#এক_সমুদ্র_প্রেম!
লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(০৮)
সাদিফ চোখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে। মেঝের দিকে ভ্রুঁ গুঁটিয়ে তাকানো। তার মুখমন্ডল জুড়ে ধূসরের সুক্ষ্ম চাউনীর বিচরন। ধূসর একই কথা আবার শুধাল,
” বললি না,কত টাকা দিয়ে নিয়েছিস?”
সাদিফ যথোপযুক্ত উত্তর খুঁজে পেল না। চশমা ভা*ঙা নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলল কী? নাহলে ধূসর কোনও দিন এভাবে জিজ্ঞেস করতে আসতোনা নিশ্চয়ই। কাজটা নির্ঘাত ঠিক হয়নি। সাদিফ সাফাই গাইতে আস্তে করে বলল
” চশমার ফ্রেমটা অনেক দামী। প্রথম বেতন পেয়ে কিনেছিলাম,প্রিয় ছিল খুব।”
” তাই বলে এভাবে রিয়্যাক্ট করবি? ”
ধূসরের স্বর প্রচন্ড ধীর। যেন সামান্যতম মে*জাজ নেই। সাদিফ তাকিয়ে বলল,
” তুমিতো জানো ভাইয়া, পিউ কী পরিমান চঞ্চল! ওকে আমি এমনিতে ব*কি? কখনও ব*কেছি? আজ নিশ্চয়ই আমার খা*রাপ লেগেছে,তাই জন্যেই….!”
ধূসর সামান্য হেসে বলল,
” তুই পিউকে বকি*স না,কারন তোর ব*কার মত কোনও কাজই করেনি ও। আমি অন্তত দেখিনি, পিউ যেভাবে আমার জিনিসপত্র এলোমেলো করে ঠিক সেভাবে তোরটা কখনও স্পর্শও করেছে৷ তুই না ডাকা অবধি এ ঘরে ও আসেনা পর্যন্ত। আজ সেইভাবে ভাবে প্রথমবারের মত তুই ওকে ব*কেছিস,আমার জানামতে ঠিক যেইভাবে প্রথম বার ও-ও তোর কোনও একটা জিনিস ভাঙ*লো। ”
সাদিফ অবাক না হয়ে পারল না। যে মানুষ বাড়িতেই থাকেনা ঠিকঠাক, এত খবর তার নখদর্পনে কী করে?
একটু চুপ থেকে বলল,
” আমার রা*গ হয়েছিল বলে ওভাবে বলেছি। ওকে তো তুমিও ব*কো ভাইয়া। তার বেলা? দেশে ফেরার পর কদিন সুন্দর করে ব্যবহার করেছো। তারপর যখন আস্তে আস্তে তুমিও দেখলে পিউয়ের একেকটা কান্ড, সেই থেকে তো আজ অবধি আমিও কখনও দেখিনি তুমি ওর সাথে একটা ভালো করে কথা বলেছ। ”
ধূসর শান্ত অথচ তপ্ত স্বরে বলল
” আমার আর তোর ব্যাপার এক নয় সাদিফ। সেটা তুই না জানলেও আমি জানি। তোর চশমা ভে*ঙেছে? কয়টা চশমা প্রয়োজন তোর? আমি দেব। এটুকু দেয়ার সামর্থ্য আমার আছে। কিন্তু পরেরবার আমি যেন না দেখি তুই পিউয়ের সাথে উচু গলায় কথা বলেছিস।”
শীতল হু*মকি তে সাদিফের কপাল গুঁছিয়ে এলো। আকাশ থেকে পরল সে।
ধূসরের এত দরদী হয়ে ওঠার কারন বুঝল না। ধূসর লম্বা পায়ে হাঁটা ধরেছে । সাদিফের মেজাজ খা*রাপ হলো। যেখানে সে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজ করে, সেখানে ধূসর তাকে টাকার গরম দেখাল? কত টাকা আছে ওর?
রাগ চে*পে রাখতে না পেরে বলেও ফেলল,
” বেকার মানুষের টাকার বড়াই,বি*ষদাঁত ছাড়া সা*পের ন্যায়। ”
সাদিফ ধ*ড়াম করে দরজা আটকাল। কথাটা চাপা স্বরে বললেও কানে পৌঁছালো ধূসরের। শুনতে পেয়েই কদম স্থিত হলো খানিক। ক*টমটে চিবুকে সে চোখ বুজে শ্বাস টেনে ঢোক গেলে। তবে দাঁড়ালো না।
সেই ক্ষনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ধূসর। এতদিন ধরে, যা তাকে বলে কয়েও করানো যায়নি,আজ এক মুহুর্তে ঠিক করল, তাই করার। এরপর চশমার গোডাউন ছু*ড়ে মা*রবে সাদিফের মুখের ওপর।
আফতাব সিকদার বরাবর নরম লোক। অফিসে যাবেন,ফিরবেন,খাবেন, বই পড়বেন,মাঝে মাঝে টেলিভিশনে খবর দেখবেন,পত্রিকা পড়বেন এসবই রুটিন। কথা কম বলেন,ঝা*মেলায় কম জড়ান। এই জন্যে তিনি চার ভাইয়ের মধ্যে বাবা মায়েরও প্রিয় ছিলেন,সাথে ভাইদেরও। এমনকি ভাতিজা-ভাতিজিরাও ভীষণ পছন্দ করেন ওনাকে। অথচ মানুষটার একটাই আক্ষেপ, নিজের ছেলেটাই বি*গড়ে যাচ্ছে। তাকে একটুও মানেনা। কানের কাছে মালা জপেও নিতে পারলেন না ব্যাবসায়। ভাবতেই ভারী নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে বুক ফুঁ*ড়ে। তার এত দুঃ*খ অথচ রুবায়দা বেগম এতেই সন্তুষ্ট। ধূসর যাই করবে তাতেই যেন মহত্ত্ব। অবশ্য এর হাজার খানেক কারন ও আছে।
মিনা বেগমের পেটে তখন পিউ। বাড়িতে পুরুষ বলতে ছিল না কেউ। বেরিয়েছিল রোজকার কাজে। ছোট ভাই আনিসের বিয়ে হয়নি তখনও। জবা বেগম ছিলেন বাপের বাড়ি,আর রুবায়দা বেগম গেছিলেন পুষ্পকে স্কুল থেকে আনতে। বাড়িতে মিনা বেগম একাই ছিলেন,সাথে অনেক দিনের পুরোনো বুয়া তাদের। পুষ্পর স্কুল কাছাকাছি হওয়ায় রুবায়দা ভাবলেন যাবেন আর আসবেন। তাছাড়া ডেলিভারির ডেইট ছিল পাঁচদিন পর। চিন্তার কিছু নেই বলেই ওইটুকু সময় একা রেখে গেলেন মিনা বেগমকে। অথচ বিপ*ত্তিটা যেন তখনি বাঁ*ধল। তলপেট ব্যা*থায় ঘুম ছুটে গেল মিনা বেগমের। নামতে গিয়ে অসতর্কতায় পি*ছলে পরলেন। লু*টিয়ে গেলেন মারবেল মেঝেতে। বুয়াও চলে গেছে কিছুক্ষন হলো। ফাঁকা বাড়িতে গো*ঙানোর শব্দ দেয়ালে দেয়ালে মিলিয়ে গেল।
সেই সময় সবে স্কুল থেকে ফিরেছে ধূসর। বয়স তখন দশের কোঠায়। কক্ষে ফিরতে গিয়েই কর্নকুহর হলো বড় মায়ের চাঁপা আ*র্তনাদ। পিঠব্যাগ মাঝপথে ফেলে রেখেই ছুটল সে। ব্যা*থায় অবস্থা খা*রাপ মিনা বেগমের। ধূসর দিশে*হারা হয়ে পরল। অতটুকু মানুষ, কী করবে, কোথায় ধরবে মাথায় ঢুকলোনা। বাড়ির কাউকে ফোন করে সময় ন*ষ্ট করা যাবেনা। তাই বুদ্ধি করে সবার আগে ফোন লাগাল পরিচিত ডাক্তারের নিকট। দশ মিনিটের মাথায় এম্বুলেন্স এলো। পুরোটা সময় ধূসর মিনা বেগমের মাথা কোলে নিয়ে বসেছিল। ছোট ছোট হাত বিশ্রামহীন বুলিয়েছে ওনার চুলে। মিনা বেগম সব বুঝলেও কথা বলার শক্তি নেই। নে*তিয়ে পরেছেন।
হাসপাতালে নেয়া হলো ওনাকে। ধূসর সঙ্গে সঙ্গে ছুটল। মানুষ অতটুকু হলেও বুদ্ধিমান,চটপটে কম ছিল না। এ মাথা থেকে ও মাথা দৌঁড়েছে সে-ই। সাথে যদিও পারিবারিক ডাক্তার হুমায়ুন ছিলেন। এরপরপর ধূসর পরিবারের বাকীদের খবর দেয়। ধীরে-ধীরে তারাও কাজ বাজ ফেলে ভিড় করল হাসপাতালে। আফতাব সিকদার প্রথম দিকে রা*গারা*গি করলেন ছেলের ওপর ,কেন আরো আগে জানালোনা তাদের। নিজে পাঁকামো করলো,নিলো এত বড় ঝুঁ*কি। অথচ আমজাদ সিকদার প্রান ভরে দোয়া করলেন। ছেলেটা না থাকলে কী হতো আজ?
ধূসরের কোনওদিকে মন নেই। সে মনোযোগ দিয়ে প্রার্থনায় ব্যস্ত। বড় মার চিৎ*কার, ছটফ*টানি নিজ চোখে দেখেছে সে৷ ক*ষ্টে বুক ছি*ড়ে যাচ্ছে তার। সেতো মায়ের মতোই আদর করেন ওকে। এরপর পরই ওটির ভেতর থেকে বাচ্চার কা*ন্নার আওয়াজ আসে। ডাক্তার হুমায়ূন জানালেন মেয়ে হয়েছে। আমজাদ সিকদার মনে মনে ক্ষু*ন্ন হয়েছিলেন যদিও। আশা করেছিলেন ছেলের। কিন্তু বুঝতে দেননি কাউকেই,হেসে আড়াল করেছিলেন । তবে সব থেকে যে মানুষটা বেশি খুশি হয়েছে, সে ছিল ধূসর। বড় মায়ের সব ক*ষ্ট শেষ, আর ব্যা*থা করবেনা ভেবে আনন্দ পেয়েছিল। অনুমতি পেয়ে সবাই যখন মিনা বেগম আর সদ্য জন্ম নেয়া পিউকে দেখতে গেল,মিনা বেগম সবার প্রথমে ধূসরকেই কাছে ডাকলেন। কোমল কন্ঠে বললেন,
” আমার মেয়েকে সবার আগে তুই নে ধূসর। আজ তোর জন্যেইতো বেঁচে ফিরলাম।”
ধূসর কাঁ*পা হাতে তুলতুলে পিউকে কোলে নেয়। পিউ কুটিকুটি পা ছু*ড়ে কাঁ*দছে৷ মিনা বেগম হাউমাউ করে কেঁ*দে ওঠেন। আধশোয়া থেকেই ধূসরকে আর ধূসরের কোলে থাকা পিউকে জড়িয়ে ধরেন। পরিবারের সবার বড় ছেলে হওয়ায় চোখের মনি ধূসর। ওই ঘটনায় মাত্রাটা যেন বৃদ্ধি পেয়েছিল আরো। কিন্তু সে ছেলেই এত ভালোবাসার মূল্য দিলোনা।
আফতাব সিকদারের ভাবনা কে*টে গেল কারো জুতোর শব্দে। আড়চোখে একবার বিছানায় শুয়ে থাকা রুবায়দা বেগমের দিক চোখ বোলালেন। সারাদিন কাজবাজ সেড়ে কিছুক্ষন হয়েছে শুয়েছেন। দেখতে দেখতে আওয়াজটা দরজায় এসে থামল। ওপাশ থেকে অনুমতি চাইল
” আসব?”
গলার স্বর পেতেই ঔৎস্যূক্য যেন তিনগুন ভর করে আফতাবের। হঠাৎ এই মানুষ তার ঘরে কেন? কৌতুহল চাপিয়ে কন্ঠটা একটু ভারী করে জবাব দিলেন,
” এসো।”
রুবায়দা বেগম তৎক্ষনাৎ নড়েচড়ে উঠে বসলেন। ক্লান্তি সব ছুটে গেছে ছেলের গলা পেতেই। ধূসরকে দেখেই গদগদ হয়ে বললেন,
” আয় বাবা আয়,ভেতরে আয়।”
আফতাব সিকদারের মনে হলো ছ বছরের রিক্তকে ডাকলেন তিনি। এত দাঁম*ড়া ছেলেকে কেউ এভাবে আহ্লাদ করে ডাকে? ধূসর ভেতরে এসে দাঁড়াল। আফতাব সিকদার বিছানা ইশারা করে বললেন ” বোসো।”
ধূসর বসল না। যা দেখে অথিতু ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন আফতাব। সহ্য সীমা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” কিছু বলবে?”
ধূসর একবার মায়ের দিক তাকাল। যিনি আগ্রহভরে দেখছেন তাকে। এরপরে বাবার দিক ফিরে সরাসরি ঘোষণা করল,
” কাল থেকে অফিস যেতে চাই আমি।”
বয়স্ক মানুষ দুটো এক চোটে ধা*ক্কা খেলেন। দুজন একে অপরকে দেখে, হা করে চেয়ে রইলেন ছেলের দিকে। ধূসরের একটুও ভাবান্তর হলো না। পরপর বলল,
” আমি কাল থেকে ব্যবসায় বসব। ”
রুবায়দা বেগম অস্থির চিত্তে শুধালেন,
” সত্যিই অফিস যাবি?”
” সান্ত্বনা দেয়ার মত কথা এটা?”
” না তা নয়,এতদিন বলে বলেও….”
আফতাব সিকদার হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দেন ওনাকে। সন্দিহান কন্ঠে বললেন ” ভেবে বললে তো? পরে মত বদলাবে না কি?”
ধূসর টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে, জবাব দেয়,
” তুমি আমাকে চেনো,মুহুর্তে মুহুর্তে মত বদলটা নিশ্চয়ই আমার সাথে যায়না? যা বললাম ভেবেচিন্তেই বলেছি।”
আফতাব সিকদার চুপ করে যান। ধূসর বেড়িয়ে গেল। তিনি বিমূর্ত চেয়ে থাকলেও চোখে হাসলেন । বুক ফুলিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেললেন। যাক! অবশেষে ছেলের সুমতি হলো!
পিউ ঘরের দরজা আ*টকে বসেছে। সে দরজা ধা*ক্কাধা*ক্কি করেও খোলানো গেল না।
তখন ঝোঁ*কের বশে ব*কাঝ*কা করলেও এখন হাঁ*সফাঁ*স করছে সাদিফ। এই নিয়ে ষষ্ঠ বারের মত চক্কর কাট*ল পিউয়ের দরজার সামনে দিয়ে। তারপর ভেবেচিন্তে বারি দিল কাঠের ওপর। নরম কন্ঠে ডাকল,
“পিউ! খোল না দরজাটা….”
ওপাশ থেকে উত্তর এলোনা। সাদিফের মাথা খারা*প হয়ে গেল। সে দিকদিশা খুই*য়ে লা*থি বসাল দেয়ালে। খি*টমিট করে বলল,
” অসহ্য! যা মন চায় কর। খুলতে হবেনা দরজা।”
রে*গেমে*গে নিচে নামল সাদিফ। ধূসরভাই বকতে বকতে শেষ করে দিলেও তো পিউ এরকম করে না। তাহলে তার বেলায় এসবের মানে কী?
সাদিফের মুখের ভঙি দেখে অসহায় শ্বাস ফেললেন জবা বেগম। তারা পরেছেন মহা ঝা*মেলায়। এত বড় বড় ছেলেমেয়েদের বাচ্চামো দেখতে দেখতে অতিষ্ঠ তারা। মিনা বেগম পিউয়ের উদ্দেশ্য বললেন
” কী একটু বলেছে তাতে জাত গেছে ওনার! খেতে হবেনা তোকে। শুধু খাবারটা পঁচুক খালি, দেখিস কী করি! একদিন না একদিন দরজা তো খুলবিই তাইনা।”
পিউ ঘরের ভেতর বো*ম হয়ে বসে। কা*ন্নাকাঁটির ফলে নাকমুখ লালিত। একটা সামান্য চশমার জন্যে সাদিফ এইভাবে বলবে এ স্বপ্নেও ভাবা যায়না। পিউয়ের ঠোঁট পুনরায় ভে*ঙে এলো। রা*গটা আসলে কার ওপর লাগছে সে নিজেই দ্বিধাদন্ধে ভুগছে।
ধুপধাপ করে পড়ার টেবিলে বসল গিয়ে৷ খাতা বের করল। কলম ছোঁয়াতেই গড়গড় করে কিছু কথা উগড়ে এলো। তারপর সারা পৃষ্ঠাজুড়ে অভিযোগ লিখল ধূসরের নামে।
” আপনার জন্যেই আমাকে সাদিফ ভাইয়াও কথা শোনালেন আজ। আপনার জন্যে আমার কপালে আর কত শ*নি আছে ধূসর ভাই? যদি না আপনি ওই পেত্নীটাকে ঘাড়ে বয়ে আনতেন, আমি নিশ্চয়ই কাঁদতাম না, রাদিফও আপনাকে ফোন করতোনা। তাহলে ওর পেছনেও ছুটতাম না আমি। আর এরকম ধা*ক্কা লাগতোনা সাদিফ ভাইয়ার সাথে । এই যে ওনার প্রিয় চশমা ভাঙ*লো এই সব দোষ আপনার। আমি বরাবর নিরপরাধ মানুষ। অথচ তাল আমার পিঠেই পরে। ধূসর ভাই আপনি একটা চো*র। অনুমতি বিহীন আমার মন চু*রি করেছেন,আবার তা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন। চোরের সাথে সাথেও আপনি একটা দর্জ্জাল-শেয়ানা লোক। বাকীদের বেলায় মুখ থেকে রস ঝরে আমার বেলায় ওষুধের মতন তেঁতো কেন?
আমায় ভালোবাসেন না কেন ধূসর ভাই? এখন যদি ভালো বাসতেন,গল্পটা অন্যরকম হতোনা?
এই যে আমি অভিমান করে দরজা আটকে বসে আছি একটু সান্ত্বনাতো দিতে আসতেন। এসে নরম স্বরে ভালোবেসে জিজ্ঞেস করতেন
‘কী হয়েছে? বিশ্বাস করুন আমি সেখানেই ভুলে যেতাম সব। আপনি মানুষ টা এমন কেন ধূসর ভাই? কেন এত পাষান! একটা পাথরের সাথে মাথা ঠু*কলে সেখান থেকেও র*ক্ত বের হয়। তাহলে আপনি পাথরের চেয়েও খা*রাপ ”
দাড়ি টানার আগেই দরজায় ফের টোকা পরল। পিউ বিরক্ত হয়। ভাবে সাদিফ বা অন্য রা। বসে রইল,দরজা খুলবেনা ভেবে। তখনি ওপাশ থেকে ভেসে আসে কাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত কন্ঠস্বর,
” পিউ!
পিউয়ের চোখ বেরিয়ে এলো। বিস্মিত হয়েছে সে। ধূসর সত্যিই এসেছে? বুঝতে সময় লাগল কিছুক্ষন। তারপর হুলস্থুল করে খাতা উলটে বইয়ের চুড়ার ভাঁজে লুকালো। চটপটে পায়ে এসেই ছিটকিনি টেনে খুলল।
ধূসরকে দেখতে হলে ছোটখাটো পিউয়ের চোখ আকাশে তুলতে হয়। সে এখনও একি কাপড় পরে। পিউ একটু অবাক হলো । ধূসর মাত্রাধিক পরিপাটি না হলেও নিজের টুকু ভালো বোঝে। বাড়ি ফিরে এক মুহুর্ত বাইরের কাপড়ে থাকেনা সে। তাহলে, উনি কী এখনও রুমে যায়নি?
তক্ষুনি ধূসর মোলায়েম কণ্ঠে শুধাল ” কী হয়েছে?”
পিউয়ের ওষ্ঠ আলাদা হয়ে পরে। খাতায় লেখা কথাগুলো মাথায় আসে। সে এরকম কিছু লিখে এলো না? মিলযুক্ত ঘটনায় মুহুর্তমধ্যে মন ভালো হয়ে গেল তার। ধূসর খানিকক্ষন তার মলিন চেহারাখানা দেখল। জিজ্ঞেস করল,
” খাবিনা?”
পিউ নড়ে ওঠে,
” হু? হ্যাঁ! ”
” আয়।”
ধূসর পা বাড়াতেই পিউ ডেকে বলল,
” শুনুন।”
ধূসর ফিরে না তাকিয়ে বলল ” কী?”
পিউ ঠোঁট কা*মড়ে সময় নিয়ে বলল ” মারিয়া আপু আপনার কেমন বন্ধু?.”
ধূসর তাকাল।
” কেন?”
” এমনি।”
” তোর পরীক্ষায় এরকম কোনও প্রশ্ন আসবে বলে আমার মনে হয়না। ”
কাঠখোট্টা জবাবে পিউ মুখ কালো করে বলল,
” আপনি এরকম করছেন কেন ধূসর ভাই? আপনার যে একটা মেয়ে বন্ধু আছে আগেতো কখনও শুনিনি। হঠাৎ ইনি কোত্থেকে উদয় হলেন? উনি শুধু আপনার বন্ধুতো?”
ধূসর চোখ সরু করে বলল ” তুই খেতে আসবি? হ্যাঁ বা না?”
গুরুগম্ভীর স্বরে পিউ ঠোঁট উল্টায়। অনেক কিছু বলতে চেয়েও ব্যর্থ হয়। হাত পা ছু*ড়তে ছু*ড়তে হাঁটতে নেয়। সাথে কাঁ*দোকাঁ*দো কন্ঠে বলে,
” যাচ্ছি। সব সময় আমার সাথেই সবাই এমন করে। আর আপনি তো এক ধাপ এগিয়ে। আপনার মে*জাজি শোরুমের ধম*কানো অফার যেন আমার জন্যেই বরাদ্দ।”
পিউ ভাবল ধূসর শুনেও না শোনার ভাণ করবে। সচরাচর যা হয়। অথচ পেছন থেকে ধূসর বলে ওঠে,
” তুইতো তাই চাস। যে নিজে এসে আত্মসমর্পণ করে তাকে ব*ন্দী না করে উপায় আছে?”
পিউ থমকাল। ঘুরে তাকাল। চোখ পিটপিট করে বলল
” তার মানে?”
ধূসর ভ্রুঁ নাঁচিয়ে বলল ” সোজা হাঁট।”
পিউ তবুও দাঁড়িয়ে। ধূসর নিচের দিক চেয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে আবার তাকাল। ঠান্ডা স্বরে বলল,
” আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। তোকে যেন টেবিলে পাই।”
ধূসর ঢুকে গেল কামড়ায়। পিউ অবোধ বনে চেয়ে রইল। কী বলল ধূসর ভাই?”
এরপর নিজেকে সামলে সিড়ি বেয়ে নামল। অত্যাধিক রা*গে শরীরের র*ক্ত গরম হলো সাদিফের
।দাঁত কি*ড়মিড়িয়ে ওভাবেই বসে রইল। এত সময় ধরে সে ডাকল,অথচ পিউ পাত্তা দিলনা। পাত্তা কী,একটা উত্তর অবধি দেয়নি। অথচ যেই মাত্র ধূসর ভাই এলো, খুলে গেল দরজা?
পিউ নিচে নামতেই সবাই এমন ভাবে তাকাল যেন আগন্তুক এগিয়ে আসছে। নিচের সিড়িটায় পা রাখতেই রাদিফ ছুট্টে এসে হাত ধরল। ভীষণ অনুতপ্ত হয়ে বলল,
” স্যরি পিউপু! আমার জন্যেই এত বকা শুনলে আজ। আমার একদম ঠিক হয়নি বড় ভাইয়াকে ফোন করা,তাহলে এসব কিচ্ছু হতোনা।”
রাদিফের ফরসা মুখ টকটকে হলো। কেঁ*দে দেবে ছেলেটা। পিউয়ের প্রতি ভালোবাসা গভীর তার। এত্তকিছু হবে কে জানত! পিউ মুচকি হেসে বলল,
” ধূর বোঁকা। ছোট ভাইয়ের সাথে কেউ রা*গ করে?”
” তুমি তাহলে আমার ওপর রে*গে নেই? ”
পিউ ওর গাল টেনে বলল ” এক্টুওনা।”
সে মুহুর্তে রাদিফের ঠোঁটে হাসি ফুঁটল। চকচকে মুখচোখে মাথা দুলিয়ে বলল ” তাহলে ঠিক আছে৷
সুমনা বেগম বললেন,
” ও পিউ,কখন থেকে ডাকছি তোকে,আয় আয় খেতে বোস। ”
মিনা বেগম বললেন ” ওর ধূসরের ঝা*ড়ি না খেলে আসলেই পেট ভরে না।”
পিউয়েরও মনে হলো কথাটা সঠিক। নাহলে যার নামে অভিযোগ লিখে খাতা ভরল,তার এক ডাকেই দরজা খুলল কেন? সে চায় ধূসর বঁকুক,রা*গ দেখাক। ধূসর লক্ষকোটি বার থা*প্পড় দেব বললেও পিউয়ের কিচ্ছু হয়না। সেখানে সাদিফের এক ধ*মকেই কেঁ*দে ফেলল আজ। কী অদ্ভূত! যাকে ভালোবাসা যায়,তার সব কিছুই কি এত ভালো লাগে?
পিউ আস্তেধীরে এসে বসল চেয়ারে। সাদিফ তুষাড় খন্ডের ন্যায় বসে তখনও। ডানে বামে তাকানোও বারন যেন। মিনা বেগম মাছের বড় একটা টুকরো একটা প্লেটে তুলতে তুলতে বললেন,
“ধূসরের খাবারটা রুমে দিয়ে আসি।”
জবা বেগম বললেন ‘ আমি যাই,আমাকে দাও।”
এরমধ্যেই আমজাদ সিকদার,আফতাব, আর আনিস নেমে এলেন নিচে। ওনাদের দেখে জবা বেগম গেলেন না আর। এ নিয়ে আবার একটা কাহিনী হবে! পুষ্প ওরা সবাই আসতেই টেবিল ভরল কানায় কানায়।
আফতাব সিকদারের মুখ হাসিহাসি। অনেকদিন পর হাস্যজ্বল চেহারাটা দেখা গেল। আমজাদ সিকদার লম্বা পাঞ্জাবির হাতা গুঁটিয়ে ছোট একটা বাটির ভেতর হাত ধুঁলেন। ওনার থালায় ভাত দিলেন রুবায়দা বেগম। আমজাদ ভাত মাখতে মাখতে হঠাৎই জিজ্ঞেস করলেন,
” ধূসর খাবেনা?”
প্রত্যেকে ঝ*টকা খেল। তড়িৎ বেগে তাকাল ওনার দিকে। এতগুলো চোখ একসাথে আ*ছড়ে পরায় সামান্য হতভম্ব হলেন আমজাদ।
” না মানে দেখছিনা টেবিলে। ডাকো তো…”
গত দুই বছরে ধূসর বাপ-চাচাদের সাথে এক টেবিলে খায়নি। খেতে বসে তোলা প্রসঙ্গ তার অপছন্দ বিধায় ভদ্রতার সহিত এড়িয়ে গেছে বরাবর। প্রথম প্রথম জানতে চাইলেও ধীরে ধীরে বিষয় টা বোধগম্য হতেই তারাও আর জিজ্ঞেস করতেন না। আজ এতগুলো দিন পর প্রত্যাশার বাইরে কিছু শুনে সবাই অবাক চোখে চেয়ে রইল। রুবায়দা বেগম ভাত তোলা চামচ টা ওভাবেই ধরে আছেন। একমাত্র স্বাভাবিক রইলেন আফতাব সিকদার। নিরুদ্বেগ সে। পিউয়ের ঠোঁটদ্বয় এক হচ্ছেনা। বড় চোখ দুটো মারাত্মক আকার পেয়েছে। পুষ্প ভাত গি*লতে পারছেনা। আনিস ও হতবাক চেয়ে। মিনা বেগম মিনমিন করে বললেন,
” না মানে ওতো খায়না এখন।”
আমজাদ সিকদার পুষ্পকে বললেন,
” ওকে ডেকে আনো যাও।”
পুষ্প ওঠার আগেই ধূসরকে নামতে দেখা গেল। সোজা এসে পিউয়ের মুখোমুখি বসল সে। এ দৃশ্যে আরেক দফা হো*চট খেল সকলে। আমজাদ সিকদার চুপ করে গেলেন। ধূসরকে বসতে দেখে কথা হারিয়ে গেল সবার। মূর্তি বনে রইলেন যেন। রিক্তর খাবার চি*বানো ছাড়া শব্দ নেই এখানে। একে অন্যের দিক জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকাচ্ছে। একজন আরেকজন কে ভ্রুঁ ইশারা করে জানতে চাইছে ঘটনা কী!
ধূসরের খাবার বাড়ার সময় আমজাদ সিকদার বললেন,
” ওকে বড় মাছের টুকরো টা দাও।”
মিনা বেগমের হাত সেখানেই স্থিত হলো। বিরাট বিস্ময় সমেত স্বামীর পানে চাইলেন। ধূসর নির্বিকার। ঘটনার আগামাথা কেউ কিছু বুঝতে পারছেনা। সুমনা বেগম সন্তর্পনে জবা বেগমকে শুধালেন,
” কী হচ্ছে বলোতো সেজো আপা? ভাইজানের হঠাৎ হলো কী?”
জবা বেগম বোঁকার মত দুদিকে মাথা নেড়ে বললেন ” জানিনা রে।”
রুবায়দা বেগম হিসাব কষছেন। ধূসর ব্যাবসায় যাবে এটা কি ভাইজান জানতে পেরেছেন? সেজন্যেই কি ওর প্রতি ভাইজানের সব রা*গ মিটে গেল?
আফতাব সিকদার মিটিমিটি হাসলেন সবার চেহারা দেখে। তখন আনিস কানের পাশে মুখ এনে বললেন,
” মেজো ভাই কিছু বুঝতে পারছো? আমারতো মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে।”
আফতাব মৃদূ হেসে বললেন ” বলছি দাঁড়া ।”
এরপরই তিনি আনন্দ নিয়ে ঘোষণা করলেন,
” একটা সুসংবাদ আছে।’
সকলের মনোনিবেশ ঘুরে গেল। আফতাব,মিনা বেগমকে বললেন,
” আপনাদের ছেলের সুবুদ্ধি হয়েছে ভাবী,সে আগামীকাল থেকে অফিস যাবে বলেছে।”
এটা ঘোষণা ছিল না। ছিল উচ্চশব্দে বিদ্যুৎ চমকানোর। পিউয়ের মাথা চক্ক*র দিল শুনে। প্রত্যেকে কিংকর্তব্যবিমু*ঢ় হয়ে তাকাল ধূসরের দিকে। ভ্রুক্ষেপহীন ছেলেটা সুস্থির ভঙিতে গ্লাসে চুমুক দিয়ে পানি খাচ্ছে। মিনা বেগম চোখ কপালে তুলে বললেন ” সত্যি বলছো?”
আফতাব সিকদার হেসে মাথা নাড়লেন। বললেন,
” ওকেই জিজ্ঞেস করুন। সামনেই তো আছে।”
কিন্তু তার আগেই জবা বেগম হন্তদ*ন্ত ভঙিতে শুধালেন,
” সত্যি ধূসর? তুই অফিস যাবি?”
ধূসর ছোট করে বলল ” হু।”
সকলের ঠোঁটে হাসি ফুঁটল। পিউ লম্বা করে মুক্ত,প্রশান্ত শ্বাস টানল। এবার আর তাদের বিয়েতে আপত্তি করবেন না বাবা। ধূসর ভাই চমৎকার কাজ করেছেন যে! পিউয়ের ইচ্ছে করল ছুটে গিয়েই ধূসরের গালে চটচটে একটা চুমু খেতে। সে লাজুক হেসে বিড়বিড় করল ” আমার ডেইরিমিল্কটাহ, উম্মম্মাহ!’
মিনা বেগম হৈহৈ করে বললেন,
” দেখলেন তো,আমি বলেছিলাম না? সময় হলে ধূসর ঠিক সিদ্ধান্তই নেবে। মিলল তো?”
আমজাদ সিকদার খুশি খুশি কন্ঠে বললেন,
” আমি ভীষণ খুশি হয়েছি ধূসর। এতদিনে আমার কথা রাখছো তুমি। ”
ধূসর কিছু বলল না।
” অবশেষে যে তুমি ব্যাবসায় আসছো,রাজনীতি ছাড়ছো ভেবেই আমি আনন্দিত।”
ধূসরের খেতে থাকা হাতটা থেমে গেল।
” আপনাকে কে বলল চাচ্চু,আমি রাজনীতি ছাড়ছি?”
আমজাদ সিকদার কপাল কোঁচকালেন
” মানে?”
ধূসর সুস্পষ্ট জবাব দিল,
” আমি রাজনীতি কখনও ছাড়ব না। দুটো একিসাথে সামলাব।”
আমজাদ সিকদারের হাসি হাসি চেহারা দপ দপ করে নিভে গেল। একিরকম আশা*হত হলেন আফতাব সিকদার নিজেও। উদ্বেগ নিয়ে বললেন,
” দুটো একসাথে কী করে সামলাবে? ব্যাবসা করা মুখের কথা নয়। দেখা গেল দু নৌকায় পা দিতে গিয়ে সব ডো*বালে।”
” সেটা সময়ই বলে দিক বাবা? এখনি ভবিষ্যতে বানী করে তো লাভ নেই।”
ছেলের অত্যুগ্র উত্তর আফতাবের পছন্দ হয়না। আমজাদ সিকদারের চেহারা থমথ*মে হলেও দ্বিরুক্তি করলেন না। মনে মনে ভাবলেন ‘ আগে তো ব্যাবসায় বসুক,একবার মন বসে গেলে রাজনীতি নিজে থেকেই ছেড়ে দেবে।”
ধূসরের এই সিদ্ধান্তে সবাই পুলকিত হলেও সাদিফের চেহারা ঘুটঘুটে হয়ে আসে অন্ধকারে। খাওয়া মন্থর হয় সেখানেই। বুঝতে বাকী নেই ধূসর ওর ওপর জেদ ধরেই করল এমন। নির্ঘাত কথাটা শুনতে পেয়েছে। অনুশোচনা হলো সাদিফের। ধূসর তার বড় ভাই৷ তাকে ক*ষ্ট দিয়ে কথা বলা ঠিক হয়নি। ক্ষমা চেয়ে নেবে বরং।
তখনই সাদিফের চোখ পড়ল পিউয়ের দিকে। পিউ অভিভূতের ন্যায় ধূসরকে দেখছে। ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে হাসি। পরপর ধূসরের দিকে তাকাল সাদিফ। ধূসর খাচ্ছে। খাওয়ার ফাঁকে আচমকা তাকাল। চোখাচোখি হলো পিউয়ের সহিত। ধূসর হাসল কী না বোঝা গেল না। একটু চেয়ে থেকেই আবার চোখ নামাল সে। সাদিফের অদ্ভূত অনুভব হয়। অস্থির লাগে৷ খাবার মাঝপথে ফেলেই উঠে দাঁড়ায়। প্রশ্ন করলে বলে যায় ” খাওয়া শেষ। ”
চলবে,