এ্যারেঞ্জ ম্যারেজ পর্বঃ ০৬
– আবির খান
বিকেল ৪টা,
নেহাল ফোনটা বের করে দেখে মায়ের ১০ টা কল। নেহাল তাড়াতাড়ি ফোন ব্যাক করে। নেহালের প্রচন্ড চিন্তা হচ্ছে। হাত কাঁপছে। কেনো জানি অনেক ভয় হচ্ছে।
নেহালঃ মা নিশি কি আসছে??? চিন্তিত কণ্ঠে।
মাঃ না বাবা ও তো এখনো আসে নাই। আর তোরে সেই কবে থেকে ফোনের পর ফোন দিচ্ছি ধরছিসই নাহ।
নেহালঃ আরে আমি ব্যাস্ত হয়ে পরেছিলাম। কিন্তু এত্তোক্ষনেতো ওর এসে পরার কথা। কোথায় গেলো?? ভয়ে ভয়ে।
মাঃ সেটাইতো। নেহাল আমার অনেক টেনশন হচ্ছে। ভয়ে ভয়ে।
নেহালঃ মা আমি এখনই বের হয়ে দেখছি। তুমি টেনশন কইরো না। অসহায় কণ্ঠে।
মাঃ দেখ বাবা। মেয়েটার আমার কই। আসহায় কণ্ঠে।
নেহাল ফোন রেখে দেয়। নেহালের হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। নিশি কোথায় গেলো কেউ জানে না। নিশির ভারসিটি শেষ হয়েছে ২.৩০ এ। আর এখন বিকেল ৪.১০ মিনিট। নেহালর গলা শুকিয়ে আসছে চিন্তায় আর ভয়ে। নেহাল কোনোরকম এক গ্লাস পানি খেয়ে অফিস থেকে বের হয়ে গাড়ি নিয়ে সোজা ভারসিটির সামনে যায়। ভারসিটির দারওয়ান নিশিকে চেনায় সে বলে, “আপা মনিতো সেই কবেই চলে গেসে। তবে মুখটা খুব মলিন আসিলো আপার”। নেহালের টেনশন আরো বেরে যায়।
নেহাল ভাবে, তাহলে কি আজকে সকালের জন্য নিশি আমাকে ছেড়ে চলে গেলো?? নাকি ওর কোনো ক্ষতি হলো?? ও আমাকে বারবার আসতে না করেছিলো। যাতে আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে। নিশি তুমি কোথায়?? নেহালের চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরছে। অনেক ভয় হচ্ছে নিশিকে হারানোর।
নেহাল পাগলের মতো প্রায় সব জায়গায় খুঁজলো। থানায় পর্যন্ত খবর চলে গিয়েছে। নেহালের বাবাও লোক লাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কোথাও নিশিকে পাওয়া যাচ্ছে না।
রাত ৮.৫০ মিনিট,
নেহাল আর ওর বাবা-মা সবাই অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে বিষন্ন ভাবে বসে আছে। কোনো খবরই আসছে না নিশির। হঠাৎই বাড়ির বেলটা বেজে উঠে। নেহাল পাগলের মতো দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে। নেহাল যা দেখে তাতে ওর না সবার জানে জান ফিরে আসে। এ যে আর কেউ নয় নিশি।
নেহালঃ নিশি…..
বলেই জোরে চিৎকার করে নিশিকে কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরে। নিশি হতম্ভব হয়ে যায় নেহালের কান্ড দেখে। কিন্তু মুহূর্তেই নেহাল যেন অন্যরকম হয়ে যায়। অনেক রাগী আর ভয়ংকর।
নেহাল ওর বাবা-মায়ের সামনে নিশিকে টানতে টানতে উপরে নিয়ে যাচ্ছে।
বাবাঃ নেহালের মা নাহ। আটকিও না। ওদের সমস্যা ওদের বুঝতে দেও। আমরা ইন্টারফেয়ার করলে সেটা অনেক বড় ইস্যু হয়ে যাবে।
মাঃ কিন্তু নেহালতো অনেক রেগে আছে। যদি??
বাবাঃ ধুর বোকা ও আমাদের ছেলে ওকে আমরা খারাপ শিক্ষা দেইনি। হয়তো একটু অভিমান করেছে কথা বললেই ঠিক হয়ে যাবে। আর এরপর যদি কিছু হয় আমরা তো আছি।
মাঃ তুমি বলছো??
বাবাঃ হ্যাঁ। আগে ওরা শান্ত হোক পরে কথা বলবো। যাওতো এক কাপ কফি নিয়ে আসো আজ অনেক টেনশন করেছি।
মাঃ আচ্ছা। তুমি বসো।
এদিকে,
নেহাল নিশিকে উপরে নিয়ে খাটের উপর ফেলে দেয় আর দরজাটা আটকে দেয়।
নিশিঃ একি কি করছেন আপনি?? ভয়ে ভয়ে।
অন্যদিকে নেহাল দরজা লাগিয়ে তাতে মাথা হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নেহালের হাত-পা এখনো কাঁপছে৷ ও ভেবেছিলো নিশি হয়তো আর আসবেনা। নেহাল নিজেকে শান্ত করছে। তবে নিশির এভাবে গায়েব হওয়াতে নেহালের প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। নেহাল আস্তে করে নিশির দিকে ফিরে তাঁকায়।
নিশি নেহালকে দেখে ভয়ে অবস্থা খারাপ। চোখ দুটো রক্তের মতো লাল হয়ে আছে। তবে চোখের আশেপাশে অশ্রুতে ভিজা। নেহাল আস্তে আস্তে নিশির দিকে এগোচ্ছে। নিশি ভয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে অন্যদিকে পিছাচ্ছে। নেহাল এগোচ্ছে নিশি পিছাচ্ছে।
একসময় নিশি দেয়ালের সাথে ধাক্কা খায়। আর পিছাতে পারে না। নেহাল নিশির কোমর এক হাতদিয়ে চেপে ধরে ওর সাথে মিশিয়ে নেয়। আর অন্য হাত ঠাস করে দেয়ালে রাখে। নিশি অনেক ভয় পেয়ে যায়। নিশি নেহালের এই রূপ কখনো দেখেনি। এতোটা ভয়ংকর রূপ যে নেহাল ধারণ করতে পারে নিশির জানা ছিলো না। নিশি ভয়ে নেহালের দিকে তাঁকাতেই পারছে না। পুরো শরীর কেমন অসর অসর লাগছে নিশির।
নেহালঃ কোথায় গিয়েছিলে?? অনেক রাগী ভাবে।
নিশিঃ বাবার কাছে হাসপাতালে। ভয়ে ভয়ে।
নেহালঃ আমাকে বলে যাওনি কেন??
নিশিঃ আপনার নাম্বার জানি না। আস্তে করে।
নেহালঃ না বলে গেলে কেন??
নিশিঃ…… উত্তর জানা নেই।
নেহালঃ তুই কেন না বইলা গেলি বল?? আমার কতোটা টেনশন হয়েছে জানিস তুই?? অসহায় কণ্ঠে।
নিশি নেহালকে দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছে।
নেহালঃ বল কেনো না বলে এভাবে চলে গেলি??? কাঁদো কণ্ঠে।
নিশি নেহালের চোখে স্পষ্ট অশ্রুর বিশাল বড় ঢেউ আসতে দেখছে। সেই ঢেউয়ে আজ নিশিও ভেসে যাবে।
নেহাল হঠাৎই নিশিকে অনেক শক্ত ভাবে আঁকড়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পরে। সাথে নিশিও জীবনের প্রথম কোনো পুরুষের কান্না দেখে সেও কেঁদে দেয়।
একটা মেয়ে অনায়াসেই কাঁদতে পারে কারণ তার মন মহান আল্লাহ তায়ালা ফুলের মতো নরম বানিয়েছেন। কিন্তু একজন পুরুষ কিন্তু সহজে কখনো কাঁদে না। কারণ তার মন মহান আল্লাহ তায়ালা পাথরের মতো শক্ত বানিয়েছেন। কিন্তু সেই পাথরের মন যখন অনেক কষ্ট বা হারানোর ভয় পায় তখন তা ভেঙে একটা বাচ্চার মনে পরিনত হয়। আর সেই মন শুধু কাঁদতে জানে।
আর নেহাল স্তব্ধ হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকে।
নেহাল কোনোভাবেই নিশিকে মানাতে পারছে না। নেহাল যে নিশিকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছে। কি করে ওকে বুঝবে। কোনো ভাবেই নিশি মানছে না।
নেহাল আর কি করবে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ওর নিয়তিকে মেনে নেয়। নিশির নিজ থেকে দেওয়া শেষ সেই পরম স্পর্শ নিয়ে বাকিটা জীবন পাড় করতে হবে ওকে ছাড়া।
নেহাল বিছানা ছেড়ে উঠে ফোনটা হাতে নেয়। আর ওর একটা অনেক কাছের বন্ধুকে ফোন দেয়।
নেহালঃ হ্যালো হিসাম।
হিসামঃ আরে বন্ধু নেহাল যে। কেমন আছিস ভাই??
নেহালঃ ভালো নারে ভাই। তোর একটা হেল্প লাগবে পারবি??
হিসামঃ ভাই তুই বল খালি জান দিয়ে দেই।
নেহালঃ ভাই এখন জান লাগবে না। শুধু একটা কাজ করে দে। তোর এই কাজের উপর আমার বাকি জীবনটা নির্ভর করবে।
হিসামঃ কি বলিস ভাই। এখনতো আমার ভয় হচ্ছে। বলতো ভাই কি কাজ।
নেহালঃ শোন তাহলে। …… পারবি না করতে??
হিসামঃ দোস্ত কাজটা আমার বা হাতের। কিন্তু রেজাল্ট যদি নেগেটিভ আসে??
নেহালঃ কি আর করার ভাগ্য ভেবে মেনে নিবো। হতাশ হয়ে।
হিসামঃ আচ্ছা ভাই আমি সব দেখছি। তুই দোয়া করিস।
নেহালঃ হুম।
হিসামঃ ভাই যা কপালে আছে তাই হবে। তুই কষ্ট পাস না। আমি তোকে জানাবো।
নেহালঃ আচ্ছা। রাখি এখন। তোর খবরের অপেক্ষায় থাকবো৷
নেহাল ফোন কেঁটে দেয়। এরমধ্যে নিশি বের হয়ে আসে। নেহাল নিশিকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিশি রুম থেকে চলে যায়। নেহাল বুক ভরা কষ্ট নিয়ে ফ্রেশ হতে চলে যায়।
নিশি নিচে এসে নাস্তা বানিয়ে নিয়ে খাবার টেবিলে পরিবেশন করে। আর এর মাঝেই নেহালের বাবা-মা এসে পরে সাথে নেহালও। সবাই খাবার টেবিলে এসে বসলো।
বাবাঃ নিশি মা কাল কই গিয়েছিলিরে??
মাঃ হ্যাঁ রে মা কাল এভাবে না বলে কই গিয়েছিলি?? নেহাল তোর টেনশনে যা অবস্থা হয়েছিল না।
নিশি নেহালের দিকে একটু তাকিয়ে আবার মা-বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
নিশিঃ আমি গতকাল একটু বাবার কাছে গিয়েছিলাম। বাবা আমাকে পেয়ে অনেক কথা বলায় আসতে দেরি হয়ে গিয়েছিলো।
বাবাঃ আচ্ছা মা কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এর পর গেলে নেহালকে সাথে নিয়ে যাস। আর নেহাল তুইও কেমন আজই ওকে একটা অনেক দামি ফোন কিনে দিবি।
মাঃ হ্যাঁ কাল ওর কাছে ফোন থাকলে এতো ঝামেলা হতো না। সব নেহালের দোষ।
নেহালঃ আচ্ছা আচ্ছা আজই কিনে দিবো।
নিশিঃ না মা ওনার কোনো দোষ নেই। আমারই দোষ আসলে না বলে হঠাৎ চলে গিয়েছিলাম।
মাঃ না মা তোর কোনো দোষ নেই। তুইতো তোর বাবাকে দেখতে যাবি এটাই স্বাভাবিক।
বাবাঃ হ্যাঁ মা তোর একটুও দোষ নেই। সব দোষ আমাদের এই গোবরগণেশর। হাহা।
নেহালঃ বাবা।
নিশিঃ সত্যিই আপনাদের মতো শ্বশুর আর শ্বাশুড়ি পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার। কষ্ট নিয়ে বলল।
মাঃ কি যে বলিস না তুই।
বাবাঃ যা আমাদের যখন এতো ভালো বললি তাহলে কাল সন্ধ্যায় তোদের বিয়ের অনুষ্ঠানটা করে ফেলি।
নিশিঃ না বাবা না। এখন না পরে পরে।
বাবাঃ কেনো?? এখন করলে কি সমস্যা??
নিশিঃ না মানে….
বাবাঃ না মা আমি তোর কোনো কথাই শুনবো না। কাল তোদের অনুষ্ঠানটা হবেই। না করিস না।
নিশিঃ…..
নেহালঃ হ্যাঁ বাবা কালই করো। ভালো হবে।
নিশি রাগী ভাবে নেহালের দিকে তাকিয়ে আছে।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে নেহাল উপরে চলে যায়। কাল অনুষ্ঠান তাই আজ অফিসে যায়নি। নিশিও তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে উপরে চলে যায়।
নিশি উপরে এসে দেখে নেহাল কফি হাতে বারান্দায় বসে আছে।
নিশিঃ এটা কি হলো??
নেহালঃ কোনটা??
নিশিঃ আপনি না করলেন না কেনো??
নেহালঃ কিসের জন্য??
নিশিঃ আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য।
নেহালঃ হলে সমস্যা কি??
নিশিঃ আপনি কি ঠিক আছেন?? এই অনুষ্ঠান হলে সবাই জেনে যাবে না আমি আপনার বউ??
নেহালঃ হ্যাঁ জানবে তো কি হয়েছে??
নিশিঃ আগামী ৩ মাস পর যে আমাকে ডিভোর্স দিবেন তখন এরা আপনাকে কি বলবে??
নেহালঃ তোমাকে ডিভোর্স দিলে না কিছু বলবে।
নিশিঃ মানে??
নেহালঃ মানে হলো তোমাকে কোনো ডিভোর্স দিবো না। যদি প্রয়োজন হয় দুটো বিয়ে করবো তাও তোমাকে ডিভোর্স দিবো না।
নিশিঃ মরে যাবো তাও ভালোবাসা ভাগাভাগি করতে পারবো না। আপনি যদি আমাকে ডিভোর্স না দেন আমি না বলেই অজানায় হারিয়ে যাবো। আর কোনো দিন ফিরে আসবো না এই বলে গেলাম মনে রেখেন।
বলেই নিশি চলে গেলো। নিশির কথা গুলো সব নেহালের বুকে তীরের মতো এসে বাঁধলো। নেহাল বিষন্ন মন নিয়ে কফি হাতে আকাশে দিকে তাকিয়ে আছে। অজানা ভবিষ্যত সামনে। হয়তো কষ্টের।
কি হবে??
চলবে…?