#এসো_বৃষ্টি_হয়ে (৮)
#writer_sayuri_dilshad
বেলির বাড়ির সামনে প্রায় আধঘন্টা যাবত দাঁড়িয়ে আছে সুখন উদ্দেশ্য বেলির সাথে দেখা করা। কিন্তু এই বাড়ির কেউ তাকে বেলির সাথে দেখা করতে দিচ্ছে না।
সে সকল রকমের চেষ্টা করেছে বেলির সাথে দেখা করার। কিন্তু বেলির পরিবার কিছুতেই দেখা করতে দিচ্ছে না। তার কথা বলা দরকার বেলির সাথে। অধৈর্য হয়ে পায়চারি করছে সে বাড়ির বাইরে।
রহমত শেখ বারান্দায় চেয়ারে বসে সুখনকে লক্ষ্য করছে। তিনি অত্যন্ত বিরক্ত সুখনের উপরে। কয়েকবার তাকে বুঝানো হয়েছে যে বেলি বাড়িতে নেই, তার সাথে দেখা করা যাবে না। তারপরও সে যেতে চাইছে না, নাছোড়বান্দা। তার উদ্দেশ্য কি!
সুখন দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো রহমত শেখের কাছে। গ্রিলের বাইরে থেকে বললো,
– আমি আমার ছেলের সাথে দেখা করতে চাই। আপনারা আমার ছেলের সাথে দেখা করতে দেন।
সুখন এই কথাটা বললো এই আাশায় যাতে সে বেলির দেখা পায়। সে নিশ্চিত বেলি লিখনকে একা ছাড়বে না। এই ফাঁকে তার সাথে কথাও বলা যাবে।
রহমত শেখ পল্টুকে ডাকলো। পল্টু বাড়ির ভেতরেই ছিলো সে বেরিয়ে এলো। রহমত শেখ ফিসফিস করে যেন পল্টুকে কি বললো। পল্টু আবার ঢুকে গেল বাড়ির ভেতরে। খানিকবাদে সে হাজির হলো লিখনকে সাথে নিয়ে।
লিখন অনেকদিন পর বাবাকে দেখলো। তাই সে তাকে দেখামাত্রই একপ্রকার উড়েই যেন বাবার কোলে গেল। বাবার গলা দুই হাতে জড়িয়ে বাবার গালে চুমু খেল। তারপর তার বুকের সাথে মিশে রইলো। হঠাৎ সুখনের কি হলো কে জানে। তার চোখ দুটি ভিজে উঠলো।গলার স্বরটা যেন খানিকটা কাঁপল। বুকের ভেতরের দাবানলটা যেন নিভে গেলো। মনে হলো এইতো শান্তি। পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে বেলি দেখছিলো ওদের দুজনকে। ওর চোখ পানিতে ভরে গেল। বুকের ভেতরটায় চিনচিন ব্যাথা অনুভব করলো। সুখেই তো ছিলো ওরা। সুখনের একটা ভুলে সব শেষ।
সুখন কিছুক্ষণ পর রহমত শেখের দিকে তাকালো। রহমত শেখ সুখনের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। এবার বললো,
– ছেলেকে তো দেখলে। তাহলে এবার যাও।
সুখন দুহাত কচলে এবার বললো,
– আমি একটু বেলির সাথে দেখা করতে চাই। ওর সাথে কিছু কথা আছে।
রহমত শেখ মাথা নেড়ে বললেন,
– বেলি বাড়ি নেই।
সুখন এবারে রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বললো,
– বাড়ি নাই মানে। বাড়িতেই আছে, আপনারা আমার সাথে দেখা করতে দিচ্ছেন না। আমার বউকে আমার সাথে দেখা করতে দিচ্ছেন না কেন? কে আপনারা!
রহমত শেখের চোখগুলো দপ করে জ্বলে উঠলো। তার ইচ্ছে হতে লাগলো সুখন মাটির নিচে পুতে ফেলতে। কিন্তু প্রতীকের কথাগুলো মনে হতেই সে নিজের রাগ সংবরণ করে উঠে দাঁড়ালো। পল্টুকে বললো,
– একে তাড়া এখান থেকে।
তারপর মন্থরগতিতে হেঁটে বাড়ির ভেতর চলে গেলো।
সুখন আরও কিছুক্ষণ ওখানেই দাঁড়িয়ে থেকে আশাহত হয়ে ফিরে গেল। সুখনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বেলি বললো,
– তুমি যদি ঐ মেয়েকে ছেড়ে চলে আসতে তাহলে হয়তো আমি তোমার সাথে চলে যেতাম।
————-
হঠাৎ করেই কুলসুম বেগমের বুকের ব্যাথা অনুভব হলো। তিনি বেলির সাথে ফোনে কথা বলছিলেন কান্নাকাটির একপর্যায়ে তার বুকে ব্যাথা অনুভব হয়। হাত থেকে মোবাইল পড়ে যায় ফ্লোরে। তিনি এলিয়ে পড়েন সোফায়। তার কষ্ট হচ্ছে প্রচুর, তিনি হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা ধরার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ব্যর্থ হলেন। ধীরে ধীরে তার চোখ বন্ধ হয়ে এলো, তিনি চোখে অন্ধকার দেখলেন।
ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ না আশায় বেলি বললো,
– আম্মা, কি হয়েছে? হ্যালো, আম্মা।
এবারেও কোনো আওয়াজ না আশায় বেলি মোবাইলটা কান থেকে নামিয়ে একবার দেখে নিলো কল কেটে গেছে নাকি। কল কাটে নি, তাহলে কথা বলছে না কেনো? বেলি আবার মোবাইল কানে রেখে “হ্যালো হ্যালো” করতে লাগলো। কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ আসলো না।
পান্না বেগম ঘরে এসেছিলেন একটা কাজে। তিনি বেলি চিন্তিত মুখ দেখে এগিয়ে এলেন বললেন,
– কি হইছে! কে কথা কয়?
– আমার শাশুড়ী। এতক্ষণ কথা বলতেছিলো, তারপর কি যেনো একটা পড়ার শব্দ হলো, এরপর আর কথা বলতেছে না।
চিন্তিত মুখে বেলি কথাটা বললো। পান্না বেগম কিছু না ভেবেই বললেন,
– হয়তো কোনো কিছু পড়ে গেছে। তিনি মোবাইল রেখে তাই তুলতে গেছেন। তাই কথা বলছেন না।
বেলির পান্না বেগমের কথা যুক্তিযুক্ত মনে হলো না। সে চিন্তিত মুখেই মোবাইলটা কান থেকে নামিয়ে রাখলো।
খানিকবাদেই বেলি রাতের ভাত খেতে বসলো, শান্তিতে সে ভাত থেকে পারলো না। কোনোমতে খেয়ে উঠে সে আবার ফোন করলো কুলসুম বেগমকে। কেউ রিসিভ করলো না। বেলি অনেকবার ফোন করলো, কিন্তু ওপাশ থেকে কেউ রিসিভ করলো। এবার বেলির চিন্তা আরও বেশি হতে লাগলো। সে সুখনের নাম্বারটা বের করলো। খানিকক্ষণ মোবাইলটা হাতে নিয়ে বসে থাকলো। ভাবলো ডায়াল করবে না করবে না। একটা পর্যায়ে এসে সকল দ্বিধাদন্দ দূরে ঠেলে ডায়াল করলো সে। রিং হতে লাগলো। বেলি মোবাইলটা কানে ধরলো।
খানিক বাদেই ওপাশ থেকে মেয়েলি গলা ভেসে আসলো, বললো,
– হ্যালো।
বেলির বুকের ভেতরটায় আবার ধক করে ব্যাথা অনুভব হলো। এতো কিছু হয়ে যাবার পরও সুখন এ মেয়েকে ছেড়ে আসে নি এখনো। বেলি নিজের মনকে শক্ত করে বললো,
– আমি বেলি বলছি। সুখনকে একটু মোবাইলটা দেওয়া যাবে। দরকার ছিলো।
মায়মুনা বেলির নাম শুনে নাক মুখ কুঁচকালো। ঝাঁঝালো গলায় বললো,
– না দেয়া যাবে না। সে বাসায় নাই। মোবাইল রেখে চলে গেছে।
ঠিক তখনি সুখন ওয়াশরুম থেকে বের হলো। সবেই বাসায় ফিরেছে সে। হাত মুখ ফ্রেশ হচ্ছিল। মায়মুনার কানে মোবাইল দেখে সে মায়মুনাকে বললো,
– কে কল দিয়েছে?
মায়মুনা সুখনের কথা শুনে থ মেরে দাঁড়িয়ে। ওপাশ থেকে বেলিও সুখনের গলার আওয়াজ শুনলো। কষ্টে তার মুখ দিয়ে দীর্ঘশ্বাস বেরুলো। সে বললো,
– শুনো আমি তার সাথে প্রেমালাপ করার জন্য কল করি নি। এখন আমাদের যা প্রেমালাপ সব কোর্টেই হবে। উকিল জজের সামনে। যদি দরকার হয় তুমি আসবে। তুমি প্রেমালাপ চালাতে পারো অন্যকারো স্বামীর সাথে। তোমার তো আবার অন্যের স্বামী খুব পছন্দ।
মায়মুনা কিছু বলতে গিয়েও বললো না। সুখন এগিয়ে এসে মোবাইলটা মায়মুনার হাত থেকে নিয়ে নিলো। মায়মুনার দিকে অদ্ভুত এক চাহনি দিয়ে কানে ধরলো মোবাইলটা, বললো,
– হ্যালো, কে বলছেন?
ওপাশ থেকে উত্তর আসলো
– আমি
সুখন খানিকক্ষণের জন্য মুখ থেকে কথা বেরুলো না।অনেকদিন পর বেলির সাথে কথা হচ্ছে তার। হঠাৎ করে বললো,
– কেমন আছো?
বেলির হাসি পেলো সুখনের রসিকতায়।হ্যা রসিকতায় বটে। সে সরাসরি মূল কথায় চলে আসলো। বললো,
– সন্ধ্যার দিকে আম্মা কল দিয়েছিলো, তারপর হঠাৎ করেই কথা বন্ধ হয়ে যায়। আমি তারপর অনেকবার কল দিয়েছিলাম কিন্তু কেউ রিসিভ করে নি। আমার মনে হয় তার খোঁজ নেয়া দরকার। এর আগেও কিন্তু তার একটা এ্যাটাক হয়েছিলো। বুড়ো হয়েছে। এখন তার সাথে থাকা উচিত অন্য কোথাও না থেকে।
শেষের কথাটায় যেন একটু শ্লেষ কটাক্ষের সুর মিশেছিলো। সুখন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
– ঠিক আছে, আমি দেখছি।
– দেখে, আমাকে কল করতে বলবেন উনাকে।
সুখন মোবাইলটা কানে ধরে রাখে। কল কেটে যাওয়ার আওয়াজ আসে ওপাশ থেকে। মায়মুনা এসে সুখনের পাশে দাড়ায় ঝাঁঝালো গলায় বলে,
– এতক্ষণ কিসের প্রেমপিরিতের আলাপ করলেন, শুনি।
সুখন ভ্রু কুচকে তাকালো মায়মুনার দিকে। কোনো কথা না বলে কুলসুম বেগমের নাম্বারটা ডায়াল করলো। রিং বেজে গেলো। ওপাশ থেকে কেউ কল ধরলো না। আরও কয়েকবার চেষ্টা করেও যখন ওপাশ থেকে কেউ রিসিভ করলো না তখন সুখন হাতে শার্ট তুলে নিয়ে বেরুতে নিলেই মায়মুনা এসে পথ আগলে দাঁড়ায় বলে,
– কোথায় যাও?
– দরকার আছে। সরো সামনে থেকে।
সুখন উত্তর দেয়। মায়মুনা চোখ ছোট ছোট করে বলে,
– দরকার! কিসের দরকার? তোমার বউ কল করতেই বাসা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছ। আর আমাকে বুঝাচ্ছ দরকার আছে। তুমি যেতে পারবা না।
সুখনের রাগ লাগে। মায়মুনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সে চলে যায়। মায়মুনা পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলায়। তার চোখে পানি টলমল করতে থাকে। সে বুঝতে চেষ্টা করে সুখনের সাথে তার সম্পর্ক টা। তার মনে হয় তাদের সম্পর্কটা এখন তলানিতে এসে জমেছে।
সুখন অধৈর্য হয়ে কলিংবেল চাপতেই থাকে। ওপাশ থেকে দরজা খোলার নাম নেই। সুখন ভয় লাগে। বুকের ভেতরটা কোনো এক অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠে। বারবার মনে হয় বেলির কথাগুলো। সে তার বুক পকেট প্যান্টের পকেট হাতড়ে দরজার চাবি খোঁজে। পেয়েও যায় ভাগ্যগুনে। কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা খোলে। বাসার ভেতরে ঢুকেই তার হাত পা জমে যায়। আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে।
অস্বাভাবিকভাবে সোফায় পড়ে আছে কুলসুম বেগম। তার অর্ধেকটা শরীর সোফায় আর অধর্কেটা বাহিরে। মোবাইল ধরার চেষ্টা করছিলেন হয়তো। মোবাইলটা ফ্লোরে পড়ে আছে। সুখন মোবাইলটা হাতে নেয়। তার আর বেলির নাম্বার ভেসে আছে।
সুখন কাঁপা কাঁপা হাতটা এগিয়ে নিয়ে যায় কুলসুম বেগমের নাকের কাছে।
চলবে,
( ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)