#এক_সমুদ্র_প্রেম!
কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(৫৯)
সকাল দশটা। সবে সবে বাইরে নরম রোদের ছটা নেমেছে। কুমড়ো ফালির মত দৃশ্যায়ন সূর্যটা শান্ত। সোনালী,চকমকে প্রকৃতির এই সময়টায়
সিকদার বাড়ির খাবার টেবিল সম্পূর্ন নিস্তব্ধ,নীরব। এতগুলো মানুষ, অথচ একটুও শব্দ নেই কারো। কয়েক পল মূর্তি বনে রইল একেকজন। দুচোখ ছাপানো রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে দেখে গেল আমজাদের হাস্যজ্জ্বল মুখবিবর।
বিলম্ব হয় তাদের ধাতস্থ হতে। আনিস সবেগে বললেন,
” পিউতো এখনও ছোট ভাইজান। মাত্র ইন্টার দিলো,ভার্সিটিতে ওঠার আগেই বিয়ে দিয়ে দেবে?”
তাল মেলালেন গৃহীনিরা। মিনা চিন্তিত কণ্ঠে বললেন,
” আপনি হঠাৎ করে ওর বিয়ে নিয়ে পড়লেন কেন? এই সবে সবে একটা মেয়ের বিয়ে দিলাম,দু তিন বছর যাক তারপর নাহয়….”
রুবায়দা বললেন,
” পিউতো এখনো সংসারের কিছুই বোঝেনা ভাইজান। ওর কি সেই ম্যাচিউরিটি এসেছে বলুন তো!”
আমজাদ কপাল কোঁচকালেন,
” আরেহ,তোমরা এমন ভাবে বলছো যেন আমি এক্ষুণি মেয়েটাকে তুলে দিচ্ছি? ওনারা শুধু দেখতে আসবেন। পছন্দ হলে কথা পাকাপোক্ত হবে। দেখতে এলেই তো আর বিয়ে হয়ে যায়না! তাছাড়া, বিয়ের পরেও পড়াশুনা করা যায়। রুবা,তুমি বিয়ের পরে পড়োনি? সুমনা পড়েনি? পুষ্প পড়বেনা? তাহলে? পিউও পড়বে।”
আফতাব তীক্ষ্ণ, প্রখর চাউনীতে ধূসরকে দেখছেন। র*ক্তাভ হয়ে উঠছে ওর অক্ষিকোটর। ক্রমে ফুঁসছে চোখা নাক। ঝড়ের পূর্ভাবাস ছেলের চেহারা দেখেই বুঝে নিলেন তিনি।
পিউ মাত্রাতিরিক্ত হো*চট খেয়েছে। যাকে বলে অদৃশ্য ভাবে মুখ থুবড়ে পরেছে ধা*ক্কায়। কাশি সামলে বাবার দিক প্রকট আঁখিতে চাইল সে।
রুদ্ধশ্বাসে বলল,
” আব্বু, আব্বু আমি এখন বিয়ে করব না।”
আমজাদ মোলায়েম কণ্ঠে বললেন,
” কেন করবেনা মা? তুমি মিছিমিছি ভ*য় পাচ্ছো। আজ শুধু দেখে যাবে। কথাবার্তা হবে। বিয়ে হতে বহু দেরী।”
পিউয়ের জ্বিভ ঠেলেঠুলে বের হতে চাইছে,
‘ আমি ধূসর ভাইকে ভালোবাসি’। কিন্তু কী মুসিবত! পারছে না কেন? সব এমন করে কাঁ*পছে কেন ওর? যেন সমস্ত দুনিয়াটা ঘুরছে।
সে আপ্রাণ চেষ্টা চালাল,নিজেকে একটু সাহসী করার। বিন্দুমাত্র পারল না। প্রতিটাবার কেমন অলখ ব্যর্থতা শক্ত হস্তে মুখ,গলবিল শুদ্ধ চেপে রাখল।
বিবেক, লজ্জা,কুণ্ঠা জ্ঞান দিলো চেঁচিয়ে,
‘ এত এত গুরুজনের সামনে কী করে বলবি ওসব? ‘
পিউ আহত মন নিয়ে বসে রয়। আজ যেন কানায় কানায় উপলব্ধি করল সেদিন পুষ্পর পরিস্থিতিটুকু। আবিষ্কার করল,
না,একটা মেয়ের জন্যে এর চাইতে কঠিন,অসহ সময় দুটি হয়না।
তারপর অসহায় চোখে চাইল ধূসরের পানে। কেন চুপ করে আছেন তিনি? কিছুই কি বলবেন না? উত্তর হিসেবে শূন্য,রিক্ত হলো পিউ।
স্টিলের মতন শক্ত হয়ে বসে থাকা ধূসর ভাইকে দেখে ব্যথায় টনটন করে ওঠে বুক। নিহ*ত মনে ভাবে, ওনার হয়ত বলার কিছু নেই।
আনিস শুধালেন, ” ছেলে কী করে ভাইজান?”
” সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। ঢাকায় দুটো বাড়ি আছে। আমার বন্ধু মুশফিক? ওনার থেকেই খোঁজ পাওয়া। এত চমৎকার ব্যবহার, কথা বললে বুঝবে। আবার ছেলে দেখতেও বেশ ভালো। তাই ভাবলাম এমন দারুণ সমন্ধ হাতছাড়া করে কী লাভ? ”
বলার সময় আমজাদের অভিব্যক্তি ছিল রমরমে। যেন ভীষণ খুশিতে আপ্লুত তিনি।
” তাই বলে এত ছোট মেয়ে ভাইজান!”
তিনি বললেন,
” তোমরা এমন করে কেন ভাবছো সুমনা? আমিতো আজই বিয়ে দিচ্ছি না।”
মিনা মুখ শুকনো করে বললেন,
” তবুও! হঠাৎ করে এভাবে হয় না কি? আর আপনি তো আমাকেও একবার কিছু জানালেন না।”
” তোমাকে পাই কোথায়? সারাক্ষণই তো থাকো রান্নাঘরে। দু দন্ড কথা বলার, আলোচনা করার সময় দাও? আর আমি ভেবেছিলাম, কথাটা সবাইকে একসাথে জানাব। চমকে দেব তোমাদের । তাই সবার সামনে বলেছি। আমার ওনাদের সাথে কথা বলা শেষ, এখন পিউকে পছন্দ করলেই সব এগোবে।”
আফতাব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এখানে ওনার বলার কিছু নেই। বাকীরা পরাস্ত নেত্রে একে-অন্যকে দেখলেন। আমজাদ সিকদার কথা দিয়ে এসেছেন যখন, বাকবিতন্ডার কোনও ফাঁকফোকরই রইল না।
আমজাদ পাথর বনে থাকা ধূসরকে বললেন,
” তাহলে বিকেলে চলে এসো ধূসর? তুমি বাড়ির বড় ছেলে, পিউয়ের বড় ভাই, তোমার থাকা জরুরি।”
ভদ্রলোকের খাওয়া শেষ ততক্ষণে। টিস্যুতে মুখ মুছতে মুছতে সিড়ির দিক পা বাড়ালেন। তক্ষুণি শোনা গেল, একটি তেজী, দগদগে স্থূল স্বর। থেমে থেমে বলছে,
” কোনও… পাত্রপক্ষ.. আসবেনা।”
আমজাদ থেমে গেলেন। পিছন ফিরলেন সহসা। নিশ্চিত হতে শুধালেন,
” কী বললে?”
পুষ্প ভীত নজরে ইকবালের দিক তাকায়। তার দৃষ্টিতেও শঙ্কা স্পষ্ট। পুষ্প চাপা কণ্ঠে বলল,
” এবার যে কী হবে!”
সে বিড়বিড় করল, ” কু*রুক্ষেত্র বাধবে।”
ধূসর উঠে দাঁড়ায় চেয়ার ছেড়ে।
‘ এই বাড়িতে, পিউকে দেখার জন্যে কেউ আসবেনা। যদি আসে, সে চৌকাঠে পা রাখলেও সিকদার ধূসর মাহতাব সেই পা ভে*ঙে ধরিয়ে দেবে হাতে। ”
তার বরফ-ছু*রির মত শীতল চাউনী,পাথরের মত কঠোর চিবুক আর পর্বতের ন্যায় সটান দেহের সঙ্গে ভেসে এল নিখাদ কণ্ঠ। যা একটু হলেও থমকে রাখল সিকদার বাড়ির সকলকে। এক রাশ বেগতিক থমথমে হাওয়া এসে ছুঁয়ে গেল তাদের৷
সাদিফ একবার পিউকে দেখছে,একবার ধূসরকে। আগত পরিস্থিতি অনুমান করে ঘাবড়ে আছে সে।
আমজাদ আশ্চর্য বনে বললেন,
” মানে! কী অভদ্রের মত কথাবার্তা এসব? আমার গেস্ট আসবে,আর তাদের সঙ্গে তুমি এরকম আচরণ করবে? মানে টা কী এসবের?”
ধূসর স্পষ্ট বলল,
” আপনার গেস্ট একজন কেন,একশ জন আসুক,তাতে আমার যায় আসেনা। কিন্তু ওই যে বললাম,পিউ ঘটিত কেউ আসবে না। না মানে, না।”
আমজাদ ফুঁসে উঠলেন ওমনি। উঁচু হলো কণ্ঠ। চুপ করে বসে থাকা আফতাবকে বললেন,
‘ আফতাব! শুনছো তোমার ছেলের কথা? দেখছ ওর বেয়া*দবি? আমার মুখের ওপর কথা বলছে সে।’
আফতাব অথৈ জলে পরে হাঁপিয়ে যাওয়ার ন্যায় তাকালেন। নরম গলায় বোঝাতে গেলেন,
‘ ভাইজান,পিউ ছোট তাই হয়ত ও…. ”
ধূসর মাঝপথে কথা টেনে নিয়ে বলল,
‘ পিউ ছোট হলেও বিয়ে হবেনা। বড় হলেও না। মোট কথা ওর বিয়ে অন্য কোথাও হবেনা। ‘
আমজাদ হতবাক হয়ে বললেন,
‘ কেন হবেনা? কীসের জন্যে? আর হবে না হবে সেই সিদ্ধান্ত তুমি নেবে? আমি ওর বাবা,আমি যা বলব তাই হবে।’ ‘
ধূসর মুখের ওপর বলল,
” হবে না বড় আব্বু। এই একটা ব্যাপারে আপনার কোনও কিছুই শোনা হবেনা। ”
থামল সে। একবার পিউয়ের কাঠ,আত*ঙ্কিত, র*ক্তিম ফর্সা চেহারার দিক চাইল। ফের আমজাদের দিক চেয়ে প্রতাপ সমেত ঘোষণা করল,
” শুধু আপনি না,বাড়ির সবাইকে বলছি,পিউয়ের বিয়ে আমার সাথে হবে। এই পৃথিবীতে ও যদি কারো বউ হয়,সেটা হবে শুধুমাত্র এই সিকদার ধূসর মাহতাবের বউ। ”
সব কিছু স্তব্ধ হয়ে পরল তৎক্ষনাৎ । পিউয়ের মেরুদণ্ড সোজা হয়ে গেল নিমিষে। চমকে,থমকে যাওয়ার তোপে শিরদাঁড়া বেয়ে তরতর করে বেয়ে চলল হিম হিম প্রবাহ।
হতচকিত হয়ে, খাওয়া রেখে দাঁড়িয়ে পরল সকলে। আফতাব আৎকে ওঠার মতন চাইলেন ছেলের দিক। পরপর ভাইয়ের দিকে।
আমজাদ বাকরহিত,ভাষাহীন,নির্বিকার দাঁড়িয়ে। দুটো বিকট অক্ষিপটও অটল,স্থির।
মিনা, রুবা দৃঢ়ীভূত নজরে একে অপরকে দেখলেন।
শুধুমাত্র ,পুষ্প আর ইকবাল তটস্থ। আগত পরিস্থিতি ভেবেই মস্তিষ্কের দুপাশের শিরা দাপাচ্ছে ওদের।
আমজাদ হতবিহ্বল,
” কী বললে তুমি?”
ধূসরের লহু স্বর,
” যা বলেছি আপনি শুনেছেন। সবাই শুনেছে। ”
পিউয়ের ছোট্ট শরীর গুটিয়ে গিয়েছে। ত্রাসে ধরফর করছে বক্ষপট। ঠকঠক করে কাঁ*পছে হাত- পা। টের পাচ্ছে পিঠ বেয়ে রেখার মত নেমে যাওয়া ঘামের ধারা।
আমজাদ এগিয়ে এলেন। রুষ্ট কণ্ঠে বললেন,
” তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছ? কী বলছো বুঝতে পারছো নিজে?পিউ তোমার বউ হবে? এমন আজগুবি স্বপ্ন কবে থেকে দেখা শুরু করেছ?”
ধূসর সোজাসুজি বলে দিলো,
” যবে থেকে আপনার মেয়ে আমায় ভালোবাসে।”
আমজাদ হতচেতন হয়ে পিউয়ের দিক ফিরলেন।
ঘটনার আগামাথা না জানা প্রত্যেকেই তাই। এত গুলো শশব্যস্ত, বিদ্যুৎ বেগী চাউনী দেখে পিউয়ের শরীর সম্ভ্রমে অবশ হয়ে গেল।
আমজাদ হা করবেন,এর আগেই ধূসর সদর্পে প্রশ্ন ছুড়ল,
” আমাকে ভালোবাসিস পিউ?”
পিউয়ের বক্ষস্থল ধ্বক করে ওঠে। নীচু হওয়া চক্ষুদ্বয়ে কোটর ভর্তি টলমলে জল নিয়ে মুখ তুলল সে। চোখাচোখি হলো দুজনের।
গভীর,কোমল,ব্যকুল দুটো চোখ, হৃদয় ভে*ঙে আনল সহসা। ভীষণ সাহসে নড়ে উঠল ছোট্ট খাট্টো দেহ। সবার সম্মুখে,
নিম্নাষ্ঠ চে*পে,মাথা নামিয়ে ওপর নীচ ঝাঁকাল পিউ।
হ্যাঁ বাসে। বাসেইতো,নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে।
জবাব পেয়ে ধূসর চোখ বুজে নেয়। প্রসস্থ বুক ওঠানামা করে। যেন ধরে রাখা নিঃশ্বাসটুকু এতক্ষণে ছাড়ল ।
মিনা চমকে মুখ চেপে ধরলেন। অবাক লোঁচনে চাইলেন রুবায়দার দিকে। ভদ্রমহিলা ঢোক গি*লছেন। বারবার দেখছেন নিঃসহায়ের মতন বসে থাকা স্বামীকে।
আমজাদ তখনও স্তম্ভিত। হুশ ফিরল ধূসরের কণ্ঠে,
” পেয়েছেন উত্তর? ”
তিনি চোয়াল শক্ত করলেন ওমনি। হনহন করে এগিয়ে এলেন মেয়ের দিক। ছ্যাত করে উঠল পিউয়ের বক্ষস্থল। গতবার বোনের হয়ে কথা বলায় এক প্রকান্ড চড়* খেয়েছিল,এবার তো বাবা মেরেই ফেলবেন ওকে। সে পালানোর জন্যে কোনও রকম দাঁড়াতেও পারল না, আমজাদ শা বেগে এসেই কনুই চে*পে ধরলেন ওর। ধমকে বললেন,
” এই বেয়াদব মেয়ে,কোন্ সাহসে এসব উচ্চারণ করো তুমি? ভদ্রতা- সভ্যতা সব ওর সাথে মিশে খেয়ে ফেলেছো? ভালোবাসার কী বোঝো তুমি? বয়স কত তোমার?”
এমন বজ্রকণ্ঠ,আর বাবার ক্রু*দ্ধ চাউনীতে পিউ ভয়ে ফুঁপিয়ে কেঁ*দে ফেলল। চোখের দিক তাকানোর সাহস কূলালোনা। নাকটা ফুলে উঠল কান্নার দমকে। ভেজা স্বরে আস্তে করে বলল,
” আমি,মিথ্যে বলিনি আব্বু… আমি সত্যিই ওনাকে…”
আমজাদ সিকদার থরথর করলেন উস্মায়। ক্ষিপ্রবেগে হাত ওঠালেন মার*তে। অথচ
এবারেও বাধ সাধল ধূসর। তৎপর পিউকে টেনে আনলো নিজের নিকট। সবার সামনে ওকে বুকের মধ্যে আগলে ধরে চাচার চোখের দিক চাইল। যার প্রতিটি পরতে জেদ, নির্ভয়ের উজ্জ্বল এক ম্রিয়মাণ প্রভা।
বিঘ্ন ঘটায় আমজাদ ক্ষে*পে গেলেন আরও। আফতাবকে বললেন,
” আফতাব,দেখছো তোমার ছেলের স্পর্ধা?”
আফতাব কূল হারা নাবিক। কী করবেন,কী বলবেন, কাকে সামলাবেন নিজেই জানেন না।
তবে পুষ্প মুখ খুলল এবার। বিনয়ী কণ্ঠে বলল,
” আব্বু তুমি এত রে*গে যাচ্ছো কেন? ভাইয়া আর পিউ দুজনকে ভালোবাসলে এতে তো খারাপ কিছু নেই। যখন আমার আর সাদিফ ভাইয়ের বিয়ের কথা উঠেছিল তখনতো তোমরা এক পায়ে রাজি হয়ে গিয়েছিলে। তাহলে এখন? এখন কী সমস্যা?”
সাদিফ ও মাথা দোলাল। সহমত সে। তবে মুখে টা-টু শব্দ করল না।
আমজাদ র*ক্তিম চোখে চাইলেন,
” সমস্যা আছে। আলবাত আছে। সাদিফ আর ও এক হলো?”
ধূসর চোখ সরু করে বলল, ” বেশ,বলুন তবে। পিউকে আমার হাতে তুলে দিলে কী সমস্যা?”
সব বুঝেও ছেলের নাটকে, আফতাব খেই হারালেন মেজাজের। টেনে টেনে বললেন,
” সমস্যা হলো তুমি তো খুব ভালো ছেলে তাইনা? তোমার মত শান্তশিষ্ট মানুষ কয়জন আছে এই তল্লাটে? ওইজন্যেই তো ভাইজান মেয়ে দিতে এত ভাবছেন! ”
বাবার খোঁচানো কথার জবাব এলো তৎক্ষনাৎ,
” আমি যাই হই,যেমনই হই,পিউ আমাকে এভাবেই চায়। আর আমি এমন থেকেই ওকে ভালো রাখব।”
আমজাদ দুই ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
” তাই? তা কীসের ভিত্তিতে বলছো এই কথা? কোন যুক্তিই বা দিচ্ছো? তোমার আরেকটা পেশা যে রাজনীতি,সেটা ভুলে গিয়েছ? যেখানে মারা*মারি কা*টাকা*টি হয়,জীবনের কোনও ঠিক ঠিকানা থাকেনা, সেখানে কোন আক্কেলে আমি আমার মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দেব? ”
” জীবনের ঠিক আমাদের কারোর নেই। কোথাও নেই৷ মরলে অফিসের এসি কেবিনে বসেও মর*তে পারি। এই যুক্তি আপনাকে পুষ্প আর ইকবালের সময় আমি দিয়েছি। তাই নতুন করে কিচ্ছু বলতে চাইনা। আপনি আমার একটা কথা শুনে রাখুন বড় আব্বু…
থামল সে। পিউয়ের দিক তাকাল। ওর কাঁধে রাখা হাতটা আরেকটু সুদৃঢ় করে মিশিয়ে ধরল বক্ষে। প্রচন্ড অধিকারবোধ মিশিয়ে দাপুটে কণ্ঠে বলল,
” পিউ আমার। আমারই থাকবে। আপনার কেন,আল্লাহ না চাইলে কারোর সাধ্য নেই ধূসরের থেকে তার ভালোবাসাকে কে*ড়ে নেওয়ার।”
ইকবাল হাত তালি দিতে গিয়েও থেমে গেল। মাথা নাঁচিয়ে বিড়বিড় করল, ” সাবাশ ব্যাটা!”
পিউ বিমূঢ় নয়নে ধূসরের দিকে চায়। এই প্রথম, এই প্রথম ভালোবাসা শব্দটি ওই মুখে শুনল সে। এক মুহুর্তের জন্য মস্তিষ্ক থমকে দাঁড়াল। প্রখর,প্রখর অনুভূতি কাম*ড়ে ধরল তনুমন। কালো বর্তমান রুদ্ধ করে, স্তব্ধ আকাশে ঝিলিক দিয়ে উঠল এক নির্মল, বিশুদ্ধ দ্যুতি। হৃদয়পটের আনাচে-কানাচে দোল খেল কড়কড়ে, সজীব বসন্তের দোলনাটা। সব ভুলে চোখ জুড়ানো আলো নিয়ে মানুষটার নিরেট চিবুক দেখে গেল সে।
সাদিফ বিস্ময়াভিভূত! পলকও পড়ছেনা। ধূসরের এই আমূল সাহসিকতার ভারে তার মেরুদন্ডহীন স্বত্তাটা কেমন নড়েচড়ে বসল। নত মাথাটা তুলতে চাইল গতিতে । সবটা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল,
‘ ভালোবাসলে নিজের মানুষ কে এইভাবে আকড়ে রাখতে হয় সাদিফ। জাহির করে বলার ক্ষমতা থাকতে হয়। তুই তো সেটা পারিসনি । তাহলে কোন আশায়, কীসের আশায় কাউকে ভালোবেসে নিজের করার স্বপ্ন দেখেছিলি? ‘
সাদিফ মেঝের দিক চেয়ে হাসল। ভীষণ, সামান্য সুক্ষ্ম হাসি। দুপাশে মাথা নাড়ল তারপর । না,আজ সে শতভাগ নিশ্চিত,পিউ একদম সঠিক মানুষকে বেছে নিয়েছে ওর জীবনে। ভালোবাসা টিকিয়ে রাখার এতটা আধিপত্য ওর কস্মিনকালেও কী হোতো? তবে আজ সে শিখল, হ্যাঁ ধূসরের থেকে শিখল। ভালোবাসলে বুকে সাহস রাখার নমুনা স্বচক্ষে দেখল। কৃতজ্ঞ রইল সে। খুব কৃতজ্ঞ।
আমজাদ কিছুক্ষণ বিহ্বল হয়ে দেখে গেলেন ওদের। আনিস খুশখুশ করছেন। চেয়েও পারছেন না ভাইয়ের মুখের ওপর জবাব দিতে। ধূসর, পিউকে বিয়ে করলে সব দিক থেকেই তো ভালো। তাহলে ভাইজান এমন করছেন কেন? রাজনীতি কি আর কেউ করেনা?
মিনা হাঁস-ফাঁস করছেন। অথচ একটুখানি সুযোগ মিলছেনা কিছু বলার।
স্বামী নামক এই লোকটা কে মাঝেমধ্যেই তিনি বুঝে উঠতে পারেননি। এই যে,আজকেও পারছেন না।
সেদিন সম্মেলন থেকে বাড়ি ফিরে কত প্রসংশা করলেন রাজনীতির। ধূসরের প্রসংশা তো আড়ালে প্রতি প্রহর করে। তাহলে সেই ছেলের হাতে মেয়েকে দিলে সমস্যাটা কোথায়? ওর মত এতটা আগলে কে রাখবে তার এই বাঁদড় মেয়েকে? দুটোকে পাশাপাশি কী সুন্দর লাগছেনা? মিনার চোখ মুঁদে আসে মুগ্ধতায়। পরপর হতাশ শ্বাস ফেললেন। আমজাদকে কীভাবে বোঝাবেন এখন? বোঝালেও শুনবেন না। ওনার মতে, সে একাই বুদ্ধিমান এই দেশে।
ইকবাল একটু নড়েচড়ে দাঁড়াল। মিনমিন করে বলল,
” ইয়ে আঙ্কেল, বলছিলাম যে,আমি একটা কথা বলব?”
আমজাদ চুপ। না অনুমতি দিলেন,না নিষেধ করলেন। ইকবাল নিজেই বলল,
” পিউকে ধূসরের সাথে বিয়ে দিলে লাভ ছাড়া কিন্তু লস আমি দেখছিনা। না মানে, পুষ্পকে নিয়ে যাওয়ার সময় আপনারা এত কাঁদছিলেন! আন্টি জ্ঞান হারালেন,আপনি ভে*ঙে পরলেন। পিউ-ধূসরের বিয়েতে কিন্তু এরকম কিচ্ছু হওয়ার কোনো চান্স নেই। কারণ পিউ তো এই বাসাতেই থাকবে৷ এমনকি আপনারা নাতি-নাত্নী নিয়ে একসাথে থাকতে পারবেন। বেয়াই বাড়ি মিষ্টি নিয়ে যাওয়ার ভেজাল নেই,টাকাও বেচে যাবে। বরযাত্রী থাকবেনা৷ গাদা গাদা লোকদের খাওয়াতে হবেনা। এক্সট্রা অতিথির কোনও প্যারাই নেই । সব দিক থেকেই কিন্তু বিষয়টা ভালো হচ্ছে। কী বলো মাই লা… ইয়ে পুষ্প…?”
পুষ্প মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ” হ্যাঁ তাইত।”
রুবায়দা গুটিগুটি পায়ে এসে আফতাবের পাশে দাঁড়ালেন। সবার কান এড়িয়ে ফিসফিস করে বললেন,
” তুমি চুপ করে আছো কেন? ”
তিনি স্ত্রীর দিক চাইলেন৷ ভ্রু কুঁচকে বললেন,
” তো কী করতে বলছো?”
” কী করবে মানে? ধূসরের কথা শুনছো না? ও যখন ঠিক করেছে পিউকে বিয়ে করবে,তখন করবেই। তুমি একটু ভাইজানকে বোঝাও না!”
” মাথা গেছে তোমার? আমি পারব না। ”
” তাহলে আমি বলি?”
আফতাব চোখ রাঙালেন ” না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো।”
আমজাদ মোটা কণ্ঠে শুধালেন,
” এটাই তোমার শেষ কথা?”
বিলম্বহীন জবাব, ” হ্যাঁ। ”
” যদি আমি না মানি? কী করবে? পালিয়ে বিয়ে করবে? ওউ,পুষ্পর বিয়ের সময় আমাকে হুমকি দিয়েছিলে না? কাজী অফিসে নিয়ে বিয়ে দেওয়ার? সেটাই প্রয়োগ করবে এখন, এইত?”
ধূসর একপেশে হাসল। ঠান্ডা গলায় বলল,
“না। সিকদার ধূসর মাহতাব কাপুরষ নয়। বিয়ে করলে লুকিয়ে নয় সবার সামনেই করব। ”
আমজাদ তাজ্জব বনে বললেন,
” তোমাদের সম্পর্ক নিয়ে, আমার অমত আছে জেনেও?”
ধূসর সাফ সাফ জবাব দেয়,
” হ্যাঁ। যদি পিউ আমায় না চাইতো,আমি কোনও দিন টু শব্দও করতাম না। কিন্তু যেখানে ও আমায় চায়, আর আমি ওকে, সেখানে আমিতো নড়বনা বড় আব্বু। আমার সিদ্ধান্তের নড়চড় এমনিতেই হয়না। যেখানে বন্ধু আর বোনের ব্যাপারে আমি এগ্রেসিভ,সেখানে নিজের ভালোবাসা পেতে কতদূর যেতে পারি,আপনার ধারণাও নেই।”
আমজাদ হাসলেন,বিদ্রুপের বক্র হাসি। বললেন,
” পিউয়ের ব্রেইন যে তুমি কতটা সুন্দর ভাবে ওয়াশ করেছ আমি বুঝতে পারছি। বেশ! তুমি যখন,তোমরা যখন এতটা ভেবে ফেলেছো নিজেদের নিয়ে,তাহলে আমিও আমার শেষ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেই?”
সবার হৃদস্পন্দন দুরুদুরু কম্পনে থিতিয়ে এলো। পিউয়ের শীর্ন বুক কাঁ*পছে।
দুশ্চিন্তায় মাথা চুবিয়ে ভাবছে,
” আব্বু আবার ত্যাজ্য করে দেবেন না তো আমাকে?”
আফতাব ভীরু কণ্ঠে শুধালেন, ” কী সিদ্ধান্ত ভাইজান?”
আমজাদ কঠিন কণ্ঠে বললেন,
” যেভাবে এই পরিবার এত বছর ধরে আমি স্বযত্নে জুড়ে রেখেছিলাম, আজ সময় এসেছে সেটা ভা*ঙার।”
সকলের চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে এলো। আৎকে উঠল একরকম। ধূসর স্তব্ধ হয়ে বলল,
” আমাদের জন্যে পরিবার কেন ভাঙবে?”
আমজাদ হাত উঁচিয়ে বললেন, ” তোমার সাথে কথা বলছিনা আমি।”
পরপর সোজা আফতাবের দিক চাইলেন তিনি।
বললেন,
” তাহলে কথাটা সবার সামনেই বলছি আফতাব?”
এরপর কণ্ঠ খানিক উঁচু করে বললেন,
” তোমাকে বেয়াই বানাতে আমার কোনও অসুবিধে নেই।”
আফতাব হেসে ফেললেন। বাচ্চাদের মতন ফিকফিকে,ঝরঝরে হাসিটা দাঁতের ফাঁক গলে উঁকি দিলো। তাল মেলালেন আমজাদ। সময়ে সময়ে হুহা করে হাসিতে মেতে উঠলেন দুই ভাই। অথচ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল বাকীরা। ধূসরের কপালে ভাঁজ পড়ল । ঘটনা মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে সবার। একেকজন শুধু বিভ্রান্ত নজরে অপরজনকে দেখছে।
হাসতে হাসতে আমজাদ,আফতাব দুজনের দিক এগিয়ে গেলেন। কোলাকুলিটাও চট করে সেড়ে ফেললেন । আফতাব হৃষ্ট চিত্তে বললেন,
” কী ভাইজান? বলেছিলাম না?”
” বললেই মানব কেন? প্রমাণ নেবনা?”
সকলে তখনও বোকার মত মুখ দেখাদেখি করছে। দুজনের হঠাৎ, বিশেষ করে আমজাদ সিকদারের আকষ্মিক এই আমূল পরিবর্তন সবটা গুলিয়ে দিচ্ছে তাদের।
মিনা বেগম কিচ্ছু বুঝতে না পেরে টুপটাপ পাতা ফেলছেন চোখের। সুমনা জিজ্ঞেস করেই বসলেন,
” ভাইজান! মানে কী এসবের, ইয়ে আমাদের একটু বোঝাবেন?”
শেষ গুটি চেক-মেট দিতেই আমজাদ ‘চ’ সূচক শব্দ করে বললেন,
‘ এই যা! জিতে গেলে? ‘
আফতাব ঠোঁট উলটে বললেন, ‘ আপনি ইচ্ছে করে হেরেছেন ভাইজান। ‘
আমজাদ হেসে উঠলেন। সমাপ্তি খেলার কোর্ট গোছাতে গোছাতে বললেন,
‘ এমন কেন মনে হলো তোমার?’
‘ আমি জানিনা। কিন্তু এই দান আপনার জেতার কথা। ‘
‘ হুম্মম্মম! চিন্তার বিষয়। এই যে আমি হারলাম,আর তুমি জিতলে এর একটা কারণ আছে জানো?’
আফতাবের এত ভণিতা একটুও ভালো লাগছেনা এখন। মাথার মধ্যে চিন্তা,উত্তেজনা দপদপ করলে ভালো লাগে কারো?
সে নরম,তবে অধৈর্য কণ্ঠে বলল,
‘ ভাইজান,ভাইজান আমি একটা জরুরি কথা বলতে এলাম, আর আপনি সেই তখন থেকে….’
আমজাদ এবারেও হাসলেন। মাথা দুলিয়ে বললেন,
‘ জানি তো কী বলবে…’
আফতাব দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলেন। তার ভাইজানের ধারণাও নেই সে কী বলতে চাইছে! থাকলে এমন হাসতে পারত না নিশ্চয়ই! আন্দাজে কী ঢিল মা*রছে,কোথায় মা*রছে কে জানে!
আমজাদ হঠাৎ হাসি থামালেন। গুরুতর মুখভঙ্গি তে চাইলেন ভাইয়ের দিক। তার নিরাশ,মলিন চেহারা দেখে ভ্রু গুটিয়ে শুধালেন,
‘ বেয়াই হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে এসেছ,তাইত?’
বৈদ্যুতিক শক লাগলে যেমন ঝটকা খায় মানুষ, ঠিক তেমন ঝাঁকুনি দিয়ে তাকালেন আফতাব। তার গোল গোল চোখ আরো গোলাকার হয়ে আসে। ঠোঁট দুটো ভাগ হয়ে চলে যায়, সমুদ্রের এপাড়-ওপাড়। শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন,
” আপনি কী করে জানলেন?”
” সেসব পরের কথা, কিন্তু আমি যদি বলি…”
আফতাব পুরোটা শোনার ধৈর্য পেলেন না। ভী*তু বুক আরও শ*ঙ্কিত হলো ভাইয়ের কিন্তু শুনেই। ধরফর করে ওনার হাঁটু আকড়ে বললেন,
” ভাইজান, ভাইজান দোহাই আপনার, অমত করবেন না। আমার ছেলের মেজাজ বেশি, মাথাটাও গরম, কিন্তু ওর মনটা ভালো। যাকে ভালোবাসে ভেতর থেকে বাসে। পিউকে ও খারাপ রাখবেনা। আপনি, আপনি না বললে আমি ম*রে যাব ভাইজান। আমার ছেলের খুশি শেষ হয়ে যাবে….’
আফতাবের চোখ চিকচিক করছে। এক্ষুণি অশ্রু নামল বলে। অথচ আমজাদ বিদ্বিষ্ট হয়ে বললেন,
” আহ! বাচ্চাদের মতো করছো কেন আফতাব? আমি কখন বললাম আমার মত নেই?”
আফতাব আশাহ*ত ভঙিতে মাথা নোয়াতে গিয়েও রকেট বেগে চাইলেন। কণ্ঠে অবিশ্বাস এনে বললেন, ” আপনার মত আছে?”
” আছে। ”
আফতাব কিছুসময় চেয়েই রইলেন ভাইয়ের দিক। এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না।
হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
” আমায় একটা চিমটি কা*টবেন ভাইজান?”
” কেন?”
” স্বপ্ন দেখছি, না সত্যি,নিশ্চিত হতাম।”
আমজাদ হাসলেন। ভাইয়ের মাথায় চাটি বসিয়ে বললেন,
” তুমি আর বড় হলে না!”
আফতাব বুক ভরে শ্বাস ফেললেন। পরপর মুখ কালো করে বললেন,
” আমি আরো কত চিন্তায় ছিলাম এতদিন! ভেবেছি আপনি মানবেন না ওদের সম্পর্ক। খুব ভ*য় লাগছিল আমার। আজ কত দোটানা ঝেড়ে ঝুড়ে সাহস করে এসেছি,আপনি জানেন না।!”
” আসতে তো হোতোই। তুমি ছেলেপক্ষ। প্রস্তাব তো আগে তুমিই দেবে। সত্যি বলতে,আমি আগে হলে দশবার ভাবতাম, কিন্তু ইদানীং এক অন্য রকম পৃথিবী আমার সামনে এসেছে জানো? সেদিন সম্মেলনে গিয়ে বুঝেছি,রাজনীতি দিয়েও মানুষের ভালো করা যায়। উপকার করা যায়। সব কাজেই দরকার নিষ্ঠা,সততা। যা আমাদের ধূসরের আছে আফতাব।”
আফতাব মাথা দোলালেন। তার চঞ্চু ভরা হাসির স্রোত৷ আমজাদ বললেন,
” এত সহজে মেয়ে দিচ্ছি বলে ভেবোনা এমনি এমনি দেব। তোমার ছেলেকে নাকানি-চুাবানী খাওয়ানোর একটা সুযোগ পেয়েছি। আগে খাওয়াব,তারপর। ”
আফতাব সতর্ক চোখে চাইলেন ” কী করবেন ভাইজান?”
আমজাদ রহস্য হাসলেন। হাসিতেই ঝরে পড়ল উত্তর।
সবাই হা করে তাদের দিক তাকিয়ে। ঘটনা শুনে মাথা ঘুরছে ওদের। দুই ভাইয়ের এই আঙুলে তুলে সবাইকে নাঁচানোর দক্ষতায় প্রত্যেকে বিমূর্ত। ধূসর রীতিমতো বিস্ময়ে হাবু*ডুবু খেয়ে বলল,
” এর মানে আপনি জানতেন আমাদের কথা? ”
আমজাদ ফিরলেন ওর দিকে।
” অবশ্যই। আমার নাকের ডগা দিয়ে আমার মেয়েকে বিয়ে করার কথা ভাবছো,আমি জানব না?”
পুষ্প শুধাল, ” তার মানে পাত্রপক্ষ টক্ষ সব বানানো?”
” হ্যাঁ। ”
ধূসরের চোখ তখনও ছোট ছোট হয়ে আছে। আমজাদ এগিয়ে এলেন। পিউ ততক্ষণে সরে দাঁড়িয়েছে ওর থেকে। তিনি কাঁধে হাত রাখলেন ধূসরের। স্মিত হেসে বললেন,
” দেখতে চাইছিলাম,আমার মেয়ের জন্যে কতটা কী লড়তে পারো! আমি সব সময় চেয়েছি,আমার মেয়েদের জীবনে এমন কেউ আসুক,যে পৃথিবীর বিপরীতে গিয়ে হলেও ওর হাত ছাড়বেনা। যার কাছে আমার মেয়ে আমার পর,সব চাইতে নিরাপদ অনুভব করবে। আর খোদার অশেষ রহমতে, আমি তা পেয়েছি। আজ বলতে কোনও দ্বিধা নেই,আমার দুই মেয়েই জহরত বেছে নিয়েছে। হয়ত আমি নিজেও এত নিখাদ হীরে ওদের জন্যে আনতে পারতাম না। ”
ইকবাল চোখ কপালে তুলে ভাবল,
” হিটলার শ্বশুর আমার প্রসংশা করল? মাই গড!”
আমজাদ বললেন,
” তুমি রাজনীতি করো আমি শুরু থেকে চাইনি। বকেছি,মে*রেওছি। চারপাশের অবস্থা দেখেই তোমার ভালোর জন্যে চাইনি সেসব। কিন্তু একটা জিনিস বুঝলাম এখন,সৎ থাকলে যে কোনও পেশা সুন্দর ধূসর। যেটা তুমি আমাকে বুঝিয়েছ। তাই অনুরোধ করব, সারাজীবন এরকম থেকো। কোনও কুৎসিত,নোংরা কাদাপানি ছিটতে দিওনা নিজের শরীরে। ”
মিনা বেগম নাক ফুলিয়ে বললেন,
” আপনি , আপনি তার মানে এতক্ষণ নাটক করছিলেন আমাদের সাথে? মজা দেখছিলেন আমরা কে কী করি সে নিয়ে?”
আমজাদ নির্দ্বিধায় স্বীকারোক্তি দিলেন,
” তোমরা যে এমন করবে আমার জানা ছিল। আমি শুধু দেখতে চাইছিলাম ধূসর কী করে! আফতাব বলছিল,ছেলে মানবেনা,শুনবেনা। আমি তাও একটু যাচাই করলাম আর কী!
তারপর মন খা*রাপ করে বললেন,
” কিন্তু আজও তোমাকে নাকানি-চুাবানী খাওয়ানোর ইচ্ছেটা আমার পূরণ হলো না ধূসর। তা তোমার বাপ যেই ভীতু,তুমি এত সাহস কোথায় পেলে বলো তো!”
আফতাব মুখ গোমড়া করে বললেন ” ভাইজান!”
ধূসর হেসে ফেলল এবার। শুভ্র দাঁত কপাটি মেলে এক স্বচ্ছ, পবিত্র হাসি ঠোঁট গহ্বরের মাঝ থেকে উঠে এলো আজ। প্রবল বেগে আমজাদকে জড়িয়ে ধরল দুহাতে। ভদ্রলোক খানিক চমকালেন। মুচকি হাসলেন পরপর। ধূসরের এতক্ষণের শক্তপোক্ত, ভারী স্বর বিনম্র হলো। বলল,
” আমি আপনার সাথে অনেক বেয়াদবি করেছি বড় আব্বু! তার জন্য ক্ষমা করবেন৷ কিন্তু সেসব…”
আমজাদ পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন,
” ব্যাস! ব্যাস! বলতে হবেনা। সেসব কারো না কারো ভালোর জন্যে,আমি জানি, বুঝি। ভরসা করি তোমায়।”
পিউ চোখ মুছল ব্যস্ত হাতে। এতক্ষণ এসব মজা ছিল শুনতেই সব চিন্তা শেষ। ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা মেয়ের এখন কপোল পূর্ন হাসিতে। পুষ্প হেসে, চঞ্চল পায়ে এসে আগলে দাঁড়াল ওকে।
ধূসর সরে এলো। হঠাৎ-ই এক অনুচিন্তন ঝাঁপিয়ে উঠল, শাণিত মস্তকের আশ-পাশে। তক্ষুণি হাসিটা মুছে গেল। আগের মত গুছিয়ে এলো ললাট। পেছনে পুষ্পর হস্তযূগলের মধ্যিখানে দাঁড়ানো, উজ্জ্বল মুখস্রীর পিউকে দেখল একবার। তারপর বাবাকে।
ফের আমজাদের দিক চেয়ে, ঝট করে বলল,
” আমি এক সপ্তাহের মধ্যে পিউকে বিয়ে করতে চাই।”
আরেকবার এক ক্ষুদ্র বাঁজ পরার শব্দ হয়। বসার ঘরে, সদ্য ফোটা আলোর লহরীটুকু কমে যায়। বিস্ময়ের তোপে তাজ্জব বনে তাকাল সবাই। তালিকা থেকে পুষ্প আর ইকবালটাও বাদ পড়েনি।
এমনকি পিউ নিজেই হাসি থামিয়ে স্তম্ভিতের মতন চেয়ে রইল।
আমজাদ বুঝতে না পেরে বললেন,
” এত তাড়াতাড়ি? কেন? আমিতো মেনে নিলাম। তাহলে… ”
ধূসর মুখের ওপর বলল,
” তাহলেও আমি আপনাদের বিশ্বাস করিনা। ”
আমজাদ তব্দা খেলেন। আফতাব বললেন,
” বিশ্বাস করো না মানে?”
ধূসর ছটফটে কণ্ঠে বলল,
” মানে,আপনারা দুই ভাই, আপনাদের ওপর আমার ভরসা নেই। যে কোনও সময় এইভাবে মত পালটে ফেলতে পারেন। দেখা গেল, হঠাৎ বলে বসলেন,পিউকে আমায় দেবেন না। বা কোনও কিছুর জেরে বদলে নিলেন সিদ্ধান্ত,তখন? আমি রিস্ক নেব না। তাই এই সপ্তাহের মধ্যেই পিউকে বিয়ে করতে চাই। ”
আমজাদ, আফতাব মারবেল চোখে একে অন্যকে দেখলেন। তাদের মুখের ওপর বলছে তাদের ভরসা করেনা?
মিনা মোক্ষম সুযোগ লুফে নিলেন। সুর মিলিয়ে বললেন,
” হ্যাঁ ঠিক বলেছিস। যেভাবে আমাদের সবাইকে এতক্ষণ চিন্তায় মা*রছিল! এই দুই ভাইকে আর এক ফোঁটাও বিশ্বাস করা যায়না।”
আফতাব বললেন, ” ভাবি,আমরা তো মজা করছিলাম।”
” ক্ষমা দাও ভাই। এই মজা আর বেশিক্ষণ চললে কারোর না কারোর হার্ট অ্যা*টাক হোতো। আমার হোতো সবার আগে।”
আমজাদ বললেন,
” তাই বলে এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে? এইত সবে পুষ্পর বিয়ে হলো। আর পিউতো ছোট, তোমরাই না বলছিলে এতক্ষণ? ”
” পিউ ছোট -বড় যাই হোক,বউতো আমার হবে। আগে হলে সমস্যা কোথায়?”
লজ্জায় চিবুক গলায় গিয়ে ঠেকেছে পিউয়ের। এই যে বারবার সবার সামনে, জোর গলায় বউ বউ করছে কুণ্ঠায় কান দিয়ে ধোঁয়া ছুটছে তার। অথচ সে মানুষের লজ্জা আছে? কী নির্লজ্জ!
আফতাব বললেন,
” কিন্তু… এত দ্রুত এত আয়োজন কীভাবে সম্ভব! আর তিন দিন আগে একটা বিয়ে শেষ হলো,এখন আবার বিয়ে? লোকে কী বলবে?”
” এখানে লোকের কথা আসছে কেন? আমাদের ব্যাপার, আমরা বুঝে নেব। আর এত আয়োজন করতে কে বলেছে? শুধু কাবিন হলেই তো হচ্ছে।”
জবা বললেন,
” ভাইজান, না মানে বলছিলাম মেয়ে উঠিয়ে দেওয়ার তো কোনও ব্যাপার নেই এখানে। সব যখন ঠিকঠাক, বিষয় টা কিন্তু মন্দ হয়না।”
সুমনা বললেন, ” আমারও তাই মনে হয়।”
আমজাদ অবাক হয়ে বললেন, ” মানে? তোমরা সবাই রাজী?”
ধূসর সোজা পিউয়ের দিক চাইল। এতেই ধড়াস করে উঠল ওর ক্ষুদ্র বুক। এই লোক এমন ভাবে তাকায়! প্রাণ গলার কাছে এসে ঝুলে থাকে।
সে শুধাল,
” তোর কোনও আপত্তি আছে?”
ইকবাল বিড়বিড় করে বলল,
” বিয়ের জন্যে মত নিচ্ছে না ধমকাচ্ছে? গলার স্বর একটু নরম করবে তা না… কিচ্ছু শিখলোনা আমার থেকে।”
পিউ আই-ঢাই করল। জ্বিভে ঠোঁট ভেজাল অস্বস্তিতে। এত গুরুজনের সামনে সে ছোট মানুষ কী বলবে? হ্যাঁ আমি রাজী, বিয়ে করব? ছি! লজ্জা শরমের একটা বিষয় আছে না, না কী! সে কি ধূসর ভাইয়ের মত অত বেহায়া !
কিন্তু বিয়ের জন্যে যে এখনই মনের ভেতর সাজান সাজান গান বাজছে! গলা ফাটিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে,
” আমি বিয়ে করব। পারলে এক্ষুণি ধূসর ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে পড়িয়ে দাও।”
কিন্তু মন চাইলেই কি সব সম্ভব? পিউ নিরুপায় হয়ে,পায়ের পাতার ওপর চোখ নামিয়ে নিলো।
ইকবাল লাফিয়ে উঠে বলল, ” এইত পিউ হ্যাঁ বলেছে। নিরবতা সম্মতির লক্ষণ না? পিউপিউ চুপ, মানে ও রাজি।”
আমজাদ এবার সত্যি সত্যি রে*গে গেলেন। লম্বা পায়ে গিয়েই ধপ করে বসে পরলেন সোফায়। গজগজ করে বললেন,
” যা তা একটা সিদ্ধান্ত নেবে,আর সবাই মিলে লাফাবে এর পেছনে। এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে হয় কারো?”
পুষ্প বলল, ” এইবার হবে আব্বু। আমার ভাইয়া ইউনিক না? তার বিয়েতে সব ইউনিক হবে। তুমি এত ভেবোনা। শুধু খুব কাছের লোকদের দাওয়াত দিয়ে এসো। বাকি সব আমরা সামলে নেব।”
জবা বললেন ” তুই কী করে সামলাবি? তুই না অসুস্থ?”
” বোনের বিয়ের খুশিতে এখন সুস্থ। আনন্দ ডাবল না?”
জবার তৎক্ষনাৎ মনে পড়ল ধূসরের সেই কথা। ”ছেলে-মেয়ের বিয়ে, এভ্রিথিং স্যুড বি ডাবল।’
মাথা নেড়ে ভাবলেন,
” এইজনেই ছেলেটা ওসব বলেছিল? ওরে প্যাঁচানো কথা রে বাবা! ক্লু তো ঠিকই দিয়েছিল,আমরাই না বুঝিনি। ”
আফতাব বলার মত কিছু পেলেন না। বিফল ভঙিতে এসে ভাইয়ের পাশে বসে গেলেন তিনিও।
মিনা প্রফুল্ল স্বরে বললেন,
” তাহলে একটা ভালো দিন ঠিক করি এ সপ্তাহে? ও মেজো, তুইত কিছু বললি না,আমার মেয়েকে ছেলের বউ বানাতে আপত্তি -টাপত্তি নেইতো?”
ভদ্রমহিলা বিস্ময়কর চাউনীতে তাকালেন। অভিমানী কণ্ঠে বললেন,
” এ কী কথা আপা? এটা তুমি আমায় জিজ্ঞেস করতে পারলে? এই চিনলে এতদিনে?”
রুবায়দা ঠোঁট উল্টাতেই মিনা এগিয়ে এলেন কাছে। গলা জড়িয়ে বললেন,
” আরে আরে হয়েছে! মজা করলাম একটু। তা কী কী যৌতুক নিবি লিস্ট বানাবি না? ”
আফতাব হা করে বললেন,
” ভাবি,কী সব হাবিজাবি মজা করছেন বলুন তো!”
আনিস আক্ষেপ করে বললেন,
” ইশ,আমার যদি একটা মেয়ে থাকতো,তাহলে আমিও এরকম ভাইজানের ছেলেদের সাথে বিয়ে দিতে পারতাম। ধুর!”
” কেন ভাই? এখনও সময় আছে,একটা মেয়ের বাবা হও,সিরিয়ালে আমার রাদিফ থাকবে তখন। পছন্দ হলে সমন্ধ এগোতে পারবে।”
আনিস হেসে উঠলেন জবার কথায়। সুমনা সতর্ক কণ্ঠে বললেন,
” আপা সামনে তো শুক্রবার। ওই দিনটা ভালো হবেনা?”
ইকবাল ছুটে গিয়ে ধূসরকে জড়িয়ে ধরল। বাহু ঝাঁকিয়ে বলল, ” বন্ধু কংগ্রাচুলেশনস! সমন্ধি থেকে এবার ভায়েরা ভাই হচ্ছি।”
ধূসর হাসল।
রুবায়দা মৃদূ আর্তনাদ করে বললেন,
” এ বাবা! শুক্রবার তো বেশি দেরীও নেই। বিয়ের জন্যে কেনাকাটা করতে হবে।”
” হ্যাঁ হ্যাঁ, রান্না শেষ করে আজই যাই চল।”
আমজাদ, আফতাব দুজন দুজনকে দেখে নীচের দিক চেয়ে মাথা নাড়লেন। এই নারী সমাজে তারা পরাজিত সৈনিক।
সাদিফ চঞ্চল কদমে ঘরের দিক ছুটল। খুশির খবর শুনেই বিশেষ একজনকে মনে পড়ছে তার ।
রাদিফ,রিক্ত বল হাতে নেমে এসেছে ওপর থেকে। বিয়ের কথাবার্তা শুনেই ছেলেটা তীব্র কৌতুহল নিয়ে শুধাল,
” কার বিয়ে হবে?”
জবা উত্তর দিলেন, ” তোর প্রিয় পিউপুর।”
রিক্ত খরগোশের মত লাফিয়ে, হাত তালি দিয়ে বলল,
” কী মজা পিপুর বিয়ে,বিয়ে! ”
পিউয়ের ওষ্ঠযূগলে হাসির বাণ৷ তবে ওই হাসি চাঁদের লুকোনো জ্যোস্নার ন্যায়। সে চোরা,লাজুক নেত্রে একবার ধূসরের দিক তাকাল। অন্তঃপটে বিয়ের ঘন্টা টুং টুং করছে তার। আর হাতে গোনা কদিন,তারপরেই ধূসর ভাই স্বামী হবে ওর। অথচ তাকাতেই কুণ্ঠিত চাউনী পালটে গেল । ধূসর এদিকেই চেয়েছিল। সে চাইতেই, ঠোঁট কা*মড়ে, চোখ রাঙাল। নিরবে বোঝাল,
” খবর আছে তোর! ”
চলবে।
#এক_সমুদ্র_প্রেম!
কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(৬০)
এক ঝাঁক উত্তপ্ত রোদ জানলা গলে ঠিকড়ে পরছে ফ্লোরে। মারবেল মেঝের জৌলুশ দ্বিগুন বেড়েছে এতে। সাদিফ ছটফটে পায়ে ঘরে ঢুকল। কপালে সূক্ষ্ম ঘামের নহর। তেমন ছটফটিয়েই ফোন তুলল হাতে। সেকেন্ডে ডায়াল হলো ‘ম্যালেরিয়া’ নামে সেভ করা নম্বরটি।
বুকের ভেতর উত্তেজনায় কেমন করছে ওর। ওষ্ঠপুটের চতুর্দিকে ঝলকে উঠছে প্রোজ্জ্বল হাসি। খবরটা শুনলে মারিয়া খুশি হবে! কিন্তু কতটা হবে সেটুকু জানেনা। হয়ত বসা থেকে লাফিয়ে উঠবে আনন্দে!
সাদিফ একা একা হাসল। ওই মুহুর্তে মারিয়ার উচ্ছ্বল, দীপ্ত মুখখানি ভেবে সেই হাসি দ্বিগুন হলো।
কানে গোঁজা ফোন তখন রিং হচ্ছে সমানে।
কিন্তু অনেকক্ষন হলেও ধরল না মারিয়া। সাদিফ আবার ডায়াল করল। গুনে গুনে তিনবার কল দিলো সে৷ না,ধরছে না তো! কখনও তো এমন হয়নি। আজ অবধি মারিয়াকে তার একবারের বেশি কল দিতে হয়েছে কী না সন্দেহ! মেয়েটাতো খুব দ্রুত রিসিভ করে সব সময়। আজ কী হল?
এবার হাসি কমে চিন্তা বিঁধল মনে। নেতিবাচক ভাবনা নাড়া দিল মস্তকে।
ফোন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার মাঝেই হঠাৎ স্ক্রিন জ্বলে উঠল। মারিয়া কল ব্যাক করেছে। এতক্ষণ অনুচিন্তনে ছেঁয়ে যাওয়া মুখমণ্ডল ঝিলিক দিয়ে উঠল মুহুর্তেই। ধরফর করে রিসিভ করল সাদিফ। তেমন ব্যস্ত ভাবে বলল,
‘ কী ব্যাপার, ফোন ধরছিলেন না কেন?’
ভেসে এলো ঘুমুঘুমু স্বর,
‘ উম,ঘুমোচ্ছিলাম।’
সাদিফের কপালের রেখা মুছে গেল ওমনি। একবার পূর্ন দৃষ্টিতে স্ক্রিনে দেখে নিলো। প্রশ্ন জাগল মনে, সব মেয়েদের তন্দ্রাচ্ছন্ন আওয়াজ কি এত সুন্দর হয়? না কী মারিয়ারটাই সুন্দর? পিউয়ের নিদ্রিত কণ্ঠটাও এমন ভালো লাগতো ওর৷ তাহলে কী ধরে নেবে,মেয়েদের কণ্ঠ মানেই শ্রুতিমধুর?
পরমুহূর্তে আপত্তি জানাল সে। ভাবল, ‘ কই,কখনও পুষ্পর গলার স্বর এত ভালো লাগেনি। তাহলে?’
তার ধ্যান ভা*ঙে মারিয়ার জিজ্ঞাসায়। হালকা সেই স্বর,’ হঠাৎ সকাল সকাল স্মরণ? ‘
সাদিফ হাসল। বলল, ‘ বলছি। আগে শুনি,এত বেলা করে ঘুমোনোর কারণ কী? ছুটি উশুল করছেন?’
‘ না না, আসলে আমার এক্সাম রুটিন দিয়েছে। কাল রাত জেগে পড়েছি… ওইজন্যে আজ আর চোখ খুলতে পারছিনা।’
‘ ওহ। কবে শুরু? ‘
‘ এক তারিখ থেকে। আমি কাজের চাপে কিছুই পড়তে পারিনি। হাতে সময় এত কম,কী যে করব!’
‘ এত প্রেশার নেবেন না। যা হয়, হবে। বেশি চিন্তা করলে কিন্তু চোখের নীচে কালি পরে যাবে।’
মারিয়া শুয়ে থেকেই ভ্রু গোঁটাল।
‘ আমাকে নিয়ে দেখছি আপনার অনেক চিন্তা!’
সাদিফ বিন্দুমাত্র অপ্রস্তুত হলো না। উলটে সোজাসুজি জবাব দিল,
‘ কাছের মানুষকে নিয়ে চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক না?’
মারিয়া থমকায়। জানে,সাদিফ কথাটা এমনি বলেছে। যেমনটা সব সময় বলে বসে।
কিন্তু এইটুকু কথাই যে তার কাছে বিরাট কিছু। এই যে বক্ষে ওঠা তোলপাড়, এর ভার কে নেবে? উনি তো জানবেনও না,ফোনের এপাশে থাকা মেয়েটি প্রতিটা প্রহর বিভোর যার চেতনায়, তার সামান্য একটু ইঙ্গিত মস্তিষ্কের নিউরন কাঁ*পাতে সক্ষম।
‘ ওসব ছাড়ুন,যে জন্যে ফোন করেছিলাম সেটা শুববেন না?’
মারিয়া ধাতস্থ হয়ে মিহি কণ্ঠে বলল,
‘ হ্যাঁ, বলুন।’
সাদিফ জানাল,
‘ আগামী শুক্রবার ধূসর ভাই আর পিউয়ের বিয়ে। আজকেই ঠিকঠাক হলো সব।’
উদ্ভাসিত তার কণ্ঠস্বর। আনন্দ ছটা চুইয়ে পরল প্রতিটি বাক্যে।
অথচ চেহারার পরতে পরতে আমাবস্যা ঘনাল মারিয়ার। শত শত মাইল দূরে থেকেই, যেন পেয়ে গেল সাদিফের মন খারাপের খোঁজ। পিউয়ের বিয়ে ঠিক হওয়া,সমস্ত দুনিয়ার নিকট আনন্দ সংবাদ হলেও,এই মানুষটির কাছে তা বিরহ। প্রেমে ব্যর্থ হওয়ার বেদনা। এক তরফা ভালোবেসে বিফল হওয়ার ইঙ্গিত। মারিয়া জানে,বোঝে, সাদিফ যতই চেষ্টা করুক,যতই তাকে বোঝাক সে ভালো আছে, সব মেনে নিয়েছে,কিন্তু ভেতরের ক*ষ্টটা কী অক্ষ*ত রয়ে যায়নি? তার হৃদয়পটের কোণ ঘেঁষে, বয়ে চলা হাহা*কারের প্রবাহ কি লাঘব হতে পেরেছে? এত সহজ বুঝি সব?
সাদিফের বিষণ্ণতা অনুভব করেই বুক দুমড়ে-মুচ*ড়ে ওঠে ওর। চোখ বুজলে কার্নিশে এসে ভিড় করে জল। সে নিজে যে পথের যাত্রী,যে দুঃখ নায়ের মাঝি,সেই একই ক*ষ্ট ভালোবাসার মানুষটা কেন পাবে? স্নেহের পিউ আর শ্রদ্ধার ধূসর ভাইয়ের এক হওয়ার হৃষ্টতায় মারিয়া হাসতে পারল না। উলটে বিষিয়ে উঠল মন। না জানি সাদিফের কত খারাপ লাগছে এখন! চোখের সামনে ভালোবাসার মানুষের বিয়ে,সংসার! কী করে সহ্য করবেন উনি ?
মারিয়ার নিজের ভাগ্যের প্রতি শুকরিয়া হলো। ভাগ্যিশ সে দূরে আছে। দূরে থাকবে। পিউ যতটা কাছাকাছি থাকে ওনার, অতটা কাছ থেকে বিচ্ছেদ সওয়ার ক্ষমতা ওর নেই। যে পারে সে কী মানুষ? না কি ঈশ্বর প্রদত্ত বিশেষ গুণের অধিকারী!
মারিয়ার নিস্তব্ধতায় সাদিফ ভ্রু গোছায়। একবার সতর্ক ভাবে দেখে নেয় লাইন কে*টে গিয়েছে কী না! না,তাহলে মেয়েটা চুপ করে কেন? সে নিশ্চিত হতে বলল
‘ ম্যালেরিয়া! আপনি কী আমার কথা শুনতে পেয়েছেন?’
মারিয়া বেদনার্ত ঢোক গিল*ল। কার্নিশে সদ্য জমা হীরকচূর্ণ আঙুলে মুছে চেষ্টা করল হাসার।
‘ হ্যাঁ শুনলাম তো। ভালো খবর!’
সাদিফ মুচকি হেসে বলল, ‘ ভালো খবর হলে আপনার গলার স্বর পাল্টাল কেন? কেন আপনি খুশি হতে পারেননি?’
মারিয়া বলতে গেল, ‘ ককই,হয়েছি….’
সাদিফের হাসিটা এবার ঠোঁট ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। ঝনঝন শব্দ তুলে বারি খেল মারিয়ার শ্রুতিপথের চারপাশে। এতেই বিষাদ টুকু প্রগাঢ় হলো মেয়েটার। গোটা আকাশ দলে-মথে কা*ন্না এসে দলা পাকাল গলায়।
সেই সময়,
সাদিফ আচ্ছ্বন্নের মত ডাকল, ‘ ম্যালেরিয়া!’
মারিয়া চেপে ধরে নীচের ঠোঁট। বুকের ভেতর কিছু একটা ভে*ঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়। ছোট করে, বোজা গলায় উত্তর দেয়, ‘ হু?’
‘ আপনি ভাবছেন,পিউয়ের বিয়ে হবে শুনে আমার ক*ষ্ট হচ্ছে?’
কিছুটা চমকালো সে। সাদিফের বুঝে নেওয়ার পারদর্শীতায় অবাক হলো।
সাদিফ নিজেই বলল,
‘ বিশ্বাস করবেন কী না জানিনা,আমার একটুও ক*ষ্ট হচ্ছেনা। আমি আগেও জানতাম,আজ তো আরো ভালো করে জানি,পিউয়ের জন্যে আমি নই, ভাইয়াই পার্ফেক্ট! আর এই সত্যি জানার পরেও কেন খারাপ লাগবে বলুন?
তাছাড়া পিউ আমার বড় ভাবি হচ্ছে, তাকে মনের কিঞ্চিৎ জায়গায় রেখেও পাপ বাড়াতে চাইনা।
মারিয়া আ*হত স্বরে বলল, ‘ ওসব আপনি নিজেকে ভালো রাখতে বলছেন। আপনার ভেতরটা তো ঠিকই দগ্ধ হচ্ছে, তাইনা?’
সাদিফ অবাক হয়ে বলল,
‘ কেন? আপনি কি বোকা? ভালোবাসলে তাকে পাওয়ার যে সুখ,ভালোবাসার মানুষ কে ভালো থাকতে দেখার সুখ তার চেয়ে অনেক বেশি। আমি কেন সেই সুখটুকু মিস করব?
তারপর বুকে হাত রাখল সে। বলল,
‘ এই যে বুকে হাত রেখে বলছি,আমার একটুও খারাপ লাগছেনা। তাহলে অহেতুক কেন কষ্ট পাচ্ছেন? কাঁদ*ছেন কেন আপনি? ‘
মারিয়া হতবিহ্বল হয়। সে তো শব্দ করে কাঁদেনি। উনি কী করে বুঝলেন তবে? মিথ্যে বলতে চাইল,
‘ কই,কাঁ*দব কেন?’
বাধ সাধল সাদিফ। স্বীকারোক্তি দিলো,
‘ এতদিনে এটুকু আপনাকে চিনেছি ম্যালেরিয়া। এখন আমার কাছে মিথ্যে বললে, ধরা পরার ঝুঁকি আছে। আজকাল আপনার ভেতরটাও পড়তে পারছি যে।
মারিয়া একপেশে হাসল। উদাস মনে ভাবল,
‘ সত্যিই যদি আমার ভেতরটা পড়তে পারতেন,কবেই ভালোবেসে আপনার কাছে ধরা পরতাম সাদিফ৷ ‘
সাদিফ প্রসঙ্গ পালটে বলল,
‘ আচ্ছা সব কিছু ছাড়ুন তো এবার। বিয়ের মাত্র সাত দিন বাকী! বাড়ি থেকে যদিও বলা হবে,তাও আমি বলছি, আপনি কিন্তু আসবেন। ‘
মারিয়া চোখ মুছে বলল,
‘ সেতো আসবই। ধূসর ভাইয়ার বিয়ে আমি না এসে পারি?’
‘ গুড! আমার একটা উপহার দিতে ইচ্ছে করছে ওদের। কী দেয়া যায় বলুন তো! ‘
সাদিফের উত্থাপনের কারণ মারিয়াকে সহজ করা। হলোও তাই। সে আগ্রহভরে জানতে চাইল,
‘ বর-কনে দুজনকেই দেবেন? না কী একজন?’
‘ অভিয়েস্লি দুজন। আই মিন কাপল আইটেম কিছু। ‘
‘ তাহলে শপে গিয়ে দেখলে ভালো হবে। ‘
সাদিফ থুত্নী ঘষে ভাবুক স্বরে বলল,
‘ শপে যাব? তাহলে বরং আপনিও আমার সাথে চলুন।’
মারিয়া বিস্মিত হয়ে বলে,’ আমি?’
‘ তা নয়ত কে? আমি এসব বুঝিনা। গতবার পিউয়ের জন্য আংটি নিয়েছিলাম,ভাগ্যিশ দেইনি। ওটা দেখলে প্রেম আরো হোতো না।’
সাদিফ ঝরঝরে হাসল। মারিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ আচ্ছা যাব।’
‘ আচ্ছা যাব কী? আজই যাব। ‘
সে চোখ বড় করে বলল ‘আজই?’
‘ ইয়াপ। আপনি ফ্রেশ হয়ে বের হন,আমি আসছি।’
বলেই ফট করে লাইন কেটে দিলো। মারিয়া হু-হা করার সুযোগ টুকুও পেলোনা।
****
পিউ দরজা চাপালো কোমল হাতে। ঘন ঘন প্রঃশ্বাস বক্ষপটে বহাল তখনও। ঠোঁটের চারপাশের
মিষ্টি,ললিত হাসিটুকুন দীর্ঘ হলো হঠাৎ। কাঁ*পতে থাকা পাঁচটা আঙুল এসে ছুঁয়ে দিলো বুকের বা দিক। মানস্পটে হানা দিচ্ছে একটু আগের সকল জীবন্ত দৃশ্যগুলি।
পিউ আনমনা হয়। তিন বছর আগে,সেই প্রথম ধূসরের সাক্ষাৎ পাওয়ার দৃশ্যটুকু মনে পড়ে। একটা তামাটে চেহারা,বলিষ্ঠ শরীর,খাদহীন নেত্রযূগল আর শক্ত চিবুকের প্রেমে পড়েছিল সে। ধীরে ধীরে সেই প্রেম প্রকট হলো। বুকের ভেতর ধুকপুক করতে থাকা হৃদযন্ত্র বার্তা দিলো, এটা প্রেম নয়,এ ভালোবাসা পিউ। প্রতিটি সেকেন্ড, প্রতিটি মিনিট,প্রতিটি ঘন্টা কাটত সে মানুষের অপেক্ষায়। তখনও কি ভেবেছিল,উনিও ভালোবাসবেন এভাবে? প্রতীক্ষার প্রকোপে, তাকে পাওয়ার ব্যস্ততায় নিরাশ মন যখন শ্রান্ত হয়ে উঠছিল,ঠিক তখনই এক পশলা বর্ষা হয়ে নেমে এলেন ধূসর ভাই। সুর মেলালেন ওর প্রণয় গীতে। স্বচ্ছ স্বপ্নময়ী হয়ে ধরা দিলেন দু’হাতে।
এই ক্ষুদ্র জীবন নিয়ে উপন্যাস লিখলে ,সেই উপন্যাসের অদ্ভূত চরিত্রে জায়গা পাবেন ধূসর ভাই। পিউ আকুল হয়ে ভাবে,এতটা ভালোবেসেও কীভাবে চেপে রেখেছিলেন উনি? কীভাবে তার চোখে-চোখ না রেখে থেকেছেন? চোখের সামনে ওকে দেখেও নির্লিপ্ত রয়েছিলেন? যেন ভালোবাসা কী জানেইনা। তীব্র ভালোবাসার দহন যেভাবে তাকে পুড়ি*য়েছিল,ওনাকে পো*ড়ায়নি?
ধূসরের বলা প্রত্যেকটা কথা,প্রতিটা শব্দ মাথার ভেতর ঝমঝমিয়ে ওঠে ওর। বুকের মধ্যে ওকে আগলে নিয়ে,বাবার দিকে তাকিয়ে ঘোষণা করা সেই বানী মনে করে আড়ষ্ট হয় অনুভূতিতে।
‘ পিউ আমার। আমারই থাকবে। আপনার কেন,সৃষ্টি কর্তা না চাইলে কারোর সাধ্য নেই ধূসরের থেকে তার ভালোবাসা কেড়ে নেওয়ার।’
পিউ ভীষণ লম্বা শ্বাস নিলো। প্রশান্তির ঠান্ডা এক দমকা হাওয়ায় জুড়িয়ে গেল শরীর।
ভাবাবেশে চোখ বুজে মাথা এলালো দরজার পৃষ্ঠে।
সহসা লাল হলো গালদুটো। আজ শুক্রবার। ঠিক সাত দিন পর এই দিনেই ওদের বিয়ে। তারপর, একটা সংসার,ছোট ছোট ছেলে মেয়ে!
পিউ রাঙা হয়ে ওঠে কুণ্ঠায়। হেসে ফ্যালে ফিক করে। ভীষণ খুশিতে দুহাতে ওড়না তুলে চক্কর কা*টে পুরো কামড়ায়। যেন খোলা আকাশে উড়তে না জানা ডানা মেলা পাখি। তার দোলাচল হৃদয়ের সঙ্গে, ফ্যানের বাতাসে দুলে ওঠে ওড়না,কপালের অবহেলিত ছোট ছোট চুল।
সে থামল। চিত্তচাঞ্চিল্যে হাত পা নাঁচিয়ে গান ধরল,
‘ হামারি সাদি মে,আভি বাকী হ্যায় হাপ্তে চার।
চারশ বারাস লাগে,এ হাপ্তে ক্যায়সে হোঙ্গে পার?
নেহি কার সাখতা ম্যায়, অর ইক দিন ভি ইন্তেজার।
আজ হি প্যাহনা দে, তেরি গোরে বাহোকা হার।
ও সাজান হো…. ও বালাম হো…… ”
তার নাঁচ-গানের মধ্যেই বিকট শব্দে বেজে উঠল ফোন। পিউ থেমে,এগিয়ে যায়। স্ক্রিনে তানহা লেখা দেখে দ্রুত বিছানায় পা গুছিয়ে বসে। রিসিভ করে খুশির খবর দেয়ার জন্য হা করল,আগেই তানহা হুতাশ করে বলল,
‘ ওরে পিউ,পিউ দেখেছিস কী হয়েছে?’
পিউ হা টুকু বুজে নেয়। কপাল কুঁচকে শুধায়,
‘ কী হয়েছে?’
তানহা বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
‘ তুই এখনও দেখিসনি? ‘
‘ কী দেখব?’
‘ তাইতো বলি,তুই এত শান্ত কী করে! ধূসর ভাই কাল একটা ছবি আপলোড দিয়েছেন না টাইমলাইনে? সেখানে এক মেয়ে কী লিখেছে দ্যাখ। ‘
পিউ আর কিছু শুনল না। প্রয়োজনবোধ করল না এক কথায়। এটুকুতেই তার ঈর্ষান্বিত মন ফোসফোস করে উঠল। ত্রস্ত লাইন কে*টে ঢুকল ফেসবুকে,তারপর ধূসরের আইডিতে।
গত রাতে ইকবাল সহ একটা ছবি পোস্ট করেছিল ধূসর। পিউ আগেই দেখেছে। লাভ রিয়াক্টও ভাসছে ওর। তানহার কথা মতো দ্রুত হাতে কমেন্ট দেখা শুরু করল সে। যেহেতু ধূসর এই জেলার ছাত্রলীগের সভাপতি, তার একটা পোস্টে অহরহ লাইক,কমেন্ট স্বাভাবিক।
‘প্রিয় ভাই,প্রাণের ভাই’ লিখে ভরিয়ে ফেলেছে একেকজন। মেয়েদের কমেন্ট হাতে গোনা। পিউ ঘেটেঘুটে, অনেকক্ষন পর, থামল। এক মেয়ের কমেন্টে চোখ পৌঁছাল তার।
লিখেছে…
‘ কালো শার্ট পড়ে আপনাকে আমার কল্পনার থেকেও সুন্দর লাগে! আপনি এত ড্যাশিং কেন বলুন তো? ছেলেদের এত হ্যান্ডসাম হতে নেই।’
পিউয়ের ব্রক্ষ্মতালু অবধি দাউদাউ করে জ্ব*লে উঠল রাগে৷ এত বড় সাহস এই মেয়ের? এত সাহস! তার ধূসর ভাইকে না কি কল্পনায় দ্যাখে? কে এই মেয়ে? পিউ তৎপর আইডিতে ঢুকল। লক করা বিধায় দেখা গেল না কিছু। ক্ষোভ ঝাড়তে চট করে অহেতুক রিপোর্ট দিলো সেখানে।
ধূসর ভাই কেন মেয়েটিকে কিছু বললেন না? কেন একটা কড়া ধ*মক দিলেন না? পান থেকে চুন খসলে ওকে তো ঠিকই ধম*কায়,চোখ পাঁকায়।
তার গায়ের রক্ত ফুট*ছে। পরিষ্কার টের পাচ্ছে খাঁ খাঁ আগু*নে ঝলসে যাচ্ছে সব।
নাকটা ফুঁস*ছে তেজে। কী করলে রা*গ কমবে?
এলোমেলো পাতা ফেলে, অগোছালো মস্তিষ্কে হুট করে এক ভাবনার উদয় ঘটল। যেই ভাবনা মারাত্মক পছন্দ হলো পিউয়ের। কাজটা করলে আর কেউ ধূসর ভাইকে মেসেজ তো দূর,ধারেও ঘিষবেনা।
পিউয়ের মেজাজ তখন থমথমে । মাথায় কঠিন জেদ। মনের ভেতর অবুঝ বাচ্চামো। একান্ত মানুষটাকে পৃথিবী থেকে লুকিয়ে হৃদপিন্ডের নিষিদ্ধ কোনও অলিন্দে ঢুকিয়ে রাখার ইচ্ছে। সমস্ত রক্তকণাও তার জেদের সাথে তাল মেলাল। ভাবনাচিন্তা ছাড়াই হুট করে ধূসরকে ট্যাগ করে
‘ Got engaged ‘ পোস্ট দিয়ে ফেলল সে। ক্যাপশনে আবার ‘আলহামদুলিল্লাহ অবশেষে!’ লিখে দিয়েছে। পুরোটা করল দাঁত পি*ষে পি*ষে। বিড়বিড় করে বলল,’ এইবার সব মেয়েরা দেখবে আর জ্ব*লবে। লুচির মত ফুলবে।’
পিউয়ের মন শান্ত হয়। মেজাজটাও ক্ষান্ত। পৃথিবী জেতার মত আনন্দ হলো যেন। সব গোল্লায় যাক, মেয়েরা আর কমেন্ট করবেনা এতেই শান্তি।
*****
এক হাতে নাকে আঁচল চেপে আরেক হাতে মিনি ট্রে নিয়ে রুমে ঢুকল পুষ্প। ইকবাল তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে। সামনে থেকে ধোঁয়া ছুটছে সমানে। পুষ্প দেখেই খেকিয়ে উঠল,
‘ এই তুমি কী করছো?’
চমকে উঠল ইকবাল। জ্বিভ কে*টে, সদ্য জ্বা*লানো সিগারেটটা স্ত্রীর ভ*য়ে ফেলে দিলো নীচে। এপাশে ফিরল হাসি হাসি চেহারায়। মাথা নেড়ে বলল,
‘ কই কিছু না। ‘
পুষ্প নাক ফুলিয়ে বলল, ‘ তুমি সিগারেট খাচ্ছিলে না?’
ইকবাল আকাশ থেকে পরার ভাণ করে বলল,
‘ আমি? না তো। কী যে বলো মাই লাভ,আমি কেন সিগারেট খাব? তুমি মানা করার পর তো ছুঁইওনা।’
পুষ্প অবাক হলো। সে স্পষ্ট দেখেছে ধোঁয়া উড়তে। অথচ এই লোক কি মিথ্যেটাই না বলছে! কটমট করে বলল,
‘ তাই না কি? আচ্ছা ঠিক আছে। কাছে এসো। ‘
ইকবালের মনে চোরের ঘন্টা ঢংঢং করে লাফিয়ে ওঠে । কাছে গেলেইত সর্বনা*শ! গন্ধ পাবে নিশ্চিত।
‘ কী হলো? এসো।’
সে মাথা নেড়ে বলল, ‘ না। যাব না।’
‘ কেন? এমনি সময় তো কাছে আসার জন্যে মুখিয়ে থাকো। এখন আসবেনা কেন?’
ইকবাল আমতা-আমতা করল কিয়ৎক্ষণ। যুতসই উত্তর না পেয়ে,
কাঁধ উচিয়ে বলল,’ এখন মুড নেই।’
পুষ্প ক্ষে*পে গেল আরো। এগিয়ে এসে টেবিলের ওপর ট্রে রাখল শব্দ করে।
‘ মুড না কী, মজা বোঝাব পরে। আগে এটা খেয়ে উদ্ধার করো আমায়।’
ইকবাল বাটি দেখে স্ফূর্ত স্বরে বলল, ‘ আরে হালিম! ওয়াও।’
পুষ্প বের হতে নিলে শুধাল,’ কোথায় যাচ্ছো? তুমি খাবেনা?’
‘ দেখছো না নাক চেপে আছি? মাংসের গন্ধ নিলেও গা গোলাচ্ছে আমার।’
‘ তাহলে কী খাবে?’
পুষ্প খানিক মন খারাপ করে বলল,
‘ সেটাইত। পেটে খিদে আছে,অথচ খেতে পারছিনা। কী যে খাই!’
ইকবাল দুষ্টুমি করে বলল, ‘ আমাকে খেতে পারো মাই লাভ।’
পুষ্প নাক চোখ কুঁচকে চাইলে চোখ টিপল সে। পুষ্প মাথা নাঁচিয়ে বলল,
‘ আচ্ছা,আস্ত তোমাকে তো আর খেতে পারব না। রান্নাঘর থেকে বটি টা নিয়ে আসছি।’
ইঙ্গিত বুঝে ইকবাল চোখ কপালে এনে বলল,
‘ মাই লাভ,তুমি আমায় কে*টে ফেলবে? ফি-মেইল রাফসান হক! এত ভালোবাসার এই প্রতিদান! ‘
পুষ্প ভেঙচি কা*টল। বেরিয়ে যেতে যেতে ফিরে চেয়ে বলল ,
‘ ওহ হ্যাঁ,আর যদি সিগারেট খেতে দেখি ইকবাল,তোমার একদিন কী আমার একদিন।’
চোটপাট দেখিয়ে চলে গেল সে। ইকবাল মুখ কালো করে নিরাশ শ্বাস নিলো। এতদিনের অভ্যেস কি রাতারাতি ছাড়া যায়? মাই লাভটা বোঝেনা ওসব। তার প্রিয় সিগারেটের সঙ্গে সতীনের মত আচরণ করে।
সে ঘরে এলো বারান্দা ছেড়ে। একবার তাকাল বাটি ভর্তি ধোঁয়া ওঠা হালিমের দিকে।
যেতে নিয়ে আবার দাঁড়িয়ে গেল। নাহ,খাবেনা। মাই লাভও তো হালিম ভালোবাসে, অথচ এখন গন্ধ নিতে পারছেনা বলে খেতে পারবেনা। তাহলে সে কী করে খাবে? মা হতে গেলে যদি এত সেক্রিফাইস করতে হয়, সে বাবা হয়ে কিছু করবেনা? ইকবাল এসে ট্রে উপুড় করে ঢেকে রাখল বাটি।
**
দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো। পিউ থমথমে কণ্ঠে জবাব দিল,
‘ খোলা আছে।’
উঁকি দিলো ইকবাল। হাসি হাসি কণ্ঠে ডাকল, ‘পিউপিউ! আসব?’
পিউ ফিরে তাকায়। হেসে বলে ‘ আসুন না।’
ইকবাল ঢুকতে ঢুকতে কপাল কুঁচকে বলল,
‘ আরে তুমি চুপচাপ বসে আছো কেন? তোমার তো এখন নাঁচানাঁচি করার কথা। এ্যাট লাস্ট ধূরের বউ হতে যাচ্ছো।’
পিউ ছোট নিঃশ্বাস ফেলল। সে তো নাঁচছিল হাত পা তুলে। কিন্তু ধূসর ভাই পরোক্ষ ভাবে হলেও সেই নাঁচে রেস্ট্রিক*টেড সিল মে*রে দিলেন।
ইকবাল এসে বসল তার মুখোমুখি।
‘ তাহলে? অবশেষে ধূসর ভাইকে পাবে। ট্রীট কবে দিচ্ছো? ‘
পিউ হতাশ কণ্ঠে বলল, ‘ আর ট্রীট!’
ওদের কথার মধ্যেই ভরাট কণ্ঠের প্রশ্ন এলো,’ তুই এখানে?’
পিউ বাকী কথা গিলে ফেলল। পিঠ ফেরাল তৎক্ষনাৎ। ইকবাল জবাব না দিয়ে পালটা প্রশ্ন ছু*ড়ল,
‘ কেন? আসতে পারিনা?’
ধূসর দরজা ছেড়ে ভেতরে ঢুকতেই পিউয়ের বুকের লাব-ডাব বেড়ে যায়। চোরা মন ভাবল,
‘ওই পোস্টের জন্য আবার কিছু বলতে এসেছে না কী?’
সে ত্রস্ত তটস্থ হয়ে বসল।
অক্ষিপট ডানে- বামে ঘুরিয়ে চুপটি করে থাকল।
ধূসর বলল,
‘ পারবি না কেন? হঠাৎ দেখলাম তাই! ‘
ইকবাল বিছানায় শুয়ে পরে। মাথায় হাত ঠেস দিয়ে প্রতাপী কণ্ঠে বলে,
‘ এটা আমার শালিকার ঘর। শালি মানে আধে ঘর ওয়ালী। আমি আসব, যাব। তুই কে? তুই এসেছিস কেন? আশ্চর্য! ‘
ধূসর চোখ সরু করে বলল, ‘ তাই?’
ইকবাল নিজেই উঠে বসল আবার। কণ্ঠ শৃঙ্গে এনে বলল,
‘ ভাই তোর কী কপাল! একই বাড়িতে একটা বউ পাবি। বিয়ের পর পিউ যে রাগ করে বাপের বাড়ি যাবে সেই ভয় ও নেই।’
তারপর দুঃখের শ্বাস ফেলল সে। যেন প্রচন্ড কষ্ট পাচ্ছে পুষ্প তার কাজিন না হওয়ায়।
পিউ দাঁত দিয়ে নখ কা*টছিল। কথাটায় শশব্যস্ত হয়,উদ্বীগ্ন কণ্ঠে বলে,
‘ তাইত। আমি রাগ করে কোথায় যাব ইকবাল ভাই?’
ইকবাল নিশ্চিন্ত কণ্ঠে বলল,
‘ আমার বাড়ি যাবে পিউপিউ। এই ইকবাল আছে যতদিন, তোমার জন্য দরজা খোলা ততদিন।’
ধূসর নিরুৎসাহিত,
‘ হ্যাঁ নিয়ে যা। এখনই নিয়ে যা। তুইও গাধা,ওটাও তাই। পাল ভারি হবে।’
ইকবাল ফুঁসে ওঠার নাটক করে বলল,
‘ এত বড় অপমান? বাড়ির বড় জামাইকে অপমান? তোর কী মনে হয় পিউকে আমি নিতে পারব না?
পরপর দাঁত কেলিয়ে বলল,
‘ তা নিয়ে পার্মানেন্টলি রেখে দেই? ইফতির সাথে বিয়ে পড়িয়ে দেব কী বলিস?’
পিউ জ্বিভ কে*টে মাথা নুইয়ে নিলো। উনি যাকে দেখতে পারেনা,তারই নাম নেয়া? ধূসর চোখ গরম করে তাকাতেই শব্দ করে হেসে উঠল ইকবাল। বলল,
‘ লেগেছে? ওভাবে তাকাস কেন? আমি কি তোকে ভয় পাই শালা?’
‘ পাস না?’
ধূসর এক পা এগোতেই ইকবাল মেরুদণ্ড সোজা করে উঠে দাঁড়াল। ছিটকে পেছনে গিয়ে বলল,
‘ মোটেইনা। ভয় পাব কেন? আমিও জিম করি। এই দ্যাখ মাসেল।’
টি শার্টের হাতা উঠিয়ে পেশিবহুল বাহু দেখাল সে। ধূসর ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,
‘ আচ্ছা? তাহলে পরীক্ষা হোক,কার মাসেলে কত জোর?’
ইকবাল ঢোক গিলল। মারামারিতে সে নড়বড়ে যোদ্ধা। ধূসর সেখানে পি এইচ ডি।
হেরে যাবেনা বলে নাটক করে চিল্লিয়ে বলল,
‘ হ্যাঁ আসছি। ‘
‘ওই ডাকছে আমায়। দেখি সর।’
ধূসরকে সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে হেঁটে গেল সে। দরজা অবধি গিয়ে দাঁড়াল। ফিরে, আঙুল তুলে প্রচন্ড দাপট নিয়ে বলল,
‘ ডাকছে বলে ছেড়ে দিলাম।’
ধূসর তেড়ে আসতে নিলেই,ছুটল ইকবাল। সে থামল না, লম্বা পায়ে পেছনে চলল ওর।
পিউ হেসে ফেলল দুজনের খুনশুঁটি দেখে।পরপর মুখ গোমড়া করে বলল,
‘ আমি কেন হাসছি? আমি তো রেগে থাকব।’
******
একটা হীরের দোকানের সামনে এসে বাইক থামাল সাদিফ। রোদের অসহ তাপ বাইরে। হেলমেট পরে ঘাম চুল বেয়ে গড়িয়ে নামছে গালে ।
দোকানের সাইবোর্ডে চোখ বোলাল সে। নিশ্চিত হতে শুধাল,
‘ এখানে?’
মারিয়া নামতে নামতে জবাব দেয়, ‘ হ্যাঁ। ‘
‘ ভালো হবে এটা?’
‘ আমি আমার অনেক বন্ধুদের নিতে দেখেছি এখান থেকে। এনাদের ডিজাইন গুলো ইউনিক! আপনি আমাকে ভরসা করতে পারেন।’
সাদিফ হাসল। স্ট্যান্ডে বাইক দাঁড় করিয়ে সাবলীল গলায় বলল,
‘ যেখানে আপনাকে ভরসা করি,সেখানে আপনার পছন্দের ওপর করব না ?’
মারিয়া বহু ক*ষ্টে ঠোঁটের হাসি ধরে রাখে। সাদিফের কিছু কিছু কথা যে তার হৃদয়ের কোথায় চলে যায় সে জানেনা। জানলে এভাবে সোজাসুজি বলত কী? ভেতরে তূখোড় রূপে বইয়ে দেওয়া ঝড় লুকোনোর হাতিয়ার হিসেবে এই হাসি ছাড়া কিছু নেই ওর। সে সামলে নিলো নিজেকে,বরাবরের মত স্থির রাখল অনুভূতি। বলল,
‘ চলুন, ভেতরে যাই। ‘
পা মিলিয়ে, সমান কদমে ভেতরে ঢুকল দুজন। মারিয়া সজাগ, তীক্ষ্ণ চাউনীতে বারবার সাদিফকে দেখছে। বিভ্রান্ত হচ্ছে ততবার। বুঝতে পারছেনা,আদৌ ভেতরে কী ঠিক আছেন উনি? না কী তারই মত ভালো থাকার ব্যর্থ চেষ্টা এসব।
সাদিফ তখন শুধাল,’ কোন দিকে যাব?’
মারিয়া আশ-পাশ দেখতে দেখতে বলল,
‘ এখানে একটা কাপল রিং সেট আছে। আমি ওদের ফেসবুক পেজে দেখেছিলাম সেদিন। আই থিংক ওটাই বেস্ট হবে গিফট হিসেবে। ‘
‘ দাঁড়ান ,কাউকে জিজ্ঞেস করি।’
ভীষণ জ্বলজ্বলে পাথরের এক জোড়া আংটি সেলস উইমেন বের করে ওদের সামনে রাখল। এক দেখাতেই মুগ্ধ হলো সাদিফ।
হাতে তুলে বলল,
‘ আরে দারুণ তো!’
‘ পছন্দ হয়েছে আপনার? ‘
‘ হ্যাঁ চমৎকার! এটা ফাইনাল। ‘
‘ আর কিছু দেখবেন না? না মানে,আরেকটু বেছে নিলে ভালো হোতো না?’
সাদিফ আপত্তি জানিয়ে বলল ‘ আরে না না। এটাই ঠিকঠাক। ‘
তারপর মেয়েটিকে শুধাল,
‘কত দাম?’
শোনার পূর্বেই ফোন বাজল তার।
‘ এক সেকেন্ড ‘ বলে সাদিফ সরে এলো সেখান থেকে। মারিয়া দাঁড়িয়ে রইল একা। ডিসপ্লেতে রাখা একেকটি দামি হীরের গয়না মোহিত লোঁচনে দেখছিল। হঠাৎ কাঁচের টেবিলের ওপর থেকে চোখ আটকাল ভেতরে রাখা ব্রেসলেটে। দৃষ্টিতে আকর্ষণ আরো বৃহৎ হলো মারিয়ার। ঠোঁট থেকে মোহাচ্ছন্নতায় বেরিয়ে এলো,
‘ কী সুন্দর এটা!’
মেয়েটি তার চোখ অনুসরন করে চায়। আগ বাড়িয়ে বলে,
‘ ম্যাম এটা পছন্দ হয়েছে? এই ডিজাইনটা কিন্তু আমাদের শপে বেস্টের মধ্যে একটি। দাঁড়ান দেখাচ্ছি…’
মারিয়া হ্যাঁ/ না বলার আগেই তিনি ব্রেসলেট কাঁচ গলে বাইরে নিয়ে এলেন। টেবিলের ওপরে রাখলেন।
মারিয়া উজ্জল পাথর গুলো মন দিয়ে দেখল। হাত বোলাল ওর ওপর। নারীর মন,গয়না ভালো লাগবে স্বাভাবিক। কৌতুহলে শুধাল,’ কত দাম এটার?’
‘ ম্যাম, এটা মাত্র ৪৯,৯৯৯ টাকা।’
মাথা লাটিমের মত চক্কর কা*টল মারিয়ার। এমন ফিনফিনে ডিজাইনের একটা ব্রেসলেটের এত দাম? এটাত ওর চার মাসের স্যালারি । অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু নয়। হীরে কেনার যোগ্যতা কি আর ওর আছে?
‘ দিয়ে দেব ম্যাম? ‘
‘ হু?’
শুকনো হেসে বলল,
‘ না না। রেখে দিন,এমনি দেখলাম।’ ‘
‘ ওকে।’
সাদিফ কথা শেষ করে এসে পাশে দাঁড়াল ওর। যেচে বলল,
‘ একটা বন্ধু ফোন করেছিল। ছুটির দিন রোজ বিকেলে ওদের সাথে বের হইতো।’
মারিয়া ছোট করে বলল ‘ ওহ।’
সাদিফ মেয়েটিকে বলল,’ তাহলে আমাকে এই রিং সেট প্যাক করে দিন। কার্ড পেমেন্ট হবে তো, না?’
‘ জি স্যার। আপনি রিসেপশনে পে করুন,আমি পাঠাচ্ছি।’
সাদিফ মারিয়াকে বলল,’ আপনি গিয়ে বাইকের কাছে দাঁড়ান। আমি বিল পে করে আসছি। ‘
মারিয়া বাধ্যের ন্যায় মাথা ঝাঁকাল। শ্রান্ত পায়ে হেঁটে চলে গেল বাইরে।
সময় নিয়ে বেরিয়ে এলো সাদিফ। মারিয়া তখন বাইক ঘেঁষে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে। তাকে দেখে সোজা হলো। সাদিফ চারপাশ দেখে কপাল গোটায়।
বলে,’ আশেপাশে ভালো রেস্টুরেন্ট নেই? জানেন কিছু? ‘
‘ রেস্টুরেন্ট দিয়ে কী করবেন?’
‘ কী করব মানে? খাব।’
‘ ওহ।’
‘ আপনি সকালে খেয়ে এসেছেন?’
মারিয়া চোখ তুলে চাইল। বলার আগেই সাদিফ বলল,
‘ খেয়ে আসেননি জানি। তাই এখন খাব,তারপর বাড়ি ফিরব।’
মারিয়া খানিকক্ষণ মূঢ় আঁখিতে তাকে দেখল। চোখ ধাঁধানো, সাদাটে রঙের ছেলেটির দিক তাকালে তার সুপ্ত প্রেম জেগে উঠতে চায়। সাদিফ চারপাশ থেকে দৃষ্টি এনে তার দিক ফিরতেই,এক ভ্রু উঁচাল। পরপর মিটিমিটি হাসল। ঘটনাচক্রে থতমত খেল মারিয়া। চোখ নামাল তৎপর ।
সাদিফ শুধাল,’ কী খাবেন?
সে নীচু কণ্ঠে বলল, ‘ ইয়ে… সকাল সকাল খালি পেটে রেস্টুরেন্টের ভারি খাবার খাব? এর থেকে হোটেলে গেলে হোতো না?’
প্রশ্নের উত্তর জানতে তাকায় সে। অথচ তাকে হতভম্ব করতে, সাদিফ সন্দেহী কণ্ঠে বলল,
‘ হোটেল?’
মারিয়া ইঙ্গিত বুঝেই রুষ্ট চোখে চাইল।
‘ আপনি তো ভীষণ ফাজিল! আমি খাবার হোটেলের কথা বলেছি। ‘
সাদিফ জ্বিভে ঠোঁট চুবিয়ে হাসল। দুষ্টু দুষ্টু হাসিটা দেখে মারিয়া লজ্জায় মিশে যায়। তার লুকোনো অভিপ্রায় খেয়াল করতেই সাদিফের নীরব হাসি প্রকান্ড হলো। হুহা শব্দে বেরিয়ে এলো বাইরে।
পরপর নিজেই আশ্চর্য হয়ে শুধায়,’ কী ব্যাপার বলুন তো! আপনার সাথে থাকলেই এত হাসছি কেন আজকাল?’
****
পিউ বড় যত্নে এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত বানিয়েছে পুষ্পর জন্যে। পুদিনা পাতা আর লেবুর মিশ্রণে বানানো এই শরবতের পেছনে অগাধ শ্রম ঢেলেছে সে। পুষ্পর মাথা ঘুরছে। সারাদিন কিছু খায়না। মিনা বেগম বলেছেন এটা খেলে ভালো লাগবে। তাই ব্যস্ত হয়ে মায়ের আগেই বানিয়ে ফেলল পিউ। একটা পুচকু আসবে বাড়িতে। খালামনির কিছু দায়িত্ব আছেনা? কিন্তু বিপদ হলো, চিনি গুলছেনা। নাড়তে নাড়তে কব্জি ব্যথা হলেও পানির তলায় দেখা যাচ্ছে দানা গুলো। ব্লেন্ডারে যা দিয়েছিল ওতে হয়নি। আবার যোগ করতে হয়েছে। আর তাতেই বেধেছে বিপত্তিটা।
এমন হলে হবে কী করে? তার সব পরিশ্রমই তো মাটি।
সে চিনি নাড়তে নাড়তে সিড়ি বেয়ে উঠল। নিবেশিত মনোযোগ শরবতের জলে।
গ্লাসের ভেতর চোখ রেখে হাঁটার মধ্যেই আচমকা একটা শক্ত হাত এসে খপ করে হাত ধরল ওর। পিলে চমকে যায় পিউয়ের। স্পষ্ট ভাবে তাকানোর পূর্বেই হস্তমালিক বিদ্যুৎ বেগে ওকে টেনে নেয় কক্ষে।
আত*ঙ্কের তোপে হাত থেকে স্টিলের চামচটা পরে গেল ফ্লোরে। ঝনঝন শব্দে আরো ভারী হলো পরিবেশ। গ্লাসের শরবত এদিক ওদিকের সঙ্গে ছলকে পরল গায়েও। মানুষটা তাকে ভেতরে এনে দরজা চাপাল। পিউয়ের পিঠ ঠেকল সেই দরজার কাঠে গিয়ে। কাঁপা কাঁপা নেত্রপল্লব তুলে চাইতেই ধরা দিলো ধূসরের শ্যামলা আনন।
পিউয়ের ভয়*ডর নিভে গেল সহসা। ত্রাসের বদলে ভর করল বিস্ময়। হা করে বলল, ‘ আপনি? আমিওতো বলি,এই বাড়িতে এভাবে কে টানে আমাকে! ডাকাত তো নেই।’
ধূসরের শৈলপ্রান্ত বেঁকে আছে। যেন প্রচন্ড বিরক্ত সে। অবশ্য খুব কম সময়ই মসৃন থাকে তা। নিরেট চিবুক দেখে ঘাবড়াল পিউ। মনে পড়ল বসার ঘরে ওকে চোখ রাঙানোর কথা।
আসন্ন পরিস্থিতি ভেবে বক্ষঃস্থল দুরুদুরু হয় । ধূসর শক্ত কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়*ল,
‘ তখন চুপ করে ছিলি কেন?’
পিউ কণ্ঠ কাঁ*পিয়ে শুধায়,’ ককখন!’
‘ যখন বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করলাম, উত্তর দিসনি কেন?’
পিউ মাথা নীচু করল।
অসহায় কণ্ঠে বলল,’ কী বলতাম তাহলে? ‘
‘ তুই আমায় বিয়ে করতে চাস না?’
অবিলম্বে একইরকম ঘাড় ঝাকাল সে।
ধূসরের স্বর গম্ভীর,’ মুখে বল।’
পিউ মেঝের দিক চেয়ে থেকেই, মৃদূ কণ্ঠে জানাল,’ চা.. চাই।’
সবেগে কোমল বাহু দুটো চে*পে ধরল ধূসর। জোরে ধরেনি, অথচ পিউ ভ*য় পেলো। হকচকিয়ে তাকালে, মৃদূ ধমকে বলল,’ তাহলে বলিসনি কেন?’
পিউ ঢোক গিলল।
‘ লজ্জা, লজ্জা করছিল।’
ধূসর শ্বাস ফেলল। বাহু ছাড়তেই সে আবার লেগে গেল দরজায়।
টের পেলো, ধূসরের একটা হাত আগের মত উঠে আসছে মাথার পাশে। পিউয়ের হৃদস্পন্দন জোড়াল হয়। মনে পড়ে যায় সেই ঘনিষ্ঠ মুহুর্তের কথা।
নিভু নিভু চোখে চাইতেই সে
ভ্রু উঁচিয়ে শুধাল,
‘ পৃথিবীর সব লজ্জা তোর একার, তাইনা? ‘
পিউ নিশ্চুপ। ধূসর বলল,
‘ আমাকে না জানিয়ে এনগেজড পোস্ট দিতে লজ্জা করেনি?’
পিউ দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট ঈষৎ কা*মড়ে ধরল এবার। নীচু কণ্ঠে স্বীকারোক্তি দিলো,
‘ কী করব? আপনার ছবিতে মেয়েরা কমেন্ট করে কেন? আপনিও তো কিছু বলেন না।’
একবার চোরা চোখে তাকাল তারপর। ধূসর
চোখ -মুখ অপরিবর্তিত রেখে বলল,
‘ কী বলব শিখিয়ে দে।’
সে বিস্মিত হয়ে বলল, ‘ আমি আপনাকে কথা শিখিয়ে দেব?’
‘ তো? কমেন্ট তো চেকই করিনা। আর এরা আমার ফ্রেন্ড লিস্টেও নেই। পাব্লিক আইডি। এসব কোত্থেকে আসে কে জানে!’
পিউ ব্যগ্র কণ্ঠে শুধাল,
‘ আপনি সত্যিই চেনেন না?’
ধূসর ভ্রু গোটায়,’ সন্দেহ করছিস?’
‘ না না।’
প্রতিটা কথা সে না তাকিয়ে বলছে। তাকালেও দেখছে আশপাশ। সরাসরি মুখের দিকে চাইছেনা দেখে,
ধূসর প্রশ্ন করল,
‘ আমার চোখের দিকে চেয়ে কথা বলতে পারিস না?’
তার উষ্ণ শ্বাসের তোপে পিউয়ের দেহ এমনিতেই শিরশিরে । রুদ্ধ কণ্ঠে জবাব দিলো,
‘ না। ‘
‘ কেন?’
পিউ কুণ্ঠা ঠেলে,মিনমিন করে বলল, ‘ শরীর কাঁ*পে।’
ধূসর কিয়ৎক্ষণ চোখ ছোট করে রেখে, ঠোঁট কাম*ড়ে হাসল। পাতলা অধর নেড়েচেড়ে বলল,
‘ তোর এই কাঁপার সময়-সীমা আর মাত্র সাতদিন। ‘
পিউ বুঝতে না পেরে তাকাল এবার। চাউনীতে প্রশ্ন।
ধূসর ভণিতাহীন বলে বসল,
‘ এই শুক্রবারের রাত তোর,আগামী শুক্রবারের রাত আমার। ‘
পিউয়ের কান ঝাঁঝিয়ে ওঠে। দুপাশ থেকে সজোরে নির্গত হয় গরম ধোঁয়া। ভ্রুদ্বয় উঠে গেল উঁচুতে। ঠোঁট দুটো ভাগ হলো, বেঁফাস কথাটায়। চোখ- মুখ খিচে বলল,
‘আপনি দিন দিন বেহায়া হয়ে যাচ্ছেন ধূসর ভাই।’
তারপর দৌড়ে বেরিয়ে গেল সে। ধূসর খোলা দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়ায় । শব্দহীন হাসি আর চকচকে চোখে দেখে যায় প্রেয়সীর চঞ্চল পায়ের ছুটে যাওয়া।
চলবে।