#এক_সমুদ্র_প্রেম!
লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(৩৬)
স্বভাবে মুখচোরা মানুষগুলো সমাজে সবথেকে বড় অসহায়। তারা নিজেদের জন্য মুখ ফুটে কখনওই কিছু চাইতে পারেনা। সোজাসুজি মনের কথা জানাতে সর্বদা বিফল তারা। আমার এটা চাই,ওটা লাগবে,এটা দরকার,নাহলে হবেনা,এরকম বাক্যগুলো ওদের জন্য নিষিদ্ধ, অস্বাভাবিক। যে একবার অন্তর্মুখী হয়,সে নিজের সীমারেখা থেকে বাইর আসতে শেখেনি। ঠেলেঠুলেও আনার সাধ্য নেই।
এরা কিছু বিশেষ মানুষের সঙ্গে মেশে,তাদেরকেই ভালোবাসে সবটুকু দিয়ে।
আজ সেই কাতারে তবে সাদিফও পরল?
সে টানটান ভাবে লেপ্টে বিছানায়। মাথার ওপরে রাখা আড়াআড়ি হাত। নেত্রযূগল নিবদ্ধ সম্মুখে লাগানো সাদা এসিটার ওপর। চোখে ঘুম নেই, মনে শান্তি নেই।
সমস্ত মুখজুড়ে বিষাদের চিহ্ন। আঁকিবুঁকি করছে হতাশা,বেদনা। এক জীবনে অনেক কিছু পেয়েছে সে। পাওয়ার খাতা ভর্তি ছিল আদরে,স্নেহে,আহ্লাদে,ভালোবাসায়। এতদিন অবধি জীবন নিয়ে ছিল যথেষ্ট হৃষিত। কী পায়নি? স্কুল,কলেজে ভালো রেজাল্ট করেছে। নিজের প্যাশন ফলো করে হয়েছে সাকসেসফুল। ভালো ছাত্র ও আদর্শ ছেলের ব্যাকরণ মানা লক্ষীমন্ত ছেলে সে। যতটা ভালো হলে পাড়ার মহিলারা তাদের মেয়ের জামাই করতে বিলম্ব ব্যাতীত ভাববেন, ঠিক অতটাই। আত্মীয়-স্বজন সকলের চোখের মণি সে। দেখতে সুদর্শন আবার লেখপড়ায় ভালো, ইউনিভার্সিটিতে ডিপার্টমেন্টের বেশিরভাগ মেয়ে তার প্রতি দূর্বল ছিল । যেচেপড়ে আসত আলাপ করতে। কত মেয়ের প্রেমের প্রস্তাব নাকচ করেছে অবলীলায়! তাদের ব্য*থিত চোখমুখ দেখে একটিবার মায়া করেনি। হত্যে দিয়ে পড়ে থেকেছে কেউ কেউ।
সব সময় নিজেকে নিয়ে মনে মনে ভীষণ গর্ব করত সাদিফ। বাড়িময় বাপ-চাচারা যখন ধূসরের কর্মকান্ডে বিরক্ত হয়ে তাকে গা*লমন্দ করতেন,পালটা মুখরিত হতেন ওর প্রসংশায়। ভাইয়ে-ভাইয়ে তুলনা লেগে থাকত যেন। অথচ আজ প্রতিটি পদক্ষেপে সেই সাদিফই নিজেকে ধি*ক্কার দিচ্ছে। নিজের ব্যক্তিত্বহীনতা নিয়ে তাচ্ছ্যি*ল্য করছে।
পুষ্পর দিয়ে যাওয়া বিশেষণ’ তুমি স্বার্থ*পর!’ কানে বাজছে নিরন্তর। সে কী আসলেই স্বার্থ*পর? এই পরিবারের জন্য সত্যিই বিষা*ক্ত? কেন? কেন সে স্বার্থ*পর হবে? পুষ্পটা তো জানেনা,পরিবারের সবার ওপর সেও না বলতে পারেনি। মেয়েটা দুবছর ধরে ভালোবেসে কেঁ*দে ব্যকুল। আর ওর ভালোবাসা? বেহিসেবী। কবে থেকে, কত বছর থেকে পিউকে হৃদয়ে জায়গা দিয়েছে গুনে পাওয়া যাবে? পুষ্প কাঁ*দছে,চোখের পানি ফেলছে,প্রকাশ করতে পারছে নিজের ক*ষ্ট। কিন্তু সে? সে কিচ্ছুটি করতে অপারগ। বুকটা ব্য*থায় ছিড়লে বাইরে থেকে সে নিশ্চুপ,নির্বিকার। বিয়ের আলাপ করার সময় মা আর বাবার মুখের হাসিটুকু তার হাসি কে*ড়ে নিয়েছে। কখনওই একটা মানুষের মুখের ওপর সে না করতে পারেনি। কাউকে না বলার ক্ষমতাই নেই ওর। কেন যেন পেরে ওঠেনা। বলতে চায়,খুব করে চায়, অথচ শক্তিতে কূলোয় না।
এই দোষ কী ওর? আজ প্রবল আক্ষেপে বক্ষ জ্ব*লছে তার। এই গুড বয়ের খেতাব তার চাইনা। কেন ধূসরের মতো হলোনা সে? ওরকম কাঠখোট্টা মানুষরাই জীবনে জিতে যায়। ঠকে যায় ভদ্রতার বেড়াজালে আটকে পরা সাদিফরা।
এই যে, নম্রতার আখ্যান পেয়ে হাত পা বেঁ*ধে গেল মোটা রশিতে। চোখ ঢেকে গেল স্নেহের পুরূ কাপড়ে। একটিবার মুখ ফুটে বলতে পারল না,আমি পুষ্পকে নয়,পিউকে চাই। ওর সাথে কাটাতে চাই সারাটাজীবন।
সত্যি বলতে পুষ্প ভুল বলেছে। না জেনেবুঝে মিথ্যে বিশেষন দিয়েছে। সে স্বার্থ*পর নয়,সে আসলে ভদ্রের নামে জ্বলজ্যান্ত কাপু*রুষ। যে মানব বুক ফুলিয়ে ভালোবাসার কথা ব্যক্ত করতে অক্ষম,তার ভালোবাসা নিয়ে সন্দেহ আছে।
সাদিফ চোখের কোনা বেঁয়ে গড়ানো অশ্রু চটজলদি মুছে নিলো। অন্ধকারে,বদ্ধ রুমে সেই জল কেউ দেখল না। কয়েক হাত দূরের সটান দাঁড়ানো দেয়ালটাও না।
***
পিউয়ের চেহারা ভীত। মধ্যরাতে কারো ঘরে চুরি করতে গেল,আর বাড়ির লোক ধরে ফেলল হাতে-নাতে। তাও আবার দারোগা রকম লোকের হাতে ধরা! সে আত*ঙ্কিত চেহারা লোকাতে ব্যস্ত। ধূসরের মুখে ‘শাস্তি’ শব্দটায় যে বুক ধড়ফড় করছে খুব।
সে বসা থেকে আস্তেধীরে, লতিয়ে উঠে দাঁড়ায়। মিনমিন করে বলে,
‘ আড়ি পাতছিলাম না ধূসর ভাই।’
‘ কী করছিলি তাহলে? ‘
‘ ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম,আপুকে দেখে দাঁড়িয়েছি। ‘
কথাটা মিথ্যে নয়। সে পুষ্পকে ঢুকতে দেখেই তীব্র কৌতুহল সমেত এগিয়ে এসেছে। এতক্ষণ ধরে দেয়া বুদ্ধিটা আপু কাজে লাগালো কী না সেসব বুঝতে। অথচ কে জানত,এই লোক এটাও ধরে ফেলবেন।
ধূসরের দৃষ্টি তার হাতের ওপর। যেটা ডলতে ব্যস্ত পিউ। কতটুকু কী আ*ঘাত পেয়েছে তীক্ষ্ণ চোখে নিরীক্ষন করছে। তেমন লাগেনি। অথচ এই মেয়ে ডলে -টলে কী অবস্থা।
সে বলল,
‘ এবার থাম,চামড়া উঠে যাবে।’
পিউ তৎক্ষনাৎ থেমে গেল।
প্রচন্ড নার্ভাস লাগছে তার। ধূসরের শা*স্তিটা ঠিক কীরকম হতে পারে সেই চিন্তায় অবস্থা করূন।
তক্ষুনি ধূসর ঠান্ডা গলায় শুধাল,
‘ পুষ্পকে আমার কাছে কে পাঠিয়েছে?’
পিউ চমকে উঠল।
দুদিকে মাথা নেড়ে বলল ‘ আমি পাঠাইনি।’
‘ তার মানে তুই-ই পাঠিয়েছিস।’
পিউ চোখ নামিয়ে নিলো। ধূসর ধম*কে বলল,
‘ পাঠিয়েছিস কেন? মানা করেছিলাম না তোকে? ‘
পিউ সরল কণ্ঠে বলল,
‘ আমার কী দোষ? আপু এত কাঁ*দছিল বলে সহ্য করতে পারিনি। ‘
ধূসরের অভিব্যক্তি বোঝা গেল না। বলল,
‘ কী কী বলেছিস আর?’
‘ আর কিছু বলিনি। সত্যি বলছি, বিশ্বাস করুন।’
ধূসরের মন গলেনি। তার গম্ভীর কণ্ঠে শোনা গেল,
‘ তোর তাহলে দুটো শা*স্তি জমা হয়েছে। আমার অবাধ্য হয়েছিস,আবার মিথ্যে বলছিস। ‘
পিউ বোঝাতে ক্লান্ত,এমন স্বরে বলল,
‘ মিথ্যে বলিনি ধূসর ভাই।’
‘ চুপ।’
চোখ রা*ঙানো দেখে দমে গেল সে। সন্তর্পনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মন খা*রাপে হাবু*ডুবু শরীরটাকে নিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে চোখ বুজে ধূসর ভাইকে বিশ্বাস করে। এতটা ভরসা তার নিজের প্রতিও নেই। আর সেখানে কী না ধূসর ভাই ওর কথা কানেই তোলেননা। সব বিশ্বাসের দ্বায়ভার তার একার?
প্রেমের মানসিক টানাপো*ড়নে পরে গেল সে। ধূসর ভাইয়ের মন বোঝা শ*ক্ত। মানুষটাই একটা স্টিলের কারখানা। ভা*ঙেনা,মচকায় না, শুধু ঝনঝন শব্দ করে। কানের বদলে ঝালাপালা করে ওর হৃদয়টা। তার কোমল মনের আনাচে-কানাচে তমসা নামবে নামবে ভাব,সেই ক্ষনে পেলো কারো কাছে এসে দাঁড়ানোর মত অনুভূতি।
কে যেন ভীষণ করে ঘেঁষে এলো শরীরের ধারে। পিউ চকিতে তাকায়। অভাবনীয়, ধূসরকে সান্নিধ্যে দেখে গলায় আটকে যায় নিঃশ্বাস। কবুতরের ছানার মতোন থরথ*র করে ওঠে দেহটা।
ধূসরের আবেশিত, মোহময়, মাদকের ন্যায় চাউনী শীতল করে দেয় হাত-পা। এমন করছেন কেন মানুষটা?
কেন এত কাছে আসছেন? পিউ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা। পায়ের পাতা শিরশির করছে। যেন তলায় মাটি নেই। ধূসর ভাইয়ের উষ্ণ শ্বাস, শাণিত চাহনী,এই অকষাৎ কাছাকাছি আসায় নাভিশ্বাস অবস্থাপ্রায়। রুদ্ধ*কর পরিস্থিতি থেকে নিজেকে বাঁচাতে সে দু কদম পিছিয়ে গেল। সরে যেতে চাইল ধূসরের থেকে।
সে মানুষের চক্ষুযূগল এক মুহুর্ত সরল না। একটিবার পল্লব পড়ল না। তার দূর্বোধ্য,খুরখার দৃষ্টি ।এই চাউনীর সঙ্গা নেই,নেই ব্যকরণে উল্লেখ করার যথাযথ বিশেষণ। তবু পিউ বারংবার আহ*ত হলো । ভয়া*বহ পর্যায়ে বক্ষ কাঁ*পল তার। সে অলস গতিতে পেছনে যেতেই পিঠ গিয়ে দেয়ালে ঠেকে। একটা নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে ব*ন্দী হয়ে কেঁ*পে ওঠে।
ধূসরের চোখ দুটোতে আজ লুকোচুরি নেই। সরাসরি, সোজাসাপটা নিক্ষিপ্ত, পিউয়ের প্রশ্নবিদ্ধ আঁখিজোড়ায়।
পিউ দুরুত্ব বাড়ানোর প্রয়াসে সফল হলো না। ধূসর আরো ঘেঁষে দাঁড়াল কাছে। মেয়েটার মাথার ওপর দিয়ে দেয়ালে ঠেসে দিল এক হাত। অদ্ভূত পুরুষালি গন্ধে রোমকূপ পর্যন্ত ঝাঁকু*নি তুলল তার। গোটা দেহে অনিয়ন্ত্রিত খেলে গেল অনুভূতির ঢেউ। মন,মস্তিষ্ক ফুঁড়ে বেরিয়ে গেল আয়ত্তের বাইরে। এই সুগন্ধে চোখ বুজে আসতে চায়। বুঁদ হয়ে ভেসে যেতে চায়,শূন্য আকাশে।
পরপর কানে লাগে একটি ভরাট,শীতল,ফিসফিসে কণ্ঠ,
‘ মাঝে মাঝে তোকে খুব কঠিন শা*স্তি দেয়ার ইচ্ছে হয় পিউ। বাধ্য হয়ে আটকে রাখি,বুঝিয়ে শুনিয়ে থামিয়ে দেই। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাওয়া কত ক*ষ্টের তুই জানিস?’
পিউ ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,
‘ আমি কী করেছি ধূসর ভাই?’
ধূসর নিঃশব্দে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রয়। এই মেয়ের এইরকম শত শত বোকা বোকা প্রশ্ন, বোকা বোকা চাউনী, তার ভেতর কী মাত্রাধিক তোল*পাড় চালায় কেউ জানে?
তার ত*প্ত শ্বাস ছুঁয়ে গেল পিউয়ের মুখমণ্ডল। সে তীর্যক হেসে, নীচু কণ্ঠে জানাল,
‘ এত বা*জে কিছু করেছিস,যার কোনও ক্ষমা নেই। ‘
তারপর কয়েক সেকেন্ড চোখ অবিচল রইল তার। এক চুল অনড় হলোনা পিউয়ের মুখস্রী থেকে। ধীরে ধীরে তার মুখটা আরও কাছে চলে আসে। ধূসরকে এইভাবে এগোতে দেখে পিউয়ের র*ক্তাসঞ্চালন অবধি স্থিত হয়। বক্ষপিঞ্জর ভে*ঙে বেরিয়ে আসতে চায় হৃদপিণ্ড। স্থায়িত্ব পেলো হাত পায়ের অনির্দিষ্ট কাঁ*পন। কপালে ঘাম ছুটল সবেগে। দূর্নিবার অনুভূতিতে, গুরুতর হয়ে এলো নিঃশ্বাস। ধূসর, পিউয়ের করূন অবস্থা বুঝল কী না কে জানে। তার লম্বা দেহ ঝুঁকে গেল,উষ্ণীষ প্রঃশ্বাস ছিটকে ফেলল পিউয়ের ঘাড়ে। আবেগের তাড়াহুড়োতে, অচিরেই দূর্বল দেহটা পিউ ছেড়ে দিলো দেয়ালে।
জোর করে চেষ্টা করল ঠিক ওই অক্ষিপট বরাবর চেয়ে থাকতে।
আস্তেধীরে পরিবর্তিত হলো তার অভিপ্রায়। হারিয়ে ফেলল নিজেকে। তিনটি বছর ধরে হৃদয়ের চারটে অলিন্দে বয়ে বেড়ানো মানুষটার প্রতি এক সমুদ্র প্রেম বেরিয়ে এলো ডাগর ডাগর চাউনীতে। মোহিত ভঙিতে চেয়ে রইল সে । ধূসর ভাই এত কাছাকাছি এলে তার কিছু একটা হয়ে যায়। কেমন কেমন লাগে। বুকের মধ্যে কেউ ঢোল বাজিয়ে নাঁচে। হৃদযন্ত্র ধ্বক ধ্বক করে। সে নিরব লোঁচন ধূসরের সমগ্র চেহারায় বোলালো। মাঝেমধ্যে
ভীষণ রকম ইচ্ছে হয়, ধূসরকে একটা সাদা কাঁচের বোতলে পু*ড়ে ফেলতে। সেই বোতলটা জীবনভর স্বযত্নে বুকের সাথে চে*পে রাখবে সে। ওই আলিফ লায়লার জ্বীনদের মত। মাঝে মাঝে বের করবে, আঁশ মিটিয়ে দেখবে, আর প্রানভরে চুঁমু খাবে। এরকম হলে কী দারূন হতোনা? পরমুহূর্তে চটক কাটল তার।
নিলজ্জের মত চুঁমুর কথা ভাবতেই লজ্জ্বায় নুইয়ে গেল। প্রেমে পড়ে সে ভাষাহীন বেহায়া হয়ে যাচ্ছে। কোথায় লজ্জ্বাবতী বৃক্ষের ন্যায় গুঁটিয়ে রবে তা না!
সে মাথা নামিয়ে কুন্ঠা ঢাকতে ব্যস্ত যখন, আচমকা ধূসর ফুঁ দিলো মুখবিবরে।
সমস্ত গাত্র শিউরে উঠল তার। চিনচি*নে শিরশিরানিতে ভরে গেল। বসন্তের হাওয়ার মত দুলে উঠল শীর্ন দেহখানি। এই অল্প ছোঁয়া, ক্ষন হাওয়া,এইটুকু সময়েই আ*গুন ব্যাতীত তাকে পু*ড়িয়ে দিল।
ধূসর কণ্ঠ খাদে নামিয়ে শুধাল,
‘ তুই এরকম কেন পিউ? কারো নিবারণের বেড়ি ভা*ঙতে কেন এত উঠেপড়ে লেগেছিস? দিনকে দিন তোর নিপুণ দক্ষতা,কারো অমোঘ বনিয়াদ নাড়িয়ে দিচ্ছে। এরপর সে একটা বড়সড় অন্যায় ঘটিয়ে ফেললে অপ*রাধী কে হবে? সে না তুই?’
দু সেকেন্ড অবাক চোখে চেয়ে রইল পিউ। শেষ কথাটার ইঙ্গিত বুঝতেই হাঁসফাঁস করে চোখ খিঁচে বুজে নিলো। জোড়ালো নিঃশ্বাসে ঝ*ড়ের গতিতে বুক ওঠানামা করে। ওষ্ঠাগ*ত প্রাণে দিশেহারা হয়ে বলল,
‘ শা*স্তিটা দিয়ে দিন ধূসর ভাই। চলে যাই আমি।’
ধূসরের ওষ্ঠপুটে ভিড়ে গেল হাসি। পিউ অস্থির ভাবে চোখ মেলল আবার। অনুভব করল, এমনিতে সে মুখে খই ফোটাতে ওস্তাদ হলেও, এই নির্দিষ্ট মানুষটির সামনে সে কিচ্ছুটি না। মনে প্রানে বিশ্বাস করে ফেলল, ধূসর ভাইয়ের কাছে আসার পর, শ*ক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে, তার হাতে দু চারটে চ*ড় খাওয়াও সহজ। এরকম দম*বন্ধ হয়ে আসেনা। রুহুটা গলার কাছে এসে আটকে থাকেনা। পুনরায় ধূসরের চোখের দিকে তাকাল সে।
ঠোঁটের কোনের ওই নির্ম*ম,দুষ্প্রাপ্য, অন্তর্ভে*দী হাসিটা টর্নেডোর ন্যায় ঘুরপাক খেল মনে।
সে তখন ভ্রুঁ উঁচায় ‘ শাস্তি চাস?’
পিউ আজ আর ভ*য় পেলোনা। একটু আগের ঘটনাচক্রের রেশ তার মনে তখনও বহমান। সে আই-ঢাই করে মাথা দোলায়। এই শাস্তি বরেণ্য। অন্তত বেচে থেকেও অনুভূতিদের কবলে নিহ*ত হওয়ার থেকে অকঠিন।
তার ভাবনার মধ্যে ধূসরের অধরদ্বয় এগিয়ে আসতে দেখা যায়। পিউ চমকে, বিমুঢ় হয়ে পরল। আগত পরিস্থিতি বুঝতেই বুকের বা পাশে অনুভব করল অসরল ভূমিকম্প। ধূসর ভাই কি চুমু খাবেন? আল্লাহ, সে নিশ্চিত ম*রে যাবে । পিউয়ের হার্টবিট থেমে গিয়েছে। র*ক্ত সমেত যেন এক্ষুনি বুক ফুঁড়ে বাইরে আসবে ওটা। সর্বদা ধূসরকে কাছে চাওয়া মেয়েটি আজ আকষ্মিক তার অচেনা আগমন মেনে নিতে পারেনা। ধূসরের স্পর্শ পাওয়ার জন্য উচাটন মন আজ হতচকিত। অলীক স্বপ্নের ন্যায় ঠেকছে সব। চোখ,কান,উন্মুখ,ব্যকুল থাকে যার জন্য সে কাছে এলে এমন হয় কেন? ছট*ফট করা অন্তকরন,আর মাথার ভেতর বাজতে থাকা রুমঝুম সুরে পিউ পাগলপ্রায়। এমন মিহি,মিধুর, ভয়*ঙ্কর য*ন্ত্রনা বোধহয় ভালোবাসায় হয়। সুরেলা, মিষ্ট পী*ড়া থেকে নিজেকে বাঁচাতে সে দুহাত রাখল ধূসরের ইস্পাত,প্রসস্থ বক্ষে। পরপর মৃদূ ধা*ক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। ধূসর স্বেচ্ছায় সরেছে,তার ধা*ক্কায় নয়। ওই বলিষ্ঠ মানুষটিকে নড়ানোর সাধ্যি সপ্তদশীর নেই।
পিউ লজ্জ্বায় সহস্র হাত নীচু হয়ে রইল। তারপর নিভু নিভু চোখ তুলে তাকাল ধূসরের, উদ্বেগশূন্য, নিরেট চিবুক পানে। মানুষটার স্বল্প,ঈষৎ মিটিমিটি হাসিটা বুকের গোপন কুঠুরির সবটা এলোমেলো করে দিল। বেসামাল হওয়ার আগেই মুচকি হেসে, এক ছুট্টে, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে।
ধূসর সেদিক তাকিয়ে ঘাড় ডলল ডান হাতে। তার ঠোঁটের কোনায় দূর্বোধ্য, দূষ্টু হাসি। ইচ্ছে করে করেছে এমন। ফাজলামো করে পিউকে জ্বা*লাতে স্বেচ্ছায়,বুদ্ধি এঁটে এগিয়েছে ঠোঁট। চুঁমু অবধি যেতনা নিশ্চিত। এখনও যে, ওই এক ভুল দুবার করার সময় আসেনি। অথচ এর আগেই পালালো মেয়েটা। ধূসর বক্র হেসে বিড়বিড় করে বলল,
‘ এইটুকুতে এই অবস্থা,সারাটাজীবন তো পরেই রইল।’
****
পার্লামেন্টে উৎসব আজ। নতুন দল নিয়ে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া হবে। হাজির হবেন নব নমিনীত তাদের মেয়র প্রার্ত্রী খলিলুল্লাহ সাহও।
তদারকিতে বরাবরের মতো ধূসর রয়েছে। একে ওকে হুকুম দিচ্ছে। না বুঝলে, বোঝাচ্ছে ভালো করে। মাঝে মাঝে হাতঘড়ি দেখছে। ঘড়িতে একটা ছাড়াবে অথচ ইকবালের দেখা নেই। এই প্রোগ্রামের জন্য আজ সে অফিস থেকে লাঞ্চের আগে বেরিয়েছে। রিসিপশনে বলে এসছে, ফিরবেনা বিকেলে। অথচ সভাপতি নিখোঁজ। ছেলেটা মাঝেমধ্যে এত দায়িতজ্ঞানহীনের মত কাজ করে কেন? একেই কীনা সে ভবিষ্যতে মেয়র করার পায়তারা করছে!
ধূসর ঠোঁট ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল। ফুল দিয়ে মূল গেটে ডেকোরেশন হচ্ছে। পুরো পার্লামেন্ট সাজানো শেষ প্রায়।
ঘেমে-নেয়ে গোসল করার মতন অবস্থা। সোহেল এসে খাবারের মেন্যু দেখিয়ে শুধাল,
‘ কোক তো খলিল ভাই খাননা,স্প্রাইট আনব না কি? একী! তুইত একদম ঘেমে গেছিস ধূসর। ভেতরে গিয়ে বসবি? আমি বরং দেখি এদিকিটা!’
ধূসর রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল,
‘ লাগবে না। তুই এক কাজ কর,সবার জন্য স্প্রাইট আনা। ওনার একার জন্য আলাদা করে আনালে খারাপ দেখায়। ‘
‘ আচ্ছা ঠিক আছে। ‘
সোহেল চলে গেল। তার ও অনেকটা সময় পর দৃশ্যমান হলো ইকবালের সাদা গাড়িটা।
ধূসর,ওমনি চোখ-মুখ পাথরের ন্যায় শ*ক্ত করল। বোধহীন ছেলেটার ওপর মেজাজ দারূনভাবে চটেছে আজ। তাকে ক*ঠিন কিছু কথা শোনানোর উদ্দেশ্যে গটগটিয়ে হেঁটে গেল কাছে।
ইকবাল গাড়ি থেকে নামল। দরজা আটকে ঘুরতেই ধূসর সামনে পড়ল। ত্বরিতে তার পো*ক্ত চিবুক মসৃন হলো। ক*ড়া কথা শোনাতে চাওয়ার ইচ্ছে, হুরহুর করে উবে গেল।
ইকবালের অবিন্যস্ত মুখমণ্ডল থামিয়ে দিয়েছে। টকটকে লাল দুটো চোখ ,অসিত ঠোঁটযূগল আরো বেশি কালো আজ, চুল অগোছালো হয়ে কপালে পরেছে,সাথে বাম চক্ষু রেখেছে দৃষ্টির আড়ালে।
ধূসর চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
‘ কী অবস্থা চেহারার?’
ইকবাল একটু হাসল। সত্যি বলতে ছেঁচড়ে এনেছে হাসিটা। বলল,
‘ রাতে ঘুম হয়নিতো,তাই আর কী!’
গলার স্বরও অন্য রকম। ভা*ঙা-চোড়া, রুগ্ন। ধূসর কাঁধে হাত রেখে বলল,
‘ তুই ঠিক আছিস?’
ইকবালের অন্তঃস্থল হুহু করে উঠল। ধূসরকে দুহাতে আগলে ধরতে মন চাইছে। মন চাইছে চিৎ*কার করে জানাতে,
‘ আমি ঠিক নেই ধূসর। তোর বোন আমায় ঠিক থাকতে দিচ্ছেনা। ভালোবাসার অনলে জ্বা*লাচ্ছে,পোড়া*চ্ছে,পুতুলের ন্যায় নাঁচাচ্ছে। ওর একটা সুষ্ঠু বিচার কর ভাই।’
মুখে বলল
‘ একদম।’
ধূসর তাও শুধাল
‘ ইজ এভ্রিথিং অলরাইট ইকবাল?’
ইকবাল স্বভাবসুলভ হেসে বলল,
‘ আরে হ্যাঁ হ্যাঁ। আমাকে দেখে অলরাইট মনে হচ্ছেনা তোর? ‘
‘ না। ‘
সে ঠোঁট ওল্টায় ‘ ঠিক আছি রে বাবা। এক মাঈল দৌড়ে এলে বিশ্বাস করবি?’
‘ থাক। ভেতরে চল,খলিল ভাই অপেক্ষা করছেন।’
‘ ও ব্যাটা এত আগেভাগে এসেছে কেন? পরে এলে খাবার কী কম পাবে?’
‘ সবাই তোর মত লেট লতিফ নয়। হি ইজ আ পাংকচুয়্যাল গাই। আয় এখন।’
ধূসর উল্টোপথে কদম ফেলল। ইকবাল দাঁড়িয়ে রইল স্থির। তার ভেতরটা খচখচ করছে অন্য কিছু নিয়ে। পুষ্প কাল রাতে হঠাৎ অস্বাভাবিক ব্যবহার করেছে। সে ক*ষ্ট পেয়েছে বুঝেও একটি বার ফোন করল না,খবর নিলো না।
হঠাৎ কী হলো সেই চিন্তা, আর ভারী বুক সমেত সারারাত বিনিদ্রায় কে*টেছে তার। এক ফোঁটা চোখ বোজেনি, ঘুমায়নি। অসংখ্য সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়েছে বাতাসে। সকালে যাও একটু ঘুমাতো,পুষ্পর নো কল,নো মেসেজ দেখে অভিমানে মাথার রগ দপদপ করে উঠল। ক্রো*ধ ছড়াল শিরাসমূহে। সব সময় রা*গ করবে ও,ভা*ঙাবে সে? কেন, এক তরফা কেন হবে এই নিয়ম? অত গুলো কলে ওকে না পেয়ে একটু না হয় উচু কণ্ঠে কথা বলেছে,তাই বলে এভাবে রিয়্যাক্ট করবে? এত বা*জে বা*জে কথা শোনাবে? সে ট*র্চার করছে মানে,সে কি অত্যা*চারী?
ইকবাল ফের অনুরাগী হয়। মনের সাথে সাথে চোখমুখ শ*ক্ত করে।
অভিমানে ছেঁয়ে যায় তনুমন। কিন্তু একটিবার পুষ্পর কথা জানার স্পৃহা কমেনা। ইনিয়ে-বিনিয়ে যদি ধূসরের থেকে একবার শুনতে পারত,সে আজ ইউনিভার্সিটি গিয়েছে কী না! তবে যা বোঝার বুঝে নেবে।
‘ কী? দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’
তার ধ্যান কা*টল। দুপা এগিয়ে গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে গেল। ধূসরের দৃষ্টি বদলাল সন্দেহে। ওর উশখুশানি নজর বন্দী হতে কয়েক সেকেন্ড লাগে। ইকবাল জ্বিভে,কৃষ্ণবর্ন ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
‘ ইয়ে মানে,বলছিলাম যে বাড়ির সবাই কেমন আছে?’
ধূসর একটুও অবাক হলোনা এমন ভঙিতে বলল,
‘ ভালো।’
‘ পিউয়ের পরীক্ষা কেমন হচ্ছে?’
‘ শুনছি তো ভালো।’
সে অকারণে সব দাঁত দেখিয়ে বলল,
‘ ভালো,ভালো। তোর হিটলার চাচার কী খবর?’
ধূসর চোখ রাঙাতেই, দাঁতে, জ্বিভ কে*টে বলল,
‘ ভালো মানুষ আঙ্কেলের কী খবর?’
‘ হঠাৎ সবার খোঁজ খবর নিচ্ছিস যে?’
‘ এমনিই। তুই আমার বেস্টফ্রেন্ড, তোর পরিবার আমার পরিবার না?’
‘ হু। বাড়ির সবাই ভালো আছে। এখন আরেকটু বেশি ভালো থাকার কথা। খুশির খবর চলছে তো।’
ইকবাল কপাল কুঁচকে বলল,
‘ কী খবর? তোর চাচার আবার ইয়ে টিয়ে হবে না কী?’
ধূসর চোখ গ*রম করে বলল,
‘ উজবুকের মত কথা বলবিনা।’
ইকবাল মাথা দোলাল। মনে মনে একটুখানি সুযোগ হাতাল পুষ্পর নাম উচ্চারণ করার। কিন্তু, ওই যে,চোরের মন পুলিশের মতো। পাছে ধূসর সন্দেহ করে বসলে!।
‘ আর কোনও প্রশ্ন?’
‘ হু? হ্যাঁ, না মানে ওই,খুশির সংবাদটা কী?’
‘ পুষ্পর সঙ্গে সাদিফের বিয়ে।’
ইকবাল বেখেয়ালে মাথা দুলিয়ে বলল,
‘ ও,ভালো।’
হুশে ফিরতেই বজ্রাহ*তের ন্যায় তাকাল। আ*র্তনাদ করে বলল,
‘ কীইইই?’
ধূসর কাঁধ উঁচু করে বলল,
‘ হ্যাঁ। এইত, কালই পাকাপাকি করল। দুদিনের ভেতর বোধহয় এনগেজমেন্টের দিনও ঠিক হবে।’
ইকবালের কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। বক্ষে সাই করে একটা তী*র বসল। বুকটা বি*চ্ছিন্ন,ফালা-ফালা করল নিমিষে। এতটা দেবে বসল যে, এফোড়-ওফোড় হয়ে গেল সব। অদৃশ্য র*ক্ত ঝড়ল অনর্গল। সে উত্তর দিতে পারল না। কেমন র*ক্তশূন্য চেহারায় ধূসরের মুখের দিক চেয়ে রইল। অক্ষিপটের শ্বেত রঙটা বিবর্ন,ফ্যাকাশে। নিশ্চিত হতে, শুকনো খনখনে কণ্ঠে শুধাল,
‘ কী বলছিস?’
ধূসরের আনন্দিত জবাব,
‘ ইয়েস! ঠিক শুনেছিস। এইত কদিনের মধ্যেই ওদের বিয়ের ডেট পরবে শুনলাম। ভাবছি, হলুদের প্রোগ্রাম অনেক বড় করে করব। উম,আমরা এক রকম পাঞ্জাবি নেই কী বলিস! আফটার অল, আমার পরিবার তোর পরিবার হলে, পুষ্প অলসো লাইক ইউর সিস্টার। ‘
ইকবাল অদৃশ্য দুহাতে কান চে*পে ধরল নিজের। অদ্ভূত অদ্ভূত আর্ত*নাদ করল। কিন্তু কথা ফুটল না। পুষ্প তার বোন? না, ইহকালে না।
ধূসর ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ কী হয়েছে?’
সে ক্লান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ পানি খাব।’
ধূসর ছোট্ট শ্বাস ফেলে আশেপাশে তাকাল। সামীরকে দেখে আদেশ করল পানি দিয়ে যেতে। ইকবালের বুকে ব্য*থা উঠেছে। বিকল বিকল লাগছে হার্টবিট। যেন এক্ষুনি অ্যা*টাক-ফ্যাটাক করে লু*টিয়ে পরবে মাটিতে। তার পুষ্পরানির বিয়ে,অন্য কারো সাথে? সে ম*রে যাবে, বাঁচবে না। এই খা*রাপ,কু*ৎসিত দিন দেখার আগে ঝাঁ*প দেবে খাদে।
যতটা কাতর ভাবে পানি চাইল সে,অতটা গলা দিয়ে নামল না। বোতলে এক চুমুক দিয়ে বাকীটা রেখে দিল। এদিকে ব্য*থা বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে ছড়িয়ে পরছে শরীরের সবখানে। বাম পাশে মনে হচ্ছে বহ্নির লেলি*হান শিখা ঢেলে দিয়েছে কেউ। ধূসর কিছুই জানেনা এমন ভাণ করে বলল,
‘ তাহলে কী বলিস? আমরা পার্লামেন্টের সবাই মিলে প্ল্যানিং শুরু করি?’
ইকবাল নির্জীব দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধায়,
‘ কীসের প্ল্যান যেন?’
‘ পুষ্প আর সাদিফের বিয়ের? সিকদার ধূসর মাহতাবের ভাইবোনের বিয়ে,ধুমধাম করে হবে, বুঝতেই পারছিস।’
ইকবালের মুখ তেঁতো হয়ে এলো। তিক্ততায় গলার কাছটা ফ্যাসফ্যাসে। ঢোক গিল*তেও যেন নরকীয় ক*ষ্ট। ধূসরের খুশিতে প্রথম বার তার বিতৃষ্ণা হলো,রা*গ হলো। চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইল চকচকে অশ্রু। গুমড়ে গুমড়ে কথা চে*পে রাখার এত য*ন্ত্রনা? এই জন্যেই কি পুষ্প কাল ওমন করেছিল? বাড়ির সবার রা*গ,ক্ষো*ভ ওর ওপর ঢেলেছে?
ইকবালের বক্ষ যাত*না অস্থির ভঙিতে বৃহৎ হচ্ছে৷ চট করে বুকের বাম পাশ চে*পে ধরে বসে পরল পার্লামেন্টের সদর সিড়িতে।
ধূসর ধড়ফড় করে ধরে বলল,
‘ কী হলো?’
ইকবাল সত্যিটা বলতে অক্ষম। বুক ডলতে ডলতে জবাব দিল,
‘ এমনি। বুকে ব্য*থা করছে একটু।’
‘ গ্যাস্ট্রিকের বোধহয়। খাসনি সকালে? ওষুধ আনাব,খাবি? ‘
ইকবাল অসহায় চোখে তাকাল। তারপর ফেলল দীর্ঘশ্বাস। সে কী করে বোঝাবে? এই ব্য*থা কীসের? এক সৎ প্রেমিক পুরুষের, প্রেমিকা হারানোর পী*ড়া, দুনিয়ার কোনও ওষুধ সাড়ানোর যোগ্যতা রাখেনা। প্রেমের মাম*লায়,বুকটা আ*সামী। প্রেমিক কাঠগড়ায় দাঁড়ালেও উকিল হয়না কেউ।
মাঝখান থেকে বিনা-দোষে হৃদয় শা*স্তি পায়। ফাঁসি হয় প্রেম ভালোবাসা আর মহব্বতের। এই নিদারূন খেলায় আজ থেকে ভাগ্য খেলোয়াড়। আর সে ছুটে চলা খেলোয়াড় দের পায়ে নি*ষ্ঠুর ভাবে ঠেলতে থাকা গোলাকার ফুটবল।
চলবে।
#এক_সমুদ্রে_প্রেম!
লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(৩৭)
ইকবাল দুঃসহ ভঙিতে ছটফট করছে। প্লেটে হাত চলেনা,গলা দিয়ে খাবার নামেনা। তার বেসামাল,বেগতিক অবস্থা। অথচ,বাকী সবাই হৈহৈ করে খাচ্ছে। আলাপ-আলোচনায় জমে গিয়েছে পার্লামেন্ট। ছয়টা লম্বা টেবিল পেতে দুই দিকে চেয়ার বসানো। এক এক টেবিলে দশ জন করে বসেছে। ধূসর,ইকবাল,খলিল সবাই একই টেবিলে। ইকবালের অস্থির অবস্থা আড়চোখে, তীক্ষ্ণ ভাবে দেখছে ধূসর। শেষে জিজ্ঞেস করল,
‘ খাচ্ছিস না কেন?’
ইকবাল নড়ে উঠল একটু,
‘ হু? কই খাচ্ছিতো।’
সোহেল বলল,
‘ খাবারটা মজা না? একদম অনেকগুলো দোকান বেছে বেছে বিরিয়ানীটা আনালাম।’
খলিল বললেন,
‘ হ্যাঁ, আমারতো ভালোই লাগছে। তেল চিপচিপে কম। ‘
ইকবাল একটু হাসল। তবে কিছু বলল না। কথা বলতে ভালো লাগছে না তার। গলার মধ্যে কী যেন ঘুরছে। প্রাণটা কা*তরাচ্ছে কৈ মাছের মতোন। তার চিন্তার মধ্যে খলিলের ধ্বনি শোনা গেল,
‘ নির্বাচনের দিন তোমরা সবাই একটু এলার্ট থেকো ইকবাল। বিরোধীদল কিন্তু হাত গুঁটিয়ে বসে থাকবে না। মনে নেই, গতবার কী কেলে*ঙ্কারি হয়েছিল?’
‘ জি।’
‘ মুখে জি বললে হবেনা। তুমি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ানোটা কমাও এখন৷ আমার পর এখানে নেতা তুমি,পার্লামেন্টের দায়িত্ব তোমার। অথচ সব দ্বায়ভার ধূসরের কাঁধে দিয়ে নেঁচে-কুদে বেড়াচ্ছ৷ রাজনীতিতে দায়িজ্ঞান হচ্ছে আসল। এত ইরেসপন্সেবল হলে হয়না। ‘
একেতো মন ভালো নেই। তার ওপর খলিলের কথা গুলোয় ইকবালের মুখের অবস্থা করূন হলো। বিষাদে ঢেকে গেল অন্তঃস্থল । ঠোঁটের চারপাশের হাসি টুকু বিলীন। দলের এত ছোট ছোট সদস্যদের সম্মুখে এভাবে না বললেই কী হতোনা?
সে মুখের ওপর যথাযথ জবাব দিতে গিয়েও পিছিয়ে যায়। আগামীতে খলিল মেয়র নির্বাচিত হবেন। দলের সিনিয়র সদস্য সে। তাকে অপমান করে কিছু বলা ঠিক হবেনা। যদি সেও একই কাজ করে,দুজনের তফাৎ রইল কই?
অথচ এই ভদ্রতার ধার, ধারল না ধূসর। সে মুখের ওপর বলে বসল,
‘ পার্লামেন্ট তো চলছে খলিল ভাই। কোনও রকম অসুবিধে হচ্ছেনা। আপনার দল ঠিক থাকলেই হলো,সেটা আমি চালাই বা ইকবাল। ‘
খলিল হাসার চেষ্টা করে বললেন,
‘ তোমার বেশি প্রেশার পরছে বলেই বললাম ধূসর। যার যা দায়িত্ব…. ‘
‘ আমার প্রেশার পরছে আমি বলিনি। আপনিই অহেতুক বাড়িয়ে ভাবছেন। ইকবাল দরকারের সময়ে থাকলেই হচ্ছে। এছাড়া ও গায়ে বাতাস লাগাক বা না লাগাক আমাদের কারোরই দেখার বিষয় নয়। ‘
শীতল যুক্তি আর অপ*মানের তোড়ে খলিলের মুখমন্ডল থমথমে হয়ে আসে। তবু তর্কে গেল না। চোখ নামিয়ে একমনে হাত চালালেন ভাতের থালায়।
ধূসর আর ইকবালের মাখো-মাখো সম্পর্ক একদম পছন্দ না তার। সে ভবিষ্যৎ মেয়র,দুজন হবে তার পা চাঁটা কর্মী। অথচ এই ছেলে তাকে গায়ে লাগায়না। আর ওর স্পর্ধা দেখে ইকবালটাও একইরকম হচ্ছে। তার রে*গেমেগে উঠে যেতে মন চায়৷ পরক্ষনে রাজনৈতিক কৌশলে নিজেকে শান্ত করে।
ইকবাল আপ্লুত চোখে বন্ধুর দিক চেয়ে থাকল। সেই চোখ জ্ব*লে উঠল পরপর৷ কোটর ছড়িয়ে পল্লব ছুঁলো। বদনের ঘাম মোছার ভাণ করে মাথা নীচু করে শার্টের হাতা দিয়ে মুছে নিলো জল। অপ*রাধবোধে হৃদয়পট ছেঁয়ে যাচ্ছে। এই বন্ধুর সাথে দুই বছর ধরে দূর্ভাবনীয় বেঈ*মানী করছে সে, ভাবতেই নিজেকে নীচ আর হেয় লাগছে ভীষণ৷
তাদের উৎসব শেষ হতে বিলম্ব হয়। দুপুর থেকে বিকেল,সন্ধ্যা গড়ায়। খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে দীর্ঘ আলোচনায় মগ্ন হলো সবাই। ইকবালের এক মুহুর্ত মন টিকছে না এখানে। তার অবস্থা গলাকা*টা মুরগীর ন্যায়।
একটাবার যদি পুষ্পর সাথে দেখা করার সুযোগ পেত। ফোন করবে একবার?
ভাবনা মতো সে উঠে দাঁড়াল। সবার চোখ তার দিকে ঘুরলে জবাব দিলো ‘ ওয়াশরুমে যাচ্ছি।’
ওয়াশরুমের সামনে এসেই তড়িঘড়ি করে ডায়াল করল পুষ্পর নম্বর। রিং হয়ে হয়ে বেজে গেল,ধরল না কেউ। ইকবালের অস্থিরতা তরতর করে ডগার ন্যায় বেড়ে যায়। বাম হাতে চুল খাম-চে খাম-চে টানল। পুষ্প ফোন ধরছে না কেন? সে কী আর তাকে চাইছেনা?
***
সাদিফ বাইক চালিয়ে সোজা এসে অফিসের সামনে নামল। স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে নিজেও দাঁড়াল। হেলমেট খুলে হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে আড়া-আড়িভাবে কাঁধে ফেলা কালো ব্যাগ ঠিকঠাক করে হেঁটে গেল ভেতরে। ভিউ মিরর দেখে, প্রতিদিন চুল সেট আপ করার বিষয়টা আজ আর মাথাতে এলোনা। সেখানে ভর্তি বেদনা,আর যাতনা তাকে ভুলিয়ে দিলো নিজের যত্ন। প্রতিটি কদমে তার দীর্ঘশ্বাস ভারী হয়। প্রতিটি পল্লব ফেলার সময় মনে পড়ে পিউকে। চোখে ভাসে তার মায়াময়,স্নিগ্ধ আঁদল। কেন যে অতটুকু মেয়ের প্রতি মন হারাতে গেল? নাহলে এই মানসিক টানাপো*ড়েনে পরতে হতোনা। এইভাবে দ্বিধাদন্দের চাপে নিঃ*শেষ হতে হতোনা।
তার মানসিক বিধ্ব*স্ততা হাজারে গড়িয়েছে গতকাল থেকে। পুষ্পর সম্পর্কে সব জেনে-শুনেও ওকে বিয়ে করতে হবে ভাবলেই হৃদয়সিন্ধুতে তমসা নামে। একটাবার যদি কিছু করতে পারত? বিয়েটা যদি আটকানো যেত!
সে থমকে দাঁড়ায় হঠাৎ। মনকে শ*ক্ত করে ভাবে,বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে সবটা খুলে বলবে। জানাবে সে পুষ্পকে নয়,পিউকে চায়। উল্টোদিকের পুষ্পও তাকে চাইছেনা। তার মনে ইকবাল। পরক্ষনে দুদিকে মাথা নাড়ল। কথাগুলো বলার সময় মায়ের ব্য*থিত মুখ মনে করে পিছিয়ে গেল। না, এ জগতে তার দ্বারা মানুষকে উপেক্ষা করা কঠিন,দূর্বার।
‘ আরে আপনি এখানে?’
হঠাৎ মেয়েলী স্বরে সম্বিৎ পেলো সাদিফ। চকিতে ঘুরে তাকাল। সম্মুখের পরিচিত তবে অনাকাঙ্ক্ষিত মুখটি দেখে বিস্ময়ে চেয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ। এই মেয়ে এখানে কেন?
মারিয়া এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়ায়। তার হাতে জল ভর্তি প্লাস্টিকের বোতল। বলল
‘ আপনি এই অফিসে কেন?
প্রশ্নটা করেই তার চোখ গেল সাদিফের বেশভূষায়। ফরমাল গেট-আপ দেখে ঠোঁট কামড়ে, অনুমান করে বলল,
‘ আপনিও কি এখানে কাজ করেন?’
সাদিফ অতি দ্রুত বিস্ময়ের হাবভাব সামলে ওঠে। চোখের চশমা ঠেলে গলা খাকাড়ি দেয়। গম্ভীর কণ্ঠে শুধায়,
‘ আপনি কে? ‘
মারিয়া আকাশ থেকে পরল।
‘ আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না? ‘
তার চোখ ছোট হয়ে এলো,
‘ চেনার মতো কোনও কারণ আছে? আপনাকে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ছেনা।’
মারিয়া ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বলল,
‘ কী আশ্চর্য! আপনার কি স্মৃতিশক্তি গেল না কী?’
আমি মারিয়া। আপনি ডাকেন ম্যালেরিয়া। মনে নেই?’
সাদিফ মুখের ওপর বলল ‘ না নেই। প্রয়োজন ছাড়া মনে রাখিনা কাউকে। ‘
মারিয়ার বুঝতে বাকী নেই, এই ব্যাটা ইচ্ছে করে এমন করছে। নাটক করছে তাকে না চেনার। সে কট*মট করে বলল,
‘ অফিসে কী করছেন,যাত্রাপালায় নাম লেখালেই পারেন। ‘
‘ এক্সকিউজ মি! দ্যাটস নান অফ ইয়র বিজনেস। আপনার সাথে কথা বলে সময় ন*ষ্ট করার ইচ্ছে নেই আমার। যেখানে দেখি ঝগ*ড়া করতে লাফিয়ে পরে। ঝগ*ড়ুটে মেয়ে কোথাকার! ‘
মারিয়া পুরোটা শুনল। চেঁতে -টেতে একাকার হওয়ার কথা ছিল। অথচ আঙুল তুলে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল,
‘ এইত চিনতে পেরেছেন। তার মানে সত্যিই নাটক করছিলেন আপনি। ‘
সাদিফ থতমত খেয়ে চোখের চশমা ঠেলল আবার। বলল,’ হোয়্যাটেভার! চিনেছি। তো?’
‘ তো মানে কী? ঢং করছিলেন কেন?’
সাদিফ জবাব না দিয়ে, পালটা প্রশ্ন ছুড়ল,
‘ আপনি এই অফিসে কী করছেন? আমাকে ফলো করে এসেছেন নিশ্চয়ই? ‘
মারিয়া অবাক হলো,
ব্যঙ্গ করে বলল,’ কী আমার সালমান খান এলেন,ওনাকে ফলো করে আসতে হবে। আমি এই অফিসে চাকরী পেয়েছি। আজ থেকেই আমার জয়েনিং।’
কথাগুলো বলতে পেরে তার বুক গর্বে ফুলে উঠল। বিশাল দপ্তরে সে কাজ করে ভাবতেই রোমাঞ্চিত অনুভব হয়। হোক সামান্য কর্মচারী,তাতে কী? তাও হওয়া ভাগ্যের।
সাদিফ মুখ কুঁচকে ভাবল,
‘ একে কে চাকরি দিলো? মাথার চেয়ে মুখ চলে বেশি।’
মুখে বলল,
‘ ও। ‘
চলে যেতে ধরলে মারিয়া জিজ্ঞেস করল,
‘ আপনি কোন পোস্টে আছেন?’
সাদিফের কাঠ উত্তর,
‘ সেটা আপনাকে কেন বলব? ‘
‘ না বলার কী আছে?’
‘ আমি অকারণে কোনও কথা বলিনা। এত ইন্টারেস্ট থাকলে নিজে জেনে নিন।’
মারিয়া মুখ বেকিয়ে বলল,’ আমার বয়েই গেছে। ‘
থামল। আবার বলল,
‘আপনি কি পিওন এখানে? আপনার জন্য এই পোস্টটা ঠিকঠাক। চা-পানি এগিয়ে দিতে অনেক ছোটাছুটি করতে হয়, সেজন্য গায়ে শক্তি লাগে। আপনার গায়ে তো অনেক শক্তি, গ্রামে বর্ষাকে তুলছিলেন শুনলাম । ‘
বলে,ঠোঁট চে*পে মিটিমিটি হাসল সে।
সাদিফের মুখ কুঞ্চন আরো গাঢ় হলো। কটম*টিয়ে উঠে আবার শান্ত হয়ে বলল,
‘ দেখুন, আজ আমার মনটা খা*রাপ। আপনার সাথে ফালতু তর্কে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। নিজের কাজে যান তো।’
মারিয়ার কিছু যায় এলোনা। কাঁধ উচিয়ে বলল,
‘ খা*রাপ মন,খা*রাপই তো থাকবে। ‘
সাদিফ তেঁতে কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। অফিসের চারপাশে চোখ বুলিয়ে আস্তে করে বলল,
‘ আপনি আসলে একটা যা তা মেয়ে। কোনও দিন শুধরাবেন না হয়ত।’
মারিয়াও একইরকম কণ্ঠ করে বলল,
‘ কিছু কিছু মানুষের জন্য আমার স্বভাব অপরিবর্তিত। আপনি হলেন তার মধ্যে একজন।’
‘ আপনি ইচ্ছে করে ঝগ*ড়া করতে চাইছেন তাইনা? ভদ্রতার সুযোগ নিচ্ছেন। ‘
পরক্ষনে সন্দিহান গলায় বলল,
‘না কী আমার মতো সুদর্শন ছেলের সাথে কথা বলার লোভ সামলাতে পারছেন না?’
শেষ কথায় মারিয়া হা করে ফেলল। পরমুহূর্তে খ্যাক করে বলল,
‘ আপনি সুদর্শন? এই মিথ্যেটা কে বলেছে আপনাকে?’
সাদিফ ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল ‘ মানে?’
‘ মানে,আপনাকে যে গোবর গনেশের মত দেখতে কেউ বলেনি?’
‘ আমাকে গোবর গনেশের মত দেখতে?’
গোবরের চিত্র চোখে ভাসতেই তার গা গুলিয়ে এলো। মারিয়া স্পষ্ট বলল,
‘ আমার মনে হয় আপনি দুঃখ পাবেন বলে কেউ বলেনি। সমস্যা নেই,বড় হয়েছেন, এখন সব বুঝবেন। আমি আপনাকে প্রথম বার সত্যিটা বলছি শুনুন, আপনাকে দেখতে কিছুটা বিদেশী মুরগীর মতোও। যাকে আমরা বলি ফার্মের মুরগী। আপনার গায়ের রঙ ঠিক ওইরকমই। ক্যাটক্যাটে সাদা। দেখলে মনে হয় ফ্লোরে চুন ঢেলে দিয়েছে কেউ। আপনার সাথে ফার্মের মুরগীর তফাত হলো, ও এক পা হেঁটে দু পা ঝিমায় আর আপনি একটার জায়গায় দশটা কথা বলেন। ‘
সাদিফ হতবাক হয়ে চেয়ে রইল। এক্ষুনি এই মেয়ের গলাটা টি*পে দিতে পারত যদি! কিংবা এক থা*প্পড়ে রুটি বানিয়ে ফেলতে পারলে শান্তি পেতো।
একে মাথা ঠিক নেই,দুইয়ে অফিস। এখানে তার রেপুটেশন আলাদা বলে চুপচাপ হজম করল সবটা। উল্টোপথে গটগটিয়ে হেঁটে গেল। নির্ভেজাল উপেক্ষা দেখে মারিয়া বিভ্রান্ত হয়ে বলল,
‘ কিছু বলল না কেন?’
সে ঘাড় চুল্কে এসে নিজের জায়গায় বসল। পানির বোতল টেবিলে রেখে
আশেপাশের সব জায়গায় চোখ বোলাল। বোকার রাজ্যে বসবাস করা নারী ভেবেই নিয়েছে, সাদিফ এই ডেস্কের কোথাও থাকবে। সেই মোতাবেক খুঁজে খুঁজে ক্ষান্ত হলো। না পেয়ে তার জিজ্ঞাসু লিপ্সা হুরহুর করে বাড়ে।
মিহি কণ্ঠে ‘ ভাইয়া শুনুন ‘বলে পাশের ডেস্কের ছেলেটিকে ডাকল। অফিসে এসে এর সাথে আলাপ হয়েছে তার।
ছেলেটি তাকালে শুধাল,
‘ সাদিফ নামে কাউকে চেনেন? ‘
‘ যার সাথে এতক্ষণ কথা বলছিলেন, ওনার নামই সাদিফ।’
মারিয়া খুশি হয়ে গেল। এর মানে ছেলেটি চেনে। সে আগ্রহভরে শুধাল,
‘ উনি এখানে কোন পোস্টে? ‘
‘ ম্যানেজার।’
‘ম্যানেজার’ শুনেই মারিয়ার চোখ তালুতে ওঠে। খুশির দফারফা, মুখটা চুপসে গেল ওমনি। সেতো এখানে সামান্য একটা পোস্টে চাকরী পেয়েছে। মাসে মাত্র চৌদ্দ হাজার টাকা বেতন। সাদিফ ম্যানেজার? এই লোকটা তো তাকে দেখতেই পারেনা। এখন কী এর আন্ডারেই থাকতে হবে?
হায় হায়!
সে মনে মনে আক্ষেপে শেষ। ঘুরেফিরে এখানেই চাকরী জুটল!
দুদিকে ত্রস্ত মাথা নেড়ে বলল ‘ আর ঝগ*ড়া করা যাবেনা।’
***
তখন রাত। ভীষণ অন্ধকারে ঢাকা মেঘশূন্য আকাশ। ঘড়িতে নয়টার বেশি বাজে। ইকবাল চোরের মত লুকিয়ে আছে একটা বড় গাছের আড়ালে। রু*দ্ধ শহরে তার শ্বাসও রু*দ্ধকর। সামনে সিকদার বাড়ির বিশাল লোহার গেট। বাড়ির চারপাশ আলোতে ডু*বছে। একবার ভেবেছিল সবাই ঘুমালে আসবে। গভীর রাতে। কিন্তু মনের দ্বিগবিদিক কাতরানোর কাছে হার মেনে আগেই হাজির হলো। ধূসর বাড়িতে নেই সে কনফার্ম। কারণ ওর আগে আগে সে ছুঁতো দিয়ে পার্লামেন্ট থেকে ছুটে এসেছে এখানে। ফেরার পূর্বেই তার কাজ হয়ে যাবে নিশ্চয়ই।
গেটের ধারে টুলে বসে ঘুমে ঢলছেন দারোয়ান। একটু পরপর চটক কে*টে ঠিকঠাক হচ্ছেন। তার ডিউটি এগারটা অবধি। এরপর আরেকজন। এইজন্যে এখনই ঘুম পাচ্ছে ভীষণ। আবার ঢলে পরছেন দেখে ইকবাল বিড়বিড় করে বলল
‘ হয় ঘুমান,নাহলে ভাগুন। দুইয়ের মধ্যে ঝুলে থাকা ভালো না।’
দারোয়ানের কানে কথাগুলো গেলোনা। হাঁটুর ওপর লাঠির ভর রেখে সে তখনও ঘুমে টলছে। ইকবাল একবার তুষাতুর চোখে দ্বিতীয় তলার বারান্দার দিক তাকাল। ঘরের আলো জলছে এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। এর মানে পুষ্প রুমেই, তাহলে ফোন টা কি কাছে নেই? তুলছেনা কেন? কেনই বা কল ব্যাক করছেনা?
এইভাবে তার হৃদয় নিয়ে খেলার কোনও মানে হয়?।
পুষ্প ফোন হাতে নিয়ে ঠোঁট উলটে বসে রইল।
ভেতর ভেতর তার ছটফটানি কিছু কম হচ্ছেনা। ইকবালের কল রিসিভ করার জন্য আঙুলগুলো নিশপিশ করছে খুব। কিন্তু ধূসর ভাই যে মানা করলেন।
ফোন ধরলেই যদি জ্বিভ ফস্কে কথা বেরিয়ে যায়,ভাইয়া রা*গ করবেন। কিন্তু সরাসরি এড়িয়ে যাওয়াও অসম্ভব । মনটা অস*হ্য রকমের আনচান করছে। কী করবে জানেনা। মনঃদ্বিধা বাড়ছে। কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। কোন কুক্ষণে সেজো চাচার মাথায় বিয়ের ভূত চাপল কে জানে!
এর মধ্যে টুং করে আওয়াজ হলো ফোনে। মেসেজ এসেছে। স্ক্রিনেই ভেসে উঠল,
‘ বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। বারান্দায় না আসা অবধি এখানেই থাকব ইনশাআল্লাহ। ‘
প্রেরক ইকবাল। পুষ্পর বুক ধ্বক করে উঠল ভ*য়ে। প্রকট চোখে বারান্দার দিক তাকাল। পরপর ত্রস্ত, এলোমেলো পায়ে ছুটল সেদিকে।
এক প্রকার বারান্দার রেলিং ধরে ঝুলে পরল সে। হন্যে চোখে গেটের দিক চেয়ে ইকবাল কে খুঁজল। দেখা যাচ্ছেনা। মিথ্যে যে বলেনি সে নিশ্চিত। এই ছেলের দুঃসাহস প্রবল।
তাকে দেখেই পুরূ ঠোঁটে হাসি ফুটল ইকবালের। গাছের সাথে হেলান দেয়া থেকে চট করে সোজা হয়ে দাঁড়াল।
পুষ্প কাঁ*পা কাঁ*পা হাতে ফোন করল। একবার রিং হতেই রিসিভ হয়। সে কিছু বলার আগেই ইকবালের ব্যথিত কণ্ঠে ভেসে এলো,
‘ এতক্ষনে আমায় মনে পড়ল মাই লাভ?’
পুষ্পর হৃদয় নাড়িয়ে দিলো এই ডাক। যা বসুমতীতে তার সবথেকে প্রিয়। মন, হৃদয়, মস্তক সব আবেশিত হয়,জুড়িয়ে যায়। ভেসে বেড়ায় আবেগের স্রোতস্বীনিতে। সে গলতে গিয়েও শ*ক্ত হলো। কপট রা*গ নিয়ে বলল,
‘ কোথায় তুমি?’
বলতে বলতে আশেপাশে মাথা ঘোরাল। নিরবে খুঁজল ইকবালকে। সে একটু এগিয়ে এসে দাঁড়ালে দৃশ্যমান হলো তার চওড়া দেহ। পুষ্প কিছু বলার পূর্বেই তার অশান্ত প্রশ্ন এলো,
‘ সাদিফের সাথে তোমার বিয়ে পুষ্প?’
পুষ্প চমকে গেল একটু। অবাক হয়ে বলল,
‘ তুমি কী করে জানলে?’
‘ এর মানে কথাটা সঠিক!’
ইকবালের আ*হত স্বর। পুষ্প মিনমিন করে জানাল,
‘ কথাবার্তা চলছে।’
সে ফুঁ*সে ওঠে,
” কেন চলবে? কীসের জন্য চলবে? এই পৃথিবীর সবাই জানে তুমি আমার বউ হবে। তাহলে? ‘
‘ বোকা বোকা কথা বোলোনা ইকবাল। তুমি আর আমি ছাড়া আমাদের সম্পর্কের কথা কে জানে?’
‘ আচ্ছা,কেউ জানেনা। তুমিতো জানো পুষ্প,তারপরেও বিয়েতে রাজী কেন হয়েছ?’
‘ তোমাকে কে বলল আমি রাজী? পিউ?’
‘ ধূসর!’
পুষ্পর কপালের ভাঁজ মিলিয়ে গেল। ভাইয়া বললে কারণ ছাড়া বলেননি। ঠোঁট গোল করে বলল,
‘ ও আচ্ছা।’
‘ ও আচ্ছা মানে? তুমি সত্যিই সাদিফকে বিয়ে করতে চাও?’
‘ না চাওয়ার কী আছে,ভাইয়া বললেন সাদিফ ভাই ভালো ছেলে। তাছাড়া বিয়ের পর বাড়ি ছেড়েও যেতে হবেনা।’
বলতে বলতে সে ঠোঁট চে*পে হাসল।
ইকবাল বিস্মিত। কণ্ঠে অবিশ্বাস ঢেলে বলল,
‘ কী! আর আমার ভালোবাসা?’
‘ আমি কী করব? বাড়ির সবাই মিলে ঠিক করল ইকবাল। না বলি কী করে?’
ইকবাল উদ্ভ্রান্তের ন্যায় আওড়াল,
‘ আর ইউ ক্রেজি? কী বলছো নিজে জানো? দুটো বছর ধরে আমরা একে অপরকে ভালোবাসি। এইত কদিন আগেই আমার হাত ছুঁয়ে কথা দিলে সারাজীবন পাশে থাকবে। হঠাৎ বদলে গেলে কেন মাই লাভ?’
শেষ দিকে গলা ধরে এলো তার। পুষ্পর মুখ কালো হয়ে যায়,মায়া হয়। এক্ষুনি জানিয়ে দিতে ইচ্ছে করে সত্যিটা।
ধূসরের নিষেধ মনে করে বলল না।
ইকবাল আবার বলল,
‘ আমি অত শত জানিনা, বউ হলে তুমি আমার হবে পুষ্প। নাহলে…. ‘
‘ নাহলে কী করবে?’
ইকবাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ‘ ম*রে যাব।’
পুষ্প আঁত*কে ওঠে। আর্ত*নাদ করে বলে
‘ এসব বলছো কেন?’
‘ তো কী শুনতে চাও? ভালোবাসলে আমাকে,আর পরিবারের কথায় বিয়ে করবে সাদিফকে? দিনশেষে সব মেয়েই এক?’
মুহুর্তমধ্যে পুষ্পর নাকের পাটা ফুলে ওঠে।
‘ কটা মেয়েকে চেনো?’
‘ তোমার মধ্য দিয়ে হাজার মেয়েকে চিনলাম।’
পুষ্প দাঁত পি*ষে বিড়বিড় করল।
‘ উজবুক! ওনার জন্য আমি কেঁদেকে*টে ম*রছি। সারাদিন পর রাতে দুটো দাঁনা পরেছে পেটে। আর সে আমার এক কথায় মেনে নিল আমি অন্য কাউকে বিয়ে করব? এই তার বিশ্বাস!’
‘ কী, চুপ করে আছো কেন?’
‘ কী বলব?’
‘ এখন আমার সাথে কথা বলতেও খুঁজতে হচ্ছে পুষ্প?’
‘না, আসলে সাদিফ ভাই উঁকিঝুঁকি দিচ্ছেন ঘরের ভেতর। কিছু বলবেন হয়ত। শুনে আসব?’
কথাটা ইচ্ছে করে রা*গাতে বলেছে সে। সফল ও হলো। ইকবাল তেলে-বেগুনে জ্ব*লে উঠে বলল,
‘ হা*রাম*জাদা আমার বউয়ের ঘরে উঁকি মা*রবে কেন? কোন সাহসে? ওর উঁকি মা*রা চোখ আমি তুলে নেব।’
পুষ্প গম্ভীর হওয়ার ভাণ করে বলল,
‘ সে আমার হবু বর ইকবাল। তুমি তাকে এভাবে বলতে পারোনা।’
ইকবাল দ্বিগুন নি*হত হয়ে ডাকল ‘ পুষ্প!’
‘ পুষ্প, পুষ্প করোনা তো। এত ভালোবাসলে বাড়িতে এসে বাবার কাছে আমাকে চেয়ে নাও। আমিতো না বলিনি। বলিনি তোমাকে বিয়ে করব না। তাহলে হাত গুটিয়ে বসে আছো কেন? অহেতুক ফোনের বিল না উঠিয়ে কাজের কাজ কিছু করো।’
‘ তোমার কী মনে হয়? আমি এমনি এমনি হাত গুটিয়ে বসে? আজ যদি তুমি ধূসরের বোন না হতে, তুলে আনতেও দুবার ভাবতাম না। বন্ধুত্ব আমার হাত পা বেঁ*ধে দিলো।’
‘ ভাইয়াতো তোমার বন্ধু নতুন হয়নি। ছোট বেলা থেকে তোমরা বেস্টফ্রেন্ড। জেনে-শুনেই তো আমার সাথে প্রেম করেছো৷ ‘
ইকবাল বিরোধিতা জানাল,ধীরস্থির কণ্ঠে বলল
‘ প্রেম করা যায়না মাই লাভ,হয়ে যায়।
মন দেয়া যায়না,হারিয়ে যায়।’
হৃদয়টা থমকে থমকে দাঁড়াল পুষ্পর। কালবৈশাখীর ন্যায় তু*ফান বইল মনে। নিরুপদ্রব হাওয়ায় ভেতরটা দুলছে।
পরক্ষণে অনমনীয় কণ্ঠে বলল,
‘ এসব কাব্যিক কথায় গলছিনা। প্রেম যখন করেছো,বিয়ে করতে হবেনা?নাহলে বসে থাকো,তোমার সামনে দিয়ে আমি সাদিফ ভাইকে বিয়ে করে চলে যাই। ও যাব কোথায়,আমাদের বাড়িতো একটাই।’
ইকবালের ভাসা ভাসা অক্ষিদ্বয় জ্ব*লছে। চিকচিক করছে অন্ধকারে। করূন কণ্ঠে বলল,
‘ তুমি কি মজা করছো মাই লাভ? এমন মজা কোরোনা,যাতে ইকবালের নিঃশ্বাস আটকে আসে। ‘
পুষ্পর বুক কেঁ*পে উঠল। ইকবালের মিহি নিনাদ অন্তকরন স্পর্শ করল নিদারূন ভাবে। অনেক মজা হয়েছে। মানুষটার অনুভূতি নিয়ে জেনেবুঝে ঠাট্টা করা উচিত নয়। ক*ষ্ট পাচ্ছে ও। সে নরম হলো। ভিজে গলায় বলতে গেল,
‘ আসলে…. ‘
আচমকা কথা থেমে গেল তার। চোখদুটো বড় বড় করে খট করে লাইন কা*টল। তারপর দ্রুত পায়ে ঢুকে গেল কামড়ায়। ইকবাল ঘটনার আগামাথা বোঝেনি। পুরোটাই ঘটেছে তার চোখের সামনে। তবুও সে অনবরত ‘হ্যালো হ্যালো’ করতে থাকে। মেয়েটার অদ্ভূত,অপরিচিত আচরণ বিভ্রমে ভোগাচ্ছে। এলোমেলো করে দিচ্ছে তাকে। পুষ্পতো এরকম নয়।
সেই ক্ষনে কাঁধে একটা শ*ক্ত, পুরুষালী হাত পরল। চমকে গেল ইকবাল। ঘুরে চেয়ে বিশালাকার হো*চট খেল।
ধূসরের ভ্রুঁ এক জায়গায় জড়োসড়ো। চেহারায় বিস্ময়ের ছাপ। ইকবাল ত্রস্ত ফোন নামিয়ে পকেটে ঢোকায়। হাসার চেষ্টা করে।
‘ তুই এখানে?’
ইকবালের গলা শুকিয়ে গেল। ভ*য়ে ভ*য়ে বক্র চোখে একবার দেখে নিলো পুষ্পর বারান্দার দিকে। পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা মেয়েটাকে অতদূর থেকে চোখে পড়ে না। ‘
‘ বাসায় যাওয়ার জন্য এত তাড়াহুড়ো করলি,বেরও হলি সবার আগে। তাহলে এখানে কেন?’
তার কণ্ঠের গাম্ভীর্যে ইকবাল ঢোক গি*লল দুবার৷ ঠোঁটের আগায় যা পেল তাই বলল,
‘ তোকে খুঁজতে এসেছিলাম।’
পুনরায় হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করল সে। ধূসরের চোখ-মুখ শিথিল হলোনা। ভ্রুঁ নাঁচাল,
‘ আমাকে খুঁজতে? ‘
ইকবাল মাথা ঝাঁকাল।
ধূসর বলল ‘ ফোন করলেই হতো।’
সে আমতা-আমতা করে বলল,
‘ হয়েছে কী,ফোনে ব্যালেন্স নেই। আবার বিকাশ ও ফাকা তাই ওই….”
ধূসর মাঝপথেই কলার ধরে টান মার*ল ‘ চল।’
ইকবাল চকিতে বলল ‘ কোথায়?’
‘ ভেতরে।’
সে ধা*ক্কা খায়,চমকিত হয়ে বলে ‘ ভেতরে কেন?’
‘ গেলেই বুঝবি।’
তীব্র অনিচ্ছা আর প্রকান্ড কৌতুহল নিয়ে ধূসরের সঙ্গে পা মেলালো ইকবাল। যেতে যেতে বহুবার পুষ্পর বারান্দায় দেখল। ধূসর তাকে সাথে নিচ্ছেনা, যেন আ*সামী টানছে।
সে চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই ঘাব*ড়ে গেল। বসার ঘরে আনিস আর সাদিফ ব্যতীত সবাই আছেন। এত মানুষকে একসাথে দেখে নার্ভাসনেসে হাত পা শীতল। শরীরটা কেমন থরথর করছে।
আমজাদের গায়ে কোর্ট-প্যান্ট, টাই ঝুলছে গলায়। আফতাবেরও একই। আজমল শুধু পরে আছেন বাসার পোশাক। বাকী দুজন কিছুক্ষন আগেই অফিস থেকে ফিরেছেন। তাদের মধ্যে কিছু নিয়ে হৈহল্লা চলছে। এতজনের কণ্ঠ আলাদা করা মুশকিল। সকলের ঠোঁটেই চওড়া,বিস্তৃত হাসি। পুষ্প ঘর থেকে উড়ে এলো প্রায়। ইকবালকে ভেতরে ঢুকতে দেখে তার কলিজা দা*পাচ্ছে। আমজাদ বললেন,
‘ তাহলে তোমরা টেবিলে খাবারের বন্দোবস্ত করো। আমরা ফ্রেশ হয়ে আসি মিনা।’
‘ আচ্ছা যাও। ‘
আমজাদ উঠতে যাবেন, এর আগেই ধূসর বলল,
‘ একটু পরে যান বড় আব্বু।’
সকলের কথাবার্তা স্থগিত হলো তার আওয়াজ পেয়ে। আমজাদ থামলেন, তবে ইকবালকে দেখেই তৎপর মুখ বিকৃত হলো তার। অথচ গৃহীনিরা গদগদ হয়ে গেলেন। মিনা বেগম দুপা এগিয়ে বললেন,
‘ ওমা ইকবাল! কতদিন পর এলে! এসো এসো।’
ইকবাল হাসল। আড়চোখে পুষ্পকে দেখতে দেখতে এগোলো। আজমলের সাথে বহুদিন পর সাক্ষাৎ বিধায় দুজন করমোর্দনের সাথে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরল। আমজাদের একটুও পছন্দ হলোনা এসব। মনে মনে আওড়ালেন ‘ আদিখ্যেতা’
পুষ্পর বুক ঢিপঢিপ করছে। মিনা বেগম এত জোরে ইকবালের নাম উচ্চারণ করেছেন যে,পিউয়ের ঘর অবধি পৌঁছে গেল। সে চটজলদি সোজা হয়ে বসল। কী মনে করে হূল*স্থূল বাধিয়ে দৌড়ে এলো সিড়ির কাছে। নীচে নামলোনা, ওপরে দাঁড়িয়ে থাকল। পাছে কেউ বলে ফ্যালে ‘ পড়া রেখে এখানে কী!’
সবার আগে তার চোখ আটকায় লম্বাদেহী প্রিয় মানুষটার ওপর। ওইত দাঁড়িয়ে আছেন। ইশ,কেউ এমনি দাঁড়িয়ে থাকলেও এত ভাল্লাগে দেখতে?
ধূসরকে দেখেই চঞ্চল পিউয়ের হৃদয় নুইয়ে আসে ফের। গতকাল রাতের পর মানুষটার সুতনু চেহারার দর্শন পেলো এতক্ষনে । ভোরে উঠতে পারেনি বিধায় দেখা হয়নি। সারাটাদিন সে ব্যস্ত,আর ও ছিল পরীক্ষার হলে। অথচ অন্তরিন্দ্রিয়ের আনাচে-কানাচেও ধূসর নামের একটা জ্বল*জ্যান্ত প্রদীপ শিখা ছলকে বেরিয়েছে বহুবার। মোহিত তরঙ্গ আছড়ে পরেছে চিত্ত পাড়ে। নিবিষ্ট, অনুরক্ত মন, তার হাসি,রা*গ ভেবে ভেবে অদূরে হারিয়েছে।
পিউয়ের গাল দুটো লজ্জ্বায় র*ক্তাভ হয়েছে ততবার,যতবার মানস্পটে ভেসেছে ধূসরের ঠোঁট যূগল ধেঁয়ে আসার দৃশ্য। কাল সে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলে সাংঘাতিক কিছু ঘটে যেত নিশ্চিত৷ ইশ!
কুন্ঠায় যখন মরিম*রি অবস্থা, কানে এলো রিনরিনে চাপা, ফিসফিসে কন্ঠ। কে যেন নাম ধরে ডাকছে! পিউ সচকিত হয়ে এদিক সেদিক তাকাল। পুষ্প তাকে ইশারা করছে নিজের পাশে এসে দাঁড়াতে।
পিউ আস্তেধীরে সিড়ি বেয়ে নামে। কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই, সে প্রশ্ন ছুড়ল
‘ ভাইয়া ইকবালকে এনেছেন কেন বলতো!’
তার চিন্তিত, উদ্বীগ্ন কণ্ঠ। পিউ চোখ বড় বড় করল। ইকবাল ভাই এসেছেন না কী? সে তল্লাশি চোখে সামনে তাকাতেই ইকবাল কে দেখে স্তম্ভিত হয়। অস্পষ্ট আওড়ায়, একী কান্ড!’
‘ আমিতো ভেবেছিলাম ইকবাল বোধ হয় আমাদের বাড়ির রাস্তা ভুলেই গেছে। আজ এতদিন পর দেখে অবাক হয়েছি। ‘
জবা বেগমের কথায় ইকবাল আবার হাসল। এই মুহুর্তে এই বোকা-বোকা হাসি ছাড়া তার কাছে কিছু নেই।
রুবায়দা,সুমনা ঝটপট কিছু নাস্তা আনতে ছুটলেন।
আমজাদের মেজাজ খা*রাপ । তিক্ত, ত*প্ত চোখে তিনি ধূসরকে দেখছেন। এই ছেলেকে তার রগে রগে অপছন্দ। একেই বাড়িতে আনতে হলো?
তিনি ধূসরের সাথে কথা বলেন না। অফিসেও না।
তাকে আটকালকেন, জেদের বশে জিজ্ঞেসও করলেন না। আবার উঠতে নিলে ধূসর এসে সামনের সোফায় বসল। বলল,
‘ অনেক তাড়া বড় আব্বু?’
তিনি একটু থতমত খেলেন। চাইলেন উত্তর দেবেন না। পরমুহূর্তে সিদ্ধান্ত পালটে গম্ভীর গলায় বললেন,
‘ অফিস থেকে এসেছি। ফ্রেশ হতে হবেনা?’
‘ হ্যাঁ, সেতো হবেন। আসলে একটা দরকারে আপনাকে আটকাচ্ছি। কাজ মিটুক,চলে যাবেন। ততক্ষণ না হয় একটু বসলেন।’
‘ কী কাজ?’
‘ বলব। সাদিফ আসছেনা কেন? দশটা ওভার,আসার তো কথা।’
সে হাতঘড়ি দেখল। বলতে না বলতেই দোরগোড়ায় সাদিফের পদধূলি পরে। সে এত মানুষের ভিড় দেখে আর ওপরে গেল না। নিজে থেকেই এসে ভীড়ে গেল সেখানে। অভ্যাসবশত পিউয়ের কাছে পানি চাইল প্রথমে। পরক্ষনে থেমে বলল,
‘ না,তোকে আনতে হবেনা। মা নিয়ে এসো।’
জবা বেগম হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে এগোলেন। পিউ তার যাওয়ার দিক চেয়ে গাল চুল্কে আবার সবার দিক তাকাল। ধূসরের সাথে সোজা-সাপটা চোখাচোখি হতেই লজ্জা পেলো। কুণ্ঠিত ভঙিতে নামিয়ে নিলো দৃষ্টি। তার গালের লালিত আভা দেখে সাদিফের বুক ভারী হয়। ব্যকুলতা বাড়ে। সে চুপচাপ সোফায় বসে। হঠাৎ ইকবালের দিক খেয়াল পরতেই সজাগ চোখে তাকায়। চোখের কোনা দিয়ে একবার পর্যবেক্ষণ করল পুষ্পকে। ঘনঘন আঁখি ঝাপটে তার পাশে বসে শুধাল,
‘ ইকবাল ভাই,হঠাৎ? ‘
ইকবাল ধূসরের দিক তাকিয়েছিল। তার ভেতর ঘূর্নিঝড় শা শা বেগে বইছে। ঠিক তার নাক বরাবর দাঁড়িয়ে পুষ্প। এত এত মানুষকে ফেলে তার হচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরতে। গলা ফাটিয়ে আর্তচি*ৎকার দিতে ‘ তুমি শুধু আমার মাই লাভ। তোমাকে পাওয়ার অধিকার আর কারো নেই।’
সাদিফ পাশে বসতেই ইকবাল সচেতন হয়ে বসল। অচিরেই আবিষ্কার করল, ছেলেটাকে তার সহ্য হচ্ছেনা। মেয়েরা মেয়েরা সতীন হলে সাদিফ তার সতান নিশ্চয়ই? সতান কে কারো ভালো লাগে? অত উদার সে নয়। জোরপূর্বক হেসে বলল,
‘ ধূসর নিয়ে এলো। ‘
‘ ওহ।’
আকষ্মিক মনে পড়ল,পুষ্প বলেছিল সাদিফ ঘরে উঁকি মা*রছে। ওতো মাত্রই ফিরল অফিস থেকে। এর মানে মেয়েটা তার সাথে ফাজলামো করছিল? তাও এরকম সেন্সিটিভ ব্যাপার নিয়ে? ইকবাল রে*গে পুষ্পর দিক তাকাল। ভ*য়ে,চিন্তায় মেয়েটার শুষ্ক,আধম*রা চেহারা দেখেই টুপ করে ক্রো*ধটুকু ঝরে গেল আবার।
‘ সবাই এসেছে,তাহলে কাজের কথা শুরু করি?’
মিনা বেগম ঘাড় কাত করলেন। প্রত্যেকে একটু নড়েচড়ে বসল। আগ্রহী চোখ গুলো সব ধূসরের শ্যামলা মুখশ্রী জুড়ে। সে ঘোষনার মত উঁচু কণ্ঠে বলল,
‘ আগামীকাল ভোরে আমি সিলেট যাচ্ছি। ফিরব সপ্তাহখানেক পরে। তাই চাইছিলাম পুষ্প আর সাদিফের এনগেজমেন্টের দিনক্ষণ জেনে যেতে। তাছাড়া সেজো চাচ্চুর ছুটিও বেশিদিন নেই। এই নিয়ে আজকেই একটা সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হয়না?’
ইকবাল -পুষ্পর বক্ষস্থল ছ্যাত করে উঠল। স্তব্ধ হয়ে গেল দুজনে। পুষ্প খপ করে চে*পে ধরল পিউয়ের হাত।
শ*ঙ্কিত,ক*ম্পিত স্বরে বলল
‘ ভাইয়া এসব কী বলছেন?’
পিউ ভেতর ভেতর আ*তঙ্কিত, ভ্রান্ত হলেও,বোনকে আস্বস্ত করতে বলল,
‘ ওনার নিশ্চয়ই কোনও পরিকল্পনা আছে। অপেক্ষা করি।’
আফতাব কপালে ভাঁজ ফেলে শুধালেন,
‘ হঠাৎ সিলেট।’
‘ একটু কাজ পরেছে।’
‘ রাজনৈতিক? ‘
‘ ওরকমই।’
ইকবাল জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট চাটল। তার চোখ দুটো গুটিয়ে এক জায়গায় পৌঁছেছে। রাজনীতির কোনও ব্যাপারে ঢাকার বাইরে যাওয়ার কথা তো হয়নি। হলে সে জানত নিশ্চয়ই।
ইকবাল কী করবে ভেবে পাচ্ছেনা। বিয়ে নিয়ে ধূসর উতলা, আগ্রহী। এটাই স্বাভাবিক। ও তো আর কিছু জানেনা। কিন্তু বন্ধু তাকে ভালোবেসে এখানে আনল,তারই ভালোবাসার মানুষের বিয়ের দিন ঠিক হওয়া দেখাতে?
ইকবাল নিজেকে স্থির রাখতে বিফল। সে গাঢ় কৌতুহলকে দ*মাতে পরাজিত। ধূসরের কানের কাছে মুখ নিয়ে শুধাল,
‘ সিলেট যাওয়ার কথা কবে হলো?’
ধূসরের সহজ উত্তর ‘ তুই আসার পর।’
সে চুপ করে গেল। পরমুহূর্তে আবার নীচু কণ্ঠে শুধাল,
‘ আমাকে এখানে কী বিয়ের কথাবার্তা শোনানোর জন্য আনলি?’
‘ হ্যাঁ। ‘
ইকবাল অক্ষি বিকট করে বলল ‘ কেন?’
‘ তুই আমার বন্ধু,আমার বোন তোরও বোন। এসব শোনার অধিকার আছে তোর। এখন চুপ কর,আমাকে কথা শেষ করতে দে।’
ইকবালে দাঁত পি*ষে,বহুক*ষ্টে স্বাভাবিক হয়ে বসল। পেট, ক্রো*ধে ফাটছে। ধূসরের চোখা নাকে একটা ঘু*ষি মা*রতে পারলে ভালো হোতো। ঠান্ডা হোতো মাথাটা। দুনিয়ায় আর কোনও মেয়ে নেই? যে পুষ্পকেই তার বোন বানাতে হবে? নিজে তো পিউকে বোন বললে ক্ষে*পে যায়। তখন?
পিউয়ের চোখমুখ অন্ধকার। ধূসর ভাই সপ্তাহ খানেকের জন্য সিলেট গেলে কতগুলো ঘন্টা দেখা হবেনা। কী করে থাকবে সে? উনি একটাবার ওকে জানালোওনা। সপ্তদশীর ক্ষুদ্র অন্তঃপুরে অভিমান জমলো। মাথা নামিয়ে কপাল কুঁচকে রইল।
‘ বড় মা,সেজো মা,অসুবিধে আছে তোমাদের?’
দুজনেই এক এক করে বললেন,
‘ না না কীসের অসুবিধে?’
‘ তাহলে কবে করতে চাইছো?’
জবা বললেন,
‘ তোর চাচ্চুতো পনের তারিখ যাবেন বলছেন। এখন ফাল্গুন মাস চলছে। এর মধ্যে করলে ভালো হতো না?’
আজমল মাথা দোলালেন ‘ আমারও তাই মনে হয়। ভাইজান,তোমরা কী বলো?’
আমজাদ বি*রক্ত মেজাজে, চুপ করে বসে। না পারতে মাথা নাড়লেন অল্প। আফতাব ও বড় ভাইয়ের পন্থা অনুসরন করলেন।
ইকবালের কপাল ঘামছে। এসির মধ্যেও পড়নের শার্ট ভিজে লেগে গিয়েছে গায়ে। দুইহাতের তালু ঘষে ঘষে খসখস শব্দ করছে। চিবুক ফুটছে উত্ত*প্ত তাওয়ার ন্যায়৷
পুষ্প -পিউ আর ধূসরকে বাদে বাকী সবাইকে গু*লি করে খুলি উড়িয়ে দিতে মন চাইছে।
ধূসর বলল ‘ ভালো হলে ওইদিনই করো। সমস্যা নেই।’
ইকবাল নিস্তব্ধ হয়ে পরে। বৃহৎ নেত্রে ধূসরের দিক চাইল। আর একটুও সহ্য হলোনা এসব। তার ধৈর্যের বেড়ি গুড়ো গুড়ো হয়ে গিয়েছে। মাথার ভেতর দাউদাউ করে বহ্নি*শিখা জ্ব*লছে। সে ছিটকে ওঠার মতন বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। তারস্বরে চি*ৎকার করে বলল,
‘ না, সমস্যা আছে,আলবাত সমস্যা আছে।’
পুষ্পর মাথা চক্কর কা*টল ওকে দাঁড়াতে দেখে। পিউয়ের হাতে দা*বিয়ে দিল নখ। হাঁস*ফাঁস করে বলল,
‘ আমার বুকে ব্য*থা করছে পিউ।’
পিউ বিড়বিড় করে বলল’ আমার তো সব জায়গায় ব্য*থা করছে।’
চলবে