এক সমুদ্র প্রেম পর্ব-৪০+৪১

0
1626

#এক_সমুদ্র_প্রেম!
লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(৪০)

টিকটিক করতে করতে ঘড়ির কাঁটা বারোটায় থেমেছে। সিকদার পরিবারে খানিকক্ষণ আগেই বয়ে গিয়েছে এক বিরাট, সুপ্ত ভয়া*নক কালবৈশাখি। ঝড়ের তা*ন্ডব একটুর জন্য রেহাই দিলো পুষ্প আর ইকবালকে। তাদের সাবলীল,সুন্দর জীবন অল্পের জন্য মুক্তি পেলো এলো মেলো হওয়ার হাত থেকে। সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমত অবশেষে বর্তেছে।

আমজাদ সিকদার হার মেনেছেন। মেনে নিয়েছেন ওদের ভালোবাসাকে। অবশ্য,মেনে নিতে বাধ্য হলেন এক প্রকার। মেয়ের অশ্রুসিক্ত চোখ-মুখ হৃদয়ে অগাধে দাগ কে*টেছে। আনাচে-কানাচে মানবিকতা আর পিতৃত্ব ছুটেছে। মিনা বেগমর ‘ মেয়ের সুখই আমাদের সুখ’ কথাটা তীক্ষ্ণ ভাবে আঘা*ত করেছে বিবেকের দ্বারে।
মন আর মর্জির বিরুদ্ধে গিয়ে বড় ক*ষ্টে,নারাজ ভঙিতে হ্যাঁ বলেছেন তিনি। অথচ ইকবাল,তার অপছন্দের তালিকায় সারাজীবন থাকবে। সেখান থেকে এই ছেলের নাম মোছার সাধ্য নেই কারো। তবুও চাইছেন,ছেলেটা সুখে রাখুক তার মেয়েকে।

আমজাদ সোফায় থম ধরে বসে আছেন। বাকীরা সবাই ঘিরে দাঁড়িয়ে ওনাকে। চেহারার জলদগম্ভীর দশা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছে,লোকটা এখনও মন থেকে মেনে নিতে অক্ষম। টু শব্দ করছে না কেউ। ইকবাল আমোলেই নিচ্ছে না এসব। তার আনন্দ নিরন্তর। শত কাঠখড় পু*ড়িয়ে হলেও পুষ্পকে পাবে এই ঢেড়। বাকী সব গোল্লায় যাক। হিটলার শ্বশুর খুশিমনে মেয়ে দিক,বা জোর করে,দিলেই হবে।

মিনা বেগম রয়ে সয়ে স্বামীর মুখের সামনে শরবতের গ্লাস বাড়িয়ে ধরলেন। তিনি এক পল স্ত্রীর দিক চেয়ে হাতে নিলেন সেটা। আস্তেধীরে চুমুক দিলেন। চোখের কোনা দিয়ে একবার তাকালেন হাতের বাম দিকে।
ইকবাল বিজয়ী হেসে বারংবার ধূসরকে জড়িয়ে ধরছে। যতবার গায়ে গা মিলছে ওদের, পিত্তি সহ জ্ব*লে যাচ্ছে ওনার। এত ঢংয়ের কী আছে? এই আদিখ্যেতা কীসের? মেয়েটাকে দিতে রাজী হয়েছে বলে তার ভাইপোর গলা সাপের মত জাপ্টে ধরবে? আশ্চর্য ছেলে তো!
এই বিরক্তিকর ছেলের ভেতর কী দেখল তার মেয়ে?
তিনি পুষ্পর দিকে ফিরলেন এবার। মেয়েটার, রিক্ত, সিক্ত চেহারা এখন নক্ষত্রের ন্যায় জ্ব*লছে। ঠোঁটে হাসির অভাব নেই। মুখমন্ডলে পরিষ্কার, সে কতটা খুশি! আমজাদের রা*গটুকু পরে গেল। যাক! মেয়ের আনন্দেই সে আনন্দিত। মেয়েটা ভালো থাকলে আর কী চাই?
রুবায়দা বললেন, ‘ আপা সবাইকে খেতে দেই?’
‘ হ্যাঁ হ্যাঁ। চল ব্যবস্থা করি।’
যেতে যেতে ধূসরকে বললেন, ‘ ইকবালকে নিয়ে বোস ধূসর। খাবার আনছি।’

ইকবাল আপত্তি জানিয়ে বলল,’ আন্টি আমাকে বেরোতে হবে। আজ খেতে পারব না।’
‘ ওমা কেন বাবা? খাবেনা কেন?’
আমজাদ সিকদার বিড়বিড় করে বললেন,
‘ দিনরাত এ বাড়ির ছেলে-মেয়ের মাথা খেলে পেটে জায়গা থাকে না কী?’

সে কথা কর্নকুহর হলো না কারো। ইকবাল হেসে বলল,
‘ আসলে অনেক রাত হয়েছে তো,আম্মু কল দিচ্ছেন বারবার। রাতে ঘরে গিয়ে না খেলে দেখব ঠিকই বসে আছে আমার জন্য।’
রুবায়দা বললেন, ‘ অল্প কিছু…. ‘
‘ না আন্টি,অন্য দিন। এরপর তো আসা যাওয়া থাকবেই।’

আমজাদ কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালেন। ভাবলেন,
‘ কী বেহায়া ছেলে! ‘
ধূসর বলল,’ একা যেতে পারবি?’
‘ আরে হ্যাঁ। তুই বিশ্রাম কর। আমি আসি এখন।’

ইকবাল আড়চোখে পুষ্পর দিকে একবার তাকাল। এতেই ভীষণ লজ্জা পেল মেয়েটা। চিবুক গিয়ে ঠেকল গলদেশে।
ইকবাল আমতা-আমতা করে আমজাদকে শুধাল,
‘ কাল তাহলে আব্বু -আম্মুকে পাঠাচ্ছি আঙ্কেল?’

তিনি আরেকদিকে মুখ ঘুরিয়ে উত্তর দিলেন,’পাঠিও।’
ইকবাল কপাল কোঁচকায়। মনে মনে বলে,
‘ এই হিটলার ব্যাটা আস্ত একটা বদ, ভা*ঙবে তবু মচকাবে না।
পরমুহূর্ত ভাবল,
‘তাতে আমার কী,শ্বশুর হোক যেমন তেমন,বউ আমার মনের মতন।’
ইকবাল হাসল। কী একটা ভেবে চিন্তিত ভঙিতে ধূসরের দিক তাকিয়ে বলল,
‘ কাল বাবা -মা আসবে কী করে ধূসর? তুইত সকালে সিলেট যাবি বললি!’

এ পর্যায়ে সবার নজর তার দিকে পড়ল। ধূসর বলল, ‘ আমি না থাকলেও বা,সবাইতো থাকবে।’
‘ তুই থাকা আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ‘

ধূসর ফিচেল হাসে, ‘ তাই?’
ইকবালের সুদৃঢ় জবাব ‘ অবশ্যই।
তারপর আমজাদের দিক চেয়ে বলল,
‘ আঙ্কেল, ওনাদের পরের শুক্রবার আনি? ধূসর ফিরুক?’
আমজাদ কিছু বলার আগেই ধূসর বলল,
‘ থাক,দরকার নেই। আমি সিলেট যাচ্ছি না।’
ইকবাল অবাক হয়ে বলল ‘ তবে যে বললি?’
‘ মিথ্যে বলেছিলাম।’
আফতাব নড়েচড়ে শুধালেন ‘ কেন?’
ধূসরের ভণিতাহীন জবাব,
‘ ইকবালের মুখ থেকে কথা বের করতে।’
আমজাদ সিকদার দ্বিতীয় বার বিরক্ত হলেন। আরেকদিকে ফিরে থাকলেন। প্রত্যেকে অবাক হলেও, ইকবাল বিস্ময়ে স্তব্ধ। বাকরুদ্ধ হয়ে কথা বলতে পারল না। ধূসর ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ হা করে না থেকে বের হ।’

সম্বিৎ ফিরল তার। বন্ধুর প্রতি মনে প্রাণে কৃতজ্ঞতায় লুটোপুটি খেল। ঠোঁট কামড়ে হেসে তাকিয়ে রইল কিছু ক্ষন। বলল,
‘ আসছি,কাল দেখা হবে।’
ধূসর বিনিময়ে ঈষৎ বেগে হাসে। চেয়ে চেয়ে দ্যাখে প্রিয় বন্ধুর প্রস্থান।

ইকবাল ঢুকেছিল যতটা উদ্বীগ্ন,অশান্ত মনে, বেরিয়েছে ততটাই ফুরফুরে মেজাজে। সে লাফিয়ে লাফিয়ে সিড়ি বেয়ে নামে। পুষ্পর ফোনে মেসেজ পাঠায়,
‘ আর কিছু দিন মাই লাভ,তারপর ইকবালের লোমশ বুকে তোমার জন্য পার্মানেন্ট একটা ঘর বানাব। ‘

পুষ্প উশখুশ করতে করতে সবাইকে একবার করে দেখল। সন্তর্পনে, খুব আস্তে, পা টিপে টিপে সিড়ি বেয়ে উঠল। কক্ষের সামনে এসেই, এক ছুটে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়াল। উঁকি দিলো সোজা মেইন গেটের ওপর। ইকবাল হেলেদুলে যাচ্ছে। পেছনের চুল দুলছে বায়ুতে। পুষ্প তৃষ্ণার্ত চোখ মেলে চেয়ে রয়। ইকবাল গাড়ির দরজা খুলতে গিয়ে কী মনে করে থামল। ঘুরে,একদম সোজাসুজি দোতলার বারান্দার দিকে তাকাল। ঠিক যা ভেবেছিল তাই,পুষ্প দাঁড়িয়ে আছে দেখে হেসে ফেলল সে। অতদূর থেকেই ভ্রু উঁচাল। পুষ্প মুচকি হেসে হাত নেড়ে বিদায় জানায়। ইকবাল হাত উঁচাল না। উলটে ফ্লাইং কিস ছু*ড়ে মা*রল তার দিকে। পুষ্প নড়ে উঠল। কুন্ঠায়,গাল দুটো লাল হয়ে আসে। হেসে মাথা নামিয়ে নেয়। ইকবাল মুক্ত,প্রশান্ত শ্বাস নিয়ে,উঠে বসল গাড়ির ভেতর।

‘ বাবাহ, কত প্রেম!’
হঠাৎ কথায় পুষ্প চমকে তাকায়। পিউ মিটিমিটি হেসে বলে,
‘ এক কাজ কর,তুইও ভাইয়ার সঙ্গে চলে যা। ‘
পুষ্প ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ বড় বোনের প্রেম করা দেখছিস? লজ্জা লাগছেনা?’
পিউ দুদিকে মাথা নাড়ল,
‘ একটুও না। প্রেম করতে পারলে দেখতে পারব না?’
পুষ্প হাসল। তারপর নিশ্চিন্ত কণ্ঠে বলল,
‘ সব যে ভালোয় ভালোয় মিটছে এই অনেক তাইনা? আমিইত ভাবিইনি আব্বু রাজী হবেন।’
‘ আমিও না। ‘
পুষ্প স্নেহার্দ্র চোখে বোনের দিক চাইল।
‘ তুই খুব ক*ষ্ট পেয়েছিস? আব্বু মে*রেছেন যে!
পিউ লম্বা হাসল। মাছি তাড়ানোর মত হাত নেড়ে বলল,
‘ আরে ধুর! ক*ষ্ট পাব কেন? আব্বুইত মে*রেছে। ব্য*থা যা পেয়েছিলাম,তোর বিয়েটা হচ্ছে বলে সব শেষ! ‘
পুষ্প আপ্লুত হয়। বোনের ভালোবাসার গভীরতা হৃদয় দিয়ে মেপে নেয়। বিলম্বহীন জড়িয়ে ধরে দুহাতে। পিউ পালটা আকড়ে ধরল।
পুষ্প ওমনভাবেই আবদার করল,
‘ আজ থেকে আমার সাথে ঘুমাবি? ‘
‘ আচ্ছা।’

**
পিউ, পুষ্পর ঘর থেকে বের হতেই সামনে পরল সাদিফ।
ওকে দেখতেই ছেলেটা দীর্ঘ হাসল। ঝকঝকে, তকতকে শুভ্র দাঁত উঁকি দিল ঠোঁটগহবরের মাঝ থেকে। পিউ দাঁড়িয়ে গেল। সাদিফের হাসি দেখে বুকটা মুচ*ড়ে উঠল তার। এতক্ষনের ভালো মনটা ঝুপ করে খারা*প হলো। মায়াময়,পূর্ন দুই অক্ষি দিয়ে চেয়ে রইল। বক্ষপিঞ্জরের চারপাশটা হুহু করে উঠল দুঃ*খে। আপু, ইকবাল ভাইকে ভালোবাসে ঠিকই,কিন্তু সাদিফ ভাইতো আপুকেই ভালোবাসতেন। আহারে! মনটাই ভে*ঙে গেল ওনার।

পিউয়ের মুখ কালো দেখে সাদিফ ভুরু নাঁচাল,
‘ কী রে?’
তার ঘোর কা*টে,
‘ হু? না কিছু না।’
‘ ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন তাহলে? ‘
পিউ চোখ নামিয়ে ফেলল।
ইনিয়ে-বিনিয়ে শুধাল,
‘ ইয়ে,আপনার খুব খা*রাপ লাগছে, তাইনা ভাইয়া?’

‘ কেন? বিয়েটা হচ্ছেনা বলে?’
পিউ মাথা ঝাঁকাল। সাদিফের পুষ্ট অধর কানায় কানায় ভরে গেল তখন। কিছু না বলে পাশ কে*টে যেতে নিয়ে থামল আবার। পরপর পিউয়ের মাথার গোছানো চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল,
‘ বোকা! ‘

পিউ নির্বোধ বনে চেয়ে রইল। এই মুহুর্তে তার মনে হচ্ছে, সাদিফ ভাই শোকে,দুঃ*খে পাগল হয়ে গিয়েছেন। কাঁ*ন্নার বদলে দাঁত মেলে হাসছেন কেন নাহলে? ওনার তো মন খারা*প হওয়ার কথা। কেঁদেকে*টে টিস্যু বক্স শেষ করার জায়গায় আনন্দে লাফাচ্ছেন। বোকা মেয়েটার হৃদয়পট আক্ষেপে শেষ । দু তিনবার আহারে! আহারে! বিড়বিড় করল ওর যাওয়ার দিক তাকিয়ে। অগোছালো কেশরাশি গোছাতে গোছাতে সামনে ফিরতেই চমকে উঠল। একদম সম্মুখে দাঁড়িয়ে ধূসর। পিউ যত্রতত্র নুইয়ে গেল। অশান্ত মন, স্থির,অবিচল হলো। লাজুক ভঙিতে পল্লব ঝাপটে চুল গুজল কানে। চোরা চোখে একবার তাকাতে গিয়ে নাগাল পেল ধূসরের শ*ক্ত চিবুকের। ওই ধা*রাল নেত্রদ্বয় অবধি পৌঁছাতে, তার দৃষ্টিযূগল বিফল হয়।

তখনি ধূসর এগিয়ে আসে। যত কদম দুরুত্ব ছিল তার থেকে অর্ধহস্ত দুরুত্ব ঘুঁচিয়ে দাঁড়াল। পিউয়ের বক্ষস্পন্দন আকাশ ছুঁলো ওমনি। অনুভূতিরা মেঘ ছিদ্র করে ফাঁক গলে পালাল তখন,ধূসরের ঠান্ডা, নিরেট হস্ত খানা গাল ছুঁয়েছে যখনই।
শিউরে উঠল মেয়েটার সমস্ত শীর্ণ দেহ।
পিউ নিভু চোখে তাকায়। ধূসরের হাত থেমে নেই,বৃদ্ধাঙ্গুলি স্লাইড হচ্ছে সমগ্র গাল জুড়ে।

পিউয়ের পল্লব বুজে আসতে চায়। চোখ খুলে রাখতে পারেনা। সুরসুর করছে শরীর। তার গাল বেঁকে পৌঁছায় কানের কাছে।

ধূসর এক ভাবে তাকিয়ে আছে,তার ফর্সা গালের দিকে। তার অক্ষিপটের মায়া, পরপর মুখ ফস্কে বেরিয়ে এলো,
‘ ব্য*থা পেয়েছিলি?’
পিউয়ের চটক কা*টল। তখনি খেয়াল হলো, এই গালেই চ*ড়টা পরেছিল।
ওনার কি মায়া হচ্ছে তার জন্য? ক*ষ্টও পাচ্ছেন? পাবেননা কেন? উনিও যে ভালোবাসেন। বসার ঘরে যতক্ষন দাঁড়িয়ে ছিল সে,কতবার যে তাকিয়েছে মানুষটা! আর বাবা থা*প্পড় দেয়ার সময়, কী রকম করে চমকে উঠেছিল। চোখ খিঁচে বুজেছিল,যেন ওনার গায়েই লেগেছে।
সেতো সব দেখেছে,খেয়াল করেছে।

পিউ মিহি কণ্ঠে বলল ‘ পেয়েছিলাম,এখন শেষ।’
ধূসর বলল,
‘ কেন বলতে গেছিলি ওসব? জানিস তো তোর বাবা ইকবালকে পছন্দ করেন না।’

তার নিষ্পাপ উত্তর,
‘ ভুল করে বলে ফেলেছি ধূসর ভাই।’
ধূসর অন্য হাত উঠে এলো পাশের গালে। অনমনীয় অঞ্জলিপুট ভর্তি হলো পিউয়ের ক্ষুদ্রাকার মুখবিবরে।
দুটো টানা টানা চোখের দিক চেয়ে বিনম্র আদেশ করল,

‘ আর কখনও এরকম পরিস্থিতিতে কথা বলবিনা পিউ। পৃথিবী উলটে গেলেও চুপ করে থাকবি। আমিতো আছি,সব সময় থাকব। সমস্ত প্রতিকূলতার মোকাবেলা করতেও প্রস্তুত আমি। কিন্তু চাইনা,তোর ওপর একটা নখের আঁ*চড় ও লাগুক।’

পিউয়ের অন্তঃস্থল অবধি স্পর্শ করল কথাগুলো। ভালোবাসার দুঃসাহসিকতায় হঠাৎই ভীষণ সাহসী হলো সে। তার কোমল হস্তযূগল ধরে ফেলল ধূসরের অমসৃন কব্জি। ক্ষুর-ক্ষার চাউনীতে চেয়েই শুধাল,

‘কেন ধূসর ভাই,আপনার পাশে দাঁড়িয়ে আপনার সঙ্গ দেয়ার একটুও অধিকার কি আমার নেই?’

ধূসরের অভিব্যক্তি তৎক্ষনাৎ মসৃন হয়। সদর্পে শিথিল হয় নিরেট, শ্যামরঙা চিবুক। পরতে পরতে বিছিয়ে যায় নিরুপদ্রব হাওয়া। অন্তঃপটে এক শীতল স্রোতের কলকল শব্দ স্পষ্ট কানে লাগে। সেই আওয়াজ নিস্তব্ধ তরঙ্গের ন্যায় ঢেউ তোলে হৃদয়ে। পিউয়ের পাপশূন্য, রিনঝিনে কণ্ঠস্বর জলতলে ডুবি*য়ে ছাড়ে গম্ভীরতার জাহাজ।

চমৎকার করে হেসে ফেলল সে। দুদিকে ছড়িয়ে গেল পুরুষালি, পাতলা ঠোঁট।
অন্যরকম গলায় বলল,
‘ অধিকার ও বুঝিস! ‘
পিউয়ের কাছে সব তুচ্ছ। তার গভীর দুটো চোখ ধূসরের হাসি দেখতে ব্যস্ত। বক্ষ কাঁ*পছে,তোলপাড় হচ্ছে খুব। এই হাসি দেখেছে যতবার, খু*ন হয়েছে ততবার। এখানে একটুও কার্পণ্য করেনা মানুষটা। লেশ মাত্র মায়া দেখায়না। বারংবার নি*ষ্ঠুর ভাবে মার*তে উঠেপড়ে লাগে।

পিউয়ের সম্মোহনী দৃষ্টির দিকে খেয়াল পরতেই
ধূসরের হাসিটা কমে এলো। আজোলে বন্দী মেয়েটার স্নিগ্ধ আঁদল থেকে আলগা হলো বাঁধন। তার লম্বা শরীরটা স্বল্প নেমে আসে। কণ্ঠ নামল খাঁদে। অধড় নড়েচড়ে বেরিয়ে এলো কিছু হৃদয়কাড়া শব্দ,
‘ পৃথিবীর সব ভালোটুকু শুধু তোর থাকুক পিউ। তোকে স্পর্শ করতে আসা সমস্ত খা*রাপ,সমস্ত অ*নিষ্ট, আমায় তাদের নিশানায় রাখুক। ‘

পিউ তুষারের ন্যায় জমে গেল। রোমাঞ্চিত অনুভূতির ডিঙি নৌকা বিরাট পাল খুলে, ছেড়ে, উড়িয়ে দিলো। সেই পাল যতবার দুলল বাতাসে,ততবার তার কানে বাজল ধূসরের নাম। কল্পনায় ভাসমান হলো কিছু উচ্চাকাঙ্খা,কিন্তু কাঙ্ক্ষিত, প্রত্যাশিত স্বপ্ন।

বেহায়া মনের ইচ্ছে জাগল ওই চওড়া বুকে মাথা রাখবে একবার। সেই সুযোগ কি আর আসবেনা? কবে হুশ হারিয়ে ধরেছিল, ওটা কি গোনার মধ্যে পরে? একবার ভালোবেসে ধরলেই না হোতো!

পুষ্প ঘর থেকে বেরিয়েছে কেবল। দোরগোড়ায় ধূসর পিউকে এমন কাছাকাছি দেখে থতমত খেল। দুরন্ত পায়ে ঢুকে গেল আবার। পরক্ষনে মাথাটা বের করে উঁকি দিলো। মুখের কাছে হাত নিয়ে খুক খুক করে কাশি দিয়ে বলল,
‘ কেউ কি আছে এখানে?’

চমকে উঠল ওরা। পাশ ফিরে পুষ্পকে দেখেই দুজন দুজনের থেকে ছিটকে সরে গেল। পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে রইল দুদিকে। পুষ্প ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
‘ আমি কি যেতে পারি?’
ধূসর গম্ভীর কণ্ঠে বলল ‘ মার খাবি বেয়াদব।’
তারপর গটগট করে হেঁটে ঢুকে গেল নিজের রুমে। পিউ লজ্জ্বায় হাঁসফাঁস করছে। জ্বিভ কা*টছে বারবার। আপু দেখে নিয়েছে। নিশ্চয়ই আন্দাজ করবে কিছু । আল্লাহ,তারপর আম্মুকে বলে দিলেই ওর পিঠ শেষ। হাতা-খুন্তি সব ভা*ঙবে এখানে।
সে ছুটে পালাতে চাইল, এর আগেই পুষ্প হাত টেনে ধরে বলল,
‘ এই এই কই পালাচ্ছিস?
পিউ কাচুমাচু করে বলল,’
‘ পালাচ্ছি নাতো,এমনি। ‘
‘ এমনি? আমি তখন প্রেম করছিলাম বলে খুব তো কথা শুনিয়ে এলি,এখন এটা কী হচ্ছিল?’
পিউ ঘাবড়ে গেল। কাঁ*পা গলায় বলল,
‘ কী হচ্ছিল? ককথা বলছিলাম।’
পুষ্প ভ্রুঁ উঁচায়। অভিনয় করে দেখায়,
‘ এভাবে?গালে হাত রেখে,হাতে -হাত দিয়ে, একে অন্যের দিকে তাকিয়ে কেউ কথা বলে জানতাম না তো।’

পিউয়ের মাথা ঘুরছে। কপালে ঘাম জমেছে ভ*য়ে।
পুষ্প সন্দেহী চোখে তাকাল। এই দৃষ্টিতে অবস্থা আরও খারাপ হলো তার । ঠিক সেই সময় পুষ্প ভ্রু নাঁচায়,
‘ ভাইয়াকে ভালোবাসিস?’
পিউ চকিতে তাকায়। দুপাশে মাথা নেড়ে বলতে যাওয়ার আগেই পুষ্প সাবধান করল,
‘একদম মিথ্যে বলবি না। তুই যে ক্লাসে পড়িস,সেটা পার করে এসেছি।’
পিউ মিইয়ে গেল।
সে বলল, ‘ আমি কিন্তু সব জানি।’

পিউ অবাক হয়ে বলল ‘ কী জানিস?’
‘ তেমন কিছু না,তুই যে তিন বছর ধরে ভাইয়ার পেছনে ঘুরঘুর করছিস, এটুকুই।’

পিউয়ের চোয়াল ঝুলে পরে। চোখ বেরিয়ে এলো প্রায়। ভীত কণ্ঠে বলল,
‘ ইকবাল ভাই বলে দিয়েছেন?’
‘ ও কেন বলবে?’
‘ তাহলে কীভাবে জেনেছিস?’

পুষ্প রহস্য হেসে বলল ‘ সিক্রেট।’
আতঙ্কে পিউয়ের চোখমুখ শুকিয়ে আসছে। পুষ্প খেয়াল করে দমে গেল৷ মেয়েটাকে বেশি ঘাটানো ঠিক হবে না।
নিশ্চিন্ত করতে বলল,
‘ এত ভ*য় পাওয়ার কিছু নেই। আব্বু- আম্মুকে জানানোর হলে আগেই জানাতাম। ‘

পিউ কী বলবে জানে না। তার চিন্তা কমেনি। আমতা-আমতা করে বলল,
‘ আসলে আমার ধূসর ভাইকে খুব ভালো লাগে।’
‘ ভালো লাগে? না ভালোবাসিস?’
সে চোখ নামিয়ে স্বীকার করল, ‘ ভালোবাসি।’
পুষ্প ফিক করে হেসে ফেলল। পিউ ত্রস্ত মাথা উঠিয়ে বলল, ‘ তুই রাজী?’
‘ রাজী না হলে এতদিন ধরে কথাটা চে*পে রাখতাম?’

পিউয়ের নেতিয়ে যাওয়া চোখমুখ সচল হলো ওমনি।
মুখমন্ডল সোনালী রোদের ন্যায় ঝলমলায়। উত্তেজিত হয়ে দ্বিতীয় বার জাপটে ধরে বোনকে। পুষ্প হাসল। পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,
‘ ধূসর ভাইয়ার মতন মানুষ হয়না। তুই সুখী হবি।’

***
খাওয়ার টেবিলে শোরগোল হলো না আজ। একদম তটস্থ,শান্ত পরিবেশ। এত রাত করে খেতে বসায় রিক্ত, রাদিফ ঘুমিয়ে গিয়েছে। সুমনা দুটোকে জোর করে তুলেও খাওয়াতে পারেননি। পরাজিত হয়ে ক্ষান্তি দিলেন।
পিউ বসতে গেলে আমজাদ নরম গলায় বললেন,
‘ এখানে বোসো।’
সে অবাক হলো, তবে ধরা দিল না। সুস্থির বেশে বসল। পুরোনো অভিমানে ফুঁসে উঠল মন।
অথচ নির্বিকার আমজাদ গায়ে মাখলেন না। এটা -ওটা এগিয়ে দিতে থাকলেন । দুই মেয়ের থালায় নিজেই তুলে দিলেন ভাত।
বাড়ির সবাই দেখল এসব। প্রকাশ না করলেও মনে মনে বিমুগ্ধ হাসল সকলে। একজন পিতার কাছে কন্যা শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তার ছোট্ট রাজ্যের আদুরে রাজকন্যা। এই সম্পর্ক তো সবকিছুর উর্ধ্বে। সামান্য একটা থা*প্পড় , অল্পখানিক ধ*মকে এগুলো ফিঁকে হয়?

**

পরেরদিন সপ্তাহ ঘুরে আবার হাজির হলো শুক্রবার। এই শহরে চাকরিরত নব্বই ভাগ মানুষের অবসরের দিন এটি। সেই মোতাবেক সিকদার বাড়ি প্রতিটা ছুটির দিনে আরাম-আয়েশে জিইয়ে রইলেও আজকের সবটা ব্যতিক্রম। সকাল থেকে রান্নাবান্না, ঘর গোছানো, মোছা সব মিলিয়ে হুলস্থূল কান্ড বেঁধেছে। পুষ্পকে ঘর থেকে বাইরেও উঁকি মারার নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন মিনা বেগম। সকাল সকাল গোসল সেড়ে,লক্ষীটি হয়ে বসে থাকতে বলেছেন। পিউয়ের দায়িত্ব ওকে সাজানোর। তিনি,জবা,আর রুবায়দা মিলে হাত চালাচ্ছেন রান্নায়। ঘরের একজন নির্দিষ্ট আয়া,আরেকজন ছুটা আয়াতেও আজ আর কূলোচ্ছেনা । বিরাট দৈর্ঘ্যের খাবার টেবিল ভরিয়ে ফেলার পণ করেছেন সকলে।

সুমনার দায়িত্ব বাচ্চা সামলানো। রিক্ত আর রাদিফ ঘর অগোছালো করতে ওস্তাদ। ওদের দিকে নজর রাখাই আজকে তার একমাত্র কাজ

সবার মধ্যে ধূসর বাড়িতে নেই। কাকভোরে উঠে বেরিয়েছে সে। সাথে নিয়েছে অফিস রুমের চাবি। গতকাল পার্লামেন্টের উৎসবের জন্য কিছু ফাইল ঘাটার কাজ অসম্পূর্ন রেখে এসেছিল। যেগুলো দুদিনের মধ্যেই জমা করতে হবে। আরাম করে সময়টাকে নষ্ট করল না তাই। ছুটল বাকী কাজ সাড়তে।

সে বেরিয়েছিল একা। অথচ ফিরল সাথে আরো চারজনকে নিয়ে। এগারটার দিকে ইকবালের পরিবারের পা পরল চৌকাঠে। প্রফেসর খোরশেদুল আলম আর স্ত্রী মুমহতাহিনা বেগম। তিন ছেলে মেয়ে,ইকবাল, ইফাত আর নুড়ি। পঞ্চ সদস্যের ক্ষুদ্র পরিবার ওদের। নুড়ি সবে ক্লাশ ফাইভে উঠেছে। একেবারে পুতুলের মতোন দেখতে। ইফতি আর পিউ সমবয়সী। তবে পিউয়ের মত হ্যাংলা পাতলা নয়, বেশ স্বাস্থ্যবান।

আমজাদ সিকদারের চেহারা একদম স্বাভাবিক। তিনি নিজেই এগিয়ে গেলেন তাদের নিয়ে আসতে। আসুন, বসুন বলে সাদরে আমন্ত্রন ও জানালেন। ঘরের মেয়ে- বউরা ভালো জামাকাপড় পরে একদম পরিপাটি।

আওয়াজ শুনে পিউ, পুষ্পর ঘর থেকে দৌড়ে বের হয়। ওপর থেকেই উঁকি দেয়। সবাইকে সোফায় বসতে দেখে আবার ছুট্টে চলে যায়।
‘ আপু ওনারা এসে গিয়েছেন।’

পুষ্প আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে। বহুদিন পর মন ভরে সাজল সে। লাল কাতান শাড়ি, চোখ ভরা কাজল, মুখে অল্পস্বল্প মেক আপের আস্তরন,চিকন ঠোঁটে লাল টুকটুকে লিপস্টিক। পিউয়ের কথায় বিদ্যুৎ বেগে ঘুরে চাইল সে। ইকবাল এসেছে শুনেই কয়েক হাত গুঁটিয়ে গেল। লাজুক ভঙিতে ছটফ*ট করল। পিউ কপাল কুঁচকে বলল,
‘ এহ,লজ্জায় একেবারে লাউ ডগা সাপের মত লতিয়ে যাচ্ছে। প্রেম করার বেলায় লজ্জা লাগেনি?’

পুষ্প চোখ সরু করে বলল,
‘ তুই বুঝি খুব ভালো? ভাইয়াকে দেখলেই যে কেমন করিস আমি দেখিনি?’
পিউ থতমত খেল। মিনমিন করে বলল,
‘শুরু হয়ে গেল আমাকে খোঁচানো।’
পুষ্প আই- ঢাই করে বলল,
‘ আমার না সত্যি খুব লজ্জা লাগছে পিউ।’
‘ কেন?’
‘ জানিনা,ভ*য় ও করছে।’
পরমুহূর্তে চিন্তিত কণ্ঠে বলল ‘ আচ্ছা,আমাকে সুন্দর লাগছে তো?’
পিউ মিটিমিটি হেসে বলল,
‘ লাগছে। ইকবাল ভাই আজ তোকে দেখেই হা করে তাকিয়ে থাকবেন।’
পুষ্প কুণ্ঠা পেয়ে বলল ‘ যাহ!’
পিউ পাশে এসে দাঁড়াল , মেকি অভিমান নিয়ে বলল,
‘ তুই কিন্তু আমাকে এখনও বললিনা আপু।’
সে ভ্রু গোছায় ‘ কী বলিনি?’
‘ ওমা! কাল না কথা ছিল,যে ইকবাল ভাইয়ের সাথে প্রেমের শুরু থেকে সবটা বলবি আমাকে?’
‘ ও হ্যাঁ। আজকে রাতে শোনাব।’
‘ আচ্ছা।

সুমনা বেগম ঘরে ঢুকেই ব্যস্ত কণ্ঠে বললেন,
‘ তোরা গল্প করছিস? ও পুষ্প চল এবার। ওনারা দেখতে চাইছেন তোকে।’

পুষ্পর হার্টবিট ওমনি বন্ধ হবার উপক্রম হলো। ফ্যাসফ্যাসে অবস্থা ঘুরপাক গেল গলবিলে। আলগোছে শাড়ির কুঁচি ধরে পা বাড়াল। সুমনা বলেন ‘ দেখে,সাবধানে,পরে যাস না আবার। ‘
পুষ্প করূন নেত্রে তাকায়। শাড়ি পরে হাঁটতে হিমশিম খায় সে। সচরাচর পরেনা তাই। আজ মেজো মা জোর করে পরিয়ে দিলেন।
সুমনার হাতটা আকড়ে ধরে বলল,
‘ ও ছোট মা,ভ*য় লাগছে তো।’
‘ আরে ভ*য় কীসের? কিছু হবে না চল।’
তারপর হাঁটতে হাঁটতে বললেন,
‘ তুইত তাও ইকবালকে চিনিস,জানিস,শুধু ওর বাবা মায়ের সামনে যাবি এখন। আর আমার বিয়ের সময়ে আমি কাউকেই চিনতাম না। কোনটা যে বর তাই জেনেছি বিয়ে ঠিক হওয়ার একটু আগে।’

পিউ পেছন থেকে চোখ বড় করে বলল ‘ তাই?’
‘ হ্যাঁ। ‘
‘ কী সাং*ঘাতিক! এভাবে না জেনে বিয়ে করা যায় না কি?’
‘ যখন তোর বিয়ে হবে তখন বুঝবি!’
পুষ্পকে নিয়ে সুমনা এগিয়ে গেলেন সামনে। পিউয়ের কদম শিথিল হলো। দুপাশে দুলে দুলে হাসল। তার বিয়ে ওভাবে কেন হবে? ছোট মা তো আর জানেন না, ওর বর এই বাড়িতেই থাকে। বলতে গেলে জন্মের পর চোখ ফে*টে দেখেছে মানুষটাকে। ওইজন্য এরকম হওয়ার কোনও চান্সই নেই।

‘ তোর চাচা একটা ব্রিটিশ। কাল আমার সাথে কেমন করছিল,আর দ্যাখ আজ আমার বাপ মায়ের সঙ্গে কথা বলতে গেলে যেন মধু ঝড়ছে মুখে।’

ধূসর চোখ-মুখ অপরিবর্তিত রেখে বলল,
‘ যে যেরকম ব্যবহারের যোগ্য!’
‘ ঠিকই ব…. খেয়াল করতেই ইকবাল থেমে গেল। নাক ফুলিয়ে বলল,
‘ এভাবে বলতে পারলি?’
‘ পারলাম।’
‘ তুই আমার বন্ধু?’
‘ না,শত্রু।’
ইকবাল কথাটা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ এহ,এটা স্বয়ং ফেরেস্তা এসে বললেও বিশ্বাস করব না ভায়া।’
‘থাম এখন।’
‘ কথা বলাও নিষেধ?’
‘ তোর বউ আসছে।’
ইকবাল চোখ বড় করে এদিক- ওদিক চেয়ে বলল,
‘ কই কই।’
‘ গর্দভ! ওপরে দ্যাখ।’

ইকবাল ফটাফট সিড়ির দিকে তাকাল। পুষ্পকে এক পলক দেখেই বক্ষ কম্পিত হয়ে থমকে গেল। ভীষণ বিভ্রান্ত,ভয়ার্ত রুপসী এক কন্যা এগিয়ে আসছে তার দিকে। ইকবালের পিটপিটে আঁখিদ্বয় বাকী সবাইকে ছাড়িয়ে পরে রইল সেখানে। শাড়ি পরিহিতা মেয়েটি তার ঘুম কাড়তে যথেষ্ট। মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,
‘ মাশ আল্লাহ! মেয়ে তো নয়, যেন হুরপরি!’

ধূসরের দিক তাকাতেই দেখল তার চোখ-মুখ কোঁচকানো। সে বুঝতে না পেরে বলল ‘ কী?’
ধূসর ক্লান্ত শ্বাস ফেলে বলল,
‘ আমি ওর বড় ভাই ইকবাল,একটু লজ্জা রাখ।’
‘ তাতে কী হয়েছে? ওর ভাই পরে, আগে আমার বন্ধু তুই।’
পরপর দুষ্টু হেসে বলল ‘ সেতো তুই পিউয়েরও বড় ভা….’
কথা শেষ করার আগেই ধূসর সবেগে কনুই দিয়ে গুঁ*তো দিলে পেটে। অতর্কিত হাম*লায় ইকবাল ভাঁজ হয়ে নুইয়ে যায়। আ*হত স্থান চে*পে ধরে দুহাতে। ধূসর বুকের সাথে বাহু গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকে। তার চোখ বাকীদের দিকে। মুখভঙ্গি স্বাভাবিক। ইকবাল ধাতস্থ হলো,সোজা হয়ে পেট ডলতে ডলতে বলল,
‘ তুই ঠান্ডা মাথায় খু*ন ও করতে পারবি।’
‘ তোকেই করব ভাবছি। ‘
‘ এই না না, তোর বোন বিধ*বা হবে।’
ধূসর হেসে ফেলল। ইকবাল হেসে কাঁধ আকড়ে ধরল ওর। বলল,
‘ আমার বিয়ের সব কেনাকা*টা কিন্তু তুই করবি ধূসর। ‘
ধূসর মুখের ওপর বলল,
‘ পারব না। আমি মেয়ে পক্ষ।’
ইকবাল ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
‘ না,তুই ছেলেপক্ষ। তুই শপিং না করে দিলে আমি বিয়ে করব না।’
ধূসর ভ্রুঁ উঁচাল,’ তাই? বিয়ে করবিনা?’
ইকবাল দুঃখী মুখ করে বলল,
‘ তুই চাইলে করব না।’
‘ এসব অন্যদিক ফিরে বল ইকবাল৷ তোর মিথ্যুক চেহারা দেখার ইচ্ছে নেই।’
ইকবালের কিচ্ছু যায় এলো না এমন ভঙিতে বলল,
‘ ইচ্ছে না থাকলেও আমাকেই দেখতে হবে বন্ধু। তোমায় যে ইহজন্মে ছাড়ব না আমি।’
ধূসর সন্দিহান চোখে তাকাতেই সে চা*পা কণ্ঠে গান ধরল,
‘ বন্ধু তুমি,শত্রু তুমি,তুমি আমার জান।
খোদার পরে তোমায় আমি,দিয়েছি স্থান।’
ধূসর কপাল কুঁচকেই চেয়ে রইল। ইকবাল দাঁত কপাটি বের করে বলল,
‘ একটু হাস শালা,সরি সমন্ধি!’

পুষ্পকে নামতে দেখেই মুমতাহিনা উঠে গেলেন। কথা বার্তা ছাড়াই জড়িয়ে ধরলেন। পুষ্প কবুতর ছানার ন্যায় থরথর করছে। হাত পা সব কাঁ*পছে। নাক ঘামছে নার্ভাসনেসে। তিনি থুত্নী ধরে বললেন,
‘ মাশ আল্লাহ! মাশআল্লাহ!আমার ছেলের পছন্দ আছে।’
ইকবাল লজ্জা পেয়ে মাথা চুল্কাল। পুষ্প এত মানুষের মধ্যে চোখ তুলতে ব্যর্থ। নুড়ি এক লাফ দিয়ে সরে গেল। নিজের পাশ দেখিয়ে উত্তেজিত হয়ে বলল,
‘ ভাবিকে আমার পাশে বসাও আম্মু। আমার পাশে বসাও।’
‘ভাবি’ ডাক শুনে পুষ্পর ভেতরটা ধড়াস করে ওঠে৷ ভালোবাসার মানুষকে স্বামী হিসেবে পাবে,সে হবে বউ। এর থেকে পূন্যের কিছু পৃথিবীতে নেই।
তার পায়ের তলা অবধি শিরশির করছে। সবাইকে ছাপিয়ে কোনও মতে একবার তাকাতে চায় প্রিয় মানুষের দিকে। পেরে ওঠেনা। কুন্ঠার বেড়ি আটকে দেয় চক্ষু। পরে না হয় মন আর চোখ ভরে দেখে নেবে!
সুমনা ওকে নিয়ে সোফার দিক এগোলেন। পুষ্পর দৃষ্টি পা থেকে ওপরে ওঠেনা। চকচকে ব্যুট আর তকতকে স্যুট দেখেই ঠাওর করে ইনি ইকবালের বাবা হবেন। সে কোনও মতে তাকাল। আস্তে করে খোরশেদ আলমকে সালাম দিল। ভদ্রলোক মুগ্ধ হেসে উত্তর করলেন। বসার জন্য আবেদন জানালেন। নুড়ির পাশেই ওকে বসিয়ে দিলেন সুমনা। ছোট্ট মেয়েটা রাজ্য জয়ের ন্যায় হাসল। পুষ্পর হাত ধরে বলল,
‘ ভাবি কত সুন্দর! তাইনা ভাইয়া? ‘
ইফতির মন আর যোগ সিড়ির দিকে। পিউ দ্রুতপায়ে নামছে। বোনের কথায় চটক কে*টে বলল, ‘ হু হ্যাঁ! কেমন আছেন ভাবি?’
পুষ্প মিহি করে বলল ‘ ভালো। আপনি? ‘
‘ আমি আপনার ছোট, আপনি বলছেন কেন আল্লাহ? তুমি করে বলবেন।’
পুষ্প নীচু চেয়েই মাথা ঝাঁকাল। ইকবাল মন খারাপ করে তাকিয়ে দেখছে সব। এই মুহুর্তে পুষ্পর পাশে বসার তীব্র ইচ্ছে তার। নুড়ি যে হাতটা ধরে আছে,ওতেও হিং*সে হচ্ছে এখন। সে ওষ্ঠ উলটে রাখে শিশুর ন্যায়। মনে মনে চায়,
‘ একটু আলাদা কথা বলতে পাঠাক ওদের, প্লিজ!’

মুমতাহিনা পুষ্পর অন্য পাশে বসতে বসতে বললেন,
‘ ইকবাল আগেই আমাকে পুষ্পর ব্যাপারে জানিয়েছিল। ছবিও দেখেছিলাম ওর। আমিত সেই থেকেই পুষ্পকে মনে মনে ছেলের বউ ভেবে বসেছিলাম। কতবার বলেছিলাম,বাড়িতে নিয়ে আয় একটু মন ভরে দেখি। আনেইনি। বলত, সময় হলে সব হবে। কিন্তু তখনও জানতাম না,ও ধূসরের বোন।
কাল হঠাৎ গিয়েই পাগলামি শুরু করল ছেলেটা। বিয়ে করবে,বিয়ে করবে বলে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলল। তাও আবার ধূসরের বোন? আমরা তো আকাশ থেকে পড়লাম। ধূসরকে তো আমরা ছোট থেকেই চিনি। আপনাদের ব্যাপারেও শুনেছি। দেখা হয়নি এই যা!
ছেলের অবস্থা দেখে কাল রাতেই ওর বাবার সাথে আলাপ করলাম। তিনিও মত দিলেন। ব্যস, চলে এলাম পরিবার নিয়ে, মেয়ের হাত চাইতে। ছবিতে তো মনে হচ্ছে কমই সুন্দর দেখেছিলাম। মেয়ে একেবারে চাঁদের টুকরো আপা। আমার কিন্তু মন জুড়িয়ে গিয়েছে দেখেই।’

মিনা বেগম প্রসস্থ হেসে বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ! ‘
পুষ্প নতজানু থেকেই মৃদূ হাসল। বাবা,চাচা, বড় ভাইদের সামনে রূপের প্রসংশায় তার কী যে অবস্থা!
পিউ ঘুরে এসে বোনের পেছনে দাঁড়ায়। আড়চোখে একবার তাকায় ধূসরের দিকে। সে মানুষটা গম্ভীর নেত্রে অন্যদিক তাকিয়ে। একবার ওর দিক তাকালে কী হয়?
পিউ অনেকক্ষণ, একভাবে ধূসরকেই দেখে গেল শুধু । ওই সময়ের একটুও ধূসর ফিরল না এদিকে। যেন কসম কে*টেছে তাকাবে না। সে ছোট্ট শ্বাস ফেলে ইকবালের পরিবারকে দেখতে থাকে। আজই প্রথম দেখছে সবাইকে। ওর দিক একবার চেয়ে মুমতাহিনা শুধালেন,
‘ ওকি আপনার মেয়ে?’
আমজাদ বললেন, ‘ জি, ছোট মেয়ে।’
‘ হ্যাঁ পুষ্পর সাথে মিল আছে চেহারায়।’
পিউ হেসে সালাম দিলো। ভদ্রমহিলা হাসি বিনিময় করে উত্তর দিলেন। শুধালেন,
‘ কোন ক্লাশে পড়ো।’
‘ এইচ এস সি দেব এবার।’
‘ ওমা তাই,আমাদের ইফতিও তো পরীক্ষার্থী এবারে।’
ইফতি কে? ব্যাপারটা জানতে পিউ চারপাশে তাকাল। খুঁজে পেল একটা অপরিচিত মুখ। ছেলেটাও তাকিয়েছে তখন। অল্প হেসে আবার ফিরিয়ে নিল চোখ। পিউ অবাক হলো এই ছেলে ইন্টারে পড়ে জেনে। এতো ওকে ধরে দশটা আ*ছাড় মারতে পারবে। কলেজ পড়ুয়া ছেলে এত লম্বাচওড়া বাবাহ! অবশ্য আঙ্কেলও উন্নত স্বাস্থ্যের। ইকবাল ভাইযে ওনার মতোন হয়েছেন বোঝাই যায়।

খোরশেদ গলা খাকাড়ি দিয়ে বললেন,
‘ এবার তাহলে কাজের কথা শুরু করি আমজাদ ভাই?’
‘ জি।’
তিনি অনুমতি পেয়ে কৃতার্থ হাসলেন। বললেন,
‘ ইকবাল আমার বড় ছেলে। ওদের জ্ঞাতিগোষ্ঠী ভাইবোনের মধ্যেও বড়। ওর বিয়েই বলতে গেলে বংশে প্রথম বিয়ে। তাই আমাদের প্রত্যেকের ছোট খাটো শখ রয়েছে। ছেলের বিয়ে ধুমধাম করে দেব। সাথে মনে রাখার মতন হবে এমন আয়োজন করতে চাই আমি। তাই একেবারে আংটিবদল থেকে অনুষ্ঠান শুরু করতে চাইলে আপনাদের অসুবিধে নেইতো? ‘

আমজাদ হেসে বললেন ‘ জি না। তবে আমার সেজো ভাই আজমল, পনের দিনের মত বাড়িতে আছে। এরপর আসতে আসতে অনেক দেরী। এবারই এলো প্রায় ছয় মাস পর। তাই ও থাকাকালীন বিয়ের কাজ সেড়ে ফেলতে চাইছিলাম,যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে আর কী।’

খোরশেদ চায়ের কাপ রেখে বললেন,
‘ না না আপত্তি থাকবে কেন? যাতে আপনাদের সুবিধা তাই হবে।’
‘ তাহলে কবে করলে ভালো হয় বলুন তো!’

আমজাদ ভাইদের দিকেও দেখলেন উত্তরের আশায়। আজমল হাতের কড়ে হিসেব করলেন দিন তারিখ। তারপর জানালেন,
‘ ভাইজান,আজ তো শুক্রবার,এই সোমবার আংটিবদল করলে হয় না?’
‘ আমাদের তো সমস্যা নেই। কিন্তু ওনাদের….’

মুমতাহিনা বললেন ‘ আমাদেরও সমস্যা নেই।’
‘ তাহলে সোমবারই ফাইনাল হোক?’
‘ জি। আর বিয়ে?’

এ পর্যায়ে আমজাদের অভিব্যক্তি পাল্টাল। কপালে দেখা দিলো অনুচিন্তনের প্রগাঢ় ভাঁজ। থেমে থেমে বললেন,
‘ আসলে খোরশেদ ভাই,আমি একটা কথা তখন থেকেই বলতে চাইছিলাম। আপনারা কী ভাবে নেবেন বুঝতে পারছি না।’

ইকবালের গলা অচিরাৎ শুকিয়ে গেল। কী বলবে এই লোক? হিটলার শ্বশুর মেয়ে দিতে আবার বেঁকে বসবেন না তো?
সে উদ্বীগ্ন চোখে ধূসরের দিক তাকায়। ধূসরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি অন্য কোথাও গাঁথা। ইকবাল ভাবল, হয়ত পিউকে দেখছে। কিন্তু তাকানোর ধরণ দেখে পরক্ষনে বিভ্রান্ত হলো। দৃষ্টি অনুসরন করে নিজেও তাকাল। উৎসের মাথায় নিজের ভাই ইফতিকে দেখে শৈলপ্রান্ত বেঁকে এলো।
ওকে এইভাবে দেখছে কেন ধূসর?
খোরশেদ বললেন,
‘ আপনি নিশ্চিন্তে বলুন ভাই। আত্মীয়র মধ্যে আবার এত ফরমালিটি কীসের?।’

আমজাদ চুপ রইলেন। সবার মধ্যে চাপা উত্তেজনা ফুটে ওঠে তখন। ভীত হয় তারা। এমনকি পুষ্পও ঘাবড়ে যায়। কী বলবে আব্বু?
সবাই যখন ওনার দিকে চেয়ে,
তিনি সময় নিয়ে বললেন,
‘ দেখুন, পুষ্প আমার বড় মেয়ে,ওর বয়সও কম। মা চাচীদের স্নেহে,আদরে,তাদের ছায়ার বড় হয়েছে। একটা সংসার সামলানোর মত বোধবুদ্ধি ওর হয়নি। বলা যায়,পরিপক্কতা আসেনি।’
মুমতাহিনা মাঝপথে বলে উঠলেন,
‘ আপনি এসব নিয়ে ভাববেন না ভাই,আমি আপনার মেয়েকে বউ করে নিচ্ছিনা। নুড়ির মতো সেও আমার আরেক মেয়ে। আমার সংসার ওর সামলানোর ও প্রয়োজন হবেনা। ওরা ভালো থাকলেই আমার চলবে।’

আমজাদ বললেন ‘ আমি জানি আপা,আপনারা ভালো মানসিকতার মানুষ সে আমি শুনেছি। কিন্তু আমি এসব নিয়ে ভাবছি না। আমার কথাটা একটু শুনুন, পুষ্পর পড়াশুনা এখনও চলছে। আমি চাইছি ও পুরো অনার্স শেষ করেই একটা সংসারে পা রাখুক। বাবা হিসেবে মেয়ের জন্য এটুকু আমি চাইতেই পারি। তাই আমার ইচ্ছে, আপাতত ইকবালের সঙ্গে ওর কাবিন হয়ে থাকুক। লেখাপড়া শেষ করতে তো আর দু বছর। তারপরই তুলে দেব আপনাদের হাতে। ওবাড়ি গিয়েই না হয় মাস্টার্স করবে।’
পুষ্পর গলায় আটকে থাকা নিঃশ্বাসটুকু স্বস্তি হিসেবে বেরিয়ে গেল। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল যেন। অথচ ইকবালের মাথায় বাঁজ পরে। বিস্ফোরিত নেত্রে চেয়ে রয় সে।
‘ ভাই এটা কী হলো? তোর চাচা তো চালবাজি করলেন। আমার বউ আমাকে পুরোপুরি দেবেনা?’

ধূসরের নিরুদ্বেগ জবাব,
‘ মোটেও না পাওয়ার থেকে এটুকু ভালো। যা হচ্ছে চুপচাপ মেনে নে।’

ইকবাল আ*হত, নিহ*ত। বাধ্য হয়ে চুপ করে থাকল। পুষ্পর দিকে তাকাল অসহায় চোখে। এই অসাধারণ, মিষ্টি ফুলটা সে রেখে যাবে? হায় হায়!
তার তো শোকে গড়াগড়ি খেতে মন চাইছে৷ অথচ এই মেয়ের মুখে শোকের ছায়া অবধি নেই। কত স্বাভাবিক! তোমার কি খা*রাপ লাগছেনা মাই লাভ? জামাই রেখে দু বছর থাকবে শুনে ক*ষ্ট হচ্ছে না?

খোরশেদ, মুমতাহিনা মুখ দেখা-দেখি করলেন। শেষে বললেন ‘ বেশ,তাই হবে।’
আমজাদ নিশ্চিন্ত শ্বাস ফেলে বললেন ‘ ধন্যবাদ! তবে কাবিন হলেও বিয়ের মতই সব আয়োজন করব আমি। শুধু মেয়েটা নিয়ে যাওয়ার বদলে রেখে যাবেন আর কী।’

ওনার দুই ঠোঁটের হাসিটা ইকবালের অসহ্য লাগল। চোরের ওপর বাটপারি করে দিল এই লোক! চোখের সামনে দুটো বছর বউ রেখে দেয়ার শাস্তি দিয়ে দিলো। রাজনীতি তো এনার করার কথা! তা না করে ব্যবসায় নামলেন কেন? হুয়াই?

মুমতাহিনা ব্যাগ থেকে আংটি বের করে বললেন,
‘ এটা আমার তরফ থেকে তোমার জন্য উপহার।সম্পূর্ন আমার তরফ থেকে বুঝলে? এই আংটি দিয়ে আমার পূত্রবধূ হিসেবে তোমায় দলিল করে নিলাম কিন্তু ।’
বলতে বলতে আংটিটা ভরে দিলেন পুষ্পর অনামিকায়। সে সালাম করতে ঝুঁকলে আটকে দিলেন। কপালে চুঁমু খেয়ে বললেন,
‘ সুখী হও, আমার ছেলে যা উড়নিচণ্ডি! ওকে বেঁধে রেখো আঁচলে।’
মিনা বেগম অনেকক্ষন যাবত একটা কথা বলার জন্য উশখুশ করছেন। কীভাবে শুরু করবেন, কেউ যদি বলে দিতো!
শেষে অধৈর্য হয়ে মিনমিন করে বলে ফেললেন,
‘ ইয়ে,আপা,দেনাপাওনার বিষয়টা?’
মুমতাহিনা এমন ভাবে তাকালেন যেন ওনার জান চেয়েছে কেউ। খোরশেদ আর তার মূক দৃষ্টি দেখেই অপ্রস্তুত হয়ে পরলেন তিনি।
ভদ্রলোক অবাক কণ্ঠে বললেন,
‘ এসব কী বলছেন ভাবি? এ যুগে এসেও এমন কথা মানায়?’
‘ না আসলে আমি…..যৌতুক বোঝাইনি,উপহার বোঝালাম আর কী!
খোরশেদ তীব্র প্রতিবাদ করলেন,
‘ না না ভাবি,এটা আশা করিনি। উপহার আমার দরকার নেই। আপনার মেয়েইতো আমার জন্য আস্ত একটা দামী তওফা। তাছাড়া আল্লাহর রহমতে আমার যা আছে আমি তাতেই সন্তুষ্ট। আপনারা এরকম কথা মুখেও আনবেন না।’

ইকবাল বিদ্বিষ্ট ভঙিতে বিড়বিড় করে বলল,
‘ আপনাদের উপহার আপনারা রেখে, মেয়েটা দিয়ে দিন আমায়। ওটাই চাই আমার। ‘
আমজাদ মনে মনে মুগ্ধ হলেন ইকবালের পরিবারের প্রতি। খোরশেদ একটা পাব্লিক ভার্সিটির প্রফেসর। অনেক নাম-ডাক আছে তার। অনেকবার সামনা-সামনি দেখেওছেন ওনাকে। লোকটা আসলেই অমায়িক। তার আফসোস হলো,ইকবাল কে ওনার ছেলে ভাবতেই।
ছেলেটা বাবার মতো হলেই পারতো।

পিউ দাঁত বার করে হাসছিল। তার ভীষণ ভালো লাগছে। শেষমেষ ইকবাল, তার দুলাভাই হবে ভাবতেই ডগমগ করছে খুশিতে। আচমকা ইফতির দিকে চোখ পড়তেই হাসিহাসি ভাবটা কমে এলো। ছেলেটা তাকিয়ে ছিল না? চোখাচোখি হতেই তড়িৎ বেগে আরেকদিক ফিরল যেন।
পিউ ঠিকঠাক হয়ে দাঁড়াল। অপ্রস্তুত ভাবে ঘাড় চুল্কাল। কেন যেন মনে হলো,ইফতি ছেলেটা ওকেই দেখছিল এতক্ষণ।
পিউ ঘুরেফিরে আবার ধূসরের দিক তাকাল । মুহুর্তে মেরুদণ্ড সোজা করে ফেলল। মানুষটার ক্ষিপ্ত,কটমটে চাউনী জোড়া দেখেই ঘাবড়ে গেল। যেন এক্ষুনি তে*ড়ে এসে থা*পড়ে চোখ-মুখ অন্ধকার করে ফেলবে। পিউ বিভ্রান্ত হলো। এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন উনি? রাতেও তো ঠিকঠাক ছিলেন। কত কাব্যিক কথা শোনালেন! গাল ধরলেন। সে কি আবার কোনও অঘটন ঘটিয়েছে?
ওমন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই গতকাল রাতের পর থেকে এক এক করে সমস্ত ইতিহাস ঘাটতে শুরু করল পিউ। মাথা এলোমেলো করে ভাবতে থাকল,
‘ কী করেছি আমি?’

চলবে

#এক_সমুদ্র_প্রেম!
লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(৪১)

শীতকাল শেষের পথে। অল্প স্বল্প গরম পরছে এখন। সূর্যের তাপ চওড়া হচ্ছে। প্রখরতা বাড়ছে রোদ্দুরের। বসন্ত সবে সবে শুরু হওয়ায় ভূমন্ডল তখন নতুন রুপে সেজেগুজে তৈরি। মৃ*তের ন্যায় বৃক্ষের চূড়ায় দেখা দিয়েছে কচি সবুজ নব নব পল্লব। এ ডাল থেকে ও ডালে লাফিয়ে বেড়ায় চড়ুই। কোকিল ডাকে নিরন্তর। মাথার ওপর তাণ্ডব করা রবির তীব্রতায়ও এক মুহুর্তে মানুষের হৃদয় বশে নিতে সক্ষম এই সুর। আর এই দারূন,চমৎকার সময়টাতেই লেখা হলো ইকবাল-পুষ্পর মিলিত হওয়ার দিনলিপি। এক ঘর মানুষের শতধাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে ধার্য্য হলো তাদের বিয়ের দিন। আগামী সোমবার আংটিবদল, আর ঠিক সপ্তাহের মাথায় যে শুক্রবার আসছে,সেদিনই ওদের আকদ হবে। দিন- তারিখ ঠিক হতেই বসার ঘরে হিড়িক পরল মিষ্টি খাওয়ার। সবাই মিলে মিষ্টি মুখ করলেন। একে অন্যকে খাওয়ালেন। মুমতাহিনা উঠে গিয়ে কুটুমদের সাথে গলাগলি করলেন। সকলের ওষ্ঠপুটে যখন হাসির অন্ত নেই,পিউ তখন গভীর দুঃশ্চিন্তায়। সবাই যখন আমোদ,ফূর্তিতে মেতে, সে চিন্তিত মনে নখ কা*টছে দাঁত দিয়ে।
ধূসরের দিক চোখ পড়লেই বুক কাঁ*পছে। লোকটা রে*গে গেলে অক্ষি কোটর কেমন অস্বাভাবিক দেখায়। নাকের পাটা ফেঁপে ওঠে বারবার। এসব দেখলেই ওর রুহু উড়ে যায়। কিন্তু এখন সে করেছে টা কী? গতকাল রাতের পর বাড়ি থেকেও বের হয়নি। কোনও ছেলের সাথেও কথা বলেনি। কথা তো এমনিতেও বলে না। আজকেও লক্ষী হয়েছিল সারাদিন। তবে এইভাবে কটমট করে দেখছেন কেন উনি?
তার মাথা ফেঁ*টে চৌচির। গলা শুকিয়ে আসছে। ধূসর প্রচন্ড খা*রাপ মেজাজে বসে। এর মধ্যেই আচমকা ইকবাল উরুর ওপর খোঁচানো শুরু করে। ধূসর খেয়াল করেও চুপ থাকল। কিন্তু ইকবালের খোঁচাখুঁচি বাড়ছে। খিট*মিট করে তাকাল সে,
‘ কী সমস্যা?’
‘ এভাবে তাকাস না,ভ*য় লাগে।’
‘ সমস্যাটা কী?’
‘ বললে রা*গ করবি না তো?’
‘ শুনি আগে।’
ইকবাল মিনমিন করে বলল ,
‘ ইয়ে,পুষ্পর সাথে একটু আলাদা কথা বলব,সুযোগ করে দে না ভাই।’
ধূসর কঠিন কণ্ঠে বলল,
‘ আমি ওর বড় ভাই ইকবাল,হ্যাংলামো করিস না।’
ইকবাল মিনতি করল ‘ প্লিজ ভাই প্লিজ। অল্প একটু সময়, প্লিজ।’
ধূসর পরাজিত শ্বাস ফেলল। ফিরতি জবাব দিলোনা।
সবার মধ্যেই সোজাসুজি পুষ্পকে বলল,
‘ পুষ্প,এখানে বড়দের আলোচনা চলুক,তুই বসে না থেকে ইকবাল কে নিয়ে ছাদ থেকে ঘুরে আয় যা।’

মেয়েটা অপ্রতিভ ভঙিতে সবার দিকে তাকায়। ইকবালের দুগাল লেপ্টে সরে গেল দুদিকে। ধূসরকে কষে একটা চুমু খেতে পারতো যদি!
কেউ কিছু বলল না। পুষ্পর অস্বস্তি হচ্ছে। এত এত গুরুজনের মধ্য দিয়ে উঠে যাবে কী?
ধূসর তাগাদা দিলো ‘ কী হলো? যা।’
‘ হু? যাচ্ছি।’
সে আলগোছে উঠে দাঁড়ায়। নুড়ি লাফিয়ে বলল,
‘ আম্মু আমিও যাব ছাদে।’
ইকবালের হাসিটা দপ করে নিভল। মানা করার জন্য জ্বিভ নিশপিশ করল। সে তো প্রেম করতে যাচ্ছে,এমন বাচ্চা বোনের সামনে অসম্ভব যা।
পুষ্প হেসে বলল ‘ এসো।’
ইকবাল অসহায় নেত্রে ধূসরের দিক তাকায়। ধূসর কাঁধ উঁচাল। নীরবে বোঝাল, এখানে সে নিরুপায়।
নুড়ি উঠতেই যাচ্ছিল,মুমতাহিনা আটকে ধরলেন। মেয়েকে কোলে টেনে বসিয়ে বললেন,
‘ না মা এখন ছাদে অনেক রোদ। গেলে কালো হয়ে যাবে তুমি।’
নুড়ির মস্তিষ্কে বিশদভাবে কথাখানা ঢোকে।
কালো হওয়ার ভয়ে সে চা অবধি খায় না।
মাথা কাত করে বলল,
‘ আচ্ছা,যাব না।’
ইকবাল বিজয়ী হাসল। পাঞ্জাবি ঠিকঠাক করে উঠে দাঁড়াল। পুষ্প ভীষণ লজ্জায় নুইয়ে আছে তখন। নুড়িকে আটকে দেয়া মানে তাদের দুজনকে আলাদা সময় কাটা*তে বোঝানো। ইশ! সবাই কী না কী ভাবলেন!
পুষ্প তাড়াহুড়ো পায়ে হাঁটা ধরল। ইকবাল চলল পেছনে।
মেয়েটার পদযূগল ছাদের মেঝে ছুঁতেও পারল না, অধৈর্য হাতে পেছন থেকে জাপটে ধরল সে। পুষ্প ছোটাছুটি শুরু করল তৎক্ষনাৎ।
‘ ছাড়ো ইকবাল,আশেপাশে বাড়িঘর আছে,দেখে ফেলবে কেউ।’
ইকবাল ছাড়ল না। তার কণ্ঠ জড়ানো,বলল,
‘ দেখলে দেখুক,আমার বউ আমি ধরব,লোকের কী?’
‘ জি না,এখনও বউ হইনি। বিয়ে হতে এখনও এক সপ্তাহ বাকী। ‘
‘ ওই একই কথা।’
পুষ্প স্বর মোটা করল, ‘ তুমি ছাড়বে? ‘
ইকবাল চ সূচক শব্দ করে ছেড়ে দিল। পুষ্প সরে এসে মুখোমুখি তাকিয়ে বলল,
‘ ভাইয়াকে ছাদের কথা বলতে তুমি শিখিয়ে দিয়েছ তাইনা?’
‘ না। ওকে কথা শিখিয়ে দিতে হয়? ও নিজেই বলেছে।’
‘ এমনি এমনি বলেছে বিশ্বাস করব? পেছনে কলকাঠি নেড়েছ না?’
ইকবাল কলার ঠিক করে বলল ‘ তা একটু নেড়েছি। এত পার্সোনালিটি তোমার ভাইয়ের,ইমোশোনাল ব্ল্যাকমেইল না করলে লাভ হয় না।’
‘ এরকম করার কী দরকার ছিল ইকবাল? সবাই কী ভাবল?’
ইকবাল বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ উফ! সবার কথা বাদ দাও তো মাই লাভ। আমাদের কথা বলি চলো।’
‘ তোমার সাথে এখন আবার কীসের কথা? সব কথা বিয়ের পর।’
ইকবাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ বিয়ের পর আর কথা বলব কীভাবে মাই লাভ,তোমার হিটলার বাপ সেইত তোমাকে সিন্দুকে ভরে রাখছেন।’
পুষ্প জ্ব*লে উঠল,
‘ একদম আমার বাবাকে হিটলার বলবে না।’
‘ কেন বলব না? বিয়ে দিচ্ছে,অথচ মেয়ে তুলে দেবে না। দুটো বছর মানে কত গুলো দিন বোঝো? আমি থাকব কী করে এতদিন?’

শেষ দিকে অসহায় শোনাল তার কণ্ঠ। অথচ পুষ্প মিটিমিটি হাসল। ইকবাল ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ হাসছো?’
‘ তো কী করব? হাসব না?’
‘ আমার দুঃখে হাসবে কেন? ‘
‘ হাসছি ,তুমি বোকা তাই। আব্বু আমাকে তুলে দেবে না বলেছে,তোমাকে এ বাড়িতে আসতে বারণ করেছেন?’
ইকবাল আনমনে বলল,’ না করেনি।’
খেয়াল করতেই অতুজ্যল চোখে চাইল। কণ্ঠে অবিশ্বাস ঢেলে বলল,
‘ এর মানে আমি যখন খুশি আসতে পারব?’
পুষ্প নাটক করে বলল,
‘ সে আমি কী জানি,তোমার ইচ্ছে।’
ইকবাল এত খুশি হলো যে একটু আগে পুষ্পর সাবধানী বানী ভুলে গেল। ভুলে গেল আশেপাশে লম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দালানকোঠা। আচমকা পুষ্পর কোমড় জড়িয়ে শূন্যে উঠিয়ে ফেলল সে। মেয়েটা ভড়কে গেছিল প্রথম দফায়। গলা জড়িয়ে ধরল তার। ইকবাল ততক্ষণে ঘুরপাক খেতে শুরু করল,সাথে চেঁচিয়ে স্লোগান দিলো,
‘ আই লাভ ইউ মাই লাভ,আই লাভ ইউ।’
পুষ্প হেসে উঠল। হাসছে ইকবাল। দুজনের তৃপ্ত হাস্য মিশে গেল বাতাসে। জানিয়ে গেল,
‘ অবশেষে ওরা এক হচ্ছে,সত্যিই হচ্ছে।’

***

অতিথিদের খাবারের জন্য সবিনীত আমন্ত্রন জানানো হয়। গৃহীনিরা ব্যস্ত হলেন টেবিল সাজাতে। ইকবাল তার ভাইবোন আর বাবা মাকে সাদরে নিয়ে যাওয়া হলো খাবার রুমে। পুষ্পকে জোর করে পাশে বসালেন মুমতাহিনা। ঠিক তার মুখোমুখি বসেছে ইকবাল। মুহুর্তে মেয়েটা জড়োসড়ো হয়ে এলো। কেন যেন লজ্জা লাগছে খুব। ছাদে ইকবাল জোর করে চুমু খেয়েছে ঠোঁটে। আর সেটা দেখে ফেলেছে পাশের বিল্ডিংয়ের এক নাদান ছেলে। ওই ঘনিষ্ঠ মুহুর্তেই ছেলেটা ডেকে বলল ‘ এই তোমরা কী করছো?’
পুষ্প কুণ্ঠায় দাঁড়াতে পারেনি। দৌড়ে নীচে চলে এসেছে। ইকবাল হাজির হয়েছে পরে। তার অঙ্গভঙ্গি স্বাভাবিক। হবে না? নিলজ্জ তো!
এখন ওই চোখের দিকেও তাকাতে পারছেনা পুষ্প। এরকম হওয়ার কথা ছিল না। তার নেত্রদ্বয় সর্বদা ব্যাকুল তার সৌষ্ঠম মুখস্রী দেখতে। গতকাল মানুষটার করা পাগলামি গুলো ভেবে ভেবে সারাটা রাত ঘুম ধরা দেয়নি চোখে। এপাশ- ওপাশ করেছে,আর একা একা হেসেছে। মাঝেমধ্যে নিজেরই বিশ্বাস করতে ক*ষ্ট হয়,কেউ এতটাও ভালোবাসে ওকে? ওর বিয়ের খবরেই যার অস্থির, অশান্ত অবস্থা হতে পারে,একদিনেই বাবা মাকে টেনেটুনে প্রস্তাব নিয়ে আসতে পারে,এই ছেলে আর কত কী পারবে কে জানে! পুষ্প মুচকি হাসল। তক্ষুনি টের পেলো পায়ের পাতায় সুরসুরি দিচ্ছে কেউ। রীতিমতো স্লাইড করছে বুড়ো আঙুল দিয়ে। পুষ্প চট করে চোখ তুলে ইকবালের দিক চাইল। ছেলেটা দুষ্টু হেসে ভ্রু উঁচায়। পুষ্প মুখ বেঁকিয়ে চোখ রাঙায় পা সরাতে। সরাল তো নাই-ই,উলটে ক্যাবলার মত স্থির হয়ে চেয়ে রইল। পুষ্প বাড়ির সবার দিকে তাকায়। এভাবে ওকে চেয়ে থাকতে দেখলে কী অস্বস্তিকর অবস্থা হবে! এদিকে তার পা থেকে মাথার তালু অবধি শিরশির করছে। আঁকাবাকা হয়ে আসছে দেহ। সবার মধ্যে বসে মোচড়ামুচড়ি করা যায়? সে অসহায় নেত্রে তাকাল। যার অর্থ,একটু পা সরাও না ইকবাল! ছেলেটা শুনল না। বরং দু পায়ের মাঝখানে পুষ্পর পা নিয়ে বন্দী করল। মিনা বেগম ওর কাছে এলেন ভাত বেড়ে দিতে। সে স্বাভাবিক হয়ে বসে থাকে। সুন্দর করে শুধায়,
‘ আপনারা খাবেন না?’
‘ খাব তো,পরে। আগে তোমরা খেয়ে নাও।’
‘ একসাথে বোসতাম আন্টি।’
তার নাটক দেখে পুষ্প ভেঙচি কাট*ল। কী ভদ্র সাজছে! টেবিলের নীচে যে অসভ্যের মত পা চলছে সেতো আর কেউ জানে না।

ধূসর প্লেটের দিক চেয়ে ফুঁ*সছে। কিছুক্ষণ পরপর ক্ষি*প্ত নজরে তাকাচ্ছে ইফতির দিকে। যখনই ইফতি পিউয়ের দিকে চায়,ধূসর হাত মুঠো করে ফ্যালে।
বত্রিশটা দাঁত খি*চে বসে থাকে। পারছেনা উঠে গিয়ে ঘু*ষি মেরে চোখ অন্ধ বানিয়ে দিতে। ভাইয়ের হবু শ্বশুর বাড়ি এসে একটা মেয়ে দেখেছে কী, এভাবে তাকাতে হবে? কই,সেতো কোনও মেয়ের দিকে কখনও তাকায়না। পাশ থেকে হেঁটে গেলেও চোখ উঠিয়ে খেয়াল করেনা মেয়েটি কে! আজকাল কার ছেলে গুলো এত ছ্যাচড়া আর অসভ্য কেন? বাড়ির লোকজনই বা কেন এত কেয়ারলেস! ছেলে এসে কোনদিকে,কারদিকে হা করে তাকায়,খেয়াল রাখবেনা তারা? এটা কী বাবা মায়ের দায়িত্বে পরেনা? আশ্চর্য তো!
ধূসরের পায়ের র*ক্ত মাথায় উঠে যাচ্ছে। ক্ষো*ভে খাড়া হয়ে যাচ্ছে সমস্ত লোমকূপ। ইকবালের ভাই না হলে এতক্ষণে তো…
সে মাথা খারাপ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ। ভেতর ভেতর ক্রো*ধে ফোস*ফোস করছে। বুঝতে পারছে না রা*গটা কার ওপর দেখালে যুতসই হবে।

সে তপ্ত চোখে একবার পিউয়ের দিকে তাকাল। মেয়েটার অর্ধশুষ্ক চক্ষুদ্বয় তার দিকেই চেয়ে। ধূসর নিভে এলো এবার। চোখ বুজে ধাতস্থ করল মেজাজ। শান্ত গলায় শুধাল,
‘ খাবিনা?’
পিউ ভ*য়ে ছিল এতক্ষণ। ধূসরের সাবলীল স্বর শুনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। এর মানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক । মৃদূ হেসে বলল,
‘ পরে খাব।’
পুষ্প বলল, ” পরে কেন? এখন বোস না।’
মুমতাহিনাও তাল মেলালেন। পিউ দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে মায়ের দিকে তাকায়। মিনা বেগম চোখ দিয়ে ইশারা করলেন বসতে। মেয়েটা বসতে গেলে ইকবাল বলল,
‘ পিউপিউ তুমি আমার কাছে চলে এসো।’
পিউ হেসে ঘুরে গিয়ে তার পাশের চেয়ারে বসল। ভাতে হাত চালানোর সময় হঠাৎই ইকবাল কানের পাশে এসে বলল,
‘ শালিকা,আমাকে দুলাভাই হিসেবে পেয়ে কেমন বোধ কোরছো?’
পিউ মুচকি হাসল। ভ্রুঁ নাঁচিয়ে বলল ‘ ঝাক্কাস।’
‘ আমার কী কপাল বলোতো পিউ,সুন্দরী শালি আর সুন্দরী বউ। উফ,ভাবতেই শরীর চারশ চার ভোল্টেজে ঝাঁকি মা*রছে।’
পিউ বলল,
‘ ভাইয়া, দুলাভাই হলে কিন্তু ঝামেলাও আছে,যা যা প্যারা দিব সব সহ্য করতে হবে।’
‘ আরে করব করব, তুমি আমার একটা মাত্র শালী,আবার ভাবিও। তোমার প্যারা দেয়ার একশ ভাগ অধিকার আছে। ‘

পিউ ভ্রু কুঁচকে বলল ‘ ভাবি?’
‘ কেন? ধূসরের বউ হলে তুমি আমার ভাবি হবে না?’
কণ্ঠ আরো নেমে এসেছে ইকবালের। পিউয়ের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেল। ‘ধূসরের বউ’ কথাটা কানের পাশে বেজে চলল কিছুক্ষণ। চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে ইকবালের পিঠের ওপর দিয়ে একবার দেখে নিলো প্রিয় মুখটিকে। ধূসরের নিরেট গালের এক পাশ মাথা খারাপ করে দিল নিমিষে। উফ! কোনও একদিন এই মানুষটার বউ হবে সে? এই যে চার আঙুলের মাথায় লোকমা তুলে খাচ্ছে, এইভাবে তাকেও খাইয়ে দেবে? এই দিন গুলো কবে আসবে পিউ? কবে এই চওড়া বুক,এই ছবির মতো আঁকা একটা মুখে চুমু খেয়ে ভরে ফেলবি তুই? বুক ভরা সাহস নিয়ে,এই মানুষটার চোখের দিক তাকিয়ে আওড়াবি ‘ আপনি শুধু আমার ধূসর ভাই। প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসি আপনাকে। এই ভালোবাসার সঙ্গা লেখার মত বই এখনও ছাপা হয়নি। তাহলে বুঝুন, কত ভ*য়ানক এই প্রেম? প্রশান্ত মহাসাগরও কিন্তু হার মানবে এখানে।

পিউ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাত মাখা শুরু করে। এত দ্রুত খায় যে ওর খাওয়াই শেষ হয় সবার আগে। সে উঠে দাঁড়াতেই, ইফতিও উঠে গেল। উদ্দেশ্যহীন ভাবে প্রশ্ন ছু*ড়ল,
‘ বেসিন টা কোথায়?’
রুবায়দা বললেন ‘ পিউ যাচ্ছে তো,ওর সাথে যাও বাবা।’
ধূসরের খাওয়া ওমনি থেমে গেল। নীচু মাথাটা উটপাখির মত সজাগ করে তাকাল।
পিউ বিরক্ত হয়। চেহারায় প্রকাশ না করলেও মনে মনে বলল, ‘ বেসিন কি সাত সাগর তেরো নদীর ওপারে? আমার সাথে আসার কী আছে?’ মুখে বলল,
‘ আসুন।’
ইফতির ঠোঁট জুড়ে বিজয়ী হাসি ফুটল। সে পা বাড়াল পিউয়ের পেছনে। মুমতাহিনা ছেলের অর্ধেক খেয়ে রাখা খাবারের প্লেটের দিক তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। হতাশ হয়ে ভাবলেন ‘ ছেলেটার ভাত মাখার অভ্যেস কবে থেকে হলো? ‘

ইফতি ডান বাম দুহাত মিলিয়ে কচলে কচলে ধুঁচ্ছে। সময় নিচ্ছে বেশ। মাঝেমধ্যে আড়চোখে দেখছে পাশে দাঁড়ানো পিউকে। সব শেষে হ্যান্ডওয়াশের বোতলের দিকে আবার হাত বাড়াতে দেখেই পিউ নাকমুখ কোঁচকাল। এই নিয়ে তিনবার হ্যান্ডওয়াশ লাগাচ্ছে সে। পিউ অধৈর্য হয়ে এঁটো হাত নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়। মেহমান বলে কুঁলুপ আঁটা মুখে। যাই হোক,কিচ্ছুটি বলা যাবে না।
ইফতি এইবার ক্ষান্ত হলো। হাত ধুয়ে,পানি ঝেড়ে, বেসিনের পাশে টাঙানো তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে শুধাল,
‘ বেশি সময় নিলাম?’

পিউ মেকি হেসে বলল, ‘ না না।’
ইফতি সরলে সে এগিয়ে এসে হাত ধোঁয়। পেছন থেকে তাকিয়ে থাকে ছেলেটা। মেয়েটা ওর সমবয়সী। অথচ বোঝাই যায়না। মনে হয়,নাইন টেনে পড়ছে। কী মিষ্টি একটা মুখ! এ অবধি যতগুলো প্রেম করেছে একটা মেয়েকেও এত ভালো লাগেনি। লাগলে ওরা পার্মানেন্ট গার্লফ্রেন্ড হতে পারত। ইফতি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পিউকে দেখে গেল। পিঠে ছড়ানো লম্বা বেনীটা ভীষণ রকম নজরে লাগল তার। আজকালকার মেয়েরা চুল লম্বাই রাখেনা,আবার বিনুনি! আর ভ্রুয়ের নীচের দুটো টানা টানা চোখ,উফ,ওই দুটোই যেন সবথেকে আকর্ষনীয়। যখন সিড়ি বেয়ে নামছিল,বড় বড় চোখ দেখেই ত সব ভুলে চেয়েছিল সে। না,এই মেয়েটাকে তার লাগবেই। একে হাতছাড়া করলে জীবনটাই একটা লস প্রজেক্ট হবে।

পিউ ঘুরে তাকাতেই দেখল ইফতি হা করে চেয়ে আছে। প্রচন্ড অসস্তি হলো তার। এলোমেলো পল্লব ফেলল মেঝেতে। ইফতি অনতিবিলম্বে নিজেকে ঠিকঠাক করে ফ্যালে। সে নিজেও অপ্রতিভ হয়েছে,তবে সামান্য । পরিস্থিতি সামলাতে গলা খাকাড়ি দিলো একবার। শুধাল,
‘ কোন কলেজে পড়ো তুমি?’
‘ ঢা*** কলেজ।’
‘ ওউ,ভালো কলেজ তো। তোমাদের বাসা থেকেও কাছে।’
পিউ বলল,
‘ জি। আপনি কোথায় পড়েন?’
ইফতি ভ্রু গোঁটায়,
‘ আপনি- আজ্ঞে করছো কেন? আমরা তো ব্যাচমেট। ব্যাচমেট কে কেউ আপনি করে বলে?’
পিউ দুষ্টুমি করে বলল,
‘ আমিতো আমার ব্যাচমেট ছেলেদের তুই করে বলি। আপনাকেও বলব?’
ইফতি নিভে গেল। মুখ গোমড়া করে বলল,
‘ যা ইচ্ছে।’
পরক্ষনে শুধাল,
‘ এক্সাম কেমন হচ্ছে তোমার?’
‘ ভালো।’
‘ সায়েন্স নিয়ে তো?’
‘ হ্যাঁ, আপনি? ‘
‘ আমি অত ব্রাইট স্টুডেন্ট নই। কোনও রকম। সায়েন্সে পোষাবে না বলে সম্মান রাখতে কমার্স নিয়েছি আর কী!’

‘ কমার্স কী খুব সহজ না কী? আমিত আমার বন্ধুদের দেখি,ওদের করা নোটস দেখি,কত বড় বড় একটা অংক! আমারতো দেখলেই মাথা ঘোরে।’
বলার ভঙি দেখে হেসে ফেলল ইফতি।
‘ তা অবশ্য ঠিক। তুমি কি মেডিকেলে এপ্লাই করবে?’
পিউ দুপাশে ঘনঘন মাথা নেড়ে বলল,
‘ এ বাবা না না,মাথা খা*রাপ? ডাক্তার হতে হলে সারাজীবন পড়তে হয়। আমি অত পড়তে পারব না। এমনিতে পাব্লিকে চান্স পেলে হোলো,নাহলে নেই।’

‘ মেয়েরা পড়াশুনা নিয়ে এত চ্যিল হয়? ‘
ইফতির অবাক কণ্ঠ। পিউ লজ্জা পেয়ে বলল ‘ আমি হই।’
‘ এইজন্যেই তুমি ভাইয়ার শালী হচ্ছো। ভাইয়াও চ্যিল,আমিও চ্যিল এবার তোমাকে পেলাম তুমিও চ্যিল। জীবনটাই চ্যিলময়।’
পিউ হেসে ফেলল।
তার সুশ্রী,ললিত মুখশ্রী অদ্ভুতভাবে দাগ কাট*ল ইফতির হৃদয়ে। ওমন মুখোমুখি দাঁড়িয়েই কিছু একটা অনুভব করল সে। সেই সময় জুতোর শব্দ এলো কানে। সাথে ভেসে এলো স্বভাবজাত গম্ভীর কণ্ঠ,
‘ হাত ধোঁয়া হয়নি?’
পিউ চকিতে তাকায়। ধূসরকে দেখেই মিইয়ে আসে। ইফতি বলল ‘ জি।’
‘ তোমাকে আন্টি ডাকছেন।’
ইফতি কথা বাড়ায়না। হনহনে পায়ে প্রস্থান নিলো। পিউ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। সে কী এখানে থাকবে? না চলে যাবে? ভেবেচিন্তে বার করল যা, তাতে গুটিগুটি পায়ে পাশ কা*টাতে গেল ধূসরের। আর ওমনি কনুই চে*পে ধরল সে। পিউ হকচকিয়ে তাকাল। ভীত কণ্ঠে বলল ‘ কী হয়েছে?’
‘ কোথায় যাচ্ছিস?’
‘ ডড্রয়িং রুরমে।’
‘ যাবি না।’
‘ তাহলে? ‘
ধূসরের চক্ষুদ্বয় একদিকে বেঁকে এলো,
‘ এতক্ষণ তো দাঁড়িয়ে ছিলিস,আমি আসা মাত্র যাওয়ার কথা মনে পড়েছে?’
পিউ নীচু স্বরে বলল,
‘ না, তা কখন বললাম? ‘
‘ তাহলে কী বলেছিস?’
‘ কিছু তো বলিনি।’
‘ কেন বলিস নি?’
পিউ দিশেহারা হয়ে বলল,
‘ আসলে কী বলব আমি?’
ধূসর আরেকদিক ফিরে শ্বাস ঝেড়ে তাকাল। ততোধিক ঠান্ডা গলায় বলল,
‘ যতক্ষণ না আমার হাত ধোঁয়া হবে,এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি। খবরদার যদি এক পা নড়েছিস।’
পিউ বিস্মিত, তবে খুশি হয়েছে। ধূসরের কাছাকাছি থাকার জন্য উতলা যে,তার আনন্দ না পেয়ে উপায় কী? তার শ*ঙ্কিত চেহারা আকষ্মিক কেমন জ্ব*লে ওঠে । তার থেকেও আদর নিয়ে উড়ে বেড়াল,অনুভূতির দল। আলোকিত,স্ফুর্ত চোখমুখে ঘাড় কাত করে বলল,
‘ আচ্ছা।’
ধূসর ওর এক হাত ধরে রেখেই বেসিনের কাছে এলো। ট্যাপ ছেড়ে হাত পেতে আদেশ করল, ‘ ধুইয়ে দে।’
পিউ অবাক হলো তার অচেনা,অপরিচিত আচরণ দেখে। নিশ্চিত হতে বলল ‘ আমি?”
‘ এখানে আর কেউ আছে?’
পিউ ভেতর ভেতর ফেটে পরল খুশিতে। আস্তেধীরে এসে ধূসরের ভেজা হাত ধরতেই তার শরীরটা ঝাঁকুনি দিলো কেমন। কান থেকে হাত পা থরথর করে উঠল জ্বরে ভোগা রো*গীর ন্যায়। নিজের পেল্লব দুহাত লাগিয়ে এঁটো হাতখানা পরিষ্কার করল সে। এত আলতো ভাবে ধরেছে,যেন এ কোনও সাতাশ বছরের যুবকের নয়,সদ্য জন্মানো শিশুর হাত। মুখমন্ডলে লালিত সূর্যকিরণ। চোখ তুলে চাইতে পারছে না মেয়েটা। ঠোঁটের লজ্জ্বাভাব আটকানো মুশকিল। বক্ষে চঞ্চল,তুলতুলে হাবভাব লুকিয়ে রাখা দুঃসাধ্য। এই খসখসে হাতটা আজন্ম মুঠোয় নিয়ে বসতে পারত যদি! কিংবা শোবার সময় মাথার নীচে বালিশ হোতো ওর। পিউ এমন ভাবে নিঃশ্বাস নিলো,
যেন কত গুরুদায়িত্ব সেড়েছে কেবল। শেষ হতেই ধূসর নির্দেশ করল,
‘ মুছিয়ে দে।’
সে মাথা চুল্কে তোয়ালের দিক হাত বাড়াতে গেলেই ধম*কে উঠল,
‘ ওটা দিতে বলেছি?’
কেঁ*পে উঠল পিউ। বিভ্রান্ত,আত*ঙ্কিত হয়ে বলল ‘ তাহলে? ‘
ধূসর আরেকদিক তাকিয়ে বলল ‘ ওড়না দিয়ে মোছা।’

পিউ চোখ পিটপিট করল বিস্ময়ে। সংশয় কা*টাতে শুধাল ‘ ওড়না দিয়ে?’
‘হ্যাঁ।’
পিউ কতক্ষণ অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে থাকে। ধূসর ভাইয়ের কী হলো হঠাৎ? না চাইতেও এমন জ্যাকপট দিচ্ছেন কেন ওকে?
তার মাথা উত্তেজনায় ভনভন করে৷
হুলস্থুল বাধিয়ে হাত মোছাল ওড়নায়৷ ইশ! এত সুখ সুখ লাগছে কেন? প্রফুল্লতায় যেন জল আসবে চোখে। সারাজীবন এই দায়িত্বটা যদি দিতেন ধূসর ভাই! আপনাকে নিয়ে লুকিয়ে পরতাম পৃথিবীর সুপ্ত কোনও গহ্বরে। বরফ, শীতল হিমাগারে বাসা বানাতাম দুজন। সেখানকার বরফকুচি গায়ে মেখে বসে বসে বিকেল কাটাতাম। অবিচল চেয়ে রইতাম আপনার আগুন দুই চোখে। তবুও মন ভরতো না হয়ত। আপনার দিক চেয়ে থাকলে আমার অন্তরের শান্তি হয়, শান্ত হয় না।
পিউ কেমন ফ্যাস-ফ্যাসে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ আর কোথাও মুছিয়ে দেব ধূসর ভাই?’
ধূসর স্থূল কণ্ঠে বলল,
‘ না, যা এখন।’

তার মনটা ঝুপ করে খা*রাপ হলো এতে। এই কথা,এই কণ্ঠস্বর তো আশা করেনি। হাত ধোয়াতে,মোছাতে বলেছেন যখন, মুখটাও মোছাতে বলতে পারতেন। এই সুযোগে আরেকটু কাছে থাকা যেতনা? দুচোখ ভরে বিমুগ্ধ নজরে দেখতে পারত না ওনাকে? ধ্যাত!
সে বিরক্ত ভঙিতে এক পা বাড়াতেই ধূসর পেছন থেকে হাত টেনে ধরে।
পিউ কেঁ*পে দাঁড়িয়ে যায়। ভেতরে তোলপাড় শুরু হলো ওমনি। অবচেতন মন বলছে ধূসর ভাই টেনে বুকে মেশাবেন এখন। কপালের ঠিক মাঝখানে চুমু খেয়ে বললেন, কী বলবেন? ভালোবাসি বলবেন,না কি অন্য কিছু শোনাবেন? না কি সেদিনের মত চুঁমু খেতে চাইবেন ঠোঁটে? ধূসরের পাতলা অধরের সেই এগিয়ে আসার পুরোনো চিত্রপট চোখে ভাসতেই পিউ কুণ্ঠায় মিশে গেল। নুইয়ে এলো শতহাত। তার বক্ষস্পন্দন জোড়াল। ধুকপুক করছে খুব। যেন বক্ষপটের সাথে ফুসফুস,নাড়িভুড়ি সব কাঁ*পছে। পেটের মধ্যে চলছে দুঃসহ ভুমিকম্প।
সেই মুহুর্তে ধূসর হাতে টান বসায়। তবে কল্পনা মতো কিচ্ছুটি করল না। বুকের না মিশিয়ে হাতখানা মু*চড়ে ধরল মেয়েটার পিঠের সঙ্গে। চমকে গেল পিউ। প্রচন্ড হতভম্ব হয়ে,ভ্যাবাচেকা খেল।
তার অভিভূত অভিপ্রায়, কর্পূরের ন্যায় উবে যায়। লজ্জায় লাল -নীল হওয়া বেরিয়ে গেল দেয়াল ফুঁড়ে। আর্ত*নাদ করে বলল,
‘ আ,ব্য*থা পাচ্ছি।’
ধূসর দাঁত পি*ষে বলল, ‘ ইফতির সাথে এত হাসাহাসি কীসের?’
‘ কই হাসলাম? হাসিনি আমি।’
‘ আমি দেখিনি?’
‘ লাগছে ধূসর ভাই।’
‘ লাগুক। কারো মনে লাগার থেকে তোর হাতা লাগা ভালো।’
পিউ কাঁদো*কাঁদো কণ্ঠে বলল,
‘ এমন করছেন কেন? ‘
ধূসর হাতে চাপ দিতেই সে মুচড়ে বলল,
‘ আমি ইচ্ছে করে হাসিনি। সত্যি বলছি। আপনি বললে অনিচ্ছায়ও হাসব না। আজ থেকে আমার হাসা বন্ধ ধূসর ভাই। আল্লাহর দোহাই, হাতটা ছাড়ুন। ‘
‘ ছাড়লে কোথায় যাবি?’
‘ যেখানে আপনি বলবেন।’
‘ঘরে যাবি। নীচে যেন না দেখি।’
‘ আচ্ছা আচ্ছা,ছাড়ুন।’
ধূসর ছেড়ে দিতেই পিউ ত্রস্ত ঘুরে গেল। জ্বলন্ত চোখে চেয়ে বলল,
‘ ঘরে কেন যাব আমি? সবাই যেখানে থাকবে আমিও সেখানে থাকব। আপনি সব সময় আমাকে ঘরে পাঠিয়ে দেন কেন? কী সমস্যা আপনার?’

ধূসর কঠিন চোখে চাইল। পিউ বিরতি নিতেই আবার খপ করে হাত মুচ*ড়ে ধরল পিঠে। ভড়কে গেল সে। একইরকম ককি*য়ে উঠল ব্যথায়।
‘ বেশি সাহস বেড়েছে আজকাল? এক চ*ড় মা*রব,দাঁত পরে মুখ খালি হয়ে যাবে।’
পিউয়ের তেজ শেষ। ভুল জায়গায় দা*পট দেখিয়েছে বুঝতেই, ফাঁটা বেলুনের মত চুপসে গেল চেহারা।
অনুরোধ করে বলল,
‘ আর করব না ধূসর ভাই। আর করব না,এবারের মতো ছেড়ে দিন।’

ধূসর পুনরায় শুধাল,
‘ ছাড়লে কোথায় যাবি?’
‘ ঘরে চলে যাব।’
‘ মনে থাকবে?’
পিউ ধৈর্যহীন,
‘ থাকবে, থাকবে।’
‘ ইফতির সাথে কথা বলবি?’
‘ ইফতির চৌদ্দ গুষ্ঠির সাথেও বলব না। প্লিজ ছাড়ুন। হাতটা খুলে গেলে পরীক্ষা দেব কী করে?’

ধূসর ছেড়ে দিল। সাথে হুকুম করল,
‘ ইফতির আশেপাশেও যেন না দেখি।’
পিউ হাত ডলতে ডলতে ঠোঁট ওল্টায়। যন্ত্রনায় চোখ ছলছল করছে তার।
এই পা*ষাণ লোকটাকেই কী না স্বপ্নে কাম*ড়ে খেয়ে ফেলতে মন চায়! বেহায়া, কু ইচ্ছেটাকে শিল-নোরা দিয়ে পি*ষে ফেলার ইচ্ছে হল । নিজের প্রতি চরম বিষাদ গাঢ় থেকে প্রগাঢ়তা পেলো। ধূসরের প্রতি রা*গে দাউ*দাউ করে আগু*ন জ্ব*লল মাথায়। মনে মনে নিজেকে গা*লি দিলো পিউ। বিড়বিড় করল,
‘ ছিহ! ছিহ!’
ধূসর চোখ রাঙিয়ে বলল,
‘ এভাবে কী দেখছিস? খেয়ে ফেলবি আমাকে? চোখ নামিয়ে সোজা ঘরে যা।’

পিউ নাক টানল। কোটর সবে সবে ভরে উঠেছে। অভিমান হলো তার। বুকের ভেতর বন্দী থাকা করূন হৃদপিন্ডটা দেয়ালে মাথা ঠু*কে ম*রে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালাল। অনুরাগের পাহাড় এত উঁচু হলো অল্পতে,সব ছেড়ে*ছুড়ে বেদুইন হতে মন চাইল। ভেজা কণ্ঠে অভিযোগ জানাল,
‘ আপনি খুব নি*ষ্ঠুর ধূসর ভাই।’
‘ তুই যাবি?’
তে*ড়ে আসতে দেখেই পিউ দুরন্ত পায়ে পালাল। মান ইজ্জতের দফারফা হচ্ছে,হয়ে আসছে। কেন যে পাষ*ন্ড টাকে ভালোবাসতে গেল! নাহলে এক্ষুনি আব্বুর কাছে জব্বর একটা নালিশ ঠুকতে পারতোনা?
অবশ্য নালিশ করেও বা! একটা স্বস্তা বালিশ ও মিলবে না। কাল বুক ফুলিয়ে মুখে মুখে তর্ক করা ছেলে কী আর এইসবের ধার ধারে?
দরজায় ঝোলানো ঝিনুকের ঝুলনি গুলো দুলে উঠল তার ছোটার তোপে। ধূসর ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল সেদিকে। পরপর ঠোঁটর কোনায় দেখা গেল চাপা,একপেশে হাসি। অক্ষিপটে চকচকে কৌতুক। হাসল সে। যে হাসিতে ঠোঁট গহ্বর থেকেও মুক্ত হলো না দাঁত।
‘ নিজের সবথেকে দামী জিনিসটা একান্ত নিজের করে রাখতে হলে,একটু নি*ষ্ঠুর হওয়াই যায় পিউ। ওসব তুই বুঝবি না।’

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে