#এমনই_শ্রাবণ_ছিল_সেদিন
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৪.
প্রায় অধিকাংশ সিনেমা আর নাটকের শ্যুটিং চলে ঢাকা উত্তরার দিয়াবাড়িতে। মেহফুজের আজকের শ্যুটিং স্পটও এখানেই ঠিক করা হয়েছে। ইব্রাহীমের সাথে যোগাযোগ করে খেয়াম আজ এসেছে সেখানে। দুরুদুরু বুকে সে কাজ করছে আর আশপাশে চোখ বুলিয়ে মেহফুজকে খুঁজছে। এখন অবধি মেহফুজ বা নয়ন কারও দেখা পায়নি সে। তাকে দেখার পর তারা দুজন যে তার ঘাড় ধরে সেট বের করে দেবে তা সে নিশ্চিত। ইশ! এত বড়ো অপমান সে হজম করতে পারবে তো? মনে প্রাণে সহস্রবার আল্লাহকে স্মরণ করা হয়ে গেছে তার। যেন কোনোভাবেই এত বাজেভাবে অপমান হতে না হয়।
সেট রেডি হওয়ার বহু আগেই তারিন আজ উপস্থিত হয়েছে সেখানে। খেয়াম তার সঙ্গে আছে, তার নানা বিষয়ে খেয়াল রাখতে হচ্ছে তাকে। তারিনকে সে যতটা সংকীর্ণ মনের ভেবেছিল, আসলে সে ততটাও তেমন নয়। বরং অনেকটাই মিশুক সে। তাদের সবার সঙ্গেই কত সুন্দর হেসে হেসেই কথা বলছে। তারিনের প্রতি ধারণা খেয়ামের আজ বেশখানিকই পালটেছে।
খেয়ামকে সকাল থেকেই বেশ ভয়কাতুরে চেহারা নিয়ে কাজ করতে দেখছে ইব্রাহীম। খেয়ামের ভাবভঙ্গির মাঝে বেশ রহস্য অনুমান করছে সে। মেয়েটাকে তার শুরু থেকেই খুব ভালো লাগে। দুদিন এসেছিল না খেয়াম। সে ভেবেছিল কাজের দৌড়ানিতে মেয়েটা হয়তো আর আসবে না এখানে। আর বোধ হয় মেয়েটার সাথে তার দেখাও হবে না। কিন্তু গতকাল রাতে খেয়ামের ফোন পাওয়ার পর থেকে বেশ আনন্দ কাজ করছিল তার মাঝে। কিন্তু এমন মুখ লুকিয়ে ওকে কাজ করতে দেখে ওর কাছে এগিয়ে এল সে। ওকে জিজ্ঞেস করল, ‘সব ঠিকঠাক আছে তো?’
খেয়াম তারিনের কাজ শেষ করে মাত্রই একটু দূরে এসে দাঁড়িয়েছিল। ইব্রাহীমের সহসা প্রশ্নে একটু চমকে উঠল সে। জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপারে?’
-‘মনে হইতেছে কোনো ঘটনা ঘটছে। কেমন মুখ সাইড়া কাজ করতাছো যেন।’
খেয়াম একটু চুপ থেকে কী যেন ভাবল। তারপর সেদিনের ঘটনা ইব্রাহীমের কাছে খুলে বলল সে। ঘটনা শুনে রীতিমতো বিস্ফুরণ চাউনিতে তাকিয়ে আছে ইব্রাহীম ওর দিকে। এমনিতেই অসম্ভব ভয়ে খেয়াম সকাল থেকে কুঁকড়ে আছে। তার ওপর ইব্রাহীমের এমন অভিব্যক্তি দেখে ভয়ে ওর গলা, বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে যেন।
-‘কী করা উচিত আমার? নিশ্চয়ই আমাকে দেখলে অপমান করে বের করে দেবে? তার আগেই আমার বিদায় নেওয়া উচিত।’ মুখটা বেজার করে বলল খেয়াম।
-‘আরে থামো? কী করছো তুমি! মেহফুজ স্যার বেশ শান্ত ধারার মানুষ। রাগি আছে কিছুটা। কিন্তু তা একেবারেই সাধারণ। একজন ফিল্ম ডাইরেক্টররে যে কত কিছুর প্রেশার নিতে হয় তা যদি টের পাইতা তাইলে বুঝতা মগজ গরম কই থেইকা আসে। শ্যুটিঙের সময় তারিন ম্যাডাম যা করে তা তো যে-কোনো মানুষেরই চান্দি গরম কইরা দেয়। কিন্তু তারে তো আর কিছু কওয়া যায় না। আর ওই সময় মাথা গরম থাকে বইলা যার তার উপরে সেই রাগ ঝাইরা দেয় স্যার। কিন্তু স্যারের ব্যবহার অমায়িক। এমনও দিন গেছে শ্যুটিং শেষে স্যার আমাগো নিজে ডাইকা এক লগে বইসা আমরা চা, মুড়ি মাখা খাইছি। যথেষ্ট আদর স্নেহ করেন স্যার আমাগো। ওইদিন তুমি এত কিছু কইছো, তাও দেখছো স্যার তোমারে একটা কথাও শুনায় নাই। আমিন স্যার হইলে তো তোমারে থাপ্পড়ও বসাইয়া দিত। শোনো, সব জায়গাতেই এমন কম বেশি কথা সহ্য কইরা কাম করতি হয়। তুমি যদি সব জায়গাতেই এমন মেজাজ দেখাইয়া চইলা আসো তাইলে কি পেটে ভাত জুটাইতে পারবা? আর সবদিনই কি তুমি এমন কথা শুনতা? দুই একদিন এমন কথা আমরাও শুনি। কিন্তু তাই বইলা যে খালি কথায় শুনি তা তো না। এহনো আমার ফোন খুললে দেখবা সেটের সবার সাথে কত কত ছবি আমাগো। কাজ শেষে কত আনন্দও করি আমরা। বোকা মাইয়া! একটু তো ধৈর্য ধইরা থাকবা।’
ইব্রাহীমের কথা শোনার পর থেকে খেয়ামের নিজের প্রতিই নিজের বিশ্রীরকম মেজাজ খারাপ হচ্ছে। সত্যিই তো! শ্যুটিঙের জন্য সেট রেডি করতে কম খাটুনি হয় না তাদের। সেখানে অমন একজন পরিচালককে তো আরও কত কিছু সামলাতে হয়। এটুকু মাথা গরম হয়তো তার জায়গায় সে থাকলেও করে বসত। সে নিজেই দেখছে, এখানের অভিনয় করা মানুষগুলোর জন্য মাঝে মাঝে কত সময় ধরে অপেক্ষা করতে হয় সবার। তাদের দেমাকও দেখে সে। এদের ছাড়া তো আর সিনেমা, নাটক তৈরি করাও সম্ভব নয়। তাই তাদের তোষামোদ করেই চলতে হয় পরিচালকদের। কিন্তু তার যে জন্মগত স্বভাব। অপমান জিনিসটা কখনোই সে মুখ বুজে সইতে পারে না। মস্তবড়ো একটা ভুল করে বসেছে। এখন দেখা যাক, সামনে কী অপেক্ষা করছে তার জন্য! প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে কাজে অগ্রসর হলো সে।
শ্রাবণের শেষ সপ্তাহ। আকাশে স্ববশে পেঁজা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। শ্যুটিঙের জন্য একদম উপযুক্ত একটি আবহাওয়া। কিছুক্ষণ আগেই মেহফুজ সেটে এসে পৌঁছেছে। বাবার শরীরটা গতকাল হঠাৎ করেই একটু খারাপ হয়ে যাওয়ায় বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত সে। তাই আজ দেরি করে শ্যুটিঙের কাজ শুরু করতে হচ্ছে। বাসায় থাকতে মনটা বেশ খারাপ ছিল তার। কিন্তু বাহিরে আসার পর অবশ্য শ্রাবণের স্নিগ্ধ, নির্মল প্রকৃতি তার বিক্ষিপ্ত মনটাকে চট করেই সতেজ করে দিলো। আকাশের পানে তাকিয়ে সবার চোখের আড়ালে বুকভরে একটা শ্বাস টেনে নিলো সে। যেন ভেতরের সমস্ত অবসাদকে নিংড়ে বের করে দিতে পেরেছে এই কৃষ্ণকায় আকাশতলে।
শট রেডি করার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছে সবাই। আজকে তারিনের সংলাপের সময় কেউ একজনকে তার মুখোমুখি সংলাপ লেখা বড়ো একটা কাগজ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। ক্যামেরার আড়ালে থাকবে কাগজ ধরে রাখা সেই ব্যক্তিটি। সংলাপ ভুলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলে একবার হলেও কাগজটার দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিতে হবে তারিনকে। আর এই দায়িত্বটি খেয়ামকেই নিতে হয়েছে। মেহফুজ না আসা অবধি তারিন মেকআপের দিকে খেয়াল নিচ্ছিল। মেহফুজের আজ মন মেজাজ ভীষণ খারাপ, তা প্রায় সবাই-ই জানে। তারিনও আজ বেশ কেয়ারফুলি কাজ করবে বলে সতর্ক হয়ে আছে। মেহফুজকে আসতে দেখেই শট দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে নিলো সে জলদি। খেয়াম তখনো খেয়াল করেনি মেহফুজকে। সংলাপগুলো মার্কার পেনে একটা কাগজে বড়ো বড়ো অক্ষরে লিখে নিয়ে এসে মাত্রই দাঁড়িয়েছে। আর মেহফুজ তখনই ক্যামেরার সামনে বসতে গিয়ে খেয়ামের দিকে তার নজর পড়ে। প্রথমবার বেখেয়ালে তার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেও দ্বিতীয়বার মুহূর্তেই এমনভাবে তাকাল মেহফুজ খেয়ামের দিকে, যেন মনে হলো পৃথিবীর সব থেকে বিস্ময়কর কোনো বস্তু তার চোখের সামনে হঠাৎ উপস্থিত হয়েছে। এই প্রথম সে বেশ কিছু মুহূর্ত নিয়ে তাকিয়ে ছিল খেয়ামের দিকে। সে মুহূর্তে খেয়ামের অবস্থা ছিল বড়োই করুণ। ওই কয়েক মুহূর্তের জন্য দুজনের চারটা চোখ একে অপরের দিকে এঁটে ছিল। একজনের চোখে ছিল পৃথিবীর চরম বিস্ময়, আর আরেকজনের চোখে ছিল অফুরন্ত ভয় আর লজ্জা। সেই লজ্জা আর ভয়ের বশবর্তী হয়ে খেয়ামের খুব ইচ্ছা করছিল মাটি খুঁড়ে একদম পাতাল দেশে চলে যেতে। এমন কঠিন মুহূর্তের মুখোমুখি সে তার এই উনিশ বছরের জীবনে কোনোদিনও হয়নি। কিন্তু তাকে বেশ অবাক করে দিয়ে মেহফুজ স্বাভাবিক মুখভঙ্গিতেই ক্যামেরার সামনে গিয়ে বসল। খেয়ামের অসহায় চাউনি আর পাংশু মুখটা দেখে কিছু আর বলার ইচ্ছা হলো না তার।
কাজের মাঝে আজ খেয়ামের খেয়ালহীনভাবে কাজ করা প্রায় সবার চোখেই পড়েছে। দুবার সংলাপের কাগজটা উলটো করে ধরে দাঁড়িয়েছিল সে তারিনের সামনে। প্রথমবার তারিন চেঁচিয়ে উঠলেও দ্বিতীয়বার আমিন চেঁচিয়ে উঠেছিল তার ওপর। তৃতীয়বার ভুল করল সে, যখন তারিন গানের সাথে কাশবনের মাঝে ঘুরছিল রোহানের আঙুল ধরে, তখন খেয়াম আর আরও দুজন ব্যক্তির তিন পাশ থেকে কাশফুল ছড়িয়ে দেওয়ার কথা ছিল ওদের দুজনের দিকে। কিন্তু খেয়াম এতটাই অসতর্ক ছিল যে হাতে ধরে রাখা কাশফুল সে ছড়িয়ে দেওয়ার বদলে শুধু হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েই ছিল। সেখানেও আমিনের ধমকানি খেতে হলো তার। তার কাজের ভুল-ত্রুটি বেশ ভালোভাবেই সবাইকে বিরক্ত করে দিচ্ছিল।
দুটো শট নেওয়ার পর যখন সবাই বিরতি নিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল বসে, তখন খেয়াম সবার থেকে বেশ দূরে এসে দাঁড়িয়ে সবার নজরের আড়ালে থাকতে চেষ্টা করছিল। বিশেষভাবে মেহফুজের নজর থেকে। এখন তো কাজ শেষ। সুযোগ বুঝে লোকটা তাকে নিশ্চয়ই অপমান না করে ছেড়ে দেবে না? একটু বাদেই সবাই ফিরবে। খেয়ামকেও আজ তাদের সঙ্গে গাড়িতে ফিরতে হবে। এর মাঝে হঠাৎ করেই নয়ন তার সামনে এসে দাঁড়াল। তাকে আপাদমস্তক একবার দেখে তারপর বলল, ‘তোমার সাহস আছে বটে।’ খেয়াম তার সহসা আগমনে খানিকটা চমকে গিয়েছিল। কথা শুনে একদমই নিশ্চুপ রইল সে।
-‘আমি তো ভেবেছিলাম তুমি কাজ ছেড়ে যাবে বলেই ওভাবে ছোটোলোকদের মতো আচরণ করে গেছ। কিন্তু তা তো ভুল ভেবেছি। তুমি ভাবলে কী করে যে এরপরও তোমাকে এখানে কাজে রাখা হবে?’
ইতোমধ্যে ইলশেগুঁড়ি নামতে শুরু করেছে। সবাই ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। নয়ন এদিকে এসেছিল গাড়ি থেকে ছাতা নেওয়ার জন্য। কিন্তু খেয়ামকে দেখে তাজ্জব বনে সে ছাতার কথা বেমালুম ভুলেই বসল। সে ফের বলল, ‘তোমার সাহসের প্রশংসা করতে হয় সত্যিই।’ এ কথা শেষ হতেই পেছন থেকে কার যেন ডাক পড়ল তার। নয়ন আর কিছু না বলে দ্রুত গাড়ি থেকে ছাতা নিয়ে চলে যেতেই এবার মেহফুজকে তার গাড়ির দিকে আসতে দেখল খেয়াম। সহকারীদের সাথে কথা বলতে বলতে আসছে সে। খেয়াম একটা বিষয় খুব করে উপলব্ধি করল। সেদিন সে যে ব্যবহার দিয়েছে মেহফুজকে, তার জায়গায় আজ যে কেউ হলে তাকে দেখা মাত্রই সত্যি সত্যিই ঘাড়টা ধরে তাকে বের করে দিতো কাজ থেকে। কিন্তু সেক্ষেত্রে মেহফুজের এমন নীরব আচরণ সে একদমই আশা করেনি। মানুষটাকে তার বড়োই অদ্ভুত লাগছে। অদ্ভুতের থেকেও বড় অদ্ভুত। কাজের মাঝে খেয়াম অগণিতবার আড়চোখে তাকে লক্ষ করেছে। নাহঃ, সেই মানুষটার দৃষ্টি ভুলক্রমেও তার দিকে পড়েনি। আর না তার চেহারাতে কোনো রাগের ছায়াও দেখতে পেয়েছে সে। এত ভাবনার মাঝে খেয়ামের আরও একটা ব্যাপার হঠাৎ করেই মাথায় এল। তার বেতনটা গুনবে নিশ্চয়ই এই মানুষটি? আচ্ছা বেতন দেওয়ার সময়ই তাহলে সে কোনো ঝামেলা পাকাবে? এমন কিছুই কি সে ভেবে রেখেছে? সত্যি সত্যিই এমন কিছু সে ভেবে রাখলে তবে তো খেয়ামের মাথায় হাত দিয়ে মাঝ রাস্তায় বসা ছাড়া আর কোনো গতি থাকবে না!
মেহফুজ গাড়ির সামনে ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে তার সহকারীদের সঙ্গে কথা বলছিল। কথার ফাঁকে বেখেয়ালেই দৃষ্টি পড়ল তার কাছে এগিয়ে আসা খেয়ামের দিকে। এগিয়ে এসে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা তাদের থেকে। সে যে কিছু বলতে এসেছে তা বুঝতে পারল মেহফুজ। তাই কথা অন্যদের সাথে চললেও তার মনোযোগ পুরোদস্তুর রইল খেয়ামের প্রতি। আজ মেয়েটা কী বলার জন্য দাঁড়িয়ে আছে এই প্রশ্নটিই মাথার মধ্যে ঘুরছে তার। তবে কথা শেষ হতেই মেহফুজ সহকারীদের বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিল, আর ঠিক তখনি খেয়াম এক মুহূর্ত দেরি না করে অতি দ্রুত ছুটে এল তার সামনে।
-‘একটু কথা ছিল আপনার সঙ্গে।’ বেশ উদ্বিগ্নতা প্রকাশ পেল খেয়ামের কণ্ঠে।
মেহফুজ দাঁড়িয়ে পড়ল তার দিকে ফিরে। মেয়েটার সাথে আজ এই নিয়ে তার তিনবার কথা হচ্ছে মুখোমুখি। সে খেয়াল করেছে, মেয়েটা প্রথমবার ছাড়া বাদ বাকি দু’বার তাকে একদম কোনো সম্বোধন ছাড়াই কথা শুরু করেছে। আর তার কথা শুরুর ধরন দেখে মনে হয় যেন তাকে মেয়েটা একদমই সম্মান দিতে নারাজ। এইটুকু মেয়ে! অথচ, এমন অসংলগ্ন আচরণ কেন তার? খ্বুই বিরক্ত সে মেয়েটার ওপর। ভ্রুযুগল কুঁচকানো আর তার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি খেয়ামের দিকে। মেহফুজের এমন পরিপ‚র্ণ দৃষ্টিতে খেয়াম যেন ক্ষীণতা অনুভব করল চকিতেই। কণ্ঠস্বর রোধ হয়ে এল তার। মেহফুজ সেই আগের মতো করেই তাকিয়ে আছে তার দিকে। নয়ন একটু দূরে দাঁড়িয়ে থেকে ওদের দেখছে। খেয়াম সহসাই মেহফুজকে মেজাজি সুরে বলে বসল, ‘আপনি কি ভেবে রেখেছেন মাস শেষে আমার বেতনটা আটকে দেবেন? তার জন্যই কাজ থেকে বের করে দিচ্ছেন না? গাধার মতো খাঁটিয়ে নিচ্ছেন শুধু! দেখেন, আমার পরিবারের অবস্থা সম্পর্কে আপনি তো অবগত। তাই মনে এমন কিছু পুষে রাখলে তা ক্লিয়ার করে বলে দিন। আমি আর কাজে আসব না। কিন্তু এমনটা করে আমার প্রতি রাগ মেটাবেন না। এটা অন্যায় করা হবে আমার সাথে।’ কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে খেয়াম থেমে গেল। বলার সময় তার কাঠিন্যভাব মুখটা নত ছিল। কিন্তু যাহঃ! কী বলবে বলে ভেবেছিল আর কী বলে বসল সে? তাকে তো স্যরি বলে কাজ থেকে ছাটাই না করার অনুরোধই জানাতে এসেছিল। কিন্তু তার বদলে এ কী বলে বসল সে! এখন কী হবে? লোকটা তার এমন ঔদ্ধত্য আচরণে এবার নিশ্চয়ই ক্ষিপ্ত হয়ে তাকিয়ে দেখছে তাকে! ভয়াকাতর চাউনিতে মেহফুজের দিকে তাকাল সে একবার। লোকটার ভ্রæযুগল আগের মতোই কুঁচকে আছে। তবে কপালে এবার স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ, মুখটাতেও তার কাঠিন্যভাব। কিন্তু চোখের চাউনিতে তার বিশেষ কিছু নেই। যেন মনে হচ্ছে খেয়ামের কথাগুলো সে থোড়াই না পরোয়া করল। আর ঠিক তা-ই যেন হলো। খেয়ামের কথাগুলো শেষ হতেই সে নিস্পৃহতা নিয়ে গাড়িতে উঠে গেল। খেয়াম এতে ভারি আশ্চর্য হলো। তার ওপর মেজাজ দেখাল না কেন লোকটা? তবে যে ভয়টা সে পাচ্ছিল সেই ভয়টা আরও বেশি করে তার মনে জেঁকে বসল এবার, মেহফুজের এই পরোয়া না করা আচরণে। অস্থির হয়ে সে মেহফুজের জানালার কাছে এগিয়ে এল। মিনতিপ‚র্ণ সুরে বলল, ‘দেখুন, আমি কিন্তু কাজে আসব। আর যা-ই করুন, কাজের বিনিময়ে অন্তত কিছু দিয়েন প্লিজ।’ নয়ন ড্রাইভারের পাশে এসে বসেছিল। মেয়েটার ওপর তার সাংঘাতিক রাগ চড়ে আছে। কিন্তু তার স্যারটা মেয়েটাকে উচিত শিক্ষা দিচ্ছে না কেন? কত বড়ো স্পর্ধা মেয়ের? যার খাবে আবার তাকেই কথা শুনাবে! নয়ন পিছু ঘুরে তাকিয়ে রইল মেহফুজের দিকে। গাড়ি ছাড়ার কথাও বলছে না সে। হঠাৎ খেয়ামের দিকে তাকিয়ে আঙুলের ইশারায় তাকে কাছে ডাকল মেহফুজ। খেয়াম অপরাধী চেহারাটা নিয়ে এগিয়ে এসে তার জানালার কাছে দাঁড়ালে মেহফুজ জানালার দিকে একটু এগিয়ে এসে তাকে বলল, ‘তোমার ব্যবহার যেমন বাজে আর তুমি যেমন অসতর্ক, তোমার কাজও তেমন বাজে আর তাতে প্রচÐ তুমি অদক্ষ। কিন্তু চ্যাটাং চ্যাটাং কথার খুব জোর আছে। তাহলে কাজের কী দরকার? কথার জোর দিয়েই দেখো রোজগার করতে পারো কিনা।’ বলেই ড্রাইভারকে ইশারা করল সে গাড়ি ছাড়তে। তারপর জানালার কাচটাও তুলে দিলো।
চলবে।