এসো বৃষ্টি হয়ে পর্ব-০১

0
2043

#এসো_বৃষ্টি_হয়ে
সূচনা পর্ব
লেখিকা- সায়ুরী দিলশাদ

নিজের স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের কাগজটা হাতে নিয়ে ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো বেলি। তার বুকের ভিতরটা এই মুহূর্তে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। আরেক বার চোখ বুলালো কাগজটাতে। নাহ কোনো ভুল নেই। স্পষ্ট সুখন আর মায়মুনা নামের মেয়েটার ছবি কাগজে। এপ্রিলের ৫ তারিখ বিয়ে করেছে কোর্টে গিয়ে। আড়াই বছরের বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকাতেই আর কান্না আটকে রাখতে পারলো না বেলি। হুহু করে কান্নায় ভেঙে পড়লো।কি করে পারলো সুখন এমনটা করতে তার সাথে। আড়াই বছরের ছেলে লিখন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে বেলির দিকে। মায়ের দিকে তাকিয়ে হয়তো বুঝার চেষ্টা করছে যে কি হয়েছে। খানিক বাদে মুখ দিয়ে অনবরত “বাবাবাবা” শব্দ করতে করতে ছুটলো মায়ের দিকে। বেলি জড়িয়ে ধরলো ছেলেকে। তাদের যে সব শেষ হয়ে গেলো। এই ছোট ছেলেটা কি বুঝতে পারছে যে সে তার বাবাকে হারিয়ে ফেলছে একটু একটু করে। কান্নার বেগ বাড়লো বেলির। চুপচাপ মায়ের বুকের সাথে মিশে আছে সে। তার ঘুম পাচ্ছে। সে ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করলো। যোহরের আজান পড়ছে চারদিকে। বেলি ফ্লোর থেকে উঠে লিখনকে বিছানায় শুইয়ে দিলো। দুইপাশে দুইটা পাশ বালিশ দিয়ে ছেলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ফোনটা হাতে নিলো। মিনিটকয়েক ভেবে কল করলো তার জেঠা কে।

বাজারের সবচেয়ে বড় মাছটা দেখে কেনার লোভ সামলাতে পারলেন না রহমত শেখ। জেলে কে জিজ্ঞেস করলেন,
– কিরে গোপাল, দাম কত?
গোপাল পান খাওয়া লাল দাত বের করে হেসে বললো,
– শেখ সাব, আপনারে দাম কওনের কি আছে। আপনার মনে যা চায় তাই দিয়া দেন। তয় এইডা কইতারি আজকের বাজারে এইডায় সবচেয়ে বড় মাছ। বিশ্বাস না করলে ঘুইরা দেহেন পুরা বাজার টা।
রহমত শেখ মাথা নাড়িয়ে হাসলেন। কিছু বলতে যাবেন ঠিক তখনি ফোনটা পাঞ্জাবির পকেট কাপিয়ে বেজে উঠলো। কপাল কুঁচকে পকেট থেকে ফোনটা বের করতেই কপালের ভাজ কেটে গেলো। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো। রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে থমথমে গলায় কিছু শুনতেই রহমত শেখ পাগলের মতো বেরিয়ে গেলেন।
গোপাল হা করে কিছুক্ষণ রহমত শেখের চলে যাওয়া দেখলো। তার মন ক্ষুন্ন হলো রহমত শেখ চলে যাওয়াতে। আজকে আর মনের মতো দাম পাওয়া হলো। সে নিশ্চিত ছিলো রহমত শেখ মাছটা তার আশানুরূপ দামের থেকেও বেশি দাম দিয়ে কিনতো।
“কি ভাই, বোয়ালটা তো দেখি অনেক বড়। কত?”
গোপালের ধ্যান ভাঙলো। সে হাসি হাসি মুখ করে তাকালো লোকটার দিকে।

রহমত শেখ হাতে বিয়ের কাগজটা স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন সোফাতে। খানিকটা দূরেই আরেটকা সোফাতে বেলি ওড়নাতে চোখের পানি মুছছে। রহমত শেখের রাগে চোখমুখ শক্ত হয়ে এলো। মুখ দিয়ে নোংরা একটা গালি ছুড়ে দিলো সুখনের উদ্দেশ্যে। তারপর বেলিকে বললো,
– বাড়ি চল আমার সাথে।
বেলি মাথা নেড়ে না বললো। রহমত শেখ এতে আরও রেগে গেলেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
– যাবি না কেন? এই হারামজাদার সাথে বুঝাপড়া পড়ে করবো। মাইরা হাড়গুড় ভাইঙ্গা দিবো। বিয়া করার শখ মিট্টা যাইবো।
বেলি আবারও শব্দ করে কেঁদে উঠলো। এইবার রহমত শেখ প্রচন্ড বিরক্ত হলেন। বিরক্তিতে মুখ দিয়ে “চ” শব্দ বের হলো অস্পষ্ট ভাবে। বললেন,
– কাঁদবি না একদম। কান্নাকাটি ভালো লাগে না আমার। তুই কি চাস আমারে বল একবার। ওরে মাইরা ফালাইতে কইলে মাইরা ফালামু। আমার বংশের মেয়ের সাথে বেঈমানী। তুই বল শুধু
বেলি চোখ মুছে জেঠার দিকে তাকালো। ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গেছে। শুঁকনো ঠোঁট গুলো নড়লে এইবার। বললো,
– জেঠা তুমি খোঁজ লাগাও, এই কাগজ সত্য কি না। এই বিয়ে সত্য কি না। এই মেয়ে কে? কোথায় থাকে? কি করে? ওর সাথে কিভাবে পরিচয় সুখনের।
রহমত শেখ মাথা নেড়ে বললো,
– সেইসব খোঁজ তো নিবোই। এখন তুই বাড়ি চল আমার সাথে।
বেলি বললো,
– না। এখন না। আগে সব কিছু জেনে নিই তারপর।
রহমত শেখ কাগজটা বেলির সামনে রেখে বললো,
– এটা দেখার পর আর কি জানার জন্য অপেক্ষা করবি তুই?
– জেঠা এখনো অনেক কিছু জানা বাকি।
কথাটা বলেই বেলি উঠে পড়লো। পরক্ষণেই আবার কি মনে করে বসে বললে,
– জেঠা তুমি এই কাগজটা ফটোকপি করে আসলটা আমাকে দিয়ে দাও। আর নকলটা নিয়ে তুমি খোঁজ খবর করো।
রহমত শেখ খানিকক্ষণ বেলির দিকে বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো,
– ফটোকপি করতে হবে কেনো?
বেলি চারপাশে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো,
– করতে হবে। কারণ যদি সুখন কাগজটার খোঁজ করে না পায় তাহলে ও তো সন্দেহ আমাকে। ভাববে আমি জেনে গেছি। সতর্ক হয়ে যাবে। তাই আসল কাগজটা আমি ঐ জায়গাতেই রেখে দিবো।
রহমত শেখ বুঝলেন না এখন লুকোচুরির কি দরকার। তার মতে এখন সুখনকে ধরে এনে ওর গোপনাঙ্গ কেটে ফেলাই সবচেয়ে উত্তম কাজ। নাহলে ওর হাত পা ভেঙে ফেলা।
– জেঠা
রহমত শেখের ভাবনায় কিঞ্চিত ছেদ পড়লো বেলির ডাকে। তিনি অস্পষ্ট ভাবে বললেন,
– উ
হাতের ঘড়িটা দেখতে দেখতে বেলি বললো,
– আমাকে যেতে হবে। লিখনকে রেখে এসেছি মায়ের কাছে। তুমি যদি কাগজটা ফটোকপি করিয়ে আমাকে দিয়ে দিতে।
রহমত শেখ একবার বেলির দিকে তাকালো বেলির একটা সন্তান আছে এটা এতক্ষণ পর তার মাথায় ঢুকলো। বেলির এখন কি হবে! মেয়েটার চারদিক যে অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে রহমত শেখ।
কেউ একজনকে ডাকতে গিয়েও ডাকলেন না তিনি। বেলি যখন বিষয়টা গোপন রাখতে চাইছে তখন তাই থাক। নিজেই উঠলেন সোফা থেকে। বললেন,
– তুই চা খা। আমি গিয়ে কাগজটা ফটোকপি করে নিয়ে আসি।
রহমত শেখ বেরিয়ে গেলো। বেলি চুপচাপ সোফায়টায় বসে রইলো। এই জেঠা তাকে অনেক আদর করে ছোটবেলা থেকেই তার কোনো সমস্যাই সবার আগে তিনিই এগিয়ে আসেন। তাই আজ এই এত বড় বিপদেও সবার আগে তার কথায় মনে হয়েছিলো।তাই তাকেই কল করেছিলো। জেঠা তাকে তার অফিসে আসতে বলেছিলো। বেলি তার শাশুড়ীকে দরকারের কথা বলে বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছিলো। এতক্ষণে হয়তো লিখন উঠে গেছে। বুড়ো মানুষটা আদৌও লিখনকে সামলাতে পারেছেন কি না কে জানে। এই মানুষটাগুলো তাকে বড্ড ভালোবাসে। ভালো তো সুখন ও বাসতো। কিন্তু এখন.. ভাবতেই চোখ জলে ভরে উঠে। বেলি ওড়না দিয়ে চোখ মুছে। কেন এমন হলে তার সাথে। দরজা ঠেলে পল্টু ঢুকলো। পল্টু হলো রহমত শেখের ডান হাত। তাদের বাড়িতে তার অবাদ যাতায়াত। বাড়ির মহিলাদের সাথে তার বেশ খাতির। তিনবেলায় রহমত শেখের বাড়িতে তার ভাত খায়। মোট কথা ছোটবড় সব কাজেই পল্টু থাকে। বেলি তৎক্ষনাৎ নিজেকে সামলে নিলো নাহলে সবাইকে বলে দিতে পারে। গুনগুনিয়ে গান গায়তে গায়তে বেলি সামনে চায়ের কাপ রাখলো পল্টু। একগাল হেসে বললো,
– কি! বেলি আপা ভালো আছ?
বেলি হাসার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। বিষাদ মুখেই বললো,
– ভালো পল্টু ভাই। তুমি কেমন?
বেলির মুখের মলিনতা চোখ এড়ালো না পল্টুর। কিছু যে একটা হয়েছে সেটা আঁচ করতে পেরেছে পল্টু। কিন্তু কিছুই বললো না সে সম্পর্কে। বেলির প্রশ্নের উত্তরে “ভালো” বলেই বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। কিছু তো একটা হয়েছে বেলির আপার সেটা খোঁজে বের করতে হবে তার। বেলি আপা তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ যার জন্য সে তার কলিজাটাও দিয়ে দিবে।
________
সন্ধ্যার দিকে সুখন বাসায় আসতেই লিখন “বাবাবাবা” বলে তার কাছে গেলো। সুখন হাসিমুখে ছেলেকে কোলে তুলে নিল। বেলি রান্নাঘরের দরজায় দাড়িয়ে ওদের দুজনকে দেখতে লাগলো। সে জানে না আর কতদিন ওদের দুজনকে এভাবে দেখতে পারবে। বুকচিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। সুখনের চোখে চোখ পড়তেই বেলি রান্নাঘরে ঢুকে গেলো। হঠাৎ করেই সুখনের মনের ভিতরটা অজানা আশঙ্কায় ছেয়ে গেলো। ভয় হতে লাগলেো প্রচুর, এমনভাবে বেলি কেনো চলে গেলো। কি হয়েছে ওর? আচ্ছা অফিসে যাওয়ার আগে কি বেলির সাথে ওর ঝগড়া হয়েছিলো! কিংবা কাল রাতে। নাহ্ তেমন কিছু তো হয় নি তাহলে বেলির কি হয়েছে?
রাতে সব কাজ শেষ করে রুমে ঢুকতেই বেলিকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো সুখন৷ বেলির শরীরের আনাচকানাচে নিঃশব্দে বিচরণ করতে সুখনের হাত। কাঁধে পড়ছে গরম নিশ্বাস। বেলি শক্ত হয়ে ঠায় দাড়িয়ে রইলো। সুখন মুখ খুললে প্রথমে। বললো,
– কি হয়েছে আমার বউটার। এই সুন্দর মুখশ্রীটায় এমন মলিনতা ভর করেছে কেন? আমি কি কোনোভাবে কষ্ট দিয়েছি আমার বউটাকে।
বেলির চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করলো,
” হ্যা কষ্ট দিয়েছো। তুমি প্রতারণা করেছো আমার সাথে। আমার সব আশা ভরসা নষ্ট করে দিয়েছো। ” কিন্তু মুখে কিছুই বললো না বেলি। চুপচাপ দাড়িয়ে নাটক দেখতে লাগলো সুখনের।
সুখন বেলিকে চুপ থাকতে দেখে আবার বললো,
– কি হলো বলো কিছু। তুমি এমন মুখ করে রাখলে আমার খারাপ লাগে। ভালোবাসিতো..
বেলি চমকে তাকালো সুখনের দিকে। সুখনের কথা অর্ধকেই থেমে গেলো। চোখে চোখ রেখে তাকালো বেলি। রাজ্যের বিস্ময় আর কৌতুক ভরা চোখ নিয়ে প্রশ্ন করলো,
– ভালোবাসো?
কন্ঠ ঝরে পড়লো শ্লেষ আর কটাক্ষের সুর।
সুখন বেলির চোখে চোখ রাখতে পারলো না আর সরিয়ে নিলো। বেলির চোখে যে অবিশ্বাস।

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে