুত বের হয়ে গেল বাসা থেকে।

এই ঘটনার পর থেকে ইশতির সাথে শারীরিক সম্পর্কও অসহ্য হয়ে উঠল সুবহার কাছে। সারা দিনের কষ্টগুলোকে যেখানে ডুবিয়ে মন ভালো করে ফেলত সেই পথটাও একদমই হারাল। ধীরে ধীরে ইশতির সবকিছুই বিষের মতো হয়ে উঠতে লাগল সুবহার কাছে।

ঘটনার পনেরো দিনবাদে সুবহা নিজেই নিজেকে সঁপে দিল চয়নের কাছে। উকিলের কাছে গিয়ে ইশতিকে ডিভোর্স দিয়ে চিরদিনের জন্য চয়নের হাত ধরল।

ইশতি সেদিন তিন পার্টের আলমারি নিয়ে বাসায় ফিরেছিল। সুবহার ক্রমাগত পাল্টে যাওয়া ব্যবহার দেখে দিগ্বিদিক ইশতি মনে করেছিল আলমারি না কেনার জন্যই বুঝি বউয়ের এই পরিবর্তন। তাই এই প্রথম সুবহার জন্য সারপ্রাইজ নিয়ে হাজির হয়েছিল ইশতি। কিন্তু কে জানত তার জন্য বদ্ধ ঘরে যেই একখানা কাগজ অপেক্ষা করছিল- সেই কাগজখানার ভার সদ্য কেনা আলমারির থেকেও অনেক বেশি হবে।

ছয়

দুই বছর পরে…

স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জয়েন করেছে সুবহা। অনেক খুঁজে পেল চাকরিটা। ওই বেতনে খরচে
কুলিয়ে উঠতে পারছিল না।

সিমলা নামের এক নারী সুবহার পাশের ডেস্কেই বসে। নতুন বিয়ে হয়েছে সম্ভবত মেয়েটার। প্রায়ই দেখা যায় ফোন করে মুখ ভার করে থাকে। মুখে ভেংচি কাটে একা একা।

বেশ কিছুদিন সুবহার নজরে পড়ে বিষয়টি। কিন্তু আগবাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে না কিছুই।

ক্যান্টিনে আজ হঠাৎ সামনাসামনি পড়ে গেল সিমলা। সুবহা নিজ থেকেই হাই বলল।
“কী খাবেন, চলুন এক টেবিলে বসি”- বলার মাধ্যমে ধীরে ধীরে কিছুটা সহজ হয়ে এল। এক ফাঁকে জানতে চাইল, একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন- প্রায়ই দেখি ফোন করে আপনি কথা না বলে মুখ বাঁকান একা একা। কার সাথে এতো অভিমান করেন?

হেসে ওঠে সিমলা। বলতে থাকে, “কখন খেয়াল করলেন? কার আবার আমার সাহেবের উপর। আরে বলবেন না এতো উদাসীন বর আমার। সারাদিনে একবার ফোন করবে না। কেবল কাজ আর কাজ। আশেপাশের সবাই কত রোমান্টিক অথচ আমার ভাগ্যে জুটেছে পুরোই আনরোমান্টিক এক মানুষ। নিজেকে প্রকাশটাই করতে পারে না কখনো। এত্ত কাজপাগল…

গতরাতে কী হয়েছে জানেন। সাহেব কাজ থেকে ফিরেছে রাত এগারোটারও পরে। আমি বেচারা খাবার নিয়ে বসে। সারাদিন অফিস শেষ করে অতরাত পর্যন্ত খাবার নিয়ে বসে থাকাও কঠিন। এত্ত রাগ লাগছিল। না খেয়েই ঠাঁয় ফুঁসছিলাম। সাহেব বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে এল। যেটুকু রান্না করেছি বাটিতে করে তার সামনে পুরোটাই বেড়ে দিয়েছি। সে প্লেট নিতেই দুটো ইলিশ মাছও পাতে তুলে দিলাম। রাতে কম খাওয়া হয়। সামান্য সবজি আর দুটো মাছ ফ্রাই করেছিলাম। আমি খাইনি। ওকে ফেলে খেতে ভালো লাগে না। তবু রাগ থেকে ওকে বললাম আমার খাওয়া শেষ। এগুলো তোমার জন্যই রেখেছি।

ওমা কিছুক্ষণ খাওয়ার পর বর মুখ বাঁকা করে বলে কি না খাবার স্বাদ হয়নি। বলেই, ভ্রু নাচিয়ে একটা মাছ উঠিয়ে রাখল। তারপর দ্রুত খাওয়া শেষ করে রুমে গেল।

কী যে রাগ উঠছিল না আমার। কতক্ষণ ঝিম ধরে বসে বসে ফুঁসলাম। এক লোকমা খাবার মুখে তুলে তো দিলই না উল্টো খাবারের বদনাম করল। কতক্ষণ ঝিম ধরে বসে বসে ফুঁসলাম।
কিছুক্ষণ বাদে আজব এক বিষয় মাথায় এল। বিয়ের পর থেকে দেখছি যেদিন রাতেই আমি রাগ করে পুরো খাবার ওর পাতে তুলেছি সেদিনগুলোতেই সে খাবার বিস্বাদ বলে খাবার তুলে রেখেছে। এর মানে কী?

সুবহা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেন বুকটা খামচে ধরছে কথাগুলো…

সিমলা বলেই চলেছে। “ঝড়ের বেগে রুমে গিয়ে বরকে দু ঘা মেরে বললাম, আমার রান্না বিস্বাদ হয়েছে না?”
বলতেই সে মুচকি হাসল। আবার রাগ উঠল আমার। চুল টানতে টানতে বললাম,
“ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারো না কিন্তু নাটকটা তো বেশ পারো। একটু খাইয়ে দিলে কী হয় হ্যাঁ? হাত ক্ষয়ে যায়…”

আমার কথা শুনে বর কেমন যেন শূন্যে তাকিয়ে রইল। ব্যাটা যন্ত্রমানব- টোটালি আনরোমান্টিক হলো যা হয় আরকি…

সুবহা আর দাঁড়াল না। লাঞ্চের সময় শেষ হয়ে আসছে বলে দ্রুত ক্যান্টিনের ভেতরে ঢুকে গেল। অথচ একরত্তি খিদে নেই তার মধ্যে। খিদে উবে গেছে। কেন যেন খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে সুবহার, খুব।

কিছু জরুরি কেনাকাটায় নিউ মার্কেটের এদিকে আসতেই সামনে পড়ল বিসমার্ক প্লাজায়। সিঁড়ি ধরে এগিয়ে গেল সুবহা। দোতালার সামনেই সেই কসমেটিকস এর দোকানটা। এক পা দু পা করে ভেতরে ঢুকল সে। চয়ন পেছন পেছনেই এল। এসেই দোকানদারকে বলল, “ম্যাডাম কী নিতে চায় বের করুন তো!”

সুবহা এক জোড়া চুড়ি ধরল হাতে। চয়ন তৎক্ষণাৎ পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “দেখি দেখি চুড়িদুটো তোমার হাতে কেমন লাগে?”

প্যাকেট থেকে চুড়ি খুলে সুবহার হাতে পরাতে লাগল চয়ন।

“নাহ্ এটা না, ওই জোড়াটা তোমার হাতে মানাবে ভালো। দেখি দেখি…”

সুবহা চুড়ি পরছে না কি করছে বোধে কিছু কাজ করছে না। ও ফিরে গেছে দুই বছর আগের সেই দিনটায়। ইশতিকে শত বলেও আয়না অথবা চুড়ি পছন্দ করাতে পারছিল না। অথচ তাদের পাশের একজোড়া দম্পতি ছিল খুবই রোমান্টিক। ঠিক চয়নেরই মতো…

চুড়ি প্যাকেট করা হয়ে গেছে। যা যা কিনতে বেরিয়েছিল একে একে সব মনে করিয়ে দিচ্ছে চয়ন। সব কেনাকাটা শেষ। জিনিসপত্রের টোটাল মূল্য জানিয়ে দেয় দোকানদার।

চয়ন এগিয়ে যায়। এগিয়ে যায় সুবহার হাতের পার্স বরাবর। হাত থেকে পার্সটা নিয়ে টাকা বের করে গুণে দেয় দোকানিকে। তারপর পার্সটা ফেরত দেয় সুবহার হাতে।

কেনাকাটা শেষ করে দুজন বের হচ্ছে। চয়ন এই সেই বকবক করেই যাচ্ছে। ওদিকে সুবহা নিশ্চুপ। যেন কোনো পাথর পা পেয়ে হেঁটে চলেছে। নিচতলায় আসতেই বড়ো ফাস্টফুডের দোকানটায় সুবহার হাত টেনে ঢোকে চয়ন। একটা কর্ণার দেখে বসে পড়ে। পছন্দমতো খাবার অর্ডার করে দেয় চয়ন। সুবহা তখনও অন্যরাজ্যে…

খাওয়া শেষ হলে এবার আর নিজেই পার্সটা টেনে নিল না চয়ন। বিলের বইটা সুবহার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “পরিশোধ করে আসো। আমি একটু ওয়াশরুমে যাব।”

পাথর চোখ থেকে হঠাৎ দু ফোঁটা পানি বেয়ে পড়ল চোয়ালে।

বিয়ের পর থেকে লোক দেখানো আদিখ্যেতা বাদে সুবহার কোনোরকম দায়িত্ব নেয়নি চয়ন। এমনকি সংসারের পেছনে একদমই টাকা খরচ করতে চায় না সে। এসব নিয়ে অশান্তি করতে চেয়েও সাহসে কুলোয় না সুবহার। এসব তার প্রাপ্য অসম্মান বলে চুপিসারে মেনে নেয়। মনে মনে বলে, “একজীবনে কতবারই বা ঘর ভাঙা যায়…”

বিল কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল সুবহা। একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর বিল পরিশোধ করছিল। কেঁপে উঠল সুবহা…

“ইশতি…”

মৃদুস্বরের ডাকটা পাশের মানুষটির কানপর্যন্ত পৌঁছাতে সময় নিল না। মানুষটি পিছু ফিরে তাকাল।

হ্যাঁ ইশতি, ইশতিই তো। সুবহা তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টিতে…

ইশতি চোখ নামিয়ে অন্যদিকে ফিরল মুহূর্তেই। ঠিক তখনই কয়েক কদম দূর থেকে এগিয়ে এল ঝলমলে চেহারার এক নারী। সুবহার অতি পরিচিত কলিগ সে যদিও। তবুও আজ কেমন অচেনা লাগছে সিমলাকে। খুব গর্জিয়াস।
সিমলার চোখে চোখ পড়লেও সুবহা অন্য দিকে ফিরল। সিমলাও আর কিছু বলল না।

সিমলা এগিয়ে গিয়ে ইশতিকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগল,

“বিল দেওয়া শেষ? আমি দোতালায় যাচ্ছি। কিছু কসমেটিকস কেনার ছিল! বিল পরিশোধ বাদে তুমি তো আর কিছু পছন্দ করে দেওয়ার মধ্যে নেই। নাও ধীরেসুস্থে উপরে উঠে এসো।”

সিমলা দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল। পেছন ফিরে তাকাল সুবহা। ইশতি উঠে যাচ্ছে। মানুষটা একই রকম রয়ে গেছে না! চোখ দিয়ে অজান্তেই পানি গড়াতে লাগল।
সুবহা খেয়াল করল, যন্ত্রমানব টা একপলকের মতোই বুঝি তাকাল পেছনে…

#Mina_Sharmin

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে