এমনই শ্রাবণ ছিল সেদিন পর্ব-০৫

0
16

#এমনই_শ্রাবণ_ছিল_সেদিন
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি

৫.
-‘কী করে আসলি তুই খেয়াম?’

-‘‘নিজের মাথা নিজে ফাটাইছি বাঁশ দিয়ে।’ দুঃখভারাক্রান্ত চেহারায় বলল খেয়াম রাহিকে।

-‘এখন আর এই নিয়া ভেবে লাভ নাই। এই সমস্যার সমাধান কী করবি সেইটা ভাব।’

-‘উহঃ! এই টেনশনেই তো ঘুম উড়ে যাচ্ছে।’

রাহি চিন্তিত ভঙ্গিতে খেয়ামের কোলের ওপর হাতটা রাখল। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বলল সে, ‘উনি তোদের প‚র্ব পরিচিত, তাই না?’

খেয়াম বিরস মুখ করে হ্যাঁ জানাল।

-‘যেহেতু পরিচিত তাহলে তুই তো সরাসরিই গিয়ে কথা বলে আসতে পারিস। স্যরিটরি বলে সব ঠিকঠাক করে নিলি। একটু রিকুয়েস্ট করে বলবি।’

-‘এখন তার বাসা অবধি যেতে হবে?’

-‘বাসায় ঢুকতে পারবি না এমন তো কোনো সমস্যা নেই। তাহলে কাজ বাঁচাতে যেতে ক্ষতি কী?’

রাহির কথাগুলো মন্দ লাগল না খেয়ামের। সেও ভাবছিল এমনটাই। অন্তত মেহফুজের মায়ের সাথে কথা বললেও এ যাত্রায় কাজটা বেঁচে যেতে পারে তার। ওই মানুষটাও ভারি কোমল মনের। মেহফুজের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার মতো সাহস তার নেই। যা অনুরোধ করার, তা তার মায়ের কাছেই করতে হবে।

পরদিন বিকালে খেয়াম আর রাহি হোস্টেল থেকে বেরিয়ে চলে এল মেহফুজের বাসায়। ঢোকার সময় একটু ঝামেলা হয়েছিল। গেটের দারোয়ান ভেতর থেকে অনুমতি নিয়ে আসার পরই তারা ঢুকতে পেরেছে। আলিশান ড্রয়িং রুমটাতে বসার পর থেকে রাহির নজর এক মুহূর্তের জন্যও স্থির নেই। আশপাশটাতে নজর বুলিয়েই যাচ্ছে সে। প্রথমদিন খেয়াম আসার পরও এমনটা হয়েছিল তার সঙ্গে। কিন্ত সে মুহূর্তেই নিজের দৃষ্টিকে সংযত করে নিয়েছিল। অত্যাধিক প্রশংসনীয় কোনো বস্তুর ওপর সে আকৃষ্ট হলেও নিজেকে সামলে নেয় অতি দ্রæতই। কারণ, তা যদি তার যোগ্যতা আর সামর্থ্যের বাহিরে থাকে তবে সেই বস্তুর প্রতি আর দ্বিতীয়বার নজর তুলে তাকায় না। ছোটো থেকেই এই অভ্যাসটি তার মাঝে গড়ে উঠেছে। লোভ করা ব্যাপারটা তার মাঝে হয়তোবা কিঞ্চিৎ অংশে থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু তা কেবল অতি তুচ্ছ বিষয়ে।

তারা অপেক্ষা করছিল নীহারের জন্য। আসার পর শুনেছে মেহফুজ বাসাতে নেই। তা জেনে খেয়াম ভেতরে ভেতরে অজস্র শান্তি অনুভব করল যেন। কিন্তু অপেক্ষার প্রহরটা একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে। নীহার কি আসবেন তার সঙ্গে দেখা করতে, না কি আসবেন না? কিছুই বুঝতে পারছে না সে। কারণ, অপেক্ষার সময়টা আধা ঘণ্টা অতিক্রম করে গেছে। এদিকে বাহিরে শ্রাবণধারা অবিরামভাবে নামতে শুরু করেছে। খেয়াম অধৈর্য মনে নিচে তাকিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুণছিল। রাহির তখন দৃষ্টি পড়ল, বসার ঘরের মূল ফটকে একজনের প্রবেশ ঘটেছে। তার ঠিক পিছু পিছুই আরও একজন ঢুকল। রাহির দিকে প্রথম ব্যক্তিটির দৃষ্টি স্থাপন হলেও তার পর মুহূর্তেই সেই ব্যক্তিটির দৃষ্টি আটকাল খেয়ামের দিকে। খেয়ামকে দেখেই ভ্রæ, কপাল কুঁচকে গেল তার।
আশ্চর্যান্বিত হলো খেয়াম। কয়েক সেকেন্ড যাবৎ মেহফুজ তার দিকে কুঞ্চিত চেহারা নিয়ে তাকিয়ে থেকে তারপর উপরে চলে গেল। রাহি জিজ্ঞেস করল, ‘লোকটা কে রে?’

-‘উনিই মেহফুজ।’

-‘পুরোই অস্থির কিন্তু।’ মেহফুজের প্রতি আগ্রহযুক্ত কণ্ঠ রাহির। খেয়াম তার কথার ইঙ্গিত সহজে ধরতে পারল না মহা দুশ্চিন্তায়। বলল, ‘অস্থির কোথায় দেখলি? স্থিরই তো দেখলাম।’

-‘আরে ধুর! অনেক জোশ দেখতে উনি। সেটা বলতেছি।’ কথাটা শুনে খেয়াম বিরক্তভরা দৃষ্টিতে তাকাল রাহির দিকে।

সিঁড়ি বেঁয়ে নামতে দেখা গেল নয়নকে। খেয়াম নিশ্চিত, লোকটা তাকে ভালো-মন্দ কথা শুনাতেই আসছে। খেয়াম আর রাহি তাকে দেখে উঠে দাঁড়াতেই নয়ন এগিয়ে এসে বলল, ‘স্যারের সাথে দেখা করতে এসেছ?’

খেয়াম সহজভাবেই উত্তর দিলো, ‘স্যার ব্যস্ত থাকলে আন্টি এলেও চলবে।’

-‘আন্টি বলতে কি ম্যাম?’

-‘জি।’

-‘একটু ব্যস্ত আছেন উনি ওপরে। স্যারও ব্যস্ত। আমাকেই বলো, কী প্রয়োজন?’

-‘আমি আসলে আমার সেদিনের ব্যবহারের জন্য খুবই লজ্জিত। ওইভাবে কথাগুলো বলা আমার একদমই উচিত হয়নি। আমি খুব দুঃখিতও। ক্ষমা চাইতে এসেছি ওনার কাছে।’

-‘তোমার কপাল আছে, জানো? শুধু স্যারের বাবা মায়ের পরিচিত বলে কোনো কিছু ফেস করতে হয়নি তোমাকে। স্যার ঠিকই ধরেছে, যে তুমি স্যরি বলতেই এসেছ। আর এভাবে হুটহাট বাসায় চলে আসাটা উনি একেবারেই পছন্দ করেন না। যদি না ওনার সাথে কোনো দরকারে এসে ব্যক্তিগতভাবে ওনার মায়ের সাথে কোনো দরকারে আসো, তাহলে সমস্যা নেই। কিন্তু ওনার সাথে এভাবে হুটহাট দেখা করতে চলে আসবে না। স্যার বলেছে কাজে আসতে। সমস্যা নেই।’

খেয়াম দৃষ্টি নত করে সম্মতি জানিয়ে চলে এল বাসা থেকে। এত বড়ো মানুষগুলোর সাথে বাড়ি বয়ে এসে কথা বলা খেয়ামের কাছে একটু আগে পর্যন্ত স্বাভাবিক লাগলেও কিন্তু ওই বড়ো মানুষগুলো যে তার মতো করে স্বাভাবিক নজরে তা দেখে না, এতক্ষণে তা বোধ করতে পারল সে। এরপর থেকে তাকে যথেষ্ট বিচার-বুদ্ধি দিয়ে চলতে ফিরতে হবে সব সময়। কোনো কাজ করার পূর্বে অন্তত দুবার ভেবে তারপর সেই কাজে অগ্রসর হবে সে। বড্ড খামখেয়ালিপনা করে ফেলেছে এ ক’দিনে।

.
খেয়ামের কর্মজীবনের দেড় মাস হতে চলেছে। একটা মাসে সে নানা বিষয়ে, নানাভাবে বারবার হোঁচট খেয়েছে, তারপর নতুন করে আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। হোঁচট না খেলে কখনও যে উঠে দাঁড়ানো শেখা যায় না। এই কর্মজীবনে এসে সে বাহিরের মানুষের সম্পর্কে, বাস্তবতা সম্পর্কে প্রায় সত্তর ভাগ জ্ঞান অর্জন করেছে। ধৈর্যশক্তি তৈরি হয়েছে তার মাঝে অসীম। সেদিনের পর শ্যুটিঙের জায়গাতে তার কাজের ভুল-ত্রুটি কেউ চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে পারেনি। প্রতিটা কাজেই সে পরিশ্রমী আর কর্মঠ। তারই প্রমাণ দিয়েছে বারবার। শ্যুটিং সেটের প্রায় প্রতিটা মানুষের সাথে তার দারুণ একটা সম্পর্কও তৈরি হয়ে গেছে। তার কাজের প্রশংসায় একবার তারিন তাকে প্রস্তাব দিয়েছিল তার পার্সোনাল অ্যাসিসটেন্ট হওয়ার জন্য। কিন্তু কেন যেন সেটা তার ব্যক্তি স্বাধীনতার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াতে বলে মনে হলো। তাই সে খুব বিনয়ের সাথে নিজের সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়ে দেয় তারিনকে। তারিনের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ায় তারিন কিন্তু একটুও রাগ বা অপমান বোধ করেনি। বরঞ্চ খেয়ামকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। এর কারণ, খেয়ামের অতি চমৎকার ব্যবহার আর তার মিষ্টি হাসি। খেয়ামের হাসিতে প্রায় সবাই মুগ্ধতা প্রকাশ করে। তার আচরণ আর বুদ্ধির প্রশংসায় প্রতিটা মানুষ তাকে বিভিন্ন কাজে সহায়তা করে, কাজে ছাড়ও দেয় তাকে। এখানে আসার পর এই দেড় মাসে তার মতো বিভিন্ন পুরুষ কর্মীদের থেকে সে প্রেমের প্রস্তাবও পেয়েছে। তা সে এমন কৌশলে এড়িয়ে গেছে, যাতে ওই মানুষগুলো তার থেকে প্রত্যাখ্যান হয়ে তার প্রতি ক্ষিপ্ত না হয়। এমনকি কিছু মানুষের অশ্লীল প্রস্তাবের শিকারও হয়েছে সে। লজ্জা আর ঘৃণায় বারবার কাজ ছেড়ে চলে আসার সিদ্ধান্তও নিয়েছিল। কিন্তু পরক্ষণেই তাদের আচরণের পরিবর্তন দেখেছে সে। এতে সে কিছু কিছু সময় বিস্মিত হলেও পরবর্তীতে তার কারণও উদ্ঘাটন করেছে। তাকে সেখানের প্রতিটা মানুষ এতটাই স্নেহ করে যে তার হয়ে প্রতিবাদ সেই মানুষগুলোই জানায়। এসব দেখে খেয়াম মনকে আরও শক্ত করে। সে ভাবে, পৃথিবীতে সেই মানুষগুলোই টিকে থাকতে পারে স্ব-সম্মানে, যারা ভেতর থেকে মজবুত।
***

১৭ই অক্টোবর।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফল প্রকাশিত হলো। সেই মুহূর্তে খেয়াম শ্যুটিং সেটে। রাত বাজে দশটা। খেয়ামের ফলাফল প্রকাশিত হবে, তা সেটের প্রায় সকলেই অবগত ছিল। সন্ধ্যা থেকে রাত দশটা অবধি খেয়াম চিন্তাতে শুধু ঘেমেছে। ঘামতে ঘামতে তার শরীরের পরিচ্ছদের অবস্থা খুবই করুণ। রাত দশটার পরই তার ফলাফল পেয়েছে সে। ভাগ্য আর পরিশ্রম উভয় মিলিয়ে সে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স করার সুযোগ পেয়েছে। এদিকে জগন্নাথে সুযোগ হওয়ার জন্য প্রত্যেকেই তার কাছে মিষ্টি খাওয়ার আবদার ধরেছে। ইব্রাহীম সেই শুরু থেকেই খেয়ামকে পছন্দ করত আর প্রস্তাবও দিয়েছিল প্রেমের। কিন্তু সে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরও খেয়ামের প্রতি তার আগ্রহ কমেনি। সে হঠাৎ খেয়ামকে বলল, ‘কোনো জিনিসই বাসি ভাল্লাগে না। তাই নগদ নগদ মিষ্টি খাওয়াবা আমাগো।’ তা শুনে খেয়াম পড়ে গেল বিপাকে। তার কাছে যা অর্থ ছিল তাতে ভালো মিষ্টি এত মানুষের জন্য কেনা মুশকিল। আর রাত করে ফিরতে হয় বলে সে টাকা বেশি লাগলেও মাঝে মাঝে উবারের সাহায্য নিয়ে হোস্টেল ফেরে। টাকাটা তার ভাড়াতেই লেগে যাবে। মিষ্টি খাওয়ানোর ইচ্ছা তার প্রবল। তবে সেই ইচ্ছা পরেরদিন প‚রণ করতে চেয়েছিল সে। কিন্তু সবার আবদারে মুখের ওপর সে বলতেও পারবে না, ‘আজ না কাল খাওয়াব।’ শ্যুটিং শেষ হতে এখনও প্রায় অনেকক্ষণই বাকি। তাই আপাতত সবাই কাজেই অগ্রসর হলো। কিন্তু তার চিন্তা কমল না।

শ্যুটিং শেষ হওয়ার পর হঠাৎ করেই ইব্রাহীম মিষ্টি নিয়ে হাজির হলো। মিষ্টিমুখ করতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেও খেয়াম ভাবতে থাকে, ‘মিষ্টি কেনার খরচটা কি ইব্রাহীম বহন করল?’ এমন কিছু হলে সে কালই টাকা পরিশোধ করে দেবে ভাবল। সেই সাথে তার আরও একটা ভাবনা শুরু হয়ে গেল। ভাবনাটা হতেই সে মেহফুজের সঙ্গে কথা বলার বেশ তাগিদ অনুভব করছে। সেদিনের পর তার মেহফুজের সঙ্গে এক বাক্যও বিনিময় হয়নি। একই সাথে সারাদিন থাকার পরও খেয়ামের যেন মনে হয় মেহফুজের উপস্থিতি সে টেরই পায় না। কারণ, মেহফুজের দিকে আগে সে যতটুকু মনের ভুলে তাকিয়ে থাকত। কিন্তু সেদিনের পর থেকে এই ভুলটাও হয় না তার।

শ্যুটিং শেষে খেয়াম সেট থেকে বেরিয়ে মেহফুজকে খুঁজে পেল তার গাড়ির কাছে। কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলছে মেহফুজ সেই মুহূর্তে। মেহফুজের সাথে খেয়ামের কথাবার্তা না হলেও মেহফুজের সামনে যেতে কেমন যেন খুব অস্বস্তি ঘিরে ধরে তাকে। ঠিক সহজ হয়ে কথা বলতে পারে না সে। কেন এমন হয় তা সে বুঝতে পারে না। তাই মেহফুজকে আসলে কী সম্বোধন করে ডাকা উচিত তা নিয়েও সে বিভ্রান্তে পড়ে যায়। স্যার সম্বোধনটা কোনোভাবেই তার মুখ থেকে বের হতে চায় না, এদিকে ভাইয়া ডাকতেও তার মহাবিরক্ত লাগে। নিজের এই ব্যাপারটাতে সে নিজেই হতাশ তার প্রতি।

মুনের সঙ্গে কথা চলছিল মেহফুজের। কথা বলে জানতে পারল মুন আগামী পরশু প্লেনে উঠছে। তখন মেহফুজের থেকে কিছুটা দূরে এসেই দাঁড়িয়ে আছে খেয়াম। যদিও খেয়ামের দৃষ্টি মেহফুজের দিকে নয়। তবুও মেহফুজ তাকে দেখে বুঝতে পারল, খেয়াম তার সঙ্গেই কথা বলতে এসে দাঁড়িয়েছে। এর আগে মেয়েটা বেশ কয়েকবার তাকে বিভিন্ন প্রয়োজনে কল করেছে। কিন্তু কেন যেন তার একদমই ইচ্ছা হয় না খেয়ামের সাথে কথা বলার। তাই সে ততবারই নয়নকে দিয়ে খেয়ামের সঙ্গে কথা বলিয়েছে। তাই তারপর থেকে খেয়াম যে-কোনো দরকারই নয়নকে জানায়। কিন্তু আজ হঠাৎ তার কাছে কী দরকার পড়তে পারে? সেটাই ভাবছে মেহফুজ।
প্রায় ছাব্বিশ মিনিট কথা বলা শেষে মেহফুজ কান থেকে ফোন নামায়। তারপর হাঁক ছেড়ে নয়নকে ডেকে বলে, ‘বের হবো এখনি। জলদি এসো।’ সে মুহূর্তে খেয়াম গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসে তার কাছে।
-‘দুমিনিট টাইম হবে আপনার?’

আজও ঠিক কোনো সম্বোধন ছাড়াই খেয়াম কথা শুরু করল। অথচ সে ভেবে এসেছিল, স্যার বলেই কথা শুরু করবে। কিন্তু তার মুখের জবান যেন পণ করেছে, ‘মহা বড় বাজ পড়লেও স্যার আমি বলব না।’ মেহফুজও খেয়ামের এই সম্বোধন ছাড়া কথা শুরুর ব্যাপারটা বারবারই লক্ষ করে। কিন্তু কিছু বলে না সে। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চেয়ে রইল শুধু খেয়ামের দিকে। খেয়াম থুঁতনিটা গলার সাথে মিশিয়ে বলতে আরম্ভ করল, ‘আসলে আমি বোধ হয় শ্যুটিঙের কোনো শিডিউল মিস করে ফেলতে পারি আমার পড়াশোনার জন্য। এতদিন তো কোনো পড়াশোনা ছিল না, তাই সমস্যা হয়নি। যদি শিডিউল মিস করে ফেলি তাহলে আমাকে কাজ থেকে বের করে দেবেন না প্লিজ। প্রয়োজনে আমার গ্যাপ দেওয়ার দিনগুলো হিসাব করে রেখে সেই হিসেবে আমার টাকাটা দেবেন।’

-‘স্যালারির ব্যাপার তো নয়ন দেখাশোনা করে। ওকে জানিয়ে রাখলেই চলবে।’ বলেই মেহফুজ আর দাঁড়ায় না। চলে যায়। তার এই উপেক্ষা করা আচরণে খেয়াম ভেতরে ভেতরে একটু সংকুচিত হলো। তার কেমন জানি কষ্ট লাগে মেহফুজের এই আচরণগুলোতে। লোকটার সমস্ত বিষয়ই তো নয়ন দেখে। তাই নয়নের কাছে বলাটাই শ্রেয় ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে সে যে কেন তার কাছে আসতে গেল! তার কাছে না এলে তার এই অগ্রাহ্য করা আচরণটুকু তো আর পেতে হতো না।
***

এক সপ্তাহ হলো মুন দেশে ফিরেছে। দেশে ফেরার পর একদিনের মতো সে বাবার বাড়িতে ছিল। তারপরই সে শ্বশুরবাড়িতে চলে এসেছে। আসার পর আজই প্রথম সে অফিস যাতায়াত শুরু করেছে। রাতে বাসায় ফিরে নিজে হাতেই রাতের খাবারের আয়োজন করে ফেলল সে। এ বাড়িতে সে থাকলে একটু বোঝা যায় যে বাড়িতে কোনো মানুষ বসবাস করে। নীহার বড্ড শান্তি পান মেয়েটা বাড়িতে থাকলে। আগে যখন তার ছোটো মেয়ে মারিয়া ছিল বাসায়, তখন সারাদিনই দুই ননদ ভাবি মিলে বাড়িটা মাতিয়ে রাখত। এ বাড়িতে মারিয়া আর মুন বাদে যে তিনটা মানুষ বসবাস করত তাদের মধ্যে মেহফুজ ছোটোবেলা থেকেই একা আর হট্টগোলমুক্ত থাকতে পছন্দ করে। তাই সে বাড়িতে থাকলেও বোঝার উপায় নেই তার উপস্থিতি। আর নীহার; স্বামী অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর থেকে রঙিন দুনিয়ার সব কিছুই যেন তার চোখে সাদা-কালো। দায়বদ্ধতা থেকে সংসারটাকে দেখেশুনে রাখতে হয়। মনের একাংশে শুকিয়ে যাওয়া নদীর মতো চর পড়ে গেছে তার। মানুষ থেকেও মানুষবিহীন বাড়িটাতে মুনের অভাব তিনি প্রচÐ উপলব্ধি করেন, যখন মেয়েটা বাড়িতে না থাকে।
রাতের খাবার টেবিল সাজিয়ে মুন আর নীহার অপেক্ষা করছে মেহফুজের জন্য। সে এলেই খেতে আরম্ভ করবে তারা। এর মাঝে মুন টুকিটাকি অনেক খবরা-খবর নিয়ে নিলো শাশুরি মায়ের থেকে। মেহফুজ অবশেষে নিচে নামল। তাকে দেখে মুন বেশ চওড়া একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘তুই কি আজকাল এক্সারসাইজ শুরু করেছিস না কি রে?’ মেহফুজের কালো পলো শার্টটার শর্ট স্লিভের নিচ থেকে তার ফর্সা পেশির মাংস ফুলে আছে। মুন সেটা লক্ষ করেই বলল। মেহফুজ চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বলল, ‘কোথায়? অনেকদিন বাদে দেখছিস তাই এমন লাগছে।’

নীহার ছেলের প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছেন। এর মধ্যে মুন বলল, ‘সত্যিই কি তাই, আম্মা?’

নীহার হেসে ফেললেন, ‘ওকে তো আমার সব সময়ই রোগা লাগে।’

-‘হুঁ, আমি তো বাবার মতো আটানব্বই ওয়েটের হলে তুমি ব্যাপক খুশি।’

মুন তখন বলল, ‘কিন্তু তোকে সত্যিই অনেক ফিট লাগছে আগের থেকে। নতুন কিছুই করছিস না?’

-‘আরে নাহ, ঘরের মধ্যে যেটুকু যা করতাম এখনো তাই-ই করি।’

-‘তাহলে বোধ হয় সত্যিই অনেকদিন বাদে দেখছি বলে তাই সব নতুন লাগছে।’

মেহফুজ ভাতের গ্রাস মুখে পুরে নিয়ে বলল, ‘তুই কিন্তু এই দেড় মাসে পারফেক্ট হয়ে গিয়েছিস।’

-‘বলছিস?’

-‘হুঁ, একদম।’

মুন খানিকটা লজ্জা পেল। নীহার হঠাৎ বললেন, ‘ওহ, আজ না আরিফ ভাই ফোন করেছিলেন। ওনার মেয়ে নাকি জগন্নাথে চান্স পেয়েছে?’ প্রশ্নটা মেহফুজকে করলেন তিনি। কিন্তু মেহফুজ কোনো উত্তর দিলো না। নীহার সেটা লক্ষ করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মেয়েটা কি কাজে আছে, মেহফুজ?’

-‘থাকবে না কেন? থাকার জন্যই তো আমার ঘাড়ে চাপিয়েছ।’

-‘কোন মেয়ের কথা বলছ তোমরা?’ মুন জিজ্ঞেস করল। মেহফুজ বলল, ‘তোর আম্মা স্বজনপ্রীতির চোটে একজন আনকুয়ালিফাইড মেয়েকে তোর অফিসে চাকরি দিতে চেয়েছিল। তুই নেই, তাই সেই সুযোগে প্রিম্যাচিওর মেয়েটিকে আমাকে অধম পেয়ে দিয়েছে আমার কাঁধে গছিয়ে।’

-‘কী যে বলিস তুই! ছোটো একটা মেয়ে। ওর বুদ্ধি কি এখনো অত ভার হয়েছে? অনেক ইনোসেন্ট কিন্তু।’ নীহার বললেন।

মেহফুজ সে কথার প্রতিবাদ জানিয়ে বলল, ‘কাজ আমার সঙ্গে করে মা। তোমার ছোটো পুচকে মেয়ের কথার ধার আর তেজ দেখলে বলতে না সে অনেক ইনোসেন্ট। যথেষ্ট ম্যাচিওরড সে। ছোটো তার শিক্ষাগত যোগ্যতায়। দেখতে শুনতে আর তার আচার আচরণে মোটেও সে পুঁচকে না।’

নীহার আর মুন মেহফুজের কথার সুরে বুঝতে পারল, মেয়েটার ওপর অনেক বেশিই ক্ষুব্ধ সে। মুন জিজ্ঞেস করল, ‘আমাকে কি বিস্তারিত বলবে তোমরা?’

তা শুনে নীহার খেয়ামের ব্যাপারে সব কিছু বললেন। মুন সব শুনে বলে উঠল, ‘পাগল তুমি আম্মা? আমার অফিসে এমন যোগ্যতার কোনো পদ আছে? তুমি জানো না? অসম্ভব। যদি পারে তো আমাদের কারখানার ওয়ার্কার হিসেবে ঢুকুক। এ ছাড়া আর কোনো কাজ নেই আমার কাছে।’

মেহফুজ তখন মাকে বলল, ‘তাহলে ওকে আর না হয় ওর বাবাকে বলে দেখো মুনের অফার।’

নীহার দ্বিমত জানালেন, ‘আরে ধুর! এর থেকে তোর কাজই অনেক সেফ আর ভালো আছে।’
***

আরিফ অনেক খুশি হয়েছেন মেয়ের ভালো ভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ হওয়ায়। ঢাকায়ও এসেছিলেন তিনি মেয়েকে নতুন ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার জন্য। কষ্ট হলেও তিনি মেয়ের পড়াশোনার পেছনে সর্বস্ব দিতে রাজি এখন। খেয়ামের আরও দুজন বন্ধুর সেখানে সুযোগ হয়েছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে খেয়াম প্রথম কিছুদিন ভার্সিটি অ্যাটেন্ড করেছিল। নতুন উদ্যমে তার জীবনটা চলতে আরম্ভ করেছে। কাজের মাঝেও সে যে এভাবে পড়াশোনার সুযোগ পাবে তা সে ভাবেনি। একদিন, দুদিন কাজে ফাঁক পড়লেও কোনো সময় তা নিয়ে কোনো ঝামেলায় পড়তে হয় না তার। তবে শেষ কিছুদিনে একটু বেশিই সে কাজে ফাঁক দিয়ে ফেলেছে। সেই ফাঁকটা অতি শীঘ্রই তাকে প‚রণ করতে হবে। নয়তো নয়ন যেভাবে তাকে বলেছিল, ‘শোনো খেয়াম, তুমি খুব ছোটো বলেই তোমাকে এই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ছুটি অনেক বেশি পড়লে তখন কিন্তু ঝামেলায় পড়তে হবে।’ নয়নের কথাগুলো মনে পড়তেই ভেতরে ভেতরে একটা আতঙ্ক কাজ করছে তার, যদি কাজটা হারিয়ে ফেলে সে? তাই আজই ছুটে এল আবার কাজের জায়গায়।

সে পানির বোতল নিয়ে এসে দাঁড়াতেই তার পায়ের কাছে মেহফুজের মাথার ক্যাপটা এসে পড়ল। প্রচণ্ড রেগে আছে মেহফুজ। শট শুরু হওয়ার কথা সকাল সাতটায়। সেখানে বেলা বাজে দশটা। কিন্তু এখনো আজকের স্ক্রিপ্টের মূল চরিত্র এসে উপস্থিত হয়নি। সেই ব্যক্তিটিকে নিয়ে মেহফুজ যে ক’বারই কাজ করতে বাধ্য হয়েছে, সে ক’বারই তাকে এমন ধরনের সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে। আসি আসি বলেও ব্যক্তিটি সেটে আসে ঘণ্টা দুই, তিন পার করে। খেয়াম শুনেছে, সেই লোকটির প্রতি মেহফুজের এত বেশি রাগ যে পারলে সে হয়তো তার নামে সত্য মিথ্যা দিয়ে চার পাঁচটা মামলা ঠুকে দিলে শান্তি পেত। আরও শুনেছে, লোকটি নাকি বর্তমান ব্যান্ড সিঙ্গারদের মাঝে বেশ জনপ্রিয় একজন সিঙ্গার। পাশাপাশি সে অভিনয়টাকেও চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ কারণেই তার ফ্যান ফলোয়ারস অত্যাধিক। আর এই দাপটেই মাটিতে সহজে পা পড়তে চায় না তার। মেহফুজ নাট্য ও চলচ্চিত্রের জগতে একজন নতুন পরিচালক হয়ে যেমন খুব দ্রুতই সাফল্য আর মর্যাদাসম্পন্ন স্থান তৈরি করে নিয়েছে, ঠিক সেই মানুষটিও অতি অল্প সময়ে অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মেহফুজকে সে খুব একটা সমীহ করে চলে না। এসব শুধু খেয়াম শুনেছেই। আর আজ তার কিছুটা প্রমাণও মিলল। সেই লোকটির আচরণেরও নাকি খুব একটা সুনাম নেই। তাকে দেখার জন্য খেয়াম ভেতরে ভেতরে অনেক বেশিই উত্তেজিত। মনে মনে সে বলে চলেছে, ‘তুমি কোথাকার হনু হে! তোমার দর্শনে যে বড়োই ব্যাকুল আমি।’

বাজখাঁই সুরে মেহফুজ সহকারীদের বলে উঠল, ‘শটই নেবো না আমি। নোমানকে বল স্ক্রিপ্ট চেঞ্জ করতে এখানে। ওর কোনো চরিত্রই রাখব না। ওর যতটুকু যা সিন আছে তা এডিটের ব্যবস্থা কর।’ বলেই সে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা খেয়ামের দিকে অগ্নিঝরা দৃষ্টিতে তাকাল। খেয়াম সেই তখন থেকে হাতে পানির বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেহফুজের হাতে আর তুলে দেওয়ার খবর নেই। মেজাজ এখন সপ্তম আকাশে মেহফুজের। ভেবেছিল সে, এই মেয়ের সাথে আর কথা বলবে না কোনোদিন। কিন্তু আজ সীমাহীন ক্রোধের কাছে সেই ভাবনা কখন যেন উবে গেল। আবারও বাজখাঁই গলায় সে চেঁচিয়ে উঠল খেয়ামের ওপর, ‘পানির বোতল কি ধরে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য এনেছ?’

খেয়াম ছুটে এসে মেহফুজের হাতে পানির বোতল তুলে দিলো। সহকারী প্রত্যেকে মেহফুজকে ঠান্ডা করতে ব্যস্ত। প্রায় এগারোটার ওপাশে এসে একটা গাড়ি থামল স্পটে। খেয়াম উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সেদিকে। তার সামনে নামল ঝাঁকড়া চুলের বাবরিওয়ালা একটি ছেলে। পরনে তার সাদা ধবধবে একটা ফতুয়া আর জিন্স প্যান্ট। গায়ের রংটা বাদামি, গোলগাল মুখ। আর তার হাতভর্তি চেইন আর ব্রেসলেট। গলায়ও কালো রঙের একটা মোটা চেইন ঝুলছে। তার ড্রাইভার নেমে একটা ছাতা নিয়ে অতি দ্রুত তার মাথায় ধরল। চুলগুলো পেছনে ঝুঁটি বাঁধতে বাঁধতে এগিয়ে আসছে সে। চেহারাতে সত্যিই একটা ব্যান্ড সিঙ্গার ভাব আছে লোকটির। মেহফুজ রাগের চোটে তার দিকে ফিরেও তাকাল না। সে আসতেই মেহফুজ চেয়ারে লাথি মেরে উঠে দাঁড়াল। আমিনসহ অন্যান্য সহকারীরা বুঝতে পারল, আজকের শট মেহফুজ জীবনেও নেবে না। আবার সেট ছেড়েও যাবে না সে। শ্যুটিঙের মাঝে তরঙ্গ কোনোরকম বেয়াড়াপনা করলে মেহফুজ আজ বড়োসড়ো কোনো ঝামেলা বাঁধাবে, নিশ্চিত। মেহফুজ বেশ দূরে গিয়েই বসল। তরঙ্গ সেটে এসে দাঁড়াতেই আমিন এগিয়ে এসে বলল, ‘একটু দেরি হয়ে গেল না? মেহফুজ স্যার তো সাংঘাতিক রেগে গেছেন।’

তরঙ্গ গলার চেইন আঙুলের মাঝে পেঁচিয়ে নাড়তে নাড়তে কেমন পরোয়া না করা অভিব্যক্তিতে বলল, ‘তাতে আমার বাল ছেঁড়া গেল।’

আমিন থতমত খেয়ে গেল তরঙ্গের এমন জবাবে। খেয়াম মেকআপ আর্টিস্ট হৃদয়ের পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিল তরঙ্গকে। তার চোখ দুটো কেমন ভয়ানক লাল আর ঘুম ঘুম ভাব যেন। মনে হচ্ছে ঘুম থেকে তাকে টেনে তুলে এখানে আনা হয়েছে। এই ছেলে আজ শট দেবে কী করে? আর এত বিশ্রী কেন এই ছেলেটার ব্যবহার? খেয়াম মৃদুস্বরে বলে উঠল, ‘কোথাকার থার্ডক্লাস এ? এত অশ্লীল কেন সে?’

তার মৃদু আওয়াজের কথাগুলো হৃদয়ের কানে পৌঁছে গেল স্পষ্টভাবেই। সে খাদে নামিয়ে আনা কণ্ঠে বলল, ‘আরে আস্তে বলো। শুনে ফেললে তোমার সম্মানের দফারফা করে বসবে। পুরো সেট মাথায় করে ফেলবে।’

-‘এমনও কোনো অভিনেতা হয়?’

-‘সে হয়।’

-‘একে কেন কাজে ডাকে?’

-‘টিভি দেখো না, না কি? দর্শকের কাছে খুবই প্রিয় মুখ সে। তার সাথে কাজ করতে হলে সবাইকেই তার এই আচরণ সহ্য করতে হয়।’

-‘বুঝলাম। কিন্তু সে শট দেবে কী করে? মনে তো হচ্ছে ঘুমে ঢুলে ঢুলে পড়ছে। এ আবার অভিনয়ও পারে?’

-‘শট দেওয়ার সময়ই দেখে নিয়ো।’

মেকআপ নেওয়া শেষে কাঠফাটা রোদ্দুরের মাঝে শট দেওয়া নিয়ে শুরুতেই তরঙ্গের বাহানা শুরু হলো, ‘আরে আমি কি মরুভ‚মির তরতাজা উট নাকি? এমন রোদে শট নেওয়ার পরিকল্পনা কোন আবালে করছে?’

পুরো শ্যুটিং সেট চেঁচামেচি করে মাথায় তুলে ফেলেছে সে। খেয়াম বারবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে মেহফুজকে খুঁজছে। আজকে দুই তুফান এক সঙ্গে হলে পুরো শ্যুটিং এলাকা যে তছনছ হয়ে যাবে, তা সে ভালোভাবেই টের পাচ্ছে। তরঙ্গকে মানানোর চেষ্টা করছে সবাই খুব। সে কোনোভাবেই রোদের মধ্যে শট দেবে না। তার একটাই কথা, ‘আরে ধুর বাল! তাকাতেই তো পারতেছি না। তার শট দেবো ক্যামনে?’

এ কথা শেষবার বলে সে কোল্ড ড্রিংক চাইল। তার কাজেই কমপক্ষে তিনজনকে নিয়োজিত থাকতে হচ্ছে সব সময়। দূর থেকে খেয়াম অসম্ভব বিরক্ত নিয়ে দেখছে তাকে। সে হঠাৎ খেয়াল করল মেহফুজ অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলতে বলতে হাঁটাহাঁটি করছে। সেই সকাল থেকে মানুষটা ঘেমে-নেয়ে বসে অপেক্ষা করছিল। হঠাৎ করেই তার জন্য মনটা কেমন আনচান করে উঠল খেয়ামের। বারবার চোখে ভাসছে মানুষটার কপাল আর চিপ বেঁয়ে গড়িয়ে পড়া তার ঘর্মাক্ত মুখটা। একটা কোল্ড ড্রিংকের বোতল খেয়াম তার জন্য নিয়ে যেতে পা বাড়াল। কিন্তু তখনি তরঙ্গ ডেকে উঠল তাকে, ‘ওই জোব্বাওয়ালি! হাতে কোল্ড ড্রিংকের বোতল নিয়ে কোনদিকে যাও? এখানে চোখে দেখো না?’

আমিন খেয়ামকে ডেকে বলল, ‘এদিকে নিয়ে আসো বোতল।’
বলেই সে তরঙ্গকে বলল, ‘মেকআপ তো খারাপ হয়ে যাচ্ছে তরঙ্গ। শটটা তাড়াতাড়ি দিয়ে দিলে ভালো হয় না?

-‘ধুর মিয়া! বললাম না এই ঠাডা পড়া রোদ্দুরের মধ্যে আমি কোনো শটমট দিতে পারব না?’

এর মাঝে খেয়ামের থেকে সে আরও একটা কোল্ড ড্রিংকের বোতল নিয়ে তাতে চুমুক দিতে আরম্ভ করেছে। আমিনসহ আরও কয়েকজন তাকে বোঝানোর কাজটা করেই যাচ্ছে। তখন মেহফুজ এসে দাঁড়াল, ‘কী ব্যাপার! শট নেওয়া শুরু হয়নি কেন এখনো?’

তরঙ্গ একবার নজর তুলেও তাকাল না মেহফুজের দিকে। আমিন এসে মেহফুজকে সমস্যাটা বলতে বাধ্য হলো। তা শুনে সে তরঙ্গকে জিজ্ঞেস করল, ‘শট দেওয়ার কথা ছিল তোমার সকাল সাতটায়। এখন প্রায় বারোটা বাজতে চলেছে। এমনিতেও এই শট এই ওয়েদারে যায় না। তারপরও তুমি এত লেট করছ কেন?’

-‘আমার সমস্যা আছে বলছি না? এত রোদে আমি শট দিতে পারব না। গায়ে উটের চামড়া না আমার।’

-‘গায়ে উটের চামড়া আমাদেরও নেই। এয়ারকন্ডিশনের মধ্যে বসবাস আমরাও করি। আমরা থাকতে পারলে তুমিও পারবে। এত ঝামেলা কোরো না তো, তরঙ্গ। যাও জলদি রেডি হয়ে নাও।’

-‘আরে মহা মসিবত তো! আমার শট দেওয়ার কথা ছিল নরম ওয়েদারে। রোদের মধ্যে শট দেওয়ার কথা তো ছিল না আমার। তাহলে আমি এখন কেন শট দেবো?’

-‘তাহলে তুমি লেটে কেন ঢুকলে? এখন কি তুমি শিডিউল আরেকটা দিতে চাচ্ছ শ্যুটিঙের? আমার তো এত সময় নেই হাতে। দেখো, এত বেশি ঝামেলা করলে তো আমাকেও ঝামেলার রাস্তাতে যেতে হবে।’ বেশ কড়া কণ্ঠেই বলল মেহফুজ।

তরঙ্গের মুখের মধ্যে পানীয় ছিল। মেহফুজের কথা শুনে সে তাচ্ছিল্যভাব প্রকাশের জন্য মুখের মাঝের পানীয়টুকু কুলকুচার মতো করে ছুড়ে মারল বাহিরে। আর তা গিয়ে পড়ল একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা খেয়ামের বোরখার ওপর। ব্যাপারটুকুতে সেটে দাঁড়িয়ে থাকা সবারই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। আর খেয়ামের চেহারা তখন রাগে হতবিহ্বল ভাব যেন। তরঙ্গ উঠে দাঁড়িয়ে চেহারা বিকৃত করে দায়সারা সুরে বলল, ‘ওকে ওকে, আজকেই এমন অসময়ে শট দিচ্ছি। এরপর এমন সময়ে আমাকে শট দেওয়ার কথা বলে পায়ে ধরলেও আমি রাজি হবো না।’

মেহফুজ আমিনের পাশে বসে শট নেওয়া দেখছে। আর অন্যদিকে খেয়াম তিরিক্ষি নজরে তরঙ্গের নিঁখুত অভিনয় মুহূর্ত দেখছে দাঁড়িয়ে। সত্যিই, তার অভিনয়ের প্রশংসা না করে থাকা যায় না। তার জন্য আজ স্পটে প্রচুর ভিড়ও জমা হয়েছে। ছেলেটার দম্ভ সম্পর্কে খেয়ামের পুরোপুরি আন্দাজ করা হয়ে গেছে এইটুকু সময়েই। প্রায় একটানা একঘন্টা সে শট দিলো। শট কাট করতে হয়েছে খুব কমবারই। এর মাঝে তার বাকি সহঅভিনেতা, সহঅভিনেত্রী দরকারে অদরকারে বিরতি নিলেও সে বিরতি নেয়নি। তাতে বোঝা গেল, সে যখন কাজ শুরু করে তখন পুরোপুরি মনোযোগ দিয়েই সে কাজ শেষ করে।

এক ঘণ্টার শট দেওয়া শেষে বড়ো দুটো স্ট্যান্ড ফ্যানের সামনে এসে বসল তরঙ্গ। এক সাথে পানি, ড্রিংক সব কিছুর ব্যবস্থা করে একজন মানুষ এগিয়ে আসছিল তার কাছে। খেয়াম হঠাৎ তার কাছ থেকে পানীয়র ট্রেটা নিয়ে তরঙ্গকে সে পার করে সোজা মেহফুজ আর আমিনের সামনের টি-টেবিলে রাখল সেটা। কাজটাতে ক্ষণিকের জন্য মেহফুজ আর আমিন হতজ্ঞান হয়ে তাকিয়ে ছিল তার দিকে। তবে বেশি সময় সে তাদের তাকিয়ে থাকার সুযোগ দিলো না। এরপরই সে আরেকটা ট্রে করে তরঙ্গের জন্য নিয়ে এল নাশতা। তরঙ্গের তখন অত্যাধিক মেজাজ চড়ে গেলেও বলতে পারল না, তাকে ফেলে কেন আগে অন্যদের নাশতা দেওয়া হলো? এই ব্যাপারটা নিয়ে রাগ দেখাতে গেলে তাকে হাভাতে ভেবেও বসতে পারে যে কেউ। খেয়াম তার টেবিলে নাশতার ট্রে রাখতেই তরঙ্গ রাগান্বিত কণ্ঠে বলল, ‘গ্লাসে পানি ঢালো।’
খেয়াম একবার শান্ত দৃষ্টিতে তাকে দেখে নিয়ে একটা গ্লাসে পানি ঢালল আর আরেকটা গ্লাসে ড্রিংক ঢালতে গিয়ে তা ছিটকে গিয়ে পড়ল তরঙ্গের প্যান্টের ওপর। প্যান্টের একদম মিডল পয়েন্টে লেগে জায়গাটুকু ভিজে গেল। তরঙ্গ তখন ‘ওহ শিট!’

বলে উঠে দাঁড়িয়ে জায়গাটুকু মুছতে মুছতে চেঁচিয়ে বলল, ‘এই, কী করলা এটা? তোমারে কাজে ঢুকাইণে কে? ঘাড় ধাক্কাইয়া একেবারে বের করে দেবো। কাজ জানো না কি চেহারা দেখাইতে আসছ? এই ওরে কাজে নিছে কে রে?’

শ্যুটিং সেট পুরো মাথায় তুলে নিয়েছে সে চিৎকার চেঁচামেচিতে। এর মাঝে অকস্মাৎ একটা ধমকে তরঙ্গ চমকে উঠল। একদম নীরব হয়ে হতবাক দৃষ্টিতে সে খেয়ামের দিকে তাকাল। তরঙ্গ দেখতে থাকল তাকে, মেয়েটার মুখ ঢাকা থাকলেও তার বড়ো বড়ো সুন্দর চোখদুটোর আকৃতি আরও বড়ো হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। চোখের চাউনিতেই যেন দুনিয়া ভস্ম করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে সে। তরঙ্গের মতো একজন মানুষকে এত সাধারণ কর্মী ধমক দিয়ে বসে, এর থেকে বিস্ময়কর ঘটনা আর কী হতে পারে? এমন স্পর্ধা তো স্বয়ং কোনো ডাইরেক্টরও দেখাবে না তার সামনে। খেয়াম ধারাল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেও বেশ স্বাভাবিক সুরে তাকে বলল, ‘অল্পতেই দুনিয়া এমন মাথায় তুলে নেন কেন? এই যে দেখুন, আমার বোরখার নিচে কতখানি ভিজে! আপনি তখন কোল্ড ড্রিংক মুখের মধ্যে নিয়ে কুলকুচা করে ছুড়ে মারলেন আমার বোরখার ওপর। তখন তো তাকিয়ে দেখেননি, এখন দেখুন। আমাকে কিন্তু এটা পরেই সারাদিন সেটে কাজ করতে হবে। আর আপনি তো কস্টিউম চেঞ্জ করবেন। সমস্যা কী? সমস্যা নেই তো।’

খেয়ামের এমন স্পর্ধাজনক আচরণে আমিন এবং আরও অন্যান্য সহকারী খেয়ামকে ধমকানোর জন্য উদ্যত হতেই মেহফুজের বাধা পেয়ে তারা থেমে গেল। মেহফুজের থেকে হঠাৎ এমন বাধা পেয়ে তার ওপরও সবাই চরম বিস্মিত হলো।

খেয়াম কথা শেষ করে নির্বিকার ভঙ্গিতে তরঙ্গের সামনে থেকে চলে আসে। সে আন্দাজ করে নিয়েছে এরপর হয়তো তাকে আর কাজে রাখতে চাইবে না। তবুও এমন অসভ্য মানুষটাকে শিক্ষা না দিলে তার রাগটাই বৃথা যেত। তবে সে তার কাজ নিয়ে চিন্তিত হলেও মেহফুজের মুখ থেকে কিছু না শোনা অবধি এই কাজ ছাড়বেও না। আর ওদিকে, তরঙ্গ সহসা ঘটনায় তথাপি কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
***

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে