এক_পশলা_বৃষ্টি_আর_সে পর্ব_০৮
লেখনিতে: চৈত্র রায়
১৫
,
,
,
বিয়ে টা হয়ে গেলো……. মা-বাবা কে ছেড়ে বাপেরবড়ির পাট চুকিয়ে বউ হয়ে এই বাড়িতে এলাম…… বউ….. আমি বউ….. আমার পাশের দারিয়ে থাকা মানুষটার সহধর্মিণী…… আর চৌকাঠের ওপারে দারিয়ে থাকা মানুষ গুলো আমার বিবাহ সূত্রে পাওয়া নতুন স্বজন…….. প্রতিটা মানুষের সাথে আলাদা আলাদা সম্পর্কে বাধা পড়ে গেছি আজ এই তিন শব্দের কবুল উচ্চারণের সাথে সাথে…… কি অদ্ভুত মানব জীবন…… গতকাল ও ওরা আমার শুধুমাত্র পরিচিত ছাড়া কেউ ছিলো না…… কাধে কোন দায়িত্ব ছিলো না….. নিজেকে অন্যের কাছে ভালো রাখার কোন চেষ্টা ছিলো না…… কারো ঘরের বউ ছিলাম না…… একটাই পরিচয় ছিলো আমি আমার মা-বাবার সন্তান……. কিন্তু আজ সেই সব সম্পর্ক ছাপিয়ে গেলো এই নতুন সম্পর্কের কাছে…… হায়রে মেয়ে মানুষ…… কতো রঙিন জীবন…… ভ্যাগিস মেয়ে হয়ে জন্মালাম…. নইলে তো মেয়েদের রঙের দুনিয়ার আফসোস থেকে যেতো……
,
,
,
বেশ তোড়জোড় করেই আমাকে বরণ করা হলো…… এবং সদর দরজায় ই জানিয়ে দেওয়া হলো আমি যেন যম ঠাকুরের মাকে আম্মু বলে ডাকি…… তার সাথে সাথে ওনার বড় বোন, ভাবি ছোট্ট বাচ্চা টা পর্যন্ত আমায় বলে দিচ্ছেন তাদের আমি কি বলে ডাকবো…… বরণ শেষ করে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলো……. তাদের পক্ষের খুব একটা আত্নীয় স্বজন ছিলো না…… মেয়ের বাড়ি কাছে হওয়ায় বেশির ভাগ ই বিয়ে এটেন্ড করে চলে গেছেন….. বাকি যারা আছেন তাদের মধ্যে বেশির ভাগই যম ঠাকুরের বন্ধু বান্ধব আর কলিগ…. কলিগ বলতে সবই হচ্ছে কলেজের স্যার….. ওনি তো আর নতুন চাকরি তে এখনো জয়েন করেনি….. বাদবাকি সবাই মুরুব্বি গোছের……
,
,
,
বরণের পালা চুকিয়ে আম্মু আর বড় আপু আমাকে তাদের ড্রয়িং রুমে নিয়ে বসালেন…… আমাকে প্রায় মাঝখানে বসিয়ে তারা সবাই খোশ গল্পে মেতে উঠলো…… অনেকেই পরিচিত হচ্ছেন….. হাতে উপহার দিচ্ছেন…… যম ঠাকুরের কলিগ মানে যাদের আমি এতো দিন স্যার বলে ডেকে এসেছি তারা আমাকে একেকজন ভাবি বলে ডাকছেন আর হাসছেন….. এদিকে লজ্জায় আমি পারিনা মাটির ভেতর ঢুকে যাই……একজন স্যার তো বলেই দিলেন এখন আর তুলিকে কিছু বলা যাবে না….. আফটার অল সাদাফ স্যারের বউ বলে কথা…… কেন যেনো এই কথাটা বার বার মাথায় খেলছিলো….. সাদাফ স্যারের বউ….. আম্মু আর মেঝভাবি আমাকে আর সেখানে বেশি সময় রাখলেন না…..
,
,
,
তবে সেদিন সন্ধ্যায় আমি যেই সাদাফ নামের মানুষ টা কে দেখেছিলাম সে আমার এতো দিনের দেখা মানুষ টা থেকে ছিলো সম্পূর্ণ আলাদা…… এতো হাস্যোজ্জ্বল….. প্রাণোচ্ছল আমি আগে কখনো ওনাকে দেখি নি….. ওনার বন্ধুরা যখন আমার সাথে আড্ডা দেবার জন্য ভেতর রুমে এলেন তখন মেঝো ভাবি গিয়ে যম ঠাকুরকে ডেকে আনলেন…… ওনাকে রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন নাও ভাই তোমার বউ পাহাড়া দাও আমার একটু কাজ আছে আম্মা ডাকছে….. বলেই ভাবি চলে গেলেন….. এতো গুলো ছেলে মানুষের মাঝে বেশ আনইজি ফিল করছিলাম…… ওনি আমার পাশে এসে বসতে নিলেই ওনার এক বন্ধু ওনাকে টেনে উঠিয়ে দিলেন…..
,
,
,
———- এই তুই সর তো….. এতো দিন তো আশে পাশে বসেই পড়িয়েছিস…… বাকি জীবন ও বসবি….. এখন সর….. আমরা একটু বসি…..
,
,
——— বললেই হলো…… পাশের জায়গা আমি ছাড়ছি না….. এতোদিনের কোলে পিঠে করে মানুষ করা বউ আমার….. তোরা বললি আর আমি জায়গা ছেড়ে দিলাম….এতোই যখন পাশে বসার শখ তাহলে বিয়ে করে নিজের বউয়ের পাশে গিয়ে বস….. আমার বউয়ের পাশে কি যা ভাগ…… সোফায় বসতে বসতে….
,
,
——— কম দুঃখে কি ভাবির পাশে বসতে বলছি….. ভাবির তো একটাও বোন নাই….
,
,
——— আমার শ্বশুর _শ্বাশুড়ি অনেক স্মার্ট বুঝলি….. অনেক সচেতন…… এক কাজ কর তুলির ফোপাত বোন আছে একটা ক্লাস ফাইবে পড়ে….. ছোট মানুষ নিজের মতন গড়ে পিঠে নিবি…
,
,
——— এখন আব্বা শুনার বয়স ভাই….. গড়ে পিঠে নেবার দিন শেষ……. তোর কপাল ভালো তুই ভাবিরে পাইছিস….. তবে ভাবি আপনার মা_ বাবা কিন্তু আমাদের সাথে অনেক বড় নাইনসাফি করেছে……
,
,
,
ওনাদের এক একটা কথা শুনে আমি শুধু বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছি….. মেঝ ভাবি, বড় আপু এখনো কেনো এদিকে আসছেন না….. এদিকে সবাই এমন সব কথা বলছে যে খুব লজ্জা পাচ্ছি…… যম ঠাকুর তো দিব্যি আয়েশ করে বসেছে….. আমার পেছনের ব্যাক কুশনের উপর হাত মেলিয়ে…… কি হাসি তার মুখে….. অথচ এতো দিন….. হাতে গুনে গুনে হিসেব করে হাসতেন…… কি গম্ভীর তার ভাবমূর্তি….. অথচ এই মানুষ টা যে এতো রসিক আজ না দেখলে জানতাম ই না।।অবশেষে বড় আপু এসে আমাকে নিয়ে গেলেন…….
,
,
,
হাতের কব্জিতে বেশ ব্যাথা করছে….. তখন সাজানোর সময় গয়না গুলো পড়াতে গিয়ে ক্যানেলাতে লেগেছিল……. পরে অবশ্য ক্যানেলা খুলেই গয়না পড়িয়ে দিয়েছিলো……. আম্মু নিজে বসে থেকে আমি ফ্রেশ হয়ে আসার পর মাছ ভাজি দিয়ে সাদা ভাত খাইয়ে দিয়েছেন……. মেডিসিন গুলো এখনো নেওয়া হয় নি….. কোন ব্যাগে ভরে দিয়েছে খুজে পাচ্ছি না….. তবে খাবার পেটে পড়ার পর পর ই গা গুলাচ্ছে….. পাতলা পায়খানা বন্ধ হয়ে এখন আবার এই উপদ্রব শুরু হয়েছে….. উফফফ আর ভাল্লাগে না……. এখানে এখন বমি করে ভাসালে কি একটা অবস্থা হবে….. ধুর….
,
,
,
খাওয়ার পর মেঝো ভাবি আমাকে আম্মুর রুমেই রেডি করিয়ে দিলেন…… লাল টকটকে একটা সুতি টাঙ্গাইল শাড়ি…… কানে ছোট্ট দুল আর হাতে বিদেশি দুটো চুড়ি…… এগুলো পাঠিয়েছেন ওনার বড় ভাই মানে আমার বড় ভাসুর……. দুল গুলো দিয়েছেন মেঝো ভাবি আর বড় আপু দিয়েছেন একটা সিম্পল হাফ নেকলেস……. চুল বাধার সময় বড়ো আপু জিজ্ঞেস করলেন….. তুলি চুল খোপা করে দিবো নাকি বেণি!!!! আমি চুল বেধে ঘুমাতে পারি না বলেই বলে দিলাম খোপা করে দিতে পরে নাহয় খোপা খুলে বালিশে ছড়িয়ে দিয়ে ঘুমানো যাবে……আপু বেশ সুন্দর করে খোপা করে দিয়ে তাতে ফুল গুজে দিলেন……
,
,
,
১৬
,
,
,
আমাকে রাত দশটার দিকে যম ঠাকুরের রুমে নিয়ে যাওয়া হলো……… খাটে বসিয়ে দিয়েই দরজা ভেজিয়ে আপু আর ভাবি চলে গেলেন……. বাইরে থেকে বেশ হাসাহাসি শুনা যাচ্ছে……সবাই এক সাথে দল পাকিয়ে হাসছেন যেনো বড়সড় কোন জয়ের ঘোষণা দিচ্ছে টেলিভিশনে…… বেশ হাসতে হাসতেই ওনি রুমে ঢুকে দরজা লক করলেন………. আমি ততক্ষণে ঝিমুচ্ছি গালে হাত দিয়ে মাথায় ঘুমটা টেনে…… দরজা লকের আওয়াজ শুনে ঝিমনি কেটে গেলো……. ঘোমটার আড়াল থেকেই দেখলাম ওনি হাত ঘড়ি খুলে টেবিলে রাখছেন আর টেবিলে রাখার পানির গ্লাসেএ উপর থেকে ঢাকনা ফেলে ঢকঢক আওয়াজ করেই পানি টা শেষ করলেন……. আমি বিছানা থেকে নেমে ওনার সামনে গিয়ে দারালাম….. আমাকে ওনার কাছে আসতে দেখে আমার দিকে ফিরে দারালেন…… আমি ও আর সময় নষ্ট না করে ঝটপট সালাম করে নিলাম…….. চারদিন ধরে মুরুব্বীরা আমার মাথা ঠুকে ঠুকে এই কিথা বলে দিয়েছেন……
,
,
,
——— কি ব্যাপার সালাম তো করেছই….. ওখানে বসে আছো কেন!!! পা টিপে দেবে নাকি বলেই হাসতে লাগলেন…..
,
,
,
আমি আর কাল বিলম্ব না করে উঠে দারালাম…… ওনারা তো বলে দিয়েছিলেন সালাম করে বসে থাকতে বর নাকি ধরে ওঠাবে কিন্তু যম ঠাকুর তো কিছুই করলো না…….. আমার এতো ভাবনা চিন্তার মাঝখানেই ওনি ঘুমটা তুলে দিলেন…….
ওনার দিকে তাকাতেই আঙুল দিয়ে ইশারা করে বললেন ওয়াশরুম টা কিন্তু রুমের অইপাশে…… কথাটা শুনেই আমি মুখ কালো করে মাথা নিচু করে রাখলাম…..
চলবে…..