এক সমুদ্র প্রেম পর্ব-৪৯+৫০

0
1794

#এক_সমুদ্র_প্রেম!
কলমে : নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(৪৯)

সাদিফ অফিসে ঢুকল। মুখের অবস্থা একদম ভালো না! মন তো আরও বেশি খা*রাপ। গেট দিয়ে তাকে আসতে দেখেই মারিয়া শশব্যস্ত হয়ে ঘুরে বসল সামনে। এই যে, এতটা সময়, সে চাতকের মত চেয়েছিল,লোকটা কখন আসবে! কিছুতেই বুঝতে দেবে না ওসব। মারিয়া কম্পিউটার স্ক্রিনে ব্যস্ততা দেখায় । সাদিফকে গেলে তার পাশ কা*টাতে হবে। সেই সময় আড়চোখে একবার দেখে নেবে বরং। জুতোর শব্দ যত কাছে আসে,মেয়েটার হৃদকম্পন বাড়ে। শ্বাস-প্রশ্বাস জোড়াল হয়। আচমকা থেমে যায় সেই শব্দ৷ সাদিফ কেও যেতে দেখা গেল না। মারিয়া সামনের দিক ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ। এইত পরিষ্কার ঢুকতে দেখেছে,তাহলে যাচ্ছেন না কেন?
শেষে অধৈর্য হয়ে পেছন ফিরল সে। ওমনি টানটান হয়ে এলো মেরুদণ্ড। সাদিফ তার কাছেই দাঁড়িয়ে। চোখের ভাষা তীক্ষ্ণ। হঠাৎ এইভাবে দেখায় ভ্যাবাচেকা খেল মেয়েটা। আশেপাশে চোরা,ভীত চোখে দেখে আবার চাইল।
‘ আপনাকে বলা হয়েছিল আমার সাথে আসবেন,এলেন না যে!’

সরাসরি প্রশ্নে খানিক বিভ্রান্ত হলো মারিয়া। কী উত্তর দেবে এখন? আপনার থেকে পালানোর জন্যে,মেলামেশা কমানোর জন্য এরকম করেছি? এটা তো কস্মিনকালেও বলা যায় না। চুপ করে থাকল তাই। সাদিফ আরেকটু এগিয়ে ডেস্ক ঘেঁষে দাঁড়ায়। অফিস তখনও শুরু হয়নি বলে, লোকজন তেমন আসেনি। ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘ ভাব নিচ্ছেন ম্যালেরিয়া? সিকদার সাদিফ হাসানের সাথে ভাব নিচ্ছেন আপনি? ‘

‘ না না আমিতো…’
সাদিফ কথা কেড়ে,শান্ত গলায় বলল,
‘ চুপ করুন! কোনও কথা শুনতে চাইনা আপনার।’

তারপর গজগজ করে চলে গেল নিজের কেবিনে। মারিয়া হা করে চেয়ে রইল। নিজেই কথা বলতে এসে,নিজেই চোটপাট দেখাল? না কি,অন্য কারোর রাগ তার ওপর ঝেড়ে দিয়ে গেল?
____

পিউ ঘুমের মধ্যে কোলবালিশ খানা আরেকটু নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে। তুলতুলে বিছানায় তার ঘুম জমে উঠেছে। চোখ খুলতেই ইচ্ছে করছে না। এত নরম বিছানাও হয়? কী তুলো দিয়ে বানায় এরা?
সহসা দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো। কেউ একজন শক্ত হাতে টোকা দিচ্ছে। পিউয়ের ঘুম ছুটে যায়। নিভু নিভু চোখ মেলে তাকায়। বৃহৎ অক্ষিপট ঘরের চারদেয়াল দেখতেই কোটর ছাড়িয়ে আসে বিস্ময়ে। তড়াক করে উঠে বসল ওমনি। বিছানা,বালিশ,বেডশিট,ফার্নিচার সবই তো অচেনা। দেয়ালে টাঙানো ওর ছবিগুলোও নেই। এটাত ওর ঘর নয়,এটা কোন জায়গা? কোথায় এসে পরল?
তখন বাইরে থেকে ইকবালের কণ্ঠ শোনা গেল,

‘ পিউপিউ! এই পিউপিউ! উঠেছো তুমি?’
পরিচিত আওয়াজে, পিউয়ের ভ*য়টা কমল। তবে বিস্মিত সে। যতটা মনে আছে প্লেনে ছিল। ধূসর ভাইয়ের বুকে মাথা রাখল,তারপর কিছু মনে নেই। ওরা কি কক্সবাজার পৌঁছে গিয়েছে? এত তাড়াতাড়ি? পিউ ত্রস্ত বিছানা থেকে নেমে দরজা টেনে খোলে। চাপানোই ছিল,তাও ইকবাল ঢোকেনি। খোলা দরজাতেই ধা*ক্কাচ্ছিল এতক্ষণ। ভেতরে একটা জোয়ান মেয়ে কীভাবে না কীভাবে ঘুমিয়েছে!

পিউকে দেখতেই ইকবালের দাঁত কপাটি বেরিয়ে এলো বাইরে। বলল,
‘ উঠে পরেছো?’
পিউ মাথা দোলাল। সে বলল,
‘ আচ্ছা,রেডি হয়ে নাও। বের হব আমরা।’
‘ কোথায় যাব?’
‘ বিচে যাবে না? খাবে না?’
পিউ চোখ বড় করে শুধাল, ‘ আমরা কি এখন কক্সবাজারে?’
‘ জি ম্যাডাম। টের পাননি কিছু? ‘
পিউ অসহায় বনে মাথা নাড়ল দুদিকে। ইকবাল হতাশ কণ্ঠে বলল,
‘ সত্যি বাবা,মেয়ে মানুষের ঘুম এরকম হয় আমার জানা ছিল না। প্লেন থেকে গাড়িতে উঠলে,হোটেলে এলে,রুমে শোয়ানো হলো,কিছুই টের পাওনি? হ্যাড সফট টু ইওর ঘুম পিউ।’

পিউ ঠোঁট উলটে বলল, ‘ আমার ঘুম এরকমই। তাছাড়া রাতে ঘুমাইনি তো তাই সব মিলিয়ে… ‘
ইকবাল দুষ্টু হেসে বলল,
‘ কেন? ধূসরের সাথে ঘুরবে বলে, এক্সাইটমেন্টে বুঝি ঘুম হয়নি?’
পিউ মাথা নামিয়ে হাসল। তারপর আবার চোখ তুলে সচকিত কণ্ঠে বলল,
‘ কিন্তু আমাকে এখানে আনল কে? ঘুমানো অবস্থায় হেঁটে হেঁটে এসেছি?’

‘ এ্যাহ? ঘুমানো মানুষ আবার হাঁটে কীভাবে? তোমাকে তো ধূসর নিয়ে এসেছে। এইভাবে কোলে করে। ‘

পেটের কাছে দুহাত বেধে সদ্য জন্মানো শিশু কোলে নেয়ার ভঙিমা করে দেখাল ইকবাল। পিউ লজ্জা পেলো,তবে অবাক কণ্ঠে বলল,
‘ এতবার কোলে নিয়েছেন? ক*ষ্ট হয়নি ওনার? আমাকে ডেকে দিলেইতো পারতেন।’
ইকবাল লম্বা শ্বাস ফেলল,
‘ কষ্ট হয়েছে কী না জানিনা। তোমার যা ওজন, একটা আঙুলের টোকা দিলেই তো পরে যাবে। ‘
পিউ মুখ ব্যাকায়। সে মোটেই অত শুকনো নয়। ইকবাল আবার বলল,
‘ ডাকতে চেয়েছিল পুষ্প,ধূসর দেয়নি। বলেছে, ঘুমাচ্ছে যখন ঘুমাক। এত প্রেম নেয়া যায় বলো তো!’

পিউ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়। ধূসর ভাই এত করেছেন ওর জন্যে? রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয় ভেতরে। লাজুক লাজুক হেসে ঘাড় চুলকায়।
ইকবাল হাসল, তাড়া দিয়ে বলল,
‘ অনেক কথা বলেছি,এবার তৈরী হও যাও,কুইক।’

বলে যেতে নিলেই পিউ শুধাল, ‘ আপু কোথায়?’
‘ শাড়ি পরছে। ওইজন্যেইত আমাকে ডাকতে পাঠাল।’

পিউ উশখুশ করল। উশখুশ করল তার অধরজোড়া। ইকবাল বুঝতে পেরে, বলল,
‘ তোমার মহারাজ ও আছেন। রেডি হয়ে বের হও,সবাইকে দেখবে। ‘
পিউ মুচকি হাসল। মাথা কাত করল এক পাশে। ইকবাল যেতেই দরজা লাগিয়ে পিঠ ঠেকাল সেখানে। ধূসরের কোলে ঘুমন্ত নিজেকে কল্পনা করল একবার। আনমনে মানস্পটে সেই দৃশ্য ভাসল। এতটা সময় অত কাছাকাছি ছিল ওরা? ওর মাথাটা কি ওনার বুকের মধ্যেই রেখেছিলেন? ইশ! জেগে থাকলে কত ভালো হোতো!
সব ভেবে পিউ ঠোঁট কাম*ড়ে কুণ্ঠিত হাসে। তারপর লজ্জায় হাঁস*ফাঁস করে মুখ ঢেকে নেয় দুহাতে।
_____

পিউ গাঢ় নীল সালোয়ার -কামিজ পড়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলো কেবল। ওড়না পেতে রাখা বিছানার ওপর। আয়নার সামনে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়াল গিয়ে। জামার পেছন দিকে চেইন। কনুই ভাঁজ করে, ঘাড় বাকিয়ে, আয়না দেখে দেখে চেইন টানাটানি শুরু করল পরপর।

ধূসর হাতের চকচকে ঘড়ির হূক লাগাতে লাগাতে পিউয়ের দরজার সামনে এলো। সবাই রেডি,ইনি এখনও বের হতে পারেনি। এত কী সাজে?
একবার তাকাল,পিউয়ের মুখোমুখি পুষ্পদের বন্ধ দরজার দিকে। মোট চারটে ঘর নিয়েছে ওরা। তার রুমটা ঠিক পুষ্পদের পাশেই। ধূসর ভেজানো দরজা ঠেলে দিতেই হা করে খুলল সেটা। বেখেয়ালে বলল,
‘ পিউ,তৈ…’

বলতে বলতে সামনে তাকাতেই কথা আটকে গেল তার। ভরাট,নিরেট পুরুষালী স্বর আকষ্মিক কানে এলে পিউয়ের বুক ছ্যাত করে ওঠে। হকচকিয়ে ফিরে তাকায়। বুকে ওড়না নেই। আয়নার প্রতিবিম্বে ফর্সা, হা করা খোলা পিঠ স্পষ্ট দেখতে পেল ধূসর। হতভম্ব হয়ে গেল ঘটনাচক্রে। চটজলদি চোখ ফিরিয়ে ঘুরে তাকাল আরেকদিক। পিউ হুশ ফিরতেই বিছানা থেকে ওড়না ছো মেরে এনে গায়ে জড়াল। ধূসর অস্বস্তিতে কী করবে বুঝে উঠল না। মুখের কাছে হাত এনে কাশলো। কয়েকবার গলা খাকাড়ি দিলো। ঘুরে থেকেই ব্যস্ত ভঙিতে বলল,
‘ তাড়াতাড়ি আয়।’
পরপর দ্রুত পায়ে প্রস্থান নিলো সে। যেন পালাল একরকম। পিউ লজ্জা পেয়েছে শতগুন বেশি৷ ইকবাল ভাই যাওয়ার পর দরজা চাপিয়ে দিয়েছিল,কেন যে আটকালো না! এইভাবে দেখে ফেললেন উনি!
____

পেছনে বিশালাকার পাঁচ তারকা হোটেল। সামনে শাণিত সৌন্দর্যের অধিকারী সুমদ্র -সৈকত। তীব্র গ*র্জন তুলে একেকটা ঢেউ এসে হুমড়ি খাচ্ছে তীরের ওপর। বালুর চড়ে বাধা,ট্রলার,স্পিডবোট দুলে দুলে উঠছে তাতে।
ধূসররা একটা নামিদামি হোটেলে উঠেছে। এখানকার নিজস্ব বীচ আছে। একটা বড় অংশ জুড়ে সীমারেখা দেয়া। শুধুমাত্র যারাই রুম বুক করেছেন এখানে,তারাই ঘুরবেন। বাইরের কারো,আসা যাওয়া নিষেধ। অথচ পুষ্প এখানে ঘুরবে না। বীচের পাড়ে এসে এমন নিরিবিলি পরিবেশ একদমই ভালো লাগছে না তার। খাবারের কোনও ভ্যানও তো নেই। সাগর দেখতে দেখতে যে এক কাপ চা খাবে,তাও তো হবে না।
সে বায়না ধরল পাব্লিক বীচে যাওয়ার। ধূসর আপত্তি করেনি। হানিমুন যেহেতু ওদের,আসার উদ্দেশ্যও ওরা,সবটা ওদের মর্জিতেই হোক।
একটা উবার নিয়ে তারা পাব্লিক বীচের প্রথম গেটে এলো। লোক সমাগমে পা রাখা যায়না এখানে। পিউয়ের চোখ কপাল ছোঁয়। এত মানুষ সমুদ্র দেখতে আসে বুঝি!

পুষ্প একটা লাল জর্জেটের শাড়ি পরেছে। বীচে পা রাখতেই হাওয়ায় আঁচল উড়ছে এদিক -ওদিক। এর মধ্যে আচমকা ইকবাল খোঁপা করা চুল গুলো খুলে দিলো। পুষ্প তাকাতেই চাপা কণ্ঠে গান ধরল,
‘ কইন্যা রে কইন্যা রে,
বাঁকা চুলতে খোঁপা আর বাইধো না রে।
ঐ চুলেতে জাদু আছে,আমার ঘুম আসে না রে।’

পুষ্প খিলখিল করে হেসে উঠল। পিউ গান শুনে পেছনে তাকিয়ে মুচকি হেসে আবার সামনে ফেরে। সম্মোহিত নেত্রে চেয়ে দ্যাখে তার সম্মুখে, ফোন কানে গুঁজে হাঁটতে থাকা দীর্ঘদেহী পুরুষটিকে৷ এত ব্যস্ত সে,পেছনে তার দিকে খেয়ালই নেই।

পুষ্প স্বলজ্জে ইকবালের বাহুতে ঘুষি বসিয়ে বলল,
‘ তুমি একটা যা তা ইকবাল।’
তার রক্তিম দুটো গাল দেখে, বরাবরের মতো বিমুগ্ধ হয় ইকবাল। ডান বাহুতে জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে। বালুর ওপর ফেলে আসা, পুষ্পর ফর্সা কদমের দিক চেয়ে বলে,
‘ মাই লাভ,জুতোটা পরে আসলে পারতে। বালুর মধ্যে অনেক শামুক থাকে,পা -টা কে*টে গেলে কী হবে!’
‘ কেন? কোলে নিয়ে হাঁটবে। পারবে না?’
‘ আমি পারব। কিন্তু কে যেন বড় ভাইয়ের সামনে লজ্জা পায়?’

পুষ্প বলল, ‘ তাও ঠিক।’

এরপর তাকাল সামনে। ধূসর সবার প্রথমে হাঁটছে,মাঝে পিউ আর পেছনে ওরা। ধূসরের কদমের সাথে পাল্লা দিতে এক প্রকার ছুটছে মেয়েটা। পুষ্প ওর দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল,

‘ পিউ ভাইয়ার সাথে সাথে হাঁটার জন্য কীভাবে হাঁটছে দ্যাখো। এই পিউ পরে যাবি,আস্তে হাঁট।’

পিউ শুনলেও, মানল না। সে থামতে চায়,কিন্তু পদযুগল ছুটছে। ইকবাল বড় দুঃখ প্রকাশ করে বলল,
‘ সত্যি,এই পিউপিউয়ের জন্য ভীষণ মায়া হয় আমার। ধূসরটা আস্ত একটা বজ্জাত! এত ভালোবাসিস,প্রকাশ করলে কী হয়?’

পুষ্প মৃদূ হেসে বলল,
‘ কিছু ভালোবাসা অপ্রকাশিতই সুন্দর! ‘

ইকবাল পাশ ফিরে দেখল এক ভদ্রলোক ডাব নিয়ে বসেছেন। পুষ্পকে শুধাল, ‘ ডাব খাবে?’
‘ যেই গরম! চলো খাই।
ইকবাল হাত উঁচিয়ে পিউকে ডাকতে গেলে বলল,
‘ ও ডাব খায়না।’
ইকবাল অবাক হয়ে বলল,
‘ সে কী? ডাব খায়না এমন মানুষ হয়?’
‘ হ্যাঁ, এই যে আমার বোন। ওর কাছে ডাবের পানি স্যালাইনের মত লাগে। আম্মুর বকাবকিতে একবার জন্ডিসের সময় খেয়েছিল,ওই শেষ। ছোঁয়ও না।’
ইকবাল হাসল। বলল,
‘ আচ্ছা চলো,তোমাকে কিনে দেই।’

–—-
পিউ ক্লান্ত হয়ে থামল। নাহ! এই জীবনে হয়ত ধূসর ভাইয়ের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটা হবে না। ওমন হাতির মত কদম ফেললে,তার মত পিপড়ের পোষায়? পিউ মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল। ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিলো। ধূসরের সব মনোযোগ ফোনে। কী এত বলে? কার সাথেই বা বলে?

পিউ পেছনে তাকায়। পুষ্প আর ইকবাল কে ডাবের ভ্যানের সামনে দেখে নাক-চোখ কোঁচকায়। এই স্যালাইন পানি খেতে এত দূর আসার কী আছে?
এরপর চোখ রাখল ডানপাশে। বিশাল সমুদ্র সেথায়! তবে অতটা তেঁজ নেই ঢেউয়ে। ছোট ছোট আকারে আছ*ড়ে আসছে কূলে। পিউয়ের ওষ্ঠপুট মুহুর্তে ভর্তি হলো দ্যুতিময় হাস্যে। বিকেলের নরম রোদের আলোয় সেই হাসি বড় মায়াময় দেখাল। চুল কানে গুঁজে সালোয়ার হাল্কা ওপরে তুলে স্লিপার জোড়া খুলে রাখল পাশে। গুটিগুটি পায়ে পানির দিকে এগোতে গেলেই পেছন থেকে ওড়নার মাথা টেনে ধরল কেউ। পিউ থমকাল। বিদ্যুৎ বেগে ফিরে চাইল পেছনে।
ধূসর ফোন পকেটে ভরতে ভরতে শুধাল,
‘কোথায় যাচ্ছিলি?’

‘ একটু পা ভেজাতাম।’
ধূসর ভ্রু উচায়,
‘ একা একা? ‘
পিউ বুঝল এখন ধমক খাবে। মুখ কালো করে বলল,
‘ তো কী করব? আমার কি দোকলা আছে? আপু ভাইয়ার সাথে ব্যস্ত। আপনি ব্যস্ত ফোনে। আমি ছোট মানুষটা এতিমের মত ঘুরছি।’
বলতে বলতে তার চেহারায় লেপ্টে আসে দুঃখ,হতাশা। ধূসর তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে থাকল। আলগোছে হাসল,পিউ তাকাতেই গম্ভীর করে ফেলল চেহারা। ওড়নার মাথায় টান বসাতেই পিউ হো*চট খাওয়ার মত কাছে এসে পরল। ধূসর সঙ্গে সঙ্গে কাঁধ পেচিয়ে পা বাড়িয়ে বলল,
‘ চল।’
পিউ খুশিতে আটখানা হয়ে শুধাল,
‘ কোথায় যাব আমরা?’
ধূসরের নিরুদ্বেগ জবাব,
‘ বেঁচে দেব তোকে।’
পিউ হেসে ফেলল। সুদৃঢ় কণ্ঠে বলল,
‘ স্বয়ং ফেরেস্তা এসে বললেও বিশ্বাস করব না।’
ধূসর অদ্ভূত চোখে চায়। দৃষ্টির গভীরতা ঠাওড় করা কঠিন। হবেইত,প্রহেলিকা যে! অথচ পাতলা ঠোঁট দ্বয় বেকে যায় একদিকে। ফের ভ্রু নাঁচিয়ে বলে,
‘ এত বিশ্বাস?’
পিউ কোনও রকম রা*গ- ঢাক রাখল না। হৃদয়ের অলিন্দে লুকোনো কথাটুকু উগড়ে দিতে বলল,
‘ নিজের থেকেও বেশি।’

ধূসরের পা থামে। স্থিত হয় হাঁটা। তার পিঠে রাখা অনমনীয় হাতটা আরেকটু দৃঢ় হলো। অবিচল হলো অগাধ লোঁচনের চাউনী। যেন কত কী বলবে,কত কী শোনাবে!

এর মধ্যে ছুটতে ছুটতে চঞ্চল পায়ে হাজির হলো পুষ্প। ওকে দেখেই ঝটপট হাত নামিয়ে নিলো ধূসর। গুঁজল পকেটে। সে এসেই আবদার করল,
‘ ভাইয়া চলুন ট্রলারে ঘুরি! সবাই ঘুরছে।’

ইশারা করা আঙুল অনুসরণ করে তাকাল ধূসর। ছয় সাতজন বসার মত ট্রলার তীরের সাথে সাড়ি বেধে লাগানো। বেশ রঙচঙে। অনেকেই ঘুরছে, ঢেউয়ের প্রকোপে ওঠানামা করছে আবার।
সে চোখ ফেরত এনে বলল,’ না। দরকার নেই।’

পুষ্পর হাসিটা নিমিষে মুছে যায়। পিউ নিষ্পাপ কণ্ঠে বলল,
‘ কেন? কী হবে চড়লে? সবাইত চড়ছে।’
ধূসর চোখা নেত্রে তাকায়,
‘ সবাই যা করবে, তুইও তাই করবি?’
‘ না,তা কখন বলেছি। কিন্তু চড়লে ভালো হতো।’
‘ সাতার জানিস? ‘

পিউ চুপসে এলো। দুদিকে আস্তেধীরে মাথা নাড়ল। পুষ্পও চুপ,সেও জানেনা। ইকবাল বুক ফুলিয়ে, গর্বের সহিত জানাল,
‘ আমি কিন্তু জানি। ‘

‘ তো? দুটো একসাথে সমুদ্রে পড়লে, একা তুলতে পারবি?’
ইকবাল অবাক কণ্ঠে বলল,
‘ একা তুলব কেন? তুইত আছিস। তোরটাকে তুই তুলবি,আমারটা কে আমি।’

ধূসর চোখ রাঙাতেই, থতমত খেয়ে বলল,
‘ না মানে,একটা তোর বোন,একটা আমার বোন,একটা আমার বউ,একটা তোর ব…..’

বেফাঁস কথা বলে ফেলছে বুঝে থামল নিজেই। ধূসর দাঁত চে*পে চেয়ে আছে। যেন এক্ষুনি নাক ফাঁ*টাবে। ইকবাল আমতা আমতা করে ওপরের দিক চেয়ে বলল,
‘ আকাশে একটাও তারা নেই কেন?’
পুষ্প ঠোঁট চেপে হাসছিল। উত্তরে বলল,
‘ দিনের বেলায় তারা, তোমার কপালে আছে।’

পিউ গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে। লজ্জা পেয়েছে। সবার কথা থামতেই মিনমিন করে বলল,
‘ চলুন না ধূসর ভাই। একটু উঠলে কী হয়?’
পুষ্প বলল, ‘ হ্যা ভাইয়া প্লিজ! একবার।’
ইকবাল ও তাল মেলাল,
‘ চল না ভাই। একদিনই তো। তাছাড়া ঢেউও নেই তেমন। সমুদ্র তো শান্ত। ‘

এত জনের অনুরোধে শেষ-মেষ হার মানল ধূসর। শ্বাস ফেলে বলল,
‘ ওকে।’

সবার আগে ইকবাল উঠল। তারপর পুষ্প। তার মধ্যে বিন্দুমাত্র ভ*য়ডর দেখা যাচ্ছে না। একা একাই উঠেছে। এরপর ধূসর। ট্রলার ঢেউয়ের তোপে তখন থেকেই অল্প অল্প নড়ছে। সে উঠেই হাত পাতল পিউয়ের দিকে। বলল,
‘ আয়।’
পিউয়ের বক্ষ জুড়ে ভালো লাগার তরঙ্গ। কম্পিত হাতখানা বাড়িয়ে দিতেই আকড়ে নিলো ধূসর। পুষ্প কাঠের ওপর বসে দুষ্টুমি করে বলল,
‘ আমাকে তো এভাবে ওঠালেন না ভাইয়া।’
ইকবাল তার পাশে বসে বলল,
‘ তোমার জন্যেত আমি আছি মাই লাভ।’

একটা মাঝারি সাইজের ট্রলার ভাড়া নিয়েছে ওরা। চালক,হেল্পার আর ওরা চারজন। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে ট্রলার পৌঁছাতেই পিউ ভয়ে নড়েচড়ে বসল। কাঠ আর লোহার তৈরি ট্রলারের কোন জায়গায় আকড়ে বসবে?মনে হচ্ছে, এই এক্ষুনি পরে যাবে। এত ভ*য় লাগছে কেন? আপুত দিব্যি বসে আছে। ধূসর ভাই,ইকবাল ভাই কী টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে! তুই এত ভীতু কেন পিউ? পিউ মিথ্যে মিথ্যে সাহসী বানাল নিজেকে। বাতাসে উড়ে যেতে চাওয়া ওড়না কোলের মধ্যে আগলে সমুদ্রের জলের দিক চাইল। কী স্রোত! এর ভেতর পরে গেলে ইন্না-লিল্লাহ কনফার্ম। বিয়ে শাদী, বাচ্চা- গাচ্চার স্বপ্ন সব এই জলেতেই শেষ। পিউ পানির দিক চেয়ে ঢোক গিলছে বারবার। প্লেনের কথা মনে করে আফসোস হলো। ওভাবে যদি আরেকবার ধূসর ভাই বুকের মধ্যে নিতেন! এখন ভয়ের ‘ভ’ উচ্চারণ করলেও ঠেলে ফেলে দেবেন। সে নিজেওতো বায়না করেছিল তাল মিলিয়ে।

পিউ নিঃসহায়ের মত বসে থাকল। তার ভীত চোখদুটো সমুদ্রের জলে। হঠাৎ টের পেলো পাশে কেউ বসেছে। ফিরে তাকাল ওমনি। ধূসরকে দেখে মিইয়ে এলো আরও। আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাল ভ*য়টুকু ঢেকে রাখতে। ধূসর ভাই কোনও ভাবে বুঝলেই ধমকাবেন,নাহলে ত্যারা কথা ফ্রি।

লুকিয়ে রাখার সমস্ত,সুন্দর চেষ্টায় বিফল হলো তাও। ধূসরের বুঝতে বিলম্ব হয়নি। তার শঙ্কিত মুখস্রী পানে এক পল চেয়ে, কাঠ খা*মচে ধরা হাতের দিক দেখল। কোনও কথাবার্তা ছাড়াই সেই হাতটা উঠিয়ে আনল মুঠোতে। পিউ চকিতে চোখ তোলে। ভয় টয় নিমিষে সমাপ্ত। উলটে মুখমণ্ডল ঘেঁষে এলো উজ্জলতায়। ধূসর হাত ধরে রেখেই ওর দিকে এগিয়ে বসল। একদম গা ঘেঁষে। পিউ চেয়ে থাকতে পারে না। মাথা নামায়,নিঃশব্দে মোহিত হাসে।

পুষ্প ট্রলারের শেষ মাথায় গিয়ে বসতেই বুক কেঁ*পে উঠল ইকবালের। ওখান থেকে পড়লে তার বউ শেষ! আর্ত*নাদ করে বলল,
‘ মাই লাভ, ওতো মাথায় যেওনা। পড়ে যাবে।’
পুষ্প সে কথায় কান দেয় না। একটু ঝুঁকে ট্রলারের গা ঘেঁষে ছল্কে ওঠে পানি ধরতে যায়। ইকবালের কলিজা ছলাৎ করে উঠল। সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে গেল জলদি। ব্যস্ত হাতে ওকে টেনে সোজা করে বলল,
‘ এরকম করছো কেন? সমুদ্রে শার্ক আছে জানোনা? হাত কাম*ড়ে ধরলে?’
তার মুখবিবরের উদ্বীগ্ন ছাপটুকু স্পষ্ট দেখে মুচকি হাসল পুষ্প। বলল না কিছু। ভেজা হাত আঁচলে মুছে বসে রইল। ইকবাল দম ফেলল। স্ত্রীর হাত মুঠোয় রেখে, পাশে বসে ঘাম মুছল কপালের। বুকটা কাঁ*পছে এখনও।

পিউয়ের হৃদয় জুড়িয়ে যায় ওদের ভালোবাসা দেখে। ইকবাল ভাইয়ের কী অমোঘ টান তার বোনের প্রতি! এত ভালোবাসা, এত সুখ,এতটা তৃপ্তি সাদিফ ভাই কখনও আপুকে দিতেই পারতেন না হয়ত। আল্লাহ যা করেন,ভালোর জন্যই। পিউ ঠোঁটে হাসি রেখে মুক্ত, শান্তির শ্বাস নিয়ে পাশ ফিরে ধূসরের দিক তাকায়। সে এদিকেই চেয়েছিল। পিউ তাকাতেই অবিলম্বে দৃষ্টি ফিরিয়ে ফোনের ওপর রাখল। পিউ বুঝে গেল বরাবরের ন্যায়।
মাথায় চড়ল দুষ্টুমি। বলল,
‘ আচ্ছা, ধূসর ভাই,এখন যদি আমাকে একটা শার্ক টেনে নেয়,কী হবে?’
ধূসরের নিরুৎসাহিত উত্তর,
‘ কিছু না।’
পিউ বিস্ময়াহত হয়ে বলল, ‘ খেয়ে ফেলবে তো। আপনার ক*ষ্ট হবে না?’
তার গম্ভীর জবাব, ‘ না। ক*ষ্ট হওয়ার কী আছে?’

পিউয়ের হাসি হাসি ভাব,চেহারার ভাঁজে লুকানো দুষ্টুমি হুরহুর করে তৎক্ষনাৎ পালায়। কোথায় ভাবল,ধূসর ভাই বকবেন,ক*ষ্ট পাবেন। সিনেমার মত মুখ চে*পে ধরে খুব মায়া করে বলবেন,
‘খবর-দার পিউ! এসব অলুক্ষনে কথা একদম বলবিনা। ‘
অথচ তার কিছুই এসে যায়না? পিউ চূড়ান্ত আ*হত হলো। মনে মনে চাইল,সত্যিই একটা শার্ক আসুক। তাকে গি*লে খাক।
তখন ইকবাল উল্টোদিক থেকে একটু উচু কণ্ঠে বলল
‘ আরে পিউ, তুমি ওর কথায় কান দিওনা। আমি বলছি শোনো,তোমাকে শার্ক টেনে নিলে,ধূসর পেটের মধ্যে গিয়ে, ঢিশুম ঢিশুম করে তোমায় বের করে আনবে, বুঝলে?

পুষ্প হু হা করে হেসে উঠল শুনে। কিন্তু পিউ হাসলো না। তার মনটাই খা*রাপ হয়ে গিয়েছে। শুধু বিড়বিড় করে আওড়াল,’ আনরোমান্টিক!’
____

মারিয়া তিঁতিবিরক্ত। অফিসের বসটাকে যদি কয়েকটা লা*থি,ঘু**ষি দিতে পারত,মনঃপুত হতো তার। এতগুলো মেয়ে কাজ করে এখানে,অথচ লোকটার হুশ -জ্ঞান নেই? এমন রাত করে কেউ মিটিং ডাকে? ছুটি দেয়? মেয়েগুলো বাড়ি যাবে কী করে ভাবলো না? রাস্তার পাড়ে ফেলে রাখা টুকরো টুকরো ইট গুলো দেখে ইচ্ছে হলো ভদ্রলোকের মাথায় মা*রার। এমনিতেই নয়টার পর বাসে সিট পাওয়া যায় না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া একটা মেয়ের পক্ষে কতটা ভোগান্তির সেই জানে! তার মধ্যে ভদ্র লোকের মুখোশ পরা, গায়ে হাত দিতে পঁটু লোক গুলো তো আছেই। বাসে উঠতেই মন চায়না মাঝে মাঝে। সেখানে দশটা পার হয়েছে ঘড়িতে। কী করে যাবে সে? এই হুটহাট মিটিং ডাকার নিয়ম আগে জানলে চাকরিই নিতোনা। না খেয়ে রইলেও না। মারিয়া মনে মনে মুখ ঝামটা দিতে দিতে স্টেশনের দিক হাঁটে। রাস্তায় দু একজন লোক ছাড়া কেউ নেই। গাড়ি চললেও সব হুশ হুশ করে উড়ে যাচ্ছে পলকে। এই মুহুর্তে সাদিফ আর তার বাইক টাকে প্রচন্ড মিস করল সে। এই জন্য বলে,আ*গুন আর বরফ একসাথে হতে নেই। সাদিফের দুদিনের সঙ্গ যে তার মনটা টুপ করে নিয়ে যাবে,জানলে ও-মুখো হতোই না। মারিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হাসলো নিজের ওপর বিদ্রুপ করে।
‘সত্যি,শেষে এমন একজন কে মন দিলি মারিয়া,যার মনে অন্য কেউ। ‘

সে হাঁটার মধ্যেই আচমকা পেছনে ক’জোড়া পায়ের শব্দ আসে। যেন অনেকে হাঁটছে। মারিয়া সতর্ক চোখে ঘুরে চাইল। সেদিনের সেই ছেলে তিনটিকে দেখেই ঝুলে গেল চোয়াল। ওরা কী ফলো করছে ওকে? মারিয়া হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো তাৎক্ষণিক। । পায়ের শব্দও বাড়ল ওমনি। মানে, ওরাও জোরে হাঁটছে?
মারিয়া ঘামতে থাকে বুঝতেই। কাঁ*পছে তার হাত পা। বাতাসের গতিতে হাঁটছিল যখনই,আচমকা ছেলে তিনটে পথরোধ করে দাঁড়াল ওর।
মেয়েটার হৃদপিণ্ড থমকে গেল সেখানেই। ওদের শরীর থেকে মদ আর সিগারেটের মিশ্র গন্ধে গুলিয়ে এলো গা। একজন বলল,
‘ এই মেয়ে,এত দেমাগ কীসের হ্যাঁ? দেখলেই পালাতে চাও দেখছি। কেন,আমরা কী বাঘ,খেয়ে ফেলব তোমাকে?’
বাকী দুজন হুহা করে হেসে ওঠে কথাটায়।
মারিয়ার হাঁটু কাঁ*পছে। তাও কণ্ঠ স্বাভাবিক রেখে বলল,
‘ পথ ছাড়ুন।’
‘ আরে ছাড়ব তো। আমাদের কাজটা হয়ে যাক,ছেড়ে দেব। দরকার পরলে বাড়তে গিয়ে দিয়ে আসব।’

মারিয়া ভ*য়ে শেষ। শুকনো অন্তরা*ত্মা নিয়ে শুধাল,
‘ ককী কাজ?’ ককী কাজজের ককথা বললছছেন আপনারা?’
দ্বিতীয় জন বলল,
‘ আরে এত তোঁতলাচ্ছো কেন? আমাদের দেখতে কী বাজে ছেলে মনে হয়? আমরা ভীষণ ভালো ছেলে বুঝলে? আর ভালো ছেলেদের জন্য দরকার একটা ভালো মেয়ে। এই যেমন তুমি।’

বলেই খপ করে হাতখানা চে*পে ধরল ওর। মারিয়া স্তব্ধ বিস্ময়ে। ভয়ে বাকরুদ্ধ। তাও, চোখ রা*ঙিয়ে বলল,
‘ হাত ছাড়ুন আমার। ‘
‘ বললাম না,কাজ শেষে ছাড়ব। চলো…’
টান বসাতেই হুলস্থূল বাঁধিয়ে হাতটা কা*মড়ে ধরল মারিয়া। ছেলেটা ব্য*থায় ‘আআআ ‘ বলে চেঁচিয়ে ওঠে। হাত ছেড়ে দেয় মুহুর্তে। বাকী দুজন চোখ দুটো মারবেলের মত করল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই উলটো ঘুরে দৌড় লাগাল মারিয়া। ‘ধর শালিরে’ বলেই
ছেলে গুলোও ছুট লাগাল পেছনে।

সুপ্রসন্ন ভাগ্য থাকলে যা হয়! মেয়েটা পড়তে পড়তে পড়ল একবারে সাদিফের বাইকের সামনেই। রীতিমতো ধা*ক্কা খেয়ে উলটে পড়ল রাস্তার ওপর। সাদিফ ফটাফট বাইকে ব্রেক ক*ষে। মারিয়াকে দেখেই ‘শীট ‘বলে স্ট্যান্ড ভিজিয়ে নেমে আসে। ছেলে তিনটে দূর থেকে এক্সিডেন্টের দৃশ্যে দাঁড়িয়ে গেল। দ্বিধাদ্বন্দে ভুগল এগোবে কী না!
মারিয়া একে ভ*য়ে কাঁপছিল,দ্বিতীয় বাইকের ধা*ক্কা। একেবারে চোখ বুজে নেতিয়ে রইল পীচের ওপর। সাদিফ ছুটে গিয়ে কাছে বসল। গাল চা*পড়ে হড়বড় করে, ডাকল,
‘ ম্যালেরিয়া,মিস ম্যালেরিয়া!’
মারিয়া ত্রস্ত চোখ খোলে। স্থিরচিত্রের ন্যায়, সামনে সাদিফের মুখটা ভেসে উঠল তখন। অথচ বিভ্রান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ আমি কি বেঁচে আছি? ‘
সাদিফ চোখ-মুখ গোছাল। তার মেজাজ এমনিতেই তুঙ্গে। মোটা কণ্ঠে বলল,
‘ বেঁচে আছেন মানে?’

মারিয়ার কপালের ভাঁজ হাওয়া। ভ*য়টাও উধাও। উলটে স্ফূর্ত কণ্ঠে বলল, ‘ আপনি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? তার মানে আমি বেঁচে আছি। প্লিজ আমাকে তুলুন। ‘

সাদিফ বিরক্ত হলেও,টেনেটুনে ওকে সোজা করে দাঁড় করাল। ভীষণ কৌতুহল সমেত শুধাল,
‘ সব সময় খালি ছোটেন কেন? আর ছুটতে ছুটতে এসে আমার সামনেই পরেন। ব্যাপার কী? ‘

মারিয়া কাঁধ ব্যাগটা বুকের সাথে চে*পে ধরে আশেপাশে তাকাল। একটু দূরে ছেলেগুলোকে দেখেই আঁত*কে বলল,
‘ ওই দেখুন,ওরা যায়নি এখনও। ‘
তার চোখ অনুসরন করে তাকাল সাদিফ। শুধাল, ‘ কারা ওরা?’
‘ ওরা বখাটে। সেদিনও আমাকে টিজ করেছিল,আর আজ আমার হাত চে*পে ধরেছে। নিয়ে যাচ্ছিল কোথাও। আজে-বাজে কথাও বলেছে।’
তার বলার ভঙি যতটা অশান্ত,সাদিফ ততোধিক শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ ও আচ্ছা।’
মারিয়া হতবাক হয়ে বলল, ‘ ও আচ্ছা মানে? ওরা আমাকে আজে-বাজে কথা বলেছে,হাত ধরে টেনেছে, আপনি কিছু বলবেন না?’

‘ আপনার হাত ধরে টেনেছে,আমি কী বলব?’
সাদিফ কাঁধ উঁচায়। বড় নিষ্পৃহ সে। আবার বলল,
‘ আর সুন্দরী মেয়ে দেখলে ছেলেরা এরকম করে। এগুলো নরমাল।’
মারিয়া আশ্চর্য না হয়ে পারল না। রু*ষ্ট চোখে একবার ছেলেগুলোর দিক তাকায়। ওরা নিজেদের মধ্যে গুজুরগুজুর করছে। সে যদি ছেলে হতো না,এক্ষুনি সবকটাকে রাম ধোলাই দিয়ে ভুলিয়ে দিতো বাপের নাম। তারপর চোখ বুজে দম ছেড়ে, শান্ত করল নিজেকে। পুনরায়, সাদিফের দিক ফিরে বলল,
‘ আপনার উচিত একটা মেয়ের সম্মানহানীর প্রতিবাদ করা। অন্তত ওদের গালে দু চারটে থা*প্পড় বসানো।’

সাদিফ অবাক হওয়ার ভাণ করে বলল, ‘ আপনার জন্য শুধু শুধু মারা*মারি করতে যাব কেন?’
মারিয়া দ্বিগুন আশ্চর্য হয়। এটা কী ধূসর ভাইয়ের ভাই? উনি হলেত বলতেও হতোনা। শুনেই ঘা দিয়ে চলে আসতেন।
তারপর মাথা ঠান্ডা করে বলল,
‘ ঠিক আছে, শুধু শুধু মারা*মারি করতে হবে না। ওই তিনটাকে মা*রার জন্য আমি আপনাকে তিনশ টাকা দেব। ‘

সাদিফ হতভম্ব চোখে চাইতেই বলল, ‘ পাঁচশ দিলে তো মা*রবেন? যান মা*রুন।’
সে কিছুক্ষণ আহাম্মকের মত চেয়ে রইল। আচমকা হেসে উঠল শব্দ করে। গত চঁব্বিশ ঘন্টায় কেবল মাত্র হাসি উঁকি দিলো ঠোঁটে। হাসতে হাসতেই বলল,
‘ মানুষ মা*রার সুপাড়ি দিচ্ছেন?

এদিকে, প্রথম ছেলেটি,পাশেরটাকে জিজ্ঞেস করল,
‘ যাবি? ঠিক কইরে ভাইবা ক।’
‘ আরে ভাবার কী আছে? ও একলা,আর আমরা তিনজন। দুই ঘা লাগবে শোয়াইতে। চল।’
‘ আচ্ছা চল,সাথে ছু*রি টুরি থাকলে বাইর কর,মাইয়াডারে আজকে লাগবোই।’

তারপর তিনজন হাতা গোটাতে গোটাতে এগোলো। একজন পকেট থেকে বের করল ছোট সাইজের ধারাল ছু*রি। মারিয়া উত্তর দিতে গেলে,ওদের আসতে দেখেই এক লাফে সাদিফের পেছনে গিয়ে লুকায়। শার্ট খামচে ধরে অনুরোধ করে,’ ওই যে আসছে,প্লিজ কিছু করুন।’

সাদিফ ঢোক গিলল। মনে মনে বলল,
‘ এত কাছে আসবেন না মারিয়া! কেমন যেন লাগে আমার।’

ততক্ষণে
ছেলে তিনটে কাছে এসে দাঁড়ায়। সাদিফ হেলমেট খুলে হাতে নিলো। প্রথম ছেলেটি,পেছনের জন থেকে ছু*রিটা এনে, স্বীয় থুত্নীতে ঘষতে ঘষতে বলল,
‘ কী হিরো? কী করো এই মাইয়ার লগে? এত রাইতে মাইয়া মানুষ লইয়া আমাগো এলাকায় দাঁড়াইছো,কলিজায় মেলা সাহস।’

সাদিফ হেসে বলল, ‘ তা একটু আছে।’
ছেলেটি রে*গে ছু*রিটা তাক করে বলল,
‘ ওই কথা কম। চুপচাপ মাইয়াটারে আমাগো হাতে তুইল্লা দিয়া ফোট, নাইলে এক কো*পে জ্যান্ত….’

শেষ করার আগেই, হেলমেট দিয়ে কষে ওর মাথায় বারি মা*রল সাদিফ। ছেলেটা একবার চক্কর কে*টে চোখ উলটে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। ছু*রিটা ছিটকে পরে নিখোঁজ হলো। বাকী দুইজন ভ*য়ার্ত চোখে দেখে ‘পালা, পালা’ বলে ছুট লাগায়। মারিয়া ভ*য়ে মুখ চে*পে ধরেছে। সাদিফ নিজেও চমকে গেছে। এই সামান্য ঘা*য়ে কেউ লতিয়ে পরে? ম*রে গেল না তো? হুটোপুটি করে ছেলেটার পাশে বসে ডাকল,
‘ এই শুনছেন? এই, এই আরে এই?’
মারিয়া বিস্ময়ে কণ্ঠ শৃঙ্গে তুলে বলল,
‘ আপনার গায়ে এত জোর?’

সাদিফ দিশেহারা ভঙিতে বলল,
‘ এই ছেলেটা উঠছে না কেন? র*ক্ত ও তো বের হয়নি। হলো টা কী?

মারিয়া বলল,
‘ অসভ্যটা ম*রে গেছে মনে হয়। ভালোই হয়েছে। চলুন পালাই।’
সাদিফ হকচকিয়ে তাকাল, ‘ কী বলছেন? একটা হেলমেটের বারিতে মানুষ ম*রে? ‘

মারিয়া কি করবে বুঝলো না। ছেলে দুটো পালিয়েছে না,আরো লোক ডাকতে গিয়েছে কে জানে! সে তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করল। ঝরঝর করে ঢেলে দিলো ছেলেটার মুখের ওপর। সাদিফের গায়েও ঝাপ্টা লাগল পানির। বিরক্ত চোখে তাকাল সে। অথচ অজ্ঞান ছেলের চোখদুটো নড়েচড়ে উঠল এতে।
ওমনি মারিয়া তাড়াহুড়ো কণ্ঠে বলল,
‘ এই বেচে আছে, বেচে আছে। এবার চলুন পালাই। ‘
সাদিফ তাও উঠল না। সে বলদ বনে গেছে। মারিয়া অধৈর্য হয়ে তার হাত ধরে টেনে তুলল। টেনেটুনে বাইকের কাছে এনে বলল,
‘ প্লিজ চলুন! ওরা আরো লোকজন নিয়ে এলে দুজনেই মা*রা পরব।’

এতক্ষণে জ্ঞানে এলো সাদিফ। হেলমেট হাতে নিয়েই বাইকে উঠল। মারিয়াও ব্যস্ত ভাবে উঠে বসল পেছনে। এরপর ধোঁয়া ছুটিয়ে পালাল দুজন।

___

পুষ্পর মুখ জিরোচ্ছে না। সাগর পাড়ে যত রকম খাবার পাওয়া যাচ্ছে গাল ভরে খাচ্ছে সে। এদিকে পিউ চেয়েও দেখছে না সেসব। তার মহাবি*রক্তি ভাবমূর্তি। ধূসরের ওপর মনে মনে ভীষণ চটেছে আজ। খাবেনা,কিচ্ছু খাবে না। কথাও বলবে না। বোমা মে*রে উড়িয়ে দিলেও না। পিউ বুকের সাথে হাত গুঁজে, মুখ ভাঁড় করে দাঁড়িয়ে থাকল। পুষ্প প্লেটে ফিশ ফ্রাই নিয়ে অমৃতের মত চিবোচ্ছে। ধূসরকে দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে। ট্রলার জার্নি শেষ করে,বালুতে পা ছোঁয়ার পর খোঁজ নেই। ধারেকাছেই থাকবে হয়ত। পুষ্প খাবার অল্পটুকু তুলে ইকবালকে খাইয়ে দিলো। বিপরীতে খাওয়ালো সেও। পিউ এই দৃশ্যে মন খা*রাপ করে ফেলল আরও। ধূসর ভাই এরকম জীবনেও করবেন না। খাইয়ে দেওয়া তো দূরের কথা।
পুষ্প খেতে খেতে আরেকবার ডাকল, ‘ এই পিউ,আয় না। খেয়ে দ্যাখ, মজা আছে তো।’

‘ তুই খা।’
ইকবাল বলল, ‘ ওর কী হয়েছে বলোতো!’
‘ জানিনা গো। ধূসর ভাই ঘটিত ব্যাপার তো,উনি ছাড়া ঠিক হবেনা মনে হয়।’
‘ দাঁড়াও,আমি গিয়ে গুছিয়ে ব্যাপারটা জেনে আসছি।’
ইকবাল হাতা ভাঁজ করতে করতে এগিয়ে গেল। টেনে টেনে ডাকল,
‘ পিউপিউ!’
পিউ চোখা নেত্রে তাকায়। ইকবাল চমৎকার হেসে বলল,
‘ কার ওপর এত রা*গ? ধূসরের?’
পিউ উত্তর দিলো না। তার প্যাঁচার মত মুখ দেখে ইকবাল থুতনী ধরে নিজের দিক ফেরাল। মায়া মায়া গলায় বলল,
‘ আহা,এই সুন্দর মুখে মেঘ মানায় না শালিকা। কী হয়েছে ভাইয়াকে বলবে না?’

পিউ ঠোঁট ওল্টায় সহসা। বাচ্চাদের মত হাবভাব করে চেহারার। চোখেমুখে প্রচন্ড দুঃ*খ ফুটিয়ে বলে,
‘ আপনি কত ভালো ভাইয়া! কত রোমান্টিক! আপুকে কত ভালোবাসেন! আর আপনার বন্ধু? একটা আনরোমান্টিক,একটা নিরামিষ, পঁচা পান্তাভাত। প্রেমের প ও বোঝেন না। কী বললে,কী করলে আমি খুশি হব,আমার ভালো লাগবে তাতো একেবারেই না। খালি ধম*কাবে,বক*বে,চোখ পাঁকাবে,আর উনিশ থেকে বিশ হলেই ঠাস ঠাস করে মে*রে দেবে।’

ইকবাল বিজ্ঞের ন্যায় মাথা দুলিয়ে বলল,
‘ হুউউউ,এতো ভারী অন্যায়।’
পিউ বলল
‘ ওসব ছাড়লাম। ওনার বকা-ঝকাতে আমার একটুও খা*রাপ লাগে না। রা*গ ও হয়না। কিন্তু বাকী সব? একটু ভালো করে কথা বললে কী হয়? ‘

ইকবাল আবার মাথা দোলাল। হা করতে গেলে ওপাশ থেকে ধূসরকে আসতে দেখা যায়। তার হাতে তিনটে আইসক্রিম। ওদের দেখে কাছে এসে, ইকবালকে দুটো এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ তোর আর পুষ্পর। ‘

তাকে দেখেই পিউ সন্তর্পনে গাল বেকিয়ে আরেকদিক ফিরে থাকে। ইকবাল ওর দিক একবার দেখে আবার ধূসরের দিক তাকাল। ধূসর তাগাদা দিল,
‘ কী? ধর।’
ইকবাল জ্ব*লন্ত কণ্ঠে বলল,
‘ রাখ তোর আইসক্রিম। আগে তুই আমাকে এটার উত্তর দে,এইভাবে আমার প্রেসটিজ পাংকচার করছিস কেন?’

ধূসর বুঝতে না পেরে বলল, ‘ মানে?’
‘ মানে,এই যে আমি,কী অমায়িক একটা মানুষ! রোমান্টিক,ভালো,আরো কত কী! আর তুই আমার বন্ধু হয়ে কিচ্ছু শিখলিনা?’
পিউ তড়িৎ বেগে তাকাল। ইকবাল ভাই কী আবার সব বলে দেবেন না কী!
হলোও তাই। ইকবাল গড়গড়ে ভঙিতে বলল,
‘ তুই যে একটা আনরোমান্টিক,একটা নিরামিষ,একটা পঁচা পান্তাভাত, পিউ না বললে তো জানতেই পারতাম না। ‘
পিউ হা করে ফেলল ঠোঁট। আত*ঙ্কে সাদা হয়ে গেল মুখবিবর। ধূসর তব্দা খেয়ে, তাজ্জব বনে তার দিক তাকাতেই ঘন ঘন দুপাশে মাথা নেড়ে বোঝাল, ‘ সে কিছু বলেনি।’

ইকবালের এত সবে কিচ্ছু এলো -গেল না। ধূসরের কাধে হাত রেখে জ্ঞান দেয়ার মত হাবভাব করে বলল,
‘ দ্যাখ ভাই, আমার সম্মান রাখার দায়িত্ব তোর। আমার মত না হোক, একটু তো রোমান্টিক হ। যাতে তোর প্রেমিকা বলতে না পারে যে, তুই প্রেমের প ও বুঝিস না।’

ধূসর ভ্রুতে ভাঁজ নিয়েই পিউয়ের দিকে চেয়ে থাকল । ঘাড় চলে গেছে একপাশে। পিউ মনে মনে কটমট করল ইকবালের ওপর। কেন যে বলতে গেল ওসব! সে ফিরেও দেখল না পিউকে। নিরুদ্বেগ ভাবে ধূসরের হাত থেকে আইসক্রিম দুটো নিয়ে বলল,
‘ আহারে গলে যাচ্ছে তো!যাই, মাই লাভ কে দিয়ে আসি।’

তারপর হেলেদুলে,আনন্দ সমেত জায়গা ত্যাগ করল। ঠোঁটে হাসি ধরছে না। পুষ্পর কাছে যেতেই সে আগ্রহভরে শুধাল, ‘ কী হয়েছে?’
ইকবাল দুষ্টু হাসল শুধু।

পিউ ওড়নার মাথা আঙুলে প্যাঁচাচ্ছে। মাথাই তুলছে না। আঁদোল সংকীর্ণ। ইকবাল ভাই এইভাবে ধোঁ*কা দেবেন কে জানত!
এখন কী হবে? দৌড়ে পালাবে এখান থেকে? সে হাঁস*ফাঁস করল কিছু সময়। তখনই শোনা গেল ধূসরের নিম্নভার কণ্ঠ,
‘ আমি আনরোমান্টিক? ‘

পিউ ভী*ত লোঁচনে চাইল। আমতা-আমতা করে বলতে গেল কিছু। এর মধ্যে ধূসর দুরুত্ব ঘুচিয়ে দাঁড়ায়। একেবারে ছুঁইছুঁই হয় তার শরীরের সঙ্গে। পিউ ঘা*বড়ে গেল। বুকের কম্পন জোড়াল। জ্বিভে ঠোঁট ভিজিয়ে কাঁ*পা- কাঁপা পল্লবে তাকায়। ধূসরের পূর্ন দৃষ্টি তার ওপর। পরপর ঠোঁট এসে ভেড়ে ওর কানের পাশে। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,
‘ একটু কাছে এলেই তো হাঁপানি রোগীর মত ছ*টফট করিস। রোমান্টিক হলে সুস্থ থাকবি? ‘

চলবে,

#এক_সমুদ্র_প্রেম!
কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(৫০)

সমুদ্রের কোল ঘেঁষে সূর্য ডু*বেছে। এইত,কিছুক্ষণ হলো। প্রকৃতির এই অদ্বিতীয় সৌন্দর্য ব্যগ্র লোঁচনে উপভোগ করেছে ওরা। পিউয়ের নেত্রপল্লবই পড়ছিল না। প্রথম দিকে সূর্য ডুবছেনা কেন,সেই নিয়ে বিরক্ত হলেও,ধীরে ধীরে নিজেই তলিয়ে গেল মনোহারিতায়। সে চুপ রইলেও পুষ্প মুগ্ধ হয়ে আওড়াল, ‘ ওয়াও,কী সুন্দর!’

এরপর চারিধার ঘিরে অন্ধকার নামল। বীচেও যেন হুরহুর করে বাড়ছিল লোক। বাড়তে থাকল অসংখ্য ভ্যানের ভীর। ধূসর আর কিছুতেই ওদের রাখবেনা ওখানে। বলল,
‘ ঘুরেছি অনেক,চল এবার।’
পুষ্প আরো থাকতে চেয়েছিল। সমুদ্রেও নামা হলো না আজ। আসতে আসতে বিকেল হওয়ায় ইকবাল নামতে দেয়নি, ঠান্ডা লাগবে বলে। কিন্তু
কড়া কণ্ঠের কাছে তার আবদার যে আর টিকবেনা সে জানে। ঠোঁট উলটে চুপ করে থাকল। চারজন গাড়িতে উঠল। ধূসর সবাইকে শুধাল,
‘ খেয়ে যাবি? না খাবার নিয়ে যাব?’

ইকবাল বলল, ‘ খেয়ে যাই।’
পুষ্প ও স্বায় দিলো। ধূসর আড়চোখে তাকাতেই পিউ অবিলম্বে মাথা নীচু করে ফেলল। পুষ্প বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করল,
‘ কী রে? এখানে খাবি? না হোটেলে যাবি?’
সে সময় নিয়ে জানাল,’ সবাই যা বলবে।’
ধূসর বাইরের দিকে ফিরল। কক্সবাজারে আগেও এসেছে সে। পার্লামেন্ট থেকে প্রতি বছর আয়োজিত বনভোজনের তাগিদে একবার ঘুরেছিল এখানে। ইকবালের ও তাই। ওইজন্যে কোনাকানি মোটামুটি পরিচিত ওদের।

জায়গার বলে দেওয়া নাম অনুযায়ী চালক গাড়ি থামালেন। একটা তকতকে, শোধিত রেস্তোরাঁয় ঢুকল ওরা। অথচ এখানেও ভীর। টেবিল খালিই নেই বলতে গেলে। একজন ওয়েটার এগিয়ে এলেন ওদের দেখে। বসার জায়গা দিতে না পেরে বিনম্র গলায় বললেন,’ স্যার একটু অপেক্ষা করুন,টেবিল এক্ষুনি খালি হবে।’

ধূসর মাথা নাড়ল। ওদের নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। পিউ কাঁচের দেয়ালের পাশে লাগানো টেবিল গুলোর দিক চকচকে নয়নে চেয়ে আছে। ভীষণ চাইছে, ওগুলো একটা খালি হোক! তবে ওখানে বসে সমুদ্র দেখবে আর খাবে। এর মাঝে এক বয়স্ক লোক হাতে ধুঁয়ে ফেরত এলেন। ওদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় ইচ্ছে করে ধা*ক্কা দিলেন পিউকে। রোগা শোকা,বেখেয়ালে থাকা মেয়েটা সেই ধা*ক্কায় পুষ্পর ওপর হেলে পরল । রা না করে ঠোঁট উলটে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল। এত জায়গা থাকতে ওর গা ঘেঁষেই যেতে হলো?
অথচ ধূসর ক্ষি*প্ত বাঘের ন্যায় ফিরল তার দিকে। ভীষণ ক্ষো*ভে চোখ দুটো জ্ব*লে উঠেছে। চেঁচিয়ে ডাকল,
‘ এই দাঁড়া।’
চিৎকারে কেঁ*পে ওঠে পিউ-পুষ্প। কিন্তু লোকটা শোনেনি। হেলেদুলে হেঁটে নিজের টেবিলের কাছে গিয়েছে সে। ইকবালের মেজাজ ও তেঁতেছে। দুবোন ভীত চোখে একে অন্যকে দেখল। ধূসরের হাবভাব নিয়ে ভ*য় হচ্ছে। কিন্তু ইকবাল শান্ত, পরিস্থিতি বোঝে। ধূসরকেও চেনে। ওকে থামাতে বলতে গেল,
‘ ধূসর এখানে এখন….

সে শুনলে তো! হনহন করে গিয়েই লোকটার কলার ধরে নিজের দিক ফেরাল। টেবিল থেকে টিস্যু তুলে হাত মুছছিলেন তিনি। বয়সে আজমলের ধারেকাছে হবেন। আকষ্মিক ঘটনায় ভ্যাবাচেকা খেলেন। টেবিলে বসা আরও দুজন ভদ্রলোক অবাক চোখে তাকালেন। লোকটা নিজের কলার ধরা ওর হাতের দিক চাইল একবার। ধূসর সোজাসাপটা শুধাল,
‘ তুই ওকে ধা*ক্কা দিলি কেন?’

সেই শীতল স্বরের প্রশ্ন রেস্তোরাঁর সব কানায় পৌঁছায়। সবার মনোযোগ নিক্ষেপ হয় এদিকে। খাওয়া রেখে উৎসুক নজরে তাকিয়ে থাকল সকলে। ইকবাল গিয়ে ধূসরের পাশে দাঁড়ায়।
লোকটি না জানার ভাণ করে বলল, ‘ ককাকে?’
ধূসরের মেজাজ খারাপ হলো আরও। লাল চোখে চেয়ে বলল, ‘ নাটক করছিস? মেয়ে দেখলেই ধা*ক্কা মা*রতে মন চায়? ‘
‘ মানে কী আশ্চর্য! রাস্তায় চলতে গেলে একটু আধটু এমন ধা*ক্কা লাগতে পারেনা? হয়ত তাই…। আর আপনি তুই তোকারি করছেন কেন? এটা কেমন ভদ্রতা?
গলার স্বর উঁচু করলেন তিনি।
ধূসরের মেজাজ আরো চটে গেল। পাল্টা চেঁচিয়ে বলল,
‘ বেশ করছি। তুই ওকে ধা*ক্কা মারলি কোন সাহসে? কোনটা ইচ্ছে অনিচ্ছের আমি বুঝিনা?’
অচেনা জায়গায় এমন ধৃষ্টতায় ঘাবড়ে গেলেন উনি। ধরেই নিলেন এ স্থানীয় ছেলে। নাহলে বেড়াতে এসে ছেলেপেলে এমন ঝামেলায় জড়ায় না। সাথে দু দুটো বলিষ্ঠ যুবককে খেয়াল করে ভীত হলেন। ছোট করে বললেন,
‘ আমি দেখিনি।’
ধূসর তাও কলার ছাড়ল না ৷ রেস্তোরাঁর কর্তৃপক্ষ লোকজন এসে কাছে দাঁড়িয়েছে। পিউকে আঙুল দিয়ে দেখাল ধূসর। ভ*য়ে মেয়েটার মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। ঢোক গি*লছে বারবার। ধূসর লোকটাকে আদেশ দিলো,
‘ সরি বল ওকে!’

ভীষণ অপমানিত বোধ করলেন উনি। এরকম হবে জানলে ভুলেও এমন করতেন না। পাশই মা*রাতেন না। ওনার সাথে আসা অফিস কলিগরা হা করে চেয়ে আছেন। পুরো রেস্তোরাঁ দেখছে তাকে। মান ইজ্জ্বতের এরুপ ধ্বং*সলীলা অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত। চোখ নামাতেই ধূসর অধৈর্য হাতে কলার ঝাঁকাল ৷ হু*ঙ্কার দিলো,
‘ সরি বল!’

লোকটা সময় নিলো,তবে আস্তে করে বলল, ‘ সরি!’

তখন হাত হঁটাল ধূসর। দম ফেলল। তারপর গটগট করে চলে এলো পিউদের কাছে।
‘ খাব না এখানে, চল।’

বলল, সাথে পিউয়ের হাত টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো। তখন পুষ্পকে দেখে কাঁধ থেকে হাত সরিয়েছিল,অথচ এখন এত এত মানুষের মধ্যেই ওকে নিজের সাথে পেঁচিয়ে হাঁটা ধরেছে। মেয়েটা দুচোখ ছাপানো বিস্ময় সমেত তার শক্ত চিবুকটা একযোগে দেখে যায় । বাকরুদ্ধ সে,হতবিহ্বল।
পেছনে হাঁটতে হাঁটতে ইকবাল, পুষ্পকে হা হুতাশ ভঙিতে বলল,
‘ সাহস দেখেছো? ব্যাটা আস্ত একটা জল্লা*দ! ভয়ড*র নেই।’

পুষ্প চাপা কণ্ঠে বলল, ‘ তুমিত একটা ভীতু! ভেড়ার মত ভাইয়ার পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলে।’

ইকবাল বলল,’ কই পেছনে? আমি আমার বন্ধুর পাশে ছিলাম। একটা ঝামেলা হলে প্রস্তুত ও ছিলাম, একশন নেওয়ার। ফোন ও বের করে রেখেছিলাম বুঝলে!’
পুষ্প তাও মুক বাঁকাল। তারপর নিমিষেই হেসে বলল,
‘ ভাইয়া কত পসেসিভ দেখেছো? সামান্য একটু ধা*ক্কায় কী রিয়্যাক্ট করল বাবাহ! কত্ত ভালোবাসেন আমার বোনটাকে।’
‘ ধা*ক্কাটা সামান্য হলেও লোকটা ইচ্ছে করে দেওয়ায় ক্ষেপেছে বেশি৷ ওইটুকু মেয়ে,মধ্যবয়সী একটা লোক তাও অসভ্যতা করলো? ওর মেয়েইত পিউয়ের বয়সী হবে। এদের কী বিবেক-জ্ঞান নেই?’
‘ পৃথিবীতে সবাই কি এক হয়? যেমন ওদের মত পুরুষ আছে, তেমন আমার বাবা,চাচ্চু আর তোমার,আর ধূসর ভাইয়ের মতোও আছে। আর আমি হচ্ছি সবচাইতে লাকি। কারণ সব ভালো মানুষ গুলোকে আল্লাহ আমার ঝুলিতে ফেলেছেন।’
ইকবালের ঠোঁট দুদিকে আমুদে ভঙিতে সরে গেল৷
এর মধ্যে ম্যানেজার লোকটি অনুনয় শুরু করলেন ধূসরকে। ‘ স্যার স্যার ‘বলে কয়েকবার ডাকলেন। ও ফিরেও দেখল না। পিউকে সাথে জড়িয়েই লম্বা পায়ে বেরিয়ে গেল। মেয়েটা হিমশীম খেল সেই কদমে তাল মেলাতে। তাতে কী? ধূসর ভাইয়ের গায়ে মিশে থাকাই সবচাইতে জরুরি এখন।
রেস্তোরাঁর মানুষ গুলো গোলগোল চোখে দেখে গেল শুধু। কানা ঘুষাও বাদ রইল না। অত কিছু কে পেছনে রেখেই ধূসরদের গাড়ি হাওয়া হয়।

_____

মারিয়া আজ সাদিফকে ছাড়ল না৷ জোর করে, ইনিয়ে-বিনিয়ে বাড়িতে নিয়েছে। বিশেষ করে ইমোশোনাল কথাবার্তায় গলে গিয়েছে সাদিফ। প্রথমে সে কিছুতেই বাড়ির ভেতর যাবে না। কিন্তু যখন মারিয়া মন খারাপ করে বলল,
‘ আমরা গরীব বলে যেতে চাইছেন না তাইনা?’
প্রকান্ড অস্বস্তি হলো তার। সেতো এরকম কিছু ভাবেইনি। সঙ্গে সঙ্গে বাইক থেকে নেমে এসে বলল,
‘ চলুন।’

কলিংবেলের শব্দ পেয়ে তড়িঘড়ি করে এগিয়ে গেলেন রোজিনা খাতুন। দরজা খুলে মেয়ের সাথে একটা অপরিচিত মুখ দেখে অপ্রস্তুত হলেন। উত্তর খুঁজতে মেয়ের দিক চাইলেন। মারিয়া প্রফুল্ল কণ্ঠে বলল,
‘ মা,উনি আমার বস সাদিফ। ওনার আরো একটা পরিচয় আছে,উনি ধূসর ভাইয়ের ভাই।’
সাদাফ সালাম দিলো। রোজিনা উত্তর নিয়ে বিনীত কণ্ঠে বললেন,
‘ আসুন, আসুন,ভেতরে আসুন।’
সে ভেতরে এসে বলল,
‘ আন্টি আমাকে তুমি করে বলবেন,আমি আপনার ছেলের মত। ‘
রোজিনা তার সদাচরণে বিমুগ্ধ হলেন। মেয়ের দিক চাইতেই মারিয়া হাসল। তারপর নিজেও হেসে বললেন,
‘ ঠিক আছে। বসো বাবা,বসো।’
সাদিফ বসল। তাকে ভীষণ অপ্রতিভ লাগছে। কখনও এরকম মেয়েদের বাসায় যায়নি। কোনও মেয়ে ক্লাশমেটদের বাড়িতেও না। মারিয়াই প্রথম। সে দাঁড়িয়ে আছে দেখে, রোজিনা বললেন,
‘ তুই গিয়ে ফ্রেস হ। আমি ওকে চা দিচ্ছি।’
মারিয়া তড়িঘড়ি করে কাধ ব্যাগ নামিয়ে বলল,
‘ না না মা,আমি দিচ্ছি।’
তারপর রান্নাঘরে ছুটে গেল। রোজিনাও পেছনে গেলেন। সাদিফ বসে বসে আশেপাশে তাকাল। তিন কামড়ার ফ্ল্যাট,তবে খুব একটা বড় নয়। ছোটখাটো ফ্রিজ,টেলিভিশন সবই আছে,কিন্তু পুরোনো, বেশ আগের। তবে গোছালো,পরিপাটি খুব। তারপর চোখ পড়ল দেয়ালে। মারিয়াদের ফ্যামিলি ফটো ঝোলানো সেখানে। রওনাক,তার বাবা,রোজিনা আর সে। রওনাক কে দেখে অবাক হয় সাদিফ। ওকে সে চেনে। ধূসরের সাথে অনেকবার দেখেছিল। উনিতো মা*রা গিয়েছেন। তবে,উনিই মারিয়ার ভাই? সেজন্যেই মেয়েটা এই বয়সে চাকরি করছে?
সাদিফ উঠে এলো। এগিয়ে গেল দেয়ালের কাছে। বহু আগের মারিয়া এখানে। বোঝাই যাচ্ছে তার শৈশবের ছবি এটি। পড়নে ফ্রক,দুপাশে দুটো ঝুটি। কী শুকনো! হাসির মধ্য থেকে উঁকি দিচ্ছে পোঁকে খাওয়া দাঁত। সাদিফ হেসে ফেলল। এই অর্ধেক সাদা -কালো দাঁতের মারিয়াকে দেখতে দারূণ লাগল তার। সে চটপট পকেট থেকে ফোন বের করে ক্যামেরা অন করল। শুধু মারিয়াকে জুম করে টুক করে ছবিটা তুলে নিলো ফ্রেমে। এর মাঝে ট্রেতে নাস্তা নিয়ে হাজির হলো মারিয়া। ওকে ছবির কাছে দেখে বলল,
‘ কী দেখছেন?’
সাদিফ নড়েচড়ে তাকায়। ফোন পকেটে ভরে। দুষ্টুমি করে জানায়,
‘ আপনার পোঁকা আক্রান্ত দাত কপাটি দেখছিলাম।’
মারিয়ার হাসিটা কমে ঠোঁট চলে এলো উঁচুতে। ভীষণ দুঃখ নিয়ে বলল,
‘ আর বলবেন না,বাবার সাথে আমার ওই একটা ছবিই আছে। তাই জন্যে ভাইয়া ওটাই বাধিয়েছিল।নাহলে এই দাঁত আমি কাউকে দেখাতাম না।’

বলতে বলতে সে এসে ট্রে টেবিলে রাখল। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই দেখল সাদিফ কাছে এসে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ এত কাছে দেখায় বক্ষ হেলেদুলে উঠল তার। এমন করে কী দেখছেন উনি?
তখনি সাদিফ বলল,
‘ এখন হা করুন তো, আপনার পোঁকা খাওয়া দাঁত গুলো দেখা যায় কী না একবার চেক করি!’
মারিয়া ঠোঁট ফাঁকা হয়ে গেল। কিছু বলতে গিয়েও হেসে ফেলল। পালটা হাসল সাদিফও। সে বলল,
‘ প্লিজ বসুন,চা ঠান্ডা হয়ে যাবে। ‘

সাদিফ ঘুরে এসে বসল। চায়ের কাপ হাতে তুলে চুমুক দিয়েই বলল,
‘ বাহ,আপনার চায়ের হাত তো বেশ ভালো।’

প্রসংশা শুনে মারিয়া মাথা নামিয়ে স্বলজ্জিত হাসে। চা শেষ করেই সাদিফ উঠে দাঁড়ায়। হাতঘড়ি দেখে বলে,
‘ আজ আসি।’
রোজিনা বেরিয়ে এলেন শুনে। বললেন,
‘ সে কী বাবা! নাস্তাতো কিছুই খেলে না। সব পরে আছে। আর এখন যাবে কেন,রাতে খেয়ে যেও।’

‘ না না আন্টি,আজ নয়,অন্যদিন। আজ তাড়া আছে।’
‘ ঠিক আছে,আবার এসো কিন্তু। ‘
‘ জি।’
সে দরজা অবধি যেতেই মারিয়া মিনমিন করে বলল,
‘ চলুন,এগিয়ে দেই।’
সাদিফ মানা করেনি। সে সামনে এগোতেই মারিয়া পিছু নিলো। নিশ্চুপ ভাবে দুজন গেটের কাছে আসে। মারিয়া গেটের লোহা আগলে দাঁড়ায়। তার দৃষ্টি কাতর। সাদিফ কয়েক পা গিয়ে থামল,ঘুরে তাকাল। মিলন হলো এক জোড়া আকুল আর এক জোড়া দ্বিধাযুক্ত চক্ষুর। মারিয়া মৃদূ হাসলে,হাসি বিনিময় করে সেও। তারপর উঠে বসে বাইকে। বলে, ‘ আসি।’
মারিয়া বলল, ‘ সাবধানে যাবেন।’
সাদিফ চলে গেলে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঘরে ঢুকল খুশিমনে। রোজিনা এঁটো বাসন গুছিয়ে রান্নাঘরে যাচ্ছিলেন,ওকে দেখে থামলেন। মারিয়া এসে কাঠের সোফায় বসল। তিনি বললেন,
‘ ছেলেটা কী ভদ্র! নম্র! তাইনা?’
‘হ্যাঁ। ‘
‘ ধূসরের সাথে চেহারার একদমই মিল নেই। কত ফর্সা! আমিতো বিদেশী ভেবেছিলাম।’
মারিয়া টি টেবিলে পা দুটো তুলে মাথা এলিয়ে দিলো পেছনে। চোখ বুজে বলল,
‘ ধূসর ভাইয়ের যা পার্সোনালিটি! সেখানে ওমন দশটা ফর্সা ছেলে মা*র খাবে বুঝলে!’
রোজিনা ঘাড় দোলালেন,
‘ তা ঠিক। ওরা না থাকলে আমাদের যে কী হোতো!’
শেষে এসে কণ্ঠ ভারি হলো তার।
মারিয়া প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,
‘ এসব এখন ছাড়ো। আমাকে একটু চা এনে দাওনা মা! মাথাটা ধরেছে।’
তিনি কপাল কুঁচকে বললেন,
‘ ওমা,এইনা বসের জন্য নাঁচতে নাঁচতে চা বানালি? এখন আমাকে বলছিস কেন? তখন টায়ার্ড লাগেনি?’
মারিয়া চোখ বুজে রেখেই হাসল,বলল,
‘ ওসব বুঝবেনা তুমি।’
আচমকা হাসি গায়েব হলো আবার। সাদিফের মনে অন্য কারো বাস,ভাবতেই ভারী হয়ে উঠল অন্তঃপাড়। চোখ খুলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলো। মাকে বলল,
‘ যাওনা, এনে দাওনা।”
‘ আনছি,আনছি।’

সাদিফ পুরো মনোযোগ দিয়ে বাইক চালাচ্ছে। এগারটা পেরিয়ে যাওয়ায় রাস্তাঘাট শূনশান হচ্ছে ধীরে ধীরে। শো শো শব্দের বাতাস এসে লাগছে গায়ে। হাল্কা ফেঁপে উঠছে তার পড়নের পাতলা শার্ট। এর মধ্যে হঠাৎ মারিয়ার কথাখানা বেজে ওঠে কানে।
‘ ওই তিনটাকে মা*রলে আমি আপনাকে তিনশ টাকা দেব।’
বলার সময়ে তার মুখভঙ্গি মনে করে হেসে উঠল সাদিফ। সেই হাসি দীর্ঘসময় লেগে থাকল ওষ্ঠপুটে। সহসা সচকিতে খেয়াল করল,তার এখন একটুও মন খারাপ নেই। পিউ চলে যাওয়ায় যতটা ছিল,তার ছিটেফোঁটা ও হাতিয়ে পেলো না। এর কারণ কী? মারিয়া? বাহ,জাদু জানে তো মেয়েটা!

______

পিউ রুমে এলো। তাদের ঘুরতে ঘুরতে রাত নেমেছে। খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকেছে বহু আগে।
সে কক্ষে এসেই হাসল। সেই পরিচিত লজ্জায় রক্তিম হয়ে ওঠা ঝলমলে মুচকি হাসিটুকুন। দুদিকের নরম গাল ফুলে ওঠল ওপরে। একটা মানুষের তাকে ধা*ক্কা দেওয়ায় রে*গে যাওয়া ধূসর ভাইয়ের চেহারা ভেবে হৃদয়পুর ছেঁয়ে এলো ভালো লাগায়,ভালো বাসায়। তারপর ওর বলা কথাটা’
রোমান্টিক হলে সুস্থ থাকবি? বারবার মনে পড়ছিল। এই যে এখনও যেন স্পষ্ট শুনছে কানে। নিরন্তর বাজছে কর্ণ পৃষ্ঠের আশেপাশে৷ পিউ মিনমিন করে বলল,
‘ একবার রোমান্টিক হয়ে না হয় আমাকে অসুস্থই বানালেন ধূসর ভাই। আপনার প্রেমে পড়ে আমার হৃদপিন্ডের চারটে প্রকোষ্ঠ এমনিতেই সুস্থ নেই।

তারপর ফোন নিয়ে বারান্দায় এলো। হোমস্ক্রিনে ধূসর আর তার যূগল ছবিটি সেভ করা। পিউ সেই ছবিতে তুখোড় যত্নে হাত বোলায়। লক খুলে গ্যালারিতে গিয়ে ধূসরের একার ছবি বের করে। তৃষ্ণা মেটাতে চেয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ। আচমকা অধর নাড়িয়ে গেয়ে উঠল,
‘ এই তুমি যতক্ষণ থাকবে কাছে,
এই দেহে ততক্ষন প্রাণটা আছে, আমার প্রাণটা আছে। ‘

পিউ রেলিং ধরে মুক্ত, তারাভরা আকাশ পানে চায়। নক্ষত্রের ঝলসে ওঠা রুপ দেখে মন আরো ফুরফুরে হয়।
ফের দুপাশে দুলতে দুলতে গান ধরে,
‘ আমি যে তোমারই প্রেমেতে পড়েছি।
আমি যে প্রেমেরই মরণে মরেছি।
তোমারই ভাবনায় একাকি ভেসেছি।
তোমারই কাছে তো এসেছি।
জেনে নাও,ও প্রিয়,বুঝে নাও আমিও,
তোমাকেই মনে প্রাণে ভালোবেসেছিইই….

গানের মধ্যেই কোনও পুরুষালি অবয়ব পেছনে এসে দাঁড়াল। সেই ছাঁয়া ভেসে উঠল বারান্দার দেয়ালে। পরপর দুটো বলিষ্ঠ হাত তাকে মাঝে রেখে দুপাশ থেকে আকড়ে ধরল হঠাৎ। আকষ্মিক স্পর্শ, চেনা সুবাস নাকে যেতেই পিউয়ের বক্ষঃস্থল থমকায়। কণ্ঠস্বর কেঁ*পে ওঠে,গান থামে সহসা। স্ফুর্ত অধরে ভূমি*কম্প নামে। একবার ফিরে চাওয়ার প্রয়াস চালায়।
পিউয়ের হাঁটু টলে ওঠে। শরীরের ঝাঁকুনি প্রবল। ধূসরের অত্যুষ্ণ শ্বাস বৈশাখের তাণ্ড*বের ন্যায় প্রক্ষেপ হয় গালে। ঠান্ডা থুত্নী লেগে আসে কাঁধে। পিউয়ের ভেতর তোলপা*ড় শুরু হলো।
ধূসর ভাই কি এবার সত্যিই রোমান্টিক হওয়ার প্রতিযোগিতায় নামলেন?

তার গতরের ঘূর্নিঝ*ড়ে, ধূসরের কপালে ভাঁজ পড়ল। গাঢ় ভাবে সরল রেখার ন্যায় স্পষ্ট ফুটে উঠল তারা। সেই ভাঁজ নিয়েই পিউয়ের দিক ঘাড় বেকে দেখল একবার।
তারপর বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
‘ আর একটু কাঁ*পলে, এখান থেকে ঠে*লে ফেলে দেব।’
হুমকি শুনে পিউ ভ*য় পায়। অথচ কম্পন থামে না। ওরা কী তার মত বাধ্য?ধূসর সেকেন্ড খানেক দেখে গেল। শেষে বিদ্বিষ্ট, ব্যর্থ হয়ে ছেড়ে দিলো। সরে এলো দুরুত্বে। গম্ভীর স্বরে বলল,
‘ ঘুমিয়ে পড়।’
তারপর বেরিয়ে যায়৷ পিউ আহত নজরে চেয়ে রইল সেই যাওয়ার দিকে।

________________________

পিউয়ের কিছু ভালো লাগছে না! নিজের ওপর তিঁতিবিরক্ত খুব। ধূসর ওইভাবে ছেড়ে যাওয়ায়,খারাপ লাগছে। ক*ষ্টও হচ্ছে। একবার গিয়ে সরি বললে হতোনা? সাথে বলবে,
‘আপনি এখন থেকে কাছে এলেও কাঁপ*ব না ধূসর ভাই। বিশ্বাস না হলে ধরে দেখুন। ‘
তারপর নিজেই জ্বিভ কা*টল। বিষয়টা কেমন দেখায় না? বেশরমের মত হয়ে যাবে কাজটা। কিন্তু উনি যে রা*গ করলেন!
এতক্ষনের হৈহৈ মেজাজ-খানা অনিমেষ হারিয়ে ফেলল পিউ। মুখ ভাড় করে বসে রইল বিছানায়। কতক্ষণ পাঁয়চারি করল কামড়া জুড়ে। নাহ,কিছুতেই মন ভালো হবে না আজ।
সে চটপটে কদমে পুষ্পদের ঘরের দিক রওনা করল।

ওদের দরজা খোলা, শুধু চাপানো। পিউ তাও কড়া নাড়ল। জানতে চাইল, ‘ আসব আপু?’
ভেতর থেকে জবাব এলো তৎক্ষনাৎ, ‘ আরে পিউপিউ এসো,ঘরতো তোমারই।’
পিউ হেসে ঢুকল। পুষ্প পা ভাঁজ করে বসে সোফায়। ইকবাল তার পাশেই। গা ঘেঁষে বসাছিল দুজনে। পিউয়ের গলা পেয়ে দুরুত্ব বাড়িয়েছে। সে ঢুকতেই পুষ্প নিজের পাশ দেখিয়ে বলল,
‘ আয় বোস।’

পিউ বসেনি। সে ওদের রুম থেকে বারান্দার দিক চাইল। ধূসর ভাইয়ের ঘরটা এদের পাশেই। বারান্দাও একইসাথে নিশ্চয়ই! ওনাকে কী দেখা যাবে? পিউ ত্রস্ত এগোলো সেদিকে। ইকবাল শুধাল,
‘ কই যাচ্ছো?’
‘ আপনাদের ঘরটা একটু দেখি!’
যেতে যেতে উত্তর দিলো। ইকবাল হাসল,বুঝেছে সে। পিউ বারান্দার এসে একদম কোনায় গিয়ে দাঁড়ায়। ডান পাশের ঘরটা ধূসরের। আলো জ্বলছে ভেতরে। পিউ কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে। যদি সে আসে এখানে! কিন্তু এলো না। উলটে বন্ধ হলো বাতি। পিউয়ের অপেক্ষার উত্তেজনা নিভে গেল। মন খারাপ করে রুমে আসতেই দেখল পুষ্প- ইকবাল ফিসফিস করে কথা বলছে। ওকে দেখতেই সহসা থামল সে আলাপ। দুজনেই গাল ভরে মেকি হাসল। পিউ এতে সন্দেহী চোখে তাকায়। প্রশ্ন করে,
‘ কী বলছিলে তোমরা?’
ইকবাল আমতা-আমতা শুরু করে। পুষ্প ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,’ তোকে বলব কেন? ‘
‘ বললে কী হয়?’
পুষ্প দুষ্টুমি করে বলল,
‘ এসব হলো নবদম্পতির কথা। এগুলো ছোটদের শুনতে নেই।’
পিউ মুখ বাঁকায়। কপট রাগ দেখিয়ে বলে, ‘থাক,শুনলাম না।’

তারপর আরেকবার বারান্দা পানে চায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে’ আচ্ছা থাকো তোমরা,আমি আসি।’
ইকবাল বলল,
‘ সে কী! এলেইত এখন। বোসো না, গল্প করি!’
পিউ মুখ কালো রেখেই বলল,
‘ ঘুম পাচ্ছে খুব ভাইয়া। গল্প কাল করব কেমন? ‘

তারপর গুটিগুটি পায়ে ঘর ছাড়ল। ইকবাল শুধাল,
‘ ও কী রাগ করল মাই লাভ? ‘
পুষ্প নিশ্চিন্ত কণ্ঠে জানাল,
‘ আরে না! আমার বোনের ওমন ঢিলে রাগ নেই।’

সাদিফ ফ্রেশ হয়ে বের হলো কেবল। জবা বেগম এর মধ্যেই খাবার রেখে গিয়েছেন ঘরে। সে আসার সময়েই বলে এসেছিল দিয়ে যেতে।
সাদিফ মাথা মুছে এসি কমাল,ফ্যান ছাড়ল। কাউচে বসে টি টেবিল থেকে খাবার নিয়ে খেতে বসল। ভাত মেখে মুখে দিতে গিয়ে মনে পড়ল পিউয়ের কথা। আজ সারাদিন ওকে দ্যাখেনি। খেয়েছে ও? বাড়িতে এসে শুনেছে ওরা বিকেলেই পৌঁছেছিল। পিউ কেমন আছে কয়েক ঘন্টায়? একটুও মনে পড়ছে ওকে? ওর স্নিগ্ধ আনন চোখে ভাসতেই
সাদিফ খাবার রেখে উঠে যায়। ফোন এনে জায়গায় বসে কল দিলো পিউকে।

পিউ পাশ ফিরে শুয়ে আছে। ঠোঁট উলটে কোলবালিশের ফিঁতে টানছে৷ ফোন সাইলেন্ট করা। সাদিফের কলে স্ক্রিন জ্বলে উঠল শুধু। তবে সেই আলো,তার মন খারাপের কাছে বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি। বেজে বেজে কে*টে গেল,সাদিফ আবার দিলো। ধরল না পিউ। সাদিফ বেশ কয়েকবার টানা কল দিয়ে থামল। এতবার তো কল দিতে হয়না ওকে। সব ঠিকঠাক আছে তো?
সে গুরুতর ভঙিতে অনক কিছু ভাবে। তারপর ব্যস্ত হাতে ফোন করে পুষ্পকে।

‘ ইকবাল,ফোন বাজছে আমার। সরো। ‘
ইকবাল সরল না। বরং কাধে ঘনিষ্ঠভাবে মুখ গুঁজে বলল,
‘ উম ঘুমাও,ধরতে হবে না।’
‘ জরুরি ফোন হলে?’
‘ তাও না।’
পুষ্প বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
‘ তোমার মত একটা হাতি আমার গায়ে হাত পা তুলে দিলে আমি নিঃশ্বাস নিতে পারি ইকবাল? একটুত মায়া করো।’

ইকবাল চোখ বুজে রেখেই বলল,
‘ এত কষ্টর ফল তুমি মাই লাভ! আমার যদি আরো চারটে হাত- পা থাকতো আমি তো সেটা দিয়েও তোমায় অজগরের মত পেচিয়ে রাখতাম ।’
‘ হ্যা,তারপর গি*লে খেতে নিশ্চয়ই? ‘
‘ ছি! ছি! মেয়েটা কী সব বাজে কথা বলে। ‘

পুষ্প দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এদিকে রিংটোনের লাগাতার স্বরে তার মাথা ধরেছে। সাদিফ ওর সাড়া না পেয়ে চিন্তায় পড়েছে আরও। যতক্ষণ না ধরবে থামবে না হয়ত। পুষ্প ভাবুক কণ্ঠে বলল,
‘ এতবার ফোন দিচ্ছে কে? বাড়িতে কিছু হয়নিতো? এই পিউতো একা ঘুমিয়েছে, ও ঠিক আছে? ‘
ইকবাল সচেতন হয়। ওমনি সরে যায়। পুষ্প চটপট উঠে ফোন হাতে নিতেই দ্যাখে সাদিফের নম্বর। তাও অবিলম্বে রিসিভ করে বলল,
‘ হ্যালো ভাইয়া,বাডিতে সব ঠিক আছে?’
সাদিফ গলা ঝেড়ে বলল,
‘ হু? হ্যাঁ। হ্যাঁ সব ঠিক আছে। তোরা, তোরা ঠিক আছিস?’
‘ আমরা তো ঠিক আছি। ‘
‘ ঘুমিয়ে পড়েছিলি? ‘
‘ না না জেগে ছিলাম। খেয়েছো তুমি? বাড়ির সবাই কী করছে?’
‘ খেয়েছি। শুয়ে পরেছে সবাই। তোরা খেয়েছিস?’ ‘ ‘হ্যাঁ। ‘
সাদিফ একটু থামল। শুধাল,
‘ পিউ কোথায়?’
কণ্ঠ অপ্রস্তুত শোনাল তার। পুষ্প সহজ গলায় বলল,
‘ ওতো রুমেই। ঘুমোচ্ছে হয়ত। বলে গেল ঘুম পেয়েছে খুব।’

সাদিফ মনে মনে বলল, ‘ ও,এইজন্যেই মহারানী ফোন ধরছেন না।’
মুখে বলল,’ ওহ।’ এঞ্জয় করছিস কেমন?’
‘ দারূন! তুমি এলে আরো মজা হতো।’
ইকবাল ফিসফিস করে বলল,
‘ মোটেইনা। তখন ধূসর-পিউ প্রেম করতে পারতো না এরকম।
পুষ্প চোখ রাঙিয়ে থামতে বোঝাল। সাদিফ শোনেনি, হাসল সে। তার চিন্তা শেষ । বলল,
‘ আচ্ছা,তাহলে ঘুমিয়ে পড়। শুভ রাত্রী। ‘
‘ শুভ রাত্রী। ‘

পুষ্প লাইন কাট*তেই ইকবাল বলল,
‘ সাদিফকে একটা বিয়ে করিয়ে দেয়া দরকার। বেচারা সিঙ্গেল বলে রাত বিরেতে কাপল দের ফোন করে।’

পুষ্প কপাল কুঁচকে বলল, ‘ তাতে তোমার সমস্যা কী?’
‘ আমার সমস্যা কী মানে? ইটস টাইম ফর রোমান্স মাই লাভ। আর রোমান্সে কেউ ডিস্টার্ব করলে সমস্যা হবে না?’

‘ কীসের রোমান্স?ঘুমাও। সকালে সূর্যদয় দেখতে যাব।’
ইকবাল লাইট নেভালো দুরন্ত হাতে। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,’ হানিমুনে এসে কেউ ঘুমায়না মাই লাভ। ‘
তারপর চট করে পুষ্পকে শুয়ে দিয়ে আধশোয়া হলো ওর ওপর। পুষ্প ভড়কেছে প্রথমে,তারপর হেসে ফেলল। ইকবালের মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল,’ পাগল!’
সে নির্দ্বিধায় জানাল,’ তোমার জন্য!’

____

পিউ এপাশ- ওপাশ করছে। সারাদিন ম*রার মত ঘুমিয়ে এখন আর ঘুম আসছেনা।
আবার ধূসর ভাইয়ের শোকে মনটাও পু*ড়ছে। কী সুন্দর মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি এসে ধরা দিয়েছিল হাতে। মনের মধ্যে থাকা অস্তমিত সূর্যটা লাফিয়ে উঠেছিল অম্বরে। প্রথম বার ধূসর ভাই নিজে থেকে এসে জড়িয়ে ধরলেন। আর সে? পিউ রাগে- দুঃ*খে কেঁ*দে ফেলল না শুধু। তবে আফসোসে বুক জ্ব*লছে এখন। নিজেকে কষে কিছু চ*ড়-থাপ্প*ড় মা*রতে পারলে শান্তি পেত।

চারদিক তখন শূনশান। গভীর রাত। সাগরের অল্প স্বল্প গর্জন আসছে কানে। এর মধ্যেই বাইরে থেকে দলীয় কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ এলো। পরপরই এলো দূর থেকে শিয়ালের ডাক। দুই তারস্বরের মিশ্রণ শুনতেই পিউ চোখ প্রকট করল। কক্সবাজারে কী শিয়াল ও ঘুরতে এসেছে? দিনের বেলায় কোথায় ছিল ওরা? ঝাউবনে?

শব্দ ক্রমে ক্রমে বাড়ছে। নিস্তব্ধ রাত,আর নীরব কামড়ায় ওমন ডাক ভূতুড়ে সিনেমার কথা মনে করাল তাকে। ঠিক যেন ভূতের গোঙানীর মত লাগছে এসব। পিউ ভ*য়ে ভ*য়ে থাই গ্লাস দিয়ে বাইরে তাকাল৷ বিদ্যুৎ বেগে আবার দৃষ্টি ফেরাল। মনে হচ্ছে, কাঁচ ফেটে উড়ে আসবে ওরা। তাকে ছিড়ে-খুঁ*ড়ে কলিজাটা বের করে খাবে।

পিউয়ের ঘাম ছুটল। অনুভব হয়,অশরীরী হাঁটছে ঘরে। সে তড়াক করে উঠে বসে, ত্রস্ত হাতে আলো জ্বালাল। পরিপাটি রুমটাকে আবিষ্কার করল শিয়ালের গর্তরূপে। যেন পাল ধরে ওয়াশরুম ছেড়ে বেরিয়ে আসবে ওরা।
বাড়িতে তো একাই শোয়। একটুও ভ*য় লাগে না। এখন এত ভ*য় পাচ্ছে কেন তবে ? অবশ্য ওই ঘর, ওই বাড়ি তো জন্ম থেকে দেখছে। আর সেখানে এই জায়গায় সম্পূর্ন নতুন।

শিয়ালের ডাক একটু পরপর থামলেও, কুকুর গুলোর বিশ্রাম নেই। যেন ভীষণ চটেছে কারোর ওপর। নিরন্তর উচ্চশব্দে ঘেউঘেউ করছে। কোনওটা আবার সুর দিয়ে ডাকছে।

পিউয়ের আত*ঙ্কে হাত পা জমে আসছে। না,এই ঘরে একা থাকা সম্ভব না ওর। সে ছটফটে পায়ে দরজা খুলল শব্দ করে। তারপর ধুপধাপ করে দৌড়ে বের হলো। সোজাসুজি পুষ্পর দরজায় এসে ধা*ক্কা দিতে গিয়েও থমকাল।
মাথায় এলো,পূষ্প তো একা নেই, ইকবাল ও সাথে। এই মাঝরাতে ওদেরকে বিরক্ত করা ঠিক হবে? পুষ্প তার নিজের বোন হলেও, ইকবাল ভাই বিরক্ত হতেই পারেন! নতুন বিয়ে হয়েছে, সেখানে কিছু প্রাইভেসি দেয়া উচিত।

পিউ অসহায় হয়ে পড়ল। দুপাশে সাড়ি সাড়ি রুমের, মাঝের সরু রাস্তাটায় অবলার মত দাঁড়িয়ে থাকল। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে মেঝের দিক চেয়ে রইল। ভীষণ কা*ন্না পাচ্ছে! মায়ের কথা মনে পড়ছে। আচ্ছা, ধূসর ভাইয়ের কাছে যাবে একবার?

তার মস্তিষ্কের ভাবনা মস্তিষ্কে থাকল। হ্যাঁ – না উত্তর বের হওয়ার আগেই কারো দরজা খট করে খুলল। হঠাৎ শব্দে পিউ চমকে তাকায়। সেকেন্ডে পেটানো শরীরের অধিকারী ধূসর বেরিয়ে আসে। তার চোখেমুখে উৎকণ্ঠা। পিউয়ের দরজা খোলার শব্দ,পায়ের আওয়াজ কর্নকুহর হতেই এই আগমন। ওকে বাইরে দেখে দরজায় থমকাল।
কন্ঠ শান্ত রেখে বলল’ এখানে কী করছিস?’
পিউ কথা বলল না। চুপচাপ চেয়ে রইল।
ধূসরের মুখবিবর অশান্ত,উদগ্রীব। এই নিশ্চুপতায় মাত্রা ছাড়াল যা।
অস্থির লোঁচনে এক পল দেখে এগিয়ে এলো। শুধাল,’ শরীর খারাপ লাগছে?’
পিউ চোখ নামিয়ে মাথা নাড়ল দুপাশে।
‘ তাহলে কী?’
পিউ ঢোক গি*লে ছোট কণ্ঠে জানাল,’ ভ*য় লাগছে! ধূসর ভ্রু বাঁকায় ‘ কীসের ভ*য়?
পিউ থেমে থেমে বলল,’ ভূত,ভূতের ভ*য়।’
তারপর তাকাল। ধূসরের ক্ষুদ্র শৈলপ্রান্ত বাঁকা দেখে উদ্বেগ নিয়ে বলল,
‘ কী জোরে জোরে শিয়াল ডাকছে! আবার কুকুর গুলো জুটেছে সঙ্গী। আমার মনে হচ্ছে ভূত আমার রুমের মধ্যে ঘুরছে। হাঁটছে। আমি ওখানে কিছুতেই শুতে পারব না। দেখা গেল ঘুমিয়েছি, সকালে আর নিজেকে খুঁজে পেলাম না। ‘
বলতে না বলতে ফের ডাক শোনা যায়। পিউ ভয়া*র্ত গলায় বলল, ‘ ওই দেখুন, এখনও ডাকে।’

ধূসরের চেহারা অপরিবর্তিত। সে বিরক্ত কী না চোরা নেত্রে চেয়ে বোঝার প্রচেষ্টা করল পিউ। কিছুই না বুঝে আবার নীচে তাকাল।হাত কচলাল।

ধূসর ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,,
‘ আমি সাথে যাচ্ছি,চল। ‘
‘ ঘুমিয়ে পড়লে চলে আসবেন?’
‘ পাহাড়া দিতে বলছিস?’
পিউ জোরে জোরে মাথা নাড়ল
‘ না না। ‘
তারপর মিনমিন করে বলল,
‘ আপনি চলে আসার পর যদি মাঝরাতে ঘুম ভা*ঙে? আবার ভ*য় লাগে,তখন? আমি ভ*য়ে মরে যাবনা? ‘

এ যাত্রায় ধূসরের অভিব্যক্তি বদলাল। মেঝের দিকে ভাবুক নজরে চেয়ে রইল। যেন সিধান্ত নিচ্ছে কত কিছুর। একটু চুপ থেকে বলল,
‘ আয়।’
বলে নিজের রুমে ঢুকল। পিউ নীচের ঠোঁট চে*পে ধরে চেয়ে রয়। ধূসর ভাই কি ওনার ঘরে যেতে বললেন? ভেবে ভেবে পা বাড়াল।
ভেতরে ঢুকতেই ধূসর বিছানা দেখিয়ে বলল,
‘ ঘুমিয়ে পড়।’

পিউ অবাক হয়ে বলল,’ এখানে?’
‘ খাটের নীচে। ‘
পিউ থতমত খেয়ে বলল, ‘ না মানে,তবে আপনি কোথায় শোবেন?’
ধূসর চোখ কুঁচকে তাকাল,
‘ এত কথা কীসের? ঘুমাতে হলে ঘুমা।’
পিউয়ের মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। ধূসর ভাই তাহলে সত্যিই রেগে আছেন? একবার হা করে কিছু বলতে গিয়েও বলল না। উলটে রে*গে গেলে!
ধূসর ভাই কোথায় শোবেন, অনুচিন্তনে মাথা খা*রাপ হয়ে গেল পিউয়ের। ধম*ক খেয়ে কথা বাড়াল না। মনঃদ্বিধা নিয়ে বিছানায় উঠল। বালিশে মাথা রেখে ওপাশ ফিরে শুলো। টের পেলো ধূসর দরজা খুলছে। সে ত্রস্ত এপাশ ফিরে বলল,’ কোথায় যাচ্ছেন?’
‘ আসছি।’

পিউয়ের ঘরের দরজা হা করে খোলা ছিল। ধূসর লক লাগিয়ে ফিরে এলো। পিউ উঠে বসে পরেছে এর মধ্যে। ধূসর বলল
‘ ভয় নেই,ঘুমা।’
বলতে বলতে নিজে টানটান হয়ে শুলো ডিভানে। মাথার নীচে দুহাত রেখে চোখ বুজল। পিউ আস্তে ধীরে শোয়। বেশ কিছুক্ষণ পর ধূসরের দিক ফিরে তাকায়। বালিশে দুহাত লাগিয়ে গাল ছোঁয়ায় সেখানে। ধূসরের চোখ বন্ধ। ঘুমিয়ে পরেছে। পিউ সেই সুযোগ লুফে নিলো। মনের সম্পূর্ন যোগ দিয়ে নিরীক্ষণ করল তাকে। দুই ঠোঁট ভরে এলো হাস্য জোয়ারে । ধূসরের ভ্রু,গভীর নেত্র,পাতলা ঠোঁট, গাল,গলা, অভঙ্গুর চিবুক,তার ফেঁপে ওঠা দুই পেশি একনিবিষ্টে অবলোকন করল৷ কত সুন্দর তার ধূসর ভাই! আর এই সুন্দর মানুষটা শুধুই ওর।
সে যখন মুগ্ধতায় বিভোর,বিমোহিত,ভুলে গিয়েছে সব, ধূসর আচমকা গম্ভীর স্বরে বলল,
‘ এভাবে তাকিয়ে থাকবিনা। ‘
পিউ ভ্যাবাচেকা খেয়ে নড়ে উঠল। ধূসর চোখ খোলেনি৷ মুখভঙ্গিও স্বাভাবিক। তবু পিউ ঘাবড়ে গেল৷ গরমের মধ্যেও তড়িঘড়ি করে কম্বলে মুখ ঢেকে ওপাশ ফিরে ভাণ ধরল ঘুমানোর।

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে