#এক_সমুদ্র_প্রেম!
কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(৬৫)
বাড়িতে উৎসব। চারপাশ মুখরিত। হৈচৈ বাঁধিয়ে ব্যস্ত সকলে। রান্নাঘর থেকে ছুটে আসছে, সুস্বাদু রান্নার ম ম ঘ্রাণ।
দেয়াল থেকে ও দেয়ালে বাড়ি খাচ্ছে একেকজনের উঁচু কণ্ঠ। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের দাপাদাপি নিরন্তর চলছে। সিকদার বাড়ির প্রত্যেকের কাঁধে তখন দায়িত্বের প্রখর চাপ।
মাঝখানে গত হয়েছে নয় মাস। চৌকাঠ ছুঁয়েছে,পূর্নবার বসন্ত। মৃতপ্রায় বৃক্ষের নগ্ন ডালে তখন সবুজ কচি পাতার রূপ নব নব বেশ বদলেছে প্রকৃতির। ধুয়ে মুছে,মুখ লুকিয়েছে জীর্ণতা সকল। শীতের রুক্ষতা তখন উৎখাত। শুকনো মাটির বুক ফুঁড়ে উঁকি দিয়েছে নরম ঘাসের অনন্য আশীর্বাদ।
এমন চমৎকার একটি সময়ে ধার্য্য হলো সাদিফ-মারিয়ার আংটিবদলের দিন-ক্ষণ। আর সেই নিয়েই একেকজনের উৎকণ্ঠা,উত্তেজনার অন্ত নেই।
ইকবাল ঘাম মুছতে মুছতে রুমে ঢুকল। বিছানায় বসা পুষ্পকে দেখে বলল,
‘ এ কী মাই লাভ! এখনও তৈরী হওনি কেন? একটু পরেই তো অনুষ্ঠান শুরু হবে।’
এত আনন্দের মাঝেও পুষ্পর মলিন আনন তার নজর কাড়ল। নিরুত্তর স্ত্রীর পাশে বসল এসে। কণ্ঠ মোলায়েম,
‘ কী হয়েছে?’
পুষ্প চিন্তিত গলায় বলল,
‘ বাবু সকাল থেকে কয়েকবার পটি করেছে ইকবাল। ওর কী শরীর খারাপ হলো? আমি তো তেমন কিছু খাইওনি।’
ইকবাল বিছানার দিক ফেরে। কাঁথার মধ্যে হাত-পা ছু*ড়ছে ওদের দু মাসের ছেলে,ইশরাক আহসান পূর্ব। ও তাকাতেই বাচ্চাটা একটু কাৎ হয়ে এলো৷ নিরবে জানাল বাবার কোলে ওঠার বায়না।
ইকবাল হাসল, পরক্ষনে হতাশ শ্বাস ফেলল। বাবু হওয়ার পর পুষ্প আগের মতো থাকতে পারছে না। রাতে ঘুম হয়না,ছেলে বারবার ওঠে। পছন্দ মাফিক কিচ্ছু খেতে পারেনা। স্ট্রিটফুডের জন্য মরিয়া মেয়ে,ওসব ছুঁয়েও দেখেনা এখন। ঝাল-মশলা তো জীবন থেকেই বাদ। আর ডেলিভারির সময়! কী যন্ত্রনা! ব্যথা*তুর চিৎকার! মনে পড়লেও আৎকে ওঠে ও।
এসব দেখলে ক*ষ্ট হয় ইকবালের! খারাপ লাগে! মনে মনে মায়ের প্রতি অপরিমেয় শ্রদ্ধা,ভক্তি,পর্বতের ন্যায় মাথা উঁচায়! একটা সন্তানকে জন্ম দেওয়া থেকে শুরু করে, তাকে বড় করা অবধি মায়েদের যেই শ্রম,যেই তিতিক্ষা,তার অল্প অল্প স্বচক্ষে দেখছে। পুষ্পর মাধ্যমে আঁচ পাচ্ছে সবটার। অথচ কিছু ছেলেমেয়ে বড় হলে, এই বাবা মাকেই ফেলে রাখে অবহেলায়,অবজ্ঞায়।
ইকবাল দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পুষ্পর হাতের ওপর হাত রেখে বলল,
‘ এখন তৈরী হয়ে নাও। আমি ওর কাছে আছি। ‘
‘ তুমি পারবেনা। ‘
‘ পারব না কেন? কতবার করলাম!’
‘ থাক। তুমি যাও,আমি থাকি। ‘
পুষ্পর মাতৃসুলভ চেহারার দিক চেয়ে রইল ইকবাল। বাবু হওয়ার পর ওর স্বাস্থ্য কিছুটা বেড়েছে। আগের মতো হ্যাংলা-পাতলা লাগেনা। বরং গাল টেনে দেওয়ার মত কিউট দেখায়! ইকবালের ইচ্ছে করে,ওই ফোলা গাল চুমু খেয়ে ঝাঁঝড়া বানিয়ে দিতে।
পুষ্পর শুকনো মুখখানা ভালো লাগছেনা ওর। দুষ্টুমি করে বলল,
‘ এত ভেবোনা মাই লাভ৷ আসলে ও শোধ নিচ্ছে। বিয়ের আগে ওর বাবাকে নাকানি-চুবানি খাইয়েছিলে তো,সবটা পুষিয়ে নিচ্ছে আমার ছেলে।’
তারপর ছেলের দিক চেয়ে বলল,’ সাবাশ বাবা! বাপ কা বেটা!’
পুষ্প কপাল কুঁচকে বলল,
‘ তুমি কি কখনওই সিরিয়াস হওনা ইকবাল?’
ইকবাল মস্তক ঝাঁকিয়ে স্বীকারোক্তি দিলো,
‘ হয়েছিলাম মাই লাভ! সাদিফ বাবুর সঙ্গে তোমার বিয়ের কথা ওঠার সময়? জীবনে প্রথম সিরিয়াস হয়েছিলাম। এই যে এখানে(গলা দেখিয়ে) এখানে এসে কলিজাটা বাদুড়ের মত ঝুলে ছিল। আর দ্বিতীয় বার সিরিয়াস হয়েছিলাম,ধূসরের একটা বিশ্রী কান্ডে। ‘
পুষ্প আগ্রহভরে শুধাল,
‘ ভাইয়া আবার কী করেছিলেন?’
‘ সেটা তোমাকে বলা যাবেনা। সিক্রেট!’
মনে মনে ভাবল,
‘ বললে ধূসর তো ঘুষি মেরেছিল,তুমি যে কী দিয়ে মারবে কে জানে!’
ওদের কথার মধ্যেই নুড়ি দুরন্ত কদমে ঘরে ঢুকল। পড়নে জমকালো বার্বি ফ্রক। দুপাশের ঝুটি দুটো দুলছে। ঝড়ের গতিতে বিছানায় উঠল সে। গুলুমুলু পূর্বর গালে এলোপাথাড়ি চুমু বসাল। প্রকোপে বাচ্চাটার গাল বেঁকে আসে, ছটফটিয়ে ওঠে। ইকবাল বলল,
‘ আরে আস্তে আস্তে… ‘
নুড়ি শুনল, মানল না৷ আবদার করল,
‘ ওকে একটু আমার কোলে দাওনা। আমি ওকে ঘুরতে নিয়ে যাই?’
পুষ্প স্বামীর দিক চাইল। নুড়ি নিজেই হাঁটতে গেলে উলটে পরে। এত ছোট বাচ্চা দেওয়া ঠিক হবে? ইকবাল মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘ এখন না আপু,আরেকটু বড় হোক। তখন শুধু কোলে নয়,তুমি ওকে সাথে নিয়ে ঘুমিও।’
নুড়ি খুশি হয়ে বলল , ‘ আচ্ছা।’
নুড়ি পূর্বের মাথার কাছের ঝুনঝুনিটা তুলে ওর সামনে বাজাল কয়েকবার। ছোট ছোট আঙুলের মধ্যে হাত ভরে কথা বলতে থাকল।
পুষ্প উঠে দাঁড়ায়। ফিডারের দুধ কব্জির উলটো পিঠে ঢেলে উষ্ণতা পরীক্ষা করে। পূর্বের কাছে বসতে গেলেই, ইকবাল বলল,
‘ কী হলো? যেতে বললাম না তোমাকে?’
পুষ্প বলতে গেল,
‘ বাবুর..
এর মধ্যেই বাইরে থেকে কাশির শব্দ শোনা যায়। কথা থামল পুষ্পর। মুমতাহিনা ঘরে ঢুকলেন। অনুষ্ঠান উপলক্ষে, স্বপরিবার, আজ সকালেই এসেছেন এখানে।
ভেতরে এসেই বললেন,
‘ কী ব্যাপার? তুমি এখনও এখানে? পিউতো তোমার জন্যে বসে আছে। রেডি হওনি কেন?’
‘ বাবুকে দুধটা খাইয়েই যাচ্ছি মা।’
‘ তোমাকে খাওয়াতে হবেনা,আমি খাওয়াচ্ছি। তুমি যাও।’
আর আজকে দাদুভাইকে আমি দেখছি। তোমার ভাইয়ের বিয়ের প্রোগ্রাম,কোথায় মজা করবে,তা না। দেখি ওঠো..’
পুষ্প সরে এলে, মুমতাহিনা বসলেন সেখানে। পূর্ব চোখ উলটে তাকাল। দুহাতের কুটিকুটি আঙুল মুখে পুড়ল। হাত পায়ের চঞ্চলতা বাড়ল একটু। ক’মাসে দাদুকে সে খুব চিনেছে।
মুমতাহিনা হেসে হেসে, স্বর আদুরে করে ডাকলেন,
‘ দাদুভাই! দাদুভাই এখন কী খাবে?’
পূর্ব হাসল। দন্ত বিহীন রাঙা মাড়ি উঁকি দিলো ভেতর থেকে । দুপায়ের ওপর বালিশ রেখে ওকে শোয়ালেন তিনি। দোলাতে দোলাতে ফিডার মুখে দিলেন। নুড়ি বসে রইল পাশে। দুজন মিলে কত কথা বলছেন! পূর্ব হু হা করছে। ঠোঁট উঁচু হচ্ছে ক্রমে। যেন সব বোঝে!
পুষ্পর ঠোঁট ভরে উঠল হাসিতে। উবে গেল দুশ্চিন্তা। পূর্ব হওয়ার পর মুমতাহিনাই ওকে বেশি রাখেন। রাতে খাওয়ানো না পড়লে হয়ত রাতেও রাখতেন। শ্বশুর -শাশুড়ি দুজনেই নাতি অন্ত প্রাণ।
পুষ্প তৈরি হবে ভাবল। আগে-ভাগে বের করে রাখা শাড়ি, ব্লাউজ হাতে তুলতেই পাশে এসে দাঁড়াল ইকবাল।
একবার সতর্ক ভাবে মা আর বোনকে পরোখ করে মুখ এগোলো ওর কানের নিকট। আলগা,নীচু কন্ঠে বলল,
‘ অল্প সেজো মাই লাভ! বেশি সুন্দর যেন লাগেনা।’
পুষ্প শুধাল,
‘ কেন?’
ইকবালের কণ্ঠ আরো নীচু হয়,
‘ এমনিতেই আমার বউ সুন্দরী! তার ওপর সেজেগুজে পরী হয়ে গেলে, আমি তো কন্ট্রোল রাখতে পারবনা। শেষে দেখা গেল, দু মাসের মাথায় পূর্বর আরেকটা ভাগীদার চলে আসছে।’
পুষ্প হা করে ফেলল। শ্বাশুড়ির দিক চাইল ত্রস্ত। তিনি ব্যস্ত নাতীকে নিয়ে। ওমনি ইকবালের বাহুতে ঘুষি মা*রল।
‘ তুমি আর ভালো হলে না!’
ইকবাল সানন্দে স্বীকার করল,
‘ বান্দা তোমার প্রেমে বহুবার খারাপ হতে রাজি মাই লাভ। ‘
পুষ্প হেসে ওঠে। দুপাশে মাথা নেড়ে, প্রয়োজনীয় অবঢৌকন বুকে চেপে ঘর ছাড়ে।
ইকবাল দুষ্টু দুষ্টু হাসল। মাথা চুল্কাল। এতকাল শুনেছে,বিয়ের পর ভালোবাসা কমে। আর সন্তান হলে আকর্ষণ। কিন্তু কই? ওদেরটা যে বাড়ছে। দিনদিন গাঢ় থেকে প্রগাঢ় হচ্ছে। পুষ্পর দিকে এখনও একইরকম তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয় ওর। ইচ্ছে করে ওকে বুকের মধ্যে জাপটে বসে থাকতে।
আহ,কী মারাত্মক বউপ্রেমী সে! ভাবলেই,প্রতিবার নিজের প্রতি গর্বে বুকটা ফুলে ওঠে।
****
‘ তুই রেডি?’
পিউ ঘুরে চাইল। পরপর মুখ বেঁকিয়ে বলল,
‘ তো কী করব? কখন থেকে বসে ছিলাম!’
পুষ্প ঠোঁট উলটে বলল,
‘ বাবুর জন্য একটু দেরী হলো। কিন্তু তুইতো কিছুই সাজিসনি। শুধু জামা পরে ঘুরছিস।’
‘ আগে তোকে সাজাই,তারপর নিজে সাজব।’
পুষ্প বাকী সব বিছানায় রেখে, ব্লাউজ-পেটিকোট হাতে নিয়ে
বলল, ‘ আচ্ছা আমি এক্ষুনি পালটে আসছি।’
ঝটপট ঢুকল ওয়াশরুমে।
তড়িঘড়ি করে পরায় বের হলোও দ্রুত।
পিউ যত্ন করে ওকে শাড়ি পরাল। পুষ্প নিজেই পারে,কিন্তু সিজারের পর তাকে নীচু হতে দেওয়া হয়না। কুচি ঠিকঠাক করার মত পরিশ্রম তো একেবারেই না। পুষ্প মেক-আপে ভালো! নিজেই টুকিটাকি সাজল। চুলে খোপা করে গাঁজরা গুঁজে দিলো পিউ। সবশেষে বোনের দিক চেয়ে বলল,
‘ মাশ আল্লাহ! খুব সুন্দর লাগছে!’
পুষ্প আয়না দেখে নেয়। চেহারায় মেয়ে সুলভ ভাবটা এখন কম। বরং পরিনত নারী লাগে ওকে ! কেমন একটা মা মা ছাপ ফোটে।
নিজেকে দেখে মুগ্ধ হলো ও। পিউকে মাথা নাঁচিয়ে বলল,
‘ থ্যাংক ইউ! এবার নীচে যাই হ্যাঁ? তুই তাড়াতাড়ি আসিস। ‘
‘ তানহা এলে রুমে পাঠিয়ে দিস।’
পুষ্প যেতে যেতে জবাব দিলো, ‘ আচ্ছা।’
পিউ টুলে গিয়ে বসে। মনোযোগী হয় সাজগোজে। বাড়ির এই বিশাল আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে একটু সুন্দর লাগতে হবে না?
***
মারিয়া আর সাদিফের প্রেমের সূচনা হয়েছিল,ঠিক পিউ-ধূসরের বিয়ের দিন। একই নিবাসের, একটি নিস্তব্ধ কক্ষ,আর শূনশান ছাদ সাক্ষী হয়েছিল দুই জোড়া চড়ুইয়ের এক হওয়ার উপাখ্যানে।
সময় সময়ে তীব্র হলো একজনের সম্পর্ক। প্রেমিক যুগল, আর কপোত-কপোতীর ভালোবাসার কোলাহলে বিভোর তখন ধরিত্রী।
প্রথম যেদিন ওদের সম্পর্ক নিয়ে আজমল কথা তুললেন,এক মুহুর্তের জন্য মূর্তি বনে গেছিল সকলে। তব্দা খেয়ে চেয়েছিল অনেকক্ষণ। সাত তাড়াতাড়ি ধাতস্থ হওয়া কূলোয়নি সাধ্যে। তারপর সেই বিস্মিত দশাধিক দৃষ্টি ঝড়ের বেগে নিক্ষেপ হলো সাদিফের ওপর।
ভোলাভালা ছেলেটা অস্বস্তিতে কাঁটা তখন। চশমা ঠেলেঠুলে মাথা নুইয়ে রাখল।
তার মত অতিরিক্ত শিষ্ট,সব্য ছেলেটা প্রেম করে? নিজের জন্য মেয়েও ঠিক করে রেখেছে? সেই মেয়ে আবার মারিয়া? আশ্চর্য! এ অতি আশ্চর্য!
ওদের বিয়ে নিয়ে মতবিরোধের ছিটেফোঁটাও হয়নি। আজমল আর জবা তো আগে থেকেই রাজী। বাকীরাও বিনাবাক্যে মত দিলেন।
হৈহৈ করে উঠল পিউ-পুষ্প।
মারিয়ার সঙ্গে তাদের খাতির গলায় গলায় কী না!
সিকদার পরিবারের মুরুব্বিরা, প্রস্তাব নিয়ে রোজিনার দ্বারস্থ হলেন তারপর। ভদ্রমহিলা এসব আগে থেকেই জানতেন। মারিয়া কখনওই কোনও কিছু ওনার থেকে লুকোয়নি। বর্ষার মত তিনিও ওর সঙ্গে বন্ধুর মত মিশেছেন সব সময়। যে মেয়ে ক্লাশে খাতায়, স্যারের থেকে একটা গুড পেলেও এসে জানাত,সে এত বড় একটা সত্যি লুকোতে পারে?
এই সমন্ধ নিয়ে আপত্তি করার মত কারণ নেই। সাদিফ নিঃসন্দেহে উপযুক্ত পাত্র। বলা বাহুল্য, ওনাদের জন্য আকাশের চাঁদ! কোন মা চাইবেনা, মেয়ের বিয়ে অত বড় বাড়িতে না দিতে?
তিনিও এক বাক্যে রাজি হলেন। সেদিনই ধার্য্য হলো ওদের বিয়ের দিন। ফাল্গুন মাসের প্রথম সপ্তাহে আংটিবদল। তার কিছুদিন পরেই বিয়ে।
সব যখন ঠিকঠাক, মারিয়া তখন ভুগছে মানসিক টানাপোড়েনে। মায়ের চিন্তায় মুখ শুকিয়ে কাঠ!
বাবা নেই, ভাই নেই,মা একা। ও চলে গেলে আরো একা হয়ে যাবে। কে দেখবে তখন? মায়ের বয়স হচ্ছে,একটা কাউকে তো থাকা দরকার।
বিপত্তিতে পড়ল, সিকদার বাড়ি হুট করে প্রস্তাব আনায়। সাদিফটাও সারপ্রাইজ দেবে বলে কিচ্ছু জানায়নি। আর সে বুঝে ওঠার আগেই কথা পাকাপাকি শেষ!
মারিয়ার দোটানা আরো বাড়ে। বিয়ে ঠিক হওয়ার আনন্দে সাদিফ যখন হৈহৈ করে বেড়াত,সে চিন্তায় নিষ্পৃহ।
এইত সেদিনের কথা। মিলনায়তনের সেই টিএসসি চত্বরের বেঞ্চিতে বসে দুজন। প্রণয়ের পর অফিসের ছুটি শেষে এটা হয়ে উঠেছে ওদের দৈনিক রুটিন।
সাদিফের হাস্যজ্জল মুখবিবর তখনও বহাল। একটু বেশিই আজকাল চটপটে হয়েছে ছেলেটা। কিন্তু বরাবরের চঞ্চল মারিয়া চুপচাপ বসে। কথা,আলোচনা, প্রশ্ন সব কিছুর ফিরতি জবাব, ‘ হু। হ্যাঁ, আচ্ছা,ঠিক আছে।’
সাদিফের বেশিক্ষণ সহ্য হলো না এসব। শেষ মেষ অধৈর্য হয়ে বলল,
‘ হয়েছে কী আপনার? ‘
মারিয়া খানিক চমকে তাকায়,’ কই? কিছু নাতো।’
সাদিফ সাবধান করল,’ একদম মিথ্যে বলবেন না। এত কী নিয়ে ভাবছেন?
ওউ,যৌতুক নিয়ে? চ্যিল! যৌতুক নেওয়ার মত চিপ মেন্টালিটির ছেলে আমি নই। রিল্যাক্স ম্যালেরিয়া,আই যাস্ট নিড ইউ। আমার আপনি হলেই চলবে।’
পাব্লিক প্লেসে সাদিফের সাবলীল স্বীকারোক্তিতে ক্ষণিকের জন্য সব চিন্তা উবে গেল মারিয়ার। দু চোখ ভর্তি শীতলতা নিয়ে এক যোগে চেয়ে রইল সে।
‘ এভাবে তাকাবেন না,আপনি এভাবে তাকালে আই ফিল শাই….’
হেসে ফেলল মারিয়া। পরপর দীর্ঘশ্বাস টানল। কোলের ওপরে রাখা হস্তখানা চেপে ধরল সাদিফ। মোলায়েম কণ্ঠ,
‘ কী হয়েছে? আমাকে বলা যায়না? খুব পার্সোনাল কিছু? ‘
মারিয়া মাথা নোয়াল। মলিন কণ্ঠে বলল,
‘ আম্মুকে নিয়ে খুব চিন্তায় আছি। আমার বিয়ের পর কী হবে ওনার? আমি ছাড়া তার তো কেউ নেই। কোথায় গুলশান,আর কোথায় মহাখালী! এতটা দূরে আম্মুকে একা একা রেখে আমি শান্তিতে থাকব কী করে?’
সে যতটা উৎকণ্ঠিত হয়ে জানাল,সাদিফ ততোধিক নিশ্চিন্ত কণ্ঠে বলল,
‘ এই ব্যাপার? এই সামান্য বিষয় নিয়ে এত ভাবছেন? আরে বাবা,আন্টি একা থাকবে কেন? আপনার সাথে আমাদের বাড়িতে থাকবে। সবাই মিলে একসাথে থাকার আনন্দই আলাদা।’
মারিয়া বিরস হেসে বলল, ‘ তা হয় না। মেয়ের শ্বশুর বাড়ি গিয়ে থাকতে কোনও বাবা-মা চাননা সাদিফ। সম্মান যে বড় নিখাদ বস্তু! কূয়োয় পড়লে আর তোলা যায়না তাকে। আসলে,বিয়ের পর যদি চাকরিটা করতে পারতাম,তাহলেও একটা…. ‘
সাদিফ কথার মধ্যেই বলল,
‘ করতে পারতেন মানে? আপনাকে চাকরি করতে কেউ বারণ করেছে?’
মারিয়া অবাক চোখে চাইল। কণ্ঠ শৃঙ্গে তুলে বলল,
‘ বিয়ের পর আমাকে চাকরি করতে দেবেন আপনি?’
সাদিফ কাঁধ উঁচায়,
‘ চাইলে করবেন। না চাইলে না। এসব আপনার সিদ্ধান্ত। আমি বলার কে?’
মারিয়া অবিশ্বাস্য নজরে চেয়ে রইল। পরপর শুধাল,
‘ আর আপনার বাড়ির লোক? আঙ্কেল,আন্টি? ওনারা কিছু বলবেন না?’
সাদিফ আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘ ওনারা কী বলবে? আমাদের পরিবার সেকেলে নয়,যথেষ্ট আধুনিক। ছেলের বউ মানে,ঘরের কাজ করার মেশিন,এরকম চিন্তাভাবনা কারোর মধ্যেই নেই। মা,বড়মা,মেজ মা এরা চাকরি-বাকরি করেনি এটা সম্পূর্ণ ওনাদের ইচ্ছে। ছোট মা কিন্তু চাকরি করতেন। রিক্ত হওয়ার পর ছেড়ে দিলেন। এখন আপনি যদি চান,আপনি চাকরি করবেন,তাহলে করবেন।
এ নিয়ে আমি বা আমার পরিবারের তরফ থেকে কোনও সমস্যা হবেনা কথা দিতে পারি। চাকরিটা যে শুধু মাত্র টাকা রোজগারের যন্ত্র তা কিন্তু নয়। আমি মনে করি পৃথিবীর সব মেয়ের উচিত সাবলম্বী হওয়া। বাবা,ভাই,স্বামী এদের ছত্রছায়ায় না থেকে নিজের একটা পরিচয় তৈরী করা। আর আমার স্ত্রী চেয়েও সেই পরিচিতি পাবেনা কেন?
মারিয়ার চোখ ভরে উঠল। জল ছাপানো অলীক মুগ্ধতা অক্ষিকোটরে। ভেজা কণ্ঠে বলল,
‘ আপনি এত ভালো কেন?’
সাদিফ মৃদূ হাসে। বৃদ্ধাঙ্গুলে ওর চোখ মুছিয়ে বলে,
‘ কারণ আপনি খুব খারাপ!’
অশ্রু সমেত হেসে ফেলল মারিয়া। যেই রূপখানা সাদিফের হৃদয়ে তুফান বইয়ে ছাড়ে। দুষ্টুমির চাউনী গভীর হলো তার। পেরেকের ন্যায় বসে গেল মারিয়ার মুখস্রীতে।
বাধ্য ছেলের, অবাধ্য মনে জেগে উঠল অনিবার্য এক বাসনা। মারিয়ার ফর্সা গাল দুটোতে ধুপধাপ ঠোঁট বসানোর ইচ্ছে।
পাশ থেকে সবেগে যাওয়া গাড়ির উঁচু সাইরেনের শব্দে হুশ ফিরল। টেনেটুনে সম্বিৎ এনে, মুখ ফেরাল আরেকদিক। নিজের এই বেহায়াপনায়, অস্বস্তিতে মাথা চুল্কাল।
হঠাৎ কী ভেবে, উদ্বেগ নিয়ে ফিরল আবার।
‘ আচ্ছা,আমাদের পাশের বিল্ডিং তো ভাড়া দেওয়া হয়। আন্টিকে ওখানকার একটা ফ্ল্যাটে তুললে কেমন হয়? তাহলে তো আন্টিও আপনার কাছাকাছি থাকবে,আর আপনিও নিশ্চিন্ত থাকলেন! ‘
মারিয়া চকচকে কণ্ঠে বলল, ‘ খুব ভালো হয়!’
সাদিফ তত্র উঠে দাঁড়াল, ‘ চলুন। ‘
‘ এখনই? ‘
‘ এক সপ্তাহ আগে টু-লেট দেখেছি। এখন পাব কী না কে জানে… চলুন চলুন…’
দুজন ব্যস্ত ভাবে উঠে বসে বাইকে। ছুটে যায় গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। সেদিন ভাগ্য প্রসন্ন থাকায়,ঘর পাওয়া গেল৷ সাদিফের বিশাল বাড়ির প্রাঙ্গন পার হলেই সেই বাড়িটা। চার তলার একটি দু কামড়ার ফ্ল্যাট ভাড়া নিলো মারিয়া। পরের মাসেই উঠল সেখানে। সাদিফের ভীষণ রকম সুবিধে হলো এতে। মারিয়াকে সঙ্গে করেই অফিসে যায়,নিয়ে আসে। চলে ইচ্ছেমতো ঘোরাঘুরি। বক্ষস্থলে তখন প্রেমের উচাটন। চক্ষু ভরা স্বপ্ন। এইত আর কটা দিন! তারপরেই পা রাখবে একটি হর্ষিত সংসারের দোরগোড়ায়।
****
পিউ সম্পূর্ন তৈরি হয়ে টুল ছেড়ে দাঁড়াল। ওড়নায় পিন লাগানোর মধ্যেই ঘরে ঢুকল ধূসর।
‘ পিউ আমার ঘড়ি..’
এদিক চাইতেই, কথা আটকাল ওর। কণ্ঠ শুনে পিউ ঘুরে তাকায়। তামাটে মুখটা দেখা মাত্রই, বিস্তর হাসি ফুটল ঠোঁটে।
ক’মাসে ধূসরের শারিরীক পরিবর্তন হয়েছে। ফর্সা হয়েছে কিছুটা। উন্নত স্বাস্থ্যের জোয়ার তো আছেই। আগের থেকেও সুন্দর লাগে দেখতে।অথচ রোগা-শোকা পিউয়ের কিচ্ছুটি হলো না। বিয়ের পর না মেয়েদের পরিবর্তন আসে? কিন্তু এক চুল নড়ল না ওর শরীর। না একটু চর্বি বাড়ল কোথাও। এত খায়,যায় কোথায় সব?
এখনও আগের মত ধূসর সামনে আসে যতবার,পিউ মন হারায় প্রতিবার। চোখে-মুখে ভিন্ন রকম মোহ লেপ্টে আসে।
এই যে এতগুলো মাস গড়াল ওদের সংসারের,কিচ্ছু পাল্টায়নি। পাল্টায়নি পিউয়ের মুগ্ধতার ধরণ,ধূসর ভাইকে চোখে হারানোর কারণ।
তবে মানুষটা বোধ হয় পাল্টেছে। বিয়ের আগের ধূসর ভাইটা গায়েব হয়েছে কোথাও। এই ধূসর ভাই নির্লজ্জ, পিউকে কাছে পাওয়ার জন্য মরিয়া। রাতে একটাবার ওপাশ ফিরতেও দেয়না। বুকে থাকবে মানে বুকেই।
অবশ্য ওই চওড়া বুক থেকে সরার ইচ্ছে ওর থাকলে তো! বরং জীবন-ভর ওখানেই আহুতি দিতে পারলেই বেশ হয়।
ধূসরের কপালে ভাঁজ। পিউ উচ্ছল কণ্ঠে শুধাল,
‘ কেমন লাগছে আমাকে?’
সে চোখ সরু করে বলল,
‘ ওড়না এভাবে পরেছিস কেন?’
গম্ভীর কণ্ঠে পিউয়ের হাসি মুছে গেল। একবার সতর্ক ভাবে নিজেকে দেখে বলল,
‘ জামায় তো অনেক কাজ,ভাবলাম…’
কথার মধ্যেই ধূসর এগিয়ে এলো। পিউয়ের ওপর থেকে, ফোমের বাক্স হতে পিন ওঠাল হাতে। নিজ উদ্যোগে এক পাশে ঝোলানো ওড়নাটা টেনে দুপাশে মেলে বলল,
‘ বাড়িতে অনেক ছেলে আসবে আজ। লাফালাফি কম করবি।’
পিউ মাথা কাঁত করল। সে বরাবরই ওর বাধ্য বউ।
ধূসর ওড়নায় পিন আটকে সরে আসে। তক্ষুণি পিউয়ের চোখ পড়ল ওর বুকের দিক। শার্টের তিনটে বোতাম খোলা। উন্মুখ শ্যামলা বক্ষপট।
‘ আমার ওড়না ঠিক করলেন? নিজেরটার এই অবস্থা কেন?’
ধূসর বুঝতে না পেরে নিজেকে দেখল। প্রশ্ন করার আগেই পিউ অধৈর্য হাতে শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলল,
‘ বাড়িতে শুধু ছেলেরাই আসছেনা,মেয়েরাও আসবে।’
ধূসর নিম্নাষ্ঠ কা*মড়ে ধরে। বরাবরের মত শব্দহীন হাসির স্লোগান তুলল পাতলা ঠোঁটে। আলগোছে পিউয়ের কোমড় চেপে ধরলে তাকাল ও। ধূসর ব্লাশন পরিহিত টুকটুকে গালে শব্দ করে চুমু খায়।
তবে আজকে আর পিউয়ের কাঁ*পুনি উঠল না। কুণ্ঠায় ভূমিক*ম্প নামল না হাঁটুতে। বরং, সে অভ্যস্ত এখন। এই নয় মাসে ধূসরের যখন তখন জ্বালা*তনের স্বীকার।
বিয়ের পর থেকেই, মানুষটা হুটহাট চুমু খায়। কথাবার্তা ছাড়াই ঠোঁট বসায় ত্বকে। পিউয়ের এই অভ্যাস আয়ত্ত, তবে ভালোবাসায় একইরকম অবিন্যস্ত সে।
কম্পন ছাড়াই, গাল দুটোতে লজ্জা ফুটল। পেল্লব হাত দুখানা উঠিয়ে ধূসরের গলা পেঁচিয়ে ধরল পিউ।
অনেকটা উঁচু হতে হলো তাতে। তার মত চুনোপুঁটির নিকট ধূসর ভাই পর্বতশৃঙ্গ কী না!
ধূসরের মদ্যক চাউনীতে দৃষ্টি রাখল পিউ। দুই জোড়া নিশ্চল অক্ষি এক হলো। ঠিক ওমন চেয়েই, জড়োতাহীন বলল,
‘ ভালোবাসি!’
ধূসরের ফিরতি জবাব এলো না। তবে কোমড়ে রাখা বাঁধনটা দৃঢ় হলো খানিক। পিউ অপেক্ষা করে। পরপর কপাল কুঁচকে বলল,
‘ কী হলো?’
‘ কী?’
‘ আমিতো ভালোবাসি বললাম।’
‘ শুনেছি।’
‘ শুনলে হবে? আপনি বলবেন না?’
‘ বলতে হবে কেন?’
পিউ ওমনি গলা থেকে হাত সরিয়ে বলল,
‘ হবেইত। আমার বুঝি শুনতে ইচ্ছে করেনা? আমিতো সারাক্ষণ ভালোবাসি ভালোবাসি বলে আপনার কান ঝালাপালা করে দেই। আর আপনি? নটা মাসে একবারও বললেন না,পিউ তোকে ভালোবাসি।
পরপর কণ্ঠ নরম করে বায়না ছু*ড়ল,
‘ বলুন না একবার!’
ধূসর বলল না। তার দৃষ্টি পিউয়ের লিপস্টিক পরা কোমল ঠোঁটে। মস্তক ঝুঁকিয়ে, নিশানা বরাবর স্বীয় ওষ্ঠপুট এগোতেই পিউ ওমনি মাথাটা পিছিয়ে নিলো।
‘ আগে ভালোবাসি বলুন।’
বিঘ্নতে ধূসর ভ্রু গোটাল। নিশব্দে আবার এগোতেই
পিউ হাত দিয়ে ঠোঁট ঢেকে ফেলল এবার। বলল,
‘ আজকে ভালোবাসি না বললে, চুমু খেতে দেব না।’
ধূসর মেঘমন্দ্র গম্ভীর স্বরে বলল,
‘ হাত সরা।’
পিউ ঘন ঘন মাথা নাড়ল। সরাবেনা হাত। আজকে ভালোবাসি শুনেই ছাড়বে।
ধূসর তপ্ত করল চোখ-মুখ। খেই হারিয়ে হাতটা নিজে সরাতে গেলেই, বাইরে থেকে পায়ের শব্দ আসে। কেউ আসছে এদিকে। শব্দে থামল ধূসর। পিউয়ের কোমড় ছেড়ে দিলে, ড্রেসিং টেবিলের কাঠে মিশে গেল সে।
ধূসর সরে এলো। চঞ্চল পায়ে ঢুকল তানহা৷ হাসি হাসি মুখ। অথচ ভেতরে ধূসরকে দেখেই একটু থতমত খেল৷ চৌকাঠে রাখা পা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে পড়ল। ফেরত যাবে,না ভেতরে আনবে ভেবে বেশামাল হলো। নার্ভাসনেস ঠেলেঠুলে, থেমে থেমে শুধাল,
‘ আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। ভালো আছেন?’
ধূসর সালামের উত্তর দিয়ে, শুধাল,
‘ হ্যাঁ। তুমি?’
‘ জি ভালো।’
ধূসর পিঠ ফিরিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়৷ ড্রয়ার থেকে ঘড়ি এনে কব্জিতে বাঁধল। আয়নায় চোখ বুলিয়ে চুল ওপরে ঠেলল। একবার চাইল খুব পাশে দাঁড়ানো পিউয়ের দিক। সে মেয়ের ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি। এই যে ধূসর হেরে গেল,চুমু খেতে পারল না, বেশ মজা লাগছে এতে। সেই ক্ষণে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময়, ধূসর কণ্ঠ খাদে এনে বলল ,
‘ এর শোধ রাতে তুলব।’
পিউয়ের হাসি শেষ। হৃদয় লাফাল সবেগে। তানহা শুনেছে কী না সেই ভ*য়ে,তড়াক করে দৃষ্টি ফেলল ওর ওপর। তানহার চোখ-মুখ স্বাভাবিক। সে এদিক ওদিক দেখছে। অপেক্ষা করছে ধূসর বের হলেই,কথার ঝুড়ি নিয়ে বসবে। পিউ স্বস্তির শ্বাস ফেলল। যাক, শোনেনি। কিন্তু এতকিছুতে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা রইল না ধূসরের। তর্জন দিয়ে নিজের মত বেরিয়ে গেল। পিউ আলগোছে ভেঙচি কা*টল। মনে মনে বলল,
‘ অনেক ছাড় দিয়েছি। আজ তো ভালোবাসি শুনেই দম ফেলব। নাহলে আমিও মিসেস ধূসর মাহতাব নই।’
ধূসর বেরিয়ে যেতেই তানহার উচ্ছলতা ফেরত এলো। ত্রস্ত ওর দিক এগিয়ে আসে। আপাদমস্তক দেখে বলে,
‘ কী সুন্দর লাগছে রে তোকে! আমাকে কেমন লাগছে?’
‘ তুইত সব সময়ই সুন্দর। তা এত দেরী করলি কেন আসতে?’
‘ যা জ্যাম রাস্তায়। আমিত ভাবলাম আসতে আসতে অনুষ্ঠানই শেষ। ‘
‘ মারিয়া আপুরা এসেছেন?’
‘ না। দেখলাম না তো। তবে ইফতিকে দেখেছি।’
বলেই দাঁত বার করে দিলো তানহা। পিউ মেকি দুঃখী কণ্ঠে বলল,
‘ দেখে কী লাভ? বেচারাকে তো পাত্তাই দিলিনা।’
তানহা হাসল। এসে বিছানায় বসল। পা দুটো নাড়াতে নাড়াতে বলল,
‘ না দিয়েই ভালো করেছি। তখন কষ্ট করে সিঙ্গেল ছিলাম দেখেই আজ একটা প্রিন্স চার্মিং পেয়েছি ভাই।’
‘ তাও কথা। তা ভাইয়ার কী খবর? বিয়ে টিয়ে কর,দাওয়াত খাই। ‘
‘ ভাইয়ার খবর ভালো। কিন্তু আমি ভ*য়ে আছি,আব্বু -আম্মুকে নিয়ে? মানবে তো ওনারা?’
‘ মানবেনা কেন? ইঞ্জিনিয়ার ছেলে তার ফেল্টুস মেয়ের জন্য পাচ্ছে, এটাইত খুশিতে মাথা ঠোকার মত বিষয়। ‘
তানহা শব্দ করে হেসে ওঠে। মাথা নাঁচিয়ে বলে,
‘ কথাটা সত্যি। আমার মত স্টুডেন্ট রাব্বির মতো একটা ব্রাইট স্টুডেন্টকে পটাতে পেরে, যুদ্ধ জয় করার মত ফিল পাচ্ছি।’
নীচ থেকে জোড়াল হৈচৈ এর শব্দ এলো তখন। তানহা উঠে দাঁড়াল। পিউ সচকিতে বলল,
‘মনে হয় এসে গেছে। চল,চল। ‘
এক ঝাঁক আত্মীয় স্বজন সমেত,চৌকাঠে এসে দাঁড়াল মারিয়া।
পড়নে সুতার কারুকাজের, সাদা ধবধবে লেহেঙ্গা ওর। খোপা করা চুলে পাথরের ক্লিপ বসানো। গলায় ভারি নেকলেস,দুহাতে শ্বেত পাথরের চুড়ি। যেন ভিন রাজ্য হতে আগত শুভ্র-সুন্দর রাজকুমারী। সে দাঁড়ানো মাত্র পুষ্প বর্ষণ নেমে এলো গায়ে। গোলাপ আর গাঁদার কুচি কুচি সজীব পাপড়ি ছিটিয়ে দিচ্ছে অনেকে। মারিয়ার চিবুক গলদেশে নামানো। লজ্জায় বুক কাঁপছে। নার্ভাস লাগছে প্রচন্ড। একবার সাদিফকে খোঁজার,ওকে দেখতে চাওয়ার প্রয়াস চলল মস্তিষ্কে। এত মানুষ ছাপিয়ে সাধ্য হলোনা নয়ন তোলার। দাঁড়িয়ে রইল ওমন,পুতুলের ন্যায়।
পিউ হৃষ্ট চিত্তে বলল,
‘ কী সুন্দর লাগছে রে আপুকে!’
তানহা কনুই দিয়ে খোঁচা মেরে বলল,
‘ এই এই সাদিফ ভাইকে দ্যাখ…’
পিউ তৎপর চাইল সেদিক। পাথর বনে দাঁড়িয়ে সাদিফ। পুরু, র*ক্তাভ ওষ্ঠযূগল আলাদা হয়ে বসে। স্থির,নিশ্চল অক্ষিপট একভাবে, মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় চেয়ে আছে মারিয়ার ওপর।
পিউ-তানহা মুখ চে*পে ফিক করে হেসে ফেলল এতে।
ইকবাল সাদিফকে ধা*ক্কা দিয়ে বলল,
‘ কী সাদিফ বাবু? দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও।’
সাদিফ ওমন চেয়েই বোকার মত শুধাল,
‘কোথায়?’
কপাল চাপড়াল ইকবাল,
‘ আরে বউকে এগিয়ে আনো। যাও…’
ঠেলে দিলো ওকে। সাদিফ এগোতে নিয়েও থামে,শ্বাস নেয় বৃহৎ। চশমা ঠিকঠাক করে অপ্রতিভ হাতে। মুচকি হেসে এগিয়ে যায় সামনে।
সাদিফ আসছে,পায়ের শব্দ স্পষ্ট শুনছে মারিয়া। একেকজনের কণ্ঠ ছাপিয়ে কানের পাশে পরে আছে সুধীর কদমের জুতোর শব্দ। বক্ষস্পন্দন থমকাল তার। আই-ঢাই লাগল সব কিছু৷
সাদিফ মুখোমুখি এসে থামল। নিসঙ্কোচে সাদাটে হাত, বাড়িয়ে দিলো সামনে। বেগ পুহিয়ে চোখ তুলল মারিয়া। চোখাচোখি হলো দুজনের। কালো স্যুটেড ব্যুটেড, চাশমিশ সাদিফ তখন নজরকাড়া সুদর্শন। মারিয়া বিমুগ্ধ হলো এবারেও৷ তার অন্তকরণের সব টুকু বশীভবন, সদর্পে হামলে নিলো সাদিফ।
কম্পিত,কোমল হাত উঠিয়ে ওর হাতে রাখল মারিয়া। নম্র পায়ে চৌকাঠ ডিঙিয়ে ভেতরে এলো। স্টেজে গিয়ে বসল দুজন। পাশাপাশি, কাছাকাছি।
সবাই স্বীয় অবস্থান থেকে লুফে নেয় ওদের একত্রে দেখার সৌন্দর্য। কালো-সাদা পোশাকের প্রেমিক যূগল তখন, পূর্নিমার চাঁদের ন্যায় আকর্ষণীয়। চোখ ধাঁধানো,মন জুড়ানো এক কপোত-কপোতীর পানে,সকলের দৃষ্টি ধ্যানমগ্ন, অভিভূতের মতোন।
পিউয়ের ভ্রু জড়োসড়ো। ধূসরকে খুঁজছে ও। পেলোও একটা সময়। ওইতো দাঁড়িয়ে! ওমনি হাসি টানল ঠোঁটে। চটপটে কদমে গিয়েই পাশে দাঁড়াল ওর। ধূসর সাদিফ-মারিয়াকে দেখছিল। মাথায় তখন রওনাকের কথা ঘুরছে। এক ব্যাচের ছিল ওরা। ইকবালের মতো নাহলেও বেশ ঘনিষ্ঠ। হাসপাতালে রওনাক শ্বাস ছেড়েছিল ওর এই দুহাতের ওপর। যাওয়ার সময় অনুনয় করেছিল,
‘ আমার মা আর বোনটাকে দেখিস। এত বড় শহরে ওদের কেউ নেই।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল ধূসর। যাক! সাদিফ মারিয়াকে ভালোবেসে একটা চমৎকার কাজ করল। কিন্তু এসব কবে হলো? কীভাবে? সে কিছু টেরই পেলো না। সাদিফ পিউয়ের ওপর দূর্বল ছিল যতটা ধারণা ছিল ধূসরের। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরী! পিউ পুরোদমে হাবুডুবু খাচ্ছিল ওর প্রেমে। আর সে নিজেও এমন আটঘাঁট বেঁধে কিশোরির প্রেমে পড়ল, ফেরত যাওয়ার উপায়ই নেই।
আচমকা কেউ বাহু পেঁচিয়ে ধরায় ধূসরের ধ্যান ভা*ঙে। না চেয়েও বুঝে যায়,কে! পিউ প্রথমে ধূসরের দৃষ্টি অনুসরন করে চাইল। নিজেও গদগদ কণ্ঠে বলল,
‘ কী কিউট কাপল! তাইনা ধূসর ভাই?
ধূসর বিরক্ত চোখে চাইল। দৃঢ় চিবুক দেখেই ঘাবড়ে গেল পিউ। মিনমিন করে বলল,
‘ সরি!’
ধূসর অতিষ্ঠ ভঙিতে সামনে ফিরল আবার। পিউ ঠোঁট ওল্টাল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বিয়ের কদিন অবধি ঠিকঠাক ছিল সব। হঠাৎই শুরু হলো ধূসরের এক নতুন ব্যামো। পিউয়ের মুখে ‘ভাই’ শুনলেই চেঁতে যাচ্ছে। হুঙ্কার ছাড়ছে ভ*য়াবহ।
শুধু সে কী সে? মা,মেজ মা, আপু সবাই মিলে ওকে ধমকায়,কেন স্বামীকে ভাই ডাকবে?
পিউ তখন অসহায়ের মত চেয়ে থাকে। কী করে বোঝাবে, ও নিজেও ভাই ডাকতে চায় না।
ধূসর, ধূসর ডাক ছুড়ে মুখে ফ্যানা তোলার যে বহুদিনের ইচ্ছে। সম্বোধনের সাথে জান,বাবু, সোনার মত আরো অনেক কিছু লাগাবে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এই দোষ কী ওর? না। দোষটা ওর মুখের। জ্বিভ ফস্কে আপনা-আপনি বেরিয়ে যাচ্ছে এই ডাক। বিয়ের আগে ছিল এক যন্ত্র*ণা, এখন হলো আরেক।
হঠাৎই কিছুক্ষণ আগের কথা মাথায় এলো পিউয়ের। মনে পড়ল রুমে করে আসে শপথবাক্য। দুরন্ত হাত সরিয়ে আনল ওমনি। সামনে তাকানো ধূসরকে বলল,
‘ আপনার হাত ধরেছি কেন,আমার তো আপনার ধারেকাছেও আসা উচিত না।’
ধূসর চাইল। ভ্রু গুছিয়ে নিশ্চিত হতে শুধাল,
‘ কী?’
তাকানোর ধরণ দেখে পিউ ভীত হয়। কিন্তু চোখেমুখে ধরে রাখে সাহস। কণ্ঠে তেজ নিয়ে বলে,
‘ কী মানে কী? আজ থেকে আপনি আমার সাথে কোনও কথা বলবেন না। ‘
ধূসর আগামাথা বুঝল না।
‘ মাথা ঠিক আছে?’
‘ আছে। অবশ্যই আছে। আছে বলেইত সুস্থ মানুষের মত কথা বলছি। যে মানুষ বউকে ভালোবাসি বলতে ভাব নেয়,তার বউয়ের কাছে আসার কোনও অধিকার নেই। একটু আগে ভুল করে কথা বলে ফেলেছি। যতক্ষণ না আমাকে ভালোবাসি বলবেন, কথাবার্তা বন্ধ। খবরদার আমাকে ডাকবেন না,ছোঁয়াতো বহুদূর।’
পিউ চোটপাট দেখিয়ে ঘুরে হাঁটা ধরল।
এপাশ ফিরে চোখ বুজে, শ্বাস নিলো। জীবনে প্রথম বার,ধূসর ভাইয়ের সাথে হম্বিতম্বি করল। যার একটা ধমকে চারাগাছের ন্যায় নুইয়ে যায়,তার দিক চেয়ে বলে এলো খবরদার? পিউ নিজেই আশ্চর্য হয় তার দুঃসাহসিকতায়।
ওদিকে ধূসর ভরকে গেছে। তার দিক না তাকিয়ে কথা বলা পিউয়ের, এইভাবে শাসিয়ে যাওয়ায় হতবিহ্বল সে। কিছুক্ষণ ভ্যাবাচেকা খেয়ে চেয়েই রইল। হঠাৎ হয়েছে কী এই মেয়ের?
***
সাদিফ আড়চোখে বার বার তাকাচ্ছে। চোখে-মুখে মাদকতা! মারিয়ার দৃষ্টি কোলের ওপর। না দেখেও বেশ বুঝছে,সাদিফ দেখছে ওকে। এতেই তো জোড়াল হচ্ছে লাজ। সাদিফ এবার বসা থেকে আরেকটু কাছে ঘিঁষল। কণ্ঠ চেপে বলল,
‘ আমাকে মা*রার প্ল্যান করছেন?’
মারিয়া ঝট করে চাইল। কৌতুহলে সাঁতার কে*টে এলো একদফা।
‘ কী করলাম?’
সাদিফের চোখ সামনে। ঠোঁট নেড়ে বলল,
‘ বলেছিলাম,ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত হতে চাই। তাই বলে সত্যি সত্যিই সারাজীবনের জন্য রোগী বানিয়ে রাখবেন?’
কথার মার-প্যাঁচ মারিয়ার নিরেট মাথায় ঢুকল না। সাদিফ সরাসরি চাইল এবার। দৃষ্টিতে -দৃষ্টি মিলে যায়। সেকেন্ডে মারিয়ার সারা মুখে বিচরণ ঘটাল তার মোহিত লোঁচনদ্বয়। কেমন রুদ্ধ কণ্ঠে স্বীকারোক্তি দিলো,
‘ আপনাকে দেখে আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে ম্যালেরিয়া। একটুখানি ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য বুকের ভেতর তোলপাড় চলছে খুব! এতটা সুন্দর আজ না লাগলে হোতো না? ‘
মারিয়ার ভ্রু কুঞ্চন মুছে গেল। বুক কাঁপল কুণ্ঠায়। হাঁসফাঁস করে মাথা নুইয়ে নিলো।
মুচকি হেসে বলল, ‘ ধ্যাত!’
সাদিফের ঠান্ডা হাত তার হাতের ওপর পড়ল সহসা। কিছু চমকে চাইল ও। চারপাশে গিজগিজে মানুষ!
সতর্ক কণ্ঠে বলল,
‘ সবাই দেখছে।’
সেই মার্জিত সাদিফের পরিবর্তন আরো একবার প্রমাণিত হলো আজ। নিরুদ্বিঘ্ন তার স্বর,
‘ দেখুক না! নিজের জিনিসই তো ধরলাম।’
মারিয়া কিছু বলেনা ফের। দুটো পুষ্ট,ফাঁপা কপোল নিয়ে বসে রয়। মুঠোয় বন্ধ থাকে ভালোবাসার মানুষের, অমসৃন হস্তখানা।
***
ধূসর পিউয়ের ছোটাছুটি দেখছে। একটুখানি শান্ত নেই এই মেয়ে! সাথে জুটেছে তানহা। বেস্টফ্রেন্ড পেয়ে উড়ছে। উড়ুক,সমস্যা সেটা নয়। তার পার্লামেন্টের ছেলেপেলে ভর্তি এখানে। না,যদিও ওরা ধূসরের জিনিসের দিক ভুলেও চাইবেনা। সমস্যাটা হলো মারিয়ার জ্ঞাতিগোষ্ঠী থেকেও কিছু লোকজন এসেছে। আবার ওদের ব্যাবসায়িক লোকজন! কে কীরকম,কার মনে কী আছে বলা তো যায় না! আর এই ছোট্ট মেয়েকে দেখে কেউ বুঝবে? এটা কারো বউ?
পিউ হাসি হাসি মুখে এদিক চাইল একবার। চোখাচোখি হলো। ধূসর ভাবল, একটু মুখ শক্ত করে চোখ রা*ঙাবে। এর আগেই পিউ ভেঙচি কা*টে। আরেকদিকে মুখ ফিরিয়ে চলে যায়।
ধূসর হতভম্ব,হতচেতন। ব্যাপারটা কী হলো?
আচমকা পেছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরে ইকবাল। একবার তাকাল ধূসর। ইকবাল বলল,
‘ সাদিফ বাবুর বিয়ের ঢাক বাজতেই নিজের বিয়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে রে বন্ধু। আবার বিয়ে করতে পারলে ভালো হোতো…’
ধূসর নেত্র সরু করতেই,থতমত খেয়ে বলল,
‘ তোর বোনকেই করতাম রে ভাই!’
পরপর দাঁত কেলিয়ে বলল,
‘ আগামী সপ্তাহে ওদের বিয়ে। তারপর বাসর। তুই যেমন পিউকে শিয়ালের মত কা*মড়েছিলি ওউ নিশ্চয়ই তাই করবে? একই বংশের ছেলে তো। এ বাবা,আমার ভাবলেও কেমন লজ্জা লাগছে! ইশ!’
ইকবাল দুহাতে চেহারা ঢাকল। যেন সত্যিই ভীষণ লজ্জায় কুপোকাত। ধূসর ওমনি দাঁত চে*পে ঘুষি মা*রল পেটে। নুইয়ে এলো ইকবাল। পেট চেপে, হকচকিয়ে চাইল।
ধূসর কণ্ঠে বিরক্তি এনে বলল,
‘ কোথায় কী বলতে হয় জ্ঞান নেই? আশেপাশে এত মানুষ, চোখে দেখিস না?’
ইকবাল ঠিকঠাক হয়ে দাঁড়ায়। নাক ফুলিয়ে বলে,
‘ মা*রলি কেন তুই?’
‘ মা*র খাওয়ার মত কাজ করলে,আরো মা*রব।’
ইকবাল হা করে বলল,
‘ আমি কি সরকারি মা*? গায়ে জোর আছে বলে একটা নিষ্পাপ বাচ্চাকে যখন তখন মা*রতে লজ্জা করে না?’
ধূসর দুই ভ্রু উঁচাল,
‘ নিষ্পাপ বাচ্চা?’
‘ বাচ্চার বাবা তো? একই কথা। এই যে আমাকে মা*রলি,কেন? আমি কি ভুল কিছু বলেছি? তুই পিউকে কামড…’
ধূসর তৎক্ষনাৎ মুখটা চেপে ধরল ওর। কটমট করে বলল,
‘ চুপ! আর একটা উল্টোপাল্টা কথা বললে,গলা টিপে দেব।’
ইকবাল প্রকট করল চোখ। পরপর দৃষ্টি নিভিয়ে, মাথা দোলাল। বোঝাল,ভুলভাল কথা বলবেনা আর। অথচ ধূসর হাত সরাতেও পারল না,
সবেগে বলল,
‘ কিন্তু কথাটাত সত্যি। তুইত পি….’
ধূসর তপ্ত কণ্ঠে বলে,
‘ ভালো হবিনা?’
মাথা নাড়ল ইকবাল। বোঝাল, না। স্বীয় প্রসংশার ঝুড়ি মেলে বলল,
‘ যাই বল, আমার মত ভদ্র ছেলে কিন্তু দুটো হয়না। বিয়ে করলাম,বাসর করলাম কেউ টের পেয়েছিস? ‘
ধূসর চ সূচক শব্দ করল
‘ তুমি থামবি?’
‘ না। আজ টাকার অফার দিলেও থামব না। খুব প্রেম প্রেম পাচ্ছে! বউটা ব্যস্ত বিধায় তোর কাছে এলাম। তাই বলে ভাবিস না,আমি সমকামী! আসলে এই পৃথিবীতে প্রেম উজাড় করে দেওয়ার মত পুষ্প আর তুই ছাড়া যে কেউ নেই আমার। ‘
ধূসর ফোস করে শ্বাস ফেলল। হতাশ,নিরাশ! চাইল রুষ্ট, ব্যর্থ চোখে। কিন্তু ইকবালের ভোলা-ভালা,সহজ সরল, দুষ্টু মুখটা দেখেই মিলিয়ে গেল বিরক্তি। শিথিল হলো ভ্রু। নিজেই মাংসল এক হাত উঠিয়ে কাঁধ পেঁচিয়ে ধরল ওর।
শুধাল,
‘ আমার জীবনের সব পূর্ণতার মধ্যে অন্যতম আর সেরা কী, জানিস?’
ইকবাল সিরিয়াস নয়। দুদিকে সজোরে মাথা ঝাঁকাল।
‘ না বললে জানব কীভাবে?’
ধূসর হাসল অল্প। সদর্পে বলল,
‘ ইকবাল আমার বেস্টফ্রেন্ড! ‘
ইকবালের মুখভঙ্গি বদলে যায়। বিস্ময়াভিভূত হয়ে তাকায় ওর দিক। ধূসর মুচকি হাসল। পেছন থেকে আমজাদ ডাক ছু*ড়লেন,
‘ ধূসর, এদিকে এসো… ‘
সে পাশ কাটিয়ে চলে গেল চাচার পিছু পিছু।
ইকবাল চেয়েই রইল। অপলক,অব্যবস্থিত হয়ে। ঝুলে রইল বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝে। সেই আট বছর বয়স থেকে বন্ধুত্ব ওদের। ধূসর কোনও দিন ঘুণাক্ষরেও এসব বলেনি। তুই আর আমি বেস্টফ্রেন্ড তাও না। তাদের মিল মুখে নয়, অন্তরে ছিল। ধূসর যাকে ভালোবাসে,সবটা দিয়ে বাসে। একটুখানি খাদ থাকেনা সেখানে। তবে প্রকাশ করতে পারেনা। মুখ ফুটে বলেনা, তোকে ভালোবাসি!
তাহলে আজ এইভাবে স্বীকার করে নিলো কী করে?
হেসে উঠল ইকবাল। বিমোহিত,পবিত্র, মৃদূ হাসি। ধূসরের যাওয়ার দিক চেয়ে বিড়বিড় করল,
‘আর আমার জীবনের পূর্ণতার অর্ধেকটাই তুই। ‘
*****
কাঙ্ক্ষিত, প্রত্যাশিত সময় হাজিরা দিলো। পালা এলো প্রিয় মানুষের অনামিকার মাধ্যমে তার হৃদিস্থ আবাসে দখলদারির।
মারিয়ার বিয়ের জন্য একটা চেইন,আর এক জোড়া ঝুমকো তুলে রেখেছিলেন রোজিনা। সেই ওর বাবা বেচে থাকার আমোলে। একবারে মেয়েকে খালি হাতে বিদায় দেওয়া কী সম্ভব? ক*ষ্ট,অভাব আর শত দূর্ভোগেও ওই গয়নায় হাত দেননি তিনি। কিন্তু আংটিবদলের দিন,সাদিফকেও তো কিছু দিতে হবে? তাই ঝুমকো জোড়া ভে*ঙে একটা মোটা আংটি গড়িয়েছেন। এই কথা মেয়ে অবশ্য জানেনা। রোজিনা বলেছেন,রওনাকের রেখে যাওয়া এটা। ওর বরের জন্য বানিয়েছিল। মারিয়াও তাই মেনেছে।
সেই আংটির বাক্সের সাথে আরো একটি আংটির বাক্স এনে রাখা হলো ওদের সম্মুখে। চকচকে,জ্বলজ্বলে হীরের আংটি হাতে তুলল সাদিফ।
উঠে দাঁড়াল হঠাৎ। মারিয়াকে ইশারা করল উঠতে। মেয়েটা বাধ্যের মত দাঁড়ায়। সাদিফ বুক ফুলিয়ে শ্বাস নেয়। ভীষণ লম্বা,দীর্ঘকায়। কৌতুহলী,জিজ্ঞাসু ত্রিশাধিক মানুষের সামনে আচমকা হাঁটুমুড়ে বসে ওর সামনে। তাজ্জব বনে গেল মারিয়া। হা করে চাইল। আশেপাশের সবাই অবাক,বিস্মিত।
জবা বেগম তো ইঞ্চিখানেক ফাঁকা ঠোঁটে স্বামীর দিক তাকালেন। দুজনেই হতবাক ছেলের এই দিন দিন বদল দেখে।
সাদিফ বৃত্তাকার আংটি স্বল্প উঁচিয়ে ধরে। আশপাশ থেকে ছেলে-পেলে ‘হোওঅঅঅঅ’ বলে চিৎকার ছুড়ল গতিতে। সাদিফ চারপাশের কোনও দিক দেখল না,তাকালোনা৷ সোজাসুজি স্তব্ধ মারিয়ার দিক চেয়েই আওড়াল,
‘ মিস ম্যালেরিয়া! আমি আপনার ভালো বন্ধু হতে চাইনি। ভালো প্রেমিক হতে চেয়েও, হয়ত পারিনি। কিন্তু গ্যারান্টি দিচ্ছি,এই সিকদার সাদিফ হাসান আপনার খুব ভালো স্বামী হয়ে দেখাবে। পায়ের নীচের নরম দূর্বাঘাসের ন্যায় বিছিয়ে দেবে শান্তি। নিরুপদ্রব, স্নিগ্ধ হাওয়ার ন্যায় বেড়িবাঁধনে, পেঁচিয়ে রাখবে ভালোবাসায়। অষ্টপ্রহর,আমৃত্যু, পবিত্র বন্ধনে আমার সাথে বাঁধা পড়তে আপনি কি রাজী? উইল ইউ ম্যারি মি মারিয়া?’
পিউ-পুষ্প-সুমনা সবাই হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরেছে। যারা মোটামুটি সাদিফকে চেনে তারাও মূর্তির মত চেয়ে। পরপর বৃষ্টির মত তালির শব্দ এলো। এলো দ্বিতীয় বার আনন্দ ধ্বনির আওয়াজ। কেউ কেউ স্বমস্বরে চিৎকার করে আবেদন করল,
‘ সে ইয়েস…’
মারিয়ার কোটরে টলটলে জল। স্রোতস্বিনীর মত উপচে আসলো বলে। নিম্নাষ্ঠ চে*পে ওপর নীচ মাথা ঝাঁকাল সে। সাদিফ হাসল,গাল ভরা,তকতকে হাসি। আঙুলে আংটি গেঁথে দিলো চটপট। ঘন তালির বর্ষণ নয়,বাঁজ পরছে যেন। সাথে আনন্দ ধ্বনি তো আছেই।
সাদিফ উঠে দাঁড়াল। বেহায়া মনে ইচ্ছে জাগল একবার মারিয়াকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরার। হলো না! এত মানুষের ভেতর এটুকু করেছে তাতেই অনেকে মূর্ছা যাওয়ার জোগাড়। ইচ্ছেটাকে বুকে চেপে মাথা চুল্কাল সে।
মারিয়াও আংটি পড়াল। সাদিফের চোখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল তৃষিত নয়নে। ওপর থেকে নির্বাক তার অন্তঃপট, চেঁচিয়ে বলল,
‘ আমিও আপনার খুব ভালো বউ হয়ে দেখাব সাদিফ। চেষ্টা করব,আপনার সব দুঃ*খ,মন খারাপ,খারাপ লাগা নিজের মধ্যে শুষে নেওয়ার। ‘
দুজনের ওপর পূনর্বার ফুলের পাপড়ি ছেটানো হলো। ধূসর হেসে, আড়চোখে পিউয়ের দিক চাইল। মেয়েটা চেয়েছিল আগেভাগেই। মুগ্ধ চোখমুখ, ও তাকাতেই যেন পালটে গেল কেমন। হয়ে উঠল রাগী রাগী। চতুর্থ বারের মত আবার ভেঙচি কাট*ল পিউ। মুখ ফিরিয়ে নিলো ফের।
ধূসর আহাম্মক বনে গেল। পরপর দাঁত চে*পে এগোতে গেলেই ছুটে পালাল পিউ। এমন জায়গায় ঢুকল,ধূসর দৃষ্টি দিয়েও তলিয়ে পেলোনা হদিস। শুধু বিড়বিড় করে বলল,
‘ একবার পাই, দাঁড়া।’
***
‘ এই ইকবাল! আমার চুল ঠিক আছে, দ্যাখোনা!’
ইকবাল চাইল। পা থেকে মাথা অবধি দেখল স্ত্রীর।
‘ সব ঠিক আছে মাই লাভ।’
‘ আরে খোপা টা খুলে গিয়েছে বোধ হয়। ‘
‘ ঘোরো ওদিকে।’
পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়াল পুষ্প। ইকবাল গাঁজরার খুলে যাওয়া মাথাটা ক্লিপ লাগিয়ে আটকে দেয়।
‘ ঠিক আছে এখন।’
পুষ্প ফিরল। ঠোঁট ইশারা করে বলল,
‘ আর লিপস্টিক? জুস খেয়েছি,উঠে গেছে?’
ইকবাল কপালের পাশ চুল্কাল দু আঙুলে।
আশপাশ দেখে, চাপা কণ্ঠে বলল,
‘ ঠোঁট বড় মারাত্মক জিনিস মাই লাভ। এসব এভাবে দেখা যায়না। রুমে চলো,খুঁটে খুঁটে দেখছি।’
পুষ্প বাহুতে কিল বসাল ওমনি। কুণ্ঠায় গাল রাঙিয়ে বলল,
‘ ছি! অসভ্য!’
ইকবাল স্বশব্দে হাসল। স্ত্রীর কাঁধ পেঁচিয়ে দাঁড়াল। পুষ্প বলল,
‘ বাবুকে একবার খাইয়ে আসব? কতক্ষণ ধরে নীচে আছি।’
‘ যেতে হবেনা। ওই দ্যাখো….’
আঙুল তাক করল ইকবাল। পুষ্প তাকাল সেদিক। মুমতাহিনা সোফায় বসে,কোলে পরিপাটি জামা পরা পূর্ব। নুড়ির হাতে ফিডারের বোতল। বাচ্চাটা যে খিদেতে কাঁদবে সেই অপশনও রাখা হয়নি। চোখমুখ কোঁচকালেই নুড়ি ফিডার মুখে পুড়তে তৈরী । পুষ্প হেসে ফেলল। তৃপ্ত কণ্ঠে বলল,
‘ কপাল করে একটা শ্বাশুড়ি পেয়েছি ইকবাল!’
‘ তাহলে আমার কপাল ভাবো? মা,বউ বন্ধু,সব বাঁধিয়ে রাখার মতো। হিটলার শ্বশুর মশাইও খারাপ না।’
পুষ্প চোখ রাঙায়, ‘ আবার?’
ইকবাল জ্বিভ কে*টে হাসল। ফের ধরতে গেলেই পুষ্প বলল,
‘ চলো চলো সবাই মিলে একটা ফ্যামিলি ফটো তুলে ফেলি!’
‘ আইডিয়া তো দারুণ। ‘
পুষ্প ইকবালকে নিয়েই চঞ্চল পায়ে স্টেজের কাছে এলো। শ্বাস টেনে ঘোষনার মত ফটগ্রাফারকে বলল,
‘ ভাইয়া আমাদের একটা ফ্যামিলি ফটো তুলে দিন তো।’
প্রস্তাবখানা মনে ধরল সবার। হৈচৈ বেঁধে গেল নিমিষে । আনাচে -কানাচে থাকা পারিবারিক সদস্যরা ছুটে ছুটে এলেন। আমজাদ -মিনা বসেছিলেন দূরে। পুষ্প তাদের হাত টেনে বলল,
‘ আব্বু-আম্মু এসো,ছবি তুলি।’
‘ আমরা কেন?’
‘ তোমাদের ছাড়া পরিবার হয় না কী?’
হেসে, উঠে গেলেন দুজন। বাকীরা স্বতঃস্ফূর্ত সামিল হলো পেছনে। পুষ্প শ্বশুর -শাশুড়িকে ডাকল,রোজিনাকেও,কেউ গেলেন না। গাল ভরে হেসে মানা করলেন।
বসে বসে দেখলেন স্টেজ ভর্তি সিকদার পরিবারের সদস্যদের পূর্ণ মিলনায়তন।
সাদিফ – মারিয়া গুরুজনদের বসার জায়গা দেওয়ার জন্য উঠতে গেলেই তাদের আবার বসিয়ে দেওয়া হয়। ওদের মাঝে রেখে দুপাশ থেকে বসলেন আমজাদ আর মিনা। নারীর পাশে নারী,পুরুষের পাশে পুরুষ। সোফাটার ঠিক মাঝ বরাবর পেছনে দাঁড়ালেন আজমল -জবা। জবার পাশে সুমনা আর আনিস। আজমলের এ পাশে রুবায়দা -আফতাব।
সোফার সামনের ফ্লোরটুকুতে এসে রিক্ত আর রাদিফ বসল। ছোট রিক্ত বাবু হয়ে বসেছে। রাদিফ বসল একটু হাঁক- ডাক পেরে। একটা সানগ্লাস চোখে,সাথে এক হাটু ভে*ঙে হিরোর ন্যায়।
সোফার এক হাতলে,মায়ের কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল পুষ্প-আর ইকবাল। অন্য হাতলে আমজাদের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে ধূসর। সবার মধ্যে পিউকে পাওয়া গেল না।
‘ পিউ কই,পিউ কই! ‘
গুঞ্জন ওঠার মধ্যে স্টেজে উঠল মেয়েটা। থমথমে মুখশ্রী। গাল ফোলা। যেন কষে ধম*ক খেয়েছে কয়েক’শ। ধূসরের দিক তাকালোও না একবার। ভাবমূর্তি ভীষন চটে থাকার! সকল জুটি গা ঘেঁষে দাঁড়ালেও সে দাড়াল ধূসরের থেকে, মাইল খানেক গ্যাপে।
ক্যামেরার ফোকাসেও আঁটছেনা এমন। ফটোগাফ্রার লেন্স একবার চোখে ঠেকিয়ে পিউয়ের নাগাল না পেয়ে আবার তাকালেন। বললেন,
‘ আপু একটু ক্লোজ হয়ে দাঁড়ান। ‘
সত্যি বলতে পিউয়ের পদযূগল সুর সুর করছিল ধূসরের কাছে ঘিঁষতে। কিন্তু শক্ত হয়ে রইল সে। আজ নরম হলে হবেনা। গাঁট হয়ে থাকল তাই। নড়ছে -চড়ছে না দেখে ছেলেটা ছবিও নিতে পারছে না।
তক্ষুণি ধূসর অধৈর্য হাতে, কোমড় চে*পে টেনে নিলো কাছে। পিউয়ের অন্তস্থল লুটিয়ে গেল আহ্লাদে। এইভাবে ধূসর কাছে টানলে সে আকাশ-বাতাসে উড়ে বেড়ায়। কিন্তু ভেতরের ভালো লাগা চাপা রাখল অভিমানের নিকট। তৎপর ধূসরের হাতটা কোমড় থেকে সরিয়ে দিলো। ধূসর আবার ধরল। পিউ আবার সরায়,ধূসর আবার ধরে৷ পিউ সরাল, ধূসর ধরল।
ধরা -ছোঁয়ার মধ্য দিয়েই কেটে গেল অনেকক্ষণ। ধূসরের মাথাটা ঝুঁকে এলো হঠাৎ। উষ্ণ অধর গিয়ে ঠেকল ওর কানের কাছে।
প্রথম রাতের মত হাওয়ায় ভাসল গহীন, ফিসফিসে স্বর। মন্ত্রের ন্যায় সেতার বাজল,
‘ ভালোবাসি পিউ!’
পিউ চমকে তাকায়। থমকে যায়। এতক্ষণ ওর সত্যিই মন খারাপ ছিল। ভেবেছিল এসব চোটপাটে লাভ হবেনা। ধূসরকে বাগে আনা তার মত মানুষের সাধ্য নয়। কিন্তু সে হার মানবে,আদৌ বলবে, একদমই আশা করেনি পিউ। তাও এই সময়? এটাত, কল্পনাতেও আনেনি।
ধূসর খুব জোর দু সেকেন্ডে আওড়েছে! কিন্তু কথাটা পিউয়ের সমস্ত নিউরনে দা-মামা বাজায় সুরের ন্যায়। এসরাজের মতোন হানা দেয় শ্রবণপথে। দূর্বল বুকখানা লাফিয়ে ওঠে। ছলকায় সকল অনুভূতি। রক্তাসঞ্চালন অবধি থেমে রয় শিরা-উপশিরায়। বিকল হয়ে আসে, দেহের প্রতিটি রন্ধ্র, মস্তকের সমগ্র কোষ বিবর। একটা মানুষের মুখে ভালোবাসি শব্দটা এত সুমধুর লাগে? এত?
ধূসর ভ্রু উচাল,
‘ খুশি?’
পিউ জবাব দিতে ব্যর্থ,বাকরুদ্ধ। ভেতরের খুশি অপ্রকাশিত রয় বিস্ময়ের ভিড়ে। কেবল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে।
পনের বছরের কিশোরী এক মেয়ে ভালোবেসে ছিল পঁচিশ বছরের এক যুবককে। এক দেখায়,এক হোচটে। দিন-মাস-বছর,এমন কোনও মুহুর্ত ছিল না এই একটা মানুষের বিচরণ হয়নি ওর মস্তকে, ওর হৃদয়ে।
কখনও ভাবেওনি, সেই মানুষটাও ওকে চাইবে,ভালোবাসবে৷ ভাগ্য গুণে বউ হবে তার। হবে টোনাটুনির সংসার।
এই ভালোবাসি শোনার জন্য হৃদপিন্ডের চারটে প্রকোষ্ঠ কী মাত্রাধিক ছটফট করেছে এক সময়! সেকেন্ড -মিনিট-ঘন্টায় বিভোর থেকেছে ওনাকে নিয়ে। ধ্যান- জ্ঞান -খেই – চিন্তা- চেতনা আহুতি দিয়েছিল প্রায়। ধূসর ভাইয়ের একটু ভালো করে কথা বলা ওর কাছে পাহাড়সম খুশি,আর একটু খানি অবজ্ঞা আকাশ ভাঙা কা*ন্না। আজ প্রথম বার সেই মুখে ভালোবাসি শুনে পিউ শক্ত থাকতে পারেনা। হাত পা কেঁপে ওঠে সেই আগের মত। কেমন নড়বড়ে ভঙিতে দুলে ওঠে শরীর। ধূসর বুকের সাথে আরেকটু আকড়ে রাখল ওকে। পিউয়ের দেহাংশ লেপ্টে যায় তার বক্ষভাগে৷
ক্যামেরায় ক্লিক হতে থাকে। অতিথিরা মুগ্ধ চোখে দেখে একটি পূর্ণাঙ্গ পরিবার। যেই পরিবারের প্রতিটি সদস্য ভালোবাসায় বাঁধা। হিংসে,রেশারেশির ভিড়ে মায়া,টান আর স্নেহের এক অনন্য প্রতীক।
পিউ তখনও হা করে তাকিয়ে। ধূসর ক্যামেরার থেকে চোখ এনে চাইল ওর দিক। স্বাভাবিক সেই দৃষ্টি, বদলে গেল ওর চাউনী দেখে। অপার্থিব মনোহর, হরিনীর ন্যায় ডাগর ডাগর চক্ষুদ্বয় ছিনিয়ে আনল তার মনোযোগ। স্বত্তা ভুলে গেল ধূসর। হারাল,খোয়াল প্রিয়দর্শীনির দুই ভেজা ঠোঁটের ভাঁজে,তার ক্ষুদ্র আদলে।
এক যোগে,নিবিষ্ট মনে, আবিষ্টের মতোন দুজনকে দেখে যাচ্ছে ওরা। অটল,অনড় সেই দেখাদেখি।
সবার হাসি-হাসি, হৃষ্ট মুখবিবর তখন ক্যামেরায়। ক্রমে ক্লিক হচ্ছে চমৎকার সব ছবি। বন্দী হচ্ছে আমুদে,খুশির মুহুর্ত।
কেবল, ❝ ধূসর- পিউয়ের চোখ একে -অন্যতে।
মৌনতায় প্রেম বিলালো,তৎকালীন চোখা-চোখিতে। বিছিয়ে দিলো অনুভূতি,গল্প জানাল কাছে আসার।
চলতে চলতে ইতি টানল, দীর্ঘ এই
#এক_সমুদ্র_প্রেম! আর ভালোবাসার।❞
সমাপ্ত…..
নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই জার্নির আজ ইতি টানলাম। ইতি টানলাম সিকদার পরিবারের। সত্যি বলতে এই পর্বটা লিখতে গিয়ে বারবার থেমেছি। এতটা খারাপ আমার কোনও দিন লাগেনি। আপনাদের মত আমিও মিশে গেছিলাম এই গল্পে,প্রতিটি চরিত্রে। অনেক জ্বালিয়েছি আপনাদের। পড়াশুনা,অসুস্থতা,ব্যস্ততার ভিড়ে বিলম্ব হয়েছে প্রতিটি পর্বে। কতটা কী মন ভরাতে পেরেছি আপনাদের জানিনা,তবে চেষ্টা করেছি খুব! আজকে সব কিছুর সমাপ্তি হলো। ধূসর-পিউকে আপনারা যেমন ভালোবাসা দিয়েছেন,ইনশা আল্লাহ,পরের চরিত্র গুলোকেও তাই দেবেন আশা রাখি। আর আমার দীর্ঘ পরিশ্রমের স্বার্থকতা হিসেবে, বিভিন্ন গ্রুপে গল্পটি নিয়ে আপনাদের রিভিউ আশা রাখছি। ক্ষনিকের জন্য বিদায় নিলাম। যারা কেবল এই গল্পের পাঠক ভালো থাকবেন তারা। ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা নেবেন। আর যারা আমার সব সময়ের পাঠক তাদের বলছি তীব্রর সাথে ফিরছি শীঘ্রই 🥰🥰