এক শহর প্রেম_২ পর্ব-৪১+৪২+৪৩

0
52

#copyrightalert❌🚫
#এক_শহর_প্রেম_২
লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪১
মেলায় মেয়েরা সবাই চুড়ির দোকানের কাছে এসে দাঁড়ায়। রং-বেরঙের কাঁচের চুরি। কাঁচের রেশমি চুড়িতে ভরপুর দোকানগুলো থেকে যেন মেয়েদের নজর সরছেই না। আদিরা নীল রেশমি চুড়ি হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। মারসাদ ওর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর কানের কাছে ঝুঁকে ধিমি স্বরে শুধালো,

“পছন্দ হয়েছে?”

নিজের এতো কাছে কারও ধিমি স্বরে আদিরা কেঁপে উঠলো। হাত থেকে চুড়িগুলো পড়ে যেতে নিলে মারসাদ ধরে ফেলে। তারপর পেছন থেকে আদিরার হাতে আস্তে আস্তে চুড়ি গুলো পরিয়ে দিতে থাকে। চুড়ি পরানোর সময় আদিরা বারবার নড়াচড়া করছে। আশেপাশে গ্রামের কেউ দেখছে কী না তা দেখছে। মারসাদ বলে উঠে,

“হাত এতো নড়াচ্ছো কেন? চুড়ি ভেঙে হাত যদি কে*টে যায়?”

আদিরা স্থির হলো। মারসাদ যত্ন সহকারে এবার চুড়ি পরাচ্ছে। মাহি, সুমিরা এই দৃশ্য দেখে মুচকি মুচকি হাসছে। তখন আহনাফ মাহির কাছে গিয়ে ওর হাত থেকে চুড়িগুলো নিয়ে পরিয়ে দিচ্ছে। মাহি ভ্রঁ নাঁচিয়ে বলে,

“দাভাইয়ের থেকে ইন্সপেরেশেন হয়ে বুঝে চুড়ি পরিয়ে দিতে এলেন?”

আহনাফ চুড়ি পরানোর দিকে মনোযোগ দিয়েই মৃদু হাসলো। তারপর বলল,
“আমার কারো ইন্সপেরেশন লাগে না।”

“ওহ আচ্ছা!”

মাহি তারপর আহনাফের চুলে হাত বুলিয়ে দিলো। এদিকে রিন্তি বারবার লাজুক লাজুক দৃষ্টিতে রাফিনকে দেখছে। রাফিনের ক্ষেত্রেও তাই। রাফিনের পাশ থেকে মৃদুল বলে উঠে,

“ইয়ার! যা। আমার পাশে দাঁড়িয়ে এই লাজুক লাজুক নজরে রিন্তুকে দেখাটা বন্ধ কর! ওর কাছে গিয়ে তোর যা মন চায় বল। চুড়ি পরাতে মন চাইলে পরা। তাও আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার সিঙ্গেল মনকে কষ্ট দিস না!”

তারপর মৃদুল রাফিনকে একটা ধাক্কা দিলে, রাফিন মাথা চুলকে লাজুক হেসে রিন্তির কাছে যায়। সুমি, মৌমি, রাত্রি, সাবিহা এই তিন জুটিকে দেখে একসাথে আফসোসের স্বরে চুড়ি পরতে পরতে বলে উঠে,

“আজ আমাদেরকে চুড়ি পরিয়ে দেওয়ার মত কেউ নেই বলে, নিজেরাই নিজেদের হাতে চুড়ি পরছি!”

মাহি হেসে উঠে। রিন্তি ও আদিরাও লাজুক হাসে।

চুড়ি পরানোর পর মারসাদ আদিরার দুই হাত দেখছে। অতঃপর বলে,
“নীল চুড়ি তোমার হাতে বেশ মানিয়েছে।”

আদিরা লাজুক স্বরে বলে,
“চুড়ি গুলো খুব সুন্দর।”

“না। চুড়ির সৌন্দর্য তাকে পরা হাতের উপর নির্ভর করে।”

আদিরা মারসাদের চোখের দিকে তাকায়। এই চোখ দুটো সবসময় তার মাঝেই মুগ্ধতা খোঁজে। আদিরা বলে,
“আল্লাহর সৃষ্টি সবাই সুন্দর। আপনিই তো বলেছিলেন।”

মারসাদ বুঝতে পারলো না, সে কি ভুল কিছু বলল! আদিরা মারসাদকে চিন্তায় ফেলে সুমিদের কাছে গেলো।

———
জুম্মার নামাজ পড়ে মারসাদ ও তার বন্ধুরা আদিরার বাবার সাথে একসাথে বাসায় আসে। তারপর সবাই একসাথে খেতে বসে। আদিরা তার বাবাকে বলে,

“আব্বা, আমরা কালকে চট্টগ্রাম চলে যাব।”

আদিরার কথা শুনে আশা বেগম প্রশ্ন করে বসেন,
“তুই না বললি তুই রবিবার পর্যন্ত থাকবি। সোমবার সকালে রওনা দিবি। তাইলে এহন কালকেই যাবি গা কেন?”

আদিরা আমতা আমতা করে সবার দিকে তাকায়। তারপর বলে,
“স্টুডেন্টের মা কল করেছিল।”

“কয়টাদিন ছুটি দিলে কী হয়? আমারে ফোন লাগায় দিস। আমি কথা কমু।”

“না না। আসলে আন্টির দেবররা এই মাসের শেষের দিকে আসবে। তাদের সাথে গ্রামে যাবে। এজন্য আমাকে বলেছে যেন কয়দিন আগে আগে পড়িয়ে দেই। ডিসেম্বরে তো ফাইনাল পরীক্ষা। ও-কে কয়েকবার পড়াতে হয়।”

আশা বেগম হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়লেন। তারপর শুধালেন,
“তাইলে কি কালকে সকাল সকাল যাবি গা?”

আদিরা হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লেন। কাশেম আলী বললেন,
“তাইলে আমি এহনি বড়ো বাজারে যামু। বড়ো একটা ইলিশ মাছ আনমু। গো*শত তো সবসময়ই খাস। বড়ো ইলিশ মাছ তো সবসময় পাওয়া যায় না। বরফের তলে রাইখা দেয়। দেহি পাই কী না।”

তারপর সবাই আর কথা না বলে খাওয়া শেষ করতে থাকে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে কাশেম আলী আগে মাছ কিনতে যান। বড়ো একটা দেড় কেজির ইলিশ, দুই কেজি বাটা মাছ (সঠিক নাম এটা কি না জানিনা) কিনে তার দোকানের ছেলেকে দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। দোকানের ছেলেকে মাছ দিয়ে পাঠানোর পর পাশের দোকানের একজন এসে জিজ্ঞাসা করে,

“কাশেম ভাই, আপনের বাড়িতে শুনলাম মেহমান আসছে?”

“হ। চট্টগ্রাম থিকা আসছে। মাইয়ার লগে পড়ে।”

“শুনলাম কয়ডা পোলাও নাকি আইছে?”

কাশেম আলী এবার থতমত খেয়ে গেলেন। তিনি বিব্রত স্বরে জবাব দিলেন,
“মাইয়ার বান্ধবীর ভাই ওরা। এত দূরে মাইয়াগুলারে একা ছাড়বো, এজন্য আইছে।”

“আসলেই ভাই তো? আজকালকার পোলা মাইয়ারা তো কত মিছা কথাই কয়! না*গররে ভাই বানায় চালায় দেয়!”

কাশেম আলী প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে পারলেন। তারও প্রথমে এতোগুলো ছেলে আসা নিয়ে আপত্তি ছিলো। নিজ স্ত্রীকে তিনি বলেছেনও। তারপর মাহির ভাই এবং মারসাদ ও তার বন্ধুরা আদিরাকে কিভাবে বাঁচিয়েছে শুনে মনকে শান্ত করেছেন। যদি সেদিন এই ছেলেগুলো তার মেয়েকে না বাঁচাতো, তাহলে তার মেয়ের কী অবস্থা হতো! এটা ভেবেই তার গায়ে কাঁপন ধরলো। তিনি কথা কাটানোর জন্য বললেন,

“সবাই তো আর খারাপ হয় না, ভাই। এহনো দুনিয়াতে কিছু মানুষ ভালা বাঁইচা আছে বইলাই দুনিয়াডা এহনো মাইয়াগো জন্যে থাকনের মতো আছে।”

লোকটাও আর কিছু বলল না। সে তার দোকানের কাজে মগ্ন হয়ে পড়লো। কাশেম আলী চিন্তিত হয়ে বেঁচাকেনায় মন দিলেন।

——–

মাছ আনার পর আদিরা, সুমি, রাত্রি ও আশা বেগম মাছ কা*টতে বসেছেন। মৌমি, সাবিহা, মাহি, রিন্তি একটু দূরে বসে মাছ কা*টা দেখছে। সুমি বলে,

“মৌমিরে, তুই যে এখন হাত গুটায়ে বসে আছিস, বিয়ের পর তো তোরও মাছ কা*টতে হবে।”

মৌমি বলে,
“আমি আশিককে বলব, বাজার থেকে মাছ কে*টে আনতে। আমি মুরগি কা*টতে পারি এটাই তো অনেক!”

আশা বেগম হাসতে হাসতে বলেন,
“মা গো, মাইয়া মানুষের সব কাম জানতে হয়। পরে শ্বশুরবাড়িতে গিয়া তুমি সেটা করো বা না করো। কিন্তু যাতে কেউ খোঁটা দিতে না পারে যে, মা-চাচিরা তো কিছু শিখায় নাই!

“কিন্তু আন্টি আমি মাছের আঁশ ছাড়াতে গিয়ে মাছের চা*মড়াই ছিলে ফেলি! আর কতো নরম। কা*টাও হয় না।”

“আস্তে আস্তে শিইখা যাইবা। এখন দেখতে থাকো, তারপরে একদিন নিজের চেষ্টা করবা।”

মৌমি সম্মতিসূচক হাসে। মাহি বলে,
“তোমরা তাও তো রান্না-বান্না পারো। আমাকে যে বিয়ে করবে তাকে বিদেশি কিছু ডিশ খেয়েই বাঁচতে হবে!”

কথাটা বলতে বলতে মাহি আহনাফের দিকে তাকায়। আহনাফ মাথা নুইয়ে হাসে। মারসাদ তো গভীর মনোযোগ দিয়ে আদিরার মাছ কা*টা দেখছে। খুব যত্ন করে কা*টছে ও। মারসাদ ফোন বের করে ছবিও তুলে নিলো।

রাতে সবাই সাথে খেতে বসেছে। সবার পাতে ভাজা ইলিশ মাছের পিস ও একটা করে বাটা মাছ ভাজা। সাথে গরম গরম ভাত ও শুকনো মরিচ৷ কাশেম আলী খেতে খেতে আদিরাকে বলেন,

“এবার থিকা খুব সাবধানে থাকবা। চোখ-কান খোলা রাখবা। আর তোমার এই বোকা বোকা স্বভাবটা এইবার বাদ দাও।”

কাশেম আলীর কথার প্রত্যুত্তরে মাহি বলে উঠে,
“এটাই তো, আঙ্কেল। আদু যে এতো বোকা! কেউ ও-কে হাজারটা কথা শুনিয়ে গেলেও মেয়ে চুপ করে থাকে! আমি আর দাভাই তো ওর এই চুপচাপ সহ্য করা স্বভাবে খুবই বিরক্ত।”

“শহরের সবার লগে তাল মিলাইতে পারে না তো। ঠিক হইয়া যাইব৷ ওরে নিয়া আমার অনেক চিন্তা হয়। ”

মৃদুল বলে উঠে,
“আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন, আঙ্কেল। আমরা আছি তো। ওর চারটা ভাই আছে।”

আহাদ মৃদুলের কথার মাঝে বলে,
“পাঁচটা। আপনেরা তো পাঁচজন। তাইলে চারটা ভাই কন কেন?”

মারসাদ কেঁশে উঠলো। রাফিন আহাদকে বলল,
“তুমিই ঠিক, বাবু! ও অংকে কাঁচা তো!”

“আমার কিন্তু অংক অনেক ভালো লাগে। আমি এবার অংকে হায়েস্ট নাম্বর পাইছি। স্যারে কইছে….”

আশা বেগম ছেলেকে মৃদু ধ*মক দিয়ে খেতে বললেন।

চলবে ইন শা আল্লাহ,

#copyrightalert❌🚫
#এক_শহর_প্রেম_২
লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪২
পরদিন সকালবেলা। সবাই ব্যাগপত্র নিয়ে প্রস্তুত। আদিরার বাবা-মা ও ভাই সবাইকে বিদায় দিচ্ছেন। তখন মারসাদ আদিরার বাবা-মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আর বলল,
“আঙ্কেল-আন্টি, আমি আপনাদেরকে কিছু ইম্পর্টেন্ট কথা বলতে চাই। জানিনা আপনারা বিষয়টা কীভাবে নিবেন। ”

মারসাদের কথা শুনে আদিরা ঘাবড়ে গেলো৷ সে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
“কাল থেকে লোকটাকে এতো করে বুঝাচ্ছি, বুঝতেই চাইলো না! উনার কথা মতো একদিন আগে ফিরে যাচ্ছি। তারপরও!”

পাশ থেকে সাবিহা ও-কে জিজ্ঞেস করে,
“কী বিড়বিড় করছিস?”

“উনি তো কালকে আমাকে বলেছিলেন, যদি আমি উনার সাথে ফিরতে রাজি হই তবে আব্বা-মা কে কিছু বলবেন না। এখন দেখ!”

সাবিহা হাসি চেপে বলল,
“তোর কি সত্যিই বিশ্বাস হয়েছিল? যে ভাইয়া আঙ্কেল-আন্টিকে বলবেন না।”

আদিরা অসহায় চাহনি দেয়। এদিকে কাশেম আলী ও আশা বেগম কিছুটা চিন্তিত। কাশেম আলী বলেন,

“কী কথা, বাজান? কিছু কি হইছে?”

“আসলে আঙ্কেল…”

“তুমি নিশ্চিন্তে কও।”

মারসাদ এবার পরিপূর্ণ সাহস সঞ্চার করে বলে,
“আমি আদিরাকে পছন্দ করি। ইনফেক্ট ভালোবাসি। আদিরাও আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু ও বলতে ভয় পায়।”

মারসাদ খানিক থামে। কাশেম আলীর মুখ থমথমে। আশা বেগমও ভয় পাচ্ছেন। তিনি যদিও আগে থেকে আন্দাজ করেছিলেন। আদিরা নিজেকে সাবিহার পেছনে আড়াল করে নিয়েছে। তার বাবার চোখমুখ দেখে বুঝতে পারছে না, যে রেগে আছে নাকি নেই। কাশেম আলীর নিরব হয়ে আছেন। মারসাদ আবার বলে,

“আমি ও-কে বিয়ে করতে চাই।”

কাশেম আলী এবার বললেন,
“মাইয়া শহরে গেছে তহনি লাগাম ছুইটা গেছে। এহন তার আমাগো পছন্দ ভালা লাগতো না। সে যদি সঠিক মানুষ খুঁইজা পায়, তয় আমার তো বাধা দেওনের কিছু থাকে না। মাইয়া ভালো থাকব, এইডাই তো চাই। তুমি আর তোমার বন্ধুরা আমার মাইয়ার চরম ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে ঝাঁপায় পড়ছো। নিজের জানের তোয়াক্কা করো নাই। তোমাগো ধন্যবাদ দিতে ভাষা নাই আমার। তয় বাজান, বিয়া তো কোনো খেলা না। বিয়া দুইটা পরিবারের মধ্য সুসম্পর্কও। এহন খালি আমরা রাজি হইলেই তো হইব না। তোমার বাপ-মায়েরেও রাজি থাকন লাগবো। তোমার বাপ-মা রাজি না থাকলে আমরাও রাজি না। শ্বশুর-শাশুড়ির মন না পাইলে সংসার অশান্তির হইয়া যায়।”

মারসাদ চিন্তায় পড়ে গেলো। তার বাবা রাজি না। এটা বললে আদিরার বাবা বেঁকে বসবেন। কী বলবে এটা ভাবার মাঝেই মাহি বলে উঠে,

“সবাই রাজি, আঙ্কেল! আপনি চাইলে আম্মু, আপুর সাথে কথা বলিয়ে দেই? আসলে আঙ্কেল, আপনি তো জানেনই আদিরার সাথে কী হয়েছিল। দাভাই চায় আদিরাকে প্রটেক্ট করতে। আদিরার তো সবে ফার্স্ট ইয়ার শেষ হলো। আরও তিন বছর তো বাকিই। দাভাই ও-কে প্রটেক্ট করতে চাইলেও আদিরা চায় না ভাইয়া ওর জন্য বিপদে পড়ুক। তাই দাভাই আপনাদের অনুমতি নিতে এসেছে।”

“সবই বুঝলাম, মা। আমাগো তেমন কোনো আপত্তি নাই। এখন আল্লাহ চাইলে আরকি।”

মাহি, মারসাদ ও তার বন্ধুরা স্বস্তি পেলো। আশা বেগম আদিরাকে একটু ঘরে ডাকলেন। আদিরা মায়ের সাথে যায়। কাশেম আলীও ঘরের দিকে গেলেন। সুমি বলে,

“আমাদের মাহি তো খুব ব্রিলিয়ান্ট! এতো সুন্দর করে শান্ত ভাবে সব হ্যান্ডেল করলো।”

মাহি কিছুটা ভাব নেওয়ার মতো করে বলল,
“আমি সবসময়ই ব্রিলিয়ান্ট।”

রিন্তি চিন্তিত সুরে বলে উঠে,
“কিন্তু আঙ্কেল-আন্টি আদুকে ভেতরের ঘরে কেন নিয়ে গেল?”

“রিল্যাক্স। ও-কে আসতে দে।”

ভেতরের ঘরে গিয়ে কাশেম আলী আদিরাকে জিজ্ঞাসা করেন,
“তুমি ওই পোলারে পছন্দ করো?”

আদিরা ভয়ে জড়োসড়ো। তার বাবা কি তাকে আট*কে ফেলবেন? এই ভয় পাচ্ছে। আশা বেগমও জিজ্ঞাসা করেন,
“বল। পছন্দ করোস মারসাদরে?”

আদিরা মাথা উপর নিচে হেলায়। কাশেম আলী বলেন,
“যাই করো, আমাগো মান-সম্মান খুওয়াইও না। আমরা গরীব মানুষ কিন্তু আত্মসম্মান আছে। পোলাটা ভালো আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু বড়লোক ঘরের পোলা। এইজন্য ভয়ও হয়। তুমি শহরে গেছো, পড়াশোনা করবা। নিজের খেয়াল রাখবা। এটুকুই। এহন যাও।”

আদিরা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর ওরা সবাই আদিরার বাবা-মা ও ভাইকে বিদায় জানিয়ে রওনা করে।

——-

সামিরা জে*লে সাগরের সাথে দেখা করতে গেছে। সাগরই পু*লিশের মোবাইল দিয়ে সামিরাকে কল করেছে। সামিরা মুখ ঢেকে থানায় গেছে। তারপর সাগরের সাথে দেখা করে। সামিরা বলে,

“আমাকে কেন ডেকেছো?”

সাগর শ*য়তানি হেসে বলে,
“তুমি যদি আমাদেরকে জেল থেকে বের না করো, তাহলে কিন্তু আমরা তোমার নাম পু*লিশের কাছে বলে দেব। দ্রুত আমাদের জামিনের ব্যবস্থা করো।”

সামিরা কিছুটা ভয় পায়। সে তোঁতলানো স্বরে শুধায়,
“কী বলে দিবে? আমি কিছুই করিনি।”

তখন দেলোয়ার পাশ থেকে বলে,
“আফা, আপনে যে আমার নাম্বারে কল করছিলেন, হেইডা কিন্তু আমি জাইনা গেছি। আপনে কইছিলেন আদিরারে রে*প করতে। তাইলে আপনে আমারে দুই লক্ষ টাকা দিবেন।”

“আমি বলেছি মানে? এই মিথ্যা বলছো কেন তোমরা?”

“শুনো সামিরা, দেলোয়ার এখনো পু*লিশের কাছে বলেনি যে কেউ ও-কে বলেছে আদিরাকে রে*প করতে। কিন্তু আদিরাকে কিডন্যাপের দিন, তুমি আমার কাছে এসেছিলে। আমার ফোনের সাথে কিছু করেছ এটা আমার বিশ্বস্ত জুনিয়র রনি দেখেছে। কী করেছিলে তুমি? রনি দেলোয়ারের ফোন থেকে তোমার নাম্বার পেয়েছে। দেলোয়ারের ফোনটা ওই গুদামঘরে পড়ে ছিল। রনিকে পু*লিশ ধরেনি৷ কারণ রনি সেদিনই তার গ্রামে চলে গিয়েছিল। দুইদিন হলো এসেছে। এসেই দেখা করেছে। পু*লিশকে আমরা বলেছি রনি এসবের ভিতরে নেই। তারপর দেলোয়ারের থেকে সেই ফোন কলের কথা শুনে রনিকে ফোন খুঁজতে পাঠিয়েছি।”

সামিরা আমতা আমতা করে বলে,
“নাম্বার পেলেই কি আমি আদিরার রে*প করতে বলেছি নাকি! নিজেদের কুকর্ম আমার নাম দিয়ে ঢাকতে চাইছ!”

সাগর বাঁকা হাসে। তারপর বলে,
“তাই নাকি! আমাদেরকে কি তোমার মূর্খ মনে হয়? চট্টগ্রাম ভার্সিটির সিএসসি ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্টদের তোমার মূর্খ লাগে? কল রেকর্ডও বের করা হয়ে গেছে। পু*লিশের কাছে এটা দেওয়া হবে।”

সামিরার অস্থির লাগছে। সে এখন নিজের কাজে নিজেই পস্তাচ্ছে। সামিরা হড়বড়িয়ে বলে,
“আমি তোমাদের জামিনের ব্যবস্থা করছি। কিন্তু প্লিজ, পু*লিশের কাছে যেন এটা না যায়।”

“তুমি আমাদের সাহায্য করলে আমরা তোমার ক্ষতি কেন করব? আমাকে যদি পু*লিশ গ্রে*ফতার করতে পারে এই কারণে যে আমি দেলোয়ারকে বলেছি আদিরাকে বিয়ে করে নিতে। তাহলে তুমি তো আমার থেকেও ভয়ংকর ক্রি*মি*নাল! মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের…..! এজন্যই বলে, মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু হয়।”

“বেশি কথা বলবে না। আমি তোমাদের জামিনের ব্যবস্থা করছি।”

তারপর সামিরা দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে যায়।

চলবে ইন শা আল্লাহ,

#copyrightalert❌🚫
#এক_শহর_প্রেম_২
লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৪৩
চট্টগ্রাম ফিরেই মারসাদের কানে একটা ভয়ানক খবর এলো। দেলোয়ার, সাগররা জামিনে ছাড়া পেয়েছে। দেলোয়ার গা ঢাকা দিয়েছে। রুহুল আমিনও জামিনে ছাড়া পেয়ে অন্য শহরে আছে এখন। কিন্তু সাগর পালায়নি। এখন সাগর ও মারসাদ মুখোমুখি বসে আছে। সাগর মারসাদের চোখে চোখ রেখে বলে,

“দেখ মারসাদ, তুই যেই কারণে আমাকে জেলে ভরেছিস, এখানে কিন্তু আমার দোষ ছিল না। দেলোয়ার আমার কাছে এসে বুদ্ধি চেয়েছে, আমি শুধু বলেছি আদিরাকে কি*ডন্যা*প করে বিয়ে করে ফেলতে। কিন্তু নিজে করাইনি। আর এতে হেল্পও করিনি। আমি ফ্লো ফ্লো তে বলেছি, দেলোয়ার যে সত্যি সত্যি করবে বুঝতে পারিনি।”

মারসাদ হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাগ কন্ট্রোল করে রেখেছে। চোখ-মুখের অবস্থা তার কঠোর। সে বলে,
“তুই বুঝতে পারিসনি?”

“আরে তোর চোখ থাকতেও কা*না নাকি! পুলিশ তো আদিরার কে*সে আমার কোনো ইনভলবমেন্ট খুঁজে পায়নি। তুই আমার নামে কম*প্লেন করছিস। দেলোয়ারকে রুহুল আমিন সাহায্য করেছে। রুহুল আমিনের সাথে আমার যোগাযোগ আছে। দেলোয়ার রুহুল আমিনকে চিনেছে আমার মাধ্যমে। কিন্তু ওই কি*ডন্যাপিং এসবে আমি ও আমার গ্রুপ ছিলাম না। তোর ও আমার মধ্যকার ঝামেলা এই ভার্সিটির ভিপির পদ নিয়ে। ভার্সিটিতে কার বেশি দাপট সেটা নিয়ে। প্রথম যখন দেলোয়ার আদিরাকে ডিস্টার্ব করেছিল, তখন তো আমি দেলওয়ারকে চিনতাম না। তোর সাথে মা*রামা*রি হওয়ার পরেই আমি দেলোয়ারকে চিনেছি। দেলোয়ার যা যা করেছে সব নিজের মর্জিতে। আমি চেয়েছিলাম ও-কে তোর বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে। কিন্তু সেই সুযোগটাই আমি পাইনি। কিন্তু রুহুল আমিন সেটা ব্যবহার করেছে।”

মারসাদ এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর বলে,
“তোর এই রচনা মূলক বক্তব্য আমার শোনার ইচ্ছে নেই। হ্যাঁ, তোর সাথে আমার ঝামেলা ভার্সিটিতে কার দাপট বেশি সেটা নিয়ে। ও ভিপির পদ নিয়ে। কিন্তু তুই রুহুল আমিনের সাথে হাত মিলিয়েছিস। এখানকার খবর রুহুল আমিনকে জানিয়েছিস। দেলোয়ারকে আমার বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে রুহুল আমিনের সাথে পরিচয় করিয়েছিস। আদিরার কি*ডন্যা*পিং এর বুদ্ধি দিয়েছিস। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও তুই পরোক্ষ ভাবে দোষী। তোর জামিন কে করিয়েছে, সেটাও আমি দুই দিনের মধ্যে জেনে যাব। উ*কিলকে দ্বিগুণ টাকা ঢাললে উ*কিল বলে দিবে।”

মারসাদ রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, তখন সাগর মাসাদকে পিছু ডাকে। আর বলে,
“শুধু শুধু উ*কিলের পেছনে কেন টাকা ঢালবি? আমিই তোকে বলে দিচ্ছি কে জামিন করিয়েছে!”

সাগরের কথার মর্ম মারসাদ ঠিক বুঝলো না। সে শুধালো,
“কি বলতে চাইছিস? আর তুই আমাকে কেন বলবি? তোর কীসের স্বার্থ? আবার কিছু নিয়ে ডিল করতে চাইছিস?”

সাগর হাসে. তারপর মারসাদের দিকে এগিয়ে এসে বলে,
“একদম তাই। কে জামিন করিয়েছে আমি তোকে সেই নামটা বলবো। তুই শুধু পুলিশের কাছে আমার নামের কে*সটা উইথড্র করে নিবি।”

মারসাদ ক্ষেপে সাগরের কলার চেপে ধরলে সাগর বলে,
“পুরো কথা শোন। আগে থেকেই এরকম মা*রামা*রিতে যাস না। তোর সাথে আমি আর কোনো ঝামেলা করব না। আমি এই দেশ ছেড়েই চলে যাব। আমার দুলাভাই অলরেডি আমার জন্য ইটালির ভিসা এপ্লাই করেছেন। সে আগে থেকেই আমাকে তার কাছে নিতে চাইছিল। তুই আমাকে কিছু ফ্যাকাল্টির রিকমেন্ডেশন আনিয়ে দিবি।”

“আর এসব আমি কেন করব?”

“করবি। কারণ আমি এখন যা সত্য ফাঁস করতে চলেছি, তার সাথে তোর জীবনও জড়িয়ে আছে।”

মারসাদ দৃষ্টি ক্রমশ তীক্ষ্ণ হচ্ছে। সে সন্দিহান হয়ে শুধায়,
“কার কথা?”

এরপর সাগর সেই কল রেকর্ডটা মারসাদকে শোনায়। কল রেকর্ডটা শুনে মারসাদের রাগ যেন আকাশচুম্বী! সাগর ফের বলে,
“এর আগেও সামিরা আমার কাছে এসেছিল, আদিরার ক্ষতি যেন করি। আমার একচুয়ালি ইচ্ছে হয়নি। বা বলতে পারিস তোর সাথে আদিরার প্রেমটা গভীর হওয়ার পর কিছু করতাম। কারন আমার শত্রুতা সম্পূর্ণটাই তোকে নিয়ে ছিল।”

মারসাদ চিন্তা করতে থাকে। শত্রুতা শেষ করার এই একটা উপায়। কারণ সাগর জে*ল থেকে বের হবেই।

“ঠিক আছে। রেকর্ডটা আমাকে দে। কিন্তু তোকে ফ্যাকাল্টির রিকমেন্ডেশন আমি আনিয়ে দিতে পারবো না। তোরটা তুই ব্যবস্থা করে নিবি। কিন্তু দেলোয়ারকে আমি মুক্ত করছি না। দেলোয়ার ও রুহুল আমিন দুজনেই শাস্তি পাবে। তোকেও শাস্তি দেওয়ার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু এই কেসে তোর ইনভলবমেন্ট পু*লিশও যেহেতু পায়নি, অযথা হয়রানি করব না। সবশেষে বলব, সঠিক পথে ফিরে আয়।”

তারপর মারসাদ সাগরের থেকে রেকর্ডটা নিয়ে সেখান থেকে চলে আসে। মারসাদ চলে যাওয়ার পর সাগরও সেখান থেকে চলে যায়। জামিনে মুক্ত হয়েই সে জানতে পেরেছে, তাকে পু*লবশ ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তার বাবা স্ট্রো*ক করেছে। এখন তাই সে তার বাড়িতে যাবে।

——–

“তুই কি পাগ*ল হয়ে গেছিস, মারসাদ? তুই সাগরকে বিশ্বাস করে ও-কে ছেড়ে দিয়েছিস! লাইক সিরিয়াসলি!”

রাফিন প্রচণ্ড রেগে আছে। আহনাফ ও মৃদুল বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করে চলেছে। রবিন বলে উঠে,
“কু*কুরের লে*জ সোজা হয় না। বোতলে ভরে রাখলেও হয় না।”

মারসাদ হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
“এই শত্রুতা আমার আর ভালো লাগে না। সাগরকে তো আর পু*লিশ সারাজীবন জে*লে বন্দি করে রাখবে না! একসময় না একসময় সে ছাড়া পাবে, তারপর এর থেকেও বেশি প্র*তিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠবে। তাছাড়া ও আমাকে একটা হেল্প করেছে এখন। সামিরার মুখোশ খুলে দিয়েছে। এতদিন ভাবতাম সামিরা হয়তো আদিরাকে পছন্দ করে না। কিন্তু ওর মনের মধ্যে এতো নোং*রা চিন্তা-ভাবনা!”

মৃদুল বলে,
“সাগর কি ভালো হবে? পরবর্তীতে পল্টিও মা-রতে পারে।”

আহনাফ বলে,
“খবর শুনেছি ওর বাবা স্ট্রোক করেছেন। যদি নিজেকে শোধরায়। দেখি কী হয়। সাগর তো ভার্সিটি ছেড়ে দিবে।”

“আমার সাগর ও সাগরের গ্রুপকে বিশ্বাসই হয় না।”

রাফিনের কথার আর কোনো প্রত্যুত্তর মারসাদ করলো না। সে রেকর্ডটা ঠিক জায়গায় কাজে লাগাবে তাই অপেক্ষা করছে।

——
শুক্রবার। আদিরা সকালের টিউশনি পড়িয়ে হোস্টেলে এসেছে। এসেই দেখে সেখানে আগে থেকে মাহি এসে বসে আছে। মাহি আদিরাকে দেখে বলে,
“এত সময় লাগলো আসতে?”

“তুই এখানে কিভাবে আসলি?”

মাহি তারপর আদিরাকে ইশারায় রুমমেটকে দেখায়। আদিরা ব্যাগটা রেখে বলে,
“আর কি বুদ্ধি করে এসেছিস?”

মাহি আহ্লাদ করে আদিরার পাশে বসে বলে,
“আমার সাথে বাসায় চল।”

আদিরা কপাল কুঁচকে শুধায়,
“কেন?”

“সুমিপু, রাত্রিপু, মৌমিপু, সাবু, রিন্তি সবাইকে আসতে বলেছি। আমরা সবাই মিলে পিকনিক করব।”

“ঘরের ভেতর পিকনিক?”

“হ্যাঁ ছোটোবেলায় খেলতাম। কলোনির বাচ্চারা মিলে। সবার বাড়ি থেকে তেল, চাল, ডাল আর যা যা লাগে। তা এনে। ঝোলাপাতি বলে।”

আদিরা বিষয়টা পাত্তা দিলো না। বলল,
“আমার ঘুম আসছে।”

“ঘুম আসবে না। আমরা খিচুড়ি করব আর ঝাল দিয়ে মুরগি রান্না করব। শুধু দুপুরে খেতে। সবার থেকে ৬০টাকা করে নেওয়া হচ্ছে। বাজার করার পর টাকা বাঁচলে তা দিয়ে কিছু একটা করা হবে দেখি।”

আদিরা রাজি হচ্ছিলোই না। কিন্তু মাহি টেনে জোর করে ও-কে নিয়েই গেছে।

চলবে ইন শা আল্লাহ,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে