এক সমুদ্র প্রেম পর্ব-৬৩+৬৪

0
1933

#এক_সমুদ্র_প্রেম!
কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(৬৩)

স্বচ্ছ আকাশে তারাদের ভিড়। অদম্য রূপের চাঁদ, লুটিয়ে দিচ্ছে প্রভা। চারপাশ ঘিরে হাওয়ার নম্র স্লোগান। কাছেপিঠে আলো নেই। শুধু রাস্তার দুই ধারে,স্তম্ভের মতো সোজা হয়ে থাকা সোডিয়ামের হলদেটে দীপ্তি।
খুব স্পষ্ট নাহলেও,সাদিফের মাত্রাধিক ফর্সা মুখটা এই স্বল্প আলোয়,মারিয়ার নিকট পরিষ্কার।

পাঁচিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সাদিফ। বক্ষপটে মাংসল হাত গুঁজে রাখা। গায়ের কালো পাঞ্জাবি মিশে গেছে তিঁমিরে। ক্ষীণ রশ্মিতে, চশমার গ্লাস চিকচিক করছে।
অমানিশার এই সুবিধে টুকু, মারিয়া হামলে নিয়েছে প্রযত্নে। তৃষিত নয়নে,চেয়ে আছে ওর দিক। সে মানুষটার নজর সম্মুখে,একটু উঁচুতে,ঐ আকাশের রাস্তায়। যেন মন দিয়ে চন্দ্রের কালিমা দেখায় ব্যস্ত!

কতক্ষণ হলো,কারো মুখেই কোনও কথা নেই। বিশাল ছাদ প্রাঙ্গনে শুধু শ্বাস-প্রঃশ্বাসের শব্দ। সাদিফ যেঁচে মারিয়াকে এখানে এনেছে। কিন্তু এসে থেকে মুখে কুলুপ এঁটে দাঁড়িয়ে। অবশ্য এই নিয়ে মেয়েটার মাথাব্যথা নেই। না আছে বিন্দুমাত্র তাড়াহুড়ো। এই যে সাদিফ ওর এতটা কাছে এতেই চলবে। এইভাবে যে খুব পাশে থেকে ওকে দেখছে এতেই সে তৃপ্ত।
মারিয়ার সম্মোহনীর ন্যায় চাউনীর মাঝে সাদিফের দীর্ঘশ্বাস ফ্যালার আওয়াজ হলো। মনোযোগে বিঘ্ন পেয়ে নড়েচড়ে চোখ নামাল মেয়েটা। কিন্তু কথা বলল না কেউই…
মারিয়া ফের সাদিফের দিক চায়।
এতক্ষণ ধরে লোকটা চুপ করে আছে কেন? ওনার কি মন খারাপ? অবশ্য হওয়ারই কথা!
যাকে ভালোবাসে,সে এখন স্বামীর সঙ্গে বাসর ঘরে মত্ত! এমন দুঃসহ সত্যির অনলে বুক তো পুড়*বেই। মারিয়ার নিজেরও মুখ কালো হয়। ফেরত আসে খারাপ লাগা। অমোঘ ইচ্ছে ছুটে আসে নিউরনে।
ভাবে,
‘ইশ! যদি কোনও অলৌকিক ক্ষমতা থাকত আমার, তা দিয়ে একটা জাদুর মলম বানাতাম। তারপর আপনার বুকে প্রলেপ লাগিয়ে সব ক্ষ*ত সেড়ে ফেলতাম সাদিফ! দুহাতের আজোলে সুখ এনে জোনাকির মত উড়িয়ে দিতাম আপনার বক্ষগহ্বরে। ওরা দিনরাত জ্বলতো,একটুখানি আমাবস্যা নামতে দিতোনা আপনার হৃদিস্থ নিবাসে। ‘

হতাশ শ্বাস ফেলল সে। নিঙরে দিলো নিজের না পারার আক্ষেপ, তার অপরাগতা। চোখ ছাপানো মুগ্ধতা,আর ভালোবাসার থৈথৈ স্রোত সমেত চেয়ে রইল ওই সাদাটে মুখমন্ডলে৷
অকষাৎ, বাতাসে সাদিফের কণ্ঠ ভেসে আসে,
‘ আর কতক্ষণ তাকিয়ে থাকবেন ম্যালেরিয়া? চোখ ব্যথা করছেনা?’

চমকে উঠল মারিয়া। বিমুগ্ধ লোঁচনে লেপ্টে এলো হতবিহ্বলতার ছাপ। সাদিফ ঘাড় বেঁকে তাকায়। ধরা পরার ভয়ে ওমনি চোখ নামাল সে।
সে মুচকি হাসল। শুধাল,
‘ এত কী দেখছিলেন?’
মারিয়া আমতা-আমতা করল, কণ্ঠে অস্বস্তি,
‘ ইয়ে মানে,ওই তেমন কিছু না।’
‘ তাহলে কেমন কিছু? ‘
মারিয়া উত্তর জানেনা। জানলেও বলতে পারবেনা। প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,
‘ নীচে যাবেন না? অনেক রাত হয়েছে!’
সাদিফের ছোট জবাব,
‘ যাব। কেন,এখানে খারাপ লাগছে আপনার? ‘
মারিয়া ঘন মাথা নেড়ে বলল, ‘ না না।’
সাদিফ আবার দৃষ্টি ফেরায়। সম্মুখে চেয়ে থেকে ডাকে,
‘ ম্যালেরিয়া!’
মারিয়ার উত্তর, ‘ জি!’
‘ কিছু কথা বলব,শুনবেন?’
তাকালে,মাথা দোলাল সে। শুনবে না কেন? এই মানুষটার কণ্ঠস্বর শোনার জন্য এক প্রহর কেন,এক রাত এই ছাদেই অনায়াসে কাটিয়ে দেব ও।

সাদিফ শ্বাস ফেলে প্রস্তুতি নিলো। প্রভঞ্জনে দুলে এলো তার ধীর-স্থির আওয়াজ,

‘ আমার জীবনটা ঠিক কী রকম আমি জানিনা। মনে হয়,ভীষণ অদ্ভূত! আর পাঁচজনের মত স্বাভাবিক না হয়ত। রস-কষ আর ঝামেলা মুক্ত! আমি কখনও কোনও বড় বিপদে পড়িনি। নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে পছন্দ করতাম। যেখানে,একটু ঝামেলা দেখেছি,সেদিকে না গিয়ে উলটো পথে এগোতাম। সত্যি বলতে আমি প্রথম বার, পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া,কিংবা প্রতিশোধ নেওয়ার মত চিন্তা,এই সবটা করেছিলাম আপনার সাথে। এর আগে কিন্তু এসব আমার মধ্যে ছিল না। ‘

থামল একটু! বলল,
‘ আমি আত্মীয় স্বজনের নিকট এক ভদ্র ছেলের প্রতিচ্ছবি। সবাই তাদের ছেলে-মেয়েকে দেখিয়ে বলতেন আমার মত হতে। যে কোনও দিন বাবার সাথে তো দূর,মায়ের চোখ দেখেও জবাব দেয়নি। তাদের হ্যাঁ এর ওপর না বলতে যায়নি।
আমাদের বাড়ি পড়াশুনায় ভীষণ স্ট্রিক্ট! আপনার সব দোষ মাফ পেলেও,লেখাপড়ার গাফিলতি এখানে ক্ষমা করা হয়না। কিন্তু আমার পড়তে ইচ্ছে করত না। আহামরি ভালো ছাত্র ছিলাম না। বছরে ক্লাশে ফার্স্ট হতে হবে এমন চিন্তাধারাও ছিল না কখনও। যতটুকু পড়তাম পরিবারের চাপে,ওদের ভ*য়ে।

ছোট থেকে আমার আর ভাইয়ার সম্পর্কটা ভীষণ সুন্দর ছিল জানেন! ভাইয়ার আদর আমার মত কেউ পায়নি। একই সাইকেলে চড়ে স্কুল গিয়েছি দুজন৷ জীবনে একদিন ওর মার খেয়ে আমার জ্বর উঠেছিল। ওটাই প্রথম, ওটাই শেষ। আমার গায়ের ধুম জ্বর দেখে ভাইয়ার খারাপ লেগেছিল কী না জানিনা,তবে যতবার আমি রুগ্ন চোখ মেলে চাইতাম, দেখতাম ভাইয়া পাশে বসে। ততবার আমাকে জিজ্ঞেস করছে,
‘ কী খাবি? কী লাগবে?’
আমি ছোট হলেও,ওর চোখে-মুখের উদ্বীগ্নতায় বেশ বুঝেছিলাম, ওর ভালোবাসার মাত্রা। ছোট বেলায় ইকবাল ভাই আর ভাইয়া যখন উঠোনে ব্যাডমিন্টন খেলত,আমি ওদের কর্ক কোড়াতাম। ওরা নিষেধ করলেও,লাভ হয়নি। কেন যেন ভাইয়ার সব কাজ কর‍তে আনন্দ হতো। ওর আশেপাশে থাকতেও ভালো লাগতো।
আর সেই ভাইয়ার সাথে আমার সম্পর্কটা হঠাৎ করেই,কেমন বদলে গেল একদিন। জীবনের প্রথম স্যালারি পেয়ে একটা চশমা কিনেছিলাম। ভীষণ শখের বলে, অন্যরকম একটা অনুভূতি ছিল তাতে। সেই চশমা পিউয়ের চঞ্চলতায় ভে*ঙে যায়। ক্ষনিকের জন্য মেজাজ খারাপ হলো। রাগে ওকে বকা-ঝাকা করলাম। সেই ঘটনার জেরে ভাইয়ার সাথে প্রথম বার তর্ক লাগল আমার। হুশ হারিয়ে একটা নিষ্ঠুর, অপ্রিয় কথা মুখ ফস্কে বেরিয়ে এলো। যেটা ভাইয়ার ইগোতে লেগেছিল খুব! লাগারই কথা। কিন্তু বিশ্বাস করুন,আমি একদম বলতে চাইনি ওসব৷ একদম না।

সাদিফ দম ফেলল। চেহারায় ফুটে উঠল তীব্র অনুশোচনার তরল চিহ্ন। এতটা সময়ের নিশ্চুপ মারিয়া,আগ্রহভরে শুধাল,
‘ তারপর? ‘
‘ তারপর, অনেকবার চেয়েছি ক্ষমা চাইব। হয়ে ওঠেনি। ভাইয়া জেদ করে,ইচ্ছের বিরুদ্ধে অফিসে গেল। পার্লামেন্ট, ব্যবসা সামলাতে হিমশিমে,ওর ক্লান্ত মুখটা দেখলে আমার পরিতাপ তরতর করে বাড়ত। অল্প সল্প দুরত্ব তৈরি হলো আমাদের। ভাইয়া কথা খুব কম বলতেন আমার সঙ্গে। তখন তো আমি পিউকে পছন্দ করতাম। তাই পরিপার্শ্বিক এসব নিয়ে অতটা ভাবিনি। সে সময়, মাথায় শুধু পিউকে পাওয়ার চিন্তা! কীভাবে কী করব,মাকে বলব,এসব ঘুরত।
কিন্তু যেদিন জানলাম ভাইয়া আর পিউ দুজন দুজনকে ভালোবাসে, আমার সমস্ত চিন্তার প্রবাহ থমকে গেল স্থানে।
প্রথম প্রথম খারাপ লাগত সত্যি, একটা কেমন দমবন্ধ করা কষ্ট হোতো! গোটা একদিন শিশুর মত কেঁদেছি। পিউ আমাকে ভালোবাসেনা,মস্তিষ্ক মানলেও,মন মানতে পারেনি। কিন্তু কী করার আছে? ভালোবাসা তো জোর করে আদায়ের বস্তু নয়। নির্দ্বিধায় সরে আসব ভাবলাম৷ মনের এই অজ্ঞাত কথাগুলো আমৃত্যু অজ্ঞাত রাখার সিদ্ধান্ত নিলাম। খুব জোরজবরদস্তি করে সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম,বলতে গেলে বাধ্য হয়েই। পিউকে পাওয়ার এক ফোঁটা আশা থাকলেও হয়ত এতটা ভালো হতে পারতাম না তখন।

কিন্তু ধীরে ধীরে আমার সামনে কিছু নিদারুণ বাস্তবতার পাতা উল্টে আসে। মস্তিষ্কে তূখোড় সত্যিটা প্রবেশ করে। অদৃশ্য কেউ, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো, ‘ ভ্রমান্ডে ভাইয়ার মত পিউকে কেউ ভালোবাসবেনা। সেই একমাত্র ওকে পাওয়ার অধিকার রাখে। যার ভেতর সাহস আছে,দূর্নিবার জোর আছে হৃদয়ে। অথচ আমার ভেতর এর ছিটেফোটাও ছিল না। ‘
যেদিন বড় আব্বু হঠাৎ করে জানালেন,পিউয়ের জন্য সমন্ধ আসবে? আমি হলে হয়ত ওখানেই হেরে বসে থাকতাম। পরাজয় মেনে একটা টু শব্দ করার সাহস পেতাম না। বসার ঘরে ওইদিনই নি*হত হতো আমাদের সম্পর্ক।

কিন্তু এখন সবটা পাল্টেছে। আমি পিউকে ভুলে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টায় খুব দ্রুত সফল হয়েছি। তবে একটা কথা ঠিক,প্রথম ভালোবাসা মনে দাগ কেটে যায়। পিউ আমার প্রথম ভালোবাসা হিসেবে অন্তঃস্থলের কোনও একটা জায়গায় আজীবন থাকবে ,কিন্তু আমার অনুভূতির কোথাও ও আর নেই। এই আট মাসে, মাঝে-মধ্যে নিজেকে যাচাই করতে একটা পরীক্ষা করতাম, পিউকে অনুভব করার পরীক্ষা। আর আশ্চর্যের বিষয়, ততবার বিফল হয়েছি আমি। মনের ধারেকাছেও হাতড়ে ওকে পাইনি। আজ যা বলছি,তা কেবল কথার কথা নয়,এগুলো আমার নিজেকে যাচাই করে প্রাপ্ত, দুর্দমনীয় সফলতা।
এত সহজে ওকে আমি কী করে ভুলতে পেরেছি জানেন? ‘
উত্তর জানতে তাকাল সাদিফ। মারিয়া আস্তে করে দুদিকে মাথা নাড়ল।
সে নির্দ্বিধায় বলল,
‘ আপনার জন্য।’

সহসা ভেতরটা দুলে উঠল ওর। টিমটিমে গতিতে কম্পিত হলো নেত্রদ্বয়ের দীঘল পল্লব৷
সাদিফের মোহাচ্ছ্বন্ন দৃষ্টি। বলল,
‘ আপনার মধ্যে একধরণের বিশেষ ম্যাজিক আছে ম্যালেরিয়া। একটা মানুষের মুড দু সেকেন্ডে ঘুরিয়ে দিতে আপনি চমৎকার একজন।’

মারিয়া বিভ্রান্ত চেহারায়,মিহি কণ্ঠে শুধাল,
‘ আমি,আমি কী করলাম?’

মুচকি হাসল সাদিফ। স্পষ্ট গলায় বলল,
‘ যে আমি কোনও এক খারাপ লাগার জেরে,সারাটাদিন গোমড়া মুখে কাটাই, সেই আমি আপনার একটা সামান্য কথায় হেসেছিলাম। যে আমি কারো বিরহে, নিরন্তর ছটফটাই, সেই আমি আপনার সাথে চিত্ত-চাঞ্চিল্যে টি এসসি চক্কর কেটে বেড়িয়েছি। যে আমার না বলা কথাগুলো,ঘুণাক্ষরেও কেউ কখনও টের পেলোনা,সেই আপনি খুব সহজে ধরে ফেললেন। যে আমি,কোনও দিন, কাউকে আমার খারাপ লাগা-ভালো লাগা পরিষ্কার করে জানাতে পারিনি,সেই আমি নিসঙ্কোচে, নিজের ভেতরের সবটা, আপনার কাছে ডায়েরির মতো মেলে ধরতে পারি। এর কারণ ঠিক কী, জানেন ম্যালেরিয়া?’

মারিয়ার গলা শুকিয়ে আসছে। কণ্ঠনালী থেকে শুরু করে, কাঠ কাঠ হচ্ছে সব। কারণ হিসেবে সাদিফ কী বলবে! কী বলতে পারে! মস্তক, কূল হারাচ্ছে সেই ভাবনায়।
রুদ্ধ হওয়া, স্বর কোনও মতে আওড়াল,
‘ ববন্ধুত্ব…’

সাদিফের হাসিহাসি মুখবিবর উজ্জল। দু কদম বাড়িয়ে এগিয়ে এলো কাছে। পেছনে হাত বেঁধে একটু ঝুঁকল ওর দিক। মারিয়ার বক্ষস্পন্দন জোড়াল। ঘামছে হাতের তালু। সাদিফ তার কাঁপা কাঁপা চোখ দুটোতে চেয়ে বলল,
‘ বন্ধুত্ব নয়,এর সঠিক,আর একমাত্র কারণ…’
একটু থেমে বলল,
‘ ভালোবাসা!’

থমকে গেল মারিয়া। চমকে উঠল চোখ-মুখ। মেরুদণ্ড ছুঁয়ে যাওয়া দরদরে হিম প্রবাহ স্পষ্ট। হাতের উল্টো পিঠ তুলে, নার্ভাসনেসে হাবুডুবু খেয়ে, ঘাম মুছল সে। চাইতে পারল না সাদিফের চোখের দিক। দোলাচল কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এলো,
‘ ননীচে যাই,চচলুন।’

অভিব্যক্তি আড়ালের নিছক প্রয়াসে,ঘুরে হাঁটাও দিলো সে। সহসা পেছন থেকে হাত টেনে ধরল সাদিফ। মারিয়া থামল। ভীষণ দ্রুত নিঃশ্বাসে ছটফট করল বুক।
অনুনয় করতে চাইল,
‘ হাতটা ছাড়ুন।’
কিন্তু গলবিল ফুঁড়ে একটা শব্দও এলো না। জ্বিভ তো আগেই অসাড়।
গাঢ় অনুভূতির তান্ডবে সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ কব্জিতে বরফ-সম,ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ পেয়ে, ফিরে চাইল। বিমূর্ত হলো, চাঁদের ঈষৎ উদ্ভাসে চকচকে, চেনা বস্তুটা দেখেই।

কণ্ঠ শৃঙ্গে তুলে বলল,’ এটা! এটাত সেই…’

সাদিফের, নজর, মনোযোগ তার ফর্সা হাতে। অমন ভাবেই, জবাব দিলো,
‘ আপনার পছন্দ করে রেখে আসা ব্রেসলেট। আর আপনাকে আমার দেওয়া প্রথম উপহার।’

মারিয়া স্তব্ধ। হাতটা ছাড়তেই মন্থর বেগে কাছে আনল।
‘ আপনি এটা কিনে এনেছেন? এত দামী একটা জিনিস!’
সাদিফ ভ্রু উঁচায়,
‘ কেন? দিতে পারিনা?’
মারিয়া সোজাসুজি বলল,’ না।’

চোখ-মুখ শক্ত করল। বাকবিতন্ডায় না জড়িয়ে,চুপচাপ ব্রেসলেটের হূক খুলতে নিল। সাদিফ খপ করে হাত চেপে ধরে। কণ্ঠে অনমনীয়তা,

‘ ভালোবেসে কিছু দিলে অপমান করতে নেই। শেখেননি?’
মারিয়া স্তব্ধ হয় ফের। সাদিফের আওড়ানো ‘ভালোবাসা’ শব্দটা ভেতরে ভূমিক*ম্প ছোটায় প্রতিবার। কিন্তু সে ভ্রান্ত,মানুষটা সবকিছু জেনে-বুঝে বলছে,না এমনিতেই…
তার নিশ্চল অক্ষি যখন আবর্ত হচ্ছিল,সাদিফও চেয়ে রইল অনুরূপ। আস্তেধীরে দু-জোড়া চঞ্চল আঁখি বিশ্রান্ত হয়। থেমে থাকে একে- অন্যতে। আচমকা সাদিফের ঠোঁটদুটো নড়ে ওঠে, বলতে শোনা যায়,
” হয়ত আমার হৃদয়ের খুব বাজে একটা নেশা হয়েছে আজকাল। সারাজীবনের জন্যে সে আক্রান্ত হতে চাইছে বিশেষ কোনও রোগে। জানেন,সেটা কী?’

মারিয়া ঢোক গিলল। কম্পিত গলায় শুধাল,
‘ ককী?’

সাদিফের ওষ্ঠযূগল জড়োতাহীন এসে ঠেকল তার কানের পাশে।
ফিসফিসে কণ্ঠে,সেতার বেজে উঠল,
‘ ম্যালেরিয়া!’

ধড়াস করে লাফিয়ে উঠল মারিয়ার ক্ষুদ্র বুক। দৃষ্টিতে অবিশ্বাস,মূঢ়তা।
সাদিফ স্বীকারোক্তি দিলো,
‘ এই রোগ কোনও পথ্যে সাড়বেনা। কোনও ডাক্তার দেখবেনা। এর চিকিৎসা শুধু একটাই,আপনি! আপনার ভালোবাসা! আপনার কাছে আসা!’

মারিয়ার পা টলছে। হাঁটু কাঁপছে। অগোছাল ভঙিতে চোখ নামাতেই,
সাদিফ বলল,
‘ আর কত নিজেকে লুকোবেন ম্যালেরিয়া? অনেক আগেই যে ধরা পরে গিয়েছেন আপনি ।’

বলতে বলতে তার গরম ডান হাত উঠে গেল মারিয়ার কপোলে। আঁকড়ে ধরল কোমল স্থান। শিরশিরে অনুভূতিতে গাঁট হয়ে নিভু চোখে চাইল মারিয়া। সাদিফ কণ্ঠ গভীর করে বলল,
‘ বলতে পারেন না,আপনি আমায় ভালোবাসেন?’

দুটো খাদযুক্ত দৃষ্টিতে মিশে গেল মারিয়া। স্বকীয়তা খোয়াল। গুলিয়ে ফেলল নিজেকে। অলিন্দের গুপ্ত প্রেম, জোয়ারের ন্যায় ফুলে উঠল চোখে। সাদিফের উষ্ণ হাতের ওপর হাত ছোঁয়াল সে। টলমলে চোখে চেয়ে স্বীকার করল,
‘ বাসি। খুব ভালোবাসি!’

সাদিফ তুষ্ট হাসে। নীলগিরির চোখ ধাঁধানো রূপের ন্যায় পবিত্র দেখাল সেই হাসিটা।
বলল, ‘ তাহলে কেন আগে বললেন না? কীসের এত ভয়? আপনিই না একদিন বলেছিলেন, ভালোবাসলে স্বীকার করার সাহস থাকা উচিত!’

মারিয়া চোখ নামাল। ভণিতাহীন বলল,
‘ ভয় নয়,বাস্তবতা। আমি আপনাকে ভালোবাসলেও,আমার ভালোবাসার কোনও ভবিষ্যত নেই সাদিফ। আপনাকে পাওয়ার মত অতটা সৌভাগ্যবতী হয়ে জন্ম হয়নি আমার।’

‘ কে বলেছে?’
মারিয়া চোখে জল সমেত হাসল। সাদিফের হাত গাল থেকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
‘ জানি। আপনার সাথে আমাকে যায় না। কোথায় আপনি! আর কোথায় আমি!’

ব্যাথতুর কণ্ঠের গুরুতর কথাটাতেও হেসে উঠল সাদিফ। পরপর অগাধ করল চাউনী,বলল,
‘ অতীতে আপনি কোথায় ছিলেন আমি জানিনা। তবে বর্তমান আর ভবিষ্যতে,

থামল,বুকের বাম পাশে আঙুল তাক করে বলল,
‘ ইনশাআল্লাহ, ঠিক এইখানে থাকবেন।’
মারিয়ার কণ্ঠ বুজে এলো কান্নায়। ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজে বলল,
‘ আপনি বুঝতে পারছেন না সাদিফ! জীবন এসব আবেগ দিয়ে চলেনা। কেউ মেনে নেবেনা এই সম্পর্ক। আপনার পরিবার সবার আগে মানবেনা। আমি এখন নিজেকে যতটুকু সামলেছি,আপনাকে পেয়েও যদি হারাই, এটুকুও পারবনা। আমি আপনার মত সবল নই। এত মনের জোর আমার নেই। তাই ভুল করেও আশা রাখিনা, আপনাকে পাব। কিংবা পাওয়া সম্ভব।’
বিরতি নিতেই সাদিফের অদ্ভূত প্রশ্নবাণ তেড়ে আসে,
‘ আমাকে ভরসা নেই, তাইত!’

মারিয়া ব্যস্তভাবে হা করল। থামাল সাদিফ,বলল,
‘ কিছু বলতে হবেনা,আমি বুঝি।
ভীতু সাদিফকে ভালোবেসেছিলেন,ভরসা না করাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই সাদিফ যে বদলেছে ম্যালেরিয়া। চারপাশের সমস্ত কিছুতে পরিবর্তন হয়েছে তার স্বত্তার। ভাইয়ার থেকে শিখেছে,কীভাবে জাহির করার ক্ষমতা রাখতে হয়। মন,মস্তিষ্ক, জ্বিভ,বাক্য এক রেখে কথা বলতে হয়। আজকের সাদিফ ভয় পায়না। বরং জানে,ভালোবাসা নিজের করে রাখার সঠিক পন্থা কী! ‘

‘ কিন্তু…
‘ আর কোনও কথা নয়… আসুন.।’
অবিলম্বে ওর হাতে টান বসাল সাদিফ। হাঁটা ধরল হনহনে কদমে। মারিয়া বিভ্রান্ত,শঙ্কিত হয়ে শুধাল,
‘ কোথায় যাব?’
সাদিফের ফিরতি জবাব এলো না। শুধু টেনেটুনে ওকে নিয়ে নেমে গেল নীচে।

***
‘ কী গো! এখনও হয়নি তোমার? রাত কয়টা বাজে দেখেছ? আলোটা নেভাও। ঘুমাব না?’

উত্তর এলো,
‘ আরে আসছি। হয়ে গেছে, এক মিনিট।’
আজমল বিড়বিড় করলেন,
‘ দশ মিনিট ধরে এক মিনিট এক মিনিট শুনছি।’

মাথায় তালু ভরে তেল দিয়েছেন জবা। সারাদিনের কাজ কর্মে একটু দূর্বল লাগছিল! চুল আচড়ে হাতখোপা করে আলো নেভালেন। একটু শান্তি মতো চোখ বুজলেন আজমল। উনিও ক্লান্ত! আয়োজন ছোট হোক,বড় হোক,খাটাখাটুনি কম যায়নি কারো!
জবা কেবল শুলেন,ওমনি ঠকঠক শব্দ হলো দরজায়। আজমল চোখ মেললেন। ঘুমের ব্যাঘাতে বিরক্ত হলেন বটে!
‘ এখন আবার কে এলো?’

উঠতে নিলে জবা বললেন,
‘আমি দেখছি,তুমি ঘুমাও।’
আজমল বললেন,
‘ না। সারাদিন অনেক খেঁটেছ। শুয়ে পড়ো। আমিই দেখছি।’

ছিটকিনি নামিয়ে, দোর টানতেই ওপাশে সাদিফকে দেখা গেল। অসময়ে ছেলেকে দেখে কিছু অবাক হলেন আজমল।
সাদিফ শুধাল,’ ঘুমিয়ে পড়েছিলে?’
আজমলের নজর তখন ওর পেছনে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ানো মারিয়ার ওপর। তারপর ছেলের দিক ফিরলেন,শুধালেন,
‘ তোমরা হঠাৎ? কিছু হয়েছে?’

জবার শুয়ে থাকা হলো না। কৌতুহলে নেমে এসে স্বামীর পাশে দাঁড়ালেন। প্রথমেই ওনার চোখ পড়ল মারিয়ার দিকে। তার দৃষ্টি মেঝেতে। চিবুক গলায়। থরথর করে কাঁপছে।
জবা কিছু বুঝতে না পেরে বললেন,
‘ কী হয়েছে?’

সাদিফ কিছু বলল না। উত্তর হিসেবে মারিয়ার হাত ধরে পেছন থেকে নিজের পাশে আনল। মেয়েটার শরীর অত্যধিক গুটিয়ে এলো এতে। বিষয়টায়, আজমল -জবার চেহারায় বিস্ময় দেখা যায়। দুজনেই হতবাক হয়ে ওদের হাতের বাঁধন দেখলেন।

সাদিফ জ্বিভে ঠোঁট ভেজাল। চোখ বুজে ভারী দম ছাড়ল। সরাসরি মা-বাবার দিক চেয়ে, ফটাফট বলল,
‘ আমি মারিয়াকে বিয়ে করতে চাই।’

নিমিষে নিস্তব্ধ হয়ে পড়ল সব। মারিয়া কম্পিত হৃদয় এবার আঁতকে উঠল ভ*য়ে। সাদিফের মুঠোয় রাখা হাতটাও থরথর করে কাঁ*পছে।
জবা-আজমল কিংকর্তব্যবিমুঢ়! মূর্তি বনে গেলেন দুজন। চেহারায় প্রবল অবিশ্বাস নিয়ে
একে-অপরকে দেখলেন। আজমল নিশ্চিত হতে শুধালেন,
‘ কী?’
সাদিফের চোখে-মুখে দৃঢ়তার ছাপ। অবিচল জবাব দিল,
‘ আমি মারিয়াকে বিয়ে করতে চাইছি। ‘

পরপর বলল,
‘ মা,বাবা…
আমি জানি, তোমরা ভীষণ অবাক হচ্ছো আমার কথা শুনে। ভাবছো, কেন হুট করে ওনাকে বিয়ে করতে চাই! হয়ত বলবে, এটা আমার ফ্যান্টাসি,কিংবা ইনফ্যাচুয়েশন! কিন্তু আমিতো আর ছোট নেই। ফ্যান্টাসি আর আকর্ষণের মধ্যকার তফাৎটা আমি বুঝি। হুট করে বিয়ের মত সিদ্ধান্ত নেব,এমন ইমম্যাচিউরও আমি নই। আমি এই ক মাসে অনেক ভেবেছি। বারবার ভেবেছি। প্রতিটা সেকেন্ড নিজের মস্তিষ্ক আর হৃদয়কে চাপ দিয়েছি সঠিক উত্তরের জন্য। একটা বার সে উত্তরের এদিক ওদিক করেনি। প্রতিবার,একেকটা ভিন্ন কাজেও আমাকে ইঙ্গিত দিয়েছে,আমার খুশি মারিয়া। আমার আনন্দ মারিয়া। আমি ওর সাথে থাকাকালীন যতটা ভালো থাকি,এর আগে এতটা ভালো,আনন্দে আমি কারো সাথে থাকিনি। নিজেকে যতটা মুক্ত মনে হয় ওর সঙ্গতে,এমনটা কোনওদিন হয়নি। যে মানুষটা আমার খুশির কারণ,তাকে সারাজীবন আমার কাছে স্বার্থপরের মত রেখে দিতে চাই। তোমরাও কী চাইবেনা? তোমাদের ছেলে একটু সুখে থাকুক! ‘

মারিয়ার চোখের জল গালে এসে গড়ায়। পায়ের আঙুল গুলো সেঁটে নেয় মেঝেতে। খুব ইচ্ছে করল একবার সাদিফের দিকে তাকানোর! পারল না! কেন যেন সাহসেই কুলোচ্ছেনা আজ।

জবার দু চোখ ছাপানো বিস্ময়। তিনি শুধু হা করে ছেলের মুখ দেখছেন।
আজমল কিছু বলতে চাইলেন। এর আগেই সাদিফ বলে ওঠে,
‘জানি, তোমরা কী বলবে! মারিয়ার অবস্থা আমাদের ধারেকাছেও নেই। আমাদের মত ধন দৌলত নেই। না অবস্থাসম্পন্ন পরিবার ওদের! কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি বাবা। বলতে গেলে,প্রথম বার নিজে থেকে সাহস করে একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি ওনাকেই চাই,তা সে যেভাবে হোক!’

জবা পল্লব ঝাপটালেন।
তিনি কি ঠিক দেখছেন? ঠিকঠাক শুনছেন? এটা সেই সাদিফ! যে আজ অবধি নিজে থেকে একটা কিছু চায়নি। নিজ সিদ্ধান্তে এক পাও বাড়ায়নি কোথাও। সে আজ বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বিয়ের কথা বলছে? তাও এতটা অনড় গলায়? তার নরম ছেলে এত শক্ত হলো কবে? কী করে?

সবার নিশ্চুপতার মাঝে,আজমল মুখ খুললেন। গমগমে গলায় শুধালেন,
‘ আর কিছু বলার আছে তোমার?’
এতগুলো কথার পিঠে এই উত্তর আশাতীত। সাদিফ বিভ্রান্ত হয়।
আজমল সহসা ডাকলেন,
‘ মারিয়া!’
মেয়েটার কাঁটার মত শক্ত হওয়া শরীরটা এবার নড়েচড়ে উঠল। তাকালোনা,শুধু আস্তে জবাব দিল,
‘ জজি…’

‘ অনেক রাত হয়েছে। ঘুমোও গিয়ে।’
সাদিফ বলতে গেল,’ কিন্তু বাবা…’

আজমল হাত উঁচালেন। বললেন,
‘ এতক্ষণ তুমি বলেছো,শুনেছি। এবার যাও। রাত তিনটে বাজে,ঘুম নষ্ট করে এসব শুনব,আমরা নিশ্চয়ই তোমার মত ছেলেমানুষ নই!’

জবা বেগম ঘাবড়ে গেলেন, স্বামীর থমথমে কণ্ঠে। তিনি কি মেনে নেবেন না ওদের? তার নিজের তো আপত্তি নেই। ছেলে যা চাইবে,তাই হোক। মারিয়া কেন,সাদিফ এইভাবে যে কোনও প্রান্ত থেকে মেয়ে নিয়ে এলে,বিনাবাক্যে মেনে নেবেন তিনি।

কারো কিছু বলার আগেই, ওদের মুখের ওপর ধড়াম করে দরজাটা লাগিয়ে দিলেন আজমল। শব্দে মারিয়ার শীর্ণ বুক ছ্যাত করে উঠল। জবা বেগম উদ্বেগী হয়ে বলতে নিলেন,
‘ তুমি…’
আজমল সতর্কভাবে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ থাকতে বোঝালেন।
জবা থামলেন,পরপর কণ্ঠ নীচে এনে বললেন,
‘ তুমি কি ওদের সম্পর্ক মানবেনা? মারিয়াকে আমি মোটামুটি চিনি। মেয়েটা ভীষণ ভালো! ও…

পথিমধ্যেই হেসে ফেললেন আজমল। জবার কথা আটকে গেল এতে। তিনি ভ্রু নাঁচিয়ে বললেন,
‘ কী ভাবো আমাকে হ্যাঁ ? আমি এত শক্ত মানুষ? জীবনে প্রথম বার আমার ছেলে মুখ ফুটে এসে কিছু চাইল,আমি দেব না?’

দুশ্চিন্তার ভারী পাথরটা বক্ষ থেকে সুড়সুড় করে নেমে গেল জবার। ঠোঁটে হাসির ফোঁয়াড়া এনে বললেন,
‘ সত্যি বোলছো?’
আজমল বললেন, ‘ হ্যাঁ। কিন্তু ওকে এখন বুঝতে দিওনা। একটু নাটক কোরো যেন আমরা খুব রেগে গেছি।’
জবা মুখ বেঁকালেন ওমনি।
‘ পারব না! তোমরা ভাইয়েরা সবকটা এমন কেন? ছেলেগুলোকে নাস্তানাবুদ করার একটা সুযোগও ছাড়তে চাওনা না? নাটক তুমি করো গিয়ে,আমার দ্বারা সম্ভব না বাপু!’

***
সাদিফ মেঝের দিক চেয়ে ঠোঁট কা*মড়াচ্ছে। চোখেমুখে গাঢ় দুশ্চিন্তা!
মারিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অসহায় কণ্ঠে বলল,
‘ কী দরকার ছিল এসবের? কেউ মানবেনা আমি আগেই জানতাম!’

সাদিফ চোখ তুলে চাইল। মারিয়ার গালে জলের দাগ বসেছে। কী মলিন মুখশ্রী! ওর চিন্তা কমাতে বলল,

‘ এসব নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবেনা। এতটা পথ যখন এসেছি,ইনশাআল্লাহ বাকীটা পথ ও ঠিক খুঁজে নেব আমি।’
‘ কিন্তু…

সেই সময় দরজা খুলল ফের। শব্দে কথা থামাল মারিয়া। আজমলের মুখটা বেরিয়ে এলো বাইরে। তিনি একবার করে দুজনকে দেখলেন। চেহারার গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন,
‘ ঘুমোতে যেতে বলেছি না তোমাদের? এখনও দাঁড়িয়ে আছো? ‘
মারিয়া ঢোক গিলে মাথা নোয়াল।
ঘুরতে পা বাড়াবে,আজমল বললেন,
‘ আপাতত কথা শুনব না বলেছিলাম,এর মানে এই নয় যে, বলেছি তোমাদের বিয়েতে আমার আপত্তি আছে।’

মারিয়া চমকে তাকাল। সাদিফের নিস্পৃহ বদন জ্বলজ্বল করে ওঠে। আজমল, মারিয়াকে বললেন,
‘তোমার মায়ের সাথে কথা বলে নেব,কেমন? ‘

তার ঠোঁটদ্বয় দুই মেরুতে। চাউনীতে অবিশ্বাস! অথচ ওষ্ঠপুটের আনাচে-কানাচে হাসির বাণ ছুটল সাদিফের। ত্রস্ত গিয়েই জড়িয়ে ধরল বাবাকে।

‘ থ্যাংক ইউ বাবা! আমি জানতাম তোমরা অমত করবেনা।’
আজমল পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন,
‘ যে ছেলে কোনওদিন সামান্য একটা বায়না করেনি আমার কাছে, সেই ছেলে নিজের সুখ চাইতে এলো আমার দরজায়। তাও প্রথম! আমি কেন? পৃথিবীর কোনও বাবার সাধ্য আছে তাকে না করার?’

জবা প্রশান্ত শ্বাস ফেললেন। পরপর নিস্তব্ধ মারিয়ার দিক চেয়ে বললেন,
‘ তুমি দূরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? এসো!’

মারিয়া ঠোঁট চেপে ধরে। টলমলে নেত্রে,এগিয়ে যায় গুটিগুটি কদমে। জবার পা ছুঁতে গেলেই, আকড়ে ধরলেন তিনি। মাথায় হাত বোলালেন। কিছু না বললেও,হাসি আর কোমল চাউনীতেই সব উত্তর বেরিয়ে এলো যেন।
হঠাৎ কী ভেবেই ছেলের দিক ভ্রু গুটিয়ে চাইলেন। প্রশ্ন ছুড়লেন,
‘ এখন কি তুইও এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে করতে চাইবি না কী?’
সাদিফ বলল,
‘ না না। আমিতো শুধু তোমাদের জানিয়ে রাখলাম। বাকীটা তোমরা তোমাদের সুবিধেতেই কোরো। আমাদের তাড়াহুড়া নেই।’

জবা বুকে হাত দিয়ে বললেন,
‘ যাক! বাচালি! নাহলে, সিকদার বাড়ির ছেলেদের ত বিয়ে পাগল হিসেবে নাম রটে যেত।’
হেসে ফেলল মারিয়া। তার হাসি শব্দহীন রইলেও,আজমল আর সাদিফের হাসি স্বশব্দে বেরিয়ে আসে। ঝুমঝুম করে আওয়াজ তোলে দেয়ালের চার কোণায়।

****
মারিয়ার পায়ের গতি বিনম্র। পাশে হাঁটছে সাদিফ। কক্ষের সামনে এসে থামল দুজন। আড়চোখে চাইল মারিয়া। ঠোঁটের কোনার মৃদূ,মুচকি হাসির জৌলুশ। চোখাচোখি করে,দৃষ্টি ফিরিয়ে, ভেতরে ঢুকল। ফের ঘুরে চেয়ে বলল,
‘ গুড নাইট!’
সাদিফের হাস্যজ্বল বদন আরো প্রকট হয়। খুব অল্প সময়ে মারিয়ার পুরো মুখের ওপর চলে চোখের বিচরণ। নিজেও,ঠোঁট নেড়ে জানায়,
‘ গুড নাইট।’

******
কক্ষের জানলাগুলো বন্ধ। ঝুলছে সফেদ রঙা মোটা পর্দা। সূর্য তার তূখোড় আলো প্রবেশ করাতে, ফাঁকফোকর হাতিয়ে ব্যর্থ হয়েছে অনেকক্ষণ। কেবল এসির ঝিমঝিম শব্দ শোনা যায়। আওয়াজে দোদুল্যমান কামড়া। বাইরে দোয়েলের কলতান।
পিউয়ের ঘুম ভাঙল তখন। কিন্তু নেত্রপল্লবে তন্দ্রার রেশ স্পষ্ট।
টেনেহিঁচড়ে দুটো চোখ খুলল সে। ঘুমিয়েছেই ফজরে। এখন কটা বাজে! প্রতিদিন বাইরের আলো দেখে বুঝতে পারে,আজ ঈষৎ অন্ধকারে ঠাওর করতে পারল না। শক্ত বালিশ থেকে মাথা তুলতে চাইল। আর ওমনি ঠুকে গেল কারও থুতনিতে।

পিউ মাথা চেপে হকচকিয়ে চাইল। খুঁজে পেল ধূসরের তামাটে মুখ। পল্লব কম্পিত হলো সবেগে। ও,ওর তো বিয়ে হয়েছে কাল! ধূসর ভাই ওর স্বামী! এটাত ওনারই ঘর।
ধূসরের চোখ আর কপালে ভাঁজ পড়েছিল ঠোকা লাগায়। গতিতে আবার শিথিল হয়েছে। কিন্তু ঘুম ভাঙেনি। ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ আসছে কানে।

পিউয়ের খেয়াল পড়ল নিজেদের দিক। একই কম্বলের আড়ালে, দুটো নগ্ন শরীর একে অন্যতে মিশে। গায়ে একটা সুতোও নেই দেখে হাঁসফাঁস করে উঠল লাজে। রাতের উত্তপ্ত চিত্রপট ভেসে উঠল চোখে।
লজ্জায় দুটো গাল ফুলেফেঁপে একাকার হলো। নিভু,কুণ্ঠিত লোঁচনে চাইল ধূসরের পানে।
তার নিদ্রিত,তেলতেলে চেহারা দেখে চাউনীতে লেপ্টে এলো মুগ্ধতা।
পিউ গালে, হাত ঠেস দিয়ে চেয়ে থাকে। বরাবরের মত ঐ মুখখানি,তার নিবিষ্ট ধ্যান কেঁড়ে নেয়। কাল তো ঠিকঠাক তাকাতেও পারেনি। শেরওয়ানী পরিহিত ধূসর ভাইকে দেখতে গেলেই দুনিয়ার সকল লজ্জা এসে গ্রাস করেছে ওকে।
রাতে মন ভরে দেখবে ভাবলেও,ধূসর ভাই হতে দিলেন কই! তার যে বড্ড তাড়াহুড়ো!
পিউয়ের অবাক লাগে ভেবে,যে মানুষ বিয়ের আগে ভালো করে তাকায়নি অবধি,একটা মিষ্টি কথা বলেনি, সে বাসর ঘরে কী অধৈর্য!

সজাগ ধূসরের চোখে- চোখ মেলাতে ব্যর্থ পিউ, ওর ঘুমানোর সুযোগ লুফে নিলো। নরম, ওষ্ঠ এগিয়ে চুমু বসাল গালে। একে একে কপালে,নাকে,ওপাশের গালে,চিবুকে। তারপর নেমে এলো,ওর উন্মুক্ত বুকে। পরপর, চুমু বসাল ধূসরের পাতলা ঠোঁটের ওপর।
ঐদিনের মত সরে গেলনা,বরং ভীষণ গাঢ় এই স্পর্শ। হাসল,ধূসরের কানের কাছে মুখ নিয়ে, ফিসফিস করে বলল,
‘ সিকদার ধূসর মাহতাব,আমি আপনাকে ভালোবাসি!’
আচমকা চোখ মেলল ধূসর। ঠিক আগের মত তড়াক দৃষ্টি। পিউ চমকে যায়। কিচ্ছু বোঝার পূর্বেই ধূসর তাকে ছিটকে ফ্যালার মতন শুইয়ে দিলো। ওপরে, আধশোয়া হলো মুহুর্তে ।
পিউয়ের চক্ষু বেরিয়ে এলো প্রায়।
ভয় পেয়েছে!
ধূসরের ঘুম ঘুম চোখ। শৈলপ্রান্ত গোটানো। এলোমেলো চুল। ভাঙা,নিরেট স্বরে বলল,
‘ ঘুমোচ্ছিলাম ভালো লাগেনি? মুড এসেছে এখন,কিছু করার নেই। ‘
ভ্রু নাঁচানো, নীরব হুম*কিতে ঢোক গিলল পিউ। ঠোঁটের নরম ত্বকে, ঘনিষ্ঠ ছোঁয়ায়,ইন্দ্রিয়গোচর হলো আরেকটি সুপ্ত সুখের ঘূর্নিঝ*ড়ের আভাস।

***
ধূসরের অসামাল উৎপীড়ন থেকে,পিউয়ের রেহাই পেতে পেতে বেলা গড়াল। মৃদুমন্দ রূপ থেকে, রৌদ্রের তাপ প্রখর হলো।

বেসিনের আয়নায় চোখ পড়তেই, হা করে ফেলল ঠোঁট । ফর্সা ত্বকের একটু জায়গা যদি ফাঁকা পাওয়া যায়! রক্ত লাল, দাগ গুলো দেখে
পিউ আই-ঢাই করে উঠল। লজ্জায় দুহাতে মুখ ঢেকে হেসে ফেলল। হঠাৎ সচকিতে আয়না দেখল ফের। এ বাবা! বাড়িতে এত লোক!
এত আত্নীয়-স্বজন! ওদের সামনে এই মুখ নিয়ে যাবে কী করে?
মাথায় হাত দিলো পিউ। ঠোঁট উলটে, নিঃসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে রইল।

সময় নিয়ে বের হলো পিউ। শাড়ি পরেছে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে কুচি ঠিকঠাক করল। আয়না ভেদ করেই চাইল বিছানার দিক। ধূসর আবার ঘুমিয়েছে।
সে বিড়বিড় করল,
‘ আমাকে বিপদে ফেলে,নিজে কী আরামে ঘুমোচ্ছে!’
ভেঙচি কা*টল। চিন্তিত ভঙিতে পায়চারি শুরু করল। এখন কীভাবে বাইরে যাবে, এটাই হচ্ছে কথা। গায়ের দাগ কম দেখা গেলেও,মুখের দাগ গুলো কী করবে?

তার চিন্তার মধ্যেই, দরজায় কড়া পড়ে। পুষ্প ডাকছে
‘ পিউ উঠেছিস? ‘
পিউ থামল। চটজলদি মেঝেতে ছড়ানো কাপড় তুলে ওয়াশরুমে রেখে এলো।
ইয়া বড় একটা ঘোমটা টানল মাথায়। যাতে নাকের ছিদ্রও ঢেকে গেছে।

ফের একবার আয়না দেখে দরজা খুলতে এগোলো। পুষ্প কিছু বলতে চাইল, এর আগেই পিউয়ের বেশভূষা দেখে অবাক হয়ে বলল,
‘ এ কী! ঘোমটা টেনেছিস কেন? এটা কি তোর শ্বশুর বাড়ি? ‘

পিউ আমতা-আমতা করে বলল,
‘ হ্যাঁ। মেজো মা আমার শ্বাশুড়ি না? একটা ভদ্রতা তো আছে।’
পুষ্প বলল,
‘ তাই বলে এত…..’
‘ নতুন বউ না আমি? আমার বুঝি লজ্জা নেই। ঘোমটা দিলে বড়ই দেওয়া উচিত। ‘
পুষ্প হার মানল। মেনে নিলো ওর যুক্তি। গলা উঁচিয়ে ধূসরের উদ্দেশ্যে বলল,
‘ ভাইয়া! নাস্তার টেবিলে সবাই অপেক্ষা করছে,খাবেনা এখন?’
ধূসরের কণ্ঠে,জড়ানো জবাব,
‘ আসছি, যা।’

***

নাস্তার টেবিলে বসেই সাদিফের সঙ্গে চোখাচোখি হলো মারিয়ার। সাদিফ ভ্রু উঁচাতেই, লাজুক ভঙিতে চোখ নামাল সে। আর তাকালোইনা।

রোজিনা তখন বললেন,
‘ তুইত অফিস যাবি,আমাকে নামিয়ে দিতে পারবি? ‘

মারিয়া কিছু বলার আগেই মিনা বললেন,
‘ সে কী আপা! আজকেই যাবেন কেন? দুটোদিন বেড়াবেন না?’
তিনি বললেন,
‘ না আপা,আবার আসব। এবার যাই।’
আমজাদ বললেন,
‘ আপনাকে আমাদের বাড়ির গাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে।’
‘ ঠিক আছে। ‘
সাদিফ খেতে খেতে মায়ের দিক চাইল। জবাও তাকালেন। ভাবলেন, কিছু লাগবে হয়ত। কিন্তু ছেলে চোখ দিয়ে ইশারা করল। যার অর্থ,রোজিনার কাছে কথাটা তুলবে কখন?

জবা বেগম দুপাশে মাথা নাড়লেন৷ আস্তে আস্তে বাড়ির সবকটা ছেলেমেয়ে নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছে। তার সাদিফটাও শেষে কী না বিয়ের জন্য পাগলাটে!
এত মানুষের মধ্যে মুখ খুললেন না। নিজেও দৃষ্টি দিয়ে বোঝালেন,
‘পরে।’

সাদিফ বাধ্য ছেলে বরাবর! ‘আচ্ছা’ বোঝাতে ঘাড় কাঁত করল। খাওয়া শেষে মারিয়ার দিক চায়। যেই মাত্র ও তাকায় নীরবে ইশারা করে,
‘ আসুন।’
মারিয়ার খাওয়া হয়নি। সাদিফের ‘আসুন’ বলার পরে হলোও না আর। অর্ধেক পথে উঠে দাঁড়াতেই, রুবায়দা বললেন,
‘ কী ব্যাপার! খেলেনা যে!’
‘ ইয়ে,দেরি হয়ে যাচ্ছে আন্টি।’

সাদিফ ততক্ষণে বেরিয়ে গেছে। মারিয়া সবার থেকে বিদায় নিয়ে সদর দরজা অবধি আস্তে আস্তে এলো। চৌকাঠ মারিয়ে, ওদের আড়াল হতেই ছুটে গেল বাইরে।

সাদিফ বাইকে তৈরি হয়ে বসে। মারিয়া কাছাকাছি এসে থামল,দুরন্ত পা সামলে ধীরে ধীরে এসে দাঁড়াল। সাদিফ তাকায়। মারিয়ার ফেঁপে থাকা গাল দুটো দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসে। ফট করে বলে বসে,
‘ এত লজ্জা পাচ্ছেন কেন ম্যালেরিয়া? মনে হচ্ছে কাল বাসর ঘরে পিউ আর ভাইয়া নয়,আপনি আর আমি ছিলাম।’

মারিয়ার কুণ্ঠিত বদন উবে গেল । চাইল হতভম্ব চোখে।
পরপর নাক ফুলিয়ে বলল,
‘ ছি! আপনি কী অসভ্য!’
সাদিফ কাঁধ উঁচায়,
‘ আমার কী দোষ? আপনি কাল থেকে এত লজ্জা পাচ্ছেন দেখে বললাম।’
‘ এত কিছু বলার দরকার নেই। দেরী হচ্ছে,চলুন।’

মারিয়া ব্যাক সিটে বসল। হাত রাখল কাঁধে। সাদিফ স্টার্ট দেয়। কিছু পথ গিয়েই, ইচ্ছে করে, গতিপূর্ণ ব্রেক কষল।
ফলাফল, মারিয়া আ*ছড়ে পরল ওর পিঠের ওপর। দুষ্টু হাসল সাদিফ। কণ্ঠে তেমন দুষ্টুমি রেখেই বলল,

‘ কী আশ্চর্য! রাস্তাঘাটে এভাবে ছেলেদের গায়ে পরছেন? এসব কী উচিত!’
মারিয়া ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
‘ ইচ্ছে করে করেছেন এরকম,বুঝিনা আমি?’
সাদিফ শব্দ করে হেসে ওঠে। একবার ভিউ মিররে চোখা-চোখি হয় দুজনের। বাইক চলতে থাকে,তবে গন্তব্য আছে এর। কিন্তু বাইকে বসা মানুষ দুটোর সদ্য জোড়া লাগা মন,কেবল উদিত এই ভালোবাসার গন্তব্য নেই। অনন্ত কাল,অনন্ত বছর,আর শতাব্দী পেরিয়েও কিছু ভালোবাসা কমেনা। হাওয়ার ন্যায় নিরন্তর ছোটে।
এখানে,তিন জোড়া শালিকের গল্প কিছুটা তেমনই।

চলবে….

#এক_সমুদ্র_প্রেম!
কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(৬৪)

সিকদার বাড়ির খাবার টেবিলটা বেশ লম্বা আর বড়। পরিবারের এত এত লোক যাতে আরামসে, একসাথে বসে খেতে পারে, তাই ফ্যাক্টরি থেকে পছন্দ করে বানিয়ে আনা এটি। প্রথম প্রথম লোকসংখ্যা কম ছিল,আস্তে আস্তে বাড়ল। ভাইয়েদের সন্তান এলো। আর এখন মেহমানদের একসাথে বসানোরও জায়গা হচ্ছে না। তাই,ওই টেবিলের সঙ্গে আরো একটি টেবিল আলগা ভাবে বসানো হয়েছে।
সবার খাওয়ার মধ্যে,পিউকে দেখেই আফতাব হৃষ্ট কণ্ঠে আওড়ালেন,
‘ আরে,আমার বউমা আসছে যে!’

পিউ লজ্জা পেলো। সবার দৃষ্টি ওর দিক পড়তেই মাথার ঘোমটা টেনে নিলো আরেকটু। মুচকি হেসে কাছে এলে আফতাব চেয়ার টেনে বললেন,
‘ আজ আমার বউমা আমার পাশে বসবে। ‘
বসল পিউ। চাচার মুখে বউমা শব্দটায় ওর খুশিতে হুশ হারানোর জোগাড়। এত কিউট লাগছে কেন শুনতে? ভেতর-বাহির শীতল হয়ে যাচ্ছে একদম! ইশ,কত স্বপ্ন দেখেছিল এই দিনটার! এত দ্রুত সত্যি হবে কে জানত!

কিন্তু রুবায়দা চোখ পিটপিট করে বললেন,
‘ ও পিউ, তুই এত বড় ঘোমটা দিয়েছিস কেন মা?’

শোনা গেল পুষ্পর দীর্ঘশ্বাস। টেনে টেনে জানাল,
‘ কী আর বলি! এটা না কী তার শ্বশুর বাড়ি মেজ মা। সে নতুন বউ,তুমি শ্বাশুড়ি, তোমার সামনে একটা ভদ্রতা আছেনা? ঘোমটা দেবে যখন,নাক চোখ ঢেকেই দিয়েছে।

সবাই হা করে তাকাতেই, উদ্বেগ নিয়ে বলল,
‘ না না, এগুলো আমার কথা নয়,ওনার কথা। ‘

পিউকে ইশারা করল ও। মেয়েটা ঠোঁট উলটে নিয়েছে। কী আজগুবি যুক্তি দেখাল তখন,এইভাবে সবার সামনে আপুর বলে দিতে হলো? পেট পাতলা কোথাকারে!
রুবায়দা আশ্চর্য হয়ে বললেন,
‘ এ আবার কী কথা? আমি কি ওমন শ্বাশুড়ি না কী, যে জামা-কাপড় নিয়ে বলব? আর তার থেকেও বড় কথা, আমি কি নিজেকে ওর শ্বাশুড়ি ভাবি? আল্লাহ! ও পিউ,তুই এই গরমে শাড়িই বা পরতে গেলি কেন? এখন পায়ে বেঁধে পরে-টরে গেলে কী হবে?’

পিউ চুপ করে থাকল। নখ দিয়ে প্লেটের পরোটা খুঁটল। কী বলবে এখন?
এই ঘোমটা যে, তোমার ছেলের দেওয়া চন্দ্রচিহ্নের ফল সেসব কী বলা যায়?
সে যতটা পারছে মাথা নুইয়ে রাখল। পারলে ঢুকে যাবে থালার ভেতর।

মিনা মেয়ের খাবার নড়তে না দেখেই চাটি মা*রলেন মাথায়,
‘ কী রে,খাবার নড়ছেনা কেন? খা।’
পিউ মাথা ডলতে ডলতে বলল,
‘ খাচ্ছি তো।’

সহসা আফতাব প্রতিবাদ করে উঠলেন,
‘ ভাবি আপনি আমার বউমা কে মা*রলেন কেন? ‘

ভ্যাবাচেকা খেয়ে চাইলেন মিনা।
রুবাও তাল মেলালেন,
‘ তাইতো! হিসেব মতো
পিউ এখন শ্বশুর বাড়ি আছে। ও আমার ছেলের বউ। তুমি ওকে মা*রলে কেন আপা?’

মিনা স্বামীর দিক চাইলেন। আমজাদ হাসছেন। তিনি পরাস্ত কণ্ঠে বললেন,
‘ ঘাঁট হয়েছে ভাই! তোমাদের বউমাকে আর মা*রব না। ক্ষ্যমা দাও।’

শব্দ করে হেসে উঠল সকলে। ওপর থেকে ধূসর নেমে এলো তখন। শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে এসে দাঁড়াল টেবিলের কাছে।
গিয়ে বসল একদম পিউয়ের মুখোমুখি,সম্মুখের চেয়ারটায়। খেতে খেতে আড়চোখে একবার ঘোমটা দেওয়া ওর দিক চাইল। সকাল সকাল,তার প্রিয়তমা স্ত্রীর স্নিগ্ধ মুখ আর ভেজা চুল দেখার অভিলাষে। কিন্তু দানবীয় ঘোমটার আড়ালে অত কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

মেয়েটা ঠিকঠাক খেতে পারছেনা। বাম হাতে ঘোমটা ধরে রাখা। সরে গেলেই তো সর্বনাশ! ঠোঁটের ফোলা অংশ ঢেকে রাখার আপ্রাণ প্রচেষ্টাটুকু বুঝে ফেলল
ধূসর। প্লেটের দিক চেয়ে ,স্বল্প,একপেশে,মিটিমিটি হাসল।
ইকবাল ওর পাশেই বসে। সে সবাইকে একবার, একবার দেখে নেয়। আস্তে আস্তে ঠোঁট খানা এগিয়ে নেয় ধূসরের দিক। আঙুল দিয়ে মুখ ঢেকে বিড়বিড় করল,
‘ তোকে ভালো মনে করেছিলাম। কিন্তু তুই…’

ধূসর ভ্রু কুঁচকে চাইল।
‘ কী করেছি?’
ইকবাল সবার কান এড়িয়ে,
চাপা কণ্ঠে বলল,
‘ কী করেছিস আবার প্রশ্ন করছিস? ছিছি! শোন,বিয়ে-সাদিতে আমি তোর সিনিয়র। সব জানি। পিউয়ের ঘোমটার রহস্য বুঝিনা ভাবিস? নিশ্চয়ই মেয়েটাকে চেহারা দ্যাখানোরও অবস্থায় রাখিস নি। ইশ! কী স্বৈরাচারী দৈত্য তুই! ব্রিটিশ রাও তোর চাইতে ভালো ছিল।’

ধূসর হতভম্ব হয়। একেকজনকে দেখে দাঁত পেষে। টেবিলের ওপর বাম হাত রাখা ছিল ইকবালের। ডিম পোচ কা*টার চামচটা আস্তে এগিয়েই, সেখানে চে*পে ধরল ও। চমকে,ছিটকে হাত সরাল ইকবাল। ভরকে বলল,
‘ শালা ডাকাত!’
তার নড়ার তোপে টেবিল নড়ে উঠেছিল। সবাই চাইল ওমনি। পুষ্প শুধাল,
‘ কী হলো? এমন করলে কেন?’
ইকবাল জোর করে হেসে বলল, ‘ কিছুনা,কিছু না।’

চোখ-মুখ শান্ত করে, খাওয়ায় মনোযোগ দেয় সকলে। ইকবাল কটমট করে বলল,
‘ এইভাবে মানুষ মানুষকে মা*রে? যদি চামচটা ঢুকে যেত হাতে?’

ধূসর নিরুৎসাহিত,
‘ গেলে যেত। ব্রিটিশ বন্ধু বানাবি,আর অ*ত্যাচার সহ্য করবিনা?’
ইকবাল আহ*ত চোখে চাইল। সে ফের বলল,
‘ আর তাড়াহুড়োর কথা কে কাকে বলে? যে বিয়ের ছ মাসের মাথায় বাবা হচ্ছে,সে?’

ইকবাল বিস্মিত কণ্ঠে, তেঁতে বলে,
‘ নিজের সিনিয়র কে খোঁচা দিলি? শালা সমন্ধি! অভিশাপ দিলাম তোকে,জীবনে ডিভোর্স পাবিনা।’

ধূসর আড়চোখে চেয়ে,হেসে ফেলল।
আমজাদ শুধালেন,
‘ বের হবে?’
‘ জি।’
‘ এখনই? ‘
‘ না। পরে।’
রুবায়দা বললেন,
‘ কাল বিয়ে করলি,আজকেও বের হবি? আজ অন্তত বাড়িতে থাক।’
‘ দুপুরে চলে আসব।’

আমজাদ ইকবালকে শুধালেন, ‘ তুমিও যাবে না কি?’
ইকবাল অবাক হলো। হিটলার শ্বশুর আবার ওর খোঁজ খবর রাখছে কবে থেকে?
নম্র কণ্ঠে বলল,
‘ জি। পার্লামেন্টে কাজ ছিল।’
‘ ওহ। যেখানেই যাও,দুজনেই দুপুরে ফিরো। পরিবারের সবাই একসাথে খেতে না বসলে মন ভরেনা।’

ইকবালের চোখদুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে। সে হা করে চাইল পুষ্পর দিক। পুষ্প মুচকি হাসে। হাসল ইকবালও। যাক! একটু একটু করে যে শ্বশুর ওকে মেনে নিচ্ছে এটাই অনেক!

আস্তে আস্তে একেকজনের খাওয়া ফুরায়। টেবিল রেখে রুমে যায় তারা। অন্যদের কথাবার্তা চলে। আনিস বের হলেন অফিসের উদ্দেশ্যে। সৈকত আর বর্ষা বিদেয় নিলো।
ধূসর উঠে দাঁড়াল। সবার মধ্যেই, পিউকে বলল,

‘ তোর…
পুরো কথা সম্পূর্ন হলো না। এইটুকু শুনেই, গতিতে জ্ব*লে উঠলেন আফতাব।
‘ আশ্চর্য! তুই -তোকারি করছো কেন? ও এখন তোমার স্ত্রী না? সম্মান দিয়ে কথা বলবে।’

ধূসর পিউয়ের দিক চাইল। ভ্রু তুলে,অবাক হওয়ার ভাণ করে বলল,
‘ তোকে এখন তুমি করে বলতে হবে?’

পিউ অসহায় হয়ে পড়ল। স্বামী আর শ্বশুড়ের তর্কের মাঝে কী বলবে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগল। স্যান্ডউইচ হওয়ার থেকে বাঁচতে মিনমিন করে বলল,
‘ আপনার যা ভালো লাগে, তাই বোলবেন ধূসর ভাই।’

সুমনা তাজ্জব কণ্ঠে বললেন,
‘ ভাই? এখনও ভাই? ওরে তোদের না বিয়ে হয়েছে? এমন করলে বাইরের মানুষ তো সব গুলিয়ে ফেলবে।’
পিউ ফোস করে শ্বাস ফেলল। বাইরের মানুষ কী গোলাবে? ওর নিজেরই সব গুলিয়ে যাচ্ছে। ধূসর ভাইকে ভাই ডাকবেনা বলে একটা সময় কত কী করত! ভাইয়া থেকে কে*টে*ছেটে ভাইয়ে নামল। হাজারখানেক ধমক শুনেও অনড় সে কিছুতেই পিছপা হয়নি। আর এখন মোক্ষম সুযোগ হাতে পেয়েও কিছু হচ্ছেনা? ওনাকে নাম ধরে ডাকার মত কলিজা,সাহস,ইচ্ছে, এখন যেন কোনওটাই নেই। তিন বছরের অভ্যেস কি আর রাতারাতি বদলাবে?
আবার, স্বামীকে যে ভাই ডাকলেও বিপদ! তাহলে কী ডাকবে? সিনেমার মত, ‘ওগো? হ্যাঁ গো,কী গো.. এভাবে?
না না। দেখা গেল অতি আহ্লাদে এসব বললে, ধূসর ভাইও অতি রেগে একখানা চ*ড় বসিয়ে দিলেন। কিংবা রুষ্ট হয়ে ধমকে বললেন,
‘ দূর হ আমার সামনে থেকে!’
তার চেয়ে থাক।

****
সোফায় তখন আন্ডা-বাচ্চাদের আসর। টেলিভিশন চলছে। সদ্য টেলিকাস্ট হয়েছে শাহরুখের নতুন সিনেমা। একেকজন তূখোড় মনোযোগী পর্দায়।
এর মধ্যে জবা বেগম ফালুদা নিয়ে এলেন। তার হাতের ফালুদা এ বাড়ির সবার পছন্দ। মেহমান মিলিয়ে বাড়িতে প্রায় পঁচিশ জন লোকের উপস্থিতি। সবার জন্য বানিয়েছেন।

প্রথমে এসে বাচ্চাদের হাতে হাতে দিলেন। পুষ্পর দিকে বাটি ধরতেই সে বিরস গলায় বলল,
‘ খাব না।’
‘ একটু খা।’
‘ উহু,বমি হবে।’
‘ হলে হবে। তাই বলে না খেয়ে থাকবি? তোর জন্য মিষ্টি কম দিয়েছি। নে…’
জোরাজোরিতে পুষ্প বাটি নিলো। ওপর থেকে সুপ্তি চঞ্চল পায়ে নামল তখন। স্লোগান দিলো,
‘ টাকা পেয়েছি,টাকা পেয়েছি।’
ছুটে সবার কাছে এলো সে। থামল,শ্বাস নিলো। পিউ শুধাল,
‘ কী পেয়েছিস?’
সুপ্তি সোজা ইকবালের হাতে একটা মোটা টাকার বান্ডিল দেয়। জানায়,
‘ ধূসর ভাইয়া দিয়েছেন। বলেছেন, আপনি মুরুব্বি, আপনার হাতে দিতে।’

পুষ্প উচ্ছ্বল কণ্ঠে বলল, ‘ আমাদের গেট ধরার টাকা?’
‘ হ্যাঁ। ‘

ইকবাল মাথা নাঁচিয়ে বলল,
‘ দেখলে,ধূসরটা কত সম্মান দেয় আমাকে? এই হলো আমার বন্ধু। যাই হয়ে যাক,কথার খেলাপ করেনা হু। একটা সন্টামন্টা আমার।’

তার গদগদ ভাব দেখে, পুষ্প বলল,
‘ তোমার বন্ধু পরে,আগে আমার ভাই।’
রাদিফ লাফিয়ে উঠে বলল,
‘ আর আমাদের দুলাভাই।’
রিক্ত হাত তালি দিলো।
একদফা হাসির রোল পড়ল ওমনি।

ইকবাল কড়কড়ে টাকার নোট গোনায় ব্যস্ত হলো। গুনে দেখল ৩৪ হাজার। কপাল কুঁচকে বলল,
‘ এক হাজার কম কেন?’

সুপ্তি দাঁত বের করে জানাল,
‘ বলেছে আপনি মিরজাফর! কাল ওনার সাপোর্ট করেননি। তাই আপনার ভাগ থেকে এক হাজার কাটা ।’
ইকবালের হাসি শেষ। একটু আগেই ধূসরের প্রসংশা করা মুখেই, কটমট করে বলল,
‘ শালা একটা ধাপ্পাবাজ! আমার মত ভালো মানুষের ভাগ থেকে এক হাজার কেটে নিলো? যোচ্চর একটা! ‘

হুহা করে হেসে উঠল ওরা। পুষ্প দুঃখী দুঃখী মুখ করে বলল,
‘ আহারে! একটু আগেই কে যেন বলল সন্টামন্টা? টাকা কম পেয়েই সব ভালোবাসা বেরিয়ে গেল?’

পিউ বলল,’ এখান থেকে আমি কিছু পাব না? আমাকে যে জিম্মি রাখা হয়েছিল,একটা ক্রেডিট তো আমারও তাইনা?’

‘ ইশ! নাক ডেকে ঘুমোচ্ছিলি তুই। কিছুতো টেরই পাসনি। আমরা বাকবিতন্ডা করে টাকা আদায় করে,তোকে কেন দেব?’

‘ এইভাবে বলতে পারলি আপু? বড় বোন হিসেবে দশ টাকা অন্তত দিতে পারতি। খুশি হোতাম।’
সুপ্তি বলল,
‘ তোমাকে খুশি করতে ডেঞ্জারাস ধূসর ভাইয়া আছেন। গরিবের হকে ভাগ বসিওনা। ‘

পুষ্প ভ্রু বাঁকায়,’ ডেঞ্জারাস?’
সুপ্তি মিনমিন করে বলল,
‘ ওনাকে দেখলেই আমার ভ*য় লাগে! কেমন যেন হিং*স্র মনে হয়। খালি পে*টাবে,মা*রবে… বাবাহ! পিউপু যে কীভাবে ওনার সাথে সংসার করার সাহস করল আল্লাহ জানে।’

পিউ ধমকে বলল,
‘ একদম বাজে কথা বলবি না।’
ইকবাল তাল মেলাল,
‘ হ্যাঁ, নো বাজে কথা ক্ষুদে শালিকা! ধূসরকে ওপর থেকে যেরকম দেখতে ভেতরর মানুষটা ততটাই ব্যতিক্রম! যদিও তুমি ছোট, অতশত বুঝবেনা। তাও বলি, ওর মত একটা লোকের সঙ্গ পাওয়া কিন্তু ভাগ্যের ব্যাপার। আর এইদিক থেকে আমি, পিউ দুজনেই লাকি! কী বলো পিউপিউ?’

পিউ হেসে বিলম্বহীন মাথা ঝাঁকাল। পুষ্প ভ্রু গুটিয়ে বলল,
‘ তুই এখনও এমন ঘোমটা দিয়ে আছিস কেন? তোর মুখটাও দেখতে পারছিনা ঠিকমতো। ঘোমটা খোল,তোকে দেখে আমার গরম লাগছে।’

পুষ্প টানতে যেতেই পিউ সরে বসল ওমনি। মাথা নেড়ে বলল,
‘ না, এখন খোলা যাবেনা, পরে।’

শান্তা চুপচাপ। তার এসবে মন নেই। টিভির দিক চেয়ে থাকলেও,চোখেমুখে বিরক্তি। ধূসর-পিউ এদের বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে এখনও কিশোরী হৃদয়ে মেঘের প্রভাব স্পষ্ট।
সে একবার সুপ্তির দিক চাইল। নিস্প্রভ কণ্ঠে শুধাল,
‘ আম্মুকে জিগেস করেছিস, কখন যাব আমরা?’
সুপ্তি মাথা নেড়ে না বোঝাল। কিন্তু পিউ বলল,
‘ আজ যাবি কেন? কাল -পরশু যাস,থাক দুটোদিন।’

শান্তা কিছু বলেনি। নিরুত্তর মাথা ঘুরিয়ে টেলিভিশনের দিক ফেলল।

ইকবাল যার যার ভাগের টাকা,তাকে কড়ায়-গণ্ডায় বুঝিয়ে দিলো। মারিয়া আর সাদিফেরটা গচ্ছিত রাখল নিজের নিকট। এলে দিয়ে দেবে।

পুষ্প সিনেমা দেখার তালে তালে বেশ কয়েক চামচ মুখে দিলো খাবার। ক্ষণ বাদেই, পাঁক খেল নাড়িভুঁড়ি। তৎপর বাটি রেখেই,মুখ চেপে দৌড়ে গেল বেসিনে।
ইকবালের নিজের খাওয়া ওখানেই স্থগিত। ফালুদা রেখে, চপল পায়ে, স্ত্রীর পেছনে ছুটল সেও।

আমজাদরা বসেছিলেন একটু দূরে। দৃশ্যটা চোখে পড়ল ওনার। মেয়ের প্রতি ইকবালের প্রতিনিয়ত এই যত্নে, বিমুগ্ধ হলেন এবারেও। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ভাবলেন,
‘ সেদিন ইকবাল -পুষ্পর বিয়ে দেওয়া, আরেকটা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল আমার। ছেলেটার মত আমার মেয়েকে এতটা ভালো কেউ বাসত কী না, সন্দেহ!’

***
পিউ টিভির দিক হা করে চেয়েছিল। পলক ও পড়ছেনা। যেন একটুখানি পাতা ফেললেই অনেক কিছু মিস হবে।
বিষয়টা, মিনা দেখেই, খ্যাক করে বললেন,
‘ এখনও বসে আছিস কেন? ধূসর ডেকে গেল না? যা ওর ফালুদা ঘরে দিয়ে আয়।’

মনোযোগে ব্যঘাত পেয়ে একটুও খুশি হয়নি সে। মায়ের প্রতি, টলমলে অভিমান নিয়ে বলল,
‘ আপুর বিয়ের পরতো ওর সাথে কী সুন্দর করে কথা বলো! তাহলে আমার সাথে এমন কোরছো কেন আম্মু?’

‘ তোকে বাড়ি থেকে বিদেয় করতে না পারার দুঃখে পাগল হয়ে গেছি। এখন যা,তোরটাও নিয়ে যা।’

পিউ কিছু বলল না। শুধু নীচের ঠোঁট ফুলে উঠল। ট্রেতে কাচের বাটিদুটো তুলে হাঁটা ধরল ঘরের দিক।

******

ধূসর বিছানায় আধশোয়া। ফোনে কিছু একটা দেখছে। তার বেশভূষা পরিপাটি। একটু পরেই বের হবে।
পিউ নরম পায়ে কক্ষে ঢুকল তখন। নূপুরের শব্দে চোখ তুলে চাইল ও । নীল-সাদা মিশেলের তাঁতের শাড়ি পিউয়ের পড়নে। মাথায় ঘোমটা। তা ভেদ করে উঁকি দিচ্ছে ছোট্টখাট্টো মুখ।

ধূসর ফোন পকেটে ভরল। পিউ চোরা দৃষ্টিতে ওকে একবার দেখে ট্রে রাখল টেবিলে। সোজা হয়ে ফিরতেই ধূসর সামনে এসে দাঁড়ায়। স্তম্ভের মতো হঠাৎ ওকে দেখে কিছু চমকাল পিউ। ধাতস্থ হয়ে,
চোখে চোখ রাখতেই মনে পড়ল রাতের কথা,সকালের কথা। স্বীয় বেহায়া চিন্তাভাবনায় নিজেই মিশে গেল মাটিতে।

উশখুশে ভঙিতে মাথা নোয়াল। ওমনি টের পেলো গতরে একটি ঠান্ডা হাতের স্পর্শ। শাড়ির পার ভেদ করে কোমড় আকড়ে ধরেছে।
ধূসর সেখানটা টেনে পিউকে নিজের কাছে আনল। ডান হাত উঠে এলো ওর মুখমন্ডলে। ঠোঁট আর গালের লাল দাগে আঙুল বুলিয়ে, হেসে ফেলল নিঃশব্দে।

পিউ গাল ফুলিয়ে বলল,
‘ খুব মজা না? আমি এই গরমে একটা ঘোমটা দিয়ে ঘুরছি আর আপনি হাসছেন? ‘
ধূসরের চেহারায় পরিবর্তন দেখা গেল না। না কমলো তার হাসি। কোমল হাত ধরে বিছানায় এনে, বসাল ওকে।
ড্রয়ার খুলে মলম বের করল। এসে বসল মুখোমুখি। মলম দেখেই পিউ মাথাটা পিছনে নিয়ে বলল,
‘ না না, জ্ব*লবে!’
‘ কিছু হবেনা, আমি আছি।’

এই এক কথা পিউয়ের সব ভয়-ভীতি উড়িয়ে দিতে সক্ষম। ধূসর যখন ঠোঁট নেড়ে আওড়ায়,’ আমি আছি।’ দু বাক্যের এই লাইনে ভেতর জুড়িয়ে যায় ওর। বক্ষে ভর করে দূর্দমনীয় সাহস।
পিউ পিছিয়ে নেওয়া মস্তক ফের আগের জায়গায় আনল। ধূসর খসখসে তর্জনীতে মলম নিয়ে, ঠোঁটে ছোঁয়াতেই কেঁ*পে উঠল ঈষৎ।
কাঁদোকাঁদো কণ্ঠে বলল ,
‘জ্ব*লছে…’

ধূসর ঝুঁকে এলো। আস্তে আস্তে ফুঁ দিলো সেখানে। চোখে-মুখে যত্নশীলতার স্পষ্ট প্রলেপ! পিউয়ের জ্বা*লাপো*ড়া উবে যায়। চাউনী হয় নিশ্চল। ধূসরের দিক চেয়ে থাকে এক ভাবে। আবিষ্টের মতোন।

ধূসর একে একে গলায়,ঘাড়ে ঠোঁটের আশেপাশে মলম লাগিয়ে শুধাল,
‘ আর কোথাও আছে?’

পিউ মিহি কণ্ঠে জানাল,
‘ বাকীটা আমি লাগিয়ে নেব। ‘
ফোন বাজল তখন। খলিলের নাম ভাসছে স্ক্রিনে। ধূসর দেখল না,বরং না চেয়েই, সাইড বাটন চেপে সাইলেন্ট করল। যেন জানে কার ফোন!

মলমের ঢাকনা লাগিয়ে পিউয়ের হাতে ধরিয়ে দিলো। উঠে দাঁড়াল, দাঁড়াল সেও। ধূসর বাইকের চাবি তোলে। ছোট করে জানায়,
‘ বের হচ্ছি।’

পিউ উদ্বেগ নিয়ে বলল,
‘ ফালুদা এনেছিলাম,খাবেন না?’
‘ তুই খেয়ে ফ্যাল!’
‘ এতগুলো!’
জবাব না পেয়ে বুঝল,আর লাভ নেই বলে । নিজেই জানাল,
‘ দুপুরে কিন্তু একসাথে খাব, মনে আছে তো?’
‘ আছে।’
‘ তাড়াতাড়ি আসবেন।’

ধূসর ফিরে তাকায়। কাছে আসে। কপালে প্রগাঢ় চুমু বসায়। জিজ্ঞেস করে,
‘ আর কোনও সমস্যা হচ্ছে?’
পিউ দুদিকে মাথা নাড়ল। সে বলল,
‘ মনে করে মলমটা লাগিয়ে নিস। এরকম একটু-আধটু দাগ কিন্তু এখন রোজ হবে।’

পিউ লজ্জায় নড়েচড়ে উঠল। এলোমেলো পল্লব ফেলল ডানে -বামে। কুণ্ঠায় রাঙা হলো তার গাল দুটো। যেন হাওয়ায় দোল খাওয়া ডালের রক্তিম কৃষ্ণচূড়ার ঝাঁক। মাথা নুইয়ে নীচু কণ্ঠে বলল,
‘ আপনিতো আগে এমন ছিলেন না ধূসর ভাই! এখন এত নির্লজ্জ হচ্ছেন কী করে?’

ধূসরের বিলম্বহীন,অবিচল জবাব,
‘ আগে কী তুই বউ ছিলি?’
পিউ নিম্নাষ্ঠ চেপে চুপটি করে রইল। লাজুক ভঙি।
ধূসর ‘ আসছি’ বলে বেরিয়ে যায়।

পিউ চেয়ে থাকল যতক্ষন দেখা যায় তাকে। মুচকি হেসে মন্ত্রের ন্যায় আওড়াল,
‘ ধূসর ভাই! আপনার নির্লজ্জতা আকাশ ছুঁয়ে দিক। মেঘ হয়ে ডাকুক। তারপর বৃষ্টি হয়ে গড়িয়ে পরুক আমার সারা শরীরে। ‘

পরপর, হুটোপুটি কদমে ছুটে এসে বারান্দায় দাঁড়াল। ঝুলে পড়ল রেলিং এ। কিছুক্ষণের মাথায় ইকবাল আর ধূসরকে বের হতে দেখা যায়।
বাইক চেপে বসেছে দুজন। ইকবালের ঠোঁট নড়ছে। বিশ্রামহীন বকবক করছে। মুখভঙ্গি সিরিয়াস। হয়ত, এক হাজার টাকা কম পাবার হা-হুতাশ।
ধূসর বাইক স্টার্ট দিতে দিতে কী মনে করে থামল। ঘুরে চাইল এদিকে।
আন্দাজ সঠিক হওয়ার ফলস্বরূপ, পিউকে দাঁড়ানো দেখেই, ঠোঁট দুটো উঠে গেল একপাশে।
পিউ স্ফূর্ত চিত্তে, হাত নেড়ে বিদায় জানায়। ধূসর দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে,বাইক ছুটিয়ে গেট পার হয়।
প্রস্থান দেখে পিউ প্রশান্ত শ্বাস টানল। বাতাসে ওঠানামা করল বক্ষপট।
চলে যাওয়া মানুষটা ওর নিজের। নিজের এই ঘর বারান্দা,এই সংসার।
যা আজ থেকে স্বযত্নে বুকের মাঝে আগলে রাখবে পিউ। ধূসর ভাইকে বিছিয়ে দেবে,এই শীর্ণ হৃদয়ে জমে থাকা এক_সমুদ্র_প্রেমের সবটুকু!

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে