এক শহর প্রেম_২ পর্ব-৪৪+৪৫+৪৬

0
58

#copyrightalert❌🚫
#এক_শহর_প্রেম_২
লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪৪
মারসাদ তার বাবার সাথে বাড়ির লনে বসে আছে। এখন সন্ধ্যা। অফিস করেই সেখান থেকে বাইকে করে কুমিল্লা চলে গেছে সে। আরশাদ খান বলে,
“কী বলতে তুমি ছুটে এসেছে? যা ফোনে বলা যায় না!”

মারসাদ হাসে৷ তারপর টেবিল থেকে কফির মগ তুলে নিয়ে বলল,
“বলছি৷ সময় তো আছেই।”

ছেলেকে এতো শান্ত কণ্ঠে কথা বলতে শুনে আরশাদ খান চিন্তিত হলেন। তিনি শুধালেন,
“তুমি হেয়ালি করছো মানে তুমি খুব ফুরফুরে মেজাজে আছো।”

“অ্যাবসুলেটলি রাইট, বাবা। তুমি সবসময় আমাকে একদম সঠিক বুঝো। ইয়াং এইজে তুমি আমার মতোই ছিলে কী না! কিন্তু এখন অনেক বদলে গেছো। আমার মধ্যে নিজের রিফ্লেকশনই তোমার পছন্দ হচ্ছে না।”

আরশাদ খান দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন। তারপর বললেন,
“বাবা হলে বুঝবে।”

“আমার বুঝতে হবে না। বরং তুমি বুঝো! সামিরাকে তো তুমি খুব ভালো মেয়ে মনে করো। সেই ভালো মেয়ের কীর্তিকলাপ জানবে না?”

ভ্রঁ কুঁচকে এলো আরশাদ খানের।
“কী বলতে চাইছ?”

তারপর মারসাদ কল রেকর্ড শোনায়। নাম্বারটা যে সামিরার নামে রেজিস্ট্রেশন করা, সেটাও দেখায়। সব দেখে ও শুনে আরশাদ খান হতবাক। তিনি বাকরুদ্ধ। মারসাদ বলে,
“আমি পু*লিশের কাছে এগুলো পাঠানোর ব্যবস্থা করে এসেছি। এতক্ষণে হয়তো পু*লিশ সামিরাদের বাড়িতে চলেও গেছে!”

আরশাদ খান কোনো প্রতিক্রিয়া করলেন না। তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে গেলেন। মারসাদও উঠে বাড়ির ভেতরে যায়। মিসেস মীরা মারসাদকে দেখা মাত্রই ছুটো এলেন। তিনি এতক্ষণ বাবা-ছেলের কথোপকথন শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছিলেন। এখন উৎকণ্ঠিত হয়ে ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন,

“কী কথা বললি তোর বাবার সাথে? আর তোর বাবা এত শান্তভাবে রুমে চলে গেলেন যে।”

মারসাদ তার মাকে সোফাতে বসিয়ে বলে,
“একটু পর তোমার বোনের ফোন তোমার কাছে আসবে। সো বি প্রিপেয়ার।”

বলেই মারসাদ চলে যাচ্ছে। মিসেস মীরা ডাকলেন,
“অন্তত খেয়ে যা।”

“তোমার মেয়ে তো ওখানে একা। তাছাড়া আমার যাওয়াটা জরুরী।”

“কী হয়েছে বল না? তোর আন্টি কল দিবে কেন?”

মিসেস মীরা মারসাদকে এই প্রশ্ন করতে করতেই উনার ফোন বেজে উঠলো। সামিরার মা কল করেছে। মিসেস মীরা কল রিসিভ করে। ফোনের অপর পাশে সামিরার মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন,

“মীরা, তোর ছেলেকে বল আমার মেয়ের নামে কে*স তুলে নিতে। ও-কে পু*লিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে।”

মিসেস মীরা হতভম্ব হয়ে গেলেন। তিনি মারসাদের দিকে তাকালেন। মারসাদ বাঁকা হাসছে। ফোনের অপরপাশ থেকে সামিরার চিৎকার ও ভাঙচুরের শব্দও আসছে। মিসেস মীরা শুধালেন,
“পুলিশ কেন সামিরাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে? কী করেছে ও?”

“আমার মেয়ে যা করেছে তোর ছেলেকে ভালোবেসে করেছে। ওর দোষ ছিল কিন্তু ও বুঝতে পারেনি। খুব জেদি মেয়ে আমার। জেদ, রাগের বশে করে ফেলেছে। আমার মেয়ের হয়ে আমি কথা দিচ্ছি, ও আর কখনো তোর ছেলের আশেপাশেও আসবে না। শুধু কে*সটা তুলে নিতে বল। ও-কে আমরা অনেক দূরে পাঠিয়ে দেবো।”

মিসেস মীরা কি বলবেন বুঝতে পারছেন না। মারসাদ তার মায়ের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে সামিরার মাকে বলল,
“আন্টি, আপনার স্বামীর তো অনেক টাকা। আপনার মেয়ে সেই টাকার অপব্যবহার করে অন্যের ক্ষতি করতে চেয়েছে। তাহলে সেই টাকা দিয়েই না হয় আপনার মেয়েকে ছাড়িয়ে আনুন।”

সামিরার মা এবার মারসাদের কাছে আকুতি-মিনতি করছেন।
“মারসাদ প্লিজ। তোমার আন্টির উপর দয়া করো প্লিজ। সামিরার আব্বু দেশে নেই। তার উপর তিনি যদি জানতে পারেন, তাহলে মেয়েকে তিনি মে*রেই ফেলবেন।”

মারসাদ খানিক ভাবে। তারপর বলে,
“কিন্তু আন্টি, আমি তো আংকেলকে সব মেইল করে দিয়েছি। আর সেটা অনেকক্ষণ আগেই করেছি। এতক্ষণে নিশ্চয়ই দেখে ফেলেছেন।”

সামিরার মা আঁৎকে উঠলেন। মারসাদ আরও বলল,
“আমি অবাক হচ্ছি, আপনি এখনো আপনার মেয়ের হয়ে ডিফেন্ড করছেন? আপনার মেয়ে টাকা ছড়িয়ে আরেকটা মেয়ের সবচেয়ে বড় সর্ব*না*শ করতে চেয়েছে। সেই সত্য যাতে ফাঁস যাতে না হয় তার জন্য সে ক্রি*মিনা*লদের জামিনও করিয়েছে। তাহলে কি আপনি আপনার মেয়ের এসব কাজে সাপোর্ট করছেন?”

সামিরার মা কাঁদতে কাঁদতে জবাব দিলেন,
“না, বাবা। আমি আমার মেয়ের এসব কাজ সাপোর্ট করছি না। কিন্তু কী করবো বলো? আমার একমাত্র মেয়ে।”

“আপনারাই ও-কে বেশি আদর দিয়ে বিগড়ে দিয়েছেন। সি নিডস ট্রিটমেন্ট। পু*লিশকে পু*লিশের কাজ করতে দিন। তারপর নাহয় টাকা দিয়ে জামিন করাবেন! কিন্তু আমি কে*স উইথড্র করব না। রাখছি।”

মারসাদ কল কেটে মিসেস মীরার হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

——–
পরদিন ভার্সিটিতে সবাই সামিরাকে নিয়ে চর্চা করছে। আদিরা খবরটা শুনে মাহিকে জিজ্ঞাসা করে। এরপর মাহি আদিরাকে সব বলে ও কল রেকর্ড শোনায়। আদিরা যখন সামিরার কল রেকর্ড শুনেছে, আদিরা পুরো থমকে গেছে। মাহি, সাবিহা, রিন্তি ও-কে সাহস দিচ্ছে। মাহি বলে,
“সামিরা আপু এতো জঘন্য কাজ করতে পারে সেটা আমি ভাবতেও পারিনি। এরপরও শাহানা আন্টি আমাকে বারবার ফোন করছে, যেন আমি দাভাই ও তোকে বুঝাই!”

কিছুক্ষণ পর আদিরা ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। মলিন স্বরে বলে,
“টাকা দিয়েই তবে নিজের মেয়েকে মুক্ত করুক। আমি এইবার তাকে ক্ষমা করতে পারব না। কোনোভাবেই না।”

তারপর সে সেখান থেকে চলে যাচ্ছে। রিন্তি ও-কে ডাকলে মাহি বাধা দেয়। তারপর হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
“ডাকিস না। ও কে একটু একা থাকতে দে। ও নিজেকে সামলে নিবে।”

তারপর রিন্তি আর আদিরাকে ডাকে না।

আদিরা থানায় যায়। সেখানে গিয়ে সামিরার সাথে দেখা করে। সামিরা আদিরাকে দেখেই রেগে যায়। আদিরা কিয়ৎক্ষণ সামিরাকে পর্যবেক্ষণ করে তাচ্ছিল্য হাসে। আর বলে,

“এতো রাগ? একটা মা’নুষ আরেকটা মানু’ষকে এতোটা অপছন্দ করে যে তাকে নিয়ে এরকম জঘন্য প্ল্যানিং করে! মেয়ে তো তুমিও। মেয়েদের সম্মান মেয়েদের কাছে সবচেয়ে প্রিয়। তোমার সাথে এমনটা হলে কী করতে?”

সামিরা উচ্চস্বরে হেসে উঠে। তারপর জে*লের গ্রিল শক্ত করে ধরে হিসহিসিয়ে বলে,
“তাহলে সরে যেতি তো আমাদের জীবন থেকে। তোকে সহ্য করতে হতো না। তোর মতো মেয়ের আবার সম্মান আছে নাকি? তোরা পারিস বড়ো ঘরের ছেলেদের নিজেদের ফে’ক ন্যা*কা-মোতে ফাঁসাতে। তোকে দেখলেই আমার ঘৃ-ণা হয়৷ রা-গ লাগে। মনে হয় নিজ হাতে খু*ন ক’রি।”

আদিরা নির্নিমেষ চেয়ে রইল। সামিরা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ফ্লোরে বসলো। আদিরা কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থেকে বলল,
“আমাদের বিয়ের খবরটা আমি ও মারসাদ নিজে এসে তোমাকে দিয়ে যাব!”

সামিরা চমকায়। সে চট করে উঠে দাঁড়ায়৷ আবার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,
“তুই! তুই! আমার মারসাদ বেবিকে বিয়ে করতে পারবি না। আমাদের এনগেজমেন্ট হবে কিছুদিন পর।”

আদিরা নির্বিকার৷ সে আবারও বলে,
“আর যদি তুমি জা*মিনে ছাড়া পেয়ে যাও তবে তোমার বাড়িতে গিয়ে বলে আসব বা ফোনেই বলব। ততোদিন তুমি অপেক্ষা করো। আর নিজের মানসিক অবস্থার ট্রিটমেন্ট করাও।”

সামিরা এসব সহ্য করতে পারছে না। সে পা’*গলের মতো করছে। আদিরা আর কালক্ষেপণ না করে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে।

চলবে ইন শা আল্লাহ,

#copyrightalert❌🚫
#এক_শহর_প্রেম_২
লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪৫
মাসখানেক পেরিয়ে গেছে। সামিরার বাবা দেশে এসে সামিরার জামিন করান। তারপর মেয়েকে সাইক্রিয়াটিস্ট দেখান। এখন সামিরা চুপচাপ থাকে। নিজের রুমে একা সারাক্ষণ ঘুম ও বারান্দায় বসে থাকা এভাবেই দিন কাটছে। আরশাদ খান ও মিসেস মীরা এসে সামিরাকে দেখে গেছেন। সামিরার বাবা-মা উনাদের কাছে মাফও চেয়েছেন। এখন উনারা আদিরার কাছে মাফ চাইতে চান।

এদিকে আদিরা নিয়মিত ক্লাস করে। ক্যাম্পাসে এখন কেউ তাকে কটু কথা শোনায় না। তার মনে হচ্ছে এতোদিন পর ক্যাম্পাসটা তার জন্য সুন্দর হয়েছে। আজ বিকেলে মারসাদের বাবা-মায়ের সাথে তার দেখা করার কথা। আদিরা খুব নার্ভাস। কাল আবার তার বাবা-মা চট্টগ্রামে আসবেন। দুই পরিবারের মধ্যে কথা হবে। সবকিছু যেন খুব দ্রুত হচ্ছে। আজকে যে আদিরা মারসাদের বাবা-মায়ের সাথে দেখা করবে, সেটা মারসাদ জানে না। তাই আদিরা আরও বেশি চিন্তিত। সকাল থেকে ক্যাম্পাসে আদিরা কেমন উঁশখুশ করছে। মাহি, সাবিহাদের সাথে বসেও যেন তার মন নেই। এদিকে মারসাদের আজ ওভারটাইম পড়েছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত ডিউটি। তার আগেই সে মারসাদের বাবা-মায়ের সাথে দেখা করবে। আদিরা জানে মারসাদের বাবা আদিরাকে তেমন পছন্দ করেন না। এখন উনি কী বলবেন, তা নিয়ে আদিরা চিন্তিত। মাহি, সাবিহা, রিন্তি অনেকক্ষণ যাবত আদিরাকে লক্ষ্য করছে। মেয়েটার খাওয়াতেও মন নেই। সাবিহা জিজ্ঞাসা করে,

“এতো কি চিন্তা করছিসরে, আদু?”

আদিরা হাসার চেষ্টা করলো। অতঃপর বলল,
“তেমন কিছু না।”

মাহি টেবিলে দুই হাতের কনুই ঠেকিয়ে গালে হাত দিয়ে বলল,
“যতোই বলিস তুই কিছু চিন্তা করছিস না। কিন্তু আমি জানি, সকাল থেকে তুই বাবাকে নিয়েই চিন্তা করে ম*রছিস! যে বাবা কি বলবেন? বাবা রেগে যাবে কি না?”

আদিরার মুখপা চুপসে গেলো। মাহি ওর দুই গাল হালকা করে টেনে দিয়ে বলে,
“রিল্যাক্স। আমার বাবা ভি*লেন না। মাঝ দিয়ে একটু আরকি… তিনি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন। তাছাড়া সামিরা আপুর সাথে দাভাইয়ের বিয়ের কথা আরও আগে থেকেই চলছিল। বাবা তো আর জানতো না, সামিরা আপু এরকম! তাই এতো ভাবিস না। কালকে আঙ্কেল-আন্টির সাথে দেখা করার আগে বাবা তোর সাথে কথা বলতে চায়।”

আদিরা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,
“এমনও হতে পারে আঙ্কেলের সত্যি সত্যি আমাকে পছন্দ না!”

“এমন কিছুই না।”

“আমার ভয় করছে।”

মাহি এবার উঠে দাঁড়ালো। তারপর বলল,
“আচ্ছা ভয় পেতে থাক। চারটার দিকে আমাকে কল করবি, একসাথে বাসায় যাব। বায়!”

এই বলে মাহি হাঁটা ধরলো। সাবিহা ও রিন্তি অবাক হয়ে গেল তাতে। রিন্তি শুধায়,
“তুই কই যাচ্ছিস এখন?”

“আহনাফের কাছে৷ উনার থেকে ট্রিট পাই আমি। টাটা।”

তারপর মাহি চলে গেলো। সাবিহা হতাশ হয়ে বলল,
“ট্রিট যেহেতু পায়, আমাদেরকে নিয়ে গেলে কি হতো? কিন্তু তা না করে এই ডিপ্রেসড আদুকেও আমাদের কাছে দিয়ে গেল!”

আদিরা রাগ করে বলে,
“তাহলে তোরা থাক। আমি লাইব্রেরিতে যাচ্ছি।”

আদিরা উঠতে নিলে সাবিহা ও রিন্তি ওর হাত চেপে ধরে। আর বলে,
“থাক। আমরাও যাব চল।”

তারপর ওরা ওর সাথে লাইব্রেরির দিকে যায়।

——–

আরশাদ খান ও মিসেস মীরার সামনে বসে আছে আদিরা। বেশ কাচুমাচু অবস্থা তার। বারবার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। মাহিও এখানে নেই। আরশাদ খান আদিরার চোখমুখ দেখে বুঝলেন কিছু। তিনি নিজেই পানির গ্লাসটা আদিরার দিকে এগিয়ে দিলেন। আদিরা জোরপূর্বক হেসে সামান্য পানি পান করলো। তারপর আরশাদ খান বললেন,
“মারসাদ যখন যা করেছে আমি সব সময় ও-কে সবকিছুতে সাপোর্ট করেছি। একমাত্র তোমার বেলায় আমি ওর বিপক্ষে ছিলাম। কারণটা তুমিও জানো। মারসাদের অ্যাকসিডেন্ট, মা*রামা*রি, জে*লে যাওয়া, হসপিটালে ভর্তি হওয়া। সবকিছুর পেছনে কারণ তোমাকে বাঁচানো ও তোমার জন্য প্রতিবাদ করা। বিষয়টাকে আরো জটিল করেছে সামিরা। ও আমাদেরকে সবসময় এসব বিষয়ে আগে ইনফর্ম করতো। বাবা হিসেবে ছেলেকে বারবার বিপদে পড়তে দেখতে তো আমারও সহ্য হয় না। একমাত্র ছেলে আমার। তাই আমি চাইনি মারসাদ তোমার সাথে সম্পর্কে জড়াক। কিন্তু যখন আসল সত্য সামনে আসলো, তখন আমার ধারণা বদলেছে। আমি জানি, মানুষ যাকে ভালোবাসে তার জন্য জীবন দিতেও দ্বিধা করে না। এটা আমি নিজেও মানি কিন্তু বাবার মন তো মানে না। মারসাদের মধ্যে আমি আমার প্রতিচ্ছবি দেখি। বরং তার চেয়েও বেশি। আই হোপ তুমি যদি আমার কোনো কথা ও কাজে কষ্ট পেয়ে থাকো তবে মেয়ে হিসেবে আমাকে বাবা ভেবে মাফ করে দিবে।”

আদিরা চমকে তাকালো। সে হড়বড়িয়ে বলে উঠলো,
“না আঙ্কেল, আমি আপনাকে ভুল বুঝিনি। আপনি আপনার জায়গায় সঠিক। কোন বাবা-মা তার ছেলে-মেয়েকে বিপদের দিকে যেতে দেখতে পারে না। আমি নিজেও উনাকে বলেছিলাম, যেন দূরে থাকে আমার থেকে।”

আরশাদ খান ফের বললেন,
“আমাদের ভুল ভেঙেছে। দোষীরা শাস্তি পাচ্ছে। আমরা তোমাকে আলাদা করে এখানে আসতে বলেছি কারণ তোমার কাছে আমাদের ক্ষমা চাওয়াটা উচিত। আমি আমার বড়ো মেয়েকে শ*ত্রুদের ডেরায় বিয়ে দিয়েছি, সেটা আমি ওর বিয়ের পর বুঝতে পেরেছি৷ তাই ছেলেকে ও ছোটো মেয়েকে নিয়ে খুব চিন্তিত। এই চিন্তার কারণে আমার ছেলের সাথেও এরকম কিছুই করতে যাচ্ছিলাম। এখন আমি ছেলের পছন্দের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত। তুমি মীরার মতোই শান্ত ও ধৈর্যশীল। আমাকে যেমন তোমার আন্টি সামলিয়ে রাখে, আশা করব তুমিও মারসাদের হুটহাট রেগে যাওয়া কন্ট্রোল করতে পারবে।”

আদিরার এবার লজ্জা লাগছে। সে নতমুখে চুপ করে আছে। আরশাদ খান উঠে আদিরার মাথায় হাত রেখে সেখান থেকে চলে গেলেন। মিসেস মীরা আদিরার পাশে এসে বসেন। আদিরার গালে হাত দিয়ে হালকা হেসে বলেন,
“তোমাকে আমার ছবি দেখে মাহির মুখে তোমার কথা শুনেই ভালো লেগে গিয়েছিল। আমার ছেলের পছন্দ মা শা আল্লাহ। কতো মিষ্টি একটা মেয়ে তুমি। তোমরা দুজন সবসময় একসাথে ভালো থাকো, সুখে থাকো।”

আদিরা লাজুক হাসলো। মিসেস মীরা তারপর মাহিকে ডাকলেন। মাহি আসতেই তিনি বললেন,
“আদিরাকে ওর হোস্টেল অবধি গাড়ি দিয়ে পৌঁছে দিয়ে আয়৷ আর তোর দাভাইকে আদিরার এখানে আসার কথা বলার দরকার নেই৷ কালকে আদিরার বাবা-মা আসবেন, তখন বাকি কথা হবে।”

মাহি আপেলে কা*মড় বসিয়ে বলে,
“ফিকার নট৷ তোমাদের মধ্যে সব যখন ক্লিয়ার তখন আমার কোনো দরকারই নেই দাভাইয়ের কানে এসব তোলার।”

মিসেস মীরা ও আদিরা হাসলো। তারপর মাহি আদিরাকে নিয়ে বের হলো। আদিরা ও মাহি বেরিয়ে যেতেই আরশাদ খান এসে মিসেস মীরার পাশে দাঁড়ালেন। তিনি নিজ স্ত্রীর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন,
“আমাকে সামলে নেওয়া, সাহস দেওয়ার জন্য তোমাকে আমি সবসময় চাই। আমাদের ছেলেও তোমার মতো কাউকে পেতে চলেছে।”

মিসেস মীরা হালকা হেসে স্বামীর কাঁধে মাথা রাখলেন। সূর্য তার দিসের শেষ আলো ছড়াচ্ছে। গোধূলিতে রক্তিম আভা সকল দুঃসময় কেটে যাওয়ার আহ্বান।

চলবে ইন শা আল্লাহ,

#copyrightalert❌🚫
#এক_শহর_প্রেম_২
লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪৬
সন্ধ্যায় আদিরার বাবা-মা ও ভাই চট্টগ্রাম এসেছেন। মারসাদ নিজে উনাদের বাস স্ট্যান্ড থেকে রিসিভ করে এনেছে। উনাদেরকে ফ্লাটে পৌঁছে দিয়ে মারসাদ ভার্সিটিতে গেছে একটা কাজে। কাশেম আলী ও আশা বেগম দুজনেই খুব ইতস্তত করছেন। শহুরে পরিবেশে উনারা অভ্যস্ত নয়। মিসেস মীরা চা-নাস্তা এনে টেবিলে রাখেন। আরশাদ খান দুপুরে কুমিল্লা গিয়েছে, একটু পরই চলে আসবেন। মিসেস মীরা দেখলেন আদিরার বাবা-মা লজ্জা পাচ্ছে। তিনি মৃদু হেসে বললেন,

“আপা, ভাইজান, আপনারা নাস্তা নিন৷ অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছেন তো। ক্লান্ত অনেক। নাস্তা খেয়ে রেস্ট করবেন।”

আশা বেগম হাসার চেষ্টা করে বলেন,
“আপনে ব্যস্ত হইয়েন না, আপা। আমরা ক্লান্ত না।”

“তা মুখে বললে তো হবে না। বাচ্চা ছেলেটার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। আপনারা নিচ্ছেন না বলে ও নিচ্ছে না। নিন না।”

আশা বেগম ক্ষীরের বাটি উঠিয়ে নেয়। মায়ের দেখাদেখি আহাদ চিকেন রোল উঠিয়ে নেয়। মিসেস মীরা বসে বলেন,
“মারসাদের বাবা আজ দুপুরে কুমিল্লা গেলেন। এখনি চলে আসবে। ফোন করেছিলাম। আর্জেন্ট হওয়াতেই যেতে হয়েছিল। আপনারা কিছু মনে করবেন না। ততক্ষণে আপনারা মারসাদের রুমে গিয়ে রেস্ট করুন। আজকে আপনারা মারসাদের রুমেই থাকবেন।”

আশা বেগম আবার বললেন,
“সমস্যা নাই, আপা। আমরা ঠিক আছি। ভাইজান আসুক।”

মিসেস মীরা আর কিছু বললেন না। তিনি উঠে গিয়ে নিজের স্বামীকে কল করলেন।

আদিরা মাহির সাথে মাহির ঘরে বসে আছে। বাবা-মা আসার পর দেখা করে বুঝেছে, তার বাবা গম্ভীর হয়ে আছে। শেষবার গ্রাম থেকে আসার সময় তিনি আদিরাকে যা বলেছিলেন, সেসব ওর বারবার মনে পড়ছে। আদিরা মাহিকে বলে,

“আব্বা মনে হয় খুশি না। সেদিন আমাকে বলেছিলেন যেন ঠিকমতো পড়াশোনা করি। নিজেকে সামলে চলি। আজকে উনার শক্ত মুখ দেখে আমার ভয় করছে।”

মাহি চিপস খেতে খেতে ল্যাপটপে কার্টুন দেখছিল। আদিরার কথা শুনে কার্টুন পস করে বলে,
“তুই ভয়টা কবে পাস না!”

আদিরা কপাল কুঁচকে তাকালে মাহি ফের বলে,
“তোকে তো আমি সবসময়ই ভয়ই পেতে দেখি! তুই ভয়টা কবে পাস না, শুধু সেটা আমাকে বল। ভয় পেতে পেতেই তোর প্রেম হলো! এখন বিয়ের কথা চলছে। সামনে বিয়েও হবে। সো চি*ল বেব!”

তারপর মাহি আবার কার্টুন দেখা শুরু করলো। আদিরা হতাশ হয়ে বসে রইল।

——-
আরশাদ খান চট্টগ্রামের ফ্লাটে ফিরতেই কাশেম আলী ও তার স্ত্রীর সাথে কুশলাদি বিনিময় করলেন। আরশাদ খানের নম্র ও সুন্দর ব্যবহার কাশেম আলীর মনের দোটানা কমালো। কাশেম আলী বললেন,

“ভাইসাহেব, আমরা গরিব মানুষ। গ্রামে থাকি। শহরের ভাবসাব বুঝি না। মাইয়া শহরের ভার্সিটিতে চান্স পাইছে তাই পড়তে দিছি। শহরে আইসা যে মাইয়া এসবে জড়াইব তা আমাগো ধারণাতেও আছিল না। গ্রামের মানুষজন কইছিল মাইয়া হাতের বাইরে যাইব গা। এহন কী করমু কন!”

আরশাদ খান হাসলেন। অতঃপর বললেন,
“ছেলেমেয়েদের একে-অপরকে পছন্দ হয়েছে। এখন আমাদের কাজ আমরা দেখেশুনে ওদের বিয়ে দিব। আপনার মেয়ে খুব ভদ্র ও নম্র স্বভাবের মেয়ে। যে-কারও নিজের ছেলের জন্য পছন্দ হবে। আজকাল তো এতো নরম স্বভাবের মেয়ে খোঁজাও মুশকিল। সেখানে ছেলে যখন খুঁজে এনেছে। আমরা রাজি না হয়ে কীভাবে থাকি?”

কাশেম আলীর মন থেকে একটা বড়ো বোঝা নেমে গেলো। তিনি বললেন,
“আপনারা যা বলেন। আমাগো কোনো সমস্যা নাই। আর বিয়ার জন্য কী কী লাগব আর আপনাগো কী কী দিতে হইব…..”

কাশেম আলী তার কথা শেষ করার আগেই আরশান খান বাধা দিলেন। আর বললেন,
“কিছু লাগবে না। আর আপনারা কেন দিবেন? যৌতুক প্রথা আমরা সাপোর্ট করি না। ইসলামে দেনমোহর দেওয়ার নিয়ম। যৌতুক প্রথা একটা কুপ্রথা। যেটার জন্য অনেক মেয়ের জীবন শেষ হয়ে যায়। কতো বাবা-মা সবকিছু হারিয়ে বসে। কারণ আপনি কাউকে দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পারবেন না। দিলেই চাইবে। কিন্তু দেনমোহর বিয়ের সময় নির্ধারণ করা হয়। যা সাথে সাথে পরিশোধ করা উচিত। দেনমোহর স্ত্রীর অধিকার। দেনমোহর অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। ইসলামে শরিয়তের বিধান, দেনমোহর সর্বনিম্ন ১০ দিরহাম। ১০ দিরহামের কম পরিমানে স্ত্রী রাজি হলেও সেটা বৈধ না। সর্বোচ্চ দেনমোহরেরও কোনো বাউন্ডারি নেই। নবীজির স্ত্রী উম্মে হাবিবার দেনমোহর ছিল ৪০০০ দিরহাম।”

কাশেম আলীর যেন অবাক হওয়া বাকি। এর আগে তিনি যেখানেই মেয়ের বিয়ের কথা তুলেছেন, সেখানেই যৌতুকে তার থেকে বাইক, ফ্রিজ, টিভি, খাট, আলমারি এসব তো চেয়েছেই। এখানে আসার পূর্বে কাশেম আলীর আরো একটা ভয় ছিল যৌতুকে কী চাইবে? বড়োলোক ঘর। হয়তো বেশি কিছু চাইবে। কিন্তু উনার ধারণা বদলে গেছে আরশাদ খানের কথা শুনে। তিনি অশ্রুসিক্ত হাসলেন। ফের বললেন,

“আপনারা বড়ো মনের মানুষ। এজস আর আমার ভয় নাই। আমার মাইয়া ভালোই থাকবো আপনাগো বাড়িত।”

আরশাদ খান হাসলেন। অতঃপর দুই পরিবার রাজি। দুই পরিবারের মধ্যে মিষ্টিমুখ হলো। মিসেস মীরা মারসাদকে কল করে আসতে বললেন। বিয়ের দিন তারিখ পহেলা ফাগুন ঠিক হলো। এখনও তিন মাসের কম বাকি। মিসেস মীরা আদিরার হাতে আংটি পরিয়ে দিলেন। আদিরা মাথায় বড়ো করে ওড়না দিয়ে লজ্জায় নতমুখে বসে আছে। মাহি ওর পাশে দাঁড়িয়ে সবার আড়ালে ওর হাতে চি*মটি কাটে। কানে কানে বলে,

“ওয়েলকাম ভাবি!”

আদিরা লাজুক হাসে। কাশেম আলী নিজের আঙুল থেকে আংটি খুলে মারসাদকে পরাতে চাইলে মারসাদ বাধা দেয়৷ বলে,
“না আঙ্কেল। আমাকে আংটি পরাতে হবে না। আমি আংটি এমনিও পরি না। ছোটো থেকে কখোনোই পরিনি। তাই প্লিজ।”

মারসাদের সাথে আরশাদ খানও তাল মেলালেন। তিনি বললেন,
“ছেলে আমার ছোটো থেকে এসব সহ্য করতে পারে না। বাচ্চাদের গলায় স্বর্ণের চেইন যখন দেওয়া হতো, তখনও ও কে পরানো যায়নি৷ ওর দাদি পরাতে চাইলেই কান্নাকাটি করে অবস্থা খারাপ করে ফেলতো। তাছাড়া পুরুষদের জন্য স্বর্ণ পরা হারাম।”

কাশেম আলী মৃদু হাসলেন৷ আংটিটা আশা বেগমের কাছে দিয়ে দিলেন।
——

পরেরদিন দুপুরের পর আদিরার বাবা-মা গ্রামে যেতে রওনা হলেন। আদিরা ও মারসাদ উনাদেরকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাস ছাড়ার আগে আহাদ জানালা দিয়ে হাত নাড়িয়ে টাটা দিচ্ছে। আদিরা চোখ মুছে নিজেও বিদায় জানায়। তারপর বাস ছেড়ে দিলে আদিরা মারসাদকে বলে,

“আপনি এখানে একটু দাঁড়ান৷ আমি আসছি।”.

এই বলে আদিরা একদিকে যাচ্ছে তখন মারসাদ ওর হাত ধরে আটকে প্রশ্ন ছুঁড়ে
“দাঁড়াব মানে? কোথায় যাচ্ছ?”

“দাঁড়ান তো। আমাকে ফলো করবেন না। একটু দাঁড়ান।”

তারপর আদিরা চলে গেলো। প্রায় পনেরো মিনিট পর সে ফিরে আসে। মারসাদ শুধায়,
“কোথায় গিয়েছিলে?”

“পরে বলব। চলুন পতেঙ্গাতে যাই।”

“এখন?”

“হুম চলুন।”

আদিরার হঠাৎ স্বভাববিরুদ্ধ কাজে মারসাদ হতবাক। তারপর মারসাদ একটা সিএনজি ঠিক করে। সিএনজি করে দুজনে রওনা করে।

পতেঙ্গাতে পৌঁছে দুজনে সাগরের পাড়ে দাঁড়ায়। পশ্চিম আকাশ রক্তিম আভায় আচ্ছন্ন। গোধূলির সময়। আদিরা ব্যাগ থেকে একটা ঘড়ির বক্স বের করে মারসাদকে দিয়ে বলে,

“এটা আপনার জন্য।”

মারসাদ বক্সটা নিয়ে বলে,
“ঘড়ি কেন কিনেছ?”

“মা বলেছে। আপনি ঘড়ি তো পরেন। তাই মা আমাকে বলেছে যেন আপনাকে ঘড়ি কিনে দেই। মাহি বলেছিল আপনি কোন কোন ব্র্যান্ডের ঘড়ি পরেন। তারপর কিনে আনলাম।”

“অযথা টাকা খরচ করেছ। আমার ঘড়ির কালেকশন এতো যে ওখানের সবগুলোই এখনও পরা হয়নি।”

আদিরা মারসাদের হাত শক্ত করে ধরে চোখে চোখ রেখে বলে,
“এটা পরবেন। আমি জানি, আপনি এটা প্রায় প্রায় পরবেন।”

মারসাদ হাসে। প্রত্যুত্তরে আদিরাও হাসে। তারপর দুজনে সমুদ্রের দিকে চেয়ে সূর্যের সমুদ্র গর্ভে বিলীন হওয়া দেখছে।

চলবে ইন শা আল্লাহ,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে