#এক_সমুদ্র_প্রেম!
লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(১৪)
বিকেল হতে না হতেই বাড়ির গৃহীনিরা ছুটেছেন শপিং মলে। বিয়ে উপলক্ষে জমিয়ে কেনাকা*টা করবেন আজ। সাথে বগলদাবা করে নিয়ে গেলেন,রাদিফ আর রিক্তটাকেও। আপাতত বাড়ি শূণশাণ। সাদিফ,পিউ,পুষ্প ছাড়া কেউ নেই। আর তারা তিনজনই নিজেদের ঘরে।
পিউ আজকেও উশখুশ করছে। একটু পরেই পড়াতে আসবে মারিয়া। আর সে কিছুতেই চায়না মেয়েটার কাছে পড়তে। যাকে দেখলেই গা জ্ব*লে তার কাছে বিদ্যা গ্রহন সম্ভব? কিন্তু পিউয়ের মাথার বুদ্ধি এখন আর সাড়া দিলোনা। উলটে তাকে বুঝিয়ে দিলো, ‘ আজ তোকে পড়তে যেতেই হবে ‘।
পিউ রা*গে, দুঃ*খে মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল। তখনি সাদিফ তার ঘর থেকে হাঁক ছু*ড়ল,
” পিউ,এক কাপ চা দিবি?”
পিউ বিরক্ত হয়। মুখ থেকে ‘চ’ বর্গীয় শব্দ করে। তখন মনে পড়ে ভিন্ন কথা। কদিন পরে যখন সাদিফ ভাইয়ের সাথে আপুর বিয়ে হবে,তারপর এগুলো থেকে ছুটি মিলবে তার। সাদিফ ভাইয়া আর জ্বা*লাবেন না। তখন মিস করবে এসব। পিউয়ের খা*রাপ লাগল। তাৎক্ষণিক ছুট লাগাল রান্নাঘরে।
ঠিক সাড়ে ছয়টায় মারিয়া হাজির হলো বাড়িতে। পড়নে কমলা চুরিদার,কোমড়ে একটা মাঝারি বেনি দুলছে। ফর্সা শরীরে রঙটা ফুঁটেছে দারুন । অন্য একটা টিউশন থেকে ফিরল মাত্র। রিক্সা পাচ্ছিল না বলে,হেঁটে এসেছে। আর তাতে পাক্কা বিশ মিনিট দেরি হলো। ব্যস্ত ভঙিতে বসার ঘরে ঢুকল সে। ঠিক সেই মুহুর্তে, ফোন টিপতে টিপতে ওপাশ থেকে আসছিল সাদিফ। বিকেলের ঘুম সেড়ে উঠল কেবল। কেউ কাউকে খেয়াল করেনি। ওমনি একে অন্যের সঙ্গে সংঘ*র্ষ। রীতিমতো মারিয়ার কপালের সঙ্গে সাদিফের থুতনী ঠু*কে গেল। অপ্রস্তুতিতে পিছিয়ে গেল দুজনেই। মারিয়া কপাল ধরে হকচকিয়ে তাকাল। সাদিফ ও ভড়কে দেখছে তাকে। সে চেঁ*তে বলল,
” মেয়ে দেখলেই ধা*ক্কা দিতে হবে? দেখে চলতে পারেন না?”
সাদিফও পালটা চেঁ*তে জবাব দেয়,,
” আপনি দেখে চলতে পারেন না? অন্ধ কোথাকারে!”
” আমি অন্ধ,না কী আপনি? চারটে চোখ দিয়েও দেখেন না, কে আসছে কে যাচ্ছে! উফ! দিলো আমার মাথাটা শেষ করে।”
সাদিফ ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
” ও হ্যালো,হোয়্যাট ডু ইউ মিন বাই চারটে চোখ?”
” কেন? বাংলা বোঝেন না? চারটে চোখ বলতে নাকের ডগায় যে ইয়্যা বড় সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছেন সেটার কথা বলছি। চশমা পরেও দেখতে পান না,তাহলে ঘরে বসে থাকলেই পারেন।”
সাদিফের আত্মসন্মানে লাগল। রে*গেমেগে বলল,
” ভদ্রতা বজায় রাখুন। মেয়ে বলে কিছু বলছিনা, মানে এই নয় যে আমি বোবা। আমার বাড়ি,আমি যার ইচ্ছে তার সাথে ধা*ক্কা খাব,দরকার পরলে তাকে নিয়ে এই মেঝেতে বক্সিং খেলব,আপনার তাতে কী? আর আপনি কে? এ বাড়িতে ঢুকলেন কী করে? দারোয়ান চাচা আপনাকে ঢুকতে দিলেনই বা কেন?
‘ আমার বাড়ি’ শব্দটা শুনে মারিয়া অবাক হলো। আজ দুদিন পড়াতে এসে এই লোককে তো দেখেনি। সরাসরি প্রশ্ন করল,
” আপনি এ বাড়ির কে? গেস্ট?”
সাদিফ আকাশ থেকে পরার ভাণ করে বলল,
” গেস্ট? নো ওওয়ে! আমি এ বাড়ির ছেলে। কিন্তু আপনি কে?”
মারিয়া বুকের সাথে হাত ভাঁজ করে দাঁড়াল। ভাব নিয়ে বলল,
” আমি পিউয়ের টিচার। ”
সাদিফ ভ্রুঁ উঁচিয়ে বলে,
” কী? টিচার? আপনার মত ঝগ*ড়ুটে মেয়ে আবার কী পড়াবে?”
মারিয়া ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,
” যা তা বলছেন কেন? এ বাড়িতে
ধূসর আমাকে এনেছে। উনি নিশ্চয়ই নিজের বোনের জন্যে এমন কাউকে বেছে আনবেনা যে পড়াশুনা জানেনা।”
‘ধূসর এনেছে’ শুনে সাদিফ দমে গেল। নাম ধরে সম্বোধন করেছে যেহেতু মেয়েটি নিশ্চয়ই ধূসরের সমবয়সী। তাহলেতো বয়সে তার বড়। সাদিফ ভ্রুঁ গুঁটিয়ে পা থেকে মাথা অবধি দেখল মারিয়ার। এইটুকু একটা মেয়ে ভাইয়ার বয়সী? সাদিফের মাথায় কিছুতেই ঢুকলোনা । দেখে তো মনে হচ্ছে, পুষ্পর চেয়ে খুব জোর এক দুই বছরের বড় হবে বা ওরই বয়সী। অথচ…. সাদিফ যখন হিসাব মেলাতে ব্যস্ত, সেই ক্ষনে মারিয়া বলে ওঠে,
” কিন্তু একটা কথা আমি কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিনা,ধূসরের মত জেন্টেলম্যানের ভাই,আপনার মত এমন অভ*দ্র কী করে হলো? যে মেয়েদের সাথে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগ*ড়া করে। ”
মুহুর্তে সাদিফ ক্ষে*পে যায়৷ চিন্তাভাবনা ছাড়াই বলে দেয়,
” তাহলে আপনিই বলুন,কোথায় কী লাগিয়ে ঝ*গড়া করব?”
মারিয়া তব্দা খেল। হতভম্ব হলো। মুখের ওপর বলল
” অস*ভ্য!”
সাদিফ নিরুদ্বেগ ভঙিতে বলে,
” সেম টু ইউ।”
মারিয়া অবাক হয়ে বলল, ‘ আশ্চর্য লোক তো আপনি! ছেলেরা এরকম কো*মড় বেঁ*ধে তর্ক করে?”
” কেন? কো*মড় না বেঁ*ধে আপনাকে বাঁ*ধলে খুশি হতেন?”
মারিয়া বিরক্ত হয়ে বলল
” আপনার সঙ্গে কথা বলাই ভুল।”
সাদিফ কাঁধ উচু করে বলল, ” সেম টু ইউ।”
মারিয়া আর যথাযোগ্য উত্তর খুঁজে পেলোনা। বিড়বিড় করে ” যত্তসব” বলে চলে গেল। সাদিফ বীতঃস্পৃহা নিয়ে ওর যাওয়া দেখল। ঠোঁট ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে ফোন পকেটে ভরল। বাইরে যাবে, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। দারুন যে মুড টা নিয়ে বের হয়েছে, এই মেয়ে যাস্ট ভে*স্তে দিলো । মানে হয় এসবের?
এক বুক জ্বা*লা,আর আপত্তি ছাইচা*পা দিয়ে পিউ বাধ্যমেয়ের মত টেবিলে বসে। মারিয়ার দিক চোখ পড়তেই সে মিষ্টি করে বলল,
” কেমন আছো পিউ?”
পিউ বিন্দুমাত্র না হেসেই উত্তর দেয়,
” ভালো।”
পালটা জিজ্ঞেসও করলোনা তাকে। মারিয়ার কিছু এলো গেলোনা। যেন সে আগেই অবগত পিউ কেমন করবে সে নিয়ে । চুপচাপ বই মেলে ধরে বলল,
” সেদিন যা পড়িয়েছিলাম পড়েছো?”
” না।”
” কেন?”
পিউ অনিহা সমেত জানাল ” ইচ্ছে করেনি।”
মারিয়া শান্ত চোখে তাকায়। ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলে,
” বেশ! তাহলে বরং আমি তোমার ধূসর ভাইকে একটা ফোন করি।”
পিউ তটস্থ হয়ে বলল, ” ককেন? এর মধ্যে উনি কোত্থেকে এলেন?”
” কেন আসবেনা বলোতো! উনিইতো আমাকে এনেছেন। সাথে ক*ড়া ভাবে বলেও দিয়েছেন,তুমি কী করছো, কী না করছো সব জানাতে। জানাব না?” ওয়েট ফোন করি।”
মারিয়া ব্যাগ থেকে ফোন বের করে হাতে তুলতেই পিউ ভ*য় পেলো। ব্যাস্তিব্যস্ত হয়ে বলল,
” না না ম্যাম আমি পড়ব। স্যরি! আজ যা পড়া দেবেন,কাল সব গড়গড় করে দেব। চাইলে এক্ষুনি পড়ে দেব।”
মারিয়া মুচকি হাসল। ফোন পাশে রেখে বলল,
” গুড। আমাকে ম্যাম বলতে হবেনা পিউ,আপু ডেকো কেমন? ”
পিউ ভেতর ভেতর রা*গে ফুঁ*সলেও মুখে বলল ” জী।”
” তাহলে তোমাকে আমি দশ মিনিট সময় দিচ্ছি। আগের পড়াটাই এখন বসে মুখস্থ করে আমাকে বুঝিয়ে দেবে,ওকে? ”
পিউ করুন চোখে তাকাল,
” এখনি?”
” হ্যাঁ, এক্ষুনি। নাও শুরু করো।”
মারিয়ার প্রত্যেকটা কথায় মধু ঝরছে । অথচ পিউয়ের শরীর জ্ব*লে যাচ্ছে তাতে। মনে মনে আরো মাত্রাধিক রা*গ পুষল এই মেয়ের বিরুদ্ধে। সাথে নিজেই নিজেকে ঘোষণা করল,
” একটা সুযোগ পাই,দেখবেন আপনার কী করি। আমাকে ব্ল্যাক মেইল করা?”
_______
বসার ঘরে আসর বসেছে। সে এক মস্ত, বড়, বিশাল সভা। বরাবরের মতো ধূসর বাদে উপস্থিত বাড়ির প্রত্যেকে। আমজাদ,আফতাব,আনিস তিনজনেই অফিস শেষে, খেয়েদেয়ে, বিশ্রাম করে নিচে এসে বসেছেন। ধূসর এখনও আসেনি বাড়িতে। প্রতিদিন অফিস থেকে পার্লামেন্টে যাওয়া তার রুটিন। ওখানকার কাজ চুকিয়ে এরপরে রাত করে বাড়ি ফেরে। এখন অবধি অফিস ঠিকঠাক সামলাচ্ছে বলে আমজাদ সিকদারও রা করেন না।
সিকদার বাড়িটা একটা একান্নবর্তী পরিবারের গল্প। প্রতিটা দিন সন্ধ্যায়,ঘুমানোর আগে বসলেও আজ ঘটনা ভিন্ন। এইত বিকেলে গৃহিণীরা শপিংয়ে গেছিলেন। ফিরেছেন সন্ধ্যার পরে। পিউ,পুষ্প হাজার জো*রাজো*রি চালিয়েছে নিজেদের জন্যে কিনে আনা জামা দেখবে বলে। অথচ লাভ হলোনা। মিনা বেগম সাফ সাফ বলে দিলেন,’ বাড়ির সবাই আসবে তারপর। ”
আর সেই মোতাবেক পুনরায় সোফার ওপর ভীড় হলো। সবাই মিলে বিশাল বিশাল সোফাগুলো ঘিরে বসল। অন্য ঘর থেকে টি টেবিল টে*নে এনে, দুটো মিলিয়ে জোরা লাগালেন সুমনা বেগম। আকারে চ্যাপ্টা হলে তার ওপর আরামসে রাখা হলো শপিং ব্যাগ। তারপর মিনা বেগম ডাক ছু*ড়লেন সবার উদ্দেশ্যে। পিউ পড়ছিল। ওমনি বইটই বন্ধ করে হুটোপুটি করে নামল। পুষ্প এলো আস্তেধীরে। তার মন -মেজাজ দুটোই খা*রাপ। ইকবালের সাথে সেই বিকেলে ঝ*গড়া হলো আর কথা হয়নি। নিজেই রে*গে সব দিক থেকে ব্লক করেছে। একটা জনমের শিক্ষা ওকে দেবে বলে। অথচ শেষে দেখা যাচ্ছে নিজেরই ক*ষ্টে দম বন্ধ লাগছে। পিউ এসেই মায়ের পাশের সোফার হাতলের ওপর বসল। মিনা বেগম একটা একটা করে প্যাকেট খুলে যার যার কাপড় হাতে দিলেন। ছেলেদের জন্যে পাঞ্জাবি,লিষ্টে রিক্ত রাদিফও রয়েছে। ওনাদের চার জনের জন্যে শাড়ি,আর পিউ -পুষ্পর জন্যে লেহেঙ্গা কিনেছেন। চার জা-য়ের জন্যে একই ডিজাইন আর একই রঙ কিনলেও ছেলেদের পোশাকে ভিন্নতা রেখেছেন তারা। বয়স ভেদে রঙ ও একেক জনের একেক রকম আবার তার নকশাও ভিন্ন। সবার পছন্দ হলো। মিনা বেগম যার টা তাকে বুঝিয়ে দিলেন। বাকী রইল সাদিফ আর ধূসর। দুজনের কেউই বাড়িতে নেই। ধূসর পার্লামেন্টে, আর সাদিফ ছুটির দিন হওয়ায় বন্ধুদের সাথে পাড়ার মোড়ে আড্ডায় ব্যস্ত। মিনা বেগম ওদের পাঞ্জাবি দুটো টেবিলের ওপর রেখে বললেন,
” এগুলো ধূসর আর সাদিফের,ওরা এলে দিয়ে দেব।”
পিউ কথাটা শুনেই হাতলের ওপর থেকে লাফ দিয়ে নামলো। আবদার করল,
” আমি একটু দেখি আম্মু? ”
” হ্যাঁ দ্যাখ। তবে ভাঁজ ন*ষ্ট করবিনা কিন্তু। ”
” ঠিক আছে।”
পিউ ঝটপট প্যাকেট খুলেই পাঞ্জাবি দুটো বের করে। একটা নীল,অন্যটা মেরুন। নিঃসন্দেহে দ্বিতীয়ও টাই মনে ধরল তার। মনে মনে এটা পরা অবস্থায় ধূসরকে কল্পনাও করে ফেলল। উদগ্রীব হয়ে মাকে শুধাল,
” এটা কার জন্যে এনেছো আম্মু?”
জবাব দিলেন রুবায়দা বেগম,বললেন,
” ঠিক নেই রে। যেটা যার ভালো লাগবে সে সেটাই নেবে। বড় সাইজই এনেছি,প্রয়োজন পরলে কে*টে নেয়া যাবে।”
পিউ ঠোঁট ভেজাল জ্বিভ দিয়ে। এই মেরুন রঙ তার ধূসর ভাইয়ের গায়ে সব থেকে বেশি সুন্দর লাগবে তার বিশ্বাস। সাদিফ কে মানাবেই না। কিন্তু ধূসর যদি এটা পছন্দই না করে তখন?
আর সেই বা ধূসরকে এটা নিতে বলবে কেমন করে?
” কীরে পিউ,তোর দেখা হলো? গুছিয়ে রাখ এবার।”
পিউ নড়েচড়ে ওঠে।
ছোট করে জবাব দেয় ” রাখছি ছোট মা।”
পিউ মেরুন রঙের পাঞ্জাবিটা ভাঁজ করতে নিয়েছে কেবল,এর মধ্যেই রাদিফ চেঁচি*য়ে জানাল,
” ওইত ভাইয়ারা এসেছে।”
সাদিফ ঢুকল। সাথে ধূসর ও আছে। দুজন আলাদা এলেও গেট থেকে এক সঙ্গে হয়েছে। সাদিফ সোজা এসে মায়ের পাশে বসল। ধূসর হাঁটা ধরল ঘরের দিকে। রুবায়দা বেগম বলতে নিলেন,
” ও ধূসর….”
সে মাঝপথে জানিয়ে দেয় ” ফ্রেশ হয়ে অাসছি। ”
থেমে গেলেন তিনি । সাদিফ এতসব জিনিসপত্র দেখে বলল,
” বাবাহ,তোমরা কী পুরো মলটাকেই তুলে আনলে না কি বড় মা?”
জবা বেগম হতা*শ কণ্ঠে বললেন,
” আর বলিস না,এ কয়টা কাপড় কিনতে আমাদের যা ঘুরতে হলো! একটা দোকানেও ভালো কিছু নেই। সব মান্ধাতার আমলের শাড়ি। নতুন কিছু ছিলোইনা।”
” ভাগ্যিশ ছিলোনা। থাকলে আর কী কী আনতে কে জানে! দেখা যেত আমার বাবা -চাচা যা ইনকাম করছেন, সব ওখানেই শেষ। ”
আফতাব নাকমুখ কুঁচকে বললেন,
” মেয়েদের সাথে শপিংয়ে মানুষ যায়? এরা ঘন্টার পর ঘন্টা হাতে একটা কাপড় নিয়ে বসে থাকবে। এক ঘন্টা লাগবে কালার বাছতে, দুই ঘন্টা কাপড়ের কোয়ালিটি বুঝতে আর তিন ঘন্টা লাগাবে দামাদামি করতে। আমি বাবাহ ওসব ঝামেলায় নেই।আগেই বলে রেখেছি, যা লাগবে টাকা দিচ্ছি নিজে কিনে নাও,কিন্তু মাফ চাই আমাকে ডেকোনা।
”
আমজদ সিকদার ঠোঁট টি*পে হাসলেন। আনিস আর সাদিফ ঘাড় নেড়ে তাকে সমর্থন জানালেও রুবায়দা বেগম মুখ বেঁকি*য়ে বললেন,
” এত বাছাবাছি আর সময় লাগে বলেই বাজারের সেরা টা কিন্তু মেয়েরাই তুলে আনতে পারে বুঝেছো? যাও না, তোমরা ছেলেরা একদিন মিলে যাও,আমাদের জন্যে কিনে আনো কিছু। তারপর দেখব এসব কথা কোথায় যায়।”
এবারে মেয়েরাও হৈহৈ করে তাকে সমর্থন দিলো। মিনা বেগম পালটা যুক্তি দিয়ে বললেন,
” শোনো ভাই,আমরা আমাদের স্বামী -বাবা- ভাই এদের টাকাপয়সার মায়া বুঝি, ন*ষ্ট করিনা। চাইনা জলে যাক। আর তাই চেষ্টা করি, নিজেদের ক*ষ্টের, সময়ের বিনিময়ে হলেও শ্রেষ্ঠটা যেন কিনতে পারি। যেটা বাকীরা দেখেই বলবে ‘হ্যাঁ খুব ভালো হয়েছে’। এই যেমন একটু আগে তোমার পাঞ্জাবিটা দেখে তুমি বললে? সেরকম। যদি ভালো জিনিস নাই আনতে পারতাম,তবে কী বলতে? ”
আফতাব দুহাত তুলে বললেন,
” ক্ষমা চাইছি ভাবি,ঘাট হয়েছে আমার। মেয়ে মানুষের সামনে বসে তাদের নামে নিন্দে করার মত অপরা*ধের জন্যে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। ”
আমজাদ সিকদার বিড়বিড় করে বললেন,
” বাড়িতে চার চারখানা বাঘিনী আছে আফতাব। পালের গোঁদা টা বেশি সাং*ঘাতিক। কথাটা মাথায় থাকেনা তোমার? কেন যে এত ভুলোমনা তুমি?”
আফতাব সিকদার আ*হত, ছোট শ্বাস ফেললেন। মিনা বগম সচেতন কণ্ঠে বললেন ” আপনি কী কিছু বললেন?”
আমজাদ দুপাশে মাথা দোলালেন” না। ‘
আনিস বললেন। ” আচ্ছা ভাবি, আমরা কি এখন যেতে পারি? আমি ক্লান্ত,ঘুমাব।”
” হ্যাঁ হ্যাঁ ভাই, যাও। হয়ে গেছে।”
” ঠিক আছে।”
আনিসের সাথে সাথে আফতাব,আমজাদ ও উঠে গেলেন। অপর পাশ থেকে নেমে এলো ধূসর। পুষ্প অন্যমনস্ক হয়ে বসে ছিল। সে এসেই ওর পাশে দাঁড়ায়। জিগেস করে,
” কফি আনতে পারবি?”
পুষ্প তৎপর উঠে দাড়ায়। ‘ আনছি’ বলেই ছুটে যায়। পিউয়ের মন খারা*প হয়। ধূসর ভাই তাকে কেন বললনা? পুষ্প যেতে যেতে পেছন থেকে রুবায়দা বেগম বলে দিলেন,
” বানানোই আছে, তুই শুধু গ*রম করে ঢেলে নিয়ে আয়।
পুষ্পর জায়গাটায় বসল ধূসর। গলায় সাদা তোয়ালে ঝুলছে। মাকে বলল,” কী বলতে চাইছিলে?”
উত্তর করলেন মিনা বেগম। বললেন,
” দ্যাখ দেখি বাবা, এই দুটোর ভেতর কোনটা তোর পছন্দ হয়?”
পিউ উদ্বিগ্ন হয়ে তাকাল।। যেন ধূসর তাকালেই চোখ দিয়ে বলে দেবে এটা নিতে। কিন্তু ধূসর না দেখেই বলল, ” সাদিফ নিক যেটা নেবে,বাকীটা আমার জন্যে রেখো।”
পিউ মিইয়ে যায়। সাদিফ চশমা ঠেলে পাঞ্জাবি দুটোতে চোখ বোলায়।
পিউ হাতে ধরা পাঞ্জাবির কোনাটা ঈষৎ খাঁ*মচে ধরল। ভীষণ রকম চাইল সাদিফ ভাইয়া এটা নয়,নীল টা বাছুক। সাদিফ দুটোর দিকেই ভালো করে দেখল। সময় নিয়ে বলল,
” এটা।”
মেরুন টা ধরতেই পিউয়ের মুখে মেঘ ঘনিয়ে আসে। ছোট্ট মুখটা সংকোচনে আরো ছোট হয়। সাদিফ তুলতেই গেলেই দেখে পিউয়ের হাতের মুঠোয় এক প্রান্ত। বলল,
” কী রে ,ছাড়! ”
পিউ হুশে এলো।
” হু?’ বলে আস্তে-ধীরে ছেড়ে দিল।
এর মাঝে পুষ্প এসে কফিমগ হাতে দিলো ধূসরের। সাদিফ উঠে দাঁড়িয়ে গায়ের সাথে পাঞ্জাবিটা ধরল। জানতে চাইল, ” কেমন লাগছে?”
সবাই বাহবা দিলেও পিউ ফিরেও দেখেনি। সে নিচের দিক চেয়ে রইল। তার মন আষাঢ়ে ছেঁয়ে। বেদ*নার্ত ঢোক গি*লে ধূসরের দিক তাকাল একবার। ধূসর মগে চুমুক দিতে দিতে শীতল চোখে তাকেই দেখছে। যেন নিরীক্ষন করছে কোনও কিছু। পিউ মিনিটের মাথায় দৃষ্টি ফেরায়। উঠে দাঁড়ায়। নিজের এলোমেলো লেহেঙ্গা টা বুকে জড়িয়ে চলে যায় কামড়ায়।
_______
পিউয়ের মন খারা*প যেমন তাড়াতাড়ি হয়,তেমন তাড়াতাড়ি চলেও যায়। কোনও একটা আনন্দের বিষয় পেলেই সব ভুলে মেতে ওঠে সে নিয়ে। আসল কথা হলো তার লেহেঙ্গা টাও মেরুন রঙের। এই জন্যেই খুব করে চাইছিল ধূসর মেরুন পাঞ্জাবিটা নিক। এখন তা যখন হলোইনা সেও আর পরবে না এটা। কাল সকালে মেজো চাচ্চু তাকে আর পুষ্পকে নিয়ে জামা কিনতে যাবেন বলেছেন । তখন না হয় সেও একটা নীল রঙের কিছু কিনে নেবে। হবেনা ম্যাচিং ম্যাচিং?
এই ভেবেই পিউ ফুরফুরে হয়,উল্লাসে মজে। বাড়িময় ছোটাছুটি করে। কিন্তু হঠাৎ কী ভেবে আবার নেতিয়ে আসে। সিরিয়াস হয়। হুট করে কোত্থেকে একটা নতুন ভাবনা উদ্ভব হয় মাথায়। আচ্ছা,এই যে ধূসর ভাই কথায় কথায় মারিয়াকে ফোন করেন,এর মানে ওনার নম্বর ওই পেত্নীটার কাছে আছে। তাহলে কী,এরা চ্যাটিং ফ্যাটিং ও করে না কী? পিউয়ের সব ছোটাছুটি, দুরন্তপনা এক ভাবনায় থেমে যায়। মাথা খা*রাপ হয়। পড়াশুনা উঠে যায় তুঙ্গে।
আপাতত এই সন্দেহ না কা*টলে তার শান্তির ঘুমের রফাদফা।
পিউ ভাবতে বসল। বই বন্ধ করে ডুব দিল বুদ্ধি উদঘাটনে। কী করলে ধূসরের ফোনটা হাতে পাবে? অনেক ভেবে তারপর উঠে পরল,ব্যস্ত পায়ে ঘর ছাড়ল। গুটিগুটি পায়ে এসে দাঁড়াল ধূসরের কক্ষের সামনে।
ধূসর ভেতরে নেই। দরজা হা করে খোলা। পিউ তাড়াহুড়ো করে ঢুকে পরে। আশেপাশে তাকায়। না, ধূসর কোথাও নেই। পরপর বিছানার ওপর ফোনটা দেখেই তার চেহারা চকচক করে ওঠে। লোলুপ দৃষ্টিতে তাকায়। ঘাড় ঘুরিয়ে সতর্ক দৃষ্টিতে একবার বারান্দাটাও দেখে নেয়। মনে মনে ভাবে,
“ধূসর ভাই কী বোঁকা,এভাবে ফোন রেখে কেউ যায়? ”
পিউ চটজলদি ফোনটা হাতে তুলল। মজার কথা হলো,ফোনের লক তার অবগত। বহুবার ধূসরের পাশে বসে আড়চোখে খুলতে দেখেছে। কিন্তু এ যেন ধূসরের সোনার হরিণ। যা সে ভুলেও কাছ ছাড়া করেনি আর পিউ ও সাহস নিয়ে ধরেনি। মোট কথা,আজ যেমন গোয়েন্দাগিরি করতে এলো এরকম তো প্রয়োজন পরেনি কখনও তাইনা? কিন্তু ফোন ধরে যেন বিপ*ত্তি বাড়ল। প্রচন্ড রকম হাত কাঁ*পছে। রীতিমতো ঠকঠক করছে আঙুল গুলো। ওদিকে বুকটাও লাফাচ্ছে। পাছে ধূসর ভাই এসে পরলে! পিউ তড়িঘড়ি করে ফোনের সাইড বাটনে ক্লিক করে। আলো জ্বলল স্ক্রিনে। বাইকে বসা ধূসরের চমৎকার একটি ছবি ভেসে ওঠে লকস্ক্রিনে। পিউ মুগ্ধ চোখ বুলিয়ে লম্বা করে শ্বাস টানে। এই মানুষ টা কী জানে,সে যে ভ*য়াবহ প্রেমে পড়েছে তার? গত তিনটি বছর যাবত তার প্রতিটি চিন্তায় সে,চেতনায় সে? জানেনা। জানলে নিশ্চয়ই এভাবে তার মন নিয়ে ফুটবল খেলতে পারতোনা। এতটা খা*রাপ তার ধূসর ভাই নয়৷ পিউ সুস্থির হস্তে প্যাটার্ন টানল। ইনবক্স গুলো একবার চেক করলেই শান্তি পাবে। মারিয়া ছাড়াও অন্য কোনও মেয়ের সাথে ধূসর ভাই কথা টথা বলে কী না তাও জানা যাবে। কিন্তু বিধিবাম! লক স্ক্রীন থেকে হোম স্ক্রীন অবধি যেতে পারল না, এর আগেই ছো মেরে ফোনটা কে*ড়ে নিলো কেউ একজন। পিউ চমকে তাকাল । প্রানপ্রিয় ধূসর ভাইকে দাঁড়ানো দেখে কলিজা ছ*লাৎ করে উঠল। মেরুদণ্ড বেঁয়ে চলল শ*ঙ্কার ঠান্ডা স্রোত । ক*ম্পমান জ্বিভ নেড়ে নিজের হয়ে সাফাই গাইবে এর আগেই ধূসর পিঠের সাথে হাতখানা মু*চড়ে ধরল তার।
ভ*ড়কে গেল পিউ। ব্যা*থায় আ*র্তনাদ করে বলল,
” আ, ধূসর ভাই লাগছে!”
_______
গভীর রাত। একটার কাছাকাছি প্রায়। পুষ্প ঘুমে তলিয়ে। তুলতুলে বিছানায়,কম্বলের নিচে নরম শরীর ঢেকে ঘন শ্বাস ফেলার মাঝেই জানলায় খটখট শব্দ হলো। পুষ্পর অগাধ নিদ্রায় যার প্রভাব পরল না তেমন। শব্দটা সময়ে সময়ে জোড়া*ল হয়। টোকাটা ধীরে ধীরে ক*ড়াঘা*তে পরিনতি নিতেই পুষ্পর ঘুম ছুটে গেল। তড়াক করে উঠে বসল। ঘরের আলো জ্বলছে। কখন ঘুমিয়ে পরল ও? পুষ্প দেয়াল ঘড়িতে চোখ বোলায়। শব্দটা তখনও হচ্ছিল। পুষ্প সজাগ হয়ে তাকাল। এই রাত বিরেতে কে জানলা ধাক্কাছে? পুষ্প অল্পবিস্তর সাহস জুগিয়ে বিছানা থেকে নামল। পা টি*পে টি*পে এগিয়ে জানলা ঘেঁষে দাড়াল। থাই গ্লাসের ওপর কান পেতে কাঁ*পা কণ্ঠে শুধাল,
” কে?”
ওপাশ থেকে ফিসফিসে জবাব আসে,
” বাবু আমি ইকবাল,জানলাটা খোলো প্লিজ! ”
পুষ্পর চোখ বেরিয়ে আসে। ত্রস্ত হাতে জানলার কাঁচ টেনে খোলে। ইকবাল এক হাতে পাইপ ধরে ঝুলছে রীতিমতো। তার মাথা চ*ক্কর দিল এমন দৃশ্যে। আর্ত*নাদ করে বলল,
” একী!”
পরপর খেয়াল পরল বাড়ির সবার কথা। চট করে মুখে হাত দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
” তুমি এখানে কেন এসছো?”
” বলছি, আগে টেনে তুলবে তো না কী।”
” ও হ্যাঁ হ্যাঁ। ”
ইকবালের মত গাট্টাগোট্টা একটা পুরুষকে টেনেটু*নে তুলতে রীতিমতো ঘাম ছুটে গেল পুষ্পর। তবুও ভালো,সফল হয়েছে। ভাগ্যিশ! রুমটা বানানোর সময় জানলাটায় গ্রীল লাগাতে দেয়নি। দিলে আজ ইকবালকে রুমে আনতো কী করে?
ইকবাল সোজা হয়ে দাঁড়াল। পুষ্প হাঁ*পিয়ে গেছে। সে দাঁত বার করে বলল,
” খুব খুশি হয়েছো আমি আসায় তাইনা?”
পুষ্প ঠোঁট নেড়ে কতক শব্দ আওড়াল। কিন্তু জো*রে শ্বাস টানায় কথা ফুঁটল না। ইকবাল তড়িঘড়ি করে টেবিলের ওপর থেকে পানির গ্লাস এনে ওর হাতে দিয়ে বলল,
” নাও, খাও।”
পুষ্প কপাল গোঁটালো। পানি খেয়ে গ্লাসটা শব্দ করে রেখেই কটম*ট করে বলল,
” তুমি এখানে কেন এসেছো?”
ইকবালের খুশি খুশি ভাবটা উবে গেল। মায়া মায়া মুখ করে বলল,
” কেন? খুশি হওনি?!
” খুশি হওয়ার মত কথা এটা? এত রাতে এভাবে পাইপ বেঁয়ে আসতে তোমায় কে বলেছে? ”
” তো কী করব? তুমি সব জায়গা থেকে আমাকে ব্লক করে রেখেছ কেন? জানোনা,রাতে কথা না বললে আমার ঘুম আসেনা? কী না কী একটু বলেছি,তাইজন্যে এভাবে চেঁ*তে-টেতে যোগাযোগ বন্ধ করবে? চিন্তা হয়না আমার?”
ইকবাল নাক ফোলায়। পুষ্প হেসে ফেলল। ভ্রুঁ নাঁচিয়ে বলল,
” তাই,আপনার আবার চিন্তাও হয়? তা কী নিয়ে এত চিন্তা শুনি?”
ইকবাল তাকাল। সরল স্বীকারোক্তি দিলো
” এরকম মিষ্টি একটা পুষ্পরেনু তোমার জীবনে থাকলে বুঝবে,কীসের চিন্তা আমার।”
পুষ্প লজ্জ্বা পায়। পরপর নিজেই চিন্তায় হাঁ*সফাঁস করে ওঠে। অধৈর্য হয়ে বলে,
” কিন্তু বাড়িতে অনেকেই জেগে আছে ইকবাল। এত তাড়াতাড়ি তো আমাদের রিক্তটাও ঘুমোয়না। কেউ যদি জানতে পারে, সর্বনা*শ হয়ে যাবে! তুমি এখনি যাও প্লিজ।”
” যাব না।”
বলে দিয়েই ইকবাল বিছানায় বসে পরল। পুষ্প ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল ” যাবে না মানে?”
ইকবাল নিরুদ্বেগ ভঙিতে বলে,
” যাবনা মানে যাবনা।”
” কিন্তু কেন?”
” ব্লক করেছো কেন?”
পুষ্প কোমড়ে হাত দিয়ে বলল ” কেন করেছি তুমি জানোনা? তোমার জন্যেইতো। কেন আবার ওসব আজেবা*জে কথা বলেছো তুমি?”
ইকবাল নির্দ্বিধায় বলল,
” বলেছি কারন তোমাকে ভালোবাসি পুষ্প। তাই তোমাকে হারানোর ভ*য় হয় আমার। আচ্ছা মেনে নিলাম,ভুল বলেছি। বেশ,ঝ*গড়া করতে,ব*কতে,তাই বলে ব্লক করবে কেন? একটু কিছু হলে এভাবে যোগাযোগ বন্ধ করে কী মজা পাও তুমি? অন্য দিকের মানুষ টার কেমন লাগে বোঝো একটুও? আচ্ছা,যারা স্বামী স্ত্রী ওদের মাঝে ঝা*মেলা হয়না? ওরা রা*গারা*গি করেনা? করেতো। পৃথিবীতে এমন কোনও স্বামী-স্ত্রী নেই যারা বুকে হাত রেখে বলতে পারবে ‘আমরা ঝ*গড়া করিনা’। তাই বলে কী তারা ডিভোর্স দিয়ে চলে যায়? ঝ*গড়া হলো ভালোবাসার একটা অংশ পুষ্প। যত ঝ*গড়া হবে ভালোবাসা তত বাড়বে। তাই বলে বাচ্চাদের মত ব্লক দেবে কেন?”
পুষ্প হা করে শুনল সব। ইকবাল থামল। ভ্রুঁ উঁচিয়ে বলল,
” আর দেবে?”
পুষ্প মন্থর গতিতে দুদিকে মাথা নাড়ে। দেবেনা শুনে ইকবাল দাঁড়িয়ে যায়। পুষ্প বিমোহিত চেয়ে থাকে। ইকবাল কতটা গুরুতর তাদের সম্পর্ক নিয়ে! কী প্রখর তার ভালোবাসা! এরকম একটা মানুষ যার জীবনে তার আর কী চাই? সে যখন তাকিয়ে হুট করে ইকবাল কোমড় চে*পে কাছে টানে। চকিতে তাকায় পুষ্প। ততক্ষনে ইকবাল বুকের সঙ্গে মিশিয়ে ধরেছে তাকে। ধ্যান ফিরলে মুচ*ড়ে ওঠে সে। চোখ রাঙিয়ে বলে
‘ কী হচ্ছে ইকবাল? ছাড়ো।”
” উহু। এতটা ক*ষ্ট করে, রি*স্ক নিয়ে প্রেমিকার রুমে এলাম,একটু এডভান্টেজ নেব না?”
পুষ্প ঘাব*ড়ে যায়। তুঁতলে বলে
” মমানে?”
ইকবাল ঠোঁট গোল করে বোঝাল ” চুমু খাব, ঠোঁটে।,
পুষ্প হতভম্ব হয়ে বলল ” কী?”
” হ্যাঁ। চোখ বন্ধ করো।”
পুষ্প ঢোক গিল*ল। বিস্মিত সে। এই আড়াই বছরে ইকবালের এরকম আচরণ এই প্রথম দেখছে। ব্লক দিয়েছে বলে কী ওর মাথাটাও গেল না কী? সে নম্র কণ্ঠে বোঝাতে চাইল,
” ইকবাল,বাবু শোনো,আমি স্যরি! আর কক্ষনও ব্লক দেব না তোমাকে। তাও এরকম কোরোনা প্লিজ!”
ইকবাল চোখ পাঁ*কায়।
” চোখ বন্ধ! নাহলে এক্ষুন আমি দরজা খুলে বেরিয়ে যাব। পথে তোমার বাবা -ভাই সবাই আমাকে দেখবে,তারপর… বুঝতে পারছো আমি কী বলতে চাইছি ?”
পুষ্প বিস্ময়াবহ হয়ে চেয়ে রইল খানিকক্ষন। এই পরিচিত মানুষটাকে অচেনা লাগছে ভীষণ। ইকবাল তাড়া দিল,
” চোখ বন্ধ করো, কুইক।”
পুষ্প দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ” ওকে,বাট শুধুই চুঁমু।”
ইকবাল ঘাড় দোলায়। পুষ্প চোখ বোজে। অথচ অনেকক্ষনেও ইকবালের সাড়া পায়না। অধৈর্য হয়ে দৃষ্টি খোলে। ইকবাল হাসছে। রীতিমতো ঝকঝকে দাঁত কপাটি উঁকি দিচ্ছে তার। পুষ্প জিজ্ঞাসায় ভ্রুঁ কোঁচকাল। ইকবালের সরল হাসিটা হঠাৎই পাল্টে যায়। অভিভূত, মুচকি হাসে সে। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে পুষ্পর গাল ধরে বলে,
” দেখলাম,আমাকে কতটা ভরসা করো। আর যা বুঝলাম,তাতে আমি ধন্য। ”
পুষ্পর মাথার ওপর দিয়ে গেল সব। ইকবাল তার দুহাত তুলে উল্টোপিঠে ঠোঁট ছোঁয়াল। চোখ খিঁ*চে বুজে ফেলল সে। ইকবাল পরপর চুঁমু আঁকে কপালে। সে এক পবিত্র,ভালোবাসার স্পর্শ। যেখানে বিন্দুমাত্র, নোংরামি নেই,ছিলোওনা কোনওদিন। পুষ্প চোখ খোলে। কিছু বলতে চায়, এর মধ্যেই দরজায় কড়া পরে। অধৈর্য হাতে ধা*ক্কাছেন মিনা বেগম । সাথে চেঁ*চিয়ে ডাকছেন,
” এই পুষ্প, দরজা খোল। তোর ঘর থেকে ছেলেদের গলার আওয়াজ আসছে কেন?”
চলবে,
#এক_সমুদ্র _প্রেম!
লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(১৫)
” ফোন ধরেছিলি কেন?”
পিউ ভ*য়ে ভ*য়ে জানাল,
” এ..এমনি।”
” মিথ্যে বলছিস। ”
ধূসরের অগাধ স্বরে পিউ ছ*টফট করে। এলোমেলো পাতা ফেলে চোখের। কী উত্তর দেবে এখন? সত্যিটা জীবন গেলেও বলতে পারবে না। ধূসর ভাই জানলে ক*বর দিয়ে দেবেন।
ধূসর হাতখানা আরেকটু চে*পে ধরে বলল,
” কী? কথা নেই জ্বিভে?”
পিউ ফের আ*র্তনাদ করে,
” আ লাগছে! আমি সত্যিই এমনি ধরেছিলাম।”
ধূসরের যুক্তি পছন্দ হয় না। হাতের বাধন দৃঢ় করতেই পিউ কাঁ*দোকাঁ*দো স্বরে বলল,
” এখন কী আমার কথাও অবিশ্বাস করছেন ধূসর ভাই?”
” যেখানে তোকেই বিশ্বাস করিনা,সেখানে তোর কথা….”
স্পষ্ট জবাবে পিউয়ের আদল ছোট হয়ে আসে।
” সত্যি বলছি,বিশ্বাস করুন।”
ধূসর ভ্রুঁ উঁচায়,
” তাই? তাহলে প্যাটার্ন জানলি কী করে? ”
পিউয়ের চোখ মারবেলের মতন হয়ে আসে। ধূসর ভাই দেখে নিয়েছেন তবে? আর মিথ্যে বলে লাভ নেই। ঢোক গি*লে আস্তে আস্তে বলল,
” আপনার পাশে বসে দেখেছিলাম কয়েকবার।”
কথাটুকুন উগড়ে দিয়ে পিউ নেত্র বুজে ফেলল। এই অপরাধে এক্ষুনি না ধূসর চ*ড় মে*রে দেয়। অথচ সে কিছু বলল না। পরিবেশ ঠিকঠাক ভেবে পিউ চোখ খোলে। ঈষৎ ঘাড় বাঁকা করে দেখতে চায় ওকে। এর আগেই ধূসর হাতে চা*প দিলো আবার।
পিউ ব্যা*থায় মু*চড়ে ওঠে। ধূসর দন্ত পি*ষে বলল,
” বিয়েতে গিয়ে ছেলেদের সাথে আড্ডা দেয়ার খুব শখ তোর তাই না?”
পিউ চোখ পিটপিট করে বলল ‘ মমানে?’
‘ রোহান কে?’
তাৎক্ষণিক ভাবে তার নিজেরও মনে পড়লোনা রোহান কে। বোকা বোকা কণ্ঠে শুধাল ‘ কে?’
ধূসর চিবুক শ*ক্ত করতেই পিউ অস্থির হয় ।মস্তিষ্কে চাপ দেয়। পরপর সকালের কথা মনে পড়ে। ওমনি ভ*য়ড*র হুরহুর করে উবে গেল। এর মানে ধূসর ভাই জ্ব*লছেন? পিউয়ের ভেতরটা আনন্দে নেঁচে ওঠে। স্ফূর্ত ভাবটা ধামাচা*পা দিয়ে নিষ্পাপ কণ্ঠে বলল,
” কেন ধূসর ভাই? ‘
ধূসর হাত ধরে রেখেই এগিয়ে আসে৷ বুক মিশে যায় তার পিঠের সাথে। শিরশিরে অনুভূতিতে গাঁট হয় পিউ। সমস্ত শরীরে অনুভূতিরা আন্দোলন চালায়। ধূসরের অতুষ্ণ শ্বাস কাঁধে পরে। ধূসর ক*ঠিন অথচ শান্ত কণ্ঠে বলল,
” একটা কথা ভালো করে শুনে নে পিউ,বিয়েতে যাবি, মজা করবি। এর বেশি লাফালে তোর পা ভে*ঙে দেব আমি। তুই আমায় চিনিস না।”
হুম*কি দিল ধূসর। অথচ পিউয়ের মনে উড়ে গেল শত শত রঙীন প্রজাপতি। সে ঠোঁট চে*পে হাসল। অবুঝের ভাণ করে বলল,
” আমি আবার কী করলাম?”
ধূসর জবাব দেয়না। ঝাড়া মে*রে হাতটা ছেড়ে দেয়।
ঘুরে এসে বিছানায় বসে। ফোনের লক আগেভাগে পালটায়। পিউ স্পষ্ট দেখতে পেয়েই মুখ কালো করে। কী এমন আছে ওই ফোনে? সে প্যাটার্ন জেনেছে বলে পাল্টে ফেলতে হলো?
ধূসর বলল,
” যা এখন। আর ভুলেও আমার যেন ধরতে না দেখি।”
পিউ কথাখানা ভেতরে দমিয়ে রাখতে পারেনা। মুখ ফস্কে বলে ফেলল,
” আপনার ফোনে কী আছে ধূসর ভাই? যে আমি ধরলে….. ”
ধূসর তাকালেই পিউ থেমে যায়। ফের চোখ নামায়। ধূসর কিছুক্ষন চেয়েই থেকে সুস্থির স্বরে জানাল,
‘ এমন কিছু,যা তোর দেখা বারন।”
পিউয়ের অন্তঃস্থলের আশপাশ হুহু করে আমাবস্যা ধেঁয়ে গেলো। মাথায় নাড়া দিলো কিছু বি*শ্রী,বিদঘু*টে চিন্তা৷ প্রথমেই ভাবল, ‘ তার মানে আমিই সঠিক?’
ধূসর ভাইয়ের ফোনে নিশ্চয়ই এমন কিছু আছে। নিশ্চয়ই কী,আছেইতো। হয়ত মারিয়ার সঙ্গেই কোনও কিছু। বা অন্য কোনও মেয়ে! নাহলে কেন এত লুকোচুরি? আচ্ছা,কী থাকতে পারে? এমন কিছু যা সে সহ্য করতে পারবেনা?
” রাত হয়েছে,ঘুমাতে যা।”
লহু কণ্ঠে পিউ নড়ে ওঠে। ভাবনা কে*টে যায়। পণ করে,সে দেখেই ছাড়বে ধূসরের ফোনের লুকোনো জিনিস। আজকের মত হাল ছাড়ল তাই। কক্ষের জন্যে পা বাড়াল,হঠাৎ কী ভেবে থামল দরজায়। ঘুরে তাকাতেই দেখল ধূসর এদিকেই চেয়ে। আজ আর দৃষ্টি সরালোনা। পিউ ভণিতা ছাড়াই বলল,
‘ একটা কথা বলব?’
‘ হু।’
পিউ মিটিমিটি হেসে ওঠে হঠাৎ। ধূসর নেত্র সরু করে। পিউ দুপাশে দুলতে দুলতে বলল,
‘ বর্ষা আপুর কাজিন রোহান ভাইয়া অনেক কিউট জানেন? রবিনের চেয়েও বেশি।’
ধূসর হতভম্ব হয়। বিস্ফো*রিত চোখে তাকায়। কিছু বলতে নিলেই পিউ হুটোপুটি করে দৌড়ে পা*লায়। ধূসর সেদিক চেয়ে শ্বাস ফেলে। বুঝতে অসুবিধে হয়না,মেয়েটা তাকে রাগাতে ইচ্ছে করে বলল এমন। ধূসর সূক্ষ্ণ হাসে। তার আন্দাজহীন পিউ,আদৌ জানে? তার ধৈর্যের বাঁধ কত মজবুত? জানলে এমন বোঁকা বোঁকা মজা করত না নিশ্চয়ই।
_______
পুষ্পর কপাল বেঁয়ে দরদর করে ঘাম পরছে। মিনা বেগম লোচন কুঁচকে মেয়েকে দেখছেন। কিছুক্ষন মনোযোগ দিয়ে দেখে সন্দেহী কন্ঠে বললেন,
” কার সাথে কথা বলছিলি?”
পুষ্প আমতা-আমতা করে বলল,
” কার সাথে বলব? ”
” সর সামনে থেকে।”
বিনাবাক্যে সরে দাঁড়াল সে৷ মিনা বেগম দ্রুত পায়ে ভেতরে ঢুকলেন। আশেপাশে তাকালেন৷ পুষ্প পেছন পেছন দোয়া দুরুদ পড়ছে৷ তিনি তাকানো মাত্রই সোজা হয়ে যাচ্ছে চটপট। মিনা বেগম বারান্দায় গেলেন,উঁকি দিলেন। সেখান থেকে নিচ অবধি দেখে ফিরে এলেন কামড়ায়। হঠাৎ চোখ পড়ল টেবিলের ওপর। ফোনে ভিডিও চলছে। ভ্রুঁ গুটিয়ে এগোলেন সেদিকে। ফোনটা হাতে তুললেন। ওমনি ভ্রু শিথিল হয়। ঠোঁট গোল করে বললেন,
” ও নাটক দেখছিলি?”
পেছন থেকে পুষ্প জবাব দিল,
” হ্যাঁ, কেন? তুমি কী ভেবেছিলে? আমি ঘরে কাউকে এনেছি?”
মিনা বেগম থতমত খেলেন। প্রসঙ্গ লোকাতে ধম*ক দিয়ে বললেন,
” বেশি বুঝিস কেন? একবারও বলেছি আমি?”
” বলোনি। কিন্তু উঁকিঝুঁকি তো ঠিকই দিলে। সাথে প্রমাণ করে দিলে আমার প্রতি তোমার বিশ্বাসের ছিটেফোঁটা ও নেই। ‘
পুষ্প দুঃ*খী দুঃ*খী মুখ করল। যেন ক*ষ্ট পেয়েছে ভীষণ। মিনা বেগমের মায়া হয়। নরম স্বরে মেয়েকে বোঝাতে গেলেন
” না মা আমি তো শুধু….”
পুষ্প থামিয়ে দিয়ে বলল,
” কিচ্ছু বলতে হবেনা আম্মু। আমি সব বুঝি। তুমি আমাকে সত্যিই বিশ্বাস করোনা। বাইরে থেকে কী না কী শুনে এভাবে চেক করছো! এক কাজ করো,সবই যখন দেখলে খাটের নীচটা বাকী রাখবে কেন? তাও দেখো। দেখে নাও আমি ওখানে কাউকে লুকিয়ে রেখেছি কী না!’
ইকবালের চোখ কপালে উঠল। মনে মনে হাঁ -হু*তাশ করে বলল,
” এভাবে বলিস না রে, বলিস না। সত্যি যদি খাটের নিচে উঁকি দেয়, আমিও শেষ, তুইও শেষ! ‘
” রা*গ করছিস কেন? মেয়ে বড় হলে মায়েদের একটু আধটু চিন্তা হয় । এখন বুঝবিনা। আগে মা হ, একটা মেয়ে হোক, তারপর বুঝবি। নয় মাস পেটে রেখেছি,দুহাতে মানুষ করেছি, কতরাত ঘুমোতে পারিনি, সেসব তো দেখলিনা। সামান্য কী করলাম তাই জন্যে এভাবে বলছিস পুষ্প?”
মিনা বেগম ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কেঁ*দে আঁচলে নাক চাপতেই পুষ্প দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মা একটু বেশিই ইমোশোনাল। কাঁ*দতে দেরি, চোখ থেকে পানি পরতে দেরি নেই।
” আহা মা,কী বললাম এমন? কাঁদছ কেন? আচ্ছা স্যরি! ভুল হয়েছে আমার। ”
মিনা বেগম শান্ত হলেন। চোখ মুছে বললেন
‘ ঠিক আছে। শুয়ে পর,রাত জেগে এসব নাটক -ফাটক দেখার দরকার নেই। শরীর খা*রাপ করবে।’
পুষ্প মাথা দোলায়,
‘ আচ্ছা।’ ‘
মিনা বেগম বেরিয়ে গেলেন। পুষ্প এক লাফে গিয়ে দরজা আটকাল। হাঁপ ছেড়ে বাঁচার মত শ্বাস নিলো। তৎক্ষনাৎ খাটের তলা থেকে বেরিয়ে এলো ইকবাল। নিজেও বুকে হাত দিয়ে শ্বাস ঝেড়ে বলল,
” থ্যাংক্স গড। বাঁচিয়ে দিলে আজ।’
পুষ্প ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
” আর এক মুহুর্ত এখানে থেকোনা,এক্ষুনি যাও ইকবাল। ভবিষ্যতে ভুল করেও এভাবে আমার রুমে এসোনা কিন্তু । ”
ইকবাল ঘোর বিরোধিতা জানিয়ে বলল,
” সেই ভরসা দিতে পারছিনা। ওটা নির্ভর করছে তোমার ওপর। ”
ইঙ্গিত বুঝে পুষ্প অসহায় নেত্রে তাকাল। বলল,
‘ এবার যাও প্লিজ?’
” যাচ্ছি বাবাহ,কেমন করছে দেখো। এত ক*ষ্ট করে এলাম পাত্তাই দিলোনা আমায়।’
” হ্যাঁ, আজ ধরা পরলে পাত্তা ছুটে যেত।’
‘ আচ্ছা, কাল তো চলে যাচ্ছো। দেখা কবে হবে তাহলে? আমি কী ওখানে যাব একবার? বা ধূসরকে বলব আমাকেও সাথে নিতে?’
পুষ্প দুদিকে ঘনঘন মাথা নাড়িয়ে বলল
” না না পাগল না কী? ভাইয়া সন্দেহ করবে৷ মোটেতো চারটেদিন। একটু ধৈর্য ধরে থাকো, দেখবে দেখতে দেখতে চলে গেছে। ‘
” কাল একবার দেখা করা যায়না?’
ইকবালের ব্যকুল স্বরে পুষ্পর খা*রাপ লাগল। একটু ভেবে বলল
‘ যাবে। কাল সকালে মেজো চাচ্চু আমাদের শপিংয়ে নিয়ে যাবেন। ওখানে এসো? ‘
ইকবাল সন্তুষ্ট হয়ে মাথা নাড়ল।
তারপর যেমন ভাবে উঠেছিল তেমন ভাবেই নেমে গেল। পুষ্প আর সেখানে দাঁড়ায়না। ইকবালের পা মাটিতে ঠেকতেই ঝটপট জানলা আটকায়।
পিউ ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে। গায়ে পাতলা চাদর,হাতে ফোন। সম্পূর্ন মনোনিবেশ দিয়ে,ধূসরের ফেসবুক আইডি ঘাটছে। কোন ছবিতে, কোন মেয়ে, কী রিয়্যাক্ট দিয়েছে, কী কমেন্ট করেছে সব খুঁটেখুঁটে দেখছে। লাভ রিয়াক্ট পেলে সেই মেয়ের আইডিতেও চলে যাচ্ছে সাথে সাথে। ভালো করে দেখছে মেয়েটা সুন্দর কী না। তবে একটা বিষয় অদ্ভূত,মারিয়া নামের কোনো চিহ্নওই নেই ধূসরের আইডিতে। তবে কী মেয়েটা অন্য কোনও নাম দিয়ে আইডি চালাচ্ছে? কাল এলে জেনে নেবে বরং। ও, কাল তো হবেনা। কাল তো ওরা বিয়ে বাড়ি যাবে। আচ্ছা,ফিরে এসে জানবে। এই কদিন ধূসর তো তার কাছাকাছিই থাকবে। উল্টোপাল্টা হওয়ার সুযোগই নেই। অবশ্য,সে রেখেছে না কী সুযোগ? এমন চাল চেলেছে,ধূসর ভাই না গিয়ে পারবেন না।
একই সাথে পিউ আরেকটা বিষয়ে সুনিশ্চিত হলো, ‘ ধূসরের ভেতর তাকে নিয়ে নির্ঘাত অনুভূতি রয়েছে। নাহলে কেন ফোনে ওসব বলতে শুনেই যেতে রাজী হবে? কেনই বা আজকের মত এভাবে সাবধা*ন করবে? নিশ্চয়ই তার পাশে কোনও ছেলে দেখলে ধূসরের রা*গ হয়? হিং*সে লাগে? আর এই জেলাসনেস টা কী ভালোবাসার নয়? ‘
পিউ নিজেকেই শুধাল। উত্তর আসে একবার হ্যাঁ, একবার না। ভালোবাসলে মানুষটা তাকে এত এড়িয়ে চলে কেন? কেন নিজেকে এত লুকিয়ে রাখে? তার কী কাছে আসতে মন চায়না? ইচ্ছে করেনা ওকে একটু ছুঁয়ে দেখতে? একবার চোখের দিক চেয়ে বলতে ‘ ভালোবাসি।’ তারতো ইচ্ছে হয়। খুব ইচ্ছে।
কী করে নিশ্চিত হবে,ধূসর ভাইয়ের মনে কে আছে? রবিনকে নিয়ে রা*গিয়েও লাভ হলোনা। ধূসরটা কী না কী নিজে নিজে বুঝে নিলো। পিউয়ের সেদিনের কথা মনে পড়ে। ধূসর তার চোখ দেখে বলেছিল ‘ তোর মিথ্যা বলার যোগ্যতা নেই।’
আচ্ছা,ধূসর ভাই কি ওর চোখ দেখে মনের কথা বুঝে ফেলেছেন?’
তবে তো ভালোবাসাটাও বোঝারা কথা। না কী বুঝেও ভাণ করেন? যে জেগে থাকে তাকে কী করে ঘুম থেকে তোলা যায়? পিউ হ*তাশ হয়ে গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে সামনে তাকায়।আচমকা বাগান থেকে কাউকে দৌড়ে যেতে দেখে সতর্ক হলো। চোখ ডলে ডলে ভালো করে দেখার চেষ্টা করল। ওর দেখার মধ্যেই লোকটা দেয়াল টপকে বেরিয়ে যায়। পিউয়ের নেত্র আকাশ ছোঁয়। চোর নাকী? ব্যাপারটা বুঝতে বুঝতেই চোর পালিয়েছে। পিউ কাউকে জানানোর জন্যে ঘর থেকে দৌড়ে বের হতে গিয়েও থেমে গেল৷ মনে হলো গায়ের শার্ট টা ভীষণ পরিচিত লাগছে। হঠাৎ খেয়াল পরে,এই শার্ট কদিন আগে ইকবাল ভাইয়ের পড়নে দেখেছিল না?
___
সকাল হলো। পুষ্প পিউ একদম সেজে-গুজে পরিপাটি। প্রথমে মল,তারপর গ্রামের বাড়ি। কী আনন্দ! দুজন একযোগে সিড়ি বেঁয়ে হৈহৈ করে নামল। এই উল্লাসে পিউ ভুলে গেল রাতের কথা। আজ আমজাদ আর আনিস ব্যাতীত বাকীরা বাড়িতেই। অফিসের কিছু প্রোজেক্ট গোছানোর জন্যে তাকে জরুরি যেতে হলো। ধূসর, আফতাব যেতে চাইলেও মানা করলেন। সামান্য কাজ,অল্প সময়, ওদের যেয়ে লাভ নেই।
আফতাব সিকদার সোফায় বসে চা খাচ্ছিলেন। পিউ এসেই বলল,
” আমরা রেডি,চলো।”
ওনার সাথে সাথে আরো ক জোড়া চোখ নি*ক্ষেপ হয় তার দিকে। তন্মধ্যে একটা চাউনী পিউকে এলোমেলো করে দেয়। যতটা স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে এলো ততটাই গুটিয়ে যায় ধূসরকে দেখে। ধূসর একবার তাকিয়ে দৃষ্টি ফেরায়,ফোনের দিকে মন দেয়। আফতাব সিকদার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
” আমার শরীরটা কেমন লাগছে যেন। তোমাদের ধূসর নিয়ে যাবে মা।”
পুষ্পর চোয়াল ঝুলে যায়। অন্যদিকে পিউয়ের মুখমন্ডল সোনালী রোদ্দুরের ন্যায় ঝলমলায়। ধূসর ভাই যাবেন মানে,আরো কিছুক্ষন,পাশাপাশি, কাছাকাছি।
পুষ্পর গলা ভ*য়ে শুকিয়ে গেল। ওখানে ইকবাল আসার কথা, যদি ভাইয়াও যায়,তবে তো……!
ধূসর বিনাবাক্যে উঠে দাঁড়ায়। যেন আগে থেকেই জানত। এগোতে নিলেই আফতাব নরম স্বরে বললেন,
” বাবার গাড়িটা নিয়ে যেও৷ এবার অন্তত ইগোটা থামাও। বাবার জিনিস তো তোমারও। ‘
পিউ ভাবল বরাবরের মত ধূসর নাকচ করবে। বাকীরাও তাই ভেবেছে। অথচ ধূসর ছোট করে বলে,
” ঠিক আছে। ”
পিউ হাঁপ ছেড়ে বাঁচে৷ আজও ধূসর যাবে মানে,সি এন জি কনফার্ম। ওইদিনের মতো ভূতের ন্যায় ইকবালের আসার সুযোগ নেই। কিন্তু একটা বিষয় তাকে ভীষণ ভাবায়,যদি ধূসর ভাই, বাইকে কাউকে নাই নিতে চাইবেন,তবে তাকে কেন তুলেছিল সেদিন? ধূসর সামনে সামনে হাঁটা ধরে। পিউ পেছনে কদম ফেলতে ফেলতে চেয়ে থাকে ওর দিকে। ধূসরের চওড়া পিঠ দেখতে দেখতে ভাবে,
” এই লোকটার মধ্যে এক আকাশ রহস্য। কবে সেসব উদঘাটন করতে পারব আমি? কবে?”
_____
পুষ্প ঝটপট ইকবালকে মেসেজ করে দেয়,যেন মলের ধারকাছেও না ঘেঁষে। ইকবাল এলোওনা তাই। অথচ পিউ ছিল মা*রাত্মক হাসিখুশি। ধূসর সাথে আছে যে! পিউ -পুষ্প দুজনেই শাড়ি কিনলো। ভালো মানের জামদানি। পুষ্পরটা গাঢ় গোলাপি। পিউ ভেবেছিল শাড়িটা অন্তত ধূসর ভাই পছন্দ করে দেবেন। সিনেমার হিরোদের মতন দূরে দাঁড়িয়ে চোখ ইশারা করে করে বোঝাবেন কোনটা ভালো লাগছে, কোনটায় না। এবারেও সেই আশায় বালি ঢাললো সে। রসক*ষহীন ধূসরটা কেনাকা*টার সময় সেখানেই রইলোনা। উলটে চলে গেল বাইরে। সাথে রাশভারি স্বরে বলে গেল ‘ এক ঘন্টার মধ্যে শেষ করবি। এক মিনিট দেরি হলে দুটোকেই এখানে রেখে যাব।’
পুষ্প ফটাফট যা সামনে পেল তাই নিল। পিউ বেছে বেছে নীল রঙয়ের শাড়ি কিনেছে। ওইযে, তার ধূসর ভাইয়ের পাঞ্জাবিটাও নীল। সবশেষে, যখন বের হবে পিউ হঠাৎই দাঁড়িয়ে যায়। পুষ্পর দিক চেয়ে চোখ বড় করে বলে,
” আমার তো কিছু অর্নামেন্টস কিনতে হবে আপু। কী করব?”
পুষ্প হাতঘড়ি দেখে বলল,
” এক ঘন্টাতো শেষ হয়নি। আমারও দরকার। চল যাই।”
পিউ মাথা দোলায়। কাপড়ের সাইড ফেলে চলে যায় কসমেটিকস কর্নারে। দুজন মস্ত বড় একটা দোকানে ঢূকল। প্রয়োজনীয় সব কিছু কিনল,টাকা দিয়ে ফিরে এলো। ধূসর গাড়ি ঘেঁষে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে। পিউ আসতে আসতে মুগ্ধতা সমেত দেখতে থাকে।
পরপর বুক ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে। মানুষটাকে বেশিক্ষন চোখের সামনে দেখলেই পাগল পাগল লাগে। দুজন কাছে এসে দাঁড়াল। ধূসর পুষ্পর থেকে চোখ সরিয়ে পিউয়ের দিক তাকাল। নাক আর ঠোঁটের মাঝখানের জায়গাটুকুন ঘামে চিকচিক করছে। এই শীতেও ঘামছে মেয়েটা। ধূসর নির্দ্বিধায় বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে ঘামটুকু মুছিয়ে দেয়। ছোট করে বলে,
” চল।”
পিউ লজ্জ্বা পেয়ে পুষ্পর দিক তাকায়। অথচ সে নিরুদ্বেগ। ব্যাপারটা তার মধ্যে বিশেষ প্রভাবই ফেলেনি যেন।
সারা রাস্তায় ধূসর কথা বলেনি। টুকটাক ফোনেই যা বলার বলেছে। এদিকে পুষ্প- পিউ তারাও চুপচাপ। পুষ্পর মন ভালো নেই। যাওয়ার আগে ইকবালের সাথে দেখা হলোনা বলে। পিউ জানলার দিক চেয়ে চেয়ে গুনগুন করে গান গাইছে। মাঝে মাঝে দেখছে ধূসর কে। সে মানুষটাকে ভ*য় পেলেও ভালোবাসা দ্বিগুন। ধূসর তার ছোট্ট জীবনের বসন্ত। আর পুষ্পর কাছে ধূসর বাঘ৷ একটু বেশিই সমঝে চলে ওকে। মাঝে মাঝে সে নিজেই ভেবে কূল পায়না,কীভাবে ধূসরের চোখ ফাঁকি দিয়ে এত বছর প্রেম করে বেড়াল? যেদিন ধরা পরবে সেদিন যে কী কুরুক্ষেত্র হবে!
নিস্তব্ধ গাড়ির ভেতর পিউ আচমকা চেঁ*চিয়ে ওঠে৷ ধূসর ত্বরিত বেগে পেছনে তাকায়। পুষ্প ভ্রুঁ কুঁচকে শুধাল,
‘ কী হয়েছে?”
পিউ মাথায় হাত দিয়ে বলল,
” আমি চুড়ি কিনতে ভুলে গেছি।’
পুষ্প ধূসরের পানে তাকায়। ধূসর বিরক্তিতে কপাল গুঁছিয়ে সামনে ফেরে। সে নিজেও বিরক্ত হয়। উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে৷ পিউ কোমল স্বরে অনুরোধ করল,
” ধূসর ভাই,গাড়িটা একটু ঘোরানো যায়না?”
ধূসর নিরুত্তর। পিউ বুঝে গেল জবাব দেয়নি,মানে শুনবেওনা। সে নিজের ভুলো মনের প্রতি অতিষ্ঠতায় ঠোঁট ফুলিয়ে শ্বাস নেয়। তার চুড়ি গুলো সব পুরোনো। এখন এক ডজন না হলেই হচ্ছে না। পরমুহূর্তে ভাবল, আচ্ছা থাক,কিছু একটা দিয়ে ম্যানেজ করে নেবে। একটা বিয়েতে চুড়ি না পরলে কিছু হয়না।
_______
বিকেলে পুরো সিকদার বাড়ি রওনা হয় মিনা বেগমের বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে। এত জন মানুষ মিলে হৈ-হুল্লোড় করে গাড়িতে ওঠে । পিউ আগেভাগে রুবায়দা বেগমের পাশে এসে বসেছে। সে কিছুতেই মায়ের সাথে অন্য গাড়িতে যাবেনা। সারা রাস্তা ধম*কে ধা*মকে নেবে। যুক্তি এটা দেখালেও আসল কথা হলো এই গাড়ির ড্রাইভার ধূসর। আর ধূসর যেখানে,সে নিঃসন্দেহে সেখানে। সাদিফ এসে জানলায় উঁকি দিল। পিউকে শুধাল,
” ভেতরে জায়গা আছে? ”
পিউ সামনে পেছনে দেখে বলল, ” একটা সিট।”
সাদিফ গলা উঁচিয়ে দেখে নেয়। একদম পেছেনের সিট খালি। যেখানে বসার ইচ্ছে, সেখানকার চান্স আদৌ নেই। জবা বেগম ছেলেকে ওখানে দাঁড়ানো দেখেই পাশে বসা পুষ্পকে বললেন,
” তুই বরং ওই গাড়িতে যা পুষ্প। ”
পুষ্প বুঝতে না পেরে বলল,
” কেন মেজো মা?”
“যা না ভালো হবে, পিউও ওখানে আছে। তুইও যা।”
পুষ্প কিছুই বুঝলোনা। তবুও কথা না বাড়িয়ে নেমে আসে। মুরুব্বি মানুষ বলেছে যখন! পিউদের গাড়ির ফাঁকা সিটটাতে উঠে যায়। সাদিফ মাথা চুল্কাল কোথায় বসবে তা নিয়ে। একটু পর ধূসর এসে ড্রাইভিং- সিটে বসে। গাড়ি স্টার্ট দিতে গিয়ে সাদিফের উশখুশানো দেখে বলে,
” কী হয়েছে?”
” না,কিছুনা। আসলে এই গাড়িতে যেতে চাইছিলাম।”
ধূসর একটু চুপ থেকে পাশের সিট ইশারা করল,
“এখানে এসে বোস।
সাদিফ সচেতন কণ্ঠে শুধাল,
” মেজো চাচ্চু বসবেন শুনলাম।”
রুবায়দা বেগম বললেন,
” সে অন্য গাড়িতে বসবে না হয়। তুই বোস তো। ”
সাদিফ উজ্জ্বল পায়ে, গাড়ির দরজা খুলে বসে। ধূসর ভিউ মিরর ঘুরিয়ে দেয়। যেখানে স্পষ্ট ফুঁটে থাকে পিউয়ের বিম্ব। সাদিফকে উঠতে দেখে জবা বেগমের ঠোঁটে হাসি ফুটল। ছেলেমেয়ে দুটোকে কাছাকাছি থাকতে দেয়া উচিত এখন। ওদের মধ্যে যত বন্ডিং ভালো হবে,তত সহজ হবে সম্পর্কটা৷ সাথে সংসারটাও সুখের হবে।
সাদিফ শান্ত,তবে প্রফুল্ল। যাকে ভালো লাগে তার সাথে জমিয়ে ফেলে মুহুর্তে। আর যে চক্ষুশূল তার সাথে জবান বন্ধ। পুরো গাড়িটাতে মেতে ছিল তারা। সে, পিউ, সুমনা বেগম,রিক্ত, আর রুবায়দা বেগম। পুষ্প চ্যাটিংএ ভীষণ ব্যস্ত। লাইনে ইকবাল। মন খারা*প তারও। একটাবার দেখা হলোনা বিধায়।
ধূসর মনোযোগ দিয়ে ড্রাইভ করছিল। মাঝেমধ্যে দেখছিল মিররের দিকে।
একটা সময় রাস্তা ফুরায়। সামনের গাড়িগুলোকে ফলো করতে করতে এসে একটা বাড়ির সামনে থামে ওদের গাড়ি।
মিনা বেগমের পিতা শাহজালাল মজুমদার গ্রামের চেয়্যারম্যান ছিলেন। সে-ই আমলেই গড়ে গেলেন,এই বিশাল, বড় তিনতলা ভবন। এখনও তার যৌলুশ ধরে রেখেছে ছেলেরা। যত্ন- আত্তি একটা ইটেরও কম পরেনা। বাবার শেষ স্মৃতি। এখনও আগের মতোই চকচক করছে দেয়াল গুলো। মিনা বেগমরাও চার ভাই-বোন। তবে দুই ভাই, দুই বোন। তিনিই বড়, সবার মধ্যে। এরপর ভাই রাশিদ, আর মুত্তালিব মজুমদার মিলেমিশে থাকেন এখানে। বর্ষা,বেলাল রাশিদের দুই সন্তান। আর মুত্তালিবের দুই মেয়ে, এক মেয়ে। বড় মেয়েটা এস এস সি দিয়েছে,কলেজে ভর্তি হবে এবার। আর ছোটটা পড়ছে সেভেনে।
একমাত্র পিউরা ছাড়া বাকী সবাই বাড়িটায় প্রথম এলো। তাই রাশিদদের পুরো পরিবার মিলে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন দরজায়। মিনা বেগম চার বছর আসেননি বাপের বাড়ি। মাঝখানে একবার বর্ষা আর বেলালকে নিয়ে ওদের মা ময়মুনা খাতুন ঘুরে এসেছিলেন। এতদিন পর বাবার বাড়ি এসে চোখ ভিজে ওঠে তার। আবেগে আপ্লুত হন। ভাইকে ধরে কেঁ*দে ফেলেন। রাশিদ আর তিনি পিঠাপিঠি। রাশিদ বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন ” বোঁকা কাঁদছিস কেন? এই যে এলি এক মাসে যেতে দেব না।”
মিনা বেগম হাসলেন। এর মধ্যে ধূসরদের গাড়ি ভেড়ে। সবার শেষে আসায় মনোযোগ সেদিকে ঘুরল সবার। পিউ -পুষ্প দ্রুত নেমেই
মামা- মামির কাছে ছুটে যায়। পিউ গিয়েই জড়িয়ে ধরে মুত্তালিব কে। ছোট মামা তার সবচেয়ে প্রিয়। মুত্তালিব চুঁমু খেলেন ওর কপালে। জিজ্ঞেস করলেন,
” কেমন আছিস?”
পিউ চঞ্চল কণ্ঠে জবাব দেয়
” খুব ভালো মামা।”
” এভাবে ভুলে গেলি পিউ? কত গুলো দিন আসিস না তোরা। আমরা বুঝি পর হয়ে গেছি?”
” ওমন করে বলছো কেন মামী? আমরা বুঝি তোমাদের ভালোবাসিনা?”
পুষ্পর কথায় বর্ষা বলল,
” তার নমুনা তো এই। বিয়ে না হলে আজও আসতিনা।”
মুত্তালিবের দুই মেয়ে শান্তা আর সুপ্তি। একটু পরপর ফিসফিস করছে নিজেদের মধ্যে। সাদিফ গাড়ির পেছনে গিয়ে ফোন উঁচুতে ধরে নেটওয়ার্ক খুঁজছে। গ্রামে আসতে না আসতেই সিম ডাউন। কোনও মানে হয়?
রাশিদ মজুমদারের হঠাৎ ধূসরের দিকে চোখ পড়তেই বললেন,
” ওটা ধূসর না মিনা?”
নাম শুনে ধূসর ফোন পকেটে ভরে তাকাল। হাত উঁচিয়ে সালাম দিলো। মিনা বেগম চওড়া হেসে বলেন,
” হ্যাঁ ভাইজান। আমার ছেলে। ”
পিউ মনে মনে আপত্তি করে বলল,
” উহু,তোমার জামাই।”
রুবায়দা বেগমের বুক ভরে আসে। তিনি হেসে আফতাবের দিক তাকালেন। ছেলেটা তাদের অথচ বড় আপা কোনও দিন ওকে পরের মত দেখেনি। সবার সাথে কখনও বলেওনি এটা আমার জায়ের ছেলে। এতটাও ভালোবাসা যায়? আর এইজন্যেই হয়ত ধূসর যেকোনো ছোট -বড় প্রয়োজনেও তাকে না ডেকে ওর বড় মাকেই ডাকে। রাশিদ হাত লম্বা করে
ডাকলেন ‘ এসো বাবা।’
ধূসর এগিয়ে যায়। রাশিদ ওর দুই কাঁধ ধরে আপাদমস্তক দেখে বলেন,
‘ কত্ত বড় হয়ে গেছো তুমি! সেই বিদেশ যাওয়ার আগে দেখেছি তারপর আর যাওয়াই হয়নি ও বাড়িতে। তুমিতো এইচ- এস -সিতে বোর্ড স্যান্ড করেছিলে তাইনা?”
ধূসর কিছু বলার আগেই,
পিউ লাফিয়ে উঠে বলল,
” হ্যাঁ। ধূসর ভাই খুব ভালো স্টুডেন্ট। ওনার মাথাটা নিউটনের মতো। শুধু ঝাঁকড়া চুল নেই। ”
বোঁকা বোঁকা কথাটায় সবাই হেসে ফেলল।
রাশিদ মজুমদার ভ্রুঁ কুঁচকে বললেন,
” তুমি কেন এসেছো?”
পিউয়ের হাসি মুছে গেল। অবাক হয়ে বলল ‘ কেন মামা, আপুর বিয়ে, আমি আসব না?”
” তোমার না পরীক্ষা? এই সময়ে বিয়েটিয়ে গোল্লায় গেলেও বা! পড়াশুনা তো আগে তাইনা? ”
পিউ চোর ধরার পরার মতন চেহারা বানাল। এই কথাটা এখানেই তুলতে হলো?
সে গত দুদিন যাবত কী সাংঘা*তিক ভ*য়ে ছিল এ নিয়ে। পরীক্ষার ছুঁতোতে সবাই তাকে রেখে না গেলে হয়। আর আসার সাথে সাথেই বড় মামা বলে দিলেন? ময়মুনা খাতুন ওকে কাছে টেনে বললেন,
” আহা এভাবে বলছো কেন? ছোট মানুষ। সবাই আসবে ও বুঝি একা বসে থাকবে বাড়িতে?”
পিউ নিভু কণ্ঠে বলল,
” আমার সব পড়া শেষ মামা। শুধু রিভিশন দিলেই হবে।”
মুত্তালিব বললেন ” হ্যাঁ জানিতো,আমাদের পিউও ভালো ছাত্রী। আচ্ছা,সবাই বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে না কী? ভেতরে চলুন। ”
আমজাদ সিকদার আসেননি। আনিস আর তিনি একেবারে অফিস থেকে ফিরবেন। আগেই ফোন করে রাশিদকে জানিয়েছিলেন আমজাদ। সবাই একে একে ভেতরে গেলেও, রাশিদ দাঁড়িয়ে রইলেন। মিনা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,
‘ ভেতরে যাবিনা? অপেক্ষা করছিস কারো জন্যে?”
” হু? হ্যাঁ ওই রোহান রা আসছে তো। ওরা আবার এখানে কোনওদিন আসেনি। চিনবে কী না কে জানে!”
”
ধূসর যেতে যেতে ‘রোহান’ নামটা শুনে থমকাল। ফিরে তাকাল দরজার দিকে। পরপর তীক্ষ্ণ চাউনিতে দেখল বর্ষার সঙ্গে কথা বলতে বলতে যাওয়া পিউকে। এই রোহানের কথাই শুনেছিল না সেদিন? যাকে পিউয়ের এত্ত পছন্দ, তাকে একবার দেখতে হচ্ছেতো।
সবাই ওপরে গেলেও ধূসর বসে পরল সোফায়। শান্তা দেখে শুধাল,
” ওপরে যাবেন না?”
ধূসর সংক্ষেপে বলল,
” পরে যাব।”
শান্তা আর কিছু বলেনা। বাকীদের ঘর দেখানোর জন্যে তাদের সঙ্গে গেল।
পিউ সিড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে পেছন ঘুরে তাকাচ্ছিল। ধূসরের বিষয়টা তার বুঝতে বাকী নেই। হাসল সে, দুষ্টু হাসি। মনে মনে আওড়াল,
” রোহান কে দেখতে চাচ্ছেন ধূসর ভাই? বেশ,দেখুন। তবে খেয়াল রাখবেন,যেন চমকে টমকে আবার চেয়ার উলটে পরে না যান ।”
চলবে,