০১
,
,
,
সাদাফ ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় টা আহামরি কোন বিশেষ ঘটনা সাপেক্ষে নয়……. ক্লাস নাইনে ওঠার পর আগের গৃহ শিক্ষকের অন্য জেলায় সরকারি চাকরি হবার সুবাদে ওনাকে রাখা হয়…… তখন তিনি আমার চাচাতো ভাই রিয়াদকে পড়াতেন…….. সেবছর রিয়াদ এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে সাদাফ ভায়ের কাছে পড়ার ইতি টেনেছিলো……… বাড়ি থেকে দূরে এসে নিজের খরচে তিনি তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকোনমিকস নিয়ে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছেন……. সেই সময় পুরাতন টিউশনির অবসান মানেই আর্থিক টানাপোড়ন……..তখন আমাকে পড়ানোর প্রস্তাব টা ছিলো তার কাছে মেঘ না চাইতেই জলের মতোন……
,
,
,
রিয়াদ মানে আমার চাচাতো ভাই যবে থেকে শুনেছে সাদাফ ভাই আমাকে পড়াবেন তখন থেকেই আমাকে তার রাগ সম্পর্কে হুশিয়ার করে দিচ্ছিলো…… সেই সুবাদে সাদাফ ভাই তখন আমার কাছে ছোট খাটো একটা যমের মতোন……মানুষটাকে না দেখেই শুনে শুনে ভয় পাওয়া যাকে বলে……. অঙ্ক আর বিজ্ঞানের দূর্বলতার জন্য এই দুটোকে মেজর সাবজেক্ট হিসাবে দিয়ে বাকি গুলো পড়া দেওয়া আর নেওয়ার মতোন করে তাকে রাখা হয়েছে……ব্যাক্তিগত ভাবে সাদাফ ভাই ছিলো বেশ গম্ভীর, চুপচাপ এবং ভয়ংকর রাগী স্বভাবের…… যদি ও সবকিছু রিয়াদের থেকেই শুনা……
,
,
,
ছাত্রী হিসাবে খুব তুখোড় না হলেও গাধা ছিলাম না একেবারে……. গণিত বুঝতে বেশ সময় লাগতো আর বিজ্ঞান!!! এই বাবাজি তো আমাকে মনে হয় কোন জন্মে সহ্যই করতে পারতো না….. সব কিছু একেবারে মাথার উপর দিয়ে রকেট গতিতে ছুটে যেতো……কোন মতেই তাকে আমার মনে ধরে রাখা সম্ভব ছিলো না……. এই দুই সাবজেক্টে পাশ করার সব ক্রেডিট আমার আগের শিক্ষকের…… সারাবছর গুনে গুনে ইম্পর্টেন্ট অংক গুলা করাতে করাতে একেবারে মুখস্থ করিয়ে দিতো…… তাই পাশ মার্ক চলে আসতো কোন রকমে……
,
,
,
সাদাফ ভাই যেদিন আসলো সেদিন প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিলো…… এক ঝাক বর্ষা ছাতার উপর নিয়ে ওনি আমাকে পড়াতে এলেন…….. প্রথম দিনই আমাকে বলেছিলেন…. রিয়াদ আমাকে সাদাফ ভাই বলে ডাকে….. চাইলে তুমি সাদাফ ভাই ও বলতে পারো বা স্যার ও ডাকতে পারো…..আমিও জগাখিচুড়ি বানিয়ে কখনো কখনো দুইভাবেই ডাকতে শুরু করি……….. শিক্ষক হিসাবে সাদাফ ভায়ের কোন তুলনা নেই…… একটা মানুষ এতো কিছু কি করে জানে…… ওনাকে দেখে আমার রীতিমতো হিংসা হতো……. কিন্তু এতো ভালো শিক্ষক পেয়েও পড়াশোনায় আমার কোন উন্নতি হচ্ছিলো না…….সে যখন করাতো বুঝতাম সামনে করতে বললে করেও দিতে পারতাম কিন্তু বাসায় হোমওয়ার্ক করতে নিলেই সব খেয়ে ফেলতাম………. সব ভুলে একাকার…..ব্যাপারটা হচ্ছিলো আমার ভয় থেকে…… কারণ বুঝানোর সময় যেই প্রশ্ন গুলো মনে আসতো সেগুলো ভয়ের কারণে মনেই থেকে যেতো মুখে আর আসতো না…..যথারীতি আমার বাড়ির কাজ তাকে দেখাতে পারতাম না আর ভুলে যাবার কারনে সামনে করতে ও পারতাম না……
,
,
,
বাবা কাজের সূত্রে দীর্ঘদিন যাবত সৌদিতে আছেন……. মা ও স্থানিয় হেলথ ককমপ্লেক্স এ চাকরি করতেন……. আর কোন ভাই বোন না থাকায় আমি বাড়িতে একা বলে একজন মহিলা রাখা হয় আমার জন্য……. সে আর তার চার বছরের ছেলে এসে সারাদিন থাকতো……… তার সাথে বাড়ির কাজ ও করতো…….. পড়া না পাড়ায় বিচার দেবার জন্য কোন গার্ডিয়ান না পেয়ে প্রথম দু চার দিন বেশ বুঝিয়ে শুনিয়ে দাত খিচিয়ে পড়ালো……. এর জন্য তিনি রিতীমত ছোট খাটো যম থেকে বেশ বড়সড় যমে রুপান্তরিত হলেন আমার কাছে…..এবং শেষ পর্যন্ত ব্যাপার টা বেতে গিয়ে ঠেকেছে আর তার সাথে সাথে আমার কপালে জুটেছে একটা গাধার উপাধি…… হাতের পিঠে বেতের নাচন ক্রমেই বাড়ছিলো দিনকে দিন……… উপায় না পেয়ে শুরু করলাম চোখ বুঝে অংক মুখস্থ করা….. যেনো তেনো মুখস্থ না পুরাই তোতাপাখি………. এই দূরাবস্থার কথা মাকেও জানাতে পারছিলাম না…….. সব শেষে দোষ গিয়ে পড়বে আমার ঘারে…..
,
,
,
সাদাফ ভাই আমাকে পড়াতে শুরু করার মাস খানেক পরেই স্কুলে পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলো…… সব পরীক্ষা ভালো দিলেও গনিত পরীক্ষায় যা মুখস্ত করে গিয়েছি তার থেকে শুধুমাত্র কমন পড়লো তেরো নাম্বার…… দেখাদেখির সুযোগ ও পাচ্ছিনা।।।।।। যা গার্ড দিচ্ছিলো….. উফফফফ….. আর বিজ্ঞান যে কি লিখেছি….. বেশ চিন্তায় ছিলাম স্যার না অজ্ঞান হয়ে যায়…….. এ তো গেলো খাতার খবর…….. পরীক্ষার অংক প্রশ্ন দেখেতো সাদাফ ভাই বেজায় খুশি…… একমাসে যতোটুকু করিয়েছেন তার থেকেই নাকি ৫৬% কমন পড়েছে……আমি তো সেদিন ওনার মুখে এই কথা শুনে তাজ্জব বনে গেলাম…….
,
,
——— এই তুলি ৯ নং কোশ্চেন টাতে কিন্তু নাম্বার পালটে দিয়েছে তুমি দেখে করেছো তো!!! প্রশ্ন টা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে…….
,
,
,
প্রশ্ন হাতে নিয়ে আমার অবস্থা হয়েছে” অভাগা যেদিকে চায় সাগর ও শুকিয়ে যায়” এর মতোন……কমন ই পড়েছিল তেরো নাম্বার……… এর মধ্যে বজ্জাত স্যার নাম্বার চেঞ্জ করে দিলো!!!! ১০ টা নাম্বারই গেলো!!! উফফফফ
,
,
——— কি হলো!!!
,
,
——— জ্বি স্যার…
,
,
,
০২
,
,
,
যথারিতি পরীক্ষার দুই সপ্তাহ পর থেকেই শুরু হলো খাতা দেখানো………… গ্রীষ্মের ছুটির জন্য সব খাতা একবারে একদিনেই দিয়ে দিলো……… সবগুলোর খাতার নাম্বার গুনে দেখলেও অংক আর বিজ্ঞান বাবাজীদের খাতা পেয়ে আমার অবস্থা নব বধুর মতো…….. খাতা পেয়ে যে ব্যাগে ভরেছি আর ভুলেও খুলে দেখিনি……
,
,
,
স্কুল থেকে গিয়ে কান্নাকাটি করে মাকে রেজাল্ট দেখালাম……….প্রথমে রাগারাগি করলেও আমার কান্নাকাটির তোরে মেনে নিলেন…… যতই হোক তার একমাত্র সন্তান আমি……. বাবাও ছিল দূর প্রবাশে……. বুকে জড়িয়ে বেশ বুঝালেন আর বললেন পরের বার যেনো এমন না হয়……সাদাফ ভাই তখন আমাকে সপ্তাহে পাঁচ দিন পড়াতেন…… শুক্রুবার সহ…….. রেজাল্ট জানানোর দিন কি এক ঝামেলার জন্য ওনি আসতে পারেন নি……. তাই মাকে ফোন দিয়েছিলেন জানালেন আর মা ও তাকে জানিয়ে দিলো রেজাল্টের কথা……. তাদের ফোনের কথা বলার সময় আমি সামনের সোফায় ই বসে ছিলাম….. পা নাড়িয়ে নাড়িয়ে নূপুরের আওয়াজ শুনছিলাম…….. কিন্তু মা যেই রেজালটের খবর টা দিলো আমার আত্নার পানি এমনেই উবে গিয়েছে……এদিকে রাতেই খবর এলো নানির পা পিছলে পরে কোমড়ের হার সরে গেছে……. মা কান্নাকাটি করে বাবাকে ফোন দিলেন…….. ঠিক হলো রিয়াদ নয়তো চাচা মাকে নিয়ে যাবেন………. আর আমি বাড়ি থাকবো সুফিয়া খালার সাথে….. সকালে মা চলে গেলেন…….. আমাকে আদর করে কপালে চুমু দিয়ে….. আর খালাকে বলে গেলেন আমি যা খেতে চাই তাই যেনো রান্না করে দেয়…… রাতেও যেনো তিনি আমার কাছে থাকেন…..
,
,
,
সেদিন আর স্কুলে যাই নি…….. মায়ের ফিরতে দুদিন…….. বিকেল চারটের দিকে সাদাফ ভাই পড়াতে এলেন….. মূলত উনি আসেন পাঁচটার দিকে……..আমাকে পড়িয়ে গিয়ে নাকি কোথাও যাবেন তাই জলদি আসা…… এসেই সবার আগে পড়লেন আমার রেজাল্ট নিয়ে……. আমি পড়ার টেবিলে না বসে দারিয়ে থেকেই ব্যাগ থেকে একটা একটা করে খাতা খুলে তার হাতেই দিচ্ছিলাম সব শেষে বিজ্ঞান আর অংক খাতা হাতে নিয়ে উনি থ হয়ে বসে আছে…… বার কয়েক খাতা ঘেটে দেখলেন……. প্রথমত মুখ না খোলার কারনে বা হাতে পেন্সিল দিয়ে হাত চেপে ধরে বেশ কয়েকবার মোচড় দিলেন……… তার শত সহস্র প্রশ্নের তোপে আমার অংক মুখস্তের কাহিনি বলতে বাধ্য হলাম……তারপরের যেই মানুষ টা ছিলো সেটা আর যাই হোক সাফাদ ভাই ছিলো না……. ছিলো এক মানুষ খেকো হিংস্র জন্তু……………. ওনি বার বার বলছিলেন একবার না বুঝলে একশো বার বুঝাবো কেন আমি এসব করলাম…….. আমার চুপচাপ থাকাতে ওনার রাগে আরও ঘি পড়লো………. রোলার নিয়ে বেশ মারলেন………… হাতে, পিঠে, পায়ে……. এতো মার খেয়েও আমার চোখে কোন জল ছিলো না……. কি করবো….. কান্না আমার একদম আসে না…… শক্ত হয়ে দারিয়ে ছিলাম…….. মার যে একেবারে খাই নি তা না কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি সেদিনের মতো মার আমি আমার বাকি জীবনে খাই নি…… সাদাফ ভায়ের হাতের রোলার টা সেদিন পড়ার টেবিলের উপর ঢিল ছুড়ে ফেলে ওনি চলে গিয়েছিলেন………… এতো মার খেয়েও বাকা রোলার টার দিকে তাকিয়ে আমার কাওন রাগ হলো না……. উল্টো ভেতর থেকে একটাই কথা বাজছিলো……. সাদাফ ভাইয়ের কাছে আমার মাফ চাইতে হবে……. আমি ওনাকে মিথ্যা বলেছি…… মাফ চাইতে হবে……
,
,
,
চলবে….
এক_পশলা_বৃষ্টি_আর_সে
লেখনিতে: চৈত্র রায়