#এক_সমুদ্র_প্রেম!
কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(৫৩)
আমজাদ সিকদারের চকচকে গাড়িটা লম্বা জ্যামের কবলে । বারবার তিনি হাত ঘড়ি দেখছেন। এই নিয়ে বিশ মিনিট হতে চলল,জট ছোটার নাম নেই। এই জ্যামের মুখাপেক্ষী হবেন না বলেই প্রতিদিন ভোরে বের হন। কিন্তু আজ,আজ আর রক্ষে পাওয়া গেল না। তিনি পাশ ফিরে একবার ভাইয়ের দিক চাইলেন। আফতাব ঘুমে ঢুলছেন। একটু পরপর মাথাটা হেলে পরছে,আবার সোজা করছেন উনি। ভদ্রলোকের এটা দৈনন্দিন রুটিন। নাস্তাও কোনও রকম নাকে মুখে ঠুসে বের হন। এত বছরেও অভ্যাসে দাঁড়াল না বলে মাঝেমধ্যে আমজাদ বিরক্ত হন বটে৷ এই, এখনও হলেন। গাড়ি যে জ্যামে আটকে,দেখো গিয়ে হুশই নেই এর। তিনি কাঁচ নামালেন। জানলা থেকে বাইরে তাকালেন। গলা উঁচিয়ে বোঝার চেষ্টা করলেন,জ্যামের লাগাম কতটা! না,এই জ্যাম ছুটতে আরো মিনিট দশেক লাগবে৷ কোন কুক্ষণে যে ফ্যাক্টরি টা এদিকে নিয়েছিলেন!
হঠাৎ একটা পরিচিত মুখ দেখে ভ্রু বেঁকে এলো ওনার। সতর্ক করলেন দৃষ্টি। চেনা মুখটি রাস্তা পাড় হচ্ছে একটু দূর থেকে। আমজাদ চিনতে পেরেই ডাক ছুড়লেন,
‘ ফয়সাল! এই যে, ফয়সাল! ‘
অকষাৎ উচু কণ্ঠে, ঘুম থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠলেন আফতাব।
‘ কে, কে, কে?’
‘ কেউনা,তুমি ঘুমাও।’
প্রথম দফার ভ*য় কা*টল ভাইয়ের শান্ত গলায়। আফতাব নিশ্চিন্তে আবার মাথা এলিয়ে দিলেন সিটে৷ নিজের নাম শুনে চটপট থামল ফয়সাল। ভুল শুনেছে ভেবে পা বাড়ালে আমজাদ ফের ডাকলেন। সাথে হাত নেড়ে চেষ্টা করলেন মনোযোগ পাওয়ার। ফয়সাল এতক্ষণে ওনাকে দেখল। কোঁচকানো কপাল মসৃন হলো সবেগে। বিনম্র পায়ে এগিয়ে এলো। সালাম দিলো হাত উঁচিয়ে৷ এত ভদ্রতায় আরো একবার মুগ্ধ হলেন আমজাদ। জবাব ফিরিয়ে শুধালেন,
‘ কেমন আছো?’
‘ জি আলহামদুলিল্লাহ আঙ্কেল,আপনি কেমন আছেন?’
‘ ভালো। এত সকালে,কোত্থেকে এলে?’
‘ বিকেলে এক্সাম আছে তো,তাই ওই সময়ের টিউশনিটা এখন পড়িয়ে এসছি।’
আমজাদ অবাক হলেন ভীষণ,
‘ টিউশনি? এখনও টিউশন করছো কেন? তোমার না চাকরি হয়েছে? ‘
ফয়সাল ওনার চেয়েও অবাক হয়ে বলল,
‘ চাকরি? নাতো আঙ্কেল! কে বলেছে আপনাকে?’
আমজাদ থেমে থেমে বললেন,
‘ হয়নি? তাহলে পিউকে পড়ানো হুট করে ছাড়লে যে?’
‘ আমি ছাড়িনি তো আঙ্কেল। আন্টিই ফোন করে আমাকে নিষেধ করেছিলেন পড়াতে যেতে।’
আমজাদ দুই চোখ ঝাপটে বললেন, ‘ কীহ?’
তারপর মনে পড়ল সেইদিনের ঘটনা। যখন পিউ মারিয়াকে দেখে হা হুতাশ লাগিয়ে কাঁ*দল, আর সে রে*গেমেগে ফিরে এলো কামড়ায়। মিনা তো ইনিয়েবিনিয়ে বলেছিলেন,’ ফয়সাল চাকরি পেয়েছে,তাই পড়াবেনা। ‘
ব্যস্ততায় উনিও আর খোঁজ নেননি৷ অথচ মিথ্যে ছিল ওটা?
আমজাদ বিরক্ত শ্বাস নিলেন। তারপর বললেন,
‘ মানা করলেন আর তুমিও গেলেনা? আমাকে একবার জিজ্ঞেস করবেনা? তোমার বাবাকে এত বড় মুখ করে বললাম আমি….’
ফয়সালের চেহারাটা এ যাত্রায় ছোট হয়ে এলো। নীচু কণ্ঠে বলল,
‘ আমি আপনাকে জানাতে চেয়েছিলাম আঙ্কেল। কিন্তু… ‘
‘ কিন্তু কী?’
সে একটু চুপ থেকে জানাল,
‘ কিন্তু ওইদিন সন্ধ্যায়ই ধূসর ভাই এসে আমায় ধমকা ধমকি করে গেলেন। তাই আর… ‘
আফতাব সচকিতে তাকালেন ধূসরের নাম শুনতেই। তার ঘুম শেষ! আমজাদ বিস্মিত কণ্ঠে বললেন,
‘ ধূসর? কী,কী বলেছে?’
‘ উনি যে ঠিক কী বলেছে আমি নিজেও বুঝতে পারিনি। তবে আপনাদের বাড়ির ধারেকাছেও যেতে মানা করেছেন আমায়। উনি হয়ত পিউ আর আমাকে নিয়ে ব্যতিক্রম কিছু ভেবেছিলেন৷ কিন্তু বিশ্বাস করুন আঙ্কেল,আমি কিন্তু পিউকে ছোট বোনই ভাবি।’
আমজাদ থম ধরে গেলেন৷ ওমন থমথমে কণ্ঠেই বললেন,
‘ ঠিক আছে, তুমি এখন যাও।’
কথার পীঠে এমন উত্তর আশা করেনি ফয়সাল। তার আঁদোলে হতাশা দেখা গেল। নালিশ টা কি গুছিয়ে করতে পারল না? এই সুযোগে টিউশনিটা আবার ফেরত পেলে ভাগ্য খুলতো। মাস শেষে আট হাজার টাকা!
অগত্যা ফলাফল শূন্য দেখে কথা বাড়াল না সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুনরায় সালাম ঠুকে বিদেয় নিলো। আমজাদ তপ্ত চোখে আফতাবের দিক চাইলেন৷ নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন তিনি। আমজাদ রেগে বললেন,
‘ তুমি যে ঘুমের ভাণ করছো,আমি কিন্তু জানি আফতাব।’
আফতাব চোখ মেললেন। ধরা পরেছেন বলে ঠোঁট উলটে সোজা হয়ে বসলেন। ভেতর ভেতর আহাজারি লাগালেন সমানে। এখন ছেলের নামে আবার দু কথা শুনতে হবে। নাহ,এই বাঁদড় ছেলে এ যাত্রায় এই বুড়ো বাপটাকে শান্তি দেবেনা।
‘ দেখেছো তোমার ছেলের কান্ড? দেখেছো? ফয়সাল টাকে তাড়িয়ে একটা বন্ধু আনিয়েছে। তা সে বন্ধু পড়াতে আসে? পনের দিন এসে আর খবর নেই। আর তোমার ভাবি,সেই বা কম কীসে? দুজন মিলে আমায় কাহিনী বানিয়ে শোনাল? দাঁড়াও, এর একটা বিহিত আমি করছি।’
আমজাদ ফোসফোস করলেন। অথচ বিড়ালছানার ন্যায় গুটিয়ে বসে রইলেন আফতাব। ওনার চুপ থাকাটা সহ্যে না কূলোলে, তিনি খ্যাক করে বললেন,
‘ কী, কথা বলছো না কেন? ‘
আফতাব মিনমিন করে বললেন,
‘ কী বলব ভাইজান? কম তো বলিনা ছেলেটাকে! এতেও কাজ হচ্ছেনা যখন,আর শুধরাবে বলে মনেও হয়না।’
সাথে একটা লম্বা আক্ষেপের নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি৷
‘ শুধরানোর দরকার নেই আর। এবার সোজা এর রাস্তাতেই আগাব৷ ও ভুলে যায় যে আমরা ওর বাপ। আগে তোমার ছেলে, মানে পালের গোঁদাটাকে দেখছি, তার পর তোমার ভাবিরও হচ্ছে।”
আফতাব গো-বেচারা ভঙিতে মাথা নাড়লেন। ভাবলেন,
‘ কী যে করবেন কে জানে! অত বড় দাঁমড়া ছেলের ত্যাড়া ঘাড়ের রগ কি আর সোজা হবে? এ ছেলে ঠিক হবেনা ভাইজান! আমি আশা ছেড়েছি,আপনিও ছেড়ে দিন।’
*******
আজ টানা তিনদিন পর সাদিফের পা পড়ল অফিসে। এমন নয় সে ছুটিতে ছিল,ইচ্ছে করে আসেনি। একমাত্র অনুষ্ঠান ব্যাতীত,ঝড় -তুফানেও যে ছেলে কামাই করেনা, সে অফিসমুখো হয়নি কদিনে। অফিসের বস,তাকে ফোন করে করে হয়রান প্রায়। একটা বার সংযোগ পাননি। পাবেন কী করে! সাদিফ সিম শুদ্ধ খুলে রেখেছিল। খেতেও নীচে নামেনি। সন্ধ্যায় আড্ডা দিতে আসেনি। হৈচৈ করেনি পিউদের সাথে। রুমে খেয়েছে,ঘুমিয়েছে,কাজ শেষে বন্ধ করেছে দোর। ওইদিনের পর জবা বেগম যতবার ঘরের সামনে যেতেন,দরজা বন্ধ। পিউও ডাকেনি। তবে ভেতর ভেতর সবাই চিন্তিত ছিল ওকে নিয়ে।
সাদিফকে দেখে কিয়ৎকাল তৃষ্ণা সমেত চেয়ে রইল মারিয়া। নিষ্পলক, নিশ্চল সেই দৃষ্টি। যেন তিনদিন নয়,তিন যুগ পর মানুষটা সামনে এসেছে ওর। এই তিনদিন কী মারাত্মক ছটফট সে করেছে কেউ জানেনা। কতবার ফোন দিয়েছে,বন্ধ। একবার চেয়েছিল ও বাড়ি যাবে,পারেনি।
প্রতিদিন সাদিফ তার পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় একবার তাকাতো,মৃদূ করে হাসতো অথচ আজ সোজা ঢুকে গেল কেবিনে৷ যেন এক যন্ত্রমানব হেঁটে গেল। ফিরেও দেখল না ওকে। মারিয়া সারাটা বেলা কাজে মন বসাতে পারল না। আঁচ করতে পারছে,মানুষটা ভালো নেই। হয়ত পিউ রাজী হয়নি। হওয়ার তো কথাও না। কিন্তু…..!
সাদিফকে নিয়ে ভাবতে বসে সব গড়মিল হচ্ছিল তার। কাজে ভুল করছিল বারবার। সব ভুলে,মাথা খারাপ হওয়ার মত অবস্থা।
লাঞ্চ টাইম পড়তেই মারিয়ার উশখুশ প্রগাঢ় হলো। চাতকের ন্যায় খানিকক্ষণ অপেক্ষা চালাল। এই বুঝি সাদিফ বের হয়! গতবারের মত এসে আবদার ছো*ড়ে একসাথে খাওয়ার৷ কিন্তু সময় কাটলেও তার দেখা নেই। শেষে অধৈর্য হয়ে পড়ল সে। নিজেই সাহস যুগিয়ে উঠে দাঁড়াল। অফিসের নিয়ম অনুযায়ী, একজন সামান্য কর্মচারী চাইলেই ম্যানেজারের কক্ষে যেতে পারেনা,যতক্ষণ না তাকে ডাকা হয়। কিন্তু মারিয়া এই নীতির ধার, ধারলনা আজ। তার মন বলছে সাদিফ ঠিক নেই। যখন পাশ থেকে যাচ্ছিল কেমন মনমরা লাগছিল দেখতে! এসব জেনেবুঝেও এভাবে পুতুল সেজে বসে থাকার মানে হয়না।
মারিয়া ত্রস্ত এগিয়ে যায়। কাঁচের দরজায় দু বার টোকা দিয়ে নরম গলায় প্রশ্ন পাঠায়’ আসব স্যার?’
‘ আসুন।’
মারিয়া বুক ভরে শ্বাস টেনে ভেতরে ঢুকল। সাদিফ কপালে এক হাত ঠেস দিয়ে আরেক হাতে কলম ধরে ছিল। একজন ঢুকেছে টের পেয়ে আলসে ভঙিতে চোখ তুলল। মারিয়াকে দেখতেই সচেতন হলো সেই দৃষ্টি। মসৃন ভুরু গুছিয়ে এলো এক জায়গায়। বলল,
‘ আপনি! ‘
কণ্ঠে অল্পস্বল্প বিস্ময়। মারিয়া এগোচ্ছেনা। স্থির দাঁড়িয়ে। তবে চাউনী অবিচল। যেন পরোখ করছে ওর ফর্সা, গোল মুখবিবর। সাড়াশব্দ না পেয়ে সাদিফ বলল,
‘ আপনাকে কিছু বলেছি। ‘
মারিয়া নড়ে ওঠে। নিজেকে সামলে নেয় দ্রুত। অগোছালো দৃষ্টি মেঝেতে ফ্যালে। সাদিফ কী বুঝল কে জানে! সামনের চেয়ার দেখিয়ে বলল,
‘ বসুন মারিয়া।’
মারিয়া চকিতে তাকায়। বুক মুচড়ে ওঠে মুহুর্তে। প্রথম বার সাদিফের মুখে নিজের ঠিকঠাক নামটা কদাচিৎ ঠেকে। হৃদয় নিঙড়ে কা*ন্না পায়। অথচ সামলে নেওয়ার প্রবল ক্ষমতা আজও বাঁচিয়ে দেয় ওকে। ঢোক গেলার সাথে, সেই কান্নাটুকুও গিলে ফেলল প্রযত্নে।
‘ কী ব্যাপার? দাঁড়িয়ে থাকবেন? আসুন।’
সাদিফের কণ্ঠ সুস্থির। তবে বেশ ভাঙা।
মারিয়া ঘাড় ঝাঁকায়। ধীরুজ কদম সামনে বাড়ায়। প্রথম বার ওর কেবিনে এলো সে। ছোট খাটো কেবিন,দেয়ালে একটা মাঝারি আকারের এসি ঝুলছে। তার পাশের দেয়ালে এক হাত বড় সাইজের ঘড়ি। একটা চৌকোনা টেবিল,সামনে দুটো ফোমের চেয়ার। ওহ,কোনায় একটা কেবিনেট,আর পানির ফিল্টার। মারিয়া আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে কাছে এল। বসল সাদিফের সামনের কেদারায়। চোখে চোখ পড়তেই নিজেকে দূর্বল মনে হলো খুব। যতটা সাহস নিয়ে এসেছিল,এখন তার কিচ্ছুটি নেই। সবটা গুলিয়ে গিয়েছে কেমন । তার মত চটাং চটাং কথা বলা মেয়েটাও,ভালোবাসার মানুষের সামনে এলে চুপ মেরে যায়?
সাদিফ ফাইল বন্ধ করে পূর্ন দৃষ্টিতে তাকায়। মারিয়াকে অপ্রতিভ লাগছে! যেন কত কিছু বলবে,আসছেনা মুখে। সে স্থির গলায় শুধাল,
‘ হঠাৎ এলেন যে!’
মারিয়া জ্বিভে ঠোঁট ভেজায়। কথা খোঁজে। সময় নিয়ে প্রশ্ন করে,
‘ ঠান্ডা লেগেছে আপনার?’
‘ না, কেন?’
‘ গলা বসে গেছে। ‘
সাদিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিছু বলল না। ওইদিন অত কাঁদার পর থেকেই গলা ভে*ঙেছে। এখনও ঠিক হয়নি। শেষ কবে এত চিল্লিয়ে কেঁ*দেছিল সে জানেনা।
মারিয়া চিন্তায় পড়েছে। সে কী কথাটা তুলবে? ওঠাবে প্রসঙ্গ? সাদিফের মুখ দেখে দ্বিধাবোধ হচ্ছে। যদি কা*টা ঘাঁ*য়ে নুন ছেটানো ভাবে!
অথচ সাদিফ নিজেই বলল,
‘ পিউকে আমি উপহারটা দিতে পারিনি! ‘
কথাটা কেমন শোনাল না? যেন হাজার খানেক ব্য*র্থতা আর মর্ময*ন্ত্রণা মিশে হেথায়৷ মারিয়ার হয়ত খুশি হওয়া উচিত। কিন্তু সাদিফের ব্যথাতুর আওয়াজ, সরাসরি বুকে গিয়ে বিঁধল। মনে হলো একটা তীর এসে শাই করে গেঁথে গেল বক্ষের বা পাশে।
সব কিছু জেনেও শুধাল,
‘ কেন? পিউ নেয়নি?’
এ যাত্রায় হাসল সাদিফ। উদাস তার স্বর,
‘ নেবে কী,ওর কাছেই তো যাইনি মারিয়া। এর আগেই কিছু দৃশ্য আমাকে সারাজীবনের মত থামিয়ে দিলো। ‘
মারিয়ার আগ্রহ জন্মাল খুব। কী সেই দৃশ্য জানার জন্য উচাটন লাগল। আগেভাগে কিছু না জানলেই ভালো হোতো হয়ত। এতটা অস্বস্তি থাকতোনা। তবু, খুশুখুশে জ্বিভ নিয়ে চুপ রইল সে। সাদিফ নিজেই বলল
‘ খুব খুশি ছিলাম আমি! উত্তেজিত ও। পিউ কী বলবে,ওর রিয়াকশন কেমন হবে এসব নিয়ে ভেবে ভেবে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু শেষমেষ এমন কিছু জেনেছি,এমন অপ্রিয় কিছু সত্যি,যার স্রোত আমার সব আনন্দ খড়কুটোর মত ভাসিয়ে, ডুবিয়ে দিলো। ‘
মারিয়া নিশ্চুপ। মাথাটাও নামিয়ে নিলো নীচে।
‘ জানতে চাইবেন না,কী সত্যি?’
‘ পিউ, ধূসর ভাইকে ভালোবাসে, তাইত?’
কথাটা মুখ ফস্কে বলে ফেলল সে। খেয়াল পড়তেই থমকে গেল নিঃশ্বাস। আ*তঙ্কিত,কম্পিত নেত্রে তাকাল। সাদিফ অত্যাশ্চর্যর ন্যায় চেয়ে তার দিক। চোখেমুখে চমক,হকচকানোর ছাপ। যা দেখে তার শ*ঙ্কা বাড়ল,ভ*য় হলো।
সাদিফ বিস্ময়াহত কণ্ঠে বলল,” আপনি জানতেন?’
মারিয়া অস্বীকার করল না। ওপর নীচে মাথা ঝাঁকাতেই সাদিফ আহ*তের ন্যায় বলল,
‘ জেনেও চুপ ছিলেন? কেন বলেননি আমায়? সেদিন যখন যাব বলেছি,আটকালেন না কেন? কেন?’
শেষ কেন টায় উচু হলো আওয়াজ। মারিয়া কেঁপে ওঠে। থেমে থেমে জানায়,
‘ আমি বললে আপনি ভুল বুঝতেন। হয়ত বিশ্বাসও করতেন না। ভালোবাসার ক্ষেত্রে এই ব্যাপার গুলো খুব অদ্ভূত হয়। চাক্ষুশ প্রমাণ ছাড়া আমরা অপর পাশের মানুষটাকে অবিশ্বাস করতে পারিনা। ‘
তারপর ওর দিক চেয়ে কাতর কণ্ঠে বলল,
‘ আমি চেয়েছিলাম বলতে, বিশ্বাস করুন! কিন্তু সেদিন আপনার মুখে পিউয়ের প্রতি দৃঢ়তা দেখে আর পারিনি। যার প্রতি আপনার এত আস্থা,সেসব আমার সামান্য কিছু কথায় নষ্ট হোক আমি চাইনি। ‘
সাদিফের সাদাটে চিবুক শক্ত। চশমার কোনা থেকে দেখা যাচ্ছে দুটো তপ্ত আঁখি। মারিয়া থামলে সেই নেত্র এক হলো। খুব জোরে এলো শ্বাস ফ্যালার আওয়াজ। তারপর তাকাল,সোজাসুজি শুধাল,
‘ কবে থেকে জানতেন? ‘
মারিয়া জ্বিভে ঠোঁট ভেজায়। আস্তে-ধীরে বলে,
‘ অনেক আগে থেকে৷ ভাইয়ার কাছে শুনেছিলাম। ধূসর ভাই পিউকে ভালোবাসেন,এটা ওনার কাছের দূরের প্রায় সবাই জানে।’
সাদিফ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর ক্লান্ত ভঙিতে মাথা এলিয়ে দিলো চেয়ারে। ঢোক গিলে বলল,
‘ সবাই জানে? কী আজব!এক বাড়িতে থেকে শুধু আমিই জানলাম না। ‘
মারিয়া বলতে নেয়,’ এখানে তো আপনার…. ‘
সে থামিয়ে দেয়। হেসে বলে,
‘আপনি ঠিকই বলতেন মারিয়া,চারটে চোখ লাগিয়েও আমি অন্ধ। নাহলে আমার এত কাছে,এত সামনে দুটো মানুষের লুকোচুরি প্রেম ধরতে পারলাম না? মাঝেমধ্যে মনে হোতো কি জানেন,পিউ ভাইয়াকে নিয়ে আগ্রহী। যেখানে আমি ডেকেও পাইনা,সেখানে ভাইয়ার সব কাজে ও যেঁচে, ছুটে হাজির হয়।
কিন্তু যেদিন চশমা ভা*ঙায় আমি পিউকে বকলাম,আর ভাইয়া আমায় শাসাল? সেদিন মনে হলো,ভাইয়া ওকে বকলেও, অধিক স্নেহ করেন৷ তাইত আমার বকা-ঝকাটা তার সহ্য হয়নি৷ আর অত আদর করলে ছোটরা তার পেছনে ঘুরবে স্বাভাবিক। আমি কত বোকা! ওইদিন ভাইয়ার শা*সানোর আড়ালে যদি স্নেহ না খুঁজে বুঝতাম,ওটা পিউয়ের প্রতি ওর ভালোবাসা, ওর টান! হয়ত আমার ভালোবাসা সেদিনই লাগাম টেনে নিতো। এতখানি গড়াত না। আফটার অল, আমি তো আর সিরিয়ালের বেহায়া ভিলেন নই,যে কেউ ভালোবাসে না জেনেও তাকে পাওয়ার লোভে উঠেপড়ে লাগব। ‘
সাদিফ প্রসস্থ হাসল। কিন্তু এর পেছনের নিঃসৃত ক*ষ্ট কড়ায়- গণ্ডায় অনুভব করল মারিয়া। সে নিজেওত একই নৌকার মাঝি। যেই নৌকার বৈঠা চলে এক তরফা প্রেমে। ছেড়া, পাতলা পাল ওড়ে মন ভা*ঙার নামে।
সাদিফের ভীষণ ফর্সা মুখের দিক চেয়ে জ্বলে উঠল তার দৃষ্টিযূগল। বুক চিড়ে নির্গত হলো কিছু নি*হত প্রশ্বাস। সাদিফ অতটা কাছে গিয়েও তার ভালোবাসার মানুষকে কিছু বলতে পারেনি,যেমন পারছেনা সে। এর থেকে পীড়া-দায়ক আর কী আছে? তাদের মধ্যে আগে যেই ঠাটবাটের ভেদ ছিল,এখন আরো একটা কারণ যোগ হলো শুধু। সাদিফের চাউনীতে পিউয়ের প্রতি অঢেল ভালোবাসা দেখেও,সে ওই মনে নিজেকে বসাতে চায়না। তার চেয়ে চলুক না, জীবন যেমন চলছে!
‘ আপনি কখনও জানবেন না সাদিফ, আপনার এই শুভ্র মুখবিবর আমার স্বস্তি নিদ্রার সন্ধি। কখনও জানবেন না, আপনার কণ্ঠ শোনার আশায় আমি কতটা ব্যকুল,ছটফটে! কখনও জানবেন না, আপনার সাথে এই গোপন বিচ্ছেদের যন্ত্রনায় আমি নিঃশেষ প্রায়।
তবুও,আমার মনের অবস্থা আপনার কাছে এমনই অপ্রকাশিত থাকুক। থাকুক এমন অজ্ঞাত। প্রার্থণা করি এসব যেন কখনও না জানেন। এইভাবেই, আপনি হবেন, আমার জীবনের আরেকটি না পাওয়া সুখ। আমার হৃদয়ের প্রথম প্রেমে পড়া,ব্যর্থ ভালোবাসা। ‘
সাদিফ বলতে গেল,
‘ জানেন মারিয়া…’
কিন্তু কথা সম্পূর্ন হলো না তার। মারিয়ার চিন্তার ভেতর থেকেই কা*ন্নার বাধ ভে*ঙে এলো। হাঁসফাঁস করে ফুঁপিয়ে কেঁ*দে উঠল সে। অনুরোধ করল,
‘ প্লিজ আমাকে মারিয়া ডাকবে না। দোহাই লাগে, শুনতে পারছিনা আমি।’
বলতে বলতে তার কা*ন্নার গতি বাড়ে। সাদিফ তাজ্জব হলো। গোল চোখে চেয়ে রইল। হঠাৎ কা*ন্নায় সে বিহ্বল বনে গিয়েছে।
মারিয়া কেঁদে-কেটে ভণিতাহীন জানাল,
‘ আপনার মুখে আমি ম্যালেরিয়া শুনতে চাই। অন্য কিছু নয় সাদিফ।’
একটা বিস্ময় না কাটতেই, আরেকটার তোপে স্তম্ভিত সাদিফ। কণ্ঠে অবিশ্বাস ঢেলে, নিশ্চিত হতে শুধাল,
‘ আপনি আমাকে নাম ধরে ডাকলেন?’
সহসা, মারিয়ার কা*ন্না থামে। সজাগ চোখে তাকায়। জ্বিভ খসে ডেকে ফেলেছে বলে সাফাই দিতে বলল,
‘ না মানে…..’
তার ভীত,ভেজা লোঁচন দেখে হেসে ফেলল সাদিফ। টেনেটুনে আনা হাসি নয়,বরং প্রাণখোলা হাসিটা ওষ্ঠপুটের রাজ্যের কানায় কানায় বিছিয়ে গেল এবার। বলল,
‘ আমি কখনও আমার জুনিয়রের মুখে নিজের নাম শুনিনি। আজই প্রথম। মন্দ লাগেনি কিন্তু। ‘
মারিয়া আই-ঢাই করে বসে রয়। দুহাতের আঙুল কচলায় সমানে। তার অপ্রস্তুত চেহারা দেখে সাদিফ বলল, ‘ রিল্যাক্স! আমি কিছু মনে করিনি।’
এর মধ্যে টেবিলে রাখা টেলিফোন শব্দ করে বাজে। সাদিফ রিসিভার তুলল, কথা শেষ করে তাকাল,জানাল,
‘ বস ডাকছেন। বিনা নোটিশে তিনদিন ছুটি কাটিয়েছি,অপেক্ষায় ছিলাম এটার। যাকগে, শুনে আসি।’
সে উঠে দাঁড়াল। সাথে সাথে দাঁড়াল মারিয়াও। মেয়েটা তখনও বিভ্রান্ত। সাদিফ এগোতে গেলে ইতস্তত করে বলল,
‘ আপনি সত্যিই কিছু মনে করেননি তো?’
সে ঘুরে চায়। মারিয়া যত্র চোখ নামাল।
সাদিফ বলল,
‘ না।’
‘ সত্যি তো?’
‘ কী করলে বিশ্বাস হবে?’
কথাটা এমনি বলেছিল,অথচ মারিয়া ব্যস্ত ভঙিতে প্রস্তাব ছু*ড়ল,
‘ ছুটির পর আমার সাথে বের হলে।’
সাদিফ কপাল কোঁচকাতেই বলল,
‘ আপনি কিছু বললে আমি কিন্তু কখনও না করিনি। আজকে কি আমি না শুনব?’
সাদিফ হাসল। যেতে যেতে বলল,
‘ ঠিক আছে। ‘
মারিয়ার ঠোঁট দুদিকে সরে গেল। হাঁপ ছেড়ে বাঁচার ন্যায় দীর্ঘ নিঃশ্বাস টানল। কোমল নেত্রে দেখল সাদিফের প্রস্থান। এই মানুষটার থেকে যত দূরে যেতে চাইছে,প্রকৃতি যেন তত টেনে আনছে কাছে।
******
পিউয়ের কিচ্ছু ভালো লাগছে না আজকাল। কোথাও মন বসছেনা। হোক সেটা ফোনে,হোক পড়ার টেবিলে,হোক বসার ঘরের আড্ডায়। সেই কক্সবাজার থেকে ফেরার পর ধূসরের সাথে ঠিক ভাবে দেখা হচ্ছে না ওর। না একটু কণ্ঠ শুনছে মানুষটার। না হচ্ছে আগের মত চোখাচোখি। সে যে ভীষণ ব্যস্ত! দৌড়-ঝাপ করছে খুব। ভোরে বেরিয়ে অফিস করছে,এরপর ছুটছে পার্লামেন্টে। সেখান থেকে আবার অফিস। ফিরতে ফিরতে রাত গড়ায়৷ পিউ কূলোতেই পারেনা তার রুটিনের সাথে। ক্লান্ত হয়ে ফেরে বিধায় রুমেও ঢোকেনা। আর এই নিয়েই তার অবস্থা করূণ!
মন আর চোখ দুটোর দখলেই যে সেদিনের রাত,সেদিনের মুহুর্ত। অথচ তারপর থেকে মানুষটাকে একটু ছুঁয়ে দেখেনি। ওনার সময় কই তার কাছে আসার! তার দিকে তাকানোর! আজ সকালেও কী তাড়াহুড়ো করে বের হলো। আজকেই যে নির্বাচন। ফিরেও দেখল না ওকে। একটু তাকালে কী হোতো শুনি? সপ্তদশী মেয়ের অভিমান হয়। প্রেমিকা সুলভ মনের প্রতিটি কোনায় অন্ধকার নামে সেই অনুরাগের তোপে। জবার ন্যায় লালিত অধর ভে*ঙে, উঠে আসে উঁচুতে। বিড়বিড় করে বলে,
‘ আবার আসুক বলতে, পিউ বিয়ে করব তোকে। বউ হবি আমার?
হব না আপনার বউ। পার্লামেন্ট কে বিয়ে করুন গিয়ে। ইকবাল ভাইকে বউ বানান। থাকেন তো সারাদিন ওদের সাথেই৷ আমাকে কী দরকার?’
বলতে বলতে বারান্দা থেকে এসে বিছানার ওপর ধপ করে বসল সে।
কিছুক্ষণ পর ফোন বাজল ৷ রিংটোন শুনে তিঁতিবিরক্ত হয়ে তাকাল পিউ। স্ক্রিনে তানহার নম্বর দেখে রিসিভ করল। অথচ হ্যাঁ -না বলার আগেই ভেসে এলো মেয়েটির উদ্বীগ্ন, অধৈর্য কণ্ঠস্বর,
‘ টেস্টের রেজাল্ট বেরিয়েছে,দেখেছিস?’
_____
ধূসর হূলস্থূল বাধিয়ে কাজ সাড়ছে। ব্যস্ত ভাবে দেখছে ঘড়ির কাঁটা। দুটোর দিকে কেন্দ্রে পৌঁছানো জরুরি। আজকে ভোট। কার্যক্রম শুরু হবে যোহরের পর।
পাশাপাশি চিন্তিত সে। ওইদিন প্রতিপক্ষের হঠাৎ আ*ক্রমণ। সোহেল যতটা বলেছিল অতটা হয়নি,তবে হুমকি দিয়েছে সত্যি। এই নিয়ে বেশিরভাগ সদস্যরাই সিটিয়ে আছে ভ*য়ে। সামনে নির্বাচন বিধায় তারাও পালটা কিছু করেনি। একবার খলিল জিতলে উচিত জবাব পাবে ওরা।
কিন্তু এখন, ইকবাল একা কী করবে কে জানে! কেউ না ম*রা অবধি ও সিরিয়াস হতে পারেনা। সারাক্ষণ ফাজলামি! চিন্তায় ধূসরের মাথা ব্য*থা উঠল। এদিকে কক্সবাজারের গ্যাপটুকুতে অসংখ্য ফাইল জমা পরেছে অফিসে। ইদানীং আমজাদ ভীষণ কড়াকড়ি লাগিয়েছেন। সঙ্গে তার ভাই ভক্ত বাপ তো আছেই। নতুন নিয়ম করেছেন দুজন,প্রতিটি ফাইল পাশ হওয়ার আগে ওকে দিয়ে দেখাবেন,ওর সই নেবেন, এরপরে ডিলে নামাবেন তারা। ধূসর বুঝে পেলোনা এতটা করার কী দরকার! আগে তো এসব ওনারাই করতেন।
ধূসর তাড়াহুড়োতে,কিন্তু মনোযোগী। হাতের কাজ যত দ্রুত শেষ হয় তত ভালো। এর মধ্যে একবার ইকবালকে কল করল । সে ধরলও রাতা-রাতি। কিন্তু প্রচুর শব্দ, গাড়ি,ঘোড়া,চেচামেচির। ইকবাল একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল।
‘ হ্যাঁ বল।’
ধূসরের ফোন স্পিকারে দেওয়া।
‘ কী অবস্থা ওখানকার?’
‘ এই মাত্র এজেন্ট বসালাম। একটু পর শুরু হবে। তুই কখন আসবি?’
‘ চলে আসব। আশরাকের লোকজন আছে?’
‘ হ্যাঁ থাকবে না আবার! কেমন করে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে। তবে হাত খালি,অস্ত্র টস্ত্র তো দেখছিনা। পুলিশ আছেনা? ভ*য় পেয়েছে বোধ হয়।’
ইকবাল হা হা করে হাসল। ধূসর বলল,
‘ আচ্ছা ছাড়,তোরা এক সাথে থাকিস। খলিল ভাইকে ওখানে যেতে মানা করেছি। আপাতত ওনার কেন্দ্রে না আসাই ভালো। আর আমি দেড়টার ভেতর পৌঁছে যাব।’
‘ আচ্ছা ঠিক আছে,তাড়াতাড়ি আসিস। ভালো লাগেনা তোকে ছাড়া। একা একা লাগছে! মনে হচ্ছে শ্বশুর বাড়িতে বউ ছাড়া বেড়াতে এসেছি।’
ধূসর ফোনের দিক চেয়ে নাক-চোখ কোঁচকাল। এই ছেলের ফাজলামো কোনও দিন যাবে না। অতিষ্ঠ ভঙিতে দুপাশে মাথা নেড়ে লাইন কা*টল সে ।
ঘড়ির কাঁটায় যখন ১:২০ বাজে তখনও কাজ শেষ হলোনা। আজ কি একটু বেশিই ফাইল রেখে গিয়েছে?
ধূসর বুঝল,এগুলো শেষ করতে বিকেল গড়াবে তার। বাকীটা নির্বাচন শেষে এসে করে যাবে,নাহলে বাড়িতে দেখবে, ভেবে উঠে দাঁড়াল। গেল সোজা আমজাদের কেবিনে। আফতাব সামনের চেয়ারে বসে তার। চা খাচ্ছেন দুজন৷ সাথে হাসিমুখের গভীর আলোচনা। সে যেতেই সেই আলোচনা স্থগিত সেখানে। সাথে চোখমুখ গম্ভীর হল। ধূসর ভেতরে ঢুকে বলল,
‘ আমি বের হচ্ছি বড় আব্বু। ‘
আমজাদ দুই ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
‘ ফাইল গুলো শেষ করে ফেলেছ? এত তাড়াতাড়ি! ‘
‘ না,শেষ হয়নি। হামিদ(পিওন) কে বলেছি বাড়িতে পাঠাতে,ওখানে দেখে নেব। ‘
‘ এত তড়িঘড়ি করে যাচ্ছো কোথায়,জানতে পারি?’
ধূসর হাতঘড়ি তে একবার চোখ বুলিয়ে জানাল,
‘ রাতে বলেছিলাম,আজ নির্বাচন আমাদের। আম অলরেডি লেইট বড় আব্বু,আই হ্যাভ টু গো।’
ধূসর ঘুরতে গেলেই
আমজাদ চায়ের কাপ টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ালেন,বললেন,
‘ এটাত কথা ছিল না ধূসর। এভাবে মাঝপথে অফিস ফেলে যখন তখন পার্লামেন্টে ছুটবে, কই এরকম তো আগে বলোনি।’
‘ আমার আজকে ওখানে থাকাটা দরকার।’
আমজাদের কণ্ঠ ভারী হলো,
‘ দরকার সেটা ব্যবসায় আসার আগে ভাবোনি ধূসর? এটা তোমার বাপ- চাচার ব্যবসা বলে যখন ইচ্ছে বের হবে,যখন ইচ্ছে ঢুকবে? কেন? অফিসের নিজস্ব নিয়ম নেই? এমনিতেই বেড়াতে গিয়ে তিনদিন কাটিয়েছ। এসে থেকে একটা গোটা দিন তোমাকে অফিসে পাওয়া যায়নি। তুমি আসার পর আমার এত গুলো ফাইল পেন্ডিং থাকে এর আগে এরকম কখনও হয়নি। তোমাকে আমরা ব্যবসায় লাভের জন্য এনেছি,লসের জন্যে নয়। ‘
এক নাগাড়ে বলে দম নিলেন তিনি। ধূসরের এতক্ষণের নরম চিবুক শক্ত হলো। আমজাদ বললেন,
‘ দুই নৌকায় পা দিয়ে আর কত? শেষ মেষ নিজের সাথে ব্যবসাটাও ডুবিওনা। এরকম খামখেয়ালি করলে,কোন ভিত্তিতে ব্যবসা তোমার ওপর ছেড়ে দেব আমরা? আমাদেরও বয়স হচ্ছে,আর কদিনই বা কাজের হাত শক্ত থাকবে? নিশ্চয়ই তোমার বাবা আর আমার এত পরিশ্রমের অফিস,কোনও বেখেয়ালি, উদাস,অযোগ্য লোককে তুলে দেব না তাইনা?’
আফতাব নিরব দর্শক। একবার ভাইকে দেখছেন, একবার ছেলেকে। মাঝেমধ্যে চুমুক দিচ্ছেন চায়ে। ধূসর হাত মুঠো করল। আত্মসম্মানে প্রচন্ড ঘা লেগেছে তার। আমজাদ ফের বললেন,
‘ অফিসে ঢুকলে কেউ বস না,কেউ বসের ছেলেও না। সবাই এক। সবার লক্ষ্য এক, আর সেটা কোম্পানিকে টপে পৌঁছানো। সেখানে তুমি কেন ছাড় পাবে?তাছা…’
ধূসর মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে,শক্ত গলায় বলল
‘ আর কিছু বলতে হবেনা। আমি আমার কাজ শেষ করে তবেই যাব।’
আর একটা কথাও শুনল না। গটগট করে কেবিনের দিক হেঁটে গেল । আমজাদ সেদিক চেয়ে মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিলেন। গ্লাস তুলে ঢকঢক করে পানি খেলেন। মেকি রা*গ নিয়ে এতগুলো কথা বলতে,ভীষণ বেগ পোহাতে হয়েছে।
ঘাড় ঘুরিয়ে আফতাবের দিক চাইলেন তারপর। ভ্রু উঁচিয়ে বিজয়ী হেসে শুধালেন,
‘ কী? কেমন জব্দ করলাম?’
আফতাব হেসে দুপাশে মাথা নেড়ে বললেন,
‘ তুমি পারোও ভাইজান! ‘
_______
দুপুর গড়িয়ে বিকেল তখন। ধূসর রাগে খেতেও বের হয়নি। হামিদকে দিয়ে খাবার পাঠালে,ওমনই ফেলে রেখেছে। ওদিকে ভোট গ্রহনের সময় শেষ । ইকবাল সহ,পার্লামেন্টের মোটামুটি সবাই, লাগাতার ফোন করছিল তাকে। এমনকি খলিলও। শেষে অসহ্য হয়ে ধূসর সাইলেন্ট করে রেখেছে। হাতের একটা ফাইল শেষ না হতেই পিওনকে দিয়ে আরেকটা পাঠানো হয়৷ ধূসরের বুঝতে বাকী নেই, এইসব দুই ভাইয়ের ইচ্ছেকৃত। অন্য সময় বের হলে কিচ্ছু বলে না। কারণ সে ফাঁকই রাখেনি বলার। আজ একটু সুযোগ পেয়েছে, ওমনি দশ কথা শোনাল। ধূসরের মেজাজ তেঁতে আছে। ভোটের ফলাফল কী হলো কে জানে! সে একবার ফোনের সাইড বাটন চাপল। ঘড়িতে চারটে পার হয়েছে। ভোট গণনা কী শুরু হয়েছে? এতক্ষণে তো হওয়ার কথা। কে জিতেছে কে জানে! ফলাফল জানতে ভেতরটা উশখুশ করছে। কেবিনে টিভি থাকলেও বোঝা যেত।
সব চিন্তা ঝেড়ে সে মন দিলো ফাইলে। বুঁদ হয়ে পরল যখন, ঠিক তখন ইকবাল কল দিলো আবার। আলো জ্বলতে দেখে ধূসর একবার আড়চোখে তাকায়। তবে ধরল না। ধরলেই এক কথা বলবে,
‘ কখন আসবি, আসছিস না কেন?’
ধূসর কপাল ঘষল আঙুলে। এর মধ্যে কেবিনে টোকা পড়ে।
আফতাব মাথা ঢুকিয়ে উঁকি দিলেন। শুধালেন,
‘ কী করছো? ‘
ধূসর নাক ফুলিয়ে তাকায়। জবাব দেয়,
‘ ক্রিকেট খেলছি। ‘
আফতাব থতমত খেলেন। ছেলে যে বেজায় চটে আছে! নাহলে ফাইল সামনে নিয়ে বলছে ক্রিকেট খেলছে? বাপের সাথে মশকরা?
কিন্তু না,তিনিও দমে যাবেন না৷ ভাইজান বলেছেন,আজ শক্ত থাকতে হবে।
‘ ইয়ে,খাবার খাচ্ছোনা কেন?’
ধূসরের নিরুৎসাহিত উত্তর, ‘ কাজ করতে দাও,বিরক্ত কোরোনা।’
আফতাব আর কথা পেলেন না। বললেন,’ কিছু লাগলে হামিদকে ডেকো।’
ধূসর উত্তর দেয় না৷ চোখ ফাইলে। ছেলেকে নিরুদ্বেগ দেখে তিনি বেরিয়ে গেলেন৷
এরমধ্যে স্ক্রিন জ্বলল। ইকবালের মেসেজ এসছে। ছোট ছোট কটা অক্ষর উঁকি দিচ্ছে সেথায়।
‘ tandob ghote gese dhuso…….
ধূসরের বুক ছ্যাত করে উঠল। তীব্র ভ*য় হানা দিলো মনে। আশরাক কি কিছু করেছে? অস্থির চিত্তে , অবিলম্বে ইকবাল কে কল দিলো সে। রিসিভ হতেই রুদ্ধশ্বাসে শুধাল,
‘ কী হয়েছে?’
প্রথম দিকে প্রচন্ড আওয়াজ। কিচ্ছু শোনা যায় না। ধূসর হ্যালো, হ্যালো করে অশান্ত হয়ে পড়ল। ইকবালের সাড়া নেই। শেষ দিকে একটু গোঙানির শব্দ এলো কানে। সেই শব্দ মস্তিষ্কে তূখোড় ভাবে বাজল তার। কপাল বেয়ে দরদর করে ঘাম ছুটল।
‘ কী হয়েছে ইকবাল? হ্যালো,শুনতে পাচ্ছিস আমার কথা? হ্যালো? ‘
কথা বলতে বলতে দাঁড়িয়ে গেল সে। কিছুক্ষণ সাড়া নেই। সব নিশ্চুপ। একটু পর ইকবালের নিভু স্বর ভেসে এলো,
‘ ওরা হামলা করেছে ধূসর। গুলি লেগেছে আমার। আমি,আমি…’
তারপর ফোন কেটে গেল। ধূসরের মাথার শিরা দপদপ করে লাফিয়ে ওঠে। হৃদপিণ্ড থমকে যায়। উৎকণ্ঠিত ভঙিতে কপাল মুছে কল দিতে থাকে। ইকবাল ধরছেনা। পরপর সোহেলকে দিলো,সেও না। একে একে পার্লামেন্টের যাদের নম্বর আছে, সবাইকে কল দিলো,এমনকি খলিলকেও। কেউই ধরছেনা দেখে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো তার। ফাইলপত্র ওমন ফেলে রেখেই একপ্রকার ছুটে বের হলো ধূসর। আমজাদ ওকে ছুটতে দেখে বাইরে এলেন। পিছু ডাকবেন এর আগেই ধূসর হন্তদন্ত পায়ে বেরিয়ে গেল। তিনি অবাক হলেন। যা ডোজ দিয়েছিলেন,ওর তো যাওয়ার কথা নয়। গেল কেন তবে?
চলবে,
#এক_সমুদ্র_প্রেম!
কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(৫৪)
ধূসর ঝড়ের গতিতে বাইরে এলো। বিধ্বস্ত লাগছে ওকে। সারা শরীর ঘামে জবজবে। বুকের মধ্যে দা-মামা বাজছে আ*তঙ্কের। উদ্ভ্রান্তের মত ছুটে গেটের কাছে এলো সে। মনে পড়ল বাইক ফেলে যাচ্ছে। আবার পার্কিং লটের দিক পিছু দৌড়াল । ওর এত তাড়াহুড়ো দেখে দারোয়ান তটস্থ ভাবে গেট সরিয়ে দিলেন দুদিক।
ধূসর পরিষ্কার দৃষ্টিতেও ঝাপ্সা দেখছে যেন৷ স্নায়ু চলাচল আগেই রুদ্ধ। চোখের সামনে ভাসছে ইকবালের স্বচ্ছ মুখ। নিরন্তর কানে বাজছে ওর কথাগুলো। ওই শুভ্র,পরিষ্কার হাসি, দুষ্টুমি গুলো মনে করে ঢোক গিলল সে। ইকবাল ওর প্রিয় বন্ধু,ছোট বেলার সঙ্গী। আর এখন তার বোনের স্বামী। আজ যদি ওর কিছু হয়,আশরাকের দলবলের একটাকেও সে ছাড়বে না।
ধূসর দুরন্ত ভাবে বাইক নিয়ে গেট পার হয়। অথচ এগোতে না এগোতেই, উল্টোদিক থেকে ধেঁয়ে এলো পাঁচখানা মাইক্রো। সামনে এসে শাই করে ব্রেক কষল চোখের পলকে। ধূসর হকচকিয়ে বাইক থামাল। অল্পের জন্য সং*ঘর্ষ হলো না। বড় বড় মাইক্রো গুলোর চাকা থেকে নির্গত ধোঁয়ায় মেখে গিয়েছে চারপাশ। ধূসর ভ্রু গুটিয়ে, কৌতূহল সমেত চায়। গাড়ির সব কাঁচ তোলা, ভেতরটা অস্পষ্ট। ও স্ট্যান্ডে বাইক দাঁড় করাল। আকস্মিক, কোনও এক চিন্তায় শক্ত হলো চিবুক । আশরাকের লোকজন কি কেন্দ্রে হা*মলা করে এখন ওকে মা*রতে এসেছে? ধূসর যত্র নেমে, সটান হয়ে দাঁড়াল। নির্ভীক তার চিত্ত। পাঁচটা মাইক্রো ভর্তি লোক সম্পর্কে আন্দাজ আছে ওর৷ এত লোকদের সাথে সে একা পারবেনা জানে,তবু অভীক অভিব্যক্তি। ভীতুর মত নয়,বীরের মত ম*রবে। ধূসর শার্টের দুই হাতা গোটাল। এর মধ্যেই একটা মাইক্রোর দরজা সজোরে খুলল একজন। ও মানসিক প্রস্তুতি নিলো লড়াইয়ের। খালি হাতে,পরাজয় নিশ্চিত,তবুও দমবে না।
তারপর এক জোড়া পা এসে মাটিতে দাঁড়াল। নিমিষে অনেক গুলো পায়ের বিচরণ। একে একে সব গুলো মাইক্রোর দরজা উন্মুক্ত হয়। ধীরে-সুস্থে বেরিয়ে আসে কিছু চেনা-জানা মুখ। ধূসরের ভ্রু দ্বয়ের গাঢ় ভাঁজ মিলিয়ে গেল ওমনি। কিছু বোঝার আগেই একটি মুখ ছুটে এলো তার দিকে।
উৎফুল্ল চিত্তে
‘ হুররেএএএএ’ বলে জড়িয়ে ধরল। সেই আনন্দ ধ্বনিতে তাল মেলাল বাকীরা। সমানতালে জয়ধ্বনি উঠল।
আচমকা এসে ধরায়, ধূসর মানুষটা সহ দু পা পিছিয়ে যায়। চোখেমুখে অবিশ্বাস ওর। যা দেখছে সব সত্যি? উত্তর আসার পূর্বে,বাকীরা এসে জড়িয়ে ধরল। অত মানুষের ভীড়ে,কারো হাত নাগাল পেল তার শরীর,কারো পেলো না। অথচ ধূসর পাথর বনে দাঁড়িয়ে। সবাইকে ছাপিয়ে তার বিভ্রান্ত আঁখিদ্বয় পরে রইল প্রথম মানুষটির ওপর। যেখানে পরিষ্কার ইকবালের হাসি হাসি মুখবিবর। পুরো বত্রিশ কপাটি মেলে আছে সে। ধূসর থম ধরে চেয়ে দেখে, ওর বাহু ঝাঁকিয়ে বলল,
‘ উই ওন ধূসর! জিতে গেছি আমরা। আজ থেকে খলিল ভাই মেয়র। আশরাক হেরে গিয়েছে। ‘
ধূসরের ওতে কান নেই। সে থেমে থেমে শুধাল,
‘ তোর না গুলি লেগেছিল?’
সহসা হো হো করে হেসে উঠল সবাই। ভারী মজার কিছু শুনেছে যেন। তারপর অতগুলো কণ্ঠ, সমস্বরে টেনে টেনে জানাল,
‘ প্র্যাংক! ‘
ধূসরের কপালের শিরা জেগে ওঠে তৎক্ষনাৎ। প্র্যাংক শব্দটা নিদারুণ ভঙিতে কানে লাগে। জট ছাড়িয়ে খলিল এগিয়ে এলেন।
উল্লাসের দীপ্তিতে তার চেহারা জ্ব*লছে। ছ’য়ের অধিক ফুলের মালা ওনার গলাতে।
কাছে এসে একটা মালা ধূসরকে পরিয়ে দিয়ে বললেন,
‘ আমরা জিতেছি ধূসর। আমাদের দল জিতেছে। তোমাদের,তোমার,আমার, সবার পরিশ্রম স্বার্থক।’
সাথে খুশিমনে বাহুতে ওকে জড়িয়ে নিলেন তিনি। ধূসর কিছু বলল না। তার দৃষ্টি তখনও ইকবালের ওপর। খলিল ওর কাধে এক হাত রেখে বললেন,
‘ আজ তোমাদের জন্য একটা বড় পার্টি থ্রো করব৷ সব আয়োজন হবে তোমাদের মত করে। ‘
সবাই মিলে আরো একবার ‘হোওওও’ বলে চেঁচাল। খলিল ভাই,খলিল ভাই বলে স্লোগান তুলল। হলো হাত তালির বর্ষণ।
ইকবাল হে হে করে হাসছে। সূর্যের নরম আলোতে তার আঁদোল প্রভাময়। এক ফাঁকে ধূসরের দিক তাকাতেই সেই হাসি দপ করে নিভে যায়। ওর কটমটে চোয়াল,আর পো*ক্ত চাউনী দেখে ঘাবড়ে গেল। সচকিত হলো ওমনি। ও এইভাবে দেখছে কেন? রেগে গেছে? গলা খাকাড়ি দিলো ইকবাল। বলতে গেল,
‘ হয়েছে কী, আমরা সবাই মিলে তোকে ফোন করছিলাম। তুই ধরছিলিস না,তাই ভাবলাম তোকে একটা সারপ্রাইজ দেব। আর তা….’
কথা শেষ হয়না, আগেই ধূসর দড় এক ঘু*ষি বসাল ওর মুখের ওপর। হকচকিয়ে পিছিয়ে গেল সে। উলটে পরতে পরতেও,কোনও মতে সামলে দাড়াল। চিবুক ধরে মারবেল চোখে তাকাল। উপস্থিত প্রত্যেকের হাসি, মুহুর্তে গায়েব।। ধূসর রা*গে কিড়মিড় করে ওঠে। শান্ত অথচ কড়া কণ্ঠে বলে,
‘ আজ থেকে তোর সাথে আমার কোনও সম্পর্ক নেই ইকবাল। দরকার নেই তোর মত বন্ধুর।’
বক্ষস্পন্দন থমকে গেল ইকবালের। বাকী রা ভীত,চিন্তিত লোঁচনে মুখ দেখা-দেখি করল৷ ধূসর রাগে গজগজিয়ে অফিসের দিক ফিরতে নেয়। বিদ্যুৎ বেগে ছুটে এসে পেছন থেকে জাপটে ধরল ইকবাল। আর্ত*নাদ করে বলল
‘ সরি! সরি! ভুল হয়ে গিয়েছে! মজা করছিলাম ধূসর, তোকে সারপ্রাইজ….
ধূসর ঝাড়ি মেরে ওকে সরিয়ে দিলো। বুকে ধা*ক্কা মেরে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল
‘ মজা? কীসের মজা? কোন ধরনের মজা এটা? তোর কোনও ধারণা আছে,আমি কতটা ভ*য় পেয়েছিলাম? মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। এই রকম লেইম, ফালতু মজা তোকেই মানায়। আর এমন লেইম,মিথ্যেবাদী মানুষের সঙ্গ ধূসরের প্রয়োজন নেই। মুখও দেখতে চাইছিনা তোর।
খলিল বোঝাতে গেলেন,’ ধূসর ওর দোষ নেই। আমরা সবাই….’
সে থামিয়ে দিয়ে বলল,
‘ আমার বোঝাপড়া আপনাদের সবার সাথে নয়। ওর একার সাথে খলিল ভাই৷ আপনি প্লিজ আমাদের মধ্যে আসবেন না।’
তিনি ব্যর্থ শ্বাস নিলেন। বললেন,’ ওকেহ।’
ইকবালের গলা শুকিয়ে কাঠ-কাঠ। ধূসর আজ সাংঘাতিক ক্ষে*পেছে। এখন বিবেক লাফাচ্ছে তার। মনে হচ্ছে সত্যিই, এইরকম মজা করা ঠিক হয়নি। ধূসর যদি সত্যি সত্যি তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে? এই এক শঙ্কায় নিজের ভালোবাসা দিনের পর দিন চে*পে রেখে অন্যায় করেছিল সে। আর আজ! না না, ধূসরের মত বন্ধু হারানো সম্ভব না। জীবন এতটা সদয় সব সময় হয়না।
ধূসর আবার যেতে ধরলে,ইকবাল আবার পেঁচিয়ে ধরল। কাঁদো-কাঁদো গলায় অনুনয় করল,
‘ ভাই মাফ করে দে! আল্লাহর কসম, আর জীবনে এরকম করব না। মজা-টজা সব বাদ আজ থেকে। আমি বুঝিনি তুই এত রে*গে যাবি! পা ধরব তোর? ‘
ধূসর তর্জন দিলো, ‘ দূরে থাক ইকবাল। ‘
ইকবাল আপত্তি জানাল জোর গলায়,
‘ সেটা পারব না। বাকী যা বলিস সব করব। আচ্ছা, এই দ্যাখ কান ধরছি,ওঠবস করছি…’
‘ এক- দুই- তিন …’
একটা পার্লামেন্টের সভাপতি হয়েও দশের অধিক মানুষের মাঝে নির্দ্বিধায় ওঠবস শুরু করল ইকবাল। ধূসর ফিরেও দেখছেনা। আরেকদিক তাকিয়ে সে। বাকী নিরব দর্শক রা চুপসে যাওয়া মুখমণ্ডল নিয়ে দাঁড়িয়ে। এই পরিকল্পনায় ওরাও সামিল ছিল যে!
ধুসরের নিরুৎসাহিতা দেখে, ইকবাল শেষে হতাশ হয়ে থামল। ঘন শ্বাস নিলো। হাস্যরসাত্মক হওয়ার সঙ্গে আবেগী সে। ছেলে বলে কী খারাপ লাগেনা? কষ্ট হবেনা? ধূসর সহজে ওর ওপর রাগেনা। এতটাতো কখনওই নয়৷ একেবারে সবার সামনে বন্ধুত্ব ছেদ করার কথা তো এমনি এমনি বলেনি। অপরাধবোধে তার চোখ ভিজে আসে। ফের বলে,
‘ ধূসর প্লিজ!’
ধূসর তোয়াক্কা করল না অনুরোধের। অফিসে ঢোকার জন্য পুনরায় পা বাড়াল। ঘোর অমানিশায় ইকবালের খানিক আগের উজ্জল আঁনন মিলিয়ে যায়।
অনুযোগী, অভিমানী কণ্ঠে খলিলকে বলল,
‘ খলিল ভাই,আপনার একটা লাইসেন্স করা পিস্তল আছেনা? নিয়ে এসেছেন সাথে? দিন তো আমায়। কেউ যখন আমার কথা শুনছেইনা,সত্যি সত্যি নিজেকে গুলি মে*রে দেই৷’
ধূসর থামছেনা দেখে বলল,
‘ একটা কথা শুনে রাখ ধূসর, বন্ধুত্ব ভা*ঙার আগে ইকবাল লা*শ হবে,কবরে যাবে। আমার র*ক্ত মাড়িয়ে যাবি,তারপর এই সম্পর্ক শেষ করবে সে। তবু বেচে থাকতে ধূসর নামের বন্ধুকে হারাবে না।’
ধূসর থামল। ফিরে চাইল। ইকবাল পাঞ্জাবির হাতা উলটো করে মুছে নিল সদ্য আসা অশ্রু। সে নেত্র সরু করে বলল,
‘ আবার নাটক শুরু? বাজে কথা অন্য কোথাও গিয়ে বল। ‘
‘ আমি বাজে কথা বলছি? ম*রে দেখালে বিশ্বাস করবি তুই?’
সোহেল এগিয়ে গিয়ে বলল,
, ধূসর,ছাড় না। আজ এত আনন্দের দিনে ইকবালের এইটুক ভুল মাফ করে দে না। দ্যাখ,ও কিন্তু একা কিছুই করেনি,আমাদের সবার বুদ্ধিতেই হয়েছে এসব। নাহলে আমরা কেউই ফোন তুলিনি কেন?তুই চাইলে আমাদের বক,তাও এভাবে চলে যাসনা। তুই ছাড়া আমাদের সব আনন্দ বৃথা,মাটি।’
ইকবাল উদ্বেগ পুহিয়ে বলল,
‘ আমিওত সেটাই বলছি,দরকার হলে আমাকে আরো মা*র,বক, লাগলে গালি দে। এই যে একটা ঘু*ষি মে*রেছে,আমি কিছু বলেছি? চাপার দাঁত তো সব নড়ে গেছে আমার,তাও তো কিছু বলিনি। কারণ আমি ভুল করেছি আমি মানি। কিন্তু সম্পর্ক রাখব না এটা কেমন কথা? মানে মানুষ দূর্বলতা ভালো বোঝে, বুঝলি সোহেল। জানে যে ওকে ছাড়া আমি অঁচল,তাই সব কিছুতে হু*মকি দেয়, মজা নেয়।’
‘ আমি হুমকি দেই? মজা নেই?’
ইকবাল ঠোঁট ফুলিয়ে, ভুরু কুঁচকে মাটির দিক চেয়ে রইল। খলিল বললেন,
” আমাদের জন্য এবারের মত বেচারাকে মাফ টা দিয়ে দাও ধূসর। প্লিজ!’
ধূসর পুরূ কণ্ঠে শুধাল,’ আর করবি?’
ইকবাল যত্র ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলল, ‘ জীবনেও না। ‘
‘ ঠিক আছে। ‘ বলার সাথে শ্বাস ফেলতেও পারল না,ইকবাল হুড়মুড়িয়ে চাঁদরের মত মুড়িয়ে ধরল ওকে। এরপর ধরল সোহেল। সোহেলের দেখাদেখি অনেকে। এতজনের আচমকা ভারে ধূসর টাল রাখতে পারল না। ওদের সহ ধপ করে পরে গেল মাটিতে। প্রথম দফায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে,পরপর হু হা করে হেসে উঠল সবাই। হাসল ধূসর। বিজয়ের,সফলতার, হৃষ্টটার স্বতঃস্ফূর্ত হাসি।
ধূসরের উন্মত্তের মত বেরিয়ে যাওয়া দেখে আমজাদ থেমে থাকেননি। নিজেও তৎপর কদমে পেছন পেছনে এসেছেন। তারপর, অফিসের সামনে ঘটে যাওয়া দৃশ্যগুলো সমস্তটা একের পর এক দেখলেন। ইকবাল আর ধূসরের বন্ধুত্ব এই প্রথম বার মোহিত করল ওনাকে। সাথে পার্লামেন্টের প্রতিটি সদস্যের ধূসরের প্রতি একাগ্রতা দেখে একটু হলেও ভালো লেগেছে। তিনি শ্বাস নিলেন। বিস্তর নিঃশ্বাস। ওদের ছেলেমানুষী দেখে,মৃদুমন্দ হাসি ভীড়ল ঠোঁটে। ঘুরে হাঁটা দিতেই আফতাব সামনে পরল। তিনিও একইভাবে বেরিয়ে এসেছিলেন। ওনাকে দেখেই আমজাদ হাসি কমিয়ে মুখচোখ পাথরের মত বানালেন। বললেন,
‘ বাঁদড়ে দুটো দিয়ে হচ্ছিলোনা। আজ বাকী গুলোও দল বল সহ অফিসে চলে এসেছে।’
তারপর ঢুকে গেলেন ভেতরে। আফতাব সেদিকে চেয়ে, আবার সামনে ফিরলেন। ধূসরকে টেনেটুনে ওরা গাড়িতে বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাইকটা বুঝিয়ে দিচ্ছে দারোয়ান কে। আফতাব ছেলের খুশি খুশি মুখবিবর দূর থেকেই দেখে গেলেন। নিজেও হেসে পিছু চললেন ভাইয়ের।
______
সিকদার বাড়ির দোরগোড়ায় ইকবাল গাড়ি থামাল। সেই কক্সবাজার থেকে ফেরার পর যে গিয়েছিল আর এলো আজ। না জানি পুষ্পটা কত্ত ক্ষে*পেছে তার ওপর! সময়ই দিতে পারেনি। আজ সুদে আসলে বউয়ের সব রা*গ পুষিয়ে দেবে সে। অপর পাশ থেকে ধূসর নামল। তাদের দুজনের হাত ভর্তি মিষ্টির প্যাকেট।
নিজেদের দল জেতার আনন্দে পুলকিত ওরা। প্রশান্ত,প্রফুল্ল চিত্তে যখন সদর দরজা পেরিয়ে ভেতরে এলো,সেই মুহুর্তে থমকে গেল সব। ভেতরের গুমোট পরিবেশ এক নিমিষে বিভ্রান্তিতে ফেলল। বসার ঘর তখন থমথমে। হৈহৈ করা নিবাস আজ নিরব,শব্দহীন। বাড়ির প্রত্যেকে উপস্থিত,অথচ কারো মুখে কথা নেই।
মিনা বেগমকে দুহাতের মাঝে আগলে ধরে আছেন রুবায়দা। যেন আটকাচ্ছেন কোনও কিছু হতে। অথচ ভদ্রমহিলা ক্রো*ধে ফাটছেন। ক্ষিপ্ত,তপ্ত লোঁচন তাঁক করা পিউয়ের ওপর। মেয়েটা জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে। সবার শুষ্ক মুখমন্ডলের মাঝে ফুঁপিয়ে কাঁ*দছে। ধূসরের সব এলোমেলো হয়ে গেল ওকে কাঁদতে দেখে। খলিলের বাড়িতে করে আসা আনন্দ- উৎসবের রেশ এক মুহুর্তে উবে গেল হাওয়ায়।
উদ্বীগ্ন গলায় শুধাল,
‘ কী হয়েছে?’
কণ্ঠ শুনে পিউয়ের শরীর কাঁ*পে। তরঙ্গের ন্যায় ওঠানামা করে। কিন্তু নত করা মাথাটা উঁচু হলো না। সকলে ওদের দিক তাকাল। ইকবাল, পুষ্পকে ইশারায় ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চাইল,
‘ ঘটনা কী?’
তার মুখশ্রী কালো। মিনমিন করে বলল
‘ আম্মু পিউকে মে*রেছে।’
ধূসর চট করে মিষ্টির প্যাকেট ফ্লোরে রাখল। ঠিকঠাক প্যাকেট বসল কী না দেখার প্রয়োজন ও বোধ করল না। লম্বা পা ফেলে এগিয়ে এসে পিউয়ের পাশে দাঁড়াল। নীচের দিক চেয়ে কাঁদতে থাকা ওর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে শুধাল,
‘ মে*রেছ কেন বড় মা?’
মিনা গজগজিয়ে উঠলেন,
‘ মারব না তো কী করব? মান -ইজ্জত কিচ্ছু রাখল না আমাদের! বেয়াদব মেয়ে কোথাকারে!’
‘ কী করেছে ও? ‘
‘ কী করেছে? কী করেছে ওকে জিজ্ঞেস কর।’
পিউ ওপরের ঠোঁট দিয়ে নীচের ঠোঁট চেপে রাখল। প্রার্থণা করল, ধূসর ভাই প্রশ্ন না করুক। সে কিছুতেই বলতে পারবে না। ক*ষ্টে তার বৃহৎ চোখ ছাপিয়ে জল নামল। ধূসর বলল,
‘ ওর বলতে হবেনা,তুমি বলো। মা*রলে কেন’
মিনা অ*গ্নিচোখে মেয়ের দিক চেয়ে। যেন ভৎস করে দেবেন ওকে।
ধূসর খেই হারিয়ে উচু স্বরে বলল,
‘ প্লিজ বলবে, কী হয়েছে?’
‘ কী আর হবে? পড়াশুনা রেখে টই-টই করলে যা হয়,তাই হয়েছে। ফেইল করেছেন মহারানী,ফেইল৷ টেস্টের রেজাল্ট বেরিয়েছে না আজ? এক বিষয়ে ফেইল করে এসেছেন।’
ধূসর আশ্চর্য চোখে তাকাল। পিউয়ের চিবুক গলদেশে ঠেকল গিয়ে। লজ্জায় চোখ বুজে, খুলল আবার। ধূসর কোমল কণ্ঠে বলল,
‘ ফেইল করেছিস?’
মিনা বললেন,
‘ ও কী বলবে? বলার মত মুখ আছে? সারাক্ষন বলতাম, পড়তে বোস,পড়তে বোস। তখন আমার কথা ভালো লাগেনি, শোনেনি। লাফালাফি, হুরোহুরি করে সময় কাটিয়েছে। কতক্ষণ বর্ষার বিয়ে,কতক্ষণ বোনের বিয়ে,আর শেষে কী হলো? ফেইল এলো। ছি!’
পুষ্প বলল,
‘ আহ মা, চেঁচাচ্ছো কেন? আস্তেও তো বলা যায়।’
তিনি দ্বিগুন চেঁচিয়ে বললেন,
‘ একদম কথা বলবিনা। চেঁচাব না তো কী করব?এই বাড়ির কোনও ছেলে মেয়ে আজ অবধি ফেইল করেছে? তারা জানে ফেইল কী জিনিস? ছি! ছি! এখন আমি কাকে মুখ দেখাব? পাশের বাড়ির ভাবি যখন জিজ্ঞেস করবেন,মেয়ের কথা,আমি কী বলব?’
মিনা হা- হুতাশ লাগালেন। তারপর রুবায়দাকে খ্যাক করে বললেন,
‘ তুই আমাকে ছাড়৷ আজ ওর একদিন কী আমার একদিন! ফেইল কীভাবে করে আমি দেখাচ্ছি।’
তেড়ে আসতে নিলে রুবায়দা আরো শক্ত করে আকড়ে ধরলেন। পিউ ভ*য়ে,এক লাফে ধূসরের পেছনে গিয়ে লুকোলো।
সেও ওকে আড়ল করে বলল,
‘ থামো বড় মা। এই সামান্য কারণে এত রিয়্যাক্ট করার কিছু নেই। ‘
মিনা চোখ কপালে তুলে বললেন,
‘ কী বলছিস? এটা সামান্য ব্যাপার? ওকে কোন সুবিধাটা দেয়া হয়নি আমাকে বোঝা! ভালো কলেজ, ভালো টিচার সব দিয়েছি। কাড়ি কাড়ি টাকা ঢেলেছি। যখন যেটা বলেছে, সেটা দিয়েছি। বই খাতা যা লেগেছে সব এনে দিয়েছি৷ তাহলে এরকম রেজাল্ট করবে কেন? তানহা তো ওর থেকে ভালো না লেখাপড়ায়,সে মেয়ে পাশ করল,ও ফেইল করল কী করে? বোঝা আমাকে।’
ধূসর ঘাড় বাকা করে পেছনে লুকানো পিউয়ের দিক ফিরল। সম্মুখীন হলো দুটো পেল্লব ভেজা ভেজা চাউনীর। কণ্ঠে প্রশ্রয় ঢেলে বলল,
‘ ফেইল কীভাবে এলো? পড়ে যাসনি?’
পিউ বুঝল না কী বলবে!
আপনার বিরহেই এই অবস্থা হয়েছিল, ওসব কী বলা যায়? মাথায় যা এলো, বলল,
‘ অসুস্থ ছিলাম,কিছু লিখতে পারিনি।’
ধূসর মিনাকে শুধাল,
‘ রেজাল্ট কার্ড পেয়েছ?’
‘ না। আজইত রেজাল্ট বের হলো। আর এই মেয়ে কত বড় ফাজিল,রেজাল্ট দেখেও ঘরে ঘাপটি মেরে বসেছিল। এত বার ডাকছি নামছিলোইনা। ওর ক্লাস টিচার ফোন করে না জানালে, আমিত জানতেই পারতাম না।’
এর মধ্য আমজাদরা বাড়িতে ঢুকলেন । মিনা ওনাকে দেখেই বললেন
‘ শুনেছেন, আপনার আদরের মেয়ে টেস্ট পরীক্ষায় ফেইল করেছে। এখন কী হবে বলুন তো? ফাইনালে তো ওকে আর তুলবেনা। এই মেয়েকে দিয়ে এবার আমি কী করব?’
তিনি উত্তরে কিছু বললেন না। তবে পিউকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ ফেইল করেছো?’
পিউয়ের এত কান্না পেলো! সে ফেইল করেছে,সবাই এভাবে আলাদা করে জানতে চাইছে কেন? লজ্জার কথা কী বুক ফুলিয়ে বলা যায়? সে কি বেহায়ার মত বলবে,হ্যাঁ ফেইল করেছি?
মিনা অবাক কণ্ঠে বললেন,
‘ আপনি ওকে ধমক না দিয়ে এত আস্তে কথা বলছেন কেন?’
তারপর রুবাকে বললেন,
‘ শুনেছিস? গলার স্বর শুনেছিস? অন্য সব ছেলেমেয়ের বেলায় মেজাজ তালগাছে থাকে,আজ কী হলো? আপনি ওকে শা*সন টাসন কিছু করেননা বলেই এই অবস্থা!’
পিউ নাক টানতে টানতে নখ দিয়ে ধূসরের পিঠের শার্ট খুঁটছে। রাদিফ,রিক্ত সবাই শুনে ফেলেছে ও ফেল্টুস। ছি! মান ইজ্জত সব শেষ!
আমজাদ স্ত্রীর কথায় বিস্মিত না হয়ে পারলেন না। মানে কী আজব নারী! নিজেই মেয়ের টিচার বদলে তাকে কথা শোনানো? সকালের রাগটা টুপ করে ফেরত এলো ওনার। নাক ফুলিয়ে বললেন,
‘ ওকে কী বলব? ওকে যারা পড়ায়,তারা যা শেখাবে ওতো তাই লিখবে খাতায়। পরীক্ষার পনের দিন আগে ফয়সাল কে পালটে মারিয়াকে না আনলে তো আর এরকম হোতো না। তখন নিজেরা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছ, আমাকে জানিয়েছিলে? এখন তাহলে আমাকে টানছো কেন? বলেছিলে না,মেয়ের রেজাল্ট নাকি বাঁধাই করার মত হবে! কী, অতি বিশ্বাসের ঝামা ঘষা পড়ল মুখে? তোমাদের দুজনের বেশি বোঝার চক্করে মাঝখান থেকে আমার মেয়েটার পড়াশোনার ক্ষতি হলো।’
মিনার কথা বন্ধ।
ইকবাল বিড়বিড় করে বলল,
‘ ব্যাটা হিটলার ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ঠিক দোষটা ধূসরের কাঁধে দিয়ে দিলো?’
সে ভেবেচিন্তে কিছু কথা সাজাল। একটু আগে,এই আলাপে ঢুকতে গিয়েই,আমজাদ কে দেখে পিছিয়ে এসেছিল। মনে পড়েছিল, পুরোনো কথা। যখন পুষ্প সাদিফের বিয়ে ঠিক হয়,আমজাদ ওকে বারবার বাইরের মানুষ বলছিলেন।আজও যদি বলে?
কিন্তু না,ধূসরের ঘাড়ে দোষ চাপছে, ও তো আর চুপ থাকবেনা। একটু কেশে বলল,
‘ আঙ্কেল,আমার মনে হয় আপনার হিসেব টা মিলছেনা। না মানে,মারিয়া তো পনের দিন ধরে পিউকে পড়াচ্ছিল। ওই অল্প দিনে, সাইন্স পড়ানো কী সহজ কথা বলুন? পিউত তাই শিখেছে যা ওকে ফয়সাল নামের ছেলেটি পড়িয়েছিল,বুঝিয়েছিল। সে ওকে এক বছর ধরে পড়াচ্ছে। তার পড়াগুলোই বহু আগে থেকে পিউয়ের মাথায় গেঁথে বসেছেনা? এখন মারিয়া যতই ভালো পড়াক,ওইসবের ওপর দিয়ে ওটা কি আর ঢুকবে বলুন! এমনিতেই ভালো কিছু আমাদের মস্তিষ্ক অনেক দেরিতে গ্রহণ করে,সেখানে সাইন্স । তাও আবার পনের দিন সময়ের? বিশাল ঝামেলার ব্যপার না? ‘
আমজাদ মুখ কোঁচকালেন। তবে জবাব দিলেন না। পেছনে দুহাত বেঁধে, বিরক্ত ভঙিতে মুখ ঘুরিয়ে রাখলেন আরেকদিক।
এদিকটায় মিনা মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে পড়লেন। হাহা-কার করে বললেন,
‘ এখন আমার বাপের বাড়ি কী বলব আমি? পাশের বাড়ি কী বলব? ইয়া আল্লাহ! সবাইকে কত বড় মুখ করে বলতাম, আমার মেয়ের মাথা ভালো,পড়াশোনা পারে। আর সেই মেয়ে সোজা ফেইল করে এলো? ‘
পিউ নিঃসহায় বনে তাকাল। ভীষণ খারাপ লাগছে তার। সত্যিইত মামা-মামীরা শুনলে কী বলবেন? আর শান্তা শুনলে,ইশ,সব গেল!
তিনি যতটা আহাজারি করলেন, ইকবাল ততোধিক নিশ্চিন্ত কণ্ঠে বলল,
‘ আন্টি আপনি কিন্তু শুধু শুধু এত ভাবছেন! ফেইল করা কী খারাপ কিছু? পৃথিবীর বিখ্যাত সব ব্যক্তিরা কিন্তু ফেল করেছিলেন। যেমন ধরুন নিউটন,মেট্রিকে ফেইল করেও কত বড় বিজ্ঞানী সে! মাথায় আপেল পড়ল,আর টুপ করে ক্যালকুলাস লিখে ফেইমাস হলো। সারা বিশ্ব চেনে ওকে। আমাদের পিউ ফেইল করেছে তো কী? ও হবে এই যুগের মহিলা নিউটন। ওর মাথায় ও একদিন আপেল পরবে আমার বিশ্বাস। যদি আপনা -আপনি নাও পরে,আমি নিজ দায়িত্বে বাজার থেকে কিনে এনে, ওর মাথায় ফেলব। আর তখন ওউ লিখবে দ্বিতীয় ক্যালকুলাস। ইতিহাসের পাতায় উঠবে ওর নাম। তখন কিন্তু ওকে নিয়ে সব চাইতে বেশি আপনারই গর্ব হবে।’
মিনা হতভম্ব হয়ে তাকালেন। তব্দা খেয়েছেন চোখেমুখে স্পষ্ট। বাকীদের অবস্থাও তাই। কিন্তু পিউয়ের হাসি পেয়ে গেল। পরপর নিজেকেই কষে অদৃশ্য চ*ড় বসাল সে। এমন সিরিয়াস মুহুর্তে হাসা পাপ। তারতো কেঁদে ভাসিয়ে দেয়া উচিত। পুষ্প চ সূচক শব্দ করে বলল,
‘ আহ,তুমি থামো তো। আগা-মাথা ছাড়া একটা বলে দিলেই হলো!’
ইকবাল অবুঝের মত কাধ উচিয়ে বলল,
‘ ঠিকই ত বললাম। এরকমটা কিন্তু হলেও হতে পারে।’
‘ আর কাউকে কিছু বলতে হবেনা। বড় মা,তুমি অহেতুক এত প্যানিক হচ্ছো। পিউ টেস্টে ফেইল করেছে তো কী? ফাইনাল পরীক্ষা তো সামনে। সেখানে ও ভালো রেজাল্ট করবে। ‘
‘ কী করে করবে? ফাইনালে ওকে তুললে তো!’
‘ সেটা পরের বিষয়। আপাতত আমি কথা দিচ্ছি,পিউয়ের রেজাল্ট ফাইনালে দেখার মত হবে।’
তারপর ওর দিক চেয়ে বলল,
‘ কী, হবেনা?’
পিউ, ধূসরের দুটো গভীর চোখে চেয়েই সাতদিনের অভিমান ভুলে বসল। আগে পিছু না ভেবে দৃঢ় ভাবে মাথা ঝাঁকাল সে। ধূসর, ইশারা করল মিনা বেগমের দিকে,
‘ বল।’
পিউ ঢোক গিলল। মায়ের সাথে কথা বলতেই রুহু কাঁ*পছে এখন৷ অনেকদিন পর মা*র খেয়েছে যে!
এত জোরে স্টিলের খুন্তি ছু*ড়েছিল গায়ে,ভাগ্যিস সঠিক সময়ে সরে পড়েছিল। নাহলে এই বসার ঘরেই ইন্না-লিল্লাহ হতো ওর। চ*ড়টা কোনও রকম সওয়া গেলেও ওটা ভ*য়ানক।
সে আস্তে করে বলতে গেল,
‘ মা আমি…
এর আগেই তিনি তেঁতে বললেন,
‘ তুই আমাকে মা ডাকবিনা। কোনও ফেইল করা মেয়ের মা নই আমি। ভালো রেজাল্ট করতে পারলে ডাকবি, এর আগে না। ‘
পিউ সবেগে বলল,
‘ ফাইনালে ভালো করব। এ-প্লাস না পেলে তখন যা মন যায় কোরো,এর থেকেও বেশি মেরো। আজ থেকে সারাক্ষণ পড়ব সত্যি বলছি।’
জবা সাফাই গাইলেন,
‘ আপা হয়েছে তো। বলেছে ও। এবার ঠান্ডা হও। ‘
‘ ঘোড়ার ডিম করবে ও। ওকে আমার চেনা আছে। পড়তে বসেনা,টিভির দিক হা করে থাকে। এমন ফাঁকিবাজের পড়াশুনার কী দরকার? আপনি আপনার মেয়ের জন্য ছেলে দেখুন তো। বিদেয় করি এটাকে।’
পিউ হা করার আগেই ধূসর চেঁতে বলল,
‘ আশ্চর্য, উল্টোপালটা কথা বলছো কেন? ও তো বলেছে ও ভালো রেজাল্ট করবে৷ তোমাদের সবটাতে বাড়াবাড়ি। এতদিন পরীক্ষায় ভালো করত,কই তখন তো একটা শব্দও শুনিনি তোমার মুখে। কেউ টেরও পায়নি। আর যেই পছন্দ মাফিক কিছু হলোনা,ওমনি শুরু?’
সুমনা তাল মেলালেন,’
‘আমারও ত একই কথা। কিন্তু আপাকে কে বোঝাবে? ‘
মিন উঠে দাঁড়ালেন,’ হ্যাঁ সব তোরা বুঝিস। আমি কিছু বুঝিনা। লাই দিয়ে ওটাকে আরো মাথায় তোল,দ্যাখ তারপর আরো কত খেল দেখায়!’
‘ আম্মু এমন করছো কেন? পিউ কি খারাপ স্টুডেন্ট? ওতো বলল ওর শরীর খারাপ ছিল সেদিন, তাও তুমি বকছো ওকে!’
মিনা একটু দম ফেললেন,বললেন,
‘ ঠিক আছে। আগে তো ফাইনালে উঠুক। দ্যাখ গিয়ে নেয় কী না! আমি কিন্তু গিয়ে মাস্টারের হাতে পায়ে ধরতে পারব না। এমনি নিলে নেবে,নাহলে না,বলে দিলাম। আর আজকের পর যদি তোর বোনকে বই ছাড়া দেখেছি পুষ্প,মনে রাখিস, ওকে কে*টে কুচিকুচি করে গেটের সামনের কুকুরটাকে খাইয়ে দিয়ে আসব আমি। ‘
পিউ ঠোঁট উলটে রাখল। তবে তার কান্না-কাটি থেমেছে। ভেতর ভেতর দুশ্চিন্তা হচ্ছে খুব! সত্যিই যদি ফাইনালে না ওঠায়, কী হবে?
এদিকে রাদিফ মারাত্মক চিন্তায় পড়ল। মিনা বেগমের শেষ কথাটায় ভীষণ কৌতূহল নিয়ে শুধাল,
‘ কিন্তু বড় মা,গেটের কুকুরটা তো অনেক ছোট,বাচ্চা। পিউপুর শরীরের এত মাংস, ও খেতে পারবে?’
মুহুর্তে পিঠে দুম করে কিল বসালেন জবা। খ্যাক করে বললেন,
‘ তোর পড়া নেই? যা গিয়ে পড়তে বোস।’
রাদিফ ছলছলে চোখে পড়তে চলল। মুখটা খোলা একদম উচিত হয়নি এখন।
মিনা আর দাঁড়াননি। হনহনে কদমে ঘরে রওনা করেছেন। আমজাদ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কাল তাহলে একবার কলেজে গিয়ে প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলতে হবে। মেয়েটাকে ফাইনালে নেয় কীনা,কে জানে!
তারপর মনে করার ভঙি করে রুবায়দা কে বললেন,
‘ তোমার ছেলেকে বোলো,হামিদ ফাইল দিয়ে গিয়েছে। দেখে যেন কালকের মধ্যে দয়া করে জমে দেয়। নাহলে বাপ চাচার হাতে হারিকেন উঠবে।’
পিউয়ের হৃদপিণ্ড যখন দুর্ভাবনায় কাতর, সেই মুহুর্তে মাথায় একটি উষ্ণ হাতের স্পর্শ পায়। হস্ত-মালিকের পানে চোখ তুলে চাইল সে। ধূসর মোলায়েম স্বরে শুধায়,
‘ খেয়েছিস?’
সে মাথা নাড়ল দুপাশে। পুষ্প আগ বাড়িয়ে বলল,
‘ খাবে কী, মার খেয়েই কূল পেলোনা। বেচারী ঘরে চুপটি করে থেকেও রেহাই পায়নি, আম্মু হুলস্থুল বাধিয়ে ডেকে এনেই….। ‘
‘ ওর খাবারটা আমার ঘরে দিয়ে যা।’
পুষ্প ঘাড় কাত করল। সে সবার মধ্যেই পিউয়ের ছোট্ট-খাট্টো হাতখানা নিজের মুঠোয় নিয়ে সিড়িতে পা রাখল।
আমজাদও ঘরের দিক এগোলেন। যে যার কাজে চলল। শুধু দাঁড়িয়ে থাকল আফতাব।
তার অভিজ্ঞ,তীক্ষ্ণ চোখ আর নিবিষ্ট মনোযোগ দুটোই সিড়ির ওপর। যেখানে পিউকে স্বযত্নে সাথে নিয়ে চলে যাচ্ছে ধূসর।
পাশাপাশি আরো এক জোড়া আঁখি ব্যগ্র ভাবে দেখছিল ওদের। ওরা আড়াল হতেই লম্বা শ্বাসে ওঠানামা করল তার বুক। ভাবল,
‘ পিউ সুখী হোক!তাতে মানুষ টা সে না হয়ে হলোই বা অন্য কেউ।’
_____
পিউকে সোফায় বসিয়ে রেখে ধূসর গোসলে ঢুকেছে। মেয়েটা চিন্তায় হাত কচলাচ্ছে সমানে। মাথার রগ দপদপ করছে ওর। শেষ বার প্রিন্সিপাল স্যার ওকে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলেন। সাথে ম্যাম নালিশ ঠুকেছিল সে পড়াশুনা করেনা। এখন ওই ভিত্তিতে স্যার যদি ওকে ফাইনাল দিতে না দেন? কী হবে? একটা বছর তো যাবেই,সাথে আম্মুর গালমন্দ ফ্রি। বন্ধুবান্ধবকে-ই বা মুখ দেখাবে কী করে? ইয়া আল্লাহ! কী একটা ফালতু বিষয়ের জন্যে ওর পরীক্ষাটা বাজে হয়েছিল, মনে করলেই রা*গ হচ্ছে। এইজন্যেই বলে,সব সময় বেশি বোঝা ঠিক না।
এদিকে ধূসর ভাই এত ভালো ছাত্র! ওনার সুনাম সবার মুখে মুখে। তার বউ হবে কী না এক ফেল্টুস মেয়ে? ছি পিউ! তুই তো ওনার যোগ্যই নোস।
পিউয়ের কা*ন্না পেয়ে গেল। চোখে জল আসার আগেই পুষ্প খবার নিয়ে ঘরে ঢোকে। টেবিলে রেখে পিউয়ের দিক চায়। বোনের শুকিয়ে, এইটুকুন হয়ে যাওয়া মুখবিবর দেখে মায়া লাগে। কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘ এত ভাবিস না তো বোনু,ইনশাআল্লাহ সব ভালো হবে।’
পিউ কাতর চোখে তাকাল। হাতটা আকড়ে ধরে বলল,
‘ যদি আমাকে না নেয়?’
‘ নেবে,চিন্তা করিস না।’
ধূসর দীর্ঘ সময় ধরে ফ্রেশ হয়। আজ পিউকে বসিয়ে রেখে এসছে দেখে তাড়াতাড়ি বের হলো। ততক্ষণে পুষ্প চলে গিয়েছে। ট্রাউজার পড়নে, উদাম গায়ে বেরিয়েছে সে। মাথা মুছতে ব্যস্ত তার দিকে, একবার চোরা চোখে তাকাল পিউ। টেনেহিঁচড়ে আবার সরিয়ে আনল দৃষ্টি। বসে রইল চুপটি করে। ধূসর ভেজা তোয়ালে চেয়ারের হাতলে মেলে দিলো। গায়ে টিশার্ট জড়াল। তারপর এসে বসল ওর সামনে। যত্র গুটিয়ে গেল পিউ। এত মুখোমুখি কেউ বসে? এখন তো চোখের পলক ও গোনা যাবে। ধূসর এই দুরুত্বকেও বাধ সাধে। নিজের পাশ দেখিয়ে বলে,
‘ এখানে আয়।’
পিউ দ্বিধান্বিত নেত্রে চেয়ে আছে। কিছু বলছেনা,উঠে যাচ্ছেওনা দেখে ফের বলল,
‘ এখানে আসতে বলেছি। ‘
সে নড়ে উঠল। যেন হুশ ফিরেছে। তারপর গুটিগুটি পায়ে মুখোমুখি সোফাটা ছেড়ে ধূসরের পাশে গিয়ে বসল। ধূসর ভাতের প্লেট হাতে নিতেই চোখ বেরিয়ে আসে ওর। উনি কী এখন খাইয়ে দেবেন? ব্যাস!সমস্ত,ভয়-ডর,চিন্তা মেঘ ছাপিয়ে বর্ষার ন্যায় গলে এল পিউয়ের। মনে মনে মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায় লুটিয়ে পড়ল সে। মা মা*রলেন, সে কাঁদল বলেইত ধূসর ভাই খাইয়ে দেবেন। আর ওনার হাতে খাওয়ার জন্য সে ওমন একশটা মা*র খেতেও রাজি।
ধূসর ভাত মেখে ওর মুখের সামনে ধরল। হা করতে বলতেও হয়নি,ব্যস্ত ভাবে খেয়ে নিলো পিউ। তারপর ভাবাবেশে বুজে ফেলল চোখ৷
এতটা তৃপ্তি! এতটা স্বাদ বুঝি, মায়ের হাতের পর প্রিয় মানুষের হাতে খেলে পাওয়া যায়?’
ধূসরের অগাধ কণ্ঠ কানে এলে চোখ মেলল পিউ।
‘ নীচে যা বলে এলাম,মনে থাকবে? না কী আবার ভুলে যাবি?’
পিউ মাথা ঝাঁকিয়ে সুদৃঢ় কণ্ঠে বলল,
‘ সব মনে থাকবে।’
ধূসর কিছু বলল না। তার মনোযোগ ভাত মাখায়। পিউ এক ধ্যানে ওর শ্যামলা মুখটা দেখল। মানুষটার চেহারায় কী ক্লান্তি! দেখেই বোঝা যাচ্ছে আজ খুব ধকল গেছে ওনার ওপর! ইশ,এই অবস্থাতেও ওকে খাইয়ে দিচ্ছে? যত্ন নিচ্ছে? তাও সামান্য একটু মায়ের বকুনি খেয়েছে বলে? আর এই মানুষটার সাথেই মারিয়াকে জড়িয়ে কী বাজে চিন্তাটাই না করেছিল সে। পিউয়ের অনুশোচনায় হৃদয় দ*গ্ধ হয়। আকাশ ভে*ঙে কান্না পায়। এবার আর চেপে থাকল না,হুহু করে বেড়িয়ে এলো তারা। ধূসর তাজ্জব বনে তাকাল। হঠাৎ কান্নায়, উদগ্রীব কণ্ঠে শুধাল’ কী হলো?’
পিউ নাক টেনে বলল,
‘ আমি তখন মিথ্যে বলেছি ধূসর ভাই। ওইদিন আমার একটুও শরীর খারাপ ছিল না। আপনাকে আর মারিয়া আপুকে নিয়ে উল্টোপাল্টা ভাবায় আমার মাথা থেকে সব পড়া বেরিয়ে গেছিল। তাই কিছু লিখতে পারিনি। সত্যিই সব দোষ আমার!’
পিউয়ের গা ভা*ঙল কান্নায়। ধূসর প্লেট নামিয়ে ,বাম হাতে চোখ মুছিয়ে বলল,
‘ আমি কি এ নিয়ে কিছু বলেছি? ‘
পিউ কাঁদল,কিছু বললনা৷ সে নিজেই বলল,
‘ যা হয়ে গেছে,হয়ে গেছে। এসব আর ভাবিস না। সামনে পরীক্ষা, তাই নিয়ে ভাব।’
পিউ ধূসরের হাতটা মুঠোয় ধরে বলল,
‘ আমি এবার খুব মন দিয়ে পড়ব ধূসর ভাই। একটুও ফাঁকিবাজি করব না।’
ধূসরের পাতলা ঠোঁট বেঁকে গেল। বলল,
‘ আমি জানি। এবার কান্না থামা।’
বলতে বলতে সে নিজেই হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে ওর ভেজা গাল মোছাল। অথচ তার শ্রান্তিতে বুজে আসছে চোখ। ঘুম পাচ্ছে রাজ্যের।
খাওয়া শেষে পিউয়ের মুখটা মুছিয়ে দিয়ে বলল,
‘ যা।’
পিউয়ের উশখুশ শুরু হলো ওমনি। সময় নিয়ে আবদার ছু*ড়ল
‘ আপনার কাছে একটু থাকি?’
ধূসর এমন ভাবে তাকাল,যেন এক্ষুনি তীর বসিয়ে দেবে বুকে। লজ্জায় হাঁস-ফাঁস করে উঠল পিউ। এমন নেশাল চোখে কেউ চায়? আই-ঢাই করে এলো-মেলো ভাবে এদিক সেদিক পলক ফেলল সে। ধূসর হাসল,সোজাসুজি বলল,
‘ আমার কাছে বেশিক্ষণ থাকা, এখন তোর জন্য বিপজ্জনক!’
পিউ কথার ইঙ্গিত বুঝতে না পেরে বোকার মত তাকাল। নিষ্পাপ স্বরে বিরোধিতা জানিয়ে বলল,
‘ মোটেইনা। আমি জানি,আব্বু -আম্মুর মত আপনার কাছেও আমি সবচাইতে নিরাপদ। ‘
ধূসর খুব জোরে হেসে ফেলল। পেশী বহুল দুহাত বিছিয়ে দিলো সোফায়। বলল,
‘ তুই এমন বোকাই থাকিস পিউ। ‘
পিউ ভ্রু গোঁটায়। সে কী হাসার কিছু বলেছে? আবার বোকা বলল কেন? মাথা খাটানোর আগেই ধূসরের গরম,নরম ওষ্ঠযূগল ছুটে এসে চুঁমু বসাল তার গালে। পিউ চমকে উঠল। আচমকা ছোঁয়ায় ক্ষুদ্র দেহ ঝাঁকুনি দিল । ধূসর কপালে ভাঁজ ফেলল সহসা,প্রকাশ করল বিরক্তি। পিউ মাথা নামিয়ে নিলো। সংকীর্ণ মুখমন্ডলে, নীভু,অসহায় কণ্ঠে বলল,
‘আমার কী দোষ? আপনি তো এর আগে এভাবে চুঁমু খাননি ধূসর ভাই। তাই হঠাৎ হঠাৎ কাছে এলে আমার কাঁপুনি ওঠে।’
তারপর চোরা চোখে দেখতে চাইল ওর অভিব্যক্তি।
ধূসরের ডান ভ্রু উঠে এলো উঁচুতে। জানতে চাইল,
‘ এখন তোর কাঁপুনি কমাতে ,সকাল-বিকাল আমাকে চুঁমু খেতে বলছিস?’
চলবে,