এক_পশলা_বৃষ্টি_আর_সে পর্ব_১৮
লেখনিতে: চৈত্র রায়
৩৫
,
,
,
কলেজ থেকে ফিরে এসে ফ্রেশ একটা গোছল দিলাম তারপর খেয়ে লম্বা একটা ঘুম…… বুধবার হওয়ায় মা আজ জলদি ফিরবেন…. বাবা ও নাকি রাতে ফিরে আসবেন গ্রাম থেকে….. সুফিয়া খালার সাথে কথা বলেই ঘুমাতে চলে গেলাম….. কেন যেনো সুফিয়া খালাকে দেখলে ফুলি খালার কথা ভীষণ রকমের মনে পড়ে…..ঘুম ভেঙে গেলো মায়ের ডাকে….. মাথায় কি সুন্দর করে হাত বুলিয়ে ডাকছেন….. এতে করে ঘুমটা যেন আরো চেপে ধরেছে….. কপালে চুমুর স্পর্শ পেতেই একটা চেনা অনুভূতি ঘুমকে ছাপিয়ে গেলো….. চোখ মেলে তাকাতেই দেখলাম আম্মু আমার মাথার কাছে বসে চুলে বিলি কেটে দিচ্ছেন….. মা তার পেছনেই দাড়ানো….. এবারো মা বেশ চিন্তিত….. কপালে চিন্তার ভাজটা স্পষ্ট একেবারে…..
,
,
,
কোনরকম ভনিতা ছাড়াই আম্মুকে সরাসরিই জানিয়ে দিলাম আমার পড়াশোনা শেষ করা অব্দি এখানেই থাকতে চাই….. আমার কথাটা আম্মুর খুব একটা পছন্দ হলো না….. এদিকে কথাটা বলার আগে ভীষণ রকমের টেনশনে ছিলাম মা এ নিয়ে কি বলেন….. বা আম্মুর সামনেই কোন ঝামেলা করে কি না….. কিন্তু না মা তেমন কিছুই বললেন না….. কেবল শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে সব কিছু মনোযোগ সহকারে শুনলেন…..
,
,
,
——— রাহেলা তুমি অন্তত কিছু বলো….. টুকিকে বোঝাও
,
,
——— আমি কি বলবো আপা….তুলি তার মা-বাবার কাছে থেকে লেখা পড়াটা শেষ করতে চাইছে….. বিয়ে দিয়েছি বলেই তো আর ঠেলে সরিয়ে দিতে পারি না….. হ্যা… যদি ওর আবদার টা অন্যায় হতো তাহলে আমি কিছুতেই মানতাম না….
,
,
——— টুকি তুই কি আমার বলা কথায় কষ্ট পেয়েছিস!!!
,
,
,
আমি জানতাম আম্মু এমন কিছুই ভাবতেন…..আম্মুর এই ভুল ধারণা টা ভাঙানো বড্ড জরুরি….. তাই আম্মুকে জড়িয়ে ধরেই একে একে বোঝালাম….. এও বললাম বিকেলে অন্যজায়গায় হাটতে না গিয়ে যেনো আমাকে দেখতে আসে রোজ….. তারপর জমিয়ে আড্ডা দেবো…..সেদিনকার মতন আম্মু মন খারাপ নিয়েই বাড়ি ফিরে গেলেন….. আম্মুর এই চলে যাওয়াটা যেনো আমার বুকে কাটা বিধাচ্ছে….. সূক্ষ্মতম চিনচিনে একটা ব্যাথা সারা শরীর জুড়ে বয়ে যাচ্ছে………আম্মু যাবার পর মা আমাকে নিয়ে একদম মুখোমুখি বসলেন….
,
,
,
——— তুলি!!কিছু কি হয়েছে?
,
,
——— না তো মা….
,
,
——— তুলি একটা কথা বলতো?? সাদাফ,আপা ওনারা মানুষ হিসেবে কেমন?
,
,
——— ওনারা মানুষ হিসেবে অসাধারণ বললেও ভুল হবে…. ওনারা অতি অসাধারণ…… এই অতি অসাধারণ মানুষ গুলোর মধ্যে তোমার এই অতি সাধারণ মেয়েটা বরাবরই নগন্য…… তাই কিছুটা সময় নিজেকে দিতে চাই….. পড়াশোনা শেষ করে…..
,
,
,
আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই মা বলতে শুরু করলেন….
,
,
——— তুই ঠিক আছিস তো মা!!!!
,
,
,
কেনো যেনো মায়ের এই সামান্য কথাটায় ভেতর থেকে কান্না দলা পাকিয়ে আসছে….. কিন্তু আমি কাদবো না… ঠোঁট কামড়ে একটু হেসেই মাকে জড়িয়ে ধরলাম….. এই জায়গাটা বড্ড প্রশান্তির…. বড্ড
,
,
,
এখন কলেজে যেতে একধরনের অস্বস্তি হয়….. রোজ শ্বশুর বাড়ি নামক বাড়িটার গেইটের সামনে দিয়ে রিক্সায় বসে আসি…… কখন না জানি আবার তার সামনে পড়তে হয়…..রোজই এই ভয়টা নিয়ে জায়গা টা পার করি…. তবে মানুষটার সাথে দেখা না হলেও আম্মু ঠিক ঠিক কলেজে চলে আসেন….. কখনো ক্লাস শুরু হবার আগে গেইটে দারিয়ে থাকেন তো কখনো কলেজ ছুটির পর….. সাথে করে বানিয়ে কিছু না কিছু নিয়ে তো আসবেই…… কেন জানি আম্মুকে দেখলে ওনার কথা বড্ড মনে হয়….. আম্মুর চেহারার সাথে খুব মিল যম ঠাকুর টার…. আচ্ছা ওনি কি আমাকে এভাবে মনে করে!!! এর মধ্যে আম্মু একদিন জিজ্ঞেস করে ফেললেন যে ওনার সাথে আমার কোন ঝগড়া হয়েছে কিনা!!! বা আমাকে বকেছে কিনা!!! আম্মুর কথা শুনে আমি দীর্ঘশ্বাস আড়াল করি ফের নতুন উদ্যমে মানুষ টাকে ভুল বাল মিথ্যে বুঝিয়ে দেই……
,
,
,
এইচএসসি পরীক্ষার আর মাস ছয়েক আছে….. এতোদিন কোন প্রাইভেটের প্রয়োজন পড়েনি….. কারণ যম ঠাকুর একাই একশো…… কিন্তু এখন তো….. থাক সেসব কথা বাদের খাতায়…….. এদিকে কলেজ তারউপর দুই দুইটা প্রাইভেট করে সন্ধ্যা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরি…… তারপর রাতের পড়াশোনা তো আছেই……. ওনার সেদিনের বলা কথাগুলো একেবারে ফুয়েলের মতন কাজ করে….. সারাদিনের ক্লান্তি যে কই যায় টেরই পাই না…… আজকাল মাকে দেখি…… কেন যেনো মাকে দেখলে বড্ড শান্তি পাই….. একটা সময় মায়ের এই চাকরি নিয়ে আমার শত অভিযোগ ছিলো…… আমাকে ঠিক মতন করে সময় দিতে পারতো না…. টিফিন টাইমে স্কুলে টিফিন নিয়ে যেতো না….. দুপুরে ভাত মাখিয়ে খাইয়ে ও দিতে পারতো না……. একটা সময় তো এই অভিযোগ গুলো কে পাহাড় করে মায়ের কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়েই নিয়েছিলাম…. ফের নানি আসলেন…. খুব বুঝাতেন….
,
,
,
——— বইনগো মাইয়া মাইনসের অলংকার স্বোয়ামি হইলেও হাতের জোর হইছে সেই কাগজের টেহা আর সম্মান হইছে পেটের বিদ্যা….. এই দুইডা জিনিস থাকলে পিতিবির কোন বেডা নাই যে গালি দিয়া কতা কইবে….. মায়েরে ভুল বুইজো না বইন….. মায়ের জ্বালা ডা বুজবা একদিন….
,
,
,
নানির কথাটা ঠিকই ছিলো….. মায়ের জ্বালা টা ঠিকি বুঝলাম….. তখন ক্লাস এইটে পড়ি…. বাবার বাজারের গোডাউনে আগুন লেগে সব শেষ…… ছাই ছাড়া কিছুই নাই…. ক্যাশে বেশ নগদ টাকা ছিলো….. সেগুলো ও ছাই….. পরদিনের বাজারের টাকাটা পর্যন্ত নাই।।।।। তার পকেটে ছিলো মাত্র পঞ্চাশ টাকা….. সেই তখন মা এই সংসারের হাল ধরেন….. তার প্রতিমাসে জমিয়ে রাখা বেতন দিয়ে বাবাকে বিদেশ পাঠান….. বাবার বিদেশ যাবার দিন খুব কেদেছিলেন মায়ের হাত ধরে…… কারণ এই চাকরির জন্য মা আমাকে সময় দিতেন না খুব একটা….. সেই নিয়ে খুব বকাবকি করতেন……. আজ বুঝতে পারছি সেইদিনের মায়ের মুখের প্রশান্তির চিলতে হাসিটা…..
,
,
,
৩৬
,
,
,
যত দিন যেতে লাগলো ততই ওনার সেদিনের বলা কথা গুলো আমার কাছে সহজ হতে লাগলো….. কোন রাগ অভিযোগ কিছুই জমাতে পারিনি দূরে সরে এসে….. বরং বারবার মনে এইটাই আসছিলো ওনার এই তেতো কথাগুলিই আমার জীবনের মঙলস্বরূপ…… বাবাকে এখনো কিছুই জানানো হয় নি….. মা হয়তো কিছু বলেছেন….. এদিকে আমার জীবনের গল্পের রচিয়তরা ফের সুযোগ পেলেন নতুন কিছু সমালোচনার…… এইবার শোনা গেলো ———
,
,
,
——— জানা আছে এই পিরিতের বিয়া কয়দিন টেকবে….. পনেরো দিন ধইরা পইড়া রইছে জামাই তো একবার চুপিও দিলো না….. দুইদিনের প্রেমে তিনদিনের সংসার…..
,
,
,
তাদের এইসব কথা শুনে আমি হাসি…. তার সাথে সাথে চোখ গুলা ও বারবার ভিজে আসে…. আর বারবার মনে আওড়াই….. মেয়ে তুমি নারী….. আর জীবন তুমার ছলনাময়ী……
,
,
,
ঊনিশ দিনের মাথায় ওনি এলেন…… বাবার সাথে ওনার সরাসরিই কথা হলো….. কোন ভনিতা ছাড়াই আমাকে বলা প্রত্যেকটা অপমানজনক কথাগুলো পাই টু পাই বলে দিলেন…. জবাবে বাবার গর্জন আর হুংকার…….
,
,
,
——— তুমি আমার মেয়েকে খাবার খোটা দিয়েছো…… আমার এতো টাকা পয়সা, বিষয় সম্পত্তি….. এ-সব কার তুমি জান!!!
,
,
——— আপনার টাকা-পয়সা, বিষয় – সম্পত্তি…. নিতান্তই আপনার….. আপনার মেয়ে আমার স্ত্রী ওসব তুলির নয়….
,
,
——— আমার একমাত্র সন্তান তুলি…. আমার যা আছে সব ওরই…… অন্তত খাওয়া পড়ার কোন কমতি হবে না ওতে….
,
,
——— খাওয়া পড়ার কমতি আমার ইনকামেও আপনার মেয়ের হবে না…. বাবা….. আমি চাইনা তুলি তার স্বামীর রোজগার আর তার বাবার সম্পত্তির উপর নির্ভরশীল হোক….তার দায়িত্ব তার নিজের নিতে হবে….
,
,
——— এ কেমন কথা!!! তার দায়িত্ব যদি তার নিজের ই নিতে হবে তাহলে তাকে আমি বিয়ে দিয়েছি কেন!!!
,
,
——— শুধুমাত্র কি এই ভরনপোষণ এর জন্য ওকে আমার হাতে দিয়েছেন বাবা!!! আমার জানামতে তো আপনার কোন কিছুরই কমতি নেই!!! শুধুমাত্র খেয়ে বাচাই ওর জীবনের লক্ষ্য!!! আমি তো ওকে আমার বাড়ির কাজের লোক হিসেবে নেই নি…. নিয়েছি আমার স্ত্রী করে…. আমার অর্ধাঙ্গিনী করে…. আমি একা খেটে টাকা রোজগার করবো আর দিনশেষে চড়া মেজাজে মা-বাপ তুলে গালাগাল করবো….. পয়সার খোটা দিবো তা নিশ্চয় আপনাদের মেয়ের ভালো লাগবে না…….. তার প্রতিষ্ঠিত হতে যত যাই লাগোক আমি নিঃসন্দেহে করবো…..
,
,
——— কিন্তু সাদাফ তুমি ওকে বুঝাতে পারতে….. ওকে ভালো মন্দটা খুলে বলতে পারতে…..
,
,
——— মা তুলির সাথে আমার বিয়ে হয়েছে সবেমাত্র আড়াইমাস….. কিন্তু তুলিকে আমি জানি প্রায় পাঁচ বছর হতে চললো….. ওর ওসব ছেলেমানুষীর কাছে সাধারণ বুঝানো হাওয়ায় বাতাসের মতন…. তাই এইবার কঠোর হয়েছি….. এই ছেলেমানুষী কতোদিন মা…. তার তো নিজেকে নিয়ে ভাবতে হবে নাকি!!! যতই থাকুক নিজের বলে একটা কথা আছে…..আপনারা দয়া করে আমায় ভুল বুঝবেন না…..
,
,
,
বাসায় যখন ঢুকলাম তখনো জানি না ওনার উপস্থির কথা….. খাটের উপর আমার বইখাতা ছড়ানো ছিটানো ছিলো…. কিন্তু এখন কোনকিছুই দেখছি না….. তার সাথে টেবিল টাও গোছানো নিশ্চিত সুফিয়া খালার কাজ ভেবে মাথা চড়ে গেলো….যেই ডাকতে যাবো খালাকে অমনি দেখি যম ঠাকুর বাথরুম থেকে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বের হচ্ছেন…… আমি তখনো আমার রুমের দরজায় দাঁড়ানো…. ওনি আমাকে দেখে…. তোয়ালেটা চেয়ারের হেলানো অংশে মেলে দিয়ে…. গ্লাসে পানি নিয়ে বিছানায় বসলেন…..
,
,
,
——— দাড়িয়ে আছো কেন!!! নিজের রুমে ঢুকতে নিশ্চয়ই আমার অনুমতি চাইছো না………
,
,
,
চলবে