এক সমুদ্র প্রেম পর্ব-৩৩ + বোনাস পর্ব

0
1679

#এক_সমুদ্র_প্রেম!
লেখনীতেঃ নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(৩৩)
ইকবাল দাঁড়িয়ে আছে। অনেকক্ষন ধরে অপেক্ষা করছে পুষ্পর। এমনিতে মেয়েটা সব সময় আগে আসে, আজ যে কী হলো!
সে বিচলিত, চিন্তান্বিত। পুষ্প তো দেরী করেনা কখনও। উলটে আগে আগে এসে বসে থাকে। যদি সাক্ষাৎ এর সময় থাকত এগারটা,পুষ্প হাজির হতো সাড়ে দশটায়। আধ ঘন্টা পথ চেয়ে বসে থাকত ওর। বলত ‘তোমার জন্যে অপেক্ষা করতে যে সুখ পাই,সেই সুখ অন্য কিছু তে পাইনা ইকবাল।’

ইকবাল মনে মনে হাসল। পুরনো স্মৃতি চারণ থেকে বেরিয়ে আরেকবার হাতঘড়ি দেখল। ফোন করবে কী করবেনা দ্বিধান্বিত সে। আজত শুক্রবার,পুষ্পর ক্লাস নেই,ভার্সিটি বন্ধ। ফোন করা নিষেধ। পাছে ধরা পরে! পিউ সেদিন ফোন ধরে ফেলায় দুজনেই আরো অধিক তটস্থ। এত কিছুর মধ্যেও ওদের দেখা করা চাই। মেয়েটা নানান অজুহাতে বাড়ি থেকে বের হবে। দুজন-দুজনকে না দেখলে শান্তি নেই যেন।

ইকবাল অস্থির ভঙিতে এ মাথা- ও মাথা হাঁটল। ধুর ভাল্লাগছে না! আসছেনা কেনও ও? কখন আসবে? এত ক*ষ্ট অপেক্ষায়? কোনও সমস্যা হয়েছে কি বাড়িতে? ফোন করবে একবার? করবে ভেবেও থেমে গেল। ওর জন্যে সমস্যা হলে পুষ্প চিঁ*বিয়ে খাবে। তার অধীর অপেক্ষার মাঝে একজন এসে দাঁড়াল সেখানে। মুখ ভর্তি মেক আপ,সালোয়ার কামিজ পরিহিত মানুষটি কেমন মোটা স্বরে বলল,
‘ অ্যাই ভাইয়া টাকা দাও।’
ইকবাল ঘুরে তাকাল। নিমিষে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। কথা না বাড়িয়ে মানিব্যাগ বের করে দশ টাকা বারিয়ে দিতেই আগন্তুক দুদিকে মাথা নাড়লেন। ঘোর আপত্তি জানিয়ে বললেন,
‘ আজকের দিনে দশ টাকায় হবেনা,গুনে গুনে একশ টাকা দাও।’

‘ আজ কী?’
‘অ্যাই ভাইয়া কী বলে? আজ কী তুমি জানোনা বাবু? চারপাশে দেখছোনা কত নিব্বা নিব্বি বসে,হু হু? আজ ভালোবাসা দিবস,আবার পহেলা ফাল্গুন। দাও দাও, একশ টাকা দাও জলদি, সময় নেই। ‘

ইকবালের কপালের ভাঁজ মসৃন হয়। জ্বিভ কা*টল মনে মনে। আজ যে ভালোবাসা দিবস ভুলেই বসেছিল। অবশ্য ভুলবেনা কেন,সে কি এই একদিন তার পুষ্পকে ভালোবাসে? আলাদা করে ভালোবাসা দিবস তারাই পালন করে যাদের ৩৬৪ দিন ঘাটতি থাকে ভালোবাসতে। তার তো নেই।
‘ এই কী ভাবছো? এত ভাবাভাবি না করে টাকা দাও ত। নাহলে কিন্তু ভুল জায়গায় হাত দিয়ে দেব হু।’

ছেলেটার চোখ কপালে উঠল। দাঁড়ানো থেকে দু পা পিছিয়ে এলো ওমনি। এদের বিশ্বাস নেই। দিতেও পারে। তড়িঘড়ি করে একশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিতেই সে খুশিমনে নিলো। যেতে যেতে রসিয়ে বলল,
‘ তুমি হ্যান্ডসাম আছো, ভালোও। তাই সালাম দিলাম,আসসালামু আলাইকুম।’

ইকবাল হেসে উত্তর করল। তারপর আশেপাশে উদগ্রীব চোখে তাকাল। এতক্ষণ ফুল নিয়ে কত ছেলেমেয়ে ঘুরেছে৷ অথচ এখন একটাও নেই। সে এগিয়ে গেল কয়েক পা। ওইত একটু দূরেই দুটো বাচ্চা ছেলে ফুল নিয়ে বসে। ইকবাল গিয়ে সেখানে দাঁড়ায়। ভীড় আছে ভালোই। প্লাস্টিকের দুটো মগ ভর্তি বড় বড় গোলাপ। টকটকে, তবে তাজা নয়। সব গুলো ন্যাতানো। ইকবালের পছন্দ হলো না। এমন নেতানো পুষ্প তার পুষ্পরানির জন্যে নহে!

ইকবাল চলে এলো। ব্য*র্থ হয়ে বেঞ্চে বসল। পুষ্প কী রা*গ করবে সে ফুল না দিলে? তার ভাবনার মধ্যে কেউ একজন চে*পে ধরে দুই চোখ। খানিকটা হকচকাল সে। পরপর মুচকি হেসে হাতদুখানি আক*ড়ে ধরল। হস্তের মালিক বলল,
‘ কে আমি, বলুন তো?’
ইকবালের দৃঢ় প্রত্যয়ী জবাব,
‘ আপনি সে, যে এই ইকবাল নামক মানুষটার মনের মধ্যে বিশাল এক ঘড় বানিয়ে বসবাস করছে, তাও ভাড়া ব্যাতীত। ‘
পুষ্প হেসে ওঠে। ইকবাল হাতদুটো সরিয়ে এনে ডান হাতের তালুতে চুমু খেল। ঈষৎ কম্পনে শরীর দুলে ওঠে তার। ইকবাল হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ভ্রুঁ নাঁচিয়ে বলে,
‘ আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারি জানো?’
পুষ্পর সহজ উত্তর ‘ হ্যাঁ। কে না জানে!’
ইকবাল একটু হাসলো। সুধীর কন্ঠে বলল
‘ এই ভালোবাসা দিবসে আমার কি তোমাকে আরেকটু বেশি ভালোবাসা উচিত মাই লাভ?’

পুষ্প তৎক্ষণাৎ উত্তর দিতে পারল না। ইকবালের প্রতিটি কথা ভেতরটা গুলিয়ে দিতে যথেষ্ট।
চটজলদি ওই নেশালো চোখ থেকে দর্শন ফিরিয়ে নেয় সে। নি*ক্ষেপ করে পায়ের বুড়ো আঙুলের ওপর।

পুষ্পর লাজুক,লতানো হাসি ইকবালের বক্ষে সুনামি ওঠায়। তান্ড*ব করে ঝ*ড়ের ন্যায়। ভুলভাল কিছু করে ফেলতে মন চায়। সে টেনেহি*চড়ে সরায় দৃষ্টি। আরেকদিক ফিরে, ঘাড় ঘষে, স্পষ্ট বিড়বিড়িয়ে বলে,
‘ এভাবে হেসোনা মাই লাভ,যা তা ঘটে যাবে।’

পুষ্প সচেতন হয়ে তাকালে চোখ টিপল সে। আরো কয়েক ধাপ বাড়তি লজ্জায় নুইয়ে গেল মেয়েটা। ইকবাল সেই কুণ্ঠা তীব্র করতে বলল,
‘ বিলিভ মি পুষ্প,তুমি যখন মাথা নামিয়ে, মুচকি মুচকি হাসো, আমার ইচ্ছে করে তোমার ফোলা গাল দুটো খেয়ে ফেলতে। ইচ্ছে করে…’
পুষ্প আর্ত*নাদ করে ওঠে,
‘ চুপ করবে ইকবাল?’
ইকবাল স্বশব্দে হেসে উঠল। হাসিতে দোল খেল লম্বাচওড়া দেহ। স্বইচ্ছায় এরকম লজ্জ্বার বাণ ছু*ড়েছে সে। পুষ্প ঠোঁট চে*পে হাসছে। উশখুশ -উশখুশ করছে।
এই ঠোঁট কা*টা মানুষটা বড্ড জ্বা*লায়! অন্তঃস্থলে পী*ড়া দেয়। অথচ একেই ওর চাই। কী তাজ্জব ব্যাপার!
ইকবাল হাসি থামাল। হঠাৎই গুরুতর কণ্ঠে শুধাল,
‘ একটা কথা বলব?’
আওয়াজ শুনে তটস্থ হয়ে বলল,
‘ বলো।’
‘ তোমার জন্যে আমি কোনও ফুল আনিনি পুষ্প। আমার মনেও ছিল না ‘আজ ভালোবাসা দিবস’। যখন শুনলাম এই সারা গার্ডেন খুঁজেছি,যা পেয়েছি,পছন্দ হয়নি, তাই কিনিনি। এই যে দ্যাখো, আমার হাত খালি। আজ এই দিনে তোমাকে ফুল না দেয়ার অপ*রাধে তুমি কি রা*গ করবে? ক*ঠিন শা*স্তি দেবে আমায়?’

কী অনাড়ম্বর স্বীকারোক্তি! পুষ্পর কানে তরঙ্গের মত বাজল। এর থেকে নিষ্পাপ,অকলুষিত কিছু নেই যেন। জড়ো হওয়া দুই ঠোঁট আপনা-আপনি সরে গেল দুদিকে।
বলল ‘ আমাকে তোমার এমন মনে হয়?’

ইকবাল দ্বিধান্বিত। জ্বিভে ঠোঁট ভিজিয়ে জানাল,
‘ প্রেমিক পুরুষ তো,প্রেয়সীর ক্রো*ধ নিয়ে আ*তঙ্ক থাকাই কি স্বাভাবিক নয়?’
পুষ্প চোখা করে তাকাতেই হেসে বলল
‘ মজা করেছি মাই লাভ। ‘

পুষ্প কিছু বলল না। কাঁধ ব্যাগের চেইন খোলায় ব্যস্ত হলো হঠাৎ। ভেতর থেকে দুটো গোলাপ বের করে ইকবালের সামনে ধরে বলল,
‘ এগুলো কেনা নয়,আমার বারান্দায় যে গাছ গুলোকে বাচ্চার মত পেলেপুষে বড় করেছিলাম সেখান থেকে এনেছি। আমার এক প্রিয় মানুষের জন্যে আরেকটি প্রিয় জিনিসের ব*লি দিলাম। এখানে দুটো ফুল আছে ইকবাল। এক কাজ করি চলো,এর থেকে একটা আমি তোমাকে দেই অন্যটা তুমি আমাকে দাও। হলোনা বরাবর?’

ইকবাল আপ্লুত চোখে তাকায়। চাউনী ছি*ড়ে-খুঁ*ড়ে যেন মুগ্ধতার বর্ষন। মাথা নামিয়ে ঠোঁট কাম*ড়ে হাসে। এই লক্ষী,এই সরল,আর মায়াময়ী মেয়েটি ওর নিজের। একান্ত নিজের। যদি না হয় সে কী বাঁচবে? হবে না কেন,হতেই হবে। নাহলে জীবন ব্যর্থ, বেঁচে থাকা অর্থহীন।

‘ কী হলো,নাও।’
ইকবাল নিলো। দুটো ফুলই নিলো। শুধু দেয়া বলতে হাটুগেড়ে বসে গেল সামনে। সবিস্মিত পুষ্প। চোরা,জড়সড় নজরে একবার আশপাশটা দেখল। ওইত অনেকেই দেখছে তাদের। মেয়েটা আই-ঢাঁই করে চা*পা কণ্ঠে বলল,
‘ ককী করছো ইকবাল?’
সে মানুষের কোনও দিকে খেয়াল নেই। তার বশীভূত, মূঢ় নেত্র একধ্যানে তাকে দেখছে। পুষ্পর শরীর সংকোচন গাঢ় হয়। ওই চোখে তাকিয়ে থাকা যায় না।
ইকবাল পুরু, কালো দু ঠোঁট নেড়ে আওড়াল,
‘ ১৪ই ফেব্রুয়ারী তো একটা উপলক্ষ্য মাত্র। মাই লাভ,আমি তোমাকে প্রতিটা দিন,প্রতিটা ঘন্টা, প্রতিটি মিনিট, প্রতিটি সেকেন্ড ভালোবাসি।’

পুষ্প মোহগ্রস্ত, বিভোর। মূক হয়ে চেয়ে। ইকবালের নিখাঁদ, সুদৃঢ় কণ্ঠ শব্দ খুঁইয়ে দেয়। ভুলিয়ে দেয় পার্থিব সব কিছু ।
মন্থর গতিতে হাত এগিয়ে ফুলগুলো ধরে। কাছে এনে আকড়ে নেয় বুকের সাথে। আস্তে করে বলে,
‘ ওঠো,সবাই দেখছেত।’
ইকবাল উঠল, বাধ্যছেলের মত। তবে কাছে এসে দাঁড়াল। হলো ঘনিষ্ঠ। যৎকিঞ্চিৎ দূরুত্ব ঘুঁচে গেছে তখন। এত কাছাকাছি হওয়া, পুষ্পর হৃদয়ে তোলপাড় চালায়। ব্রীড়িত ঢেউ আঁছড়ে পরে বুকে।
ইকবাল সজীব,আকুল কণ্ঠে বলল,
‘ পুষ্প,তুমি আমার জীবনের প্রিয় প্রাপ্তি।’
‘ আর তুমি আমার ভুবনে সুখের তৃপ্তি। ‘
‘ কখনও ছেড়ে যাবেনা তো?’
ইকবাল হাত বাড়িয়ে দেয়। নিরবে চায় অঙ্গীকার। পুষ্প বিনা বাধায়, দ্বিধাহীনভাবে হাতের ওপর হাত রাখে। অধর নেড়ে আত্মবিশ্বাস সমেত জানায়,
‘ যাব না, কথা দিলাম।’

দুটো চড়ুই পাখির ন্যায় পাশাপাশি শরীর ওদের। মিশে একাকার অধীর,আকাঙ্ক্ষিত অক্ষিপট। প্রেমের বাঁধনে এক জোড়া মন বাঁধা পরেছে ঠিক,কিন্তু বৈধ বন্ধন আসতে কত বাকী আর? কবে ওপাশের মানুষটিকে একটু ছুঁয়ে দেখবে তারা? যাতে নিষেধ নেই,বারণ নেই, আছে ভালোবাসা। হবে যথোচিত স্পর্শ?

আচমকা পুষ্পর ফোন বেজে ওঠায় দুজনের ধ্যান ভাঁঙে। এক জোড়া দেহ নড়েচড়ে উঠল। বাড়ল দৈহিক দুরুত্ব। ইকবাল গলা খাকাড়ি দিয়ে আরেকদিক তাকাল। পুষ্প কানের পাশে চুল গুঁজে ফোন বের করে। যতটা নিরুদ্বেগ ছিল, স্ক্রিনে ‘ধূসর ভাইয়া ‘লেখা দেখেই বুকটা ধড়াস করে উঠল। যেন সজো*রে,সবেগে একটা কুড়াল দিয়ে কো*প পরেছে। তৎক্ষনাৎ ভীত কণ্ঠে বলল,
‘ ভাইয়া ফোন করেছে?’
ইকবাল মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াল। শ*ঙ্কিত চেহারায় আশেপাশে তাকাল। সতর্ক কণ্ঠে বলল,
‘ ব্যাটা এখানেই কোথাও নেইত?’
কথাটায় পুষ্পর হৃদপিণ্ড থমকায়। হাত পা কাঁ*পুনি শুরু হয়। যেন এক্ষুনি থার্মোমিটার বিদীর্ণ করে জ্বর আসবে গায়ে। এলোমেলো পাতা ফেলে যতদূর চোখ যায় মিছেমিছি খোঁজে।
মুখমন্ডল ভ*য়ে লাল। ইকবাল খেয়াল করতেই নিজেকে স্বাভাবিক করল। চা*পা দিল স্বীয় আ*তঙ্ক। ওকে সহজ করতে বলল,
‘ আরে আগেই এরকম করছো কেন? ফোন ধরে দ্যাখো কী বলে?’
পুষ্প ঢোক গি*লে বলল ‘ যদি ব*কে?’
‘ আহহা! ধরেই দ্যাখো না।’

পুষ্প ভ*য়ে ভ*য়ে রিসিভ করল। কানে গুঁজতেই ধূসরের প্রথম প্রশ্ন,
‘ কোথায় তুই?’
ত্রা*সে মেয়েটার কলিজা ছ*লাৎ করে ওঠে। ক*ম্পিত কণ্ঠে জবাব দেয়,
‘ এইত ভভাইয়া,এককটু ববেরিয়েছি। ককেন?’

***
মারিয়া ‘সিকদার বাড়িতে’ রয়ে গেল আজ। দুপুরে না খাইয়ে তাকে ছাড়া হবেনা, এই সিদ্ধান্তে উপনীত সকলে। সেও দোনামনা করে হার মানল শেষে। মেনে নিয়ে বলল ‘ আচ্ছা, তাই হবে।’
আজমলের জন্যে বিশেষ আয়োজনে আরো দুটো আইটেম যোগ হলো। আজকে জমিয়ে খাওয়া-দাওয়া হবে। সবাই বাড়িতে। ধূসরকেও বলা হয়েছে তাড়াতাড়ি ফিরতে। এইত,এলো বলে।
মারিয়া এতক্ষণ রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে ছিল। মিনা বেগম সুনিপুণ রান্নাবান্নায়। সে নিজেও জানে,তবে টুকিটাকি। এত পাঁকা হাত নয়। তবে রান্না শেখার ঝোঁক বেশ। মনোনিবেশ দিয়ে কয়েক পদ দেখল। বেগুন ভাজার জন্যে কড়াইয়ে তেল বসানোর পর বেরিয়ে এলো। ভাবল,একবার পিউয়ের ঘরে যাবে। বাড়িতে ও ছাড়া কথা বলার মত এখন কেউ নেই। পুষ্পকে তো আসা থেকে দেখছেনা। শুনেছে বেরিয়েছে। স্কুলজীবনের কিছু বন্ধুরা আসবে,দেখা করবে সবাই। মারিয়া দোতলার দিকে রওনা হয়। নিঃসন্দেহে সিড়ি বেয়ে উঠতে হবে তাতে। মাঝপথে আসতেই সাদিফ সামনে পরে। আশ্চর্যজনক ভাবে দুজনেই থেমে দাঁড়াল। একে অন্যকে দেখে পাশ কা*টাতে গেল। কিন্তু হলোনা। মারিয়া যেদিক যাচ্ছে,সাদিফ সেদিকে যায়। ডানে গেলে ডানে,বামে গেলে বামে। বামে গেলে বামে,ডানে গেলে ডানে। কী বি*শ্রী ব্যাপার!
শেষমেষ হতা*শ হয়ে দুজনেই দাঁড়িয়ে যায়। মারিয়া কিছু বলতে গিয়েও থামল। লোকটা অতীতে তার উপকার করেছিল কী না! অথচ অশিষ্ট ছেলেটা খ্যাক করে বলল,
‘ কী সমস্যা? হয় এক জায়গায় সোজা হয়ে দাঁড়ান,আমাকে নামতে দিন। নাহলে সরুন সামনে থেকে।’
মারিয়া বিকৃ*ত করে ফেলল মুখবিবর। এই ছেলেকে ভালো ভাবা আর টয়লেট ক্লিনার কে জুস ভাবা এক রকম না? সে বির*ক্ত হয়ে বলল,
‘ আমি আগে উঠেছি সিড়িতে,আগে আমি যাব। আপনি সরে দাঁড়ান।’

সাদিফ অবাক চোখে তাকায়। তার ধারণা মতে সে যথেষ্ট নরম ভাবে কথা বলেছে। অথচ দ্যাখো, এই মেয়ে কী অভদ্র! কী বেয়া*দব! কী গর্হিত! মোটা কণ্ঠে বলল,
‘ এটা আমার বাড়ি। সো আমি আগে যাব।’
‘ বাড়িটা আপনার একার নয়,অনেকের। সেই অনেকের ওসিলায় আমি একটা বড় অংশ পাচ্ছি,আপনি পাচ্ছেন শুধু নিজের অংশ।তাই আমার রাস্তা আপনার আগে ছাড়া উচিত।’

বুদ্ধিহীন প্রতর্কে হাসি পেল সাদিফের। বলল,
‘ আপনি উকিল হলে আসামী বাঁচাতে পারতেন না। নির্দোষ হলেও ফাঁ*সি হয়ে যেত।’
মারিয়া বুঝতে না পেরে বলল ‘ মানে?’

তার স্পষ্ট জবাব,
‘ মানে, আপনি একজন অত্যন্ত খা*রাপ এবং বিকল যুক্তিবিদ। ‘

মারিয়া দাঁত চেপে ধরে, বলে,
‘ আর আপনি একজন খা*রাপ মানুষ। যার কাজ হলো মেয়েদের সাথে গায়ে হুমড়ি খেয়ে ঝ*গড়া করা।’
সাদিফের বিশেষ কিছু এলো গেল না কথাটায়। চোখের চশমা খানিক ওপরে ঠেলে বলল,
‘ মেয়ে মানুষ হয় মোমের মত। গলে গলে পরা তাদের অভ্যেস। সেখানে যদি কাঠের মত দেখি, আমার কেন সবারই ইচ্ছে করবে হাতুড়ি দিয়ে পে*টাতে।’

মারিয়া তেলে-বেগুনে জ্ব*লে বলল
‘ আজেবা*জে কথা বলা ছাড়া আপনার কি আর কাজ নেই ? আপনি আদৌ জানেন আমি কেমন?’
সাদিফ সোজাসুজি বলল,
‘ আপনি হলেন রাস্তার পারে বিক্রি করা এক গ্লাস বেলের শরবতের মত। দেখতে ভালো কিন্তু খেতে অতিশয় বি*শ্রী। প্রায় অর্ধেক লোক অল্প খেয়ে ড্রেনে ফেলে দেয়। ‘

মারিয়া দমে গেল না। পালটা জবাব দিল,
‘ ও তাই? আর আপনি হলেন রাস্তার সেই বিশেষ প্রানীর লেজের মত,যেটা টানলেও সোজা হয়না।’
সাদিফ হতভম্ব। নিমিষে অভিব্যক্তি বদলে গেল। ইঙ্গিত ধরতে একটুও সময় ব্যয় হয়নি। শ*ক্ত হয়ে এলো চোখমুখ। কিছু বলতে নিলে পিউ নাঁচতে নাঁচতে হাজির হলো সেখানে। ওকে দেখেই কথা গি*লে নিল সে। পিউ দুজন কে একবার একবার দেখে বলল,
‘ একী! তোমরা দুজন এখানে স্ট্যাচু হয়ে আছো কেন? হয় নিচে নামো,নাহলে ওপরে ওঠো।’

মারিয়া বলল ‘ আমিও সেটাই বলছিলাম ওনাকে। যে সরে দাঁড়ান আমি পিউয়ের ঘরে যাই,কিন্তু উনিতো সরছেনই না।’

পিউ চোখ ছোট করে বলল ‘ সরছেন না কেন?’
সাদিফ, মারিয়ার প্রতি কট*মট করে এক সাইড হয়ে দাঁড়াল।
জয়ের হাস্যে অধর ভরে উঠল তার। মিটিমিটি হাসি দেখে নাক ফোলায় সাদিফ। পিউ অধৈর্য চোখে একবার সদর দরজা দেখল। তারপর দেখল দেয়ালে টাঙানো বিশাল ঘড়িটা। তার চাউনী উদগ্রীব। সেখানে প্রতীক্ষা লেপ্টে। মানুষটা ফিরবে কখন?
সাদিফ শুধাল,
‘ কাউকে খুঁজছিস?’
‘ হু? না,মানে হ্যাঁ, আব্বুরা এখনও ফিরছেনা কেন?’
‘ আসবে সময় হলে। ‘
বলতে বলতে সাদিফ নিচে নেমে গেলো। মারিয়া বলল,
‘ চলো পিউ,তোমার রুমে যাই। তোমার বেলকোনি দিয়ে না কি সুন্দর আকাশ দেখা যায়? ‘
পিউ বলল,
‘ হ্যাঁ যায়ত৷ এসো দেখাই।’
তারা পা বাড়ানোর মধ্যে রাদিফ ছুটে এলো। হাতের ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ এই তুমি ফোন কোথায় কোথায় রেখে ঘোরো আপু? এই নাও,ফোনের ভেতর থেকে পুষ্পপু চিৎকার দিচ্ছে।’

হড়ভড় করে বলল,সাথে ফোনটা ধরিয়ে দিল। নিজের ট্যাবে গভীর মনোযোগ তার। গেমস খেলছিল বসে। এই সময় ফোন আসাও একটা ডিস্টার্ব।
‘ ফোনের ভেতর থেকে পুষ্প চিৎকার দিচ্ছে? তার মানে?’
‘ কল করেছে আর কী।’
‘রাদিফ যেভাবে বলল,আমি ভাবলাম কী না কী!’
‘ ওর কথাবার্তাই এমন।’
ফোন তখনও বাজছে। পিউ রিসিভ করে বলল,
‘ হ্যাঁ আপু বল।’
‘ কী করছিস?’
‘ কিছু না। তুই কোথায়? আসবি কখন? ভাল্লাগছে না।’
‘ ওইজনেই তোকে ফোন করলাম। আমার বন্ধুরা তোকে দেখতে চাইছে। চটপট তৈরি হয়ে বের হ তো।’
পিউ অবাক হয়ে বলল,
‘ এখন? আমাকে দেখার কী আছে? আমিত ওদের চিনিওনা।’
‘ তুই না চিনলেও ওরাতো চেনে। স্কুল ফ্রেন্ড না আমার? আজকে চিনবি। আয় এখন, দেরী করিস না।’

‘ কিন্তু…. ‘
‘ প্লিজ, বনু আমার, ভালো না তুই? আয়। সুন্দর করে সেজেগুজে আসিস কেমন?’
পিউ ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল
‘ আচ্ছা। কিন্তু কোথায় আসব?’
‘ উম,তুই বের হ, আমি লোকেশন পাঠাচ্ছি। ‘
‘ আম্মু বের হতে দেবে এখন?’
‘ দেবে,আমি আম্মুকে বলেছি। আম্মুর একটা লাল শাড়ি আছেনা? ওটা পরে আয়।’
পিউ মুখ কুঁচকে বলল ‘ বিয়ে করতে যাব না কি? শাড়ি পরে হাঁটতে আমার ক*ষ্ট হয়। সামলাতে পারিনা।’
‘ আচ্ছা তাহলে সাদা চুড়িদার আছেনা, ওটা পরিস কেমন? ‘
‘ ঠিক আছে। ‘

লাইন কা*টতেই মারিয়া বলল ‘ কোথাও যাবে?’
‘ হ্যাঁ, আপু ডাকল,ওর বন্ধুদের সাথে দেখা করব।’

সে ঠোঁট উলটে বলল,
‘ তুমি গেলে আমি একা হয়ে যাব।’

‘ তাহলে তুমিও চলো। ‘
পিউয়ের কণ্ঠ উজ্জ্বল।
‘ না না,সমস্যা নেই। তুমি যাও।’
‘ একা হবে কেন,সাদিফ ভাইয়া আছেনা? ওনার সাথে গল্প করবে।’
মারিয়া বিদ্বিষ্ট হয়ে বিড়বিড় করল ‘ মানুষ আর পেলোনা।’
মুখে বলল ‘জবা আন্টিত ঘরেই, ওনার সাথে গল্প করব না হয়।’
‘ আচ্ছা,আমি তাড়াতাড়ি চলে আসব। যাই এখন তৈরি হই?’
‘ যাও। ‘

পিউ সত্যিই সাজল। সাদা চুরিদার পরল। কপালে টিপ দিল, ঠোঁটে মাখল একটু লিপস্টিক। চুলগুলো পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে গুছিয়ে আটকাল। সবশেষে পার্স ব্যাগ হাতে নিয়ে হেলেদুলে বের হলো।
বসার ঘরে আসতেই সাদিফ সামনে পরে। টেলিভিশনে বিপিএলের হাইলাইটস দেখছে সে। ওকে দেখতেই ডেকে উঠল,
‘ কোথায় যাচ্ছিস?’
পিউ হাঁটা-পথে জবাব দেয় ‘ একটু বাইরে। আপুর বান্ধুবিরা আসবেতো, সেখানে।’
‘ আমি আসব?

পিউ দাঁড়িয়ে গেল।
‘ মেয়েদের মধ্যে আপনি গিয়ে কী করবেন?
সাদিফ থতমত খেয়ে বলল ‘ না এমনি।’
পিউয়ের আদল তমসায় ছেঁয়ে গেল। তার জানা মতে সাদিফ ভাইয়া পুষ্পকে পছন্দ করেন। এখনও নিশ্চয়ই সেজন্যে যেতে চাইলেন? ও নিজেওত মনে মনে তাকে দুলাভাই ধরে বসেছিল। মাঝখান থেকে আপুটাই ইকবাল ভাইয়ের প্রেমে পাগল! অবশ্য ইকবাল ভাই মানেই জহরত। সে মানুষটার শালী হওয়াও ভাগ্য!
পিউ মনে মনে বলল
‘ থাক ভাইয়া! আপনি ক*ষ্ট পাবেন না। আপনার জন্যে বিশ্বসুন্দরী খুঁজে আনব আমরা। ইকবাল ভাইয়ের মত দুলাভাইয়ের জন্যে না হয় আপনাকে একটুখানি সেক্রিফাইজই করলাম।’
তখন সাদিফ শুধাল,
‘একা যেতে পারবি?’
পিউয়ের ধ্যান ছোটে। বলে,
‘ হু? পারব।’
‘ আচ্ছা, সাবধানে যাস। তাড়াতাড়ি ফিরিস।’
‘ ঠিক আছে। ‘

পিউ চলে গেল। সাদিফের মন খা*রাপ হয়। বাসায় আছে, তাও আজকের এমন সুন্দর দিনে। বিকেলে পিউকে নিয়ে একটু ঘুরতে বের হবে ভেবেছিল। অথচ মেয়েটাই বাইরে যাচ্ছে। ফিরে এসে ক্লান্তিতে আর নড়তেও চাইবেনা।

সাদিফ রু*ক্ষ মেজাজে টিভি বন্ধ করে দেয়৷ ফিরে যায় কামড়ায়। পিউ ছাড়া নিজের বাড়িতেই তার মন টেকেনা। শূন্য শূন্য লাগে। কী ভয়া*বহ ব্যধি, হায় রে!

****
বাড়িতে আপাতত একটা গাড়ি অবশিষ্ট। তাছাড়া আছে সাদিফের বাইক। পিউ সব উপেক্ষা করে একবারে পায়ে হেঁটে গেট থেকে বের হলো। শেষ বার ফোন চেক করল,পুষ্প লোকেশন পাঠিয়েছে কি না দেখতে।
না পাঠায়নি। হয়ত পাঠাবে। জায়গা বেশি দূরে হবে না। ও যে একা একা অত কিছু চেনেনা তার বোন জানে। ধারে-কাছে হওয়াই স্বাভাবিক।
একটা রিক্সা ডাকুক বরং।
সে মেইন রোডের দিক এগোতে থাকল। সামনে থেকে বহু রিক্সা আসছে, যাচ্ছে। কিন্তু মানুষে ভর্তি। তার দু সেকেন্ড বাদেই সামনে থেকে খালি রিক্সা আসে। সে ডাকার আগেই চালক থেমে গেলেন। বললেন,
‘ যাবেন? ‘
পিউ মাথা দোলায়। তিনি বললেন
‘ ওডেন।’
পিউ উঠল,ঠিকানা বলার আগেই চালক টান বসালেন প্যাডেলে। সে বিভ্রান্ত হয়ে বলল,
‘ কোথায় যাব শুনলেন না,ভাড়াও তো ঠিকঠাক হলোনা মামা।’
‘ যাইতে যাইতে কইয়েন। হুনুমনে। ভাড়াতো বাড়বে না,যা দেন সব সময় তাই থাকব। ‘
পিউ আর কথা বাড়াল না। ফোন বের করে পুষ্পকে কল দিতে চাইল। বলবে সে বের হয়েছে, ঠিকানা পাঠাতে। রিক্সা পাঁচ মিনিটের পথ ও অতিক্রম করেনি,আচমকা থেমে গেল। পিউ স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে বলল
‘ কী হলো? থামলে….’
বলতে বলতে অর্ধেক পথে আটকে গেল সে। ওপাশ থেকে ধূসরকে এগিয়ে আসতে দেখে কয়েক পল থমকে রইল। ব্যগ্রতায় পল্লব ঝাপ্টাল। এটা কি সত্যিই ধূসর ভাই? উনি না অফিসে? এই সময় এখানে?
তার চিন্তার ফাঁকে ধূসর কাছে আসে। পরপর উঠে পরে রিক্সায়। চালককে নরম স্বরে আদেশ করে,
‘ চলুন।’
রিক্সায় টান পরতেই পিউ পরে যেতে নেয়। ধূসর অতিদ্রুত হাটু চে*পে ধরল। হুশে এলো সে। চমকে তাকাল তার দিকে। এর মানে উনি সত্যিই পাশে বসে?
পিউয়ের চোখেমুখে লেপ্টে যায় অবিশ্বাস। হতবিহ্বলতা মাত্রা ছাড়ায়। প্রকান্ড অক্ষিযূগল নি*ক্ষেপ হয় ধূসরের শ্যামলা মুখে। তারপর দেখে নেয় তার হাত,যা শক্ত*পোক্ত বাঁধনে ধরে রাখা তার উরুদ্বয়।
পিউ হা করে তাকিয়ে রইল। মস্তিস্কটা আবার শূন্য। সেখানে কিচ্ছু ঢুকছে না। ধূসর ভাই স্বয়ং এক গোলকধাঁধা। যার ভেতরটা ভরপুর সকল অমী*মাংসিত রহস্যে। এই রহস্য ভেদ করার সাধ্য ওর নেই।
ধূসর বরাবরের ন্যায় উদ্বেগহীন ,ভ্রুক্ষেপমুক্ত। পাশে বসা কিশোরির মাথা ব্য*থার কারণ হয়েও তার রা নেই,শব্দ নেই। সে নিরুৎসাহিত। হঠাৎ কিছু সময় পর নিজেই ঘাড় ফেরাল। চক্ষু দিল পিউয়েতে।
এই যে মেয়েটার বোকা বোকা চাউনী,এই যে জিজ্ঞাসু চোখমুখ, এগুলো তাকে ভালো থাকতে দেয় না। এই স্নিগ্ধ মুখস্রী, হিং*সে করে তার শান্তির নিদ্রাকে।
ধূসর বিস্মিত পিউয়ের চুল থেকে অচিরাৎ পাঞ্চ ক্লিপ খুলে দেয়। সব ঝাপটে পরে পিঠে। হাওয়ার বে*গে উড়ে আসে মুখমন্ডলে। পিউয়ের হা বৃহৎ হয় আরো। হতচেতন,বিমুঢ় সে। কণ্ঠনালি বন্ধ। চোখের চারদিক ঘিরে থাকা কেশরাশি ধূসর সরিয়ে দিল। পরপর গেঁথে দেয় কানের পশ্চাতে। সেই আগের মত দু-আঙুল দিয়ে বন্ধ করে দিলো, পিউয়ের ফাঁকা অধরদ্বয়। বলল,
‘ মশা ঢুকবে।’

চলবে,

#এক_সমুদ্র_প্রেম!
লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(ভ্যালেন্টাইন স্পেশাল)

রিক্সার গতি মন্থর,সুধীর। তিন চাকার বাহন খানা চলছে তার স্বকীয়তায়।
কোমল প্রবঞ্জন চতুর্দিক ঘিরে। বসন্তের হিমেল হাওয়া কাঁ*পন ধরায় গায়ে। রাস্তা ফাঁকা নেই। সংখ্যাতীত যানবাহনে ভর্তি আজ। তার ওপর মানুষের ভীড়। দিগবিদিক ঘুরছে অনেকে। পড়নের চাকচিক্যময়, সুন্দর সুন্দর পোশাক গুলো রঙচটা শহরে বেশ ফুটেছে আজ। যেদিকে তাকায় শুধু রঙীন আর রঙীন। অথচ এত কিছুতে মন,চোখ কোনটাই নেই পিউয়ের। সে লাজুক ভঙিতে ছটফট করছে। গাল দুটো লালিত। পল্লব কাঁ*পছে। বুকের ওঠানামা অস্বাভাবিক।
কেউ বাম পাশে হাত দিলে স্পষ্ট টের পাবে, হৃদযন্ত্রের লাফা*লাফি, দাপা*দাপি। ধূসরের গা ঘেঁষে বসা,তার মদ্যপ পারফিউমের সুগন্ধ,উষ্ণ স্পর্শ সব কিছুতে ওষ্ঠাগতপ্রাণ। মানুষটা হঠাৎ করে কীভাবে এলেন? রিক্সায় বসলেনই বা কেন? পিউয়ের মাথা ভর্তি প্রশ্ন অগোছালো,অবিন্যস্ত ছোটে। অন্তরে ফোটে বসন্তের ফুল। সত্যিই এমন দিনে মানুষটা তার এত কাছে? সত্যিই?

পিউ হাঁস*ফাঁস, হাঁস*ফাঁস করে। অস্থির চিত্তেও শান্ত হয়ে বসে থাকে। লাজুকলতার ন্যায় গুটিয়ে রয় দেহ। বক্ষে তখন উথাল-পাতাল। ধড়াস ধড়াস লাফাচ্ছে হৃদপদ্মের ছোট্ট অবাধ্য খাঁচা। ঠান্ডা বাতাসেও কপাল জুড়ে ঘামের রেশ। রিক্ত মস্তক। অথচ পাশের মানুষটি নির্বিকার। যেন স্টিলের মত শক্ত হয়ে বসে।
রিক্সা কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে পিউ জানেনা। সুদীর্ঘ পথের এক ফোটাও ঠাওড় করেনি। বুঝতে চায়নি গন্তব্য। তার অন্তঃকরনে বাজছে প্রেমের গীত। সেই বিখ্যাত উত্তাম কুমারের গান,
‘ এই পথ যদি না শেষ হয়,তবে কেমন হতো তুমি বলোতো!
যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয়,তবে কেমন হতো তুমি বলোতো!’

সে মনে মনে হাসল। মিশ্র অনুভূতির, মৃদূ হাসি। প্রিয় মানুষের সঙ্গে হুড খোলা রিক্সায় বসার এক অমোঘ স্বপ্ন আজ পূরন হচ্ছে। এই প্রথম বার ধূসর ভাইয়ের সাথে রিক্সায় চড়ছে সে। ইশ! এইভাবে ওনাকে নিয়ে বাকী স্বপ্ন গুলোও সত্যি হতো যদি! তাহলে তার থেকে সুখী মানুষ পৃথিবীতে খুঁজে পেত না কেউ। পিউ আড়চোখে একবার ধূসরের দিক তাকায়। তার লম্বা চুলের ডগা গুলো উড়ে উড়ে লাগছে মানুষটার কানে,চোখের পাশে। অথচ নির্লিপ্ত তার দৃষ্টি ওই সম্মুখ সরণিতেই।
পিউ কুণ্ঠিত ভঙিতে চাউনী ফিরিয়ে নীচের দিকে তাকায়। আলগোছে অবাধ্য কেশ গুঁজে দেয় কানের পিঠে। আচমকা পুষ্পর কথা মাথায় এলো। তার লজ্জা -টজ্জা ওমনি শেষ।
চোখ বড় বড় করে ফেলল। তটস্থ ভঙিতে তাকাল ধূসরের দিকে। ভীত কণ্ঠে বলল,
‘ ধূসর ভাই,আপু ডেকেছিল।’
সে তাকালোনা। ওমন সামনে চেয়েই বলল ‘ কেন?’
‘ ওর বন্ধুরা আসবে,আমাকে দেখার জন্যে যেতে বলেছে।’
‘ তোকে দেখার কী আছে? তুই কি চিড়িয়াখানায় আটকে রাখা বানর?’
পিউ ঠোঁট ফুলিয়ে বলল ‘ আলাপ করবে বলেছে।’
‘ আলাপ করবে কেন? তুই সেলিব্রেটি? ‘

একটা বাক্যও তার দিক চেয়ে বলেনি। পিউ হাল ছেড়ে বসে থাকল। অল্প স্বল্প চিন্তা শুরু হলো মাথায়। আপু যদি ওর দেরী দেখে বাসায় ফোন করে? কাল পরীক্ষা আর সে রাস্তায় ঘুরবে, দিতে হবে একশ একটা জবাবদিহি। আর আম্মুতো ঠ্যাং ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেবেন।

ধূসর নিজে থেকেই বলল,
‘ চিন্তা নেই, আমি আছি।’

‘ আমি আছি’ এই একটা কথা পিউয়ের অস্থির মস্তিষ্ক, শান্ত করল নিমিষে। তার শঙ্কিত চোখমুখ সবেগে মসৃন হয়। ধূসরের প্রতি এক বুক ভরসায় অমত্ত থাকে মেয়েটা।
আরো কিছু পথ রিক্সা চলল। ধূসর বলাতে থামল রাস্তার এক পাড়ে এসে। পিউ এতক্ষণ পর আশেপাশে তাকাল। চোখ বোলাল যতটা দেখা যায়। দোকান-পাটের ওপর টাঙানো সাইনবোর্ড গুলোর লেখা দেখে নিশ্চিত হলো গন্তব্য স্থল। এটাত রবীন্দ্র সরোবর! দারূন জায়গা! পিউয়ের ক্ষুদ্র হৃদয় চটপটে হয়। ধূসর নেমে দাঁড়াল। ভাড়া মেটাল চালকের। পিউ চারপাশ থেকে দৃষ্টি এনে তাকাতেই ছোটখাটো হো*চট খেল। ধূসরের পাতা হাতের দিকে নি*ক্ষেপ হলো তার বিকট,অবিশ্বাস্য চক্ষুদ্বয়। আস্তেধীরে কম্পিত বীণা রাখল সেই হাতের ওপর। ধূসর অচিরেই আকড়ে ধরল। বৃহৎ হস্ত তালুতে মিশে গেল পিউয়ের কনিষ্ঠ কব্জি। রিক্সা থেকে নামল সে। উত্তেজনায় হাত পা কাঁ*পছে। ধূসর ভাই কী তাকে নিয়ে ঘুরতে এসেছেন? এতটা সুপ্রসন্ন ভাগ্য কবে হলো?
ধূসর ওকে সমেত সামনে এগোয়। তার লম্বা কদম আজ ভীষণ সুস্থির। পিউ এতেও তাল মেলাতে ব্যর্থ,হিমশিম খায়। তার মনে হচ্ছে সে দৌড়ালে ঠিকঠাক হতো।

ধূসর গিয়ে বসল একটা বেঞ্চে। পিউকে বলতে হয়নি,সে চঞ্চল ভঙিতে বসল আগেই। ধূসর এক পায়ের ওপর আরেক পা তুলে চারপাশে তাকায়। গলা উঁচিয়ে দ্যাখে। নীরবে কাউকে খোঁজে। পিউয়ের আপাতত কোনও দিকে মন নেই। তার দুটো তৃপ্ত চোখ ধূসরের সুশ্রী চেহারায়। ওইটুকু সময় ধূসরের মুখের গড়ন হৃদয়পটে বন্ধ করে ফেলল। এই মুখটা যত দেখে আঁশ মেটেনা,মন ভরেনা। প্রতিবার তুষাতুর লাগে নিজেকে। এমনিতেও মানুষটার আঁদলের সামান্যতম কাঁ*টাছে*ড়াও তার মুখস্থ,আত্মস্থ। পিউয়ের দেখা সর্বাধিক সুদর্শন পুরুষ ধূসর ভাই। তার চোখদুটো যেন পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর জাদুঘর। আর তামাটে মুখটা কাঁচের ভেতর গোছানো সাজানো আঁকি-বুকি পেপার ওয়েটের মত। যতবার সে দ্যাখে ততবার খু*ন হয়। নির্ম*মভাবে ধূসর ভাই হ*ত্যা করে ওকে। আচ্ছা,এই দুনিয়ায় ওর আগমনের কারণ কী? এই মানুষটাকে দেখে দেখে বারবার মন হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার জন্য? এই নিঃস্ব হওয়ায় এত সুখ কেন? কেন এত প্রশান্তি? কেউ বুঝি মন খুঁইয়ে এত উল্লাসে মাতে? মন চুরি করা স্বয়ং চোরকে পাশে বসিয়ে আনন্দ পায়? এই বসুন্ধরায় ভালোবাসার নিয়ম গুলো এমন অদ্ভূত কেন? কেন এত যুক্তিহীন? ভালোবাসা তাকে শেখাল,শ্যামলা বর্নের এক যুবকের প্রেমে পাগল হওয়া। গুরুভার এক পুরুষের প্রতি অনুভূতির জাল বিছিয়ে নিজেকে সপে দেওয়া। এর শেষ কোথায়? কোথায় সমাপ্তি?

ধূসর হাত উঁচিয়ে কাউকে ডাকল। পিউয়ের ধ্যান ভা*ঙল তখন। মাথার ওপরে বড় পলিথিন বোঝাই করা পানির বোতল নিয়ে এক নারী এগিয়ে এলেন। একটা বোতল ধরিয়ে দিলেন তার হাতে। টাকা নিয়ে ফেরত গেলেন আবার। পিউ সবটা দেখল। তবে খুব একটা মনোযোগ ওতে ছিল না। ধূসর বোতলের ছিপি খুলে তার দিকে বাড়িয়ে দিতেই সে সচেতন চোখে তাকায়।
মুচকি হেসে নিয়ে নেয়। ঢকঢক করে খায়। গলবিল ওঠানামা করে। পুরোটা সময় ধূসর চেয়ে থাকে। পিউ বোতল নামাতেই তার চোখ ফিরে আসে। নিবদ্ধ হয় সামনে। পিউ হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুখ মুছল। আস্তে করে শুধাল,
‘ এখানে আমরা কেন এসেছি ধূসর ভাই?’
ধূসরের বক্র জবাব,
‘ মন চাইল তাই।’

পিউ চিকণ চোখে তাকাল। আরেকদিক ফিরে ভেঙচি কা*টল। পণ করল আর একটা কথাও জিজ্ঞেস করবেনা। বো*ম মা*রলেও শব্দ বের হবেনা মুখ দিয়ে। এই লোকের পা থেকে মাথা অবধি ত্যাড়ানো । মানুষটাও ত্যাড়া,ঘাড়টাও ত্যাড়া,কথাবার্তাও ত্যাড়া। সে নিজেকেই শা*সাল,
‘ চুপ থাক পিউ! আরেক একটা কথাও না।’

তারপর অদৃশ্য আঙুলে ঠোঁট চে*পে ধরল নিজের। আচমকা ধূসর উঠে গেল। রীতিমতো আড়াল হলো সামনে থেকে। পিউ বসে বসে দেখল। ভালো*মন্দ জিজ্ঞেস করতে চেয়েও করল না। করলেও বা,উত্তর পাবেনা সুনিশ্চিত।
সে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে। ইনবক্স চেক করে ব্যস্ত হাতে। অদ্ভূত ব্যাপার, পুষ্প এখনও লোকেশন পাঠায়নি। পিউ বিস্মিত হয়। সাথে একটু আধটু মেজাজ খারা*প। তাকে বের হতে বলে এই মেয়ে কোথায় হাওয়া হয়ে বসেছে? ধূসর ভাই না এলে সে কি এতক্ষণ পথিমধ্যে ঘুরতো? হারিয়ে যেত না? কলেজ আর কোচিং ছাড়া ও কি একা কোথাও গিয়েছে কখনও? তার কিশোরি মনে রা*গ ছেঁয়ে যায়। সিদ্ধান্ত নিলো, আজ বাসায় গিয়ে নালিশ করে দেবে আম্মুকে। বিচার বসাবে। কেন আপু এত দায়িতজ্ঞানহীন হবে, কেন? পরপর নিজেই মিইয়ে গেল। ভাবল,আম্মু যদি জিজ্ঞেস করেন, তাহলে তুই কোথায় ছিলিস? কী বলবে সে? তোমার আদরের দুলাল আমাকে মাঝপথে রিক্সা সহ কিড*ন্যাপ করে এখানে এনেছেন, বলবে এটা? এটাতো সত্যি। সাথে অল্পস্বল্প মিথ্যে। তার মন জানে,কী বা*জে রকমের নেঁচেকুদে সাথে এসছে সে। ধূসর ভাইয়ের সঙ্গে কোথাও যাওয়া,তাও এই ভাবে একা? সেটাও আবার ভালোবাসা দিবসে? উফ! ভাবা যায়না এসব। সে এখনও পারছেনা ভাবতে। তার চিন্তাধারা, আবেগে আত্মহারা!

পিউ স্ক্রিনের দিক তাকিয়ে হাসছিল। আকষ্মিক মুখের সামনে এক গুচ্ছ গোলাপ দেখে চট করে মাথা তুলল। প্রচন্ড ধা*ক্কা খেল পরপর। নিজের চোখের প্রতিই যেন উঠে গেল ভরসা,আস্থা। তীব্র বিশ্বাসহীনতায় পল্লব গুলো কেমন ভারি হয়ে বসল। ধূসর হাটুমুড়ে বসতেই পিউ থমকে গেল। তার শরীর শিরশির করছে। হাত পা বিবশ। ধূসর বসেছে। শার্টের ওপর দিকের একটা বোতাম খোলা,উঁকি দিচ্ছে তার শ্যামলা বুক। পিউয়ের বেহায়া চাউনী ঘুরপাক খায় সেখানে। টেনেটুনে আনে তার মুখবিবরে। অজানা আনন্দাশ*ঙ্কায় কাঁ*পতে থাকা বুক নিয়ে ধূসরের দিক চেয়ে রইল। তবে কি সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসছে? ধূসর ভাই এখনি বলবেন মনের কথা?
পিউয়ের আকুল,উদগ্রীব মুখটা মন দিয়ে দেখল ধূসর। চোখ সরিয়ে নিল, তারপর আবার তাকাল। ঠোঁটের কোনে মিহি,অথচ ভূপৃষ্ঠের সবথেকে সুন্দর হাসিটি নিয়ে বলল,

‘ বহুদিন ধরে কিছু কথা নিজের ভেতর লুকিয়ে রেখেছিলাম পিউ। আজ সময় এসেছে সেসব বলে দেয়ার। আমি যে আর পারছিনা! তোর এক সমুদ্র প্রেমের কাছে আমার শক্ত*পোক্ত ধৈর্যের জাহাজটা ডু*বে গিয়েছে। আজ আর বলতে মানা নেই,
‘ ভালোবাসি পিউ।’
তুই যতটা চাস,তার চেয়েও অনেক বেশি চাই তোকে। তুই যতটা ভালোবাসিস,এর চেয়েও অধিক ভালোবাসি!’

পিউয়ের কণ্ঠনালি স্তব্ধ। ধুকপুক করছে বুক। নিজের কানের প্রতি বিশ্বাস খোঁয়াল। স্তম্ভিত সে। সেকেন্ডে চোখের কোটর ভরে উঠেছে। ঠোঁট দিয়ে বহুক*ষ্টে কা*ন্না চে*পে ধরে। এই কা*ন্না, আনন্দের, অপেক্ষার। ধূসর ভাইয়ের মুখ থেকে এতদিনে ভালোবাসার কথা শুনল সে। অবশেষে এলো সেই সময়। ধূসর উঠে দাঁড়াল,এগিয়ে এলো। সেই গতদিনের মত স্বযত্নে চোখ মোছাল। পিউ হুহু করে কেঁ*দে ওঠে। জাপটে ধরে, মুখ লোকায় বুকে। অতঃপর কানের পাশে স্পর্শ পায় দুটো তপ্ত ঠোঁটের। ফিসফিসিয়ে বলছে,

‘ চোখের জলে তোকে, এতটা আদুরে লাগবে কেন বলতো! তোর এই রুপ কারো সহ্য সীমার খুঁটি নড়বড়ে করে দেয়। ভে*ঙে দেয় নিয়মের বাঁধ। কাঁদিস না পিউ,একদম কাঁদিস না। তোর কান্নায় কেউ সংযম হারালে দোষী হবে সে,যে বহুবার তোর ভেজা চোখমুখ দেখে ধ্যান বিসর্জন দিয়েছে ।’

বলতে বলতে তার উষ্ণ অধর পিউয়ের কানের লতি ছুঁয়ে গেল। কেঁ*পে ওঠে মেয়েটা। অতি শীর্ন শরীর স্পষ্ট ঝাঁকুনি দিতে দেখা যায়। জোর খাটিয়ে মুখ তুলতে চায়,অথচ পারেনা। এর আগেই কেউ ধ*মক ছোড়ে,
‘ ধরবি? এই মেয়ে!’
পিলে চমকে গেল তার। সম্বিৎ ফিরল। সম্মুখে দাঁড়ানো, কপাল গোছানো ধূসরকে দেখে হতবাক হলো। আশ্চর্য বনে দেখল নিজেকে,সামনের জায়গাটাকে। এখানেই না ধূসর ভাই বসেছিলেন? পিউ এলোমেলো পাতা ফেলল। মস্তিষ্ক পার করে চলে যাচ্ছে সব। চোখ পিটপিট করে ধূসরের দিক তাকাল আবার। কোথায় ফুল? কীসের গোলাপ? অধৈর্য হাতে নিজের চোখ ছুঁয়ে দেখল। একি! সে না কাঁ*দল? এইত এক্ষুনি কাঁ*দছিল,তবে চোখ শুকনো কেন?এসব তাহলে স্বপ্ন? কল্পনা?

পিউয়ের উদ্বোলিত তনুমন নেতিয়ে পরল। বক্ষ চি*ড়ে নির্গত হলো আ*ক্ষেপের শ্বাস। চোখেমুখে লেপ্টে এলো অন্ধকার। এই জনমে বোধ হয় ভালোবাসার কথা শোনা হবেনা। ধূসরের মেজাজ বিগড়ায়। সে যে এত্তক্ষণ ধরে ডেকে হয়রান,এই মেয়ের হুশ আছে? আইসক্রিম টাও গলে যাচ্ছে।
সে দ্বিতীয় বার ধ*মক দিল,
‘ পিউ তুই নিবি,না ফেলে দেব?’
পিউ চকিতে ফেরে,সতর্ক হয়। হাত এগিয়ে আইসক্রিম নিয়ে আসে। কিন্তু তার জ্বিভ থেকে গলবিল, সব তিঁতকুটে। অনীহ চোখে চেয়ে রয় কোন আইসক্রিমটার পানে। একটুও খেতে ইচ্ছে করছে না। এমনিতেই দুচোখ ছাপানো আশা নিয়ে এসেছিল,ভাবল,আজ বুঝি ধূসর ভাই কিছু একটা বলবেন।
তার ওপর এসব জল্পনা-কল্পনা সেসব বাড়িয়ে দিল কয়েক গুন। ধূসর পাশে বসেছে। তার হাতে ওয়ান টাইম কাপে ভরা দুধ চা। পিউ আশা*হত,ভ*গ্নহৃদয়-বিবর্জিত। মনে মনে বিলাপ করে,
‘ কবে ভালোবাসার কথা বলবেন ধূসর ভাই? কবে?’

পিউয়ের মন শুরু থেকে যতটা স্ফূর্ত ছল,এখন ততটাই সংকীর্ণ। গম্ভীরতায় গা ঢেকে বদলে গিয়েছে আগের রুপ। ভালো লাগছেনা কিছু। ধূসর ভাই ভালোবাসার কথা বলবেন না। আচ্ছা সে নিজেই তো বলবে ভেবেছিল। বলে দেবে এখন? এটাই সময়। কেউ নেই, দুজন শুধু। বলে দিক বরং। শুভস্ব শীঘ্রম!
পিউ ঢোক গি*লে তাকাল। আমতা-আমতা করে বলল,
‘ ধূসর ভাই! একটা কথা বলব?’
ধূসর চায়ের কাপে,পাতলা ঠোঁট ছুইয়ে বলল,
‘ পরে। ‘
‘ অনেক জরুরি। ‘
‘ হু,পরে।’
পিউ সন্তর্পনে চ বর্গীয় শব্দ করল,যাতে ধূসরের কানে না যায়।
‘ কিছু খাবি?’
পিউ মাথা নাড়ে। বীতস্পৃহায় দাঁতে -দাঁত পি*ষে ধরে। মনে মনে ব*কেঝকে গুষ্টি উদ্ধার করে ধূসরের। আজকের দিনে, এরকম জায়গায় এনে জিজ্ঞেস করছে কিছু খাবি?
কেন ,দুটো ভালোবাসার কথা বললে জাত যাবে?
সে কি অন্ধ? দেখতে পাচ্ছেনা চারপাশে কত জোড়া জোড়া ঘুরছে? ওইতো, তাদের বাম দিকে বসে দুজন। আহা মেয়েটির মাথা ছেলেটির কাঁধে। কী নয়ানভিরাম দৃশ্য! তার যে কবে এরকম দিন আসবে?
পিউয়ের অন্তঃপুর পরিতাপে ভরে যায়। তন্মধ্যে ভেতর থেকে কেউ ঘোষণা করল,
‘ আসবেনা পিউ,আসবেনা। তোর কপালে যে আনরোমান্টিক গরিলা জুটেছে, তাতে এসব আশা ছাড়।’

পিউ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। প্রেম-ভালোবাসা বোঝার পর থেকে চার-চারটে বসন্ত গেল,অথচ প্রেমটাই হচ্ছে না। হায়রে ধূসর ভাই! আপনাকে ভালোবেসে আমি ম*রেছি। না পারছি বলতে,না পারছি চলতে। এইভাবে আমাকে বিকল বানিয়ে, কী মজা পাচ্ছেন আপনি?

সময় পেরোচ্ছে। ধূসরের মুখে কথা নেই। সে একইরকম বসে।
মুখমন্ডলে কেমন অদ্ভূত ছাপ। যেন কত কী বলবে,অথচ পারছে না। পিউ ব্যকুল নেত্র তাক করে রাখে ওই চেহারার পানে। তার মন চায়,সে চায়,একটু কিছু বলুক মানুষটা। নাহয় তাকে বলতে দিক। পিউ আই-ঢাঁই করে আবার ডাকল,
‘ ধূসুর ভাই!’
সে তাকায়। ধা*রাল চোখজোড়ায় কী অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ! পিউ বলল
‘ একটা কথা…. ‘
‘ পরে শুনব।’
পিউ বিদ্বিষ্ট, মহা*বিরক্ত। মুখমন্ডলে দাগ কা*টে সেই চিহ্ন। নিজেও কিছু বলবেনা,তাকেও বলতে দেবেনা। কেন? এভাবে চুপচাপ বসে থেকে কী মহাভারত উদ্ধার হচ্ছে শুনি?

হাঁটু অবধি ফ্রক পরা এক বাচ্চা মেয়ে এগিয়ে এলো। হাতে ঢোকানো কতগুলো কাঁচা,সতেজ ফুলের চাকা। ইতোমধ্যে পুরো সরোবর সে কয়েকবার চক্কর কে*টেছে। এই জুটি নতুন পেয়ে ছুটে এলো প্রায়।পিউ জিনিসটা বহুবার দেখেছে। কিন্তু নিজের জন্যে কেনেনি। মেয়েটি কাছে এসে দাঁড়াল। দুজনকেই অনুরোধ করল,
‘ একটা ফুল নেবেন?’
পিউ দুপাশে মাথা নাড়ে। অথচ ধূসর বলে,
‘ দাও।’
পিউ অবাক চোখে তাকাল। পল্লব ঝাপ্টাল বিভ্রমে। ফুলের চাকা ধূসরের দিক বাড়িয়ে দিল মেয়েটি। সে টাকা বার করতে করতে বলল,
‘ ওকে দাও।’
কথামতো মেয়েটি তার হাতে ধরিয়ে দেয়। টাকা নিয়ে প্রস্থান নেয়। পিউ তখনও বোকার মত বসে।

ধূসর কপাল কুঁচকে বলল,
‘ এটা কি হাতে নিয়ে বসে থাকার জিনিস?’
পিউ উত্তর দিলো না। কী বলবে জানেনা সে। ধূসর অপেক্ষাও করল না উত্তরের। টেনে নিয়েই পরিয়ে দিল মাথায়। পিউয়ের নেত্রদ্বয় মূক । গালে লেপ্টে থাকা চুল ধূসর সরিয়ে দেয়। পূর্ন,গহীন দৃষ্টি বোলায় তার মুখস্রীতে। সেই দৃষ্টিতেই পালটে যায় পিউয়ের অনেক কিছু। চট করেই বুঝে নেয়,মানুষটার মনে জমিয়ে রাখা প্রগাঢ় অনুভূতির কথা। ধূসরের চাউনী
আস্তেধীরে বদলায়। শিথিল হয় অভিপ্রায়। চোখমুখের পেশীতে খেলে যায় পরিবর্তন। পরপর হন্তদন্ত হয়ে চক্ষু সরালো। শার্টের কলার ঝাঁকিয়ে চারপাশে অগোছালো,উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি ছু*ড়ল। পরিচ্ছন্ন অপ্রস্তুত, অপ্রতিভ ভাব মাথা তোলে তাতে।

কাপের কোনায় ফের চুমুক বসাতে গিয়ে দেখল ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। কৃত্রিম বিরক্তি ঘিরে ধরল তাকে। বিলম্ব ব্যাতীত চা শুদ্ধ কাপটাকে ছু*ড়ে ফেলল সামনে।
পিউয়ের ওষ্ঠজুড়ে লাজুক হাসির ভিড় জমেছে। ফুলের চাকায় চলে যাচ্ছে হাত। ধূসর ভাই ভালোবাসি না বলুক,এই যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাপার গুলো, এতেই তো কত ভালোবাসা মিশে! নিজ মুখে কয়েকটা শব্দের ভিত্তিতে নয়,তার আচার-আচরণ আর চোখের দৃষ্টিতে ভালোবাসাটা বিশ্বাস করে নিলো পিউ। কিছু মানুষের ভালোবাসা এমনই হয়,মুখে নয়,কেবল আর কেবল চাউনীতে ভাসে। ইঙ্গিত দেয় প্রতিটি দর্শনে। বুঝিয়ে দেয় গভীরতা!

ধূসর গলার শ্লেষা পরিষ্কার করল। আচমকা আবদার ছুড়ল ‘ গান শোনা।’
পিউ চকিতে তাকায়।
‘আমি?’
‘ এখানে আর কেউ আছে?’
কণ্ঠে তার রাশভারী, স্বাভাবিকত্বের প্রভাব।
পিউ বলল,
‘ না মানে এখন?’

ধূসর নেত্র সরু করল। মেঘমন্দ্র গাম্ভীর্য নিয়ে বলল,
‘ গান গাওয়ার জন্যে আলাদা সময়সূচি দরকার? ক্যালেন্ডার আনব? ‘
পিউ নিরীহ কণ্ঠে বলল,
‘ কী গান গাইব?
ধূসর ছোট করে বলল
‘ যেটা ইচ্ছে।’
পিউ ঠোঁট কাম*ড়ে, চোখ নামিয়ে ভাবে। এই মুহুর্তে ধূসর ভাইয়ের পাশে বসে তার আওয়াজ বের করতে ক*ষ্ট হচ্ছে,সেখানে গান? অথচ মানুষটার প্রথম আবেদন, ফেরানোর সাধ্যও যে নেই। পিউ
চোখ বোজে। মাথার মধ্যে খুঁজে বেড়ায় কোনও মনকাড়া সঙ্গীত।
হাতাহাতি করে যা পেলো সেই নিয়ে সুর তুলল,

❝ Tasafer ke hasi lamhein, tera ehsas karte hain.. Tera jab jikre atahein,to milne ko tadaptehein….
Humara hal na pucho,ke duniya bhool beithehain.
Chaleen aayoon tumharen bin,na marte hain na jitehein..
Suno accha nehi hotaaa, kisiko aise tadpana…
Mohabbat mein koyeen ashiq kyun ban jata hain dewana.
Agar a peyar hota hain,kisi pein dil jo atahein..
Bada muskil hotahein dil ko samhalna….

মিহি,মিষ্টি স্বরে সম্পূর্ন গান শেষ করে থামল সে। মনে যা এসেছে তাই গেয়েছে। প্রতিটি বাক্য ধ্রুবসত্যি। ধূসর ভাইয়ের ছোড়া প্রণয় বাণ তার অন্তঃস্থল এ ফোড় -ও ফোড় করে দিয়েছে।
ধূসরের অভিব্যক্তি বুঝতে আগ্রহভরে ওর দিক তাকাল পিউ। তার পুরুষালি ঠোঁটে মিটিমিটি পাতলা হাসি। সে তাকিয়েছে বুঝতেই চট করে গম্ভীর করল চোখমুখ। পিউ অপেক্ষা করল একটু প্রসংশার। করল না সে। হঠাৎ সটান দাঁড়িয়ে বলল,
‘আয়।’

পিউ মর্মা*হত হয়,তবে বলা মাত্র উঠে যায়। মাথার ভেতর কিছু অদ্ভূত ইচ্ছে উঁকিঝুঁকি দেয়। ইতস্ততা আর ভ*য়ডর কাটিয়ে ধূসরের এক বাহু আকড়ে ধরে। ধূসর শান্ত চোখে একবার অবলোকন করল সেই স্পর্শ স্থান। মুখের দিক তাকাতেই, পিউ অল্পবিস্তর ঘা*বড়ে গেল। হাত ধরা ঠিক হলো না বোধ হয়। সে সরাতে চায়,এর আগেই ধূসর পা বাড়াল সামনে।
পিউ গাল ফুলিয়ে শ্বাস নেয়। অধর ভরে আসে হাসিতে। স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে সাথে সাথে কদম মেলায়। কিছু দূর এসে ফুলের দোকান দেখে ধূসর দাঁড়িয়ে যায়। দোকানির বড় প্লাস্টিকের মগ ভর্তি গোলাপ পরিদর্শন করে,জিজ্ঞেস করল,
‘ কতগুলো ফুল এখানে?’
দোকানি একে একে গুনে বললেন ‘ ৪৩ টা।’
‘ পিস কত?’
‘ ৫০ টাকা।’
‘ দিন।’
‘ কয়টা?’
‘ সব।’
লোকটা অবাক হলেন। মুখে প্রকাশ পেল সেই ছাপ। চুপচাপ একটা একটা মিশিয়ে স্কচটেপ দিয়ে আটকে গুচ্ছ বানালেন। পিউকে সাথে দেখে নিজের মত হিসেব কষলেন। বলতে হয়নি,নিজেই এগিয়ে ধরলেন ওর দিক।
‘ নিন আপা।’
পিউ মনঃদ্বিধা সমেত চেয়ে। ধূসরের জবাবের অপেক্ষায় সে। এগুলো কি ওর জন্যে? ও কি ধরবে? ধম*ক খাবে নাতো?
ধূসর তখন মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করছে। তন্মধ্যে একবার তাকিয়ে ভ্রু উঁচায়
‘ কী?ধর!’
পিউ অনতিবিলম্বে হাতে নিলো। পরিতোষের অতিউচ্চ উর্মী, আছ*ড়ে পরল বক্ষে। হৃদকম্পন জোড়াল হয়। ধূসর টাকা মিটিয়ে রিক্সা ডাকল। পিউকে আগে উঠিয়ে, পাশে বসল নিজে। একইরকম সাবধানে,উরুর কাছটা চে*পে রাখল হাত দিয়ে। পিউ এক ধ্যানে তাকিয়ে তার দিকে। বিমূর্ত,বিমোহিত, বিস্মিত সেই চাউনী। ঝরঝর করে ঝরছে, যেখানে বৃষ্টিস্নাত ভালোবাসা।

পুরো রাস্তায় সে মুখ খোলেনি। প্রচন্ড ভালোলাগা দখল করেছে তার বক্ষপট। আজকের দিনের কাছে সে ঋনী। না হোক প্রেমময় কথোপকথন ,না হোক রোমাঞ্চকর বাক্য বিনিময়,এই কয়েক ঘন্টা ধূসর ভাই পাশে ছিলেন যে! এই বা কম কীসে? এতেই সে আপ্লুত,উচ্ছসিত। গতকাল রাতভোর,যে স্বপ্ন সে বুঁনেছে,আঁখিদুটি ছাপিয়ে যে অলীক কল্পনা এঁকেছে, তার যৎকিঞ্চিত হলেও তো পূরন হয়েছে। পিউ আফসোস করল ভীষণ, কেন যে পুষ্পর কথায় শাড়ি পরল না! তাহলে যে ইচ্ছেটা পুরোপুরি পূর্নতা পেত!

সে ললিত নেত্রে গোলাপ গুলোর দিকে তাকায় একবার।ধূসর ভাই পাশে রয়েছেন বিধায়,নাহলে এই ফুলে চুমু দিয়ে ভরিয়ে ফেলত এখন। জীবনে প্রথম পুষ্প উপহার,তাও দিয়েছে প্রিয়তম সে। এর চেয়ে হৃষ্টতার কিছু হয় বুঝি!

সে অতিক*ষ্টে চিত্তচাঞ্চল্য সামলে নেয়। নিরুদ্বেগ ভঙিতে বসে থাকে। দেখতে দেখতে রিক্সা পৌঁছায় গলিতে। তখন, ধূসর চালককে থামতে বলল। যাওয়ার সময় যেখান থেকে উঠেছিল, সেখানে এসেই নামল। ভাড়া মিটিয়ে পিউয়ের দিক চেয়ে বলল,
‘ যা তাহলে। ‘
‘ আপনি যাবেন না?’
‘ পরে।’
পিউ ঘাড় কাত করল। রিক্স চলতে থাকে,অথচ তার চোখ সরেনা। সামনে এগোলেও মাথা ঘুরে থাকে পেছনে। ধূসর ভাইওতো তাকিয়ে আছেন। নিষ্পলক,নিবিষ্ট সেই চাউনী। যতক্ষণ পিউকে দেখা গেল সে দেখল৷ অতঃপর বাম হাতটা আনল চোখের সামনে। এই হাতেই ছিল পিউয়ের ছোট্ট হাত। হাসল সে, অন্যরকম, আলাদা,অদ্ভুত হাসি।

**

পিউ গেট থেকে ঢুকতে যায় আচমকা কেউ মাথায় চাটি মেরে ডাকল ‘ ওই।’
সে চমকে তাকাল,অবাক হলো। পুষ্প দাঁত বার করে হেসে ভ্রু উঁচায়।
‘ কী রে!’
পিউ তৎক্ষনাৎ চোরা-পথে ফুলগুলো ওড়নার পেছনে লুকায়। চোখ বড় বড় করে বলল,

‘ তুই? তুই কোত্থেকে এলি? ‘
পুষ্প দুপাশে, দু-হাতের তালু বিছিয়ে বলল,
‘ সারপ্রাইজ! ‘
‘ কীসের সারপ্রাইজ? আমাকে বের হতে বলে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেছিলি? লোকেশন পাঠিয়েছিস? ‘

পুষ্প, পিউয়ের গোলাপ ফুল দেখে নিয়েছে আগেই। সে ঠোঁট চেপে হাসি আটকায়। ধরা দেয়না। আগে আগে মেইন গেট পার হয়। হাঁটা-পথে জবাব দেয়,
‘ আমি লোকেশন না পাঠিয়ে তোর অনেক বড় উপকার করেছি।’
পিউ পেছনে আসতে আসতে শুধাল ‘ কী উপকার?’
‘ একদিন বুঝবি।’
‘ আমি এখন বুঝতে চাই।’
‘ উহু, সময় হোক।’
তারপর থেমে দাঁড়াল। সচেতন কণ্ঠে বলল,
‘ আচ্ছা শোন,আম্মু বা কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবি এতক্ষণ আমরা একসাথে ছিলাম, ওকে? ‘
পিউ কপাল কোঁচকায়
‘ মিথ্যে কেন বলব?’
পুষ্প বুকের সাথে হাত ভঁাজ করে বলল,
‘ তাহলে কী বলবি শুনি? কোথায় ছিলিস এতক্ষণ? ‘
পিউ চুপ করে গেল। সে যে ধূসর ভাইয়ের সাথে ছিল সেটাতো বলা যাবে না। পুষ্প হেসে, আবার চলতে থাকে। বলে যায়,
‘ যা বললাম, মনে থাকে যেন। ‘

***
ঘড়িতে তখন ছয়টা বাজে। ধূসর দুপুরে খেতে আসেনি। ফোন করলেও লাভ হয়নি। যতবার রিসিভ করেছে আশেপাশে তীব্র কোলাহলের শব্দ। কিছু ক্ষণ হলো মারিয়াও চলে গিয়েছে।

প্রতি শুক্রবারের মত আজকেও বসার ঘরে বসেছে চায়ের আসর। নরম বিকেলে ছাদের সেই চারখানা চেয়ারে বসে, গল্পে মেতে ছিলেন চার সহোদর। মাগরিবের আজানের আগে আগে নীচে এলেন তারা।

মিনা বেগম চা বানিয়ে জবার কাছে পাঠালেন। তিনি এসে সবার হাতে হাতে দিলেন। পিউ ঘুম সেড়ে কেবল নীচে নামল। বলতে গেলে সেই পৌঁছেছে সবার শেষে। রিক্ত আর রাদিফ বাদে বাকী সকলে উপস্থিত। পুষ্প, সাদিফ প্রত্যেকেই আছে। পিউ নামতেই সে এক পাশে সরে বসার জন্যে জায়গা দেয়।
পিউ বসল, হাই তুলতে তুলতে সেজো মায়ের কাছে চা চাইল।

আজমল লুঙ্গি পরেছেন,সঙ্গে আবার ঢিলেঢালা ফতুয়া। আয়েশ করে, তৃপ্তি সমেত চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,
‘ ভাবির হাতের লেবু চা যে কতদিন পর খাচ্ছি ভাইজান। ওখানে ভীষণ মিস করি জানো।’
আমজাদ হাসলেন। নিজেও প্রসংশা করলেন,
‘ তোর ভাবির চা বানানোর হাত আসলেই মাশআল্লাহ।’
সুমনা বললেন,
‘ আমি যে কতবার চেষ্টা করলাম,আমারটা হলোইনা। আপার লেবু চা সত্যিই স্পেশাল। ‘

মিনা বেগম ভাজা-পোড়ার ট্রে নিয়ে হাজির হয়েছেন মাত্র। সবার তারিফ শুনে লজ্জা পেলেন। বিশেষ করে স্বামী নামক মানুষের। লোকটা সামনাসামনি তার গুনগান কখনওই করেনা। তিনি আস্তেধীরে এগিয়ে এসে ট্রে রাখলেন টেবিলের ওপর।
বললেন
‘ কী ছাতার মাথা বানাই, তা আবার তোদের এত ভালো লাগে!’

আফতাব প্রতিবাদ করলেন,
‘ মোটেই ছাতার মাথা নয় ভাবি। আপনি জানেন না আপনার হাতে জাদু আছে।’
মিনা গদগদ হেসে বললেন ‘ কী যে বলো না ভাই!’

সেই সময় ধূসর বাড়িতে ঢুকল। তার জুতোর শব্দ সকলের মনোযোগ ফেরাল। আমজাদ দেখতেই আরেক দিক মুখ ঘোরালেন। ওর ওপর তার রা*গটা এখনও পরেনি। আর কী ঢ্যামনা ছেলে,গুরুজন রে*গে আছে বুঝেও মাফ চাইছেনা। আশ্চর্য!
মিনা দেখতেই উজ্জ্বল কণ্ঠে বললেন,
‘ এসে গেছিস ধূসর? দুপুরে তো কিছু খাসনি বোধ হয়,যা ফ্রেশ হয়ে আয়,খাবার দিতে বলি।’

‘ হু।’
ধূসর যাচ্ছিল ওপরে। আজমল ডাকলেন ‘ ধূসর! ‘
সে থেমে তাকায়, ‘ জি চাচ্চু।’
‘ আমার একটু কথা ছিল সবার সাথে। তুমিও থাকো।’

‘ মিছিলে গিয়েছিলাম চাচ্চু। সমস্ত গায়ে ধূলোময়লা। লম্বা শাওয়ার নিতে হবে। আপনি বাকীদের বলুন,আমি জয়েন করব। সমস্যা নেই।’

‘ ঠিক আছে, যাও।’
আমজাদের মুখটা আরো বেশি তিক্ত হলো। দাঁত কপাটি খিঁ*চে স্তম্ভ হয়ে রইলেন। রাজনীতি,মিছিল,স্লোগান তার অপছন্দের শীর্ষে,অথচ ঘরের ছেলে বুক ফুলিয়ে সেসবই ঘোষনা করে।

আফতাব ভাইয়ের চোখমুখ দেখে ঘটনা ঠাওড় করতে পেরেছেন। গো-বেচারা লোকটা টু শব্দ করলেন না। চোরা চোখে ভাইয়ের দিক তাকিয়ে থেকে চুপচাপ কাপের প্রান্তে চুমুক দিতে থাকলেন। মনে মনে দোয়া করলেন ‘ ইয়া আল্লাহ! ধূসরকে নিয়ে আর কোনও কথা না উঠুক। ‘

জবা বেগম চোখ দিয়ে স্বামীকে ইশারা করলেন, বলতে বললেন কিছু। আজমল মাথা নাড়লেন। গলা খাকাড়ি দিয়ে বললেন,
‘ বড় ভাইজান! ভাবি! আমার একটা কথা ছিল আপনাদের সাথে।’
আমজাদ ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলেন। মিনা শাড়ির আঁচলে ঘাম মুছতে মুছতে তটস্থ হলেন। পিউয়ের ঘুমের রেশ তখনও কাটেনি। পিয়াঁজু তে কা*মড় দিতে দিতে অন্য হাতে চোখ ডলছিল সে। সেজো চাচার কথাতে থমকাল। খাবার মুখে পু*ড়ে ভুলে গেল চিবোতে।
ত্রা*সে বুক লাফাচ্ছে। আন্দাজে অসুবিধে হচ্ছেনা, চাচ্চু কী বলবেন!
সে আ*তঙ্কিত লোঁচনে বোনের দিক তাকায়। পুষ্প মনের সুখে খাচ্ছে। তার চোখ আজমলের ওপর। যেখানে পরিষ্কার আগ্রহ।
আজমল ওকেই ডাকলেন। নিজের পাশ দেখিয়ে বললেন,
‘ পুষ্প মা,এসো দেখি চাচ্চুর কাছে।’
পুষ্প স্ফুর্ত মনে উঠে গিয়ে বসল সেখানে। আজমল তার মাথায় হাত বুলিয়ে সেটা কাঁধে রাখলেন। আমজাদ কে বললেন,
‘ ভাইজান,আমার নিজের মেয়ে নেই। পুষ্প আর পিউই আমার মেয়ে। ওদের আমি সন্তান থেকে আলাদা দেখিনা। আমরা কেউই ভাইয়ের ছেলেমেয়েকে আলাদা করিনা তুমি জানো। আমাদের এই একান্নবর্তী পরিবারে যতটা মিল,আমি মনে করি এই মেলবন্ধন হয়ত দেশে হাতে গুনলেও কম হবে। ‘

আমজাদ হেসে বললেন
‘ সেত ঠিকই। আমার পরিবার সোনার টুকরো পরিবার! লাখে একটা!’
আজমল বললেন,
‘ আমি যদি তোমার কাছে একটা আবদার করি, রাখবে? আপনি রাখবেন ভাবি?’

মিনা উৎফুল্ল গলায় বললেন ‘ রাখব না মানে? খালি চাও তুমি ভাই। ‘
‘ কী চাও আজমল,বলেই দ্যাখো।’
বাকীরা কৌতুহলী। চেহারায় শুনতে চাওয়ার প্রবণতা। পিউয়ের গলা শুকিয়ে আসছে। বিচলিত ভঙিতে বারবার ওপরের দিক তাকাচ্ছে। প্রার্থনা করছে ধূসর আসার।
আজমল বিনীত হাসলেন। পুষ্পর দিক একবার দেখে বললেন,
‘ আপনার মেয়েটাকে আমি আমার ছেলের জন্যে চাই। পুষ্পকে আমি সাদিফের বউ করতে চাই ভাবি। ‘

সাদিফ কেশে উঠল। কাশির দমকে কাপ থেকে গরম চা উত্থলে পরল গায়ে। পুষ্প কিংকর্তব্যবিমূঢ়! বিস্ফোরিত চোখে চাচার দিকে তাকাল। হাত পা কাঁ*পছে,দুনিয়া দুলছে। পিউয়ের মুখ কাঠ-কাঠ। সে ব্যথিত,অসহায় নজরে বোনের দিক চেয়ে রয়। ফের আরেকবার তাকায় সিড়ির দিকে। এই সমস্যার সমাধান,তার ধূসর ভাই,
‘কখন আসবেন আপনি?

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে