#এমনই_শ্রাবণ_ছিল_সেদিন
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
[কমেন্টের স্ক্রিনশটটা খেয়াল করবেন সকলে]
৮.
খেয়াম এখন শুধুই পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। কারণ, মেহফুজের ছবির শ্যুটিঙের কাজ সম্পূর্ণ শেষ। এখন শুধু ধারণকৃত ভিডিয়োগুলো একত্রিত ও ধারণকৃত শব্দ সম্পাদনা, সব ধরনের শব্দ মিশ্রণ এবং সংগীতের সুর করা ও সংগীত ধারণ করা হচ্ছে। কম্পিউটার গ্রাফিক কোনো দৃশ্য থাকলে তা যোগ করা হচ্ছে। এখানে আপাতত খেয়ামের কোনো কাজ নেই। তাকে বেতনটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে কিছু দিনের জন্য বিরতি দিয়েছে কাজ থেকে। মেহফুজের পরের কাজ আরম্ভ হলে তখনই তার কাজ শুরু হবে। কারণ, মেহফুজের অধীনে ছাড়া সে আর কারও কাজে নিয়োজিত হবে না বলে ভেবেছে। প্রায় মাস দুয়েকের লম্বা একটা ছুটি পেয়েছে সে কাজ থেকে। এর মাঝে বাড়ি থেকেও ঘুরে এসেছে। পড়াশোনা, ইউনিভার্সিটি, বন্ধুদের নিয়ে বেশ চলে তার সময়গুলো। সেই সময়ের মাঝে নতুনত্ব আসে তো সেদিন, যেদিন সে ফেসবুকের ইনবক্সে নয়ন খন্দকার আইডি থেকে মেসেজ পায়। তার লেখা একটি ছোটো গল্পের প্লট পছন্দ হয়েছে বর্তমানের জনপ্রিয় পরিচালক আরহাম মেহফুজের। এবং খুব শীঘ্রই তার প্লটে একটি নাটক নির্মাণ করতে চায় সে। তার গল্পটা চেয়ে নয়ন এই কথাগুলো বলে মেসেজ করেছে তাকে। তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায়। ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে খেয়ামের দুদিন সময় লাগল। এ দেশের লেখক সমাজে জনপ্রিয় লেখকদের সুন্দর লেখার শেষ নেই। শেষে কিনা আরহাম মেহফুজ তাদের রেখে তার মতো চিপাগলিতে আটকে থাকা মানুষের অখাদ্য লেখা পছন্দ করল? তার জানামতে আরহাম মেহফুজ একজন বিচক্ষণ মানুষ। তবে এমন বোকামি কী করে করছে সে? না কি সত্যিই ভিন্ন এবং ভালো লাগার মতো কিছু খুঁজে পেয়েছে তার লেখাতে? এসবের পাশাপাশি আরও একটি চিন্তা উদয় হলো খেয়ামের। এখনকার পরিচালক তো কতশত লেখকদের গল্প নিয়ে কাজ করে সামান্য কৃতিত্বটুকুও দেয় না। আর সম্মানী তো দূরে থাক। সেখানে এই মানুষটা এতটা নীতিবান! সে চাইলে তাকে না জানিয়ে বা তার থেকে অনুমতি না নিয়েই কাজ শুরু করতে পারত। তাতে খেয়াম চাইলেও কিছু বলতে বা করতে পারত না। অবশ্য করার ইচ্ছাও হতো না তার। কিন্তু মানুষটার চারিত্রিক গুণাবলিতে সে দিন দিন আকৃষ্ট হয়েই চলেছে।
তার থেকে এসব জানার পর রাহি অতি উত্তেজনায় তাকে বলল, ‘দোস্ত, তোর ভাগ্য খুইলা যাচ্ছে রে। এখনি ফোন করে তোর মেহফুজ স্যারকে জানায়া দে ষষ্ঠ তারা মানুষটা তুই নিজেই।’
খেয়ামের এখনও বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি। সে নীরবে ঠায় বসে রইল। রাহি তার কাঁধ ঝাঁকিয়ে আবার বলল, ‘কীরে, খুশিতে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলি নাকি? ফোন করে জানা ওনারে। যোগাযোগ করতে চাইছে না তোর সঙ্গে?’
খেয়াম দেবম‚র্তির মতো বসে থেকে বলল, ‘আমি পারব না ওনার সামনে যাইতে। বলতেও পারব না আমার পরিচয়।’
রাহি এ কথায় রাগান্বিত হলো, ‘মানে কী? কী হইছে তোর? এমন ভং ধরছিস ক্যান? বলবি না তো কী করবি? কাজ করতে দিবি না ওনারে তোর গল্পে?’
-‘দেবো না ক্যান? করবে, অবশ্যই করবে। আমি আমার পরিচয় দিয়ে ওনার সামনে যাইতে পারব না রে।’
-‘আরে ক্যান? কারণ কী?’ বিরক্তিতে চেঁচিয়ে ওঠে রাহি।
খেয়ামের অস্বস্তির কারণ খেয়াম নিজেও বুঝতে পারছে না। এত দিন মানুষটার সামনে কাজ করতে কোনো দ্বিধা, সঙ্কোচ কাজ করেনি তার। হঠাৎ করে তার মনের অন্তঃস্থলে অতিথি পাখির মতো অজানা এক রাশ অযৌক্তিক, অকারণ লজ্জা আর সংশয় কোথা থেকে এসে যেন হঠাৎ বাসা বেঁধেছে। ওই মানুষটির সামনে নিঃসঙ্কোচে কাজ করতে সে পারবে না, যখন ওই মানুষটি জানতে পারবে Dew Drop নামের এলোমেলো লেখাটি তারই। যেই গল্পে একজন বিদেশিয়ো সুন্দরী রমণী এ দেশের মাটিতে আসে বেড়াতে। আর এখানে আসার পর এ দেশের শ্রাবণধারার প্রেমে পড়ে যায় সে। আর তারপর আরও একটি চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে যায় তার সাথে। তার থেকেও চার বছরের ছোটো এ দেশের একজন বর্ষাপ্রেমিক ছেলের প্রেমে পড়ে সে। একই সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে অনাকাক্সিক্ষতভাবে কবে যেন সেই ছেলেটিও ভালোবেসে ফেলে তাকে। কিন্তু মেয়েটির বাগদত্তা অপেক্ষা করে আছে তার জন্য তার জন্মভূমিতে। একটি অসম আর অসমাপ্ত প্রেমের গল্পই সে এক বৃষ্টির রাতে তার অগোছালো চিন্তাধারা মিশিয়ে লিখেছিল। আর আজ সেই গল্পটির ঠাঁই হবে কিনা টিভির পর্দায়! এও কি সম্ভব? এত বড়ো বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে ওঠা যে তার পক্ষে অসম্ভব। কী করে বোঝাবে সে এই কথা রাহিকে?
***
পৌষের মাঝামাঝি। কুয়াশার পুঞ্জীভূত ধুম্রজাল চিরে পুব আকাশে রবি নিজেকে উদিত করে জানান দিচ্ছে নগরবাসীকে, ‘রাত যে পোহালো।’ মেহফুজের ঘুম ভেঙেছে তার উদয় মুহূর্তের পূর্বেই। খুব ভোরে তার দৌড়ানোর অভ্যাস। কাছের লেক থেকে ফিরে লনে এসে দাঁড়িয়েছে। মাকে দেখা যায় উপরে তার ঘরের জানালা থেকে। ছেলেকে দেখে হাত নেড়ে সুপ্রভাত জানালেন তিনি। তারপর ইশারায় লনে বসতে বললেন ছেলেকে। মেহফুজ গিয়ে বসে লনের ডান পাশে রাখা শৌখিন ধাঁচের বেতের চেয়ারগুলোর একটিতে। মা আসছেন কফি নিয়ে, তা সে জানে।
লনের ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশিরবিন্দুগুলো মুক্তোদানার মতো ঝলমল করছে কোমল সূর্যরশ্মিতে। কী যে সুন্দর লাগছে দেখতে! লনের বাম পাশে মায়ের হাতে রোপণ করা নানান ফুলের গাছ। অর্কিড, বার্ডস নেস্ট ফার্ন, বস্টন ফার্ন, সিলভার ফার্ন, রিবন ফার্ন দিয়ে সাজানো বাগানের এক ভাগ। আবার অন্য ভাগে অ্যাজেলিয়া, জেনারিয়াম, অ্যান্থুরিয়াম, স্যালভিয়ার মতো রংবাহারি ফুলের গাছেও ভরিয়ে তোলা। ক্রোটোন, ফক্সটেল, অ্যালপিনিয়া, ক্যালডিয়াম, ক্যালানথিয়ামের মতো পাতাবাহার আর নানাজাতের পাম গাছও রেখেছেন তিনি। গাছগুলোর পাতা থেকে টুপটুপ করে শিশির ঝরে পড়ার দৃশ্য আর পাখিদের কলরব মনটাকে যেমন আন্দোলিত করে তুলে, তেমনই চোখের আরামও দেয়। সকাল আর বিকালে এখানটাতে বসলে মনটা অন্যরকম প্রশান্তি আর স্নিগ্ধতায় ছেয়ে যায় যেন।
মা এলেন শাল গায়ে জড়িয়ে হাতে দুমগ কফি নিয়ে। ছেলেকে আজ বেশ প্রফুল্ল লাগছে যেন। বসতে বসতে বললেন, ‘ছবিটা মুক্তি পেয়ে গেল অবশেষে?’ মেহফুজ কফিতে চুমুক দিয়ে মৃদু হেসে হ্যাঁ জানাল। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘মুন ওঠেনি?’
-‘না। শীত এলে তো বেলা করে ওঠে।’
-‘অফিসের দেরি হয়ে যাবে তো।’
-‘তুই কখন বের হবি?’
-‘এইতো ঘণ্টা দুইয়ের মধ্যে।’
-‘আমি রান্না চাপাই গিয়ে তাহলে। তুই আয়।’
মা বিদায় নেওয়ার পর মেহফুজ নয়নকে কল করে। তিনবার রিং বাজলে নয়ন ঘুমু ঘুমু স্বরে হ্যালো বলতেই মেহফুজ তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘আমাকে কোনো আপডেট দিলে না যে? গতকাল রাতেই তো জানানোর কথা ছিল।’
নয়ন যেন লাফ দিয়ে উঠে বসেছে, এমন তড়িঘড়ি কণ্ঠে বলে, ‘স্যার…আসলে…মানে কী বলব! কাল রাতে যে কখন দ্রুত ঘুমিয়ে পড়েছি তা বুঝতেই পারিনি। আমি এখনি আপনার বাসায় চলে আসছি।’
-‘ধীরে ধীরেই আসো। সমস্যা নেই।’
নয়ন কোনোরকমে নাশতা সেরেই উপস্থিত হয়েছে মেহফুজের বাসায়। মাঝেমাঝে নয়নের কার্যকলাপ এমন হয় যেন মেহফুজের আজ্ঞাবহ দাস সে। যার জন্য কিছু আদেশ করার পূর্বেই তাকে প্রস্তুত থাকতে হয়। তাকে এমন পড়িমরি করে শীতের এই সকালবেলায় আসতে দেখে মুন কতক্ষণ তাকে নিয়ে নীহারের রান্নার পাশে দাঁড়িয়ে হাসি মজা করেছে তার সাথে। মেহফুজ তৈরি হয়ে নিচে নেমে নয়নকে দেখে একটুও অবাক হলো না। নয়ন তার অতি বাধ্য একজন কর্মচারী। গত চার বছরে তার এমন কার্যকলাপ দেখে সে অভ্যস্ত। খাবার টেবিলে বসে তাকে ডাকল, ‘নয়ন এসো, খেতে খেতে কথা বলি।’
সে ড্রয়িংরুমে বসেছিল হাতে পত্রিকা নিয়ে। ডাইনিং স্পেস থেকে মেহফুজের কণ্ঠ শুনে এগিয়ে এসে বলল, ‘আমি খেয়ে এসেছি স্যার। সমস্যা নেই, আপনি নাশতা করেন। আমি অপেক্ষা করছি।’
-‘আরে বললাম বসতে, বোসো।’
নয়ন কখনোই মেহফুজের আদেশ অমান্য করতে পারে না। তাই আদেশ পেয়েই সে তার পাশের চেয়ারটা টেনে বসে পড়ে। মুন রান্নাঘর থেকে এসে দুজনের খাবার বেড়ে দেয়। মেহফুজ তাকেও বলল, ‘তুইও বসে পড়। দেরি করে কী করবি?’
-‘না, আজ দেরি করেই যাব। তোরা খেয়ে নে।’
খাবার বেড়ে দেওয়ার মুহূর্তে মুন আর নয়নের চোখে চোখ পড়লে দুজন সৌজন্য বিনিময়ের হাসি হাসল কেবল। মুন রান্নাঘরে ফিরে যেতেই নয়ন কথা শুরু করল, ‘স্যার সে একজন মেয়ে। নামটা যেন কী বলল! আরাধ্যা না আরদ্রা? ঠিক মনে পড়ছে না এখন। তো যা-ই হোক, সে রাজি হয়েছে গল্পটা আমাদের দিতে। যদিও রাজি তো হবেই। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হলো সে আমাদের সঙ্গে মিট করবে না। মানে আমরা যেহেতু তার গল্পের মূল কাহিনিটুকু নেবো তাই তার দেখা করাটা খুব জরুরি নয়। সে বলেছে, আমরা তার সম্মানীর বিষয় ভাবতে চাইলে সেটা বিকাশ বা অন্য কোনো মাধ্যমেও ব্যবস্থা করতে পারি। আর আমারও মনে হলো যেহেতু গল্পের পুরো গঠন, সংলাপ, সব আপনিই সাজাবেন তাই তার সঙ্গে সামনাসামনি সাক্ষাৎ না হলেও চলে আমাদের। ছোটোখাটো ফেসবুক রাইটার তো। আমাদেরও তার সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশের দরকার কী?’
মেহফুজ খেতে খেতে বলল, ‘ফেসবুক রাইটার বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা উচিত নয় আমাদের। আর সে যদি না চায় তো আমাদেরও প্রশ্ন আসে না তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার। কথাবার্তা বলে সব ক্লিয়ার করে নিয়ো। এই গল্পটা নিয়ে আমি আগামী বছর কাজ শুরু করব। মানে আষাঢ়, শ্রাবণ মাসেই।’
***
গাজীপুরের বেলাই বিলের পাশে সেট রেডি করে ফেলেছে সবাই। এবারের গল্পটি মিলে মোট আরও দুটো গল্পে তরঙ্গ মেহফুজের সঙ্গে কাজ করবে। আজকের শটে দুজন কলাকারদের চরিত্র চাষী আর আরেকজনের বিলের মাঝি চরিত্র। আর তরঙ্গ একজন চিত্রশিল্পীর ভূমিকায় অভিনয় করবে এই গল্পে। বিলের পাশের সবুজ মাঠটাতে দাঁড়িয়ে চিত্র অঙ্কন করবে সে। তার বড়ো বড়ো চুলগুলো আর কিছুটা ভাবুক চেহারার জন্যই তাকে এমন একটি গল্পে নির্বাচন করেছে ইমরান। মেকআপ চলছে তার। কিন্তু সে মেকআপের ফাঁকে আড়চোখে এবং কড়া চাউনিতে দেখছে খেয়ামকে। বেশ দীর্ঘ ঘেড়ওয়ালা সাদা-কালো রঙ মিশেলে একটি গোল জামা পরেছে খেয়াম। তার ওপর গায়ে একটি কালো শাল। মাথায় সাদা ওড়নাটা থাকলেও তার কোমর ছাড়িয়ে যাওয়া রেশমী কালো চুলগুলো পিঠের মাঝখানটায় পড়ে আছে। প্রায় অনেকগুলো দিন বাদে তাকে দেখে তরঙ্গের মনে হচ্ছে, মেয়েটা এই কদিনে দেখতে আরও মিষ্টি হয়েছে। এর মাঝে একদিন অবশ্য মেয়েটার সঙ্গে তার একবার রাস্তায় দেখা হয়েছিল। সে গাড়িতে জ্যামে বসেছিল। খেয়ামকে সেদিন বাইপাসে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গাড়ির জানালাটা নামিয়েছিল তার জন্য। কিন্তু সে অপমানিত হয়েছিল যখন খেয়াম তাকে দেখেও একজন অচেনা মানুষ ভেবে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছিল। প্রথমে সে ভেবেছিল হয়তো খেয়াম চিনতে পারেনি। কিন্তু তার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সে জানালার কাছে ঘেঁষে বসে। তাতে জ্যামে আটকে থাকা মানুষগুলো তার জানালার কাছে ভিড় করে তার থেকে অটোগ্রাফ, ফটোগ্রাফ নিতে আরম্ভ করলেও কিন্তু খেয়াম তা দেখে এক বিন্দু আগ্রহ দেখায়নি তার প্রতি। এ আচরণ খেয়ামের মতো ছোটোখাটো কর্মচারীর থেকে তরঙ্গ জীবনেও প্রত্যাশা করেনি। তার অহংকারের ভিত যেন মেয়েটা একটু আগ্রহ সহকারে তার দিকে না তাকিয়েই নড়িয়ে দিয়েছে। মনে মনে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত সে মেয়েটার ওপর। আজ এই মেয়েটাকে একটা চরম শিক্ষা দিয়েই ছাড়বে সে। এইটুকুন মেয়ে, অথচ তার ভাবখানা আকাশ ছোঁয়া যেন। কীসের এত ভাব তার? তাই-ই সে দেখবে আজ।
সব কিছু মিলিয়ে শট নিতে নিতে প্রায় বিকাল পার হয়ে গেল। রমজান মাস চলছে। আরেকটু বাদেই মাগরিবের আজান দেবে। রোজা রাখার মতো মানুষ হয়তো এই সেটে কেউ নেই বললেই চলে। দীর্ঘ সময়ের কাজ থাকার জন্য খাবার তারা সঙ্গে করেই এনেছিল। সবাই যখন খেতে আরম্ভ করেছে খেয়াম তখন বেশ দূরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। তারা তাকে খেতে আসতে ডাকলে সে জানায়, ‘আমি রোজা রেখেছি আপু। আপনারা খেয়ে নিন।’
তা শুনে নয়ন তখন অন্য একজন সহকারীকে বলে, ‘স্যারও কিন্তু রোজা রেখেছেন।’
সেই সহকারী তা শুনে জবাব দেয়, ‘স্যারের খাবার আলাদা রেখে দিয়েছি। খেয়ামের খাবারটাও তাহলে আলাদা রাখি?’
-‘হ্যাঁ রাখো।’
বেশ দূর থেকে দেখা গেল মেহফুজ আর ইমরান গ্রামের মধ্যে থেকে বেরিয়ে কথা বলতে বলতে সেটে আসছে। দুজন পুরোনো বন্ধু বলেই দূরে কোথাও শ্যুটিঙে এলে তাদের দুজনকে একা একা এদিক সেদিক ঘুরতে ফিরতে দেখা যায়। তারা সেটে এসে পৌঁছতেই আজান দিয়ে ফেলে। নয়ন মেহফুজের খাবারের ব্যবস্থা করার মুহূর্তে মেহফুজ তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘বাকিরা কই?’
-‘কানাইয়া বাজারে যে নতুন ব্রিজ হয়েছে ওখানে চা খেতে গেছে।’
মেহফুজ ইমরানকে বলল, ‘তো তুই বস। দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’
-‘না, ভাবতেছি আমিও চা খেয়ে আসি। তুই ইফতার কর।’
-‘খেয়েদেয়ে যেতি?’
-‘খা, সমস্যা নাই। এখনি আসতেছি।’
বলেই সে নয়নকে জিজ্ঞেস করল, ‘যাবা নাকি, নয়ন?’
-‘স্যারের কাছে থাকি, ভাই।’
-‘আরে যাও, ঘুরে এসো।’ মেহফুজ বলল।
নয়ন জিজ্ঞেস করল, ‘যদি কিছু দরকার পড়ে আপনার?’
-‘আমার কোনো দরকার পড়বে না। আর পড়লেও আমি দেখে নেবো। যাও তুমি।’
তা শুনে ওরা এগিয়ে যেতেই সন্ধ্যার আবছা আলোয় একটু দূরে খেয়ামকে দেখল নয়ন। তার মনে পড়ল, খেয়ামও তো রোজা রেখেছে। ও কিছু খেয়েছে নাকি? ভাবতেই ডেকে উঠল তাকে, ‘এই খেয়াম, ওদিকে কী করো? ইফতার করেছ?’
খেয়াম হালকা পানি মুখে দিয়ে রোজা ভেঙে এদিকে ওদিকে চেয়ে বাড়ি-ঘর দেখছিল। কিছুক্ষণের জন্য কারও বাড়িতে গিয়ে তাহলে নামাজ আদায় করে আসত। নয়নের ডাক শুনে সে তার দিকে ফিরল। মেহফুজও নয়নের দৃষ্টি লক্ষ করে তাকাল খেয়ামের দিকে। খেয়াম এগিয়ে এসে নয়নকে বলল, ‘জি ভাইয়া করেছি। আপনারা কই যান?’
-‘আমরা যাই একটু চা খেতে।’
-‘স্যারকে এই বিলে একা রেখে?’
-‘সমস্যা নেই, পরিচিত মানুষ আছে এখানে। পাশের গ্রামেই। তুমি কী ইফতারি করলে? তোমার খাবার তো আলাদা রাখা হয়েছিল স্যারের খাবারের সঙ্গে। স্যার ওই যে ইফতারি করছে গাড়িতে বসে। তুমি যাও, খেয়ে নাও।’
খেয়াম একবার ঘাড় ফিরে তাকাল লাল মার্সিডিজ বেঞ্চ গাড়িটার দিকে। গাড়ির দরজাটা খোলা। ভেতরে আলো জ্বলছে। গাড়ির জানালা থেকে দেখা যাচ্ছে মেহফুজকে। সেও এদিকেই তাকিয়েই আছে। খেয়াম দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে মুখে হাসি টেনে বলল, ‘সমস্যা নেই। আমি হালকা পাতলা ইফতার করেছি। আমি আসলে নামাজ পড়ার জন্য ওদিকে দেখছিলাম কারও বাসায় যাওয়া যায় কি না।’
-‘আরে স্যারের সাথে যেয়ো ওনার পরিচিতর বাসায়। এখন যাও, ইফতার করে আসো আগে।’ বলেই সে মেহফুজের দিকে তাকাল। মেহফুজ খাওয়ার মাঝে দেখছে তাদের। গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে মেহফুজকে বলল নয়ন, ‘স্যার, খেয়ামও রোজা ছিল। তাই ওকে খেতে যেতে বলছি।’
মেহফুজ ইশারায় নয়নকে বলল খেয়ামকে চলে আসতে। নয়ন তখন বলল, ‘খাবার তো আসার সময়ই নিয়ে আসছিলাম। তুমি কই থেকে কী খেলে? যাও যাও, খেয়ে নাও গিয়ে!’
বলেই ইমরান আর সে বাজারের দিকে রওনা হলো।
অস্বস্তিতে কাঠ হয়ে খেয়াম হাতের নখ কামড়াচ্ছে। মেহফুজ খাওয়া শেষ করে গাড়ি থেকে নেমে হাতটা ধুতে ধুতে খেয়ামকে দেখল। সে একই জায়গাতে দাঁড়িয়ে আছে। মেহফুজ একটু গলা ছেড়ে তাকে বলল, ‘খাবার রাখা আছে গাড়িতে। খেতে আসো।’
খেয়ামের পা জোড়া চলতে বহু কষ্ট হচ্ছিল। হঠাৎ করে এত আড়ষ্টতা এল কোথা থেকে সেটাই সে বুঝছে না। মেহফুজের সামনে একা এলেই হাত-পা যেন থরথর করে কাঁপে তার। গাড়ির কাছে সে এগিয়ে আসতেই মেহফুজ ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে কারও উদ্দেশ্য বিনায় বলল, ‘নামাজের টাইম পার হয়ে যাবে। ওরা কখন আসবে কে জানে!’
এ কথা শুনে খেয়াম বুঝতে পারল, তার খাওয়ার জন্যই মেহফুজ এখানে অপেক্ষা করছে। আপাতত সেটে তারা দুজন ছাড়া কেউ নেই। মেহফুজ এই বিলের পাড়ে খেয়ামকে ভর সন্ধ্যাবেলায় একা ফেলে যেতে পারবে না বলেই সবার ফিরে আসার কথা ভাবছে। খেয়াম কিছু বলল না। গাড়িতে ঢুকে জুস আর খেজুর খেয়ে বেরিয়ে এল। মেহফুজকে বলল, ‘আপনি যেতে পারেন। সমস্যা নেই।’
মেহফুজ দাঁড়িয়ে ফোন চাপছিল। হঠাৎ খেয়ামের কথা শুনে তার দিকে চোখ তুলে চেয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে গিয়েও নিতে পারল না। দ্বিতীয়বারের মতো নজর বাধা পড়ল তার খেয়ামের মুখের দিকে। খেয়াম বুঝতে পারল না তার এহেন চাউনির কারণ। যদিও মেহফুজ আবারও তখনি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছিল। সে বাজারের পথের দিকে চেয়ে বলল, ‘একা থাকা কিছুটা রিস্ক।’
কথাটা বলে সে আঁড়চোখে খেয়ামের দিকে আবার তাকাল। তবে এবার তার নজর ছিল খেয়ামের জামার হাতার দিকে।
খেয়াম জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি নামাজ পড়তে যাবেন তো?’
মেহফুজ মুখে উত্তর দিলো না। মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানাল শুধু।
-‘আমিও কারও বাসায় যেতে চাইছিলাম নামাজ আদায়ের জন্য। তখনই নয়ন ভাই ডাক দিলো।’
মেহফুজ আশপাশে একটু দেখে গাড়ি লক করে বলল, ‘তাহলে চলো আমার সাথে।’
গা শিরশির করা হাওয়া বিলের পাড়ে। পৌষের শীতের দাপট বোঝা যায় নগরের বাইরে এলে। ভরা বর্ষাতে বেলাই বিলের জলরাশির সৌন্দর্য এই পৌষে এসে খুঁজে পাওয়া যায় না তেমন। বিল শুকিয়ে জায়গায় জায়গায় চর পড়ে যায়, জলরাশিতে শাপলাও দেখা যায় না। তবুও মেহফুজ তার এবারের গল্পটির মাঝে ঢাকার আশপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জায়গাগুলোকে কেন্দ্র করে সেট তৈরি করছে এসব জায়গায়।
পাশের গ্রামে ঢুকে মেহফুজ তার পরিচিত একজনের বাড়িতে গিয়ে খেয়াম আর সে নামাজ আদায় করে সেখান থেকে খুব দ্রæতই বেরিয়ে আসে। মেহফুজের থেকে অনেকটা দূরত্ব রেখে খেয়াম তার পিছু পিছু চলছে। বিলের কাছাকাছি এসে তারা একটু দূর থেকে দেখতে পায় চিকেন ফ্রাই করার আয়োজন করছে সকলে বিলের পাড়ে বসে। আরও কিছু মুহূর্ত এই বিলে তারা কাটাবে। খেয়াম ভেবেছিল কাজ শেষ করে একটু দ্রুতই ফিরবে সে হোস্টেল। পড়াশোনার চাপটা বেশ। সামনে পরীক্ষা। এদিকে শরীরটাও তেমন টানছে না আর। তাই মনটাও সায় দিচ্ছে না এতখানি সময় কাটাতে। বিড়বিড় করে আক্ষেপের সুরে স্বগতোক্তি করল, ‘এই কাজের পাশাপাশি আর আমার পড়া! কী দরকার ছিল ইংরেজির মতো বিষয় নেওয়ার? সাধারণ, সহজ কোনো বিষয় নিলেই পারতাম।’ মেহফুজ ফোনের আলো জ্বেলে চলার মাঝেই খেয়ামের মৃদুকণ্ঠে কথা বলা শুনতে পায়। তবে স্পষ্ট বুঝতে পারে না। চলা থামিয়ে পিছু ফিরে সে। খেয়ামকে জিজ্ঞেস করে, ‘কিছু বললে?’ খেয়াম ক্ষণিকের জন্য মেহফুজের কথা শুনে চমকায়, সে শুনে ফেলল কিনা এই ভেবে। তবে দ্রুত সামলে উঠে বলে, ‘না, কিছু বলিনি।’
-‘ও, তো তুমি অত পিছে পড়ে আছ কেন? আমার সাথে আসো।’
-‘সমস্যা নেই।’
কথাটা শুনে মেহফুজ হাঁটার মাঝে আরেকবার পিছু ফিরে তাকাল ওর দিকে। তারপর হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘রাতে এমন স্পট মেয়েদের জন্য নিরাপদ নয়। পেছন থেকে কেউ টেনে নিয়ে গেলে বুঝতেও পারব না।’ তার এমন নির্বিকারভাবে বলা কথাগুলো শুনে খেয়ামের বুকটা নিমিষেই কেঁপে উঠল। এই মানুষটা মোটেও রসিকতা করার মতো মানুষ নয়। আর তার সাথে তো তেমন সম্পর্কও নেই। অতএব, কথাটাকে গুরুত্ব না দিয়ে পারল না সে। পেছন থেকে দ্রুত পদে হেঁটে এসে এসে মেহফুজের পাশাপাশি চলতে শুরু করল। মেহফুজ তখন একবার আড়চোখে তাকাল তাকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে। তারপর সে নজর ফিরিয়ে নিতেই খেয়ামের কেন যেন মনে হলো মেহফুজ মিটিমিটি হাসল। কিন্তু সে ভুল দেখেছে কিনা তা জানতেই বারবার চোরা দৃষ্টিতে দেখতে থাকল মেহফুজকে।
সেটে পৌঁছে ওরা দেখল চিকেন ফ্রাইয়ের সব বন্দোবস্ত করে ফেলেছে সবাই। এদিকে শীতের প্রকোপ খেয়ামের গায়ের চাদরটা ভেদ করেই যেন কামড় বসাচ্ছে শরীরে। সবাইকে একবার দেখে সে হাঁটতে হাঁটতে বিলের চর পড়া জায়গাতে এসে দাঁড়াল। তখন হঠাৎ ইব্রাহীমও তার পাশে এসে দাঁড়াল।
-‘শীতের রাইতে চিকেন ফ্রাই। ওহ্ সেই! ইমরান স্যার ভালোই কিছু খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করে শ্যুটিং শেষে।’ খেয়াম পাশে ফিরে তাকিয়ে তাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কতক্ষণ কাটাবে সবাই এখানে?’ তার প্রশ্ন আর কণ্ঠে ইব্রাহীম মন খারাপের আভাস পেল। সে উল্টো জিজ্ঞেস করল, ‘কী হইছে গো? মন খারাপ না কি?’
খেয়ামের উদ্দেশ্যহীন দৃষ্টি সামনে, বহুদূরে। হঠাৎ করেই ভাইয়ের কথা আজ ভীষণ মনে পড়ছে তার। গত বছর রোজার মাসেই ভাইটা তার বাড়িতে এসেছিল। ভেবেছিল, ভাইটা এসে বাবাকে বলবে, ‘আমার ভুল হয়ে গেছে বাবা। আমাকে ক্ষমা করে দাও।’ আর তারপরই আবার তাদের পরিবারটা আগের মতো সুখী পরিবার হয়ে যাবে। ভাইয়া চাকরি করে প্রতি মাসে বাড়িতে টাকা পাঠাবে, বাবার আর মুদির দোকান চালাতে হবে না। ছুটিতে ভাইয়া বাড়ি আসবে, কত মজা হবে আবার। তার পরীক্ষা শেষ হলে ভাইয়া তাকে ঢাকা নিয়ে যাবে, ভাইয়ার কাছে থেকে পড়বে সে। কিন্তু এসব ভাবনা যে ভাবনাই রয়ে গেল। আর ভাইটা! সে যে আরও ভাবনার বাহিরে এক অচিন্তনীয় উপহার প্রদান করে গেল তাদের। সেই উপহারের ওজন বইতে না পেরে তাকে ছুটে আসতে হলো এই অচেনা, অজানা শহর আর মানুষের মাঝে। শুধুই ক’টা টাকার জন্য। অথচ, আজ তার থাকার কথা ছিল কোথায়!
-‘খেয়াম! এই খেয়াম!’
কারও ডাকে চিন্তার মহল থেকে বেরিয়ে আসে খেয়াম। ইব্রাহীম উদ্দেশক চোখে দেখছে তাকে। তার দিকে তাকাতেই ইব্রাহীম ফের জিজ্ঞেস করল, ‘কী হইছে তোমার?’ খেয়াম অনান্তরিকভাবে হাসে, জবাব দেয়, ‘শরীর, মন কোনোটাই ভালো লাগছে না আজ। হোস্টেল ফেরা দরকার।’ ইব্রাহীম খেয়ামের মুখটার দিকে তাকায়। কী যেন খোঁজার চেষ্টা করে তার চেহারাতে।
তরঙ্গ মাদুরের ওপর বসে গিটারে টুংটাং আওয়াজে সুর তুলছে। একেক সময় একেক গানের সুর। হঠাৎ অগ্নিশিখার হলুদে কিরণে সে দেখতে পেল খেয়ামকে। ইব্রাহীমের পাশাপাশি হেঁটে আসছে খেয়াম। শীতে প্রচÐ কাহিল অবস্থা যেন তার। কুঁকড়ে হাঁটছে। এর মাঝে তারা এসে তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার কফি খাবেন?’ তরঙ্গের বক্র চাউনি সামনে, খেয়ামের দিকে। তারাকে বলল, ‘একটু আগেই তো চা খাইয়া আইলাম।’
তারা এ কথা শুনে চলে যাচ্ছিল। তরঙ্গ হঠাৎ আবার ডেকে উঠল তাকে, ‘শোনো, তোমাকে আনতে হবে না। খেয়ামকে দিয়ে পাঠাও।’
তারা সম্মতি জানিয়ে চলে এলেও একটু যেন রাগ হলো তার। তবে সেটা তরঙ্গের ওপর না খেয়ামের ওপর তা বোঝা গেল না। বয়সে সে খেয়ামের থেকে বছর পাঁচেকের বড়ো। আর খেয়ামের থেকে বহু আগেই কাজ করছে সে এখানে। মোটামুটি সবার সাথেই তার ভালো সম্পর্ক, খেয়ামের সঙ্গেও। কিন্তু তার থেকেও ভালো সম্পর্ক সবার সঙ্গে খেয়ামের। এর কারণ সে জানে। খেয়াম খুব হাসিখুশি একটা মেয়ে, দেখতেও চমৎকার। তার প্রতি অনেকেরই আগ্রহ আছে তাও সে জানে। কিন্তু এই সেটে একমাত্র তরঙ্গই তাকে সহ্য করতে পারে না। অথচ তারপরও খেয়ামের প্রতি তরঙ্গের আগ্রহও আজ সে স্পষ্ট বুঝতে পারল। সে তো দেখতে খারাপ নয়, খেয়ামের থেকেও ফর্সা সে। কিন্তু খেয়ামের প্রতি যে আগ্রহ সবার, ততটা আগ্রহ তার প্রতি সবার প্রকাশ পায় না কেন? সে কি খেয়ামের থেকে দেখতে খারাপ? বরং খেয়ামের থেকেও স্মার্ট সে সব দিক থেকে। এসব ভাবতে ভাবতেই এল সে খেয়ামের কাছে। গাড়ি থেকে কফি এনে তরঙ্গকে গিয়ে দিতে বলল। ততক্ষণে মাদুরে প্রায় সবাই বসে পড়েছে। খেয়াম কফি আনার সময় খেয়াল করল মেহফুজ তার গাড়ির হুডির সঙ্গে হেলে দাঁড়িয়ে ইব্রাহীমের সঙ্গে কথা বলছে। সে মুহূর্তে এক ঝলক তাদের দুজনের চারটা চোখ মিলিত হলো। খেয়াম কফি নিয়ে চলে এলেও মেহফুজ তার যাওয়ার দিকেই চেয়ে রইল।
-‘স্যার আপনার কফি।’
তরঙ্গ শুনতে পেলেও ভ্রুক্ষেপ করল না খেয়ামের কথা। পাশে বসে থাকা এক সহকারী ছেলের সঙ্গে কথা বলছে সে। খেয়াম আরও একবার ডাকল তাকে। তখনও তরঙ্গের একই ভাব। পাশের সহকারী ছেলেটি তাকে ইশারায় কফির মগটা তরঙ্গের পাশে রাখতে বলল। খেয়াম তার কথা মতোই মগটা তরঙ্গের পাশে রেখে চলে আসার মুহূর্তে আচমকা বজ্রকণ্ঠে তরঙ্গ চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওই মেয়ে! তোমারে ঠ্যাঙের কাছে রাখতে বলছি কফি?’
পাশের সহকারী ছেলেটি তখন বলল, ‘ভাই আমিই বলছি ওরে। আপনি কথা বলতেছিলেন দেখে।’
তরঙ্গ কর্ণপাত করল না ছেলেটির কথা। খেয়াম তার দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘আমি আপনাকে দু’বার ডেকেছিলাম। আপনি কথা বলছিলেন তখন। তাই আর ডেকে বিরক্ত করতে চাইনি।’
-‘উদ্ধার করে দিছো আমারে। এই যে আমি না দেখে পায়ের গুঁতাতে ফেলে দিলাম মগটা। আর গরম কফিটা যদি আমার পায়ে পড়ত, তো কী হইত?’
-‘আমি বুঝতে পারিনি এমনটা হবে। দুঃখিত স্যার।’ খেয়াম নত সুরেই বলল।
-‘দুঃখিত বললেই হবে, না? কাজ দেখেশুনে করা লাগে না? আমি কথা বলতেছিলাম। কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত দাঁড়ায় থাকতে খুব কষ্ট হয়ে যাইত?’
খেয়াম বুঝতে পারছে তরঙ্গ ইচ্ছা করেই এই বাহানায় তাকে এখন শুধু শুধুই রাগারাগি করবে। কিন্তু তার যে মোটেও কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। সে নির্দোষ, এটাও তার বুঝিয়ে বলতে ইচ্ছা করছে না। তাই সে ক্ষমা চেয়ে কথার শেষ দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তা আর হবে বলে মনে হয় না। কারণ, তরঙ্গ এমন কোনো সুযোগের জন্যই হয়তো অপেক্ষা করছিল। তার থেকে বয়সে বড়ো এই ছেলেটিকে খেয়ামের মনে হয়, ছেলেটির পূর্ণপরিণত ভাব এখনও তার হাঁটুতেই আটকে আছে। নয়তো তার মতো সামান্য কর্মচারীকে অপদস্থ করে সে কী মজা পায়?
তরঙ্গের চেঁচামেচি থামল মেহফুজের উপস্থিতিতে। তরঙ্গের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে সবাইকে হাঁক ছেড়ে বলল মেহফুজ, ‘এই, সবাই কাজ শেষ করো জলদি। আমাদের ফেরার সময় হয়ে গেছে।’
ইমরান তখন বলল, ‘এখনও তো সব ফ্রাই করা হলোই না। খাওয়ার পর্ব তো বাকিই। এত তাড়া দিচ্ছিস ক্যান?’
মেহফুজ এ প্রশ্নের উত্তরে কিছু বলল না। অগ্নিদৃষ্টিতে তরঙ্গের দিকে শুধু তাকিয়ে রইল। তরঙ্গ অবশ খেয়াল করল না তার দৃষ্টি। ইমরান আবারও মেহফুজকে বলল, ‘আরে দাঁড়ায় আছস ক্যান? পাশে এসে বস ব্যাটা। বেশি টাইম লাগবে না। আর কিছুক্ষণ।’
ইমরানের আবদারে মেহফুজ বসল। খেয়াম তখন তরঙ্গের আদেশ রক্ষা করতে আবারও এক মগ কফি আনল তার জন্য। তারপর সেও বসল তরঙ্গের থেকে কিছুটা দূরে।
নীহারিকাবৎ রাত। চারপাশের বাতাস যেন ভীষণ বিক্ষুব্ধ। থেকে থেকে বাতাসের তীব্রতায় কেঁপে কেঁপে উঠছে খেয়াম। তরঙ্গের চোখজোড়া বারবার প্রচণ্ড আগ্রহের সঙ্গে আড়নজরে দেখছে তাকে। লক্ষ করছে খেয়ামের কেঁপে ওঠা। ওদিকে মেহফুজের কী একটা কথা শুনে সবাই হো হো শব্দে হেসে উঠল। খেয়ামও তার কথা শুনে হাসছে। মানুষটাকে খেয়ামের গম্ভীরই লাগত। আজ সে আবিষ্কার করল, মেহফুজ ভারি রসিকতাও জানে। একবার ঘাড় কাত করে দেখতে চেষ্টা করল সে মেহফুজের মুখটা। মেহফুজ তার কাতারেই বসেছে। কিন্তু প্রায় সাত আটজনের পরে। তবে দেখা গেল তার মুখের বাঁ পাশটা শুধু। আগুনের জ্বলজ্বল হলদে আভায় তার খোঁচা খোঁচা দাড়ির ফর্সা মুখটা দেখতে খুব ভালো লাগছে। হঠাৎ ইব্রাহীমের কথা কানে এল খেয়ামের।
-‘খেয়াম, শীত করতেছে বেশি? আমার জ্যাকেটটা দেবো?’
-‘না ভাইয়া। ঠিক আছি।’ বেশ অস্বস্তি নিয়ে বলল খেয়াম।
-‘আরে দেখতেছি তো কাঁইপা কাঁইপা উঠতেছ। লাগলে নেও। সমস্যা কী?’
-‘সমস্যা নাই ভাইয়া। আমার আসলে ভালো লাগে না কারও কিছু ব্যবহার করতে।’
কথাটা শুনে ইব্রাহীম একটু নিভল যেন। বোঝা গেল, ভালো লাগল না তার খেয়ামের কথাটা। এ কথায় তরঙ্গও বাঁকা চোখে তাকাল তার দিকে। খেয়ামের ঠান্ডা দেখে সেও চাইছিল তার চাদরটা এগিয়ে দেবে। কিন্তু দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছিল সে। ভাগ্যিস দেয়নি! নয়তো তাকেও অপমান হতে হতো এই পুঁচকে মেয়ের কাছে।
মেহফুজের তাড়া পেয়ে সবাই চিকেন ফ্রাই করা প্রায় অর্ধেকটা বাকি রেখে উঠে পড়ল। সব গোছগাছ আরম্ভ করে তারা। শুধু তরঙ্গই তখনও বসেছিল নিচে। গাড়ি ছাড়ার পূর্ব মুহূর্তে উঠবে বলে আলস্যতা নিয়ে বসে ফোন চাপছিল। ফোন চাপার মাঝখানে হঠাৎ তার পায়ে প্যান্টের ফাঁকে গোড়ালির কিছুটা ওপর ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ অনুভব হচ্ছিল। কিন্তু সেদিকে কোনো মনোযোগ নেই তার। তারপর সেখানে যখন কিছু নড়চড় করছে বলে মনে হলো, ঠিক তখন সে বুঝতে পারল সেটা কী হতে পারে। পা নড়াতেও তখন তার ভয় হচ্ছিল। শুধু তাকিয়ে দেখল সাপের লেজটুকু বেরিয়ে আছে, আর সেটার পুরো শরীরটা তখন ইতোমধ্যে তার প্যান্টের ফাঁকে ঢুকে পড়েছে। সে মুহূর্তেই ভীষণ আশ্চর্য এক কাণ্ড ঘটাল খেয়াম। লেজটা ধরে এক টানে প্যান্টের ফাঁক থেকে সাপটাকে বের করে দূরে ছুড়ে মারল। বিস্ময়ে অভিভ‚ত তরঙ্গ। বড়ো বড়ো চোখ করে চেয়ে দেখছে সে খেয়ামকে। খেয়াম তখন তাকে বলে উঠল, ‘স্যার, যত সমস্যা আপনার শুধু প্যান্টেই হয়? আর সেটাও আমিই সমাধান করি। নিন, এবার তো উঠুন।’
তরঙ্গ বিস্ময়ে কথা বলতে ভুলেই গিয়েছিল। উঠে দাঁড়িয়ে বিস্ময়পূর্ণ গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কী করলা তুমি ওইটা?’
-‘কী করলাম?’ জবাবে খেয়ামের নির্বিকার ভঙ্গিতে পালটা প্রশ্ন।
-‘ভয় করল না তোমার?’
-‘ভয় করলে কি আর ওকে বের করতে পারতাম?’
***