#এসো_বৃষ্টি_হয়ে (৬)
#writer_sayuri_dilshad
লিখনের চোখভর্তি পানি। বিছানায় বসে আছে কালকের সেই নোংরা কাপড়গুলো পড়েই। বেলিকে দেখে একপ্রকার লাফ দিয়েই পড়ে বেলির কোলে। মিশে যায় একদম বেলির সাথে। বেলি শক্ত করে জড়িয়ে ধরে লিখনকে বুকের সাথে। লিখনের কান্না থেমে গেছে। বেলি লিখনকে নিয়ে বেরিয়ে আসে রুম থেকে। একবার চোখ বুলালো পুরো রুমটায়। সুখন সোফায় বসে আছে। এক হাতে নাকে বরফ চেপে ধরে বসে আছে অন্য হাতে নাকের রক্ত মুছছে। মুখটা ব্যাথায় মলিন হয়ে আছে। মায়মুনা পাশেই ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে পল্টুকে দেখছে। পল্টু বেলিকে দেখে এগিয়ে গেল তার দিকে। সুখন আর মায়মুনার দৃষ্টিও গেলো পল্টুর সাথে সাথে।
পল্টু বললো,
– যাওয়া যাক তাহলে।
বেলি মাথা নেড়ে হ্যা বললো।
সুখন উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
– কাজটা তোমরা ঠিক করলে না। আমার ছেলেকে তোমরা আমার মতামত ছাড়া নিয়ে যেতে পারো না।
পল্টু কানে আঙুল নিয়ে চুলকে বললো,
– কি! কি বলেন?
সুখন থতমত খেয়ে যায়। পল্টু হাসে শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে। লিখনকে কোলে নিয়ে বলে,
– বাবার মতো কাপুরুষ হবে না। এই মামার মতো বীরপুরুষ হবা বুঝলা।
লিখন কি বুঝলো কে জানে। তার মুখে হাসি ফোটে। সেই হাসি দেখে পল্টু ও হাসে ঘর কাঁপিয়ে।
বেলি বেরিয়ে যেতে নিলে মায়মুনা দাড়িয়ে বলে,
– বান্দীর ঘরে বান্দী আমার বাসায় গুন্ডা নিয়ে এসে মাস্তানি করস। নাগর নিয়ে আসছিস কেন? একলা আসতি একদম চুল ছিড়ে হাতে ধরিয়ে দিতাম।
বেলির থমকে দাঁড়ায়। পল্টু চোখ রাঙিয়ে তেড়ে যেতে যেতে,
– তোরে আমি খাইছি আজকে।
বেলি পল্টুকে থামিয়ে দেয় নিজে এগিয়ে যায় মায়মুনার দিকে। তারপর বলে,
– এই নাও। একাই আসছি। কি করবে এখন?
মায়মুনা থতমত খেয়ে তাকিয়ে থাকে বেলির দিকে। বেলি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে একদলা থুথু ছুড়ে মারে মায়মুনার মুখে। ঘটনার হতবিহ্বলতায় সবার মুখ হা হয়ে যায়। বেলি আর কোনো শব্দ ব্যায় না করে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। পল্টু আবার ঘর কাঁপিয়ে হেসে দেয়। তারপর পা বাড়ায় বেলির পিছন পিছন।
এবারে মায়মুনা একটা চাপা আর্তনাদ করলো।তারপর রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,
– দেখছো, কাজটা দেখছো তোমার বউয়ের। ওরে কাঁচা চাবায়ে খেয়ে ফেলতে মন চাচ্ছে। আর ওই গুন্ডাটা কি ভয়ানক ভাবে হাসলো দেখছো। বিচ্ছিরি একদম
কথা শেষ করেই দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। সুখন অসহায় ভাবে কিছুক্ষণ ঐ দিকে তাকিয়ে থেকে নাকে বরফ চেপে ধরলো।
পল্টু লিখনকে কোলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
– আপা চলো কিছু খেয়ে নেই। পেটে তো ক্ষুধায় ইদুর দৌড়াদৌড়ি শুরু করছে।
বেলি গম্ভীর মুখে বললো,
– চুপ থাক।
পল্টু শুকনো মুখে বললো,
– আমি চুপ থাকলে কি হইবো। পেটে তো চুপ থাকে না। দেখো কেমন অদ্ভুত সব শব্দ করে।
পল্টু কথাটা শেষ করা মাত্রই বেলির পেটেও একটা অদ্ভুত শব্দ হয়। বেলি আশে পাশে চোখ বুলায় একবার। চারদিকে মানুষের কথা আর গাড়ির শব্দে শব্দটা কেউ শুনতে পায় না ভেবে চুপ করে যায়। কিছুক্ষণ পর বলে,
– চল, পল্টু কিছু খেয়ে নেয়া যাক।
কথাটা শুনে পল্টু খুশি হয়। খুশিতে তার মধ্যে একটা গদগদ ভাব চলে আসে। সে পাশের রেস্টুরেন্টের দিকে হাত তুলে বলে,
– চলো, ঐ খানেই যাই।
তারা পা বাড়ালো রেস্টুরেন্টের দিকে।
রহমত শেখ পানের খিলিটা মুখে দিয়ে কুলসুম বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে,
-এসবের কোনো দরকার নাই বেয়াইন। আপনার সম্পত্তি দিয়ে বেলি কি করবে বলেন! আর তাছাড়া আমরা তো আর বেলিকে ঐ বাড়িতে দিবো না। বেলিও যাবে না বলছে। তাহলে তো এসবের দরকার নাই।
আহমেদ শেখও ভাইয়ের কথাতে সায় দেয়। কুলসুম বেগম অনুনয়ের স্বরে বললেন,
– আমি সব কিছু আমার নাতিকে দিয়ে যাবো। আমার বউমা কে দিয়ে যাবো। মেয়েটা আমার জন্য অনেক করেছে। তাকে আমি ঠকাতে পারবো না৷ আর তাছাড়াও আমি আমার ছেলেকে একটা শিক্ষা দিতে চাই। আর যাওয়ার জন্য আমিও বলি না। যদি সুখন কোনোদিন ভালো হয় তাহলে বেলি ভেবে দেখবে যে সে যাবে কি না।এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই
রহমত শেখ বলেন,
– আপনার ছেলেকে শিক্ষা দিতে হলে আপনি অন্যভাবে শিক্ষা দেন৷ আমরা বা বেলি কেউই আপনার সম্পত্তি চাই না৷
কথার মাঝখনেই পান্না বেগম উপস্থিত হলেন নাস্তা নিয়ে। রহমত শেখ বললেন,
– নেন, নাস্তা নেন।
কুলসুম বেগম উঠে দাঁড়িয়ে পরে। বলে,
-না ভাইসাব, খাবো না কিছু। আমাকে বাসায় যেতে হবে খালি বাসা রেখে এসেছি। বেলি তো এখনো এলো না। দেখে যেতাম মেয়েটাকে।
আহমেদ শেখ বললেন,
– আমাদের বাড়িতে এসে না খেয়ে যাবেন এইটা হয় না। দুপুরের খাবার খেয়ে পরে যাবেন।
কুলসুম বেগম কিছু বলতে যাবেন তার আগেই বেলি এসে উপস্থিত হলো।
বেলির কোলে লিখনকে দেখে কুলসুম বেগম নিজেট চোখে পানি উপস্থিতি টের পেলেন। চোখ মুছে এগিয়ে গেলেন তাদের কাছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
– আমার ছেলে ঘরে হীরা রেখে পঁচা শামুকে পা কাটতে গেছে। ও ভুগবে, অনেক ভুগবে। আমি তোমাকে আর ঐ বাড়িতে যেতে বলবো না। যদি কোনোদিন আমার ছেলে সত্যি ভালো হয়ে আসে তবেই যেয়ো।
কথা শেষ করে তিনি লিখনের কপালে চুমু খেলেন। তারপর বেরিয়ে গেলেন। পিছন পিছন বাড়ির সবাই ডাকলো তিনি দাড়ালেন না। সোজা পৌঁছুলেন উকিলের অফিসে। বেলির নামে কিছু সম্পত্তির লিখে দেওয়ার ব্যবস্থা করে বাসায় গেলেন। বাসায় যেতে মন চায় না তার। তবুও পাগুলো টেনে বাসায় গেলেন। এখন তার প্রতিটা রাত শেষ হয় সুখনকে গালি দিতে দিতে।
শেখ বাড়ির মেয়ে বউরা উঁকি দিয়ে বুঝার চেষ্টা করছে পুলিশ কেন এসেছে। তারা কৌতুহল দমন করতে পারছে না। আহমেদ শেখ কথা বলছে পুলিশের সাথে।
পুলিশকে বিদায় দিয়ে আহমেদ শেখ বাড়ি ঢুকতেই পান্না বেগম এগিয়ে আসেন। জিজ্ঞেস করেন,
– কি হয়েছে? পুলিশ কেন?
আহমদ শেখ হেসে বলে,
– সুখন জিডি করেছে পল্টুর নামে। তাকে বাসায় গিয়ে মারধর আর শাসানির জন্য।
পান্না বেগম অবাক হলেন। বললেন,
– জিডি মামলা সব তো আমাদের করা দরকার। ওরে পথে পথে ঘোরানো দরকার।আমার মেয়েটার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছে।
আহমেদ শেখ বললেন,
– হবে হবে। সব হবে।
বলেই রুমে ঢুকে গেলেন।
সন্ধ্যার সময় বেলি বারান্দায় বসে ছিলো।চোখ বন্ধ করে। মা লিখনকে নিয়ে একটু বেরিয়েছে। জেঠিমা রান্নাঘরে কিসব যেন করছে।
হঠাৎ একটা সুমিষ্ট পুরুষালী কন্ঠ কানে এলো। চোখে বেলি চারদিকে তাকালো। কিছুটা দূরে একটা ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছে। বেলি কাপড় ঠিক করে বললো,
– কে!কাকে চাই?
রহমত শেখের বউ মিনু আক্তার দৌড়ে রান্নাঘর থেকে বের হলো। বললো,
– প্রতীক এলি নাকি!
অন্ধকারে থাকা লোকটা এবার এগিয়ে এলো, মিনু বেগমের পা ছুঁয়ে সালাম করে বললো,
– ফুপি কেমন আছো?
মিনু বেগম লোকটার মাথায় হাত রেখে বললো,
– ভালো বাবা। তুই কেমন আছিস? বাড়ির সবাই কেমন আছে?
– জ্বি। ভালোই আছে।
মিনু বেগম অভিযোগের সুরে বলেন,
-কতদিন পরে এসেছিস এই বাড়িতে। আমার কথা মনে পড়ে না কি তোদের!
লোকটা উত্তরে হেসে বেলির দিকে তাকালো।
লাইটের আলোয় স্পষ্ট দেখা গেলো লোকটার মুখের হাসি। উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রং, বেশ লম্বা। টিকালো নাক, চোখগুলো জ্বলজ্বল করছে৷ দেখে বেশ বুদ্ধিমান মনে হলো বেলির কাছে।
মিনু বেগম তার দৃষ্টি লক্ষ করে বেলির দিকে তাকালো বললো,
– ও হচ্ছে বেলি। আমার দেবরের মেয়ে৷
বেলি তখনো একদৃষ্টিতে লোকটার দিকে। চেনা চেনা লাগছে লোকটাকে।
লোকটা একটু এগিয়ে এসে বললো,
– কেমন আছো, বেলি?
বেলির যেন একটু অস্বস্তি হলো। চোখ তুলে তাকলো তার জেঠিমার দিকে।
জেঠিমা হেসে বললেন,
– চিনিস নি! আরে এটা প্রতীক। ঐ যে গরু শিং দিয়ে গুঁতিয়ে পুকুরে ফেলে দিয়েছিলো।
বেলির চোখের সামনে ঘটনা ভেসে উঠলো, পুকুরে পড়ে গিয়ে ভিজে জুবুথুবু হয়ে যাওয়া মুখটা মনে পড়তেই বেলি হেসে ফেলে। কিন্তু সেই চেহারা আর নেই অনেক পরিবর্তন হয়েছে। চেনায় যাচ্ছে না তাকে। বেলি বললো,
– ভালো। আপনি কেমন আছেন?
প্রতীক লজ্জা পেয়ে যায়। কান লাল হয় লজ্জাতে। বলে,
– ভালো।
মিনু বেগম প্রতীকে নিয়ে গিয়ে রুমে বসালো। তাকে চা নাস্তা দেওয়া হলো। খানিক বাদেই রহমত শেখ বাড়ি ফিরলেন। তিনি প্রতীকের সাথে কোশল বিনিময় করে বললেন,
– শুনলাম তুমি অনেক নামকরা লইয়ার। উকালতি করে বেশ নাম ডাক কামিয়েছো। তা বাবা আমাদের একটা সাহায্য করতে পারবে।
প্রতীক রহমত শেখের মুখের দিকে তাকালো। তারপর
বললো,
– জ্বি, জ্বি বলুন।
রহমত শেখ বেলিকে ডাকলেন। বেলি ভিতরে এলো।
রহমত শেখ বেলির সব কথা খুলে বললেন প্রতীককে। প্রতীক গম্ভীর মুখ করে শুনলো সবকিছু। তারপর বললো,
– এখন আপনারা কি চান?
রহমত শেখ বললো,
– দেখো আমরা চাইছি ওর বিরুদ্ধে একটা শক্ত মামলা দিতে। এই বিষয়েই আমাদের তোমার সাহায্য প্রয়োজন। তুমি আইনের লোক। কিভাবে কি করলে ঐ হারামজাদা ভোগবে বেশি সেটা তুমি বলতে পারবে। আইনের মারপ্যাচ ছলাকলা বুঝো বেশি তোমরা।
বেলি এতক্ষণ নিরবে এককোণে দাঁড়িয়ে ছিলো৷ এবার সে বেরিয়ে গেলো। প্রতীক তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বললে,
– আমি আমার সর্বোচ্চটা দিয়েই আপনাদের সাহায্য করবো। ওই লোকের কঠিন থেকে কঠিন শাস্তি হবে। আপনারা চিন্তা করবেন না।
মনে মনে বললো,” আমি ভেবেছিলাম তুমি সুখে আছো।”
চলবে,