#এক_সমুদ্র_প্রেম!
লেখনী: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(০৪)
” তুই?”
এই সামান্য দুই শব্দের বাক্যটা ধূসর ভাই এমন ধ*মকে শুধালেন,আরেকটু হলেই প্রানপাখিটা উড়ে যাচ্ছিল প্রায়। গত তিনবছর ধরে ধূসর ভাইয়ের রামধম*ক খেয়ে পরে বেচে আছি। হিসেব মতো এ আমার কাছে ডালভাত হওয়ার কথা। অথচ প্রতিটা বার আমি ভ*য়ে আড়ষ্ট হই,লাফিয়ে উঠি শ*ঙ্কায়।
এই যেমন এখন হলো! ওনার মুঠোয় থাকা আমার আঙুলটাও থরথরিয়ে কেঁ*পে জানান দিলো আমি ডেঞ্জার জোনে বসে আছি। বাঁচতে হলে পালানো ফরজ। ধূসর ভাই রে*গে গেছেন। এইতো,ওনার চিকন নাক ফুলছে। শুয়ে থেকে উনি আমায় ব*কেঝ*কে আরামবোধ করছেন না হয়ত। উঠে বসতে চাইলেন। কিন্তু আমি কি অত বোকা? যেই মাত্র আঙুলটা শিথিল করে ধরেছেন, ওমনি সুযোগটা লুফে নিলাম আমি। তাৎক্ষণিক ত্রস্ত পায়ে ভো-দৌড় লাগালাম। পেছন থেকে ধূসর ভাই চেঁচিয়ে সাবধান করলেন,
” দাঁড়া পিউ, পালাবিনা বলছি!”
আমি কথা শুনে মেনে নেয়ার পাত্রি নই। ধূসর ভাই আমায় হাতে পেলে খবর করে ছাড়বেন,এই চিন্তা করে দাঁড়িয়ে থাকার মত বেকুব পিউ নয়। এখানে থাকলে উনি যে খুব সমাদর করবেন তাতো অার না। ঠিক যেমন হুটোপুটি করে উঠেছিলাম,তেমন করেই ছুটে নিচে নামতে দেখে আম্মু আর্তনাদ করে বললেন,
” হায় আল্লাহ! এই মেয়ে এমন ছোটাছুটি করে, কোনদিন পরে হাত পা ভাঙবে।”
আমি একেবারে টেবিলের কাছে এসে ব্রেক কষলাম। ত্রস্ত হাতে গ্লাস তুলে চুমুক দিলাম। ঘন শ্বাস নিতে দেখে, সাদিফ ভাই ভ্রু কুঁচকে বললেন,
” এভাবে হাপাচ্ছিস কেন? ভাইয়া ধা*ওয়া টাওয়া করেছিল না কী?”
আপু তাল মিলিয়ে বলল,
” ওর তো কাজই একটা, ধূসর ভাইয়ের ঝাড়ি খাওয়া।”
সবাই হু হা করে হেসে উঠল এতে। যেন ভারী মজার কিছু শুনলো।
ছোট মা বললেন,
” তা আজ কী উল্টোপাল্টা করেছিস আবার? টের তো পেলাম দরজা আ*ছড়ে খুলেছিস,এই নিয়েই না কী?
আমার মুখটা শুকিয়ে এলো। ঠোঁট উলটে ফেললাম ক*ষ্টে। এরা আমার খারাপ সময়ে কী মজাটাই না নিচ্ছে! নিক,এমন একদিন আসবে যখন ধূসর ভাই রসগোল্লার চেয়েও মিষ্টি করে আমার সাথে কথা বলবেন। তখন সবার এই দাঁত কপাটি কোন গাছের মাথায় থাকে দেখব আমিও।
মেজো মা আমার অন্ধকার মুখ দেখে এগিয়ে এলেন কাছে। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
” মন খা*রাপ করিস না। ধূসর তো একটু ওরকমই। তুই ও কেন শুধু শুধু ওকে ডাকতে গেলি!”
এটা কোনও কথা হলো? উনি ওমন বলে আমি ওনার কাছে যাবনা? আমার প্রেম এত ঠুনকো না কী মেজো মা? সামান্য কারনে তোমার ছেলের সঙ্গ ত্যাগ করলে তুমিই তো বলবে, আমার ছেলেটাকে কেউ ভালোবাসেনা। দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। পুত্রবধূ পাল্টাতে চাইবে। আর এই ঝুঁ*কি পিউ নেবে? কদাপি নহে!
সাদিফ ভাই মোলায়েম কণ্ঠে বললেন,
” আয়,খেয়ে নে। মুখ কা*লো করে থাকলে কী লাভ হবে? ”
আমি লম্বা শ্বাস ফেলে ফের সাদিফ ভাইয়ের পাশে গিয়ে বসলাম। আমার খালি প্লেটে উনি যত্ন নিয়ে পরোটা-ভাজি তুলে দিলেন। তারও অনেকক্ষন পরেই ধূসর ভাই ঘর থেকে বের হলেন। এক্কেবারে পরিপাটি হয়ে সিড়ি ভে*ঙে নামলেন। আমি মনের দুঃ*খে খাবার চিবোতে চিবোতে তাকালাম কেবল, ওমনি ফিটফাট ধূসর ভাইকে দেখেই খাবার গলায় আ*টকে গেল । মুখটাকে হা করে চেয়ে রইলাম। নেভি ব্লু শার্ট পরে হাতা গোঁটাতে গোঁটাতে নামছেন উনি। আম্মুর মুখে অনেক বার শুনেছি, নেভি ব্লু রঙটা ফর্সাদের জন্যে। ওদের ভালো মানায়। কিন্তু না, ধূসর ভাইকে দেখে মনে হলো আম্মু সম্পূর্ণ ভুল। ধূসর ভাইকে তো ফাটাফাটি লাগছে। একেবারে আমার স্বপ্নের রাজপুত্রের আপডেট ভার্সন। সাদিফ ভাইয়ের খাওয়া শেষ। তিনি হাত ধুঁতে উঠে গেলেন।
ধূসর ভাই চেয়ার ফাঁকা দেখে আমার পাশেই এসে বসলেন। ওমনি শুরু হলো আমার বুকে ধুকপুক, ধুকপুক শব্দ। ওনার শরীর থেকে আসা, বেলিফুলের ক*ড়া পারফিউমের ঘ্রানে আমার নাসারন্ধ্র উথা*ল-পাতাল শুরু করল। খুশিতে ডগমগ হওয়ার আগেই মাথায় এলো একটু আগের কথা। চট করে অভিব্যক্তি বদলে গেল আমার। সকাল থেকে ধূসর ভাইকে পাশে বসানোর জন্যে ম*রিয়া আমি, এখন যেন কিছুতেই ওনাকে পাশে মেনে নিতে পারলাম না। একটু আগে যা করেছি নির্ঘাত আমার খ*বর আছে!
আত*ঙ্কের কাছে আমার প্রেমানুভূতি ফি*কে হয়ে গেল। চোরের মত মুখ করে খাচ্ছিলাম। ধূসর ভাইকে দেখে পরিবারের চার নারী সদস্যই আগ্রহী হয়ে পরলেন। কী খাবে,কী নেবে, এই নিয়ে হল্লাহল্লি লাগালেন। হঠাৎই ধূসর ভাই আম্মুকে বললেন,
” বড় মা, আমার মনে হয় পিউয়ের পড়াশুনার প্রতি তোমাদের আরো সচেতন হওয়া উচিত। ওর টিউটর কে বলে দেবে প্রয়োজন মতো সব রকম ক*ড়াক*ড়ি দিতে। ”
আমার খাবার তৎক্ষনাৎ বন্ধ হলো। আম্মু বুঝতে না পেরে বললেন,
” কেন রে বাবা,কিছু হয়েছে?”
আমি নিচের দিক চেয়ে চোখ খি*চে ঠোঁট কা*মড়ে ধরলাম। গতকাল আপুর পিঠে তালটা আজ আমার পিঠে পরল বলে। ধূসর ভাই থমথমে কণ্ঠে বললেন,
” ওকে তো আমি বই নিয়ে বসতে দেখিনা। যখনই দেখছি হয় টিভি দেখছে,ফোন টিপছে নাহলে বড়দের মাঝে বসে বসে কথা শুনছে। এরকম করলে পরীক্ষায় রেজাল্ট কীরকম আসবে আন্দাজ করতে পারছো?”
আম্মু হা*হাকার করে বললেন,
” আমি কী করব! ওকি আমার কথা শোনে? সবাই তোল্লায় দিয়ে মাথায় তুলেছে। একমাত্র তুই ছাড়া ওকে শা*সন কেউ করেনা,আর ও নিজেও কারো কথা শোনেনা”
ধূসর ভাই আড়চোখে একবার আমাকে দেখে বললেন,
” এখন কী করতে চাইছো? ”
আম্মু গদগদ হয়ে বললেন,
” তুই ওকে পড়া না বাবা! তুই পড়ালে ওর সব সমস্যা সমাধান হবে আমি নিশ্চিত।”
পাশ থেকে মেজো মা-ও সুর মেলালেন,
” হ্যা রে ধূসর,তুই মেয়েটাকে পড়া। ”
আমি আঁ*তকে উঠলাম। ধূসর ভাই পড়াবেন মানে? পাগল না কি? উনি পড়ানো মানে মা*র একটাও নিচে পরবেনা। সাথে বকাঝকা পাবো ডিসকাউন্টে।
ওনাকে দেখলেই আমার হ্যাং ধরে যাওয়া মাথাতে পড়াশুনা ঢুকবে তখন? চোখের সামনে প্রিয় মানুষ রেখে কেউ পড়া মুখস্থ করতে পারে? যে পারে সে এলিয়েন। আমি ভদ্র- সভ্য মেয়ে। ওসব আমার দ্বারা সম্ভব না।
হাতের মুঠোয় পরোটার টুকরোটা শক্ত করে চেপে ধরলাম। দুদিকে ঘনঘন মাথা নেড়ে বিড়বিড় করলাম,মন প্রান দিয়ে চাইলাম,
” ধূসর ভাই যেন রাজি না হন। প্লিজ প্লিজ প্লিজ!
তারপরপরই ধূসর ভাই গম্ভীর কণ্ঠে ঘোষণা দিলেন,
” আমার সময় হবেনা বড় মা। দেখছো তো কত ব্যস্ত থাকি! পিউয়ের পরীক্ষা দুমাস পরেই। যেমন আছে চলুক। ”
আমি তকতকে চেহারায় তাকালাম। মিইয়ে যাওয়া ঠোঁটে মুহুর্তমধ্যে হাসি ফুঁটল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলাম,
” যাক, ধূসর ভাই পড়াচ্ছেন না।
এরপর আর কেউ কিছু বলেনি। ধূসর ভাইও কিছু বললেন না। একনিষ্ঠ মনে খাচ্ছিলেন। আপুর খাওয়া শেষ, সে উঠে গেল। আমার মনে হলো ধূসর ভাইয়ের পাশে বেশিক্ষন বসে থাকা সুবিধের হবে না। গতকাল কলেজে কান ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম,উনি সেই ভিত্তিতেই যে কথাগুলো বললেন বেশ বুঝেছি। এরপর আর কী কী বলবেন তার কোনও ঠিক নেই। আমার কীর্তিকলাপের তো আর শেষ নেই!
আমি তাড়াহুড়ো করে খাওয়া শেষ করলাম। আম্মু,চাচিরা থাকতেই উঠে যাব,তাহলে আর বি*পদের আ*শঙ্কা নেই।
কিন্তু না। খাওয়া শেষ করেও উঠতে আর পারলাম না। আমি যে একরকম পালাচ্ছি,ঠিক বুঝতে পেরেছেন ধূসর ভাই। কী চতুর লোক! সেই মুহুর্তে টেবিলের নিচ থেকে আমার বাম হাতটা চে*পে ধরলেন উনি। আমি বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে তাকালাম। ভী*ত দৃষ্টি হয়ে এলো মারবেলের মতন।
ধূসর ভাই আমার দিকে একবারও না দেখে আম্মুদের উদ্দেশ্যে বললেন,
” তোমরা দাঁড়িয়ে থেকোনা। আমি নিজের মতো নিয়ে নিচ্ছি খাবার। যাও,কোনও কাজ থাকলে করো।”
ওনার সুন্দর -সাবলীল কথাটা মেনে নিলেন সকলে। ছোট মা রিক্তকে মুখ ধোঁয়াতে বেসিনে নিয়ে চললেন। পাঁকামো করে খেতে গিয়ে সব গায়ে মাখিয়েছে সে। সেজো মা ঘরে গিয়েছেন আরো আগে। মেজো মা আর আম্মু বাকী এঁটো থালাবাসন গুছিয়ে রান্নাঘরে ছুটলেন। পুরো টেবিলটায় বসে রইলাম আমি আর ধূসর ভাই। গোটা ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটল আমি না পারলাম কিছু বলতে,না কিছু করতে। প্রবল বেগে ভ*য়ড*র এসে গলা চে*পে ধরল। মিনমিন করে খাচ্ছিলাম,সেটাই যেন কাল হলো এখন। ধূসর ভাই চুপচাপ। এটাই যে ঝ*ড়ের পূর্বাভাস। আমার মন কু গাইছে।
কী করবেন ধূসর ভাই?
আমার গভীর ভাবনার মধ্যেই ধূসর ভাই একটা হকচকিয়ে দেয়া কান্ড ঘটালেন। অকষাৎ হা*মলা চালিয়ে বাম কানটা টেনে ধরলেন আমার। এতই জোরে ধরলেন যে মনে হলো ছি*ড়ে না ফেলা অবধি থামবেন না উনি। অতর্কিত আক্র*মনে ভড়কে তো গেলামই ব্যা*থায় রীতিমতো মুখ বিকৃত করে ফেললাম।
” আ ব্যা*থা পাচ্ছি ধূসর ভাই…..ব্যা*থা পাচ্ছি তো….
আমার আ*র্তনাদে ওনার মন গললনা। উলটে শ*ক্ত কণ্ঠে বললেন,
” আর করবি?”
আমি অসহায় চোখে তাকালাম। আগেপিছে না ভেবেই জো*রে- জো*রে মাথা নেড়ে বললাম,
” আর করবনা। কোনওদিন না। আমার দোহাই আপনাকে,কানটা ছাড়ুন। একটা কান না থাকলে বিয়ে হবেনা। ”
ধূসর ভাই দয়া দেখালেন। ছেড়ে দিতেই আমি ব্যস্ত হাতে চে*পে ধরলাম কান। কীভাবে ধরেছে বাবা! আমি কান ডলতে ডলতে কাঁ*দোকাঁ*দো কণ্ঠে বললাম,
” এভাবে কেউ কান মলে ধূসর ভাই? এখন যদি কানে আর না শুনি? ব্যা*থায় রাতে যদি জ্বর আসে? কাল যদি কলেজে না যেতে পারি? পড়তে না পেরে যদি পরীক্ষায় ফেল করি, দোষ কিন্তু আপনার। ”
ধূসর ভাই নাক মুখ কোঁচকালেন।
দাঁত চিবিয়ে বললেন, ” টেনে একটা থা*প্পড় দিলেই সব সেড়ে যাবে।”
আমি ঠোঁট উলটে চুপ করে গেলাম। তখনও সমানে কান ডলছি। ধূসর ভাইয়ের ছোট ছোট চোখ আমাতেই নিবদ্ধ। পরপর সামনে চেয়ে বললেন,
” রাতে কি নে*শা করে ঘুমাস?”
অযৌক্তিক একটা প্রশ্ন না? ধূসর ভাইয়ের মত মানুষের মুখে এরকম কিছু শুনে আমি অবাক হয়ে বললাম,
” ওমা,আমি নে*শা করব কোন দুঃ*খে?”
ধূসর ভাই তাকালেন। বড় শীতল সেই দৃষ্টি। আমি সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে আনলাম নিচে। ও চোখে বেশিক্ষন চেয়ে থাকলেই যেন মৃ*ত্যু দেখি নিজের। উনি বললেন,
” আমার মনে হয় তোর মাথায় আজকাল স*মস্যা দেখা দিচ্ছে। চাচ্চু ফিরলে বলব তোকে ভালো দেখে একটা এসাইলোমে দিয়ে আসতে।”
না চাইতেও তাকালাম আবার। প্রচন্ড কৌতুহলি হয়ে বললাম,
” কেন? কী করেছি আমি?”
ধূসর ভাই একটু চুপ থেকে বললেন,
” ভুলভাল জায়গায় পাগলামো করছিস।”
আমি না বুঝে ভ্রু কুঁঞ্চিত করলাম। ধূসর ভাই আরেকদিক চেয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বড় করে নিঃশ্বাস ফেললেন। চোখা চোখে ফিরলেন আবার। অকষাৎ আমার মুখের দিকে ঝুঁকে এলেন। একদম চোখের দিকে চেয়ে শুধালেন,
” তুই কি বোঁকা পিউ? যে সময়টায় তোর পৃথিবী রঙে রঙে রাঙানো উচিত, সে সময়ে বর্নহীন রঙের প্রতি তোর কেন এত আকর্ষন? ”
ক*ঠিন ক*ঠিন কথাগুলো অর্থ বুঝে উঠতে পারিনি। সব আমার মাথার ওপর দিয়ে গেল। অথচ আমি বিন্দুমাত্র আগ্রহও দেখালাম না মানে বোঝার।
উলটে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম ধূসর ভাইয়ের চোখদুটোর দিকে। আমার মনে প্রশ্ন জাগল,
” এই নেত্রদ্বয় আমায় দেখে সম্মোহিত হয়েছে কোনও দিন?”
এক তরফা প্রশ্নের জবাব কখনও আসেনা। সে দোনামনা করে লতিয়ে পরে মাটিতে। কিন্তু এই যে ধূসর ভাই আমার এতটা কাছে,এতেই যেন এলোমেলো হয়ে গেলাম আমি। মুখ ফুঁটে শব্দ বের হলোনা। হারিয়ে গেল কথার স্রোত। উনি খানিকক্ষন সুস্থির বনে তাকিয়ে থাকলেন। সেই দৃষ্টি দুর্বোধ্য। তারপর, প্রগাঢ় কণ্ঠে আওড়ালেন,
” তোকে যেন আর আমার রুমের ধারে-কাছে না দেখি।”
আমার মোহিত মুখভঙ্গি সেই ক্ষনে পালটে গেল। ধূসর ভাই হাজার রে*গে কথা বললেও এতটা খা*রাপ লাগেনি। অথচ এখন আঁধারে আঁধারে ভরে গেল ভেতরটা। ধূসর ভাই ভ্রুক্ষেপই দেখালেন না। খাবার মাঝপথে ফেলেই চলে গেলেন নিজের মতোন। আমি থম মেরে বসে রইলাম সেখানেই। অনুরাগী দৃষ্টিতে ধূসর ভাইয়ের যাওয়ার দিকে তাকালাম। ঠিক তক্ষুনি সাদিফ ভাই ওনার ঘর থেকে হাঁক ছাড়লেন,
” এই পিউ, এদিকে আয়তো!”
ওমনি ধূসর ভাইয়ের পা জোড়া থেমে গেল। আমি পরিষ্কার দেখলাম ওনাকে থমকাতে। সেকেন্ডের কম সময়েও আবার হাঁটা ধরলেন উনি। লম্বা কদমে বেরিয়ে গেলেন সদর দরজা হতে। উনি যাওয়া মাত্রই আমি মুখ ভেঙচালাম। নিজে নিজে বললাম,
” বললেই হলো? একশবার যাব। আজ বাদে কাল যে ঘর আমার হবে, সে ঘরে আপনি যেতে বারন করার কে?”
শব্দ করে প্লেট টাকে টেবিলের ওপর রেখে হেলেদুলে চললাম সাদিফ ভাইয়ের রুমে। এই লোকটার আরেক নাম জ্বা*লাতন। ওনার মা আছেন,এত গুলো চাচী আছে,পুষ্প আপু আছে। এরপরেও কাজের জন্যে আমাকেই চাই?
_______
তখন বিকেল। শীতের প্রকোপে সূর্যের নরম তেজ প্রকৃতিতে। একটু পরেই সন্ধ্যে হবে হবে ভাব। কুয়াশাও ছড়িয়েছে বেশ। আর আজ ঠিক, টানা সাতদিন পর বাবা ফিরলেন । এ নিয়ে সকাল থেকে হৈ-হুল্লোড় লেগে আছে। আমরা প্রত্যেকে অপেক্ষা করছিলাম বাবার আগমনের জন্যে। স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি সব ছেড়েছুড়ে রয়ে গেছিলাম বাড়িতে। বাবার আসার কথা তিনদিনের মাথায়। অথচ সব ঝা*মেলা ঝ*ক্কি পুহিয়ে ফিরলেন দেরি করে। ওনার পৌঁছাতে পৌঁছাতে মাগরিবের আজান দিলো।
সাথে আমাদের সবার জন্যে চিটাগং থেকে দুহাত ভরে জিনিসপত্র এনেছেন । বাদ পরেনি বুয়াও।
বাবা আমাদের পরিবারের সব থেকে ববয়ঃজ্যোষ্ঠ বলে সন্মানেও সবার শীর্ষে। আমরা প্রত্যেকে তাকে ভ*য় পাই,সমঝে চলি। ওনার অনুমতি না পেলে ঘরের বাইরে পা রাখাও চলবেনা। শুধু ওই একজনই রয়ে গেলেন নিয়মের বাইরে।
কিন্তু আজ যেন বাবা একদম নরম মাটির মত। এসে প্রত্যেককে আদর করছেন, চুঁমু দিচ্ছেন। ড্রয়িংরুমের কোথাও আমি ছিলাম না বলে বাবা আমার নাম ধরে জোরে জোরে ডাকলেন। আওয়াজ পেতেই আমি দৌড়ে নামলাম।
বাবাও একইরকম সতর্ক বানী দিলেন,
” আস্তে আস্তে পরে যাবে তো।”
বাবার মুখের ঝকঝকে হাসি,এক সোফা ভর্তি জিনিসপত্র। সেগুলোকে দেখিয়ে বলতে গেলেন,
” এই দেখো, তোমার জন্যে ___
কিন্তু সম্পূর্ণ করতে পারলেন না। এর আগেই আমি ছুটে গিয়েই আছড়ে পরলাম বুকে। জোরেশোরে কেঁ*দে ফেললাম। সাতদিন পর বাবাকে চোখের সামনে দেখে আমার অশ্রু আপনা-আপনি বেরিয়ে এলো। মানুষটা সবাইকে শা*সন, বা*রনে তটস্থ রাখলেও আমায় এক ফোঁ*টা ব*কেননা। এ নিয়ে আপু হাজারটা অভিযোগ করলেও বাবার এক কথা,
” ওতো ব*কার মত কিছুই করেনা!”
তবুও আমি বাবাকে ভয় পাই,ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি।
আমার কান্নার শব্দ বাড়ছে। ধূসর ভাইকে ভালোবাসা বোঝাতে না পারার ব্যর্থতাও হয়ত এই সময় উ*গড়ে আসছে। আমার কান্না দেখে বাকিরা হতভম্ব হলো। ভ্যাবাচেকা খেয়ে চেয়ে রইল। শুধু বাবা মুচকি হেসে মাথায় চুঁমু দিলেন। আদুরে কণ্ঠে বললেন,
” আমার আম্মাটা মনে হয় আমাকে একটু বেশিই মিস করেছে তাইনা?”
পাশ থেকে আপু ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
” ও একা না আব্বু,আমিও কিন্তু করেছি।”
বাবা কিছু বলার আগেই রাদিফ বড়দের মত করে জবাব দিল,
” কিন্তু তুমিতো কাঁদছোনা। আগে তুমিও পিউপুর মত করে কেঁদে দেখাও,তাহলেই না বড় চাচ্চু বুঝবেন। ”
সবাই খিলখিল করে হেসে ওঠে। হেসে ফেললাম আমিও। আপু চোখ পাঁকিয়ে রাদিফের দিক তাকাল। কিন্তু বাচ্চা ছেলেটা তোয়াক্কাই করল না যেন। উলটে ওর জন্যে বাবার আনা জামাকাপড় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরল।
সাদিফ ভাই অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরলেন। মূলত বাবা আসবেন জেনেই। উনি এক কাঠি ওপরে গিয়ে, এসেই বাবার পা ছুঁয়ে সালাম করলেন। সাথে অমায়িক হেসে শুধালেন,
” কেমন আছেন চাচ্চু? শরির ভালো আছে?”
এরুপ শ্রদ্ধা,সাদুবাদ দেখে বাবা পুলকিত হয়ে বললেন,
” খুব ভালো আছি বাবা। এতদিন পর তোদের সবাইকে দেখলাম,ভালো না থেকে পারি? তা তোর অফিসের কী খবর? কাজ বাজ যাচ্ছে কেমন ? চাপ হচ্ছেনা?”
” না না,সামলে নিচ্ছি আমি।”
বলতে বলতে সাদিফ ভাই আমার দিকে তাকালেন। হাত ইশারা করে বোঝালেন,
” পানি দিতে।”
আমি পানি আনতে এগোলাম। রোজকার চাকরি। শুধু সাদিফ ভাই নন,আজ মেজো চাচ্চু, ছোট চাচ্চু সবাই আগেভাগে একে একে বাড়ি ফিরেছেন। আস্তেধীরে জমজমাট হলো ওনাদের আড্ডা। গল্পে এতই মজে গেলেন যে কারোর ক্লান্তিবোধই বিশেষ সুবিধে করতে পারলোনা। আম্মু, মেজো মা, সেজো মা প্রত্যেকে বাবাকে কতবার বললেন ” আগে একটু বিশ্রাম করতে। গল্প না হয় পরে হতো।”
না,বাবা আমারই মতো কথা শোনার পাত্র নন। তিনি খোশগল্পে মশগুল হয়ে গেলেন, সাথে বাকিরাও। ছোট মা চা বানিয়ে দিয়ে গেলেন তন্মধ্যে। এতে যেন ষোলকলা পূর্ন হলো আরও।
কথায় কথায় বাবা হঠাৎই মেজো চাচ্চুকে জিজ্ঞেস করলেন,
” তোর ছেলে কোথায়?”
মেজো চাচ্চুর হাসিহাসি মুখটা দপ করে নিভে গেল। শান্তশিষ্ট মানুষটা একবার মেজো মার দিক তাকালেন। সেও সহায়হীন চোখে চেয়ে। ছেলের সঠিক হদিস তারা কেউই জানেন না । বাবা বুঝে নিলেন। দুদিকে মাথা নেড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
ছোট চাচ্চু ও মন খা*রাপ করে বললেন,
” ধূসরকে নিয়ে আশার আলো একদমই দেখছিনা।”
আমার মুখটা বিরক্তিতে তেঁতো হয়ে উঠল। ধূসর ভাইয়ের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে এক দফা আলাপ চলবে এখন।
ওনারা কেন যে এরকম বলে! এমন তো নয় যে ধূসর ভাই বসে বসে খাচ্ছেন,ঘুরেফিরে বাপের টাকা ন*ষ্ট করছেন। চলছেন তো সম্পূর্ন নিজের খরচে। তাহলে ওনার মনমর্জি মোতাবেক চলুক না। আর সব থেকে বড় কথা এই যে আমি,ওনার বউ হব,সেতো মেনে নিচ্ছি সব। তাহলে বাকীরা এরকম করে কেন?
সেজো চাচ্চু, মানে সাদিফ ভাইয়ের বাবা একজন ফরেস্ট অফিসার। আপাতত রাঙামাটিতে বদলি উনি। সরকারি লম্বা ছুটি ব্যাতীত বাড়ি আসা হয়না। তবে সেজো মা রাদিফ কে নিয়ে ঘুরেফিরে আসেন মাঝেমধ্যে। তাই আজকেও সবার মধ্যে সেজো চাচ্চুই মিসিং। থাকলে ভালো হতো। বাড়িটা ভরে যেত একদম। আমার হবু শ্বশুর মশাই একা আসেননি বাড়িতে, হাত ভরে বাজার বয়ে এনেছিলেন। সাথে আম্মুর হাতে দিতে দিতে বলেছিলেন,
” প্রত্যেকটা আইটেম রাধবেন ভাবি। যাতে হাত চেটেপুটে খেলেও পেট না ভরে। আজ সবাই কব্জি ডুবিয়ে খাব কিন্তু ।”
আম্মু মৃদূ হেসে বললেন
” দেখব কত খেতে পারো!
আম্মু রান্নাঘরে। সাথে তার সেনাবাহিনীরা,মানে আমার চাচী গোষ্ঠি।
আপাতত বসার ঘরে আমরা,আর বাড়ির পুরুষরা। আমরা অবশ্য ওনাদের আলাপে নয়,আছি নিজেদের ব্যস্ততায়। বাবা কী কী কার জন্যে আনলেন সেসব নিয়েই চলছে তদারকি। একেকটা প্যাকেটের পিন,স্কচটেপ খোলার দায়িত্ব পরেছে আমারই কাঁধে। আমার দুপাশে রাদিফ আর আপু। তার উৎকন্ঠিত ভেতরের জিনিসপত্র দেখতে। ঠিক তখনি রিক্ত কুটিকুটি পায়ে সদর দরজা হতে ছুটতে ছুটতে এলো। স্লোগান দিতে দিতে বলল,
” বলো ভাইয়া গা*লি কিনেছে,বলো ভাইয়া গা*লি কিনেছে।”
সবার উৎসুক চাউনী নি*ক্ষেপ হলো বাচ্চা ছেলেটার ওপর। আমি চোখ পিটপিট করলাম। গা*লি কীভাবে কেনে ? রিক্ত বেশ কয়েকবার আওড়ানোর পর বুঝলাম ওটা আসলে গাড়ি। বলো ভাইয়া মানে তো ধূসর ভাই।ধূসর ভাই গাড়ি কিনেছেন?
কথাটা শুনেই সব কাজ স্থগিত। আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম। আম্মুরা রান্নাঘর ছেড়ে বের হলেন। দ্রত এগোলেন রিক্তর কথার রহস্য উদঘাটন করতে। কারন ধূসর ভাইয়ের গাড়ি আগে থেকেই আছে। উনি আবার একটা গাড়ি কিনে কী মাথায় রাখবেন?
বাবা আসার পর গড়ে ওঠা রমরমে পরিবেশ টা পেছনে ফেলেই আমরা প্রত্যেকে এগোলাম গেটের দিকে। এমনকি সাদিফ ভাই,ছোট চাচ্চুও।
দরজা অবধি এসে দেখলাম,
ধুসর ভাই দাঁড়িয়ে, পাশে একটা অচেনা লোক, তার পাশে আমাদের দারোয়ান। ওনাদের তিনজনের মাঝখানে ঠেস দিয়ে দাঁড় করা একটি চকচকে কালো রঙের বাইক।
দারোয়ান চাচা হা-হু*তাশ করছেন কিছু নিয়ে। দুদিকে মাথা নেড়ে ক্রমশ বিড়বিড় করছেন। মেজো মা অবাক হয়ে বললেন,
” কী রে ধূসর,হঠাৎ বাইক কিনলি যে?”
ওনার আগেই দারোয়ান চাচা হৈহৈ করে বললেন,
“আপনার পোলা পা*গল হইয়া গেছে। নাইলে কেউ গাড়ি বেইচা হুন্ডা কেনে কন?”
আমি চমকে গেলাম। একইরকম তাজ্জব হলো বাকিরাও। শুধু ধূসর ভাই নিরুদ্বেগ। বাইকের হেলমেট হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছেন। সেজো মা বিস্ময় নিয়ে বললেন,
” ওমা, সে কী কথা? গাড়ি কেন বেঁচেছিস? কত শখ করে কিনেছিলি!”
আমাদের আশ্চর্যজনক চাউনী ধূসর ভাই বিশেষ পাত্তা দিলেন না। ধীর কণ্ঠে ভাবলেশহীন জবাব দিলেন,
” আজকাল গাড়ির থেকে বাইক ভালো লাগছে, তাই।”
চলবে,