#এক_সমুদ্র_প্রেম!
কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(৬১)
সন্ধ্যে হচ্ছে। তবে আজকের সন্ধ্যে নামার আয়োজন একটু বেশিই ধীর-স্থির । ফট করে সূর্য ডু*বে,অন্ধকার আসেনি। সিকদার বাড়ির কারোরই অবশ্য এই সন্ধ্যে নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। তারা ব্যস্ত,ভীষণ ব্যস্ত বিয়ের তালিকা করতে।
কথা ছিল আজকেই শপিং করতে যাবেন। কিন্তু পরবর্তীতে পিছিয়ে আনলেন সিদ্ধান্ত। বাড়ির কর্তারা একটা দিন বিশ্রাম নিচ্ছেন,এই দিন ঘর খালি করে কীভাবে যাবেন তারা?
যাওয়া হলো না আজ। হিসেব মেলালেন,কাল বের হবেন আরামসে। সুমনা ইউটিউব ঘেটে বেনারসির মতামত নেয়া শুরু করলেন পিউ হতে।
অথচ তাদের এত এত সেগুড়ে উদ্যোগে এক বস্তা বালি ঢেলে সন্ধ্যার পরপরই দুটো প্যাকেট সমেত বাড়ি ঢুকল ধূসর। সাথে সব সময়ের সঙ্গী ইকবালও আছে। সোফায় তখন নারী মহলের সব সময়কার চায়ের আড্ডা। ধূসরের হাতে মোটা মোটা শপিং-ব্যাগ দেখে আলাপ থামল তাদের৷ সে সোজা এসে চায়ের ট্রে সাইডে চাপিয়ে ব্যাগ গুলো রাখল।
মিনা শুধালেন,’ কী রে এতে?’
‘ দ্যাখো।’
বলতে হয়নি,কৌতুহলে সুমনা নিজেই প্যাকেট খুলতে লেগে পরলেন। পিন-টিন ছোটানোর পর যা আবিষ্কার হলো তাতে অত্যাশ্চার্য একেকজন। পটাপট হা করে চাইলেন ওর দিকে। রুবা বললেন,
‘ আমরা তো কালই বের হতাম। তুই আগে আগে নিয়ে এলি?’
‘ শুধু বেনারসিটা আর শেরওয়ানী এনেছি। বাকী যা লাগে সেগুলো তোমরা এনো।’
তিনি ঠোঁট উলটে বললেন,
‘ বুঝেছি, মায়েদের পছন্দে ভরসা নেই। ওইজন্যে এত তাড়া!’
ধূসর একবার পিউয়ের দিক চাইল। সে মেয়ের দুই চোখে বিস্ময়ের ভেলকি। ঠোঁট যূগল অর্ধ ইঞ্চি ফাঁকা। মারবেল নেত্র ঝাপ্টে ঝাপ্টে দেখছে বেনারসির কাজ। হাতের কাপের চা শরবত হোক,তাতে খেয়াল নেই। আপাতত এই মেরুন চমৎকার বেনারসি আর একই রঙের শেরওয়ানীতেই রাজ্যের মনোযোগ ওর। যেন কাপড় নয়, পৃথিবীর অষ্টমাশ্চর্যের কোনও বস্তু।
ধূসর দৃষ্টি এনে বাকীদের দিক ফেলল। মায়ের কথার, সহজ,সাবলীল জবাব দিলো,
‘ তা নয়। তোমাদের মেয়ের খুব শখ এই রঙের বেনারসি পরবে। তাই নিয়ে আসা।’
পিউ বিস্ফোরিত নয়নে চায়৷ সহসা দুইয়ের অধিক বিদ্যুৎ বেগী চাউনি নিক্ষেপ হয় তার ওপর। ভরকে যায় পিউ। মিনা ভ্রু তুলে শুধালেন, ‘ তুই বলেছিলি আনতে?’
পিউ অসহায় চোখে চাইল। উত্তর নেই বিধায় পরাস্ত ভঙিতে চোখ নামাল। মেঝের দিক চেয়ে কপাল কুঁচকে ভাবল,’ আমি কবে ওনাকে এসব কথা বললাম? বেনারসি নিয়ে তো কোনও দিন আলাপও করিনি। ‘
ভাবতে ভাবতে তার মস্তিষ্ক যখন সুদূর পথ পাড়ি দিলো, খেই হারাল, সমুদ্র ডিঙালো, হঠাৎ সচকিত হয় সে। মনে পড়ল বহু দিন আগের সেই কথাগুলি৷
পুষ্পর বিয়েতে তানহা ভেবে বকবক করেছিল। তখন এরকম কিছুই বলেছিল না?
তানহা তো পাশে ছিল না। ছিলেন ধূসর ভাই। উনি কি সেই কথা মনে রেখেই এগুলো নিয়ে এলেন?
সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময়াবহ হয়ে মাথা তুলল পিউ।
ততক্ষণে ধূসর আবার বেরিয়ে যাচ্ছে। ও তার পিঠের দিকে চেয়ে রইল এক ধ্যানে। মা, চাচীদের হাসি -ঠাট্টার কথাগুলো সামান্য তম কানে ঢুকল না। তার বিস্মিত চাউনী বদলে এলো মুগ্ধতায়। অপলক চেয়েই প্রশ্ন করল নিজেকে,
‘একটা মানুষ এমন নিরুদ্বেগ থেকেও, এতটা ভালোবাসে কী করে? ‘
*****
সারাদিনের প্রচন্ড গরম আর উষ্ণ রোদের পর আকাশে হঠাৎ গুরুগম্ভীর মেঘের বিচরণ। বৃষ্টি নামার সম্ভাবনা জোড়াল। আমজাদ আগে-ভাগেই কাচ টেনে দিলেন জানলার।
একবার ঘড়ির দিক চাইলেন। রাত প্রায় এগারটা ছোঁবে,মিনা কক্ষে আসার নাম নেই। এই মহিলা নীচে এত কী করে! সারাদিন রান্নাঘর, বসার ঘর। সপ্তাহে একটা দিনই তো স্বামী থাকে বাড়িতে! এত বছরে সেই হুশ-জ্ঞানও হয়নি।
আমজাদ বিছানায় এসে বসলেন। টেলিফোন তুলে কল লাগালেন রাশেদের নম্বরে।
এই টেলিফোন খানা তার বাবার কেনা। ভীষণ শখের বশে এনেছিলেন বাড়িতে। আজকাল এসব কেউ ব্যবহার করেনা,কিন্তু আমজাদ বাবার স্মৃতি ধরে রেখেছেন। কয়েক জায়গায় ছাল-ছোকলা উঠে গেলেও ফেলে দেননি। বাবার জিনিস,যতদিন আকড়ে থাকা যায়!
রাশেদের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকেই মিনার পদচরণ পড়ল কামড়ায়। প্রতিদিনের মত ওজু করে এশার নামাজ পড়লেন। জায়নামাজ গুছিয়ে রেখে বিছানার কাছে এলেন। স্বামীর দিকে একটিবারও না দেখে পিঠ ফিরিয়ে চুপচাপ শুয়ে পরলেন। আমজাদের কপাল বেঁকে এলো তৎক্ষনাৎ ।
পিউ মায়ের মতো হয়েছে। এক দন্ড বকবক না করলে শান্তি পায়না এরা। এমন মানুষ হঠাৎ নীরব হলে,দুশ্চিন্তায় ভোগে চারপাশের লোকজন।
রোজ যে রুমে এসেই তাকে জিজ্ঞেস করেন,’ নামাজ পড়েছেন?’
আজ করল না কেন? সাথে কত শত কথা বলে, আজ কী হলো?
আমজাদ একটু এগিয়ে বসলেন। রয়ে সয়ে বললেন
‘ আমার বাম পায়ের শিরায় একটু টান খাচ্ছিলাম সকাল থেকে। তেল মালিশ করে দেবে? ‘
মিনা ফিরে না চেয়ে উঠে বসলেন। থমথমে চেহারায় ওয়াড্রবের ওপর থেকে তেল এনে, সামনে বসে গম্ভীর গলায় বললেন,
‘ পা দিন।’
আমজাদ দিলেন না। বরং প্রশ্ন ছুড়*লেন,’ কী হয়েছে তোমার?’
‘ কী হবে?’
‘ আমারও তো একই প্রশ্ন,কী হবে? মেনেই তো নিলাম তোমাদের আবদার। দিচ্ছি বিয়েটা, এক সপ্তাহ পরই দিচ্ছি। মাত্র রাশেদ-দের ও জানালাম,তাহলে এরকম করছো কেন?’
মিনা হাস্যহীন শুধালেন,’ কী করলাম?’
আমজাদ ক্লান্ত কণ্ঠে বললেন,
‘ দ্যাখো মিনা,বয়স হচ্ছে আমার। সেই জোয়ান কালের মতো, মনের ক্ষমতা নেই যে তুমি না বলতেই বুঝব কী অন্যায় করেছি! চারদিকের এত ঝামেলা,সব থেকে বড় ঝামেলা তোমার আদরের পূত্র। এত মানসিক প্রেশারের মধ্যে আমি সত্যিই রহস্য উদঘাটনে ব্যর্থ৷ ‘
‘ ব্যর্থ আপনি কেন হবেন? ব্যর্থ তো আমি। বিয়ের এত বছর পরে এসে বুঝলাম, আমি আপনার মনঃপুত ভালো স্ত্রী হতে পারিনি। ‘
অভিমানের ঝরঝরে বর্ষার ন্যায় শোনাল কথাটা।
আমজাদ হতভম্ব চোখে চাইলেন,’ কী উল্টোপাল্টা বলছো?’
‘ উল্টোপাল্টা? আমি উল্টোপাল্টা বলছি?’
‘ অবশ্যই! এসব আমি কোনও দিন বলেছি?’
মিনা মুখ ঘুরিয়ে শান্ত গলায় বললেন,
‘ বলবেন কেন? কাজে প্রকাশ করবেন। সব কি মুখে বলতে হয়?’
আমজাদ দিশেহারা।
‘ কী করলাম আবার!’
ত্রস্ত মিনার চোখ ভরে উঠল। ভেজা কণ্ঠে বললেন,
‘ সব সময় বলতেন,আমার কাছে কিছু না বললে আপনার না কি শান্তিতে ঘুম হয়না। আমিও সেটা মেনে খুশিতে উড়তাম। অথচ ঠিকই আমার থেকে কথা লুকান আপনি। কিছু শেয়ার করেন না, জানানোর প্রয়োজন বোধ করেন না। ‘
আমজাদ দ্বিগুন হতচেতন হয়ে বললেন,
‘ কী লুকালাম?’
মিনা তেঁতে উঠলেন,
‘ কী লুকালেন মানে? ভাণ করছেন? ধূসর যে পিউকে পছন্দ করে একটা বার আমাকে জানাতে পারতেন না? নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন,নিজে নিজে ছক কষেছেন সব কিছুর। আমি কে? কেনই বা বলবেন আমায়! আমিতো পরের মেয়ে তাইনা? সংসারের জন্য খাটতে এসেছি। খেটেখুটে জানটা বেরিয়ে যাবে,ব্যাস চলে যাব ক*বরে।’
আমজাদ রে*গে গেলেন। মৃদূ ধমক দিয়ে বললেন, ‘কী যা তা বোলছো?’
মিনা টলমলে চোখে চেয়ে বললেন,
‘ হ্যা যা-তাই বলছি। আমার মত মূল্যহীন মানুষের কথায় দাম থাকবে না কী?’
আমজাদ হতাশ শ্বাস নিলেন। বোঝাতে গেলেন,
‘ আমি তোমাকে বোলতাম। কিন্তু তুমি শুনলেই রুবা,জবা এদের বলে দিতে। তখন বিষয়টা ঘুরে যেত।’
আচ্ছা তুমিই ভাবো,আমি যেমন তোমাকে কিছু না বলে থাকতে পারিনা, তুমি পারো,ওদের কাছে কিছু না বলে থাকতে?’
মিনা মাথা নাড়লেন দুপাশে। তিনি বললেন,
‘ তাহলে? যদি বলতে বিষয়টা এত চমকপ্রদ হতো? সবাই অবাক হোতো এত?’
‘ এইজন্য বলেননি? কিন্তু আপনি আমাকে মানা করলেই আমি আর কাউকে বলতাম না।’
‘ আচ্ছা বাবা,ভুল হয়েছে না বলে। তাই জন্য এমন মুখ গোমড়া করে রাখবে? একটা দিন একটু সময় পাই দুজনে গল্প করার,সেদিনও ঝ*গড়া করবে? ‘
মাথা ঠান্ডা হলো ওনার৷ একটু চুপ থেকে ঘাড় নেড়ে বললেন,
‘ আচ্ছা ঠিক আছে। যা হয়েছে,হয়েছে। পা তো দিন এখন,টান লাগছে কোথায়?’
‘ লাগছেনা। ওটা তোমার মনোযোগ পেতে মিথ্যে বলেছিলাম। ‘
বলেই হেসে উঠলেন আমজাদ। স্বামীর হাসি দেখে এবার হেসে ফেললেন মিনাও। তেলের বোতল পাশে রেখে,আলগা স্বরে বললেন,
‘ আপনি পারেন ও! ‘
‘ আচ্ছা শোনো,ভাবছিলাম একটা পানের ডালা বানাব। দুজন মিলে রাতের খাবারের পর আয়েশ করে চিবানো যাবে।’
মিনা উদ্বেগ নিয়ে বললেন, ‘ সেসব পরে,আগে আমাকে বলুন তো! এই যে ধূসর- পিউয়ের বিষয়টা আপনি কীভাবে জানলেন? সারাক্ষণ বাড়িতে থেকেই আমি কিছু বুঝতে পারলামনা। আপনি তো থাকেন বাইরে।’
‘ তুমি সরল সহজ মানুষ তো,তাই বোঝোনি। যদিও, আমিও প্রথমেই সব বুঝেছি তা নয়। তবে একটু আঁচ করেছিলাম যেদিন ফয়সালের সাথে দেখা হলো। শুনলাম পিউকে নিয়ে ছেলেটাকে ধমকে এসেছে ধূসর। খটকা লাগল। সেদিনই আবার বাড়ি ফিরে দেখলাম, তুমি মেরে*ছ বলে তার রাগা*রাগির দৃশ্য। তারপর পিউকে আগলে ঘরে নিয়ে যাওয়া। এসবে খটকা’টা গাঢ় হলো। তখন থেকে দুটোকে লক্ষ্য করছিলাম। ধীরে ধীরে সন্দেহ প্রকট হতে থাকল। ওইদিন সম্মেলনেও ছেলেপেলে দের পিউকে ভাবি ডাকতে শুনেছি।’
মিনা অবাক কণ্ঠে আওড়ালেন, ‘ভাবি?’
‘ হ্যাঁ। অতটুকু মেয়েকে কেন ভাবি ডাকবে, আমি কি বুঝিনা? তবে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছি কবে জানো? ‘
মিনা আগ্রহভরে চাইলেন,’ কবে?’
‘ পিউ যেদিন ধূসরের সাথে মিষ্টি আনতে যেতে চাইল,আর আফতাব মানা করল? শুনেছিলে তো কেমন করে চেচিয়ে উঠল? সেদিন। বুঝলাম আমি একা নই,আফতাবও নির্ঘাত কিছু জানে। তাছাড়া নিজের হাতে ওটাকে বড় করেছি,হাব-ভাব, চাল-চলন সব জানি। আফতাব মানসিক টানাপোড়েনে পড়ে গিয়েছিল। একদিকে বড় ভাই,অন্যদিকে ছেলে। কয়েক দিন যাবত ওর অস্থিরতা খেয়াল করছিলাম,কিছু বলিনি। অফিসে অন্যমনস্ক থাকতো। দু তিন বার করে ডাকার পর সাড়া মিলতো ওর। আমি তাও ভাণ করলাম কিছুই বুঝিনি। অপেক্ষা করছিলাম, ও আসুক,নিজে এসে ছেলের জন্য কিছু চেয়ে নিক। সব সময় ভাইজান কেন সিদ্ধান্ত নেবে? আর শেষমেষ তোমার দেবর পিতৃস্নেহের কাছে হার মেনে দরজায় এসে দাঁড়াল। এইতো… পরের সবটুকুই তো জানো।’
মিনা বিস্ময়াভিভূত হয়ে বললেন,
‘ কী সাংঘাতিক অনুমান শক্তি আপনাদের! আনিস সি আই ডিতে না গিয়ে আপনারা গেলেই তো পারতেন।’
আমজাদ হাসলেন। দুষ্টুমি করে বললেন,
‘ যেতে তো চেয়েছিলাম,নেয়নি।’
মিনা বুক ভরে শ্বাস টেনে বললেন,
‘ যাক বাবা! সব ভালোয় ভালোয় মিটলেই আমার শান্তি। ‘
তারপর আনমনা হয়ে বললেন,
‘ আপনার মনে আছে? ধূসর হওয়ার পর রুবা কী মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ল? বাচ্চাটাকে দেখার মত অবস্থা তো দূর,বিছানা থেকেও নড়তেও পারতোনা। দেখাশুনার জন্যে দুইদিনের ধূসরকে আমি আমার কোলে তুলে নিলাম। রাতে এতবার খেতে উঠত,আপনি ঘুমোতেও পারতেন না। অথচ তাও কোনও দিন একটু বিরক্ত হননি। বলতেন,আমার ছেলেই তো কাঁ*দছে,বিরক্ত হব কেন? চার মাস লাগল রুবার সুস্থ হতে, ততদিনে ধূসর আমার নিজের অংশ হয়ে গেল! ভেবেছিলাম বড় হতে হতে মাকে পেয়ে অতটা কাছে ঘিষবেনা। ভুলে যাবে। অথচ না,সে ছেলে কিন্তু এখনও আমার ন্যাওটা। ‘
আমজাদ মাথা দোলালেন নীরব। মিনা নিজেই বললেন,
‘ ওর প্রতি আমার একটা আলাদা টান আছে জানেন? বাকীদের প্রতিও আছে, কিন্তু এতটা প্রখর না। পুষ্প হওয়ার পর মনে মনে ভেবেছিলাম,যদি ধূসরের বউ করা যায় ওকে! কিন্তু ওর চোখে পুষ্পর প্রতি স্নেহ,দায়িত্ব ছাড়া কখনও কিছু দেখিনি। তাই সাহসও করিনি। আর পিউ! ও এত ছোট! আবার ধূসর যতক্ষণ বাড়িতে থাকতো, উঠতে বসতে একশটা ঝাড়ি খায়। তাই ওদের নিয়ে এমন কিছু আমার তো মাথাতেও আসেনি। অথচ তলে তলে দুটোতে ঠিক ভালোবাসা করে ফেলল দেখলেন?’
তাল মিলিয়ে হাসলেন দুজন। আমজাদ শুধালেন,
‘ তুমি খুশি এবার?’
উত্তর ,হাসির ফোঁয়াড়ায় বুঝিয়ে দিলেন মিনা। স্বামীর হাতের ওপর হাত রেখে বললেন, ‘ খুব!’
*****
‘ এই বাচ্চা মেয়েটি আবার কে?’
হঠাৎ প্রশ্নে চমকে উঠল সাদিফ। পেছন ঘুরে মাকে দেখে তড়িঘড়ি করে ফোনের আলো নেভাল। উপুড় হওয়া থেকে সোজা হয়ে বসে বলল,
‘ তুমি কখন এলে?’
জবা পাশে বসতে বসতে বললেন,
‘ মাত্র এলাম। কিন্তু এই বাচ্চাটা কে? কেমন চেনা চেনা লাগছিল। দেখেছি কোথাও? চিনি আমি?’
সাদিফ আমতা-আমতা করে বলল,
‘ এটা গুগলে পাওয়া ছবি। আমিই চিনিনা,তুমি কীভাবে চিনবে?’
জবা বেগম আনমনা হয়ে বললেন,’ কিন্তু… ‘
সাদিফ কথা কাটাতে চায়। সে যে এতক্ষণ এক পোকা দাঁত কপাটির অধিকারী মেয়ের ছবি দেখছিল, সেই মেয়ের আসল পরিচয় কী আর বলা যায় নাকি? প্রসঙ্গ পাল্টাতে মায়ের কোলে শুয়ে বলল,
‘ তুমিতো আজকাল আসোই না আমার ঘরে।’
জবা ছেলের কোমল চুলের ভাঁজে হাত ভরলেন। কথাটায় কপাল গুছিয়ে বললেন,
‘ তুই বুঝি বাড়িতে থাকিস? আজকেও দেখলাম বাইরে গেলি। আসব যে সুযোগ দিস?’
সাদিফ হাসল। হঠাৎ কিছু ভেবে চট করে উঠে বসে বলল,’ দাঁড়াও, একটা জিনিস দেখাই তোমায়।’
বিছানা ছাড়ল সে৷ হ্যাঙারে ঝোলানো শার্টের বুক পকেট থেকে বের করল সেই আংটির বাক্স। মায়ের সামনে মেলে ধরে বলল,’ কেমন?’
জবা বেগম হা করে বললেন,
‘ কী সুন্দর রে! হীরের না?’
‘ হ্যাঁ। পিউ আর ভাইয়ার বিয়েতে দেব ভাবছি।’
‘ খুব ভালো হবে! কত নিলো?’
‘ ভ্যাট সহ ষাট প্লাস পরেছে।’
‘ ভালো হয়েছে। কিন্তু আসল হীরে দিয়েছে? নাকি তোকে বোকা-সোকা পেয়ে নকল ধরিয়ে দিলো?’
বলতে বলতে হীরের একটা আংটি তুলে চোখের সামনে ধরলেন জবা। জহুরি চোখে উল্টেপাটে দেখলেন। সাদিফ বলল,
‘ আরে সার্টিফিকেট আছে। তাছাড়া নামি- দামি ব্রান্ড,নকল দিলে ওদেরই সমস্যা।’
‘ হুউউ। কিন্তু তুই এত বেছে-গুনে আনলি কী করে? যে ছেলে এখনও নিজের জন্য শার্ট-প্যান্ট পছন্দ করে কিনতে পারেনা,মাকে টাকা দিয়ে বলে এনে দিও। সে গয়না কিনল একা গিয়ে? বাবাহ!
সাদিফ মাথা চুল্কাল। একা কী পারতো? মারিয়া সঙ্গে গিয়েছিল বলেই না। জবা বেগম বাক্স বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আক্ষেপ নিয়ে বললেন,
‘ পুষ্প ইকবালকে পছন্দ না করলে আজ তোদের বিয়েটাও…’
সাদিফ আটকে দিলো মাঝপথে ।
‘ থাক না ওসব।’
জবা মায়া মায়া চোখে তাকালেন। বললেন,
‘ তোর খুব খারাপ লাগে,তাইনা রে বাবা?’
‘ খারাপ লাগবে কেন?’
‘ তুইত ওকে পছন্দ করতি। প্রতিদিন ওকে সামনে দেখছিস…’
সাদিফ বিমূর্ত। সে কবে পুষ্পকে পছন্দ করল? পিউকেও বহুবার এই কথা বলতে শুনেছে। এই বদ্ধমূল ধারণা কী করে জন্মাল এদের?
জবা বেগম মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘ তুই দুঃখ পাস না বাবা! পিউয়ের বিয়েটা হয়ে যাক, ছ মাস পরেই আমরা সবাই তোর জন্য মেয়ে দেখা শুরু করব। ‘
সাদিফ মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল। বিরক্তি টুকুন গি*লে নিয়ে,চুপ রইল বরাবরের মত।
*******
সপ্তাহের মোড় ঘুরতেই হাজির সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। খুব কাছের লোক ছাড়া কাউকে ডাকা হলোনা বিয়েতে। যাদের না ডাকলে মুখ লুকানো বিপদ,আমজাদ কেবল ওদেরই দাওয়াত দিলেন। বৃহস্পতিবার রাতে মাকে নিয়ে চৌকাঠে হাজির হলো মারিয়া। ধূসর নিজে গিয়ে দাওয়াত দিয়ে এসেছেন তাদের। রোজিনা একটু অস্বস্তিবোধ করছিলেন প্রথমে। একদিনের আলাপ হলো মাত্র,এর মধ্যেই বাড়িতে ওঠা কেমন না কেমন দেখায়! কিন্তু ধূসরের মুখের ওপর না বলতে পারেননি। অথচ আসার পরপরই সমস্ত অস্বস্তি খড়কুটোর মত ভেসে গেল ওনার। সিকদার বাড়ির গৃহীনিদের অমায়িক ব্যবহার, সকল অপ্রতিভতা মুছে ফেলল মুহুর্তে। প্রহরে প্রহরে সহজ হয়ে উঠলেন রোজিনা খাতুন।
কিন্তু বিপদে পড়েছে মারিয়া। এখানে আসার পর থেকে একটা বান্দাও তার সাথে কথা বলছে না। না পুষ্প,না পিউ,আর না বর্ষা -শান্তা- সুপ্তি। মুখে কুলুপ এঁটেছে সকলে। অপরাধ! পুষ্পর বিয়েতে না এসে তাদের সুন্দর পরিকল্পনা ধ্বং*স করা। বর্ষা একাই এসেছে। সৈকত আসবে কাল দুপুরে।
এত ঘনঘন বিয়েতে তো আর ছুটি নেওয়া যায় না!
এদিকে আমজাদও সমান বিপাকে পড়েছেন। রাশিদ আর মুত্তালিব বারবার শুধাচ্ছেন’ হঠাৎ এত তাড়াহুড়ো করে বিয়ে কেন?’ শুধু কি তারা,যারাই আসছে সবার একই কথা,একই প্রশ্ন। আমজাদ নাজেহাল হচ্ছেন যতবার, ততবার কটমটে চোখে দেখছেন ধূসরকে।
ও ছেলের খেয়াল থাকলে তো! সে নিজের বিয়ের লাইটিং নিজে করতে ব্যস্ত। ঠিকঠাক নাহলে আবার ঝাড়ছেও লোকগুলোকে। ইকবাল সেসব দেখে হতাশ হয়। বিড়বিড় করে বলে,
‘ লজ্জা শরম নেই। একটুও নেই।’
***
ভাড় মুখো সঙ্গীদের মানাতে বেশ কাঠখড় পো*ড়াতে হলো মারিয়ার। এমন মিষ্টি মেয়ের ওপর দিন শেষে রা*গ আর ধরে রাখা গেল না।
যখন আপোষ হলো, সবকটা মিলে হৈচৈ -এ মেতে উঠল ফের। তবে এবার মৈত্রী মিসিং। ছোট খাটো আয়োজন বিধায় তাদের আর জানানো হয়নি। সাদিফ মনে-প্রাণে হাঁপ ছেড়ে বেচেছে এতে। মেয়েটাকে দেখলে তার অসম্ভব অস্বস্তি হয়!
পার্লার থেকে একটি মেয়ে আনা হয়েছে। পিউয়ের কনুই অবধি মেহেদী পড়াচ্ছে সে। তার পড়নে লাল-হলুদ মিশেলের তাঁতের শাড়ি। কানে ছোট ছোট স্বর্নের ঝুমকো। তবে সবথেকে চোখে লাগা বিষয় হচ্ছে, প্রজ্জল চেহারার বিস্তর -সরল হাসিটুকুন।
দুপুরে ওদের দুজনের গায়ে হলুদ হয়েছে। পুষ্পর মত অত বিশাল আয়োজনে নয়,ছোট পরিসরে।
বর-কনে কে আলাদা আলাদা ভাবে গোসল দিয়েছেন গৃহীনিরা। পিউকে গোসল করিয়েছেন, ওয়াশরুমে,আর ধূসরকে ছাদে। তারপর শাড়ি পরিয়ে পুতুলের মতো বসিয়ে রাখা হয়েছে ওকে।
মিনা বেগম কড়া করে বলেছেন,’ ঘর থেকে বের হবি না।’
না বললেও পিউ বাইরে আসতো না আজ। ধূসর বাড়িময় ঘুরছে। চোখাচোখি হলেও ভীষণ লজ্জা লাগে ওর। মাথা তুলতেও ক*ষ্ট যেন।
একটা বিশাল শীতলপাটির ওপর বসে পিউ। থুত্নী ঠ্যাকানো হাঁটুতে। ভাসা ভাসা নেত্রদ্বয় তাক করা হাতের ওপর।
তার চারপাশে সামান্য জায়গা ফাঁকা নেই। মেয়ে দলের একটা জট বেঁধেছে। পুষ্প গল্পের আসরে বসেছে এক বাটি আচার সমেত।
সবার গল্প-গুজব আর হাসাহাসির মধ্যেই ধূসর দরজায় এসে দাঁড়াল। তার বলিষ্ঠ,কালো অবয়ব লাইটের আলোয় ফ্লোরে ভাসতেই তাকাল ওরা। কথা থামল,হাসি কমল। ধূসরকে দেখেই পিউ জড়োসড়ো হয়ে গেল৷ আরো গুটিয়ে বসল। দৌড়-ঝাঁপ করার রেশ ধূসরের চোখে-মুখে লেপ্টে। ফোটা ফোটা ঘামের নহর কপালের ওপর। গায়ে থাকা বাদামি টি শার্ট মিশেছে বুকে। পিউ বেশিক্ষন চেয়ে থাকতে পারল না। লাজুক ভঙিতে তৎপর চোখ নামালো।
পুষ্প শুধাল,’ কিছু বলবে ভাইয়া?’
সবার আগ্রহী চাউনী তার দিকে। একাধিক প্রশ্নবিদ্ধ মেয়েলি চোখ গুলোও ধূসরকে বিব্রত করতে পারল না। সে টানটান বক্ষে,ছোট করে বলল,
‘ একটু বাইরে যা সবাই।’
পুষ্প ওরা হা করে একে-অন্যকে দেখল। মারিয়া দুষ্টুমি করে বলল,’ সবাই? পিউকেও নিয়ে যাব?’
ধূসর সহজ ভাবে তাকাল,অথচ মেয়ে এতেই ঘাবড়ে বলল,
‘ না না বাবা! মজা করলাম। ‘
সবাই ঠোঁট চেপে হাসি আটকে ঘর ছাড়ল। পিউ বসে রইল শক্ত হয়ে। মনের আনাচে-কানাচে প্রগাঢ় অনুভূতির জোয়ার ছুটেছে তখন। কী বলতে এসেছেন ধূসর ভাই? আবার কি একটা বেফাঁস কথা বলে লজ্জায় ফেলবেন ওকে?
এতক্ষনের সরব, পূর্ন কামড়া নিস্তব্ধ এখন।
ধূসর ছোট কদমে এগিয়ে আসে। প্রতিটি পদচারণ বাড়িয়ে দেয় পিউয়ের বুকের দুরুদুরু স্বভাব। শিরশিরে পা দুটো সে আরো সেঁটে নিলো শাড়ির নীচে। কাঁ*পা কাঁ*পা চক্ষুদ্বয়ে তাকাল । ধূসর কাছে এলো,হাটুমুড়ে বসল তার মুখোমুখি। বিশ্রান্ত নজরে কিছু পল চেয়ে রইল হলদে আলোয় ঘেরা,হলদে শাড়িতে আবৃত তার হৃদয়হরনী পানে। কে জানত,এই ছোট্ট একটা মেয়েই তুখোড় সুনামি বইয়ে দেবে ওর অন্তরে। নির্দয়ীর মত কে*ড়ে নেবে মন, ঘুম,ধ্যান।
এমন ধাঁরাল চাউনীর নিকট নিজেকে নিঃসহায় আবিষ্কার করল পিউ। মারাত্মক প্রভাব পড়ল তার তনুমনে,শিরায়,শরীরের প্রতিটি বাঁকে। সহসা কানে এলো সুগভীর স্বর,
‘ হাত দে।’
পিউ চেয়েছিল। অথচ বেখেয়ালির ন্যায় শুধাল,
‘ হু? ‘
‘ হাত চেয়েছি।’
পিউ মোহে ডু*বে থেকেই দুটো হাত এগিয়ে ধরল সামনে৷ মেহেদীর কারণে তার ডান হাতে বিন্দুমাত্র জায়গা ফাঁকা নেই। বাম হাতের কনুই থেকে কব্জি অবধি নেমে এসেছে ডিজাইন।
ধূসর দুটো হাত একে একে দেখে বলল,’ বাম হাত।’
পিউ ত্রস্ত অন্য হাত নামিয়ে নেয়। বাম হাত পেতে রাখে ওমন। ধূসর তার উষ্ণ হস্তে, মুঠোয় ধরল সেটি। ডালা থেকে তুলল অর্ধ-সমাপ্ত মেহেদীর কোণ। একবার চাইল পিউয়ের বিভ্রান্ত চোখে। তারপর ঠিক তালু বরাবর কোণ ঘুরিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে লিখে দিলো ‘ ধূসর!’
পিউ স্তব্ধ! বিহ্বল নজর বোলায় একবার হাতের দিক,একবার সম্মুখে বসা শ্যামলা পুরুষের চেহারায়। ধূসর হাসল। সেই চিরচেনা শব্দহীন হাসি। স্বল্প আওয়াজে বলল,
‘ কবে একবার কেঁদে ভাসিয়েছিলি না? আমার নাম অন্য একজনের হাতে দেখে? তাই আজ নিজেই,নিজের নাম তোর হাতে লিখে দিলাম। সাথে লিখে দিলাম এই আমাকেও।
লেখা উঠে যাবে পিউ। মানুষটাকে আবার মন থেকে উঠিয়ে দিস না।’
পিউয়ের চেহারা ফ্যাকাশে হলো। স্তম্ভিত চোখ দুটো হক*চকিয়ে উঠল। আৎকে ওঠার ন্যায় বলল,’ এসব কী বলছেন? আপনাকে ছাড়া আমার পৃথিবীও ভাবতে পারিনা ধূসর ভাই।’
তার সদ্য জল ডো*বানো চোখের দিক চেয়ে মুচকি হাসল ধূসর। চিকণ ঠোঁট বাড়িয়ে টুপ করে গভীর চুমু বসাল কপালে। অকষাৎ দরজায় ঝোলানো পর্দার ওপাশ হতে খুকখুক কাশির শব্দ ভেসে আসে।
‘ ইয়ে, আমরা কি এখন ভেতরে আসব?’
বর্ষার কণ্ঠ শুনে সরে এলো ধূসর। পিউয়ের লালিত চেহারার দিক থেকে চোখ সরাল। লম্বা পায়ে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। পিউ চেয়ে রইল সেই যাওয়ার দিকে।
লিখে দেওয়া নামের হাতখানা বক্ষপটে চেপে ধরল। এই মেহেদীর রং যদি সারাজীবনেও না উঠত,ভালো হোতো না?
******
অল্প লোক সংখ্যাতেই বাড়িতে পা ফেলা যাচ্ছেনা। বসার ঘরের চেয়ার -টেবিল,সোফা সরিয়ে জায়গা বের করা হয়েছে। ঠিক মাঝ বরাবর ফোমের আসন পাতা হলো। তার ওপর শুভ্র সাদা কভার। চারপাশে পাটাতন বসিয়ে আসনের মধ্যিখানে ঝোলানো হলো রেখায় গাঁথা ফুল। যেই ফুলের ঘনত্বে এপাশ-ওপাশ চাইলেই দেখা মুশকিল। একপাশে বর বসবে,অন্য পাশ কনের। অথচ দুজনেই মুখোমুখি আবার।
সাউন্ড সিস্টেমের দায়িত্ব নিয়েছে বেলাল। সাদিফের হুকুম, কিছুতেই ফোন বা ক্যাসেট রাদিফের হাতে দেওয়া যাবে না। ফাজিলটা টিকটকের উল্টোপাল্টা গান ছাড়া কিচ্ছু বোঝেনা। গতবার বুক চিনচিন গান ছেড়ে ইজ্জত খেয়ে ফেলেছিল।
সবাই তখন মহাব্যস্ত। খেটে-খুটে কাহিল সাদিফ। মানুষের চাপা-চাপিতে এসিতেও কূলোচ্ছেনা ওর। বারবার ছুটে গিয়ে ফ্রিজ থেকে পানি বের করে খাচ্ছে। সকলে তৈরি হলেও, ছেলেটা রুমে ঢোকারও ফুরসত পেলো না। শেষে ইকবাল তাকে ঠেলে-ঠুলে তৈরি হতে পাঠাল। ওকে সরিয়ে নিজে উঠল টুলে। একটু দূরে পুষ্প চেয়ারে মাথা এলিয়ে বসেছিল। তার বমির সমস্যা, এত মশলা আর মাছ-মাংসের গন্ধে বিকট হয়েছে। তাও লাফিয়ে লাফিয়ে মা-চাচীদের হাতে হাত লাগাতে গিয়েছিল। কিন্তু ওকে স্ব-সম্মানে রান্নাঘর থেকে বের করে দিয়েছেন ওনারা। সেই থেকে সে এখানে বসে। শরীরের অস্থিরতায় কোনও রকমে একটা হাফসিল্কের শাড়ি জড়িয়েছে গায়ে।
ইকবালকে দেয়ালে ঝোলানো ফুলের দড়ি বাঁ*ধতে দেখে কপাল কোঁচকাল সে। ক্ষণবাদে সেই দৃষ্টি বদলাল। হয়ে উঠল ঝলমলে, সুখী সুখী। ঠিক এরকম একটা মুহুর্তে ইকবালকে এই বাড়িতে দেখেছিল ও। খেয়াল করেছিল তীক্ষ্ণ লোঁচনে। ঘাম মুছতে মুছতে আনিস – সুমনার বিয়েতে ধূসরের সঙ্গে মিলে কাজ করছিল ইকবাল। ওই দৃশ্যটুকুতেই বিভোর হয়ে পুষ্প মন দিয়ে বসল। আর আজ? আজ সেই ছেলেরই বাবুর মা হবে? ফিক করে হেসে উঠল পুষ্প। ইকবাল শব্দ শুনে পাশ ফেরে। ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করতে যায় হাসির কারণ। তার বলবান দেহের বেতাল নড়াচড়ায় দুলে ওঠে উঁচু টুল। উলটে যেতে ধরলেই পুষ্প ভ*য়ে দাঁড়িয়ে গেল। কাছে যাওয়ার আগেই রকেট বেগে এসে টুলখানা চেপে ধরলেন আমজাদ। শক্ত মেঝের ওপর পতন থেকে বাচল ইকবাল। কৃতজ্ঞ চোখে চাইল শ্বশুরের দিকে। তিনি ভ্রু গুছিয়ে বললেন,
‘ সাবধানে কাজ করবে তো। আর এই ফুল গুলো না কাল টানানো হলো? আজ আবার টানাচ্ছো যে?’
ইকবাল বিনয়ী স্বরে বলল, ‘ খুলে গিয়েছিল আঙ্কেল।’
আমজাদ একটু চুপ থেকে বললেন,
‘ শ্বশুর কে এবার বাবা ডাকতে শেখো। আঙ্কেল তো প্রতিবেশিও হয়।’
চলে গেলেন ভদ্রলোক। ইকবাল হা করে চেয়ে রইল। পুষ্প ততক্ষণে কাছে এসে দাঁড়ায়। চিন্তিত গলায় বলল,
‘আরেকটু হলেই পরতে! ভাগ্যিশ বাবা ধরে ফেললেন।’
ইকবাল ওসবে মন না দিয়ে বলল,
‘ হিটলার শ্বশুর বোধ হয় আমার প্রতি ইম্প্রেস হচ্ছে মাই লাভ।’
পুষ্প প্রথমে গাল ফোলাল হিটলার শব্দে। পরপর হেসে তার নাক টেনে দিয়ে বলল,
‘ আমার ইকবাল মানুষটাই এমন। ইমপ্রেস না হয়ে যাবে কোথায়?’
****
ঘড়িতে তখন আটটা বাজে। ধূসর আসনে পা ভাঁজ করে বসেছে কেবল। এই আসনের চতুর্দিক ঘিরে মেহমানরা বসে। বিয়ের সমস্ত বন্দোবস্ত শেষ। পিউ এলেই শুরু হবে কালিমা পড়ানো। পরিচিত প্রফেশনাল ক্যামেরাম্যান আনা হয়েছে একজন। তিনি বিভিন্ন এঙ্গেলে,বিশ্রামহীন ছবি তুলছেন ধূসরের।
ওর পার্লামেন্টে জানানো হয়নি। কম-সমের অনুষ্ঠান বলে কেবল সোহেল আর মৃনাল এসেছে। যারা ধূসরের ভীষণ কাছের।
তবে আমজাদ ভেবে রেখেছেন,ছয়-সাত মাস পর একটা বড় করে গেট- টুগেদারের আয়োজন করবেন। ব্যাবসায়িক,পরিচিত সমস্ত লোক ডেকে পুষিয়ে নেবেন এই ফাঁকফোকর।
ধূসর বারবার ওপরের দিকে তাকাচ্ছে। অধীর দুই অক্ষিপট। পিউ নামার নাম নেই। বিয়ে হবে কখন? কী এত সাজে এই মেয়ে? শাড়ি পরলেই যেখানে তার হৃদয় এসে থেমে থেমে যায়,বউ সাজলে কেমন দেখাবে?
ইকবাল হাসি হাসি মুখে এসে পাশে আসন করে বসল। কাঁধে হাত রেখে টেনে ডাকল,’ বন্ধুউউউ!’
ধূসর কপাল গুটিয়ে বলল,
‘ হাসছিস কেন? ‘
ইকবাল জবাব দিলো না, শুধু হাসল। ধূসর চাপা কণ্ঠে ধমকাল,
‘ একদম হাসবিনা। তুই হাসা মানে অদ্ভূত কিছু শোনানো।’
ইকবাল ফিসফিস করে বলল, ‘ বাসর রাতের জন্য রেডি?’
‘ কেন? তুই রেডি ছিলি না?’
সে দুঃখী গলায় বলল,’ ছিলাম মানে! কিন্তু সব প্রস্তুতিতে জল ঢেলে আমার বউটা ঘুমিয়ে পড়েছিল সেদিন।’
ধূসর হেসে ফেলল। ইকবাল আরেকটু কাছে ঘেঁষে এলো ওর। বাহুতে আহ্লাদী হাত ডলতে ডলতে বোঝাল,
‘ দ্যাখ ভাই, অনেক মান-ইজ্জ্বত খেয়েছিস আমার। এবার যা বেচে আছে সেটুকু রাখিস। একটু রোমান্টিক হোস। বাসর ঘরে মেয়েটাকে না ধমকে, একটু ভালোবাসিস। ‘
ধূসর কিছু বলতে হা করে,অথচ পূর্বেই কানে এসে বিধল চপল পায়ের নূপুরের রুনঝুন শব্দ। পিউ আসছে! না চেয়েই বুঝে নিলো সে। ঢোক গিলে, মন্থর বেগে চোখ তুলল সিড়ির দিকে। মারিয়া,পুষ্প,বর্ষা সবাইকে ছাপিয়ে ধূসরের বিমোহিত লোঁচনদ্বয় পরে রইল বেনারসি পরিহিতা সদ্য অষ্টাদশে পা রাখা মেয়েটিতে।
পিউয়ের মাথায় জর্জেটের লাল ওড়না। গায়ে মোটা বেনারসি। স্বর্নের গয়না কান,নাক,গলায়। দুহাত ভরা লাল পাথরের চুড়িতে।
সে যখন গুটিগুটি পায়ে হেঁটে আসছিল, মনে হলো অম্বরের নিষ্কলুষ, মায়াবী মেঘ নেমে এসেছে গৃহে। ওই ডাগর ডাগর চাউনীতে ধূসরকে পাওয়ার তৃপ্তিটুকু তার সবচেয়ে বড় প্রসাধনী। নীম্ন নেত্রে ঘেঁষে যাওয়া কাজল, মেরুন লিপস্টিকের আস্তরণে ঢাকা শিল্পের মত ঠোঁট সব যেন থমকে রাখল ধূসরকে।
পিউ আজ বউ নয়,সেজেছে তার প্রান-ঘাতি*নী। এই রূপ, এই অন্যরকম ভিন্ন দুটো চোখ,যা রূপকথার থেকেও স্নিগ্ধ,সরল। জান নিয়ে রেহাই-ই দেবেনা যেন। ধূসর খুব ক*ষ্টে চোখ ফেরাল। একরকম টেনেহিঁ*চড়ে, ঘষে এনেছে দৃষ্টি । নীচের দিক চেয়ে মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল।
রুবায়দা হৃষ্ট চিত্তে আওড়ালেন, ‘ পিউকে কী সুন্দর লাগছে না আপা?’
মিনা বেগম চোখ ভর্তি আনন্দাশ্রু সমেত মাথা দোলালেন।
ধূসর আর তাকালোনা৷ কেমন ঝিম মেরে বসে রইল। শেরওয়ানি ফুঁড়ে তার হৃদয় বাইরে আসতে চাইছে। লাফাচ্ছে খুব।
পিউ কাছে এসেছে। গাঢ় তার নূপুরের শব্দ। ইকবাল দেখেই বলল, ‘ আরিব্বাস! এটা কে?’
পিউ লজ্জা পেয়ে হাসে। ফুলের টানেলের এপাশে বসানো হয় তাকে। ঠিক মুখোমুখি দুজন। পিউ আড়চোখ তুলে তাকাল একবার। এত ঘন ঘন ফুলের সাড়ির মাঝেও মেরুন শেরওয়ানীর আকাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে দেখে প্রতিবারের মত আজও তার দৃষ্টি থামে,বক্ষ কাঁপে।
****
পিউকে স্টেজ অবধি এগিয়ে দেয়ার পর মারিয়া দাঁড়িয়ে রইল এক কোণে। তার ব্যগ্র চোখ খুঁজছে একটি প্রিয় মুখ, সু- প্রিয় চেহারা। সময় কাটলে দেখা মিলল তার। সাদিফ ব্যস্তভাবে তৈরী হয়ে এসেছে।
পড়নে কালো কারুকাজ খচিত মকমলের পাঞ্জাবি, সাথে সাদা পাজামা। চুল গুলো আঙুল দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে নামছে সে।
মারিয়া হা করে চেয়ে থাকল। কালো পোশাকে, সাদাটে সাদিফের সৌন্দর্য চারগুন বেড়েছে। গায়ের রঙ আরো বাড়তি দাগ তুলেছে যেন। মারিয়ার
চোখে-মুখে মুগ্ধতা লেপ্টে এলো মুহুর্তে।
সাদিফের গোল-গাল চেহারায় অন্যরকম হিরো ভাব। স্বতঃস্ফূর্ত কদম। ওষ্ঠপুটে চঞ্চল হাসি। ভোলা-ভালা মুখবিবর দেখে মনে হচ্ছে,ইনি মিষ্টি কথা ছাড়া কিচ্ছুটি জানেনা। অথচ এই লোক যে কী মারাত্মক লেভেলের ঠোঁটকা*টা আর ঝগ*ড়ুটে ছিল এক সময়, তার থেকে ভালো কে জানে? সম্পর্ক ল্টা কত তিক্ত ছিল শুরুতে! আর এখন? এখন যেন মধুর চেয়েও সমধুর। মারিয়া ওমন চেয়ে থেকেই মৃদূ হাসল।
এর মধ্যেই সাদিফ এসে সামনে দাঁড়াল তার। গতকাল থেকে কাজের চাপে ভালো করে কথাও হয়নি দুজনের।
মারিয়া তখনও মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে । সাদিফ ঠোঁট কাম*ড়ে,ভ্রু গুছিয়ে দেখল। তারপর মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলে,
‘ ও হ্যালো ,মিস ম্যালেরিয়া! ঘুমোতে হলে রুমে যান,ড্রয়িং রুম কিন্তু ঘুমের জন্য নয়।’
মারিয়া চমকে, নড়ে উঠল। ধ্যানের মধ্যে সাদিফ সামনে এসে দাঁড়াল সে দেখেইনি? আশ্চর্য আশ্চর্য! থতমত খেয়ে বলল,
‘ ঘু..ঘুমাচ্ছিলাম না।’
‘ তাহলে কী করছিলেন? এভাবে হা করে দেখছিলেন কেন আমাকে?’
মারিয়া চটক কা*টার মতন চাইল। আমতা-আমতা করে বলল,
‘ কই,কখন?’
: মিথ্যে বলে লাভ নেই। প্রায়ই দেখি আমার দিকে চেয়ে থাকেন৷ ব্যাপার স্যাপার কী?’
সাদিফ ভ্রু নাঁচাতেই মারিয়া আরেকদিক চেয়ে বলল,
‘ বাজে কথা।’
ধরা পরার শঙ্কায় সে ঘুরে হাঁটা ধরল । পেছন থেকে সাদিফ সন্দিহান কণ্ঠে বলল,
‘ আই থিংক, ডাল ম্যায় কুছ কালা হে।’
মারিয়া জ্বিভ কে*টে, চোখ খিঁচল। কী ক্যাবলার মত চেয়েছিল,আর ধরাও পরল হাতে নাতে? প্রেসটিজ পুরো ঘেটে-ঘ।
চোটপাট বজায় রাখতে বলল,’ তো আমি কী করব? আপনার থিংক, আপনার সমস্যা আপনার।’
সাদিফ এগিয়ে আসে। আলগা স্বরে বলে,
‘কিন্তু বিষয়বস্তু তো আপনি ম্যালেরিয়া।’
মারিয়া ফিরে তাকায়,
‘ কী রকম?’
সাদিফ ভাবুক ভঙিতে চশমাটা খুলে হাতে নিলো।পাঞ্জাবির হাতায় দু তিনটে ঘষা দিয়ে ফের চোখে পড়ল। পেছনে হাত বে*ধে ঝুঁকে এসে বলল,
‘ কেন যেন মনে হচ্ছে, আপনি আমার প্রেমে পড়েছেন।’
মারিয়ার বুক কেঁ*পে উঠল। সদর্পে কু*ঠারের এক ঘাঁ বসল যেন। তার হতভম্ব চেহারা দেখে মিটিমিটি হাসল সাদিফ। স্টেজের কাছে কাজী সাহেবকে এগোতে দেখে, হেসে পা বাড়াল সেদিক। পেছনে রেখে গেল স্তব্ধ মেয়েটিকে।
****
সবার মুখের ঝলমলে, ফকফকে হাসির মধ্য দিয়ে কাবিন নামায় সই করল ধূসর। এরপর পিউ সই করে তাকায়। কাজী সাহেব বলতে বললেন,
‘ বলো মা কবুল!’
একবার বলেছেন,অথচ পিউ
সবেগে, অবিলম্বে আওড়াল, ‘ কবুল- কবুল- কবুল।’
ভদ্রলোক ভ্যাবাচেকা খেলেন। কর্ম জীবনে এমন স্ফুর্ত বউ প্রথম দেখলেন আজ। ওনার পাঠ করানোর পূর্বেই কবুল বলে দিলো? ধাতস্থ হয়ে বললেন,
‘ আলহামদুলিল্লাহ। ‘ বড়রা ঠোঁট টিপে হাসে।
এরপর ধূসরকে বলতে বললেন। সেও সময় নিলো না। চুটকি মে*রে যেন বিয়ের কাজ সম্পন্ন হলো ওদের। ইকবাল এ পাশে বসা সাদিফের কানে ফিসফিস করে বলল,
‘ দেখেছো সাদিফ বাবু,এদের বাসর ঘরে ঢোকার কী তাড়া!’
সাদিফ হু-হা করে হেসে উঠল শুনে। মোনাজাত শেষে ধূসর পিউয়ের দিক চাইল। এত গুলো মানুষ এড়িয়ে সরাসরি,খুরখার চাউনীতে। পিউ তাকায় পরপর, নিভু নিভু দৃষ্টি, লাল দুটো গাল। স্বামী-স্ত্রী হিসেবে প্রথম বার চোখাচোখি হয় দুজনের। ধূসরের ঠোঁট গহ্বরের ফাঁক গলে ছুটে চলল প্রাপ্তির হাসি।
যেই হাসি মিশে গেল প্রবল বাতাসে। ছুটতে ছুটতে গাছ -ফুল -পাখি -লতা পাতাকে জানিয়ে দিলো,
❝শুনেছ তোমরা,খবর পেয়েছ?
এক_ সমুদ্র_ প্রেমের উত্তাল উর্মীর বিক্ষিপ্ত স্রোতে,এক জোড়া হৃদয় বৈধভাবে বাঁধা পড়েছে আজ। খুশি হয়েছ? ❞
চলবে।
#এক_সমুদ্র_প্রেম!
কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(৬২)
সময় চলছে গন্তব্যে। রাতের অন্ধকার আর সবেগি হাওয়ার সাথে গতির বিরাট পাল্লা তার। নিরন্তর ছুটছে ঘড়ির কাঁটা। রাত্রীর দ্বিতীয় প্রহর শেষ হলো কেবল। ধূসর-পিউয়ের বিয়ের পাঠ চুকেছে অনেকক্ষণ হবে। অথচ এখনও সবাই রাজ্যের ব্যস্ত পথিক। হাত,মুখ,পা, দেহ জিরোচ্ছেনা কারো।
এমনিতে বিয়ে হলে, মেয়ে বাড়ি গুটিয়ে থাকে বিষন্নতায়। কন্যা বিদায়ের, আজীবনের জন্যে তাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর হাহাকারে বাবা মায়ের বক্ষ ছি*ড়েখুঁড়ে আসে। যেমনটা সেবার পুষ্পর বিয়েতে হয়েছিল।
মিনা বেগম অজ্ঞান ছিলেন। বনিয়াদ ভে*ঙে কেঁ*দে ফেলেছিলেন শ*ক্তপোক্ত আমজাদ সিকদারও।
কিন্তু পিউয়ের বিয়ের ঘটনা উলটো। তার শ্বশুর বাড়ি, বাবার বাড়ির দরজা,ছাদ, দেয়াল সবই একটা। সে আমৃত্যু এখানেই ঘাঁটি গেড়েছে। সেইজন্যে কান্না*কাটি তো দূর,বাড়ির লোকজন থেকে একটু -আধটু দামও পাচ্ছেনা।
একবারও এসে খবর নিচ্ছেনা ওর! সে যে সন্ধ্যে থেকে না খেয়ে আছে কারোর হুশ নেই । ভীষণ খিদেয় পেটে চলছে ইঁদুর ছোটার প্রতিযোগিতা। বিকেলের পর দাঁতে কিচ্ছু পরেনি। এতক্ষণ না খেয়ে থাকা যায়? মা-ও একবার এলোনা। বিয়ে হতে না হতেই ওকে পর করে দিলো? পিউয়ের এমন শান্ত হয়ে বসে থাকা পোষাচ্ছে না। বসার ঘর থেকে বাতাসে, কোরমা-পোলাওয়ের ঘ্রাণ ছুটে আসছে। ক্ষুদা বেড়ে প্রকান্ড হয়েছে তাতে।
কিন্তু বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। এ ঘরে রেখে যাওয়া সময় সুমনা,পুষ্প সবাই মিলে বলে গিয়েছে,
‘ একবার বাসর ঘরে ঢুকলে আর বের হওয়া নিষেধ।’
পিউ পেট চে*পে বাধ্য হয়ে বসে রইল। হাঁটুতে মুখ গুঁজে অসহায় শ্বাস ফেলল। বিয়েরও এত জ্বালা!
বসার ঘরে খেতে বসেছেন অতিথিরা। বিশাল জায়গা জুড়ে ছয়- সাতটার মত লম্বা লম্বা টেবিল পাতা হয়েছে। দফায় দফায় লোক বসছে খেতে। মেহমানদের আধিক্য না থাকায়, অসুবিধে হচ্ছেনা।
সিকদার বাড়ির তিন কর্তা,সাদিফ, ইকবাল তদারকি আর খাদিম দিতে ব্যস্ত । আনিস রিক্তকে নিয়ে বিপাকে পরেছেন। ছেলেটার জ্বর উঠছে হয়ত। তাপমাত্রা উষ্ণ হচ্ছে গায়ের। অসুস্থতায় খুনখুন করছে একটু পরপর। সুমনা ব্যস্ততায় ওনার কাছে রিক্তকে ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। আপাতত বাড়িময় ছেলেকে কাঁধে চড়িয়ে ঘুম পাড়ানোই তার কাজ।
সৈকত জামাই বলে তাকে কোনও দায়িত্ব দেয়া হচ্ছেনা। নিতে এলে টেনেটুনে খেতে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু ইকবালের বেলায় এই নিয়ম টিকলো না। সে এক বাটি রোস্ট সমেত হেলেদুলে আসার সময় ধূসর বলল, ‘ আমাকে দে,তুই খেতে বোস।’
ভালো একটা প্রস্তাবেও,
ইকবাল রুষ্ট চোখে চাইল। কড়া কণ্ঠে বলল,
‘ নতুন জামাইয়ের এত কথা বলতে হয়না। মানুষজন খারাপ বলবে। চুপচাপ বসে থাকো যাও।’
পাশ কাটিয়ে চলে গেল তারপর। তার মুরুব্বি হাবভাব দেখে, ধূসর হতবুদ্ধি হয়ে চেয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ।
***
খাওয়ার পর সুপ্তির লিপস্টিক উঠে গিয়েছে। বেসিনের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিপুণ যত্নে ঠোঁটে লাগাচ্ছে সে।
ঘুরে চাইতেই দূরে দাঁড়ানো ধূসর হাত উঁচিয়ে ডাকল। চোয়াল ঝুলে গেল সুপ্তির। ঘাবড়ে গেল। মনে পড়ল, তাদের গ্রামে ধূসরের বাঁধাই করা অতীত। শিহাব কে পি*টিয়ে আসার ঐতিহাসিক কান্ড। তার ছোট্ট আদোলে আতঙ্ক দেখা গেল। ভয়ে-ভয়ে এসে বলল, ‘জি ভাইয়া!’
‘ এদিকে এসো।’
ধূসর সোজা রান্নাঘরের দরজায় এলো। বূয়া বটিতে শসা কাটছিলেন। ওকে দেখেই শুধালেন,
‘ কিছু লাগব ভাইজান?’
‘ যা যা খাবার আছে একটু একটু করে একটা প্লেটে দিন তো। মাংসের ঝোল দেবেন না। আর ইলিশ মাছ দু-পিস দেবেন।’
তিনি ঘাড় কাঁত করলেন। তড়িঘড়ি, ব্যস্ত হাতে প্লেট,বাটি নিলেন। বড় বড় ড্যাকে, হাড়ি-পাতিলের ভেতর থেকে আদেশ মত সব তুললেন।
সুপ্তি পেছনে দাঁড়িয়ে চোখ পিটপিট করে দেখছিল। ভাবছিল, এসব কার জন্য?
ধূসর প্লেট নিয়ে ওর হাতে দিলো। নরম কণ্ঠে বলল,
‘ একটু কষ্ট করে এটা আমার রুমে দিয়ে এসো।’
সুপ্তির ভ্রু মিলিয়ে গেল এবার। ওনার রুমে তো পিউ আপু আছে। খাবার নিশ্চয়ই ওর জন্য? কত ভালোবাসা বউয়ের প্রতি! হেসে ফেলল সে। ঘাড় হেলিয়ে বলল, ‘ আচ্ছা।’
পিউ নিঃসহায়ের মত বসে। নখ দিয়ে চাদর খুঁটছে। ঘরটা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। পাটাতন বসিয়ে ফুলের টানেল দিয়েছে চারপাশে৷ সাদা চাদরের ঠিক মধ্যখানে লেখা “ধূসর-পিউ”।
ঘরে ঢুকে,এসব দেখেই পিউয়ের বুক ধ্বক করে উঠেছিল। ‘বাসর রাত’ কথাটা মনে করলেও ম*রে যাচ্ছিল লজ্জায়।
কিন্তু সেই লজ্জা ধীরে-সুস্থে গায়েব হলো খাবার সংকটে। বলেনা, ‘ ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়! পূর্নিমার চাঁদ সেখানে ঝলসানো রুটি ।’
পিউ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এতক্ষণে সবাই নিশ্চয়ই সব খেয়ে দেয়ে শেষ করে ফেলেছে? ওকে কী খেতে দেবেনা? সে নিরুপায় হয়ে জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে খেল।
রুমটা ধূসরের। কোথায় কী রাখা জানেনা! খাবার দাবার কিছু থাকলে ভালো হোতো। আগে বুঝলেও ওর রুম থেকে কয়েকটা চিপ্সের প্যাকেট এনে রেখে দেয়া যেত৷
সেই সময় সুপ্তি ঘরে ঢুকল। চাপানো দোর ঠেলে দেওয়ার শব্দে তাকাল পিউ। ওর মুখের আগে তার নজর পৌঁছাল হাতের খাবারের ওপর। চোখ দুটো চকচক করে উঠল ওমনি। সুপ্তির হা করার আগেই কে*ড়ে নিলো প্লেট৷
অল্পস্বল্প ভ্যাবাচেকা খেলো মেয়েটা । পিউ রীতিমতো ঝাঁপিয়ে পরেছে থালায়। তাড়াহুড়োয় দাঁনা তালুতে উঠে গেলে সুপ্তি পানি এনে দিলো। পুরো থালা পরিষ্কার -পরিচ্ছন্ন করে থামল পিউ। যুদ্ধ জেতার মত হাসি ফুটল ঠোঁটে। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে কৃতজ্ঞ চোখে চাইল সুপ্তির দিক। সে তখন পাশে বসে। পিউ বড় শ্বাস নিয়ে বলল,
‘ তোকে আনলিমিটেড ধন্যবাদ। আরেকটু হলে খিদেতে ম*রেই যেতাম।’
সুপ্তি বলল,
‘ ধন্যবাদ টা আমাকে না দিয়ে, নিজের বরকে দিও। সে-ই মনে করে সব পাঠিয়েছে, নাহলে বাড়িতে সবাই ব্যস্ত।’
পিউ আঙুল চাটছিল। কথাটায় থেমে তাকাল। নিশ্চিত হতে শুধাল,
‘ ধূসর ভাই?’
সুপ্তি সব দাঁত দেখিয়ে বলল, ‘ না,ধূসর জামাই।’
বিস্মিত চোখে কয়েক পল চেয়ে রইল পিউ। ধূসর ভাই এত কিছু মনে করে পাঠালেন? পুনরায় বউ বউ ভাবটা চেহারায় ফুটে উঠল তার। ভালো লাগার তোপে ফুলল লালিত কপোল। লজ্জা পেল ভীষণ! মানুষটা খেয়েছে কী না একবার জানতে না চেয়েই ও গপগপ করে খেয়ে ফেলল? এত বাজে বউ তো সে নয়। এতক্ষণ খেয়ে যেটুকু আনন্দ লাগছিল,এবার ক*ষ্ট লাগল পিউয়ের। মিহি কণ্ঠে জানতে চাইল,
‘ উনি খেয়েছেন? জানিস কিছু? ‘
****
অনুষ্ঠানের রেশ মোটামুটি কমেছে। কোনও রকম শান্ত হয়েছে হুটোপুটি। চিৎকার-চেঁচামেচির আওয়াজ আপাতত নেই। খাওয়া দাওয়া শেষে, কাছাকাছি নিবাসের অতিথিরা বেরিয়ে গিয়েছেন। তন্মধ্যে ইকবালের বাড়ির লোক অন্যতম। তাদের রাখার জোরাজোরি তে পরাস্ত হয়েছেন আমজাদ।
ইফতি আজ সারাটা বিয়ে বাড়ি তানহাকে খুঁজেছে৷ পায়নি কোথাও। আসেনি না কী? পিউকে যে জিজ্ঞেস করবে ওই সাহসে কূলোয়নি ওর। ধূসরের নীরব হু*মকি, আর বড় ভাইয়ের চোখ রা*ঙানোর পর সে মেয়ের দিকে তার তাকাতেও ভ*য় লাগে। ইফতি
মেসেঞ্জারে ঢুকে দেখেছে তানহা এক্টিভ নেই।
মন খারাপ হয়েছে ওর। আজকাল যেই মেয়েকেই পটাতে যায়,হাত ফস্কে মাছের মত বেরিয়ে যায় সেটা।
এদিকে তানহার জ্বর উঠেছে। যাকে বলে হাড়মজ্জা কাঁ*পিয়ে দেওয়ার মত জ্বর। ইদানীং এই জ্বরের প্রকোপটা একটু বেশি দেখা যাচ্ছে চারপাশে। ঘরের কেউ না কেউ অসুস্থ হতে শোনা যায়।
তানহার গতকালই আসার কথা ছিল বিয়েতে। পিউয়ের গায়ে হলুদ নিয়ে তাদের কতশত পরিকল্পনা!
কিন্তু ধুম জ্বর ছুটল দুপুরের পর। বিছানা রেখে উঠতে না পারার মতোন দশা।
পিউ শ’খানেক ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছে। এত জ্বর নিয়ে তানহার মা আসতে দেননি। সেই অবস্থাতেই ছিলো না মেয়েটা। ঘর শুদ্ধ দাওয়াত,কিন্তু মেয়ের শরীরের কথা ভেবে তারাও যেতে পারেননি। বিয়ে বাড়িতে, যেখানে সবাই ব্যস্ত থাকবে, সেখানে অসুস্থ মানুষ না নেয়াই ভালো। তানহা জ্বর ভুলে শুয়ে শুয়ে কাঁদল। একমাত্র বেস্টফ্রেন্ডের বিয়েতে যেতে না পারার দুঃখে কাহিল সে। পিউয়েরও সমান মন খারাপ। বিয়ে নাহলে ছুটে গিয়ে দেখে আসতে পারত। তবে যতটুকু পেরেছে, করেছে। সেজেগুজে সবার আগে ওকেই ভিডিও কল দিয়েছে। তানহার মা মেয়ের সামনে ফোন ধরেছেন, রুগ্ন চোখে শুয়ে শুয়ে দেখেছে মেয়েটা।
****
ঘড়ির কাঁটায় তখন ১টা বেজে ১০মিনিট।
ধূসরের চারপাশে পুরুষ মহলের আড্ডা। এক হালি চাচা, পিউয়ের দুই মামা, সুমনা,জবা সবার বাপের বাড়ির লোকজন। এদের হৈহৈ আলাপে বেশিক্ষণ ধৈর্য রাখতে পারছে না ধূসর। এত রাত হলো,
ঘরে যাবেনা, না কী? আর কতক্ষণ বসে থাকবে? তার সুপ্ত মেজাজ চটে যাচ্ছে।
এদিকে ইকবাল, সাদিফ,পুষ্প, মারিয়া কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। একটু আগেও তো ছিল এখানে। সবগুলো একসাথে গেল কোথায়?
ধূসর অধৈর্য, বিদ্বিষ্ট হয়ে কপালে আঙুল ঘষল। রুবায়দা দেখতে পেয়েই কাছে এসে শুধালেন,
‘ মাথাব্যথা করছে? কফি খাবি?’
ধূসর চোখ তুলল। তার শ্যামলা চেহারার আনাচে-কানাচে বিরক্তি। কোথায় বলবে,ঘরে যাবি? এই রাত দেড়টার সময় কফি খায় কে?
সে উঠে দাঁড়াল তৎক্ষনাৎ।
সংক্ষেপে বলল ‘ না। রুমে যাচ্ছি।’
অবিলম্বে হাঁটাও ধরল। মুরুব্বিরা খানিক থতমত খেলেন ব্যাপারটায়। কেউ কাউকে বুঝতে না দিয়ে স্বাভাবিক রাখলেন চোখ-মুখ।
কিন্তু রুবায়দা স্বাভাবিক থাকতে পারলেন না। তিনি ত্রস্ত পায়ে মিনা বেগমের কাছে এলেন। চাপা কণ্ঠে বললেন,
‘ আপা, ধূসরতো ঘরে চলে গেল। পায়েস, শরবত কিছুইত…’
পথিমধ্যেই, বুয়া থালায় মাজুনি ঘষতে ঘষতে বললেন,
‘ তয় কী করব আম্মা? রাইত বাজে দুইটা,আমনেরা হেরে অহনও বহাইয়া রাকছেন। নুতোন বউ রাইখা কেউ এমবায় থাহে?আরও ভাইজানের বালোবাসার বউ। কত যুদ্দ করল হেদিন দেকলাম তো!’
মিনা কিছু বললেন না। রুবায়দার কনুই টেনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন দ্রুত। এক কোনায় এসে বললেন,
‘ একটা কথা বলব রে রুবা?’
ভদ্রমহিলা অবাক হয়েছেন। এভাবে টেনে-টুনে আনা,আবার এত কাতর কণ্ঠে বিভ্রান্ত হয়ে বললেন,
‘ হ্যাঁ… বলোনা!’
মিনার চোখে-মুখে ইতস্ততার চিহ্ন। সময় নিয়ে,রয়ে সয়ে বললেন,
‘ আমি জানি, ধূসর তোর একমাত্র ছেলে। ছেলের বউ নিয়ে প্রতিটি মায়ের শখ-আহ্লাদ থাকে। তোরও ছিল। কত কথা, স্বপ্ন এসে আমাকে বলতি তুই। সেই ধূসরের আল্লাহর হুকুমে মনে ধরল আমার মেয়েকে। তার হুকুমেই বিয়ে হলো আজ। তুইত জানিস,পিউ ভালো-মন্দ তেমন বোঝেনা। আঠের বছর চলছে কিন্তু পরিপক্কতা একটু কম। লাফালাফি করে অনেক। সংসার যে কী ওর ধারণাই নেই। গভীরতা বোঝাতো বহু দূর। না বুঝেই অনেক ভুল করবে, তোর মন মতো পারবেন না হয়ত। তুই একটু শিখিয়ে পড়িয়ে নিস? যেমন ভাবে গড়লে তোর মনে হবে ও তোর যোগ্য বউমা তেমন করেই শাসন করিস।
তুই শেখালেই ও শিখবে। ছটফটে হলেও আমার মেয়েটা অনেক লক্ষী! বড়দের অসম্মান করেনা কখনও।’
রুবায়দা কিছুক্ষণ আশ্চর্য চোখে চেয়ে রইলেন। হতবিহ্বল হয়ে বললেন,
‘ আপা! তুমি এসব, আমাকে বোলছো? ‘
মিনা হা করলেন,পূর্বেই তিনি ঝাড়া মেরে হাতটা ছাড়িয়ে নিলেন। রেগে বললেন,
‘ কিছু বলতে হবে না আপা, সব বুঝেছি! মুখেই আমাকে বোন বলো। সামনেই এত ভালোবাসা!
পিউ তোমার একার মেয়ে তাইনা? আমার মেয়ে না ও? ও কেমন আমি তা জানিনা?’
‘ রাগ করছিস কেন? আমি তো…’
‘ তুমিতো তুমি। বুঝিয়েই দিলে আমি পিউয়ের শুধু চাচিই রয়ে গেলাম, মেজ মা হতে পারিনি। কেন আপা? আমি কি কোনও দিন কম ভালোবেসেছি ওকে? আলাদা চোখে দেখেছি? তাহলে এসব কীভাবে বলতে পারলে?
মিনা অসহায় চোখে চাইলেন। কী বলতে, কী বলে ফেলেছেন! রুবায়দা উলটে চেঁতে গেল। তিনি বাহুতে হাত ডলতে ডলতে বললেন,
‘ ও মেজো,শোন না! একটু মাথাটা ঠান্ডা কর বোন। আমি ওভাবে বলতে চাইনি। তুইতো চিনিস তোর আপাকে। আচ্ছা ভাই, ভুল হয়েছে। মাফ চাই।’
রুবায়দা মুখ বেকিয়ে আরেক দিক তাকালেন। মিনা ঠোঁট ওল্টালেন শিশুর ন্যায়। কাঁদো-কাঁদো স্বরে বললেন,
‘ মেয়ের মা হিসেবে না হয় একটু বলেই ফেলেছি। তাই জন্যে…’
পরপর কণ্ঠে দুষ্টুমি এনে বললেন,
‘এখন এই রাগে মুখ ফিরিয়ে রাখবেন বেয়াইন সাহেবা? ছেলেপক্ষ বলে কি মাথা কিনে নিয়েছেন? এ কেমন অবিচার বলুন তো!’
চোটপাট আর টিকল না রুবায়দার৷ হেসে ফেললেন। পরপর ভ্রু গুটিয়ে বললেন, ‘ এরকম আর কখনও বলবে?’
মিনা বিশ্রান্ত কণ্ঠে বললেন,
‘ না বাবা, ঘাট হয়েছে আমার! মুখেও আনব না এসব।’
রুবায়দা মিনাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
‘ আপা! পিউ আমার কাশ্মিরী আপেলের মত সুন্দরী বউমা। এমন বউমা বিনা পরিশ্রমে পেয়ে আমি তো সৌভাগ্যবতি মনে করছি নিজেকে।’
মিনা মাথা নাঁচিয়ে বললেন,
‘ আর আপনার বাহাদুর ছেলেকে মেয়ের জামাই হিসেবে পেয়ে আমিও সমান সৌভাগ্যবতী।’
দুজনেই হেসে উঠলেন৷ জবা দেখেই, সতর্ক কণ্ঠে বললেন,
‘ একী! তোমরা কী নিয়ে হাসছো? আমাকেও বলো, আমিও শুনব।’
পরপর সুমনা ভিড়লেন সেখানে। সব কাজ ফেলে,ওমন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই চার জায়ের হাস্যরসের সভা বসল।
বুয়া তখন রান্নাঘর থেকে মাথা বের করে বললেন,
‘ খালাম্মা! খাওন তো পইছা যাইবে,ফিরিজে রাখলেন না?’
খোশগল্প স্থগিত। মিনা মনে করার ভঙি করে বললেন,
‘ ও হ্যাঁ হ্যাঁ।’
রান্নাঘরে যেতে গেলেই জবা টেনে ধরে বললেন,
‘ ও হ্যাঁ হ্যাঁ নেই। সারাদিন তুমি আর মেজ আপা অনেক খেটেছ! এখন সোজা ঘরে যাবে। বাকীটা আমরা দেখছি।’
‘ আহা,তোরা পারবিনা।’
সুমনা বললেন, ‘ বলে দিলে সব পারব। তুমি দেখিয়ে দিয়ে যাও,আমরা চুটকিতে শেষ করছি।’
বাধ্য হয়ে ওনাদের সবটা বুঝিয়ে দিলেন মিনা। পাশে দাঁড়িয়ে থাকবেন ভাবলেও,দুজন মিলে দুই জা’কে ঠেলেঠুলে পাঠিয়ে দিলেন ঘরে।
****
ধূসর কক্ষের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরে। হতভম্ব হয়। নীচে মনে মনে খোঁজা বিচ্ছুর দলগুলো সব এখানে হাজির। রীতিমতো দরজার সম্মুখে সাড়ি বেঁধে প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে বসেছে একেকজন। প্রথমে সাদিফ,তারপর ইকবাল,পাশে পুষ্প,মারিয়া,শান্তা, সুপ্তি। হাসাহাসি করছিল কিছু নিয়ে,ওকে দেখেই সবাই তটস্থ হয়ে ফিরল। ইকবাল প্রমোদ কণ্ঠে বলল,
‘ আরেহ! আসুন আসুন ভায়রা ভাই। আপনারই অপেক্ষায় পথ চেয়ে ছিলাম।’
ধূসর প্রশ্ন ছুড়ল ‘ তোরা এখানে?’
পুষ্প ছটফটে গলায় জবাব দেয়, ‘ আমরা গেইট ধরেছি।’
সাদিফ বলল, ‘ ভাইয়া, তুমি একই বাড়িতে বিয়ে করে গেইট ধরা,জুতো চুরি, হাত ধোঁয়া, এইসব কিছু থেকে বেচে গিয়েছ। কিন্তু কথায় বলে সবার জন্য আঈন সমান। ইকবাল ভাই যা যা ভুগেছেন,তোমাকেও ভুগতে হবে। আর তাই, আমরা সবাই মিলে, তোমার বাসর গেট ধরেছি। আভি আন্দার যানে মে, প্যায়সা দেনা পারেগা।’
ইকবালের ঠোঁটে হাসি।
ভ্রু উঁচিয়ে উঁচিয়ে বলল,
‘কী শালা সমন্ধি? কেমন লাগছে এখন? ‘
পরপর গুরুতর ভঙিতে বলল, ‘ আমার সময় তুই সাহায্য করিসনি। করলে এখন তোর সাপোর্টে থাকতাম৷ সাদিফ আমাকে বাচিয়েছিল,তাই আমি ওর সাপোর্টে। ‘
দুজন হ্যান্ডশেক করল তারপর। ধূসর বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
‘ আমি খুব টায়ার্ড ইকবাল! ভালো লাগছে না এসব। সর।’
পুষ্প আপত্তি জানিয়ে বলল,
‘ না না,এসব বললে তো হবে না। এটা আমাদের অধিকার। টাকা না দিয়ে আপনি যেতে পারবেন না।’
সাদিফ তাল মলিয়ে বলল,’ হ্যাঁ। টাকা না দিলে প্রবেশ নিষিদ্ধ।’
ধূসর কপাল কুঁচকে বলল, ‘ তোরা দুটো না পিউয়ের বড় ভাই-বোন? লজ্জা করছেনা ওর বাসর রাতে গেট ধরছিস?’
পুষ্প-সাদিফ মুখ দেখা-দেখি করল। পরপর দাঁত বের করে সমস্বরে বলল, ‘ একটুও না।’
সাদিফ কাঁধ উঁচিয়ে জানাল,
‘ আমরা পিউকে চিনিইনা? কে ও? কী নাম ওর? আমরাতো তোমাকে চিনি ভাইয়া। তুমি আমাদের বড় ভাই। বড় ভাইয়ের বাসরের গেট ধরা ছোট ভাই বোনদের কর্তব্য। আমি আবার কর্তব্য নিয়ে হেলাফেলা করতে পারিনা।’
ইকবাল বলল,’ আমিও না।’
টাকা আদায়ের এই আন্দোলনে শান্তা আর সুপ্তি নিরব৷ তারা দল ভারি করতে বসলেও টু শব্দ করছেনা। শান্তার ভেতর ভেতর খারাপ লাগছে। কখনও এই লোকটার ওপর মারাত্মক ক্রাশ ছিল ওর। আচ্ছা,সে তো পিউয়ের থেকে অল্প একটু ছোট। উনি চাইলে বিয়েটা তো ওকেও করতে পারতেন।
মারিয়া মুখ খুলল এবার। ধূসরকে বলল,
‘ ভাইয়া থাক,এদের সাথে বার্গেইনিং না করে বিষয়টা মিটিয়ে নাও। দর-কষাকষি তোমার সাথে যায়না।’
তার পামপোট্টিতে ধূসর গলল কী না বোঝা গেল না। বুকে হাত বেঁধে ভ্রু নাঁচিয়ে শুধাল,
‘ তা কত দাবি তোমাদের?’
সবাই এক জোটে হৈচৈ বাধিয়ে জানাল,
‘ ৩৫ হাজার। ‘
পুষ্প হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে হিসেব দিলো,
‘ দেখুন ভাইয়া! আমরা মোট ছয়জন। সবাই ছ ‘হাজার করে নিলে ৩৬ হাজার হচ্ছে। আপনাকে তো আমরা অনেক ভালোবাসি, তাই এক হাজার টাকা ডিসকাউন্ট দিচ্ছি। ‘
ধূসর মাথা দুলিয়ে বলল, ‘ ও আচ্ছা।’
তার নিরুদ্বেগ ভাবভঙ্গি দেখে ইকবাল- সাদিফের কানের কাছে গিয়ে বলল,
‘ আমারা কি কম বলে ফেললাম সাদিফ বাবু?’
সে দ্বিধাদন্দে ভুগে বলল, ‘ পঞ্চাশ চাইলে মনে হয় ভালো হোতো। ‘
ধূসর বিনাবাক্যে পকেটে হাত ভরল। পরপর ‘চ’ সূচক শব্দ করে বলল,
‘ শীট! মানিব্যাগ তো রুমে। নিয়ে বের হইনি। জায়গা দে,গিয়ে নিয়ে আসি।’
ইকবাল ওমনি দাঁড়িয়ে বলল, ‘ একদম না। গেলে আর আসবিনা তুই৷ ‘
ধূসর ততোধিক শান্ত ভঙিতে বলল, ‘ তাহলে টাকা দেব কোত্থেকে? ‘
সবাই একটু দোটানায় পড়ল। সাদিফ ফিসফিস করে বলল, ‘ আমি গিয়ে নিয়ে আসব?’
ইকবাল তেমন করেই জবাব দিলো,’ দরজা খুললেই যদি দৌড়ে ঢুকে যায়? গায়ে তো মহিষের মতো শক্তি। আমি ধরে রাখতে পারব না।’
সাদিফ চিন্তিত ভঙিতে ঠোঁট কাম*ড়াল। ধূসর ব্যস্ত কণ্ঠে বলল, ‘ যা করবি তাড়াতাড়ি! ‘
ইকবাল দুষ্টুমি করে বলল, ‘ কেন? বউয়ের কাছে যাওয়ার জন্য তর সইছেনা?’
ধূসর মুখের ওপর বলল, ‘ না।’
মারিয়া আগ বাড়িয়ে বলল,
‘ আরে, ভাইয়া যখন বলছেন, রুম থেকে এনে দেবেন তখন নিশ্চয়ই দেবেন। পৃথিবী উলটে গেলেও কিন্তু ধূসর ভাইয়ার কথা নড়চড় হয়না।’
ইকবাল মনে মনে ভাবল,কথাটা ঠিক।
এদিকে সবাই ওর মুখের দিকেই চেয়ে। দলের সিনিয়ির সদস্য বলে কথা! পুষ্প সন্দেহী কণ্ঠে শুধাল,
‘ সত্যি দেবেন তো ভাইয়া?’
ধূসরের উত্তরের আগে, মারিয়া বলল,
‘ আরে দেবে দেবে। ভাইয়া ওমন না কী! নাও জায়গা ছাড়ো, ওনাকে যেতে দাও।’
তার কণ্ঠে দৃঢ় বিশ্বাস গলেগলে পরছে।
ইকবালও মাথা হেলিয়ে স্বায় দিলো। একটা প্লাস্টিকের চেয়ার সরিয়ে রাস্তা দিলো ওকে। খুলে দিলো দরজার তালা। ধূসর বক্র হাসল। সবার সামনে দিয়ে টানটান বক্ষে, লম্বা পায়ে ঢুকল রুমে। তারপর পেছন ঘুরে চাইল । সব কটা দরজায় ঝুলে এসেছে প্রায়। ধূসর ঘাড় ডলে, আচমকা ফট করে দরজা লাগিয়ে দেয়। টেনে দেয় ছিটকিনি। ভড়কে গেল ওরা। তব্দা খেয়ে হা করে মুখ দেখা-দেখি করল। তারপরই শুরু করল ধাক্কানো।
পুষ্প আর্তনাদ করে বলল ‘ এ কী! এটা কী হলো?’
সাদিফ বলল,’ ভাইয়া দিস ইজ চিটিং! ‘
ইকবাল বলল, ‘ শালা, সম্বন্ধি,ভায়রা, অসভ্য,চিটিংবাজ। ‘
ধূসর ঠোঁট কামড়ে হাসল। উদ্বেগহীন জানাল,
‘ ধা*ক্কিয়ে লাভ নেই। কাল সকালে দেখা হবে।’
‘ সকালে দেবেন?’ ‘
‘ হ্যাঁ। ‘
‘ ঠিক তো?’
ধূসর বলল, ‘ বিশ্বাস করলে কর,নাহলে দাঁড়িয়ে থাক সারারাত। সকালের আগে দরজা খুলছি না।’
মারিয়ার বড় মুখ এবার ছোট হয়ে গেল। ধূসরের টান টানতে গিয়ে চেহারায় লেপ্টে গিয়েছে অদৃশ্য চুন-কালি। চোর চোর ভাব করে চুপ রইল সে। সাদিফ কটমটে চোখে চেয়ে বলল,
‘ সব আপনার জন্য হয়েছে। ‘
তারপর ওর মত করে বলল,
‘ পৃথিবী উলটে গেলেও ধূসর ভাইয়ার কথার নড়চড় হয়না।’
এবার হলো তো?’
মারিয়া মাথা নুইয়ে বলল, ‘ আমি কী করলাম?’
পুষ্প মন খারাপ করে বলল , ‘ এখন কী হবে? শুধু শুধু আধ ঘণ্টা ধরে বসে ছিলাম।’
ইকবাল তার বিফল চেহারা দেখে, মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘ ডোন্ট বি স্যাড মাই লাভ! হতচ্ছাড়াটা দিন-দিন বাটপার হয়ে যাচ্ছে। যখন বলেছে আজ খুলবেনা,খুলবেইনা।’
পরপর নিশ্চিন্ত কণ্ঠে বলল,
‘ তবে সকালে দেবে বলল যখন, দেবে। ভেবোনা এত। চোর হলেও লোকটা ভালো। কথা একটা বললে রাখে কিন্তু। ‘
‘ তাহলে আর দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। চলো যাই, ঘুম পাচ্ছে আমার। শান্তা,সুপ্তি তোরাও ঘুমা গিয়ে।’
ওরা মাথা দোলাল। পুষ্প হাই তুলল। তার কাঁধ পেঁচিয়ে রুমে রওনা করল ইকবাল। শান্তা- সুপ্তি আজ পিউয়ের ঘরে শোবে,সাথে মারিয়াও। সে ওদের পেছনে,পা বাড়াতে গেলেই আচমকা হাতটা টেনে ধরল সাদিফ।
মারিয়া চমকে তাকাল। সাদিফ ভ্রু গুটিয়ে শুধাল,
‘ আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’
‘ রু রুমে…’
বলতে বলতে তার নেত্রদ্বয় সতর্ক ভাবে আশপাশ দেখে নেয়।
সাদিফ বলল, ‘ এখন রুমে যেতে হবেনা।’
‘ তা তাহলে?’
সাদিফ দুষ্টু হেসে হুবহু ওকে নকল করে বলল,
‘ তা তাহলে, আমার একটা প্রস্তাব আছে, রাখবেন?’
মারিয়া লজ্জা পেল। নিম্নাষ্ঠ চেপে, আস্তে করে শুধাল,’ কী?’
‘ ছাদে যাব।’
সে ভ্রু কপালে উঠিয়ে বলল,
‘ এত রাতে ছাদে?’
‘ কেন? ভয় লাগছে?’
মারিয়া মুচকি হাসল। নরম কণ্ঠে স্বীকারোক্তি দিলো,
‘ আপনি পাশে থাকলে কীসের ভয়?’
সাদিফের অভিব্যাক্তি বদলায়। বৃহৎ হয় চেহারার ঔজ্জ্বল্য। ওষ্ঠপুটে চকচকে হাসি বহাল রেখে দূর্বোধ্য চোখে চাইল সে। কণ্ঠ নীচু করে বলল,
‘ তাহলে যাওয়া যাক?’
***
সবাই চলে গিয়েছে বুঝতেই শব্দহীন, বিজয়ী হাসল ধূসর। হাঁপ ছাড়ল। শরীরের রগে রগে ক্লান্তি ছুটছে। ভোর পাঁচটায় উঠেছিল,তারপর থেকে বিছানা ছুঁয়েও দ্যাখেনি। মিটিমিটি হাসি ঠোঁটে রেখে পেছন ঘুরল সে। ওমনি স্তব্ধ হলো চক্ষুদ্বয়। স*জোরে তীর এসে বসল ঠিক হৃদপিন্ড বরাবর।
বউ বেশে, এক লাল টুকটুকে অপ্সরী ঘুমোচ্ছে বিছানায়। কী সুখভীর নিদ্রা! কী ভারী নিঃশ্বাসের আওয়াজ! সাথে ললিত একটি মুখ। মাথার নীচে রাখা চুড়ি পরা হাতগুলো লাইটের কড়া আলোতে জ্বলছে। দীপ্তি দিচ্ছে নাকের পাথুরে ফুল। এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর নেই। নিষ্পাপ মুখখানি এসে যখন সামনে দাঁড়ায়,ধূসর এই জগত ভুলতে সক্ষম। সক্ষম ওই রাঙা ওষ্ঠযূগলের হাসির জন্য,ধরিত্রীর সকল নিয়ম ভা*ঙতে। ধূসর অভিভূতের ন্যায়, নিষ্পলক চেয়ে রইল। নিদ্রিত ওই ছোট্ট মেয়েটা ওর বউ! ওর ভালোবাসা! পার্থিব জগতের মাঝে অপার্থিব সৌন্দর্যের অধিকারীনি, তার হৃদয়হরনী পিউ!
ধূসরের তুষাতুর দুটো নিশ্চল আঁখি একসময় পলক ফেলল। ঠোঁট দুটো সরে গেল দুদিকে। বিস্তর বক্ষপট ওঠানামা করল তুষ্টিতে,তৃপ্তিতে।
আচমকা চোখ মেলল পিউ। তন্দ্রাচ্ছন্ন, নিভু নেত্রযূগল প্রথমেই খুঁজে পেলো একটু দূরে দাঁড়ানো ওই মানুষটিকে। বহু প্রতীক্ষার,অনেক সাধনার,আর ভীষণ ভালোবাসার ধূসর ভাই!
পিউ তড়াক করে উঠে বসল। ঘুমিয়ে পড়েছিল ভেবেই লজ্জা পেলো,বিস্মিত হলো। কিন্তু ওর কী দোষ? এতক্ষণ কুণ্ঠায় অধীর,অস্থির হয়ে পায়চারি করেছিল! আই -ঢাই করে একবার এদিক থেকে সেদিক গিয়েছে রুমের। ধূসর ভাই আসবেন, তারপরের টুকু ভেবেই তরতরিয়ে ঘেমেছিল। নার্ভাস-নেসে দিশা হারিয়ে বারবার ওয়াশরুম অবধি ছুটেছে। শেষে একটু বিছানায় শরীর ছাড়তেই রাজ্যের ঘুম নামল। এমন ঘুম যে,টেরই পেলোনা কিছু? ওর তো এই খাটের মধ্যমনিতে বসে থাকার কথা। যেমনটা ও কল্পনায় দেখতো। তার মাথায় টানা বড়সড় ঘোমটা স্বযত্নে এসে তুলবেন ধূসর ভাই। ওর নীচু মুখ তুলবেন আঙুলে। কপালে চুমু আঁকবেন ভালোবেসে।
পিউ অনুচিন্তনের রেশ বেশি দূর গড়াতে দেয় না। ধূসর দাঁড়িয়ে আছে দেখেই ব্যস্তভাবে উঠে এগিয়ে যায় কাছে। ওকে আসতে দেখে সে থামল,বাড়ানো কদম পিছিয়ে আনল। পিউ ঝটপট ওর পা ছুঁয়ে সালাম করল। সুমনা বেগম শিখিয়ে দিয়েছিলেন যাওয়ার সময়।
ধূসরের ভ্রুদ্বয়ে ভাঁজ পড়ল। অবাক হলো খানিক। পিউ সাফাই দেওয়ার ভঙিতে বলল,
‘ আমি একদম ঘুমোতে চাইনি ধূসর ভাই। কখন যে চোখটা লেগে এসেছিল!’
ধূসরের মন নেই ওতে। সে প্রখর, মনোযোগী চোখে পিউয়ের পা থেকে মাথা অবধি দেখে নেয়। পিউ অতটা লম্বা নয়,ছোটখাটো,আদুরে আনন। কিন্তু শাড়ির ভারে আজ ওকে ছোট তো দূর,পূর্নাঙ্গ নারী লাগছে। যে নারী ধূসরের ব্যক্তিগত,ওর বাম প্রকোষ্ঠে লুকিয়ে রাখা একান্ত প্রেম।
ধূসর একটু এগোয়। পিউয়ের ক্ষুদ্র মুখবিবরটা তুলে নেয় অমসৃণ অঞ্জলিপুটে৷
বুড়ো আঙুল ছুঁয়ে দেয় নাকের পাথরের ওপর৷ তাকে চুপ দেখে পিউ ফের বলতে গেল,
‘ আপনি কি রাগ করে….’
সহসা একটা আঙুল লিপস্টিক পরিহিত ঠোঁটে চেপে ধরল ধূসর। থামল পিউ।
ধূসর হ্যাঁ -না কিচ্ছু বলল না। একটা টু শব্দও এলো না বাইরে। আচমকা, চট করে ওকে কোলে তুলে ফেলল। পিউ চমকে গেল। কিছু বোঝার আগেই মাথা এসে ঠেকল তুলতুলে বালিশে। ধূসর গায়ের ওপর আধশোয়া হতেই গাত্রের রক্ত ছোটাছুটি তৎপর থেমে গেল তার।
কী হবে! কী হতে পারে! ভাবতেই কাঁটার মতন শক্ত হয়ে গেল লজ্জায়। ফেরত এলো চিরচেনা সেই কম্পন,সেই হাত পায়ের টাল-মাটাল তান্ডব।
তার-ওপর ধূসরের দুটো নেশাল চোখ। তীরের মত চাউনী, মদ্যক অক্ষিপট। এসব পিউকে সুস্থ থাকতে দিলো না। পেটানো শরীরের নীচে থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে সে। কণ্ঠস্বরে ভূমিকম্প নামিয়ে বলতে যায়,
‘ আমি..একটু মানে..’
ধূসর কথা সম্পূর্ন করতে দিলো না। ওর গরম ওষ্ঠপুট কানের পাশে যেতেই আপনা-আপনি মুখ বন্ধ হয়ে গেল পিউয়ের। শুনতে পেলো একটি ফিসফিসে কণ্ঠ,
‘ এই রাত আমার,বলেছিলাম না? আজ তুই কাঁপলেও ধূসরের,না কাঁপলেও ধূসরের। ‘
বলতে বলতে ঠোঁট দুটো ছুঁয়ে গেল ওই রক্তাভ গাল। পিউ লজ্জায় হাঁসফাঁস করে উঠল। একে একে কপাল,চোখের পাতা,নাকের ডগা সমস্ত কিছু সিক্ত হয় ধূসরের চুম্বনে। পিউ চোখ দুটো খিঁচে নিলো তখন, যখন মানুষটার উষ্ণ অধর ঘূর্নিঝড় বইয়ে দিলো তার গলার ভাঁজে। এতটা অস্থির,অশান্ত ধূসর কখনও হয়নি,কখনও না।
পিউ একটা সময় সয়ে নিলো। বিলম্ব হলেও আকাঙ্ক্ষিত পুরুষের কাঙ্ক্ষিত ছোঁয়ায় ধাতস্থ করল নিজেকে। তিন বছর ধরে, তৃষ্ণার্ত চাতকের ন্যায় অপেক্ষা করা মানুষটার নিকট সহাস্যে সমর্পণ করল নিজেকে। তার দুটো শীর্ণ হাত, আকড়ে ধরল ধূসরের উন্মুক্ত, চওড়া, শ্যামলা পিঠ। রাত্রির তিন প্রহরে রচিত হলো তাদের ভালোবাসার বিস্তর রচনা,নতুন সূচনা।
চলবে।