#এক_মুঠো_সুখপ্রণয়
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#অন্তিমপর্ব_১৮
“মায়া মা তুই কি তোর বড় মায়ের সাথে রেগে আছিস?”
মায়া ফোলা ফোলা চোখে বড় মায়ের দিকে তাকায়। মাথা নেড়ে না ইঙ্গিত করে হাত দিয়ে ছবির দিকে ইশারা করে। আমি তার অনুসরণ করে ছবির দিকে তাকাতেই মুখটা মলিন হয়ে গেলো। এটুকু মেয়ে মা-হীন অনুভূতি বড্ড কষ্টময়। আমি নিজেই সেই ট্রমা এখনো বয়ে বেড়ায়। তপ্ত শ্বাস ফেলে মায়া কে কোলে নিলাম। ছবির দিক থেকে সরিয়ে তাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হলাম। বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত কবরস্থানের সামনে এসে দাঁড়ালাম। সেখানকার পাহারাদার আমাদের দেখে দরজা খুলে দিলেন। আমি মায়া কে নিয়ে একটি কবরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলাম। মায়া নাক টেনে ফুঁপিয়ে উঠে। ইশ্ মেয়েটার ফুঁপিয়ে কান্না করাটা একেবারে বুকে গিয়ে বিঁধে। এইটুকুন মেয়ের মুখে কতশত মায়ায় ভরা। মুখ থেকে আপনাআপনি ‘মাশাআল্লাহ্’ চলে আসল। সন্তপর্ণে কবরের দিকে তাকিয়ে চোখ বুজে দোয়া পাঠ করলাম। মায়া একবার তার বড় মায়ের মুখের দিকে আরেকবার কবরের দিকে তাকিয়ে নিজেও দু’হাত তুলে প্রার্থনা করতে লাগল। তখনি পেছন থেকে কেউ কাঁধে হাত রাখে। দোয়া পাঠ সমাপ্ত করে মুচকি হেসে বললাম।
“ছেলেকে নিয়ে তবে এসেই গেলেন আপনি!”
“কি করব বলো ছেলের মা যে বাসায় নেই। তাই মনও টিক ছিল না। দারোয়ান বলল তোমরা এখানে আসছো। তাই ছেলেকে জামা পরিয়ে নিয়ে আসলাম। এতে একসাথে দুই কবর জিয়ারত হয়ে গেলো। ঐ দেখো আব্বুও আম্মুর কবরের দিকে তাকিয়ে আছেন।”
শারফানের কথায় সেদিক তাকালাম। শ্বশুর আব্বু মৃত শ্বাশুড়ির কবরের দিকে তাকিয়ে চোখ মুচ্ছেন। আমি শারফান এর সঙ্গে এগিয়ে গেলাম। শ্বশুর আব্বু আমাদের দেখে চোখ মুছে স্বাভাবিক হয়ে গেলেন। হাস্যজ্জ্বল মুখে ‘মায়া দাদুভাই দাদুর কাছে আসবে?’ মায়া কে উদ্দেশ্য করে কথাটি বলেন তিনি। মায়া ঠোঁট ফুলিয়ে ‘দাদু দাদু’ বলে শ্বশুর আব্বুর কোলে উঠে পড়ল। শ্বশুর আব্বু মায়ার সাথে মজা করে কথা বলছেন। আমি শারফানের কোলে থাকা আমার আর শারফানের প্রথম পুত্র সন্তান শাহেদ মারুফ সদ্য দুবছরের সন্তান আমাদের। মায়া শেরহাজ আর মিমলির প্রথম কন্যা সন্তান মায়া মারুফ সবে তিনবছর চলছে তার।অথচ পাকনা বুড়ি একটা। এইটুকুন বয়সে দুষ্টুমির সেরা। শেরহাজের জান যায় যায় অবস্থা হয়ে পড়ে। তবুও সে তার দেবরকে দেখেছে। স্বচক্ষে দেখেছে এইটুকুন বাচ্চা পেলেও সে খুশি। সে খুশি তার বউহীনা। দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এলো হৃদয়ের গোপনচিত্ত ভেদ করে। শারফান আমার কাঁধ ধরে তার বাবার উদ্দেশ্যে বলে,
“চলো আমাদের এবার ফেরা যাক। অনেকক্ষণ হলো এসেছি। আকাশের অবস্থাও মেঘলা। বৃষ্টি হতে পারে।”
শ্বশুর আব্বুর সাথে আমিও সহমত পোষণ করলাম তার কথায়। একসঙ্গে বাড়িতে এসে হাজির হলাম। শারফানের কোলে শাহেদ কে দিয়ে মায়া কে কোলে নিয়ে রান্নাঘরে গেলাম। চেয়ারে বসিয়ে রেখে নিজ হাতে সবটা প্রস্তত করতে লেগে গেলাম। দুঘণ্টা পর জোহরের আযান পড়ে। শারফান শাহেদকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। বিধেয় সে শান্তিমনে তার বাবার সাথে জোহরের নামাজ পড়ার জন্য তৈরি হয়ে গেলো। আমি হাতের কাজটুকু করে মায়া কে নিয়ে রুমে আসলাম। শাহেদের পাশে বসিয়ে তাকে বললাম।
“মা আমার তোর ছোট ভাইটারে একটু দেখে রাখিস। ঘুম ভাঙ্গার পর প্রচুর কান্না করে সে। তাই কান্না করতে চাইলেই মাথায় হাত বুলিয়ে দিস কেমন?”
মায়া মাথা নাড়ল। আমি শারফান এর কাছে গিয়ে মায়ার চোখের আড়ালে একচুমু খেয়ে দিলাম। শারফান চমকে গেলেও হাসল। লাজুকতা ফুটেছে আমার স্বামীর চেহারায়। তিনি আমার কপালে চুমু এঁকে বেরিয়ে গেলেন। আমি মায়ার কাছে ছেলেকে রেখে গোসলে চলে গেলাম। গোসল সেরে এসে দেখি ছেলে-মেয়ে দুটোই একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। মুচকি হেসে চুলের থেকে তোয়ালে খুলে আয়নার সামনে গিয়ে চুল মুছতে লাগলাম। তখনি গরম শক্তপোক্ত হাতের স্পর্শ কোমরে পড়তেই শরীর শিউরে উঠল। শারফান তার বউয়ের কাঁধে মুখ এগিয়ে ঘন এক ঘ্রাণ নিলো চুলের থেকে। নেশালো কণ্ঠে বলে উঠে।
“জানেমান আজ রাতে আমার জন্য সাজবে?”
নিসংকোচ প্রেমের আবেদন পেয়ে কি আর তা হেলা করা যায়? লাজুক হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলাম। পরক্ষণে মায়া আর শাহেদ এর কথা মাথা আসতেই শারফানের দিকে ঘুরলাম। সেও কিছুটা ঘোর থেকে বেরিয়ে এলো। তবুও কোমর ছাড়ল না। চিন্তাময় গলায় বলে উঠলাম।
“কিন্তু শাহেদ আর মায়ার কি হবে? আব্বুর শরীর প্রায় অসুস্থ থাকে। উনার কাছে বাচ্চাদের সামলানোর জন্য দিতে ইতস্তত লাগে। শেরহাজ তো দেশের বাহিরে গিয়েছে এখন আসার কথা নয়। তাহলে আপনি যে আবদার করছেন।”
শারফান মৃদু হেসে আমার গাল ধরে বলেন,
“শেরহাজ আজই আসছে। তার সামনে ইয়ার ভেকশনের ছুটি। তাই আজকে বিকালের ফ্লাটেই চলে আসছে। কতদিন আর বাহিরের আউল ফাউল খাবার খাবে। এবার নাকি তার ভাবীর হাতের রান্না খেতে আসবে।”
শেরহাজ আসার খবরে খুশি হলাম খুব। এমনিতে বেচারা মেয়ের বাপ হয়ে মেয়েকে সময় দেয়, পড়াশুনাও করছে , জবও করছে। তার মত ছেলেরা প্রায় ধনীর আদরের রাজপুত্রের মত চলে। সেখানে শেরহাজ একেবারে শারফানের মত বুঝদার হয়ে গেলো। এই যেনো ঢের খুশির। আমি শারফানকে বাচ্চাদের দেখে রাখতে বলে রান্নাঘরে গেলাম। কেননা শেরহাজ আসবে তাহলে কিছুটা রান্নার আইটেম বাড়ানো উচিৎ। সেই ভেবে বিরিয়ানির জন্য মশলাপাতি বের করে কাজের বুয়াকে কাটাকুটি করতে বসিয়ে দিলাম। বিরিয়ানি, ভুনা চিংড়ি, রোস্ট আইটেম করলেই যথেষ্ট। কাজের বুয়া কাটাকুটি করতে থেকে মুখে পান এঁটে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
“আপা মিমলি আপার কথা বহুত মনে পড়ে। আহা কত অভাগী ছিল মাইয়াটা। যহন এ বাড়িত আইল তহনো অপমান হইল। যহন ছোট সাহেবের লগে বিয়া হলো তহন ও অবহেলায় মরতো। যাও আপনি আইয়োনের পর সুখের দিন পাছিল। তাও কুয়ে দিলো বাচ্চার লাইগা। ছোট সাহেবের লাই বহুত মনে কাঁদে আপা। ছেলেটার যৌবনের দার শেষ হওয়ার আগেই মিমলি আপা মইরা গেলো। ছোট সাহেব কেনে নিজেরে সামলাই আর তো অবাক লাগে।”
কাজের বুয়া প্রায় বছরখানেক হচ্ছে এ বাড়িতে কাজ করেন। তাই তার কথাগুলো স্বাভাবিক বলা। কিন্তু মিমলির পরিণতির কথা ভাবলেই বুক কামড়ে উঠে। সেই দিনের কথাগুলো আজও চোখ ভাসে।
অতীত….
মিমলি কে না দেখে আমি শেরহাজকে খবর পাঠায়। সেও চিন্তিত হয়ে চারদিক খোঁজা শুরু করে। তখনি মিমলির মা কল দিয়ে কান্নার সুরে বলে, ‘বাবা শেরহাজ আমার মেয়ের কি হয়েছে? ও বাসায় এসেই আমায় বকেঝকে রুমবদ্ধ হলো। ও বাবা আমার মেয়েটারে বাঁচাও। একটা মাত্র নাড়িছেঁড়া ধন আমার।’
শেরহাজের ফোন লাউডে ছিলো। মিমলির মা অর্থাৎ আমার চাচী শ্বাশুড়ির কথায় চমকে গিয়েছি আমরা। তৎক্ষণাৎ বিয়ের আমেজ শেষ করে রওনা দিলাম চাচী শ্বাশুড়ির বাড়িতে। অন্যদিকে মিমলি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সুন্দররুপ কে ঘৃণার সহিতে নানান কথা চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে বলছে। রুমের দরজার বাহির থেকে মিমলির মা মিসেস জাহানারা দরজায় হাত পিটিয়ে খুলতে বলছেন। মিমলির বাবাও পরিস্থিতি বুঝে উঠতে পারছেন না। তিনিও চিন্তিত হয়ে স্ত্রীকে সরিয়ে দরজায় হাত পিটিয়ে খুলতে বলছেন। কিন্তু মিমলির কানে সেসব কথা যাচ্ছে না। সে তার রুমে থাকা ফলের ঝুড়ি থেকে ছুড়ি নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। নিজের হাতের উপর ছুড়িটা রেখে কান্নার সুরে নিজের মত বিড়বিড় করতে লাগে। তখনি শেরহাজের আওয়াজ শুনে সে থমকে গেলো। শেরহাজ দরজার বাহির থেকে জোরে জোরে দরজা পিটিয়ে খুলতে বলছে। তার নাম ধরে ডাকছে। মিমলির হাতে থাকা ছুড়িটা কাঁপছে। বুকের ভেতর কম্পন বেড়ে গিয়েছে তার। শেরহাজের পরিবার মাত্রই এসেছে। পরিস্থিতি কি হচ্ছে বুঝতে না পেরে শেরহাজও তাল মিলিয়ে দরজা পিটিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভেতর থেকে মিমলির সাড়াশব্দ না পেয়ে তার মাঝে ভয় হানা দিলো। সে শারফান কে ইশারা করে কাছে ডাকে। দুভাই একত্রে ধাক্কা মারল দুবার। তৃতীয়বার আঘাত করতেই দরজা খুলে যায়। ভেতরে নজর পড়তেই দেখে ছুড়ি মাটিতে পড়া কিন্তু রক্তের ছিটেফোঁটা নেই। মিমলি ছুড়ির পাশেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। শেরহাজ চমকে তৎক্ষণাৎ মিমলিকে খুলে নিয়ে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরের হাসপাতালে নিয়ে এলো। সকলে ডক্টরের কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি শেরহাজ কে কি বলে শান্ত্বনা দেবো বুঝছি না বিধেয় শারফানকে ইশারা করলাম। সেই গিয়ে শেরহাজকে জড়িয়ে ধরে চিন্তামুক্ত থাকতে বলে। ঘণ্টাখানেক পর ডক্টর এসে পেশেন্ট এর হাসবেন্ড এর কথা জিজ্ঞেস করেন। তার কথামত শেরহাজ এগিয়ে গেলো। তখনি ডক্টর সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ দেয়। মিমলির স্কিন ক্যানসার হয়েছে। শুনেই থম মেরে গেলো পুরো পরিবার। মিমলির মা মিসেস জাহানারা মাথা চেপে ধরে ধপ করে বসে গেলেন। মিমলির বাবা স্তদ্ধ । স্ত্রীর সাথে যতই মনোমালিন্য থাকুক না কেনো মেয়েকে নিয়ে তার মনে কখনো বিরুপ প্রভাব ছিল না। মেয়ে কালো বর্ণধারী হলেও তার চোখের অগোচরে মেয়ের খেয়াল রাখা, আবদার পূরণ করা কখনো মেয়েকে বুঝতে দিতেন না যে, তিনি মেয়েকে ভালোবাসেন। আজ মেয়েই কি তবে অভিমান করে এত বড় রোগ বাঁধালো। ওহ তারা তো পাপী! তাদের কারণেই তাদের শাস্তি তাদের মেয়ের উপর এসে পড়েছে। শেরহাজ কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে।
“এএসব কি বলছেন আপনি ডক্টর? পেশেন্ট একেবারে নরমাল আছে বোধহয় আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। প্লিজ আরেকবার দেখুন না।”
ডক্টর রিপোর্ট দেখিয়ে দেয়। এমনকি এর চিকিৎসা সূত্র বলার পর বলেন,
“এর কেমোথেরাপিতে বাচ্চাকে বাঁচানো যাবে না। তাই যদি চিকিৎসা করাতে চান তবে বাচ্চা হারাতে হবে। কিন্তু সেটা যদি প্রথমবার হতো তবে মানা যেতো। কিন্তু কেমোথেরাপির ফলে জরায়ুর মুখে ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে আপনার স্ত্রী মা হওয়ার ক্ষমতা হারাবেন। এখন যদি বাচ্চা চান তবে ধরে রাখুন মিসেস শেরহাজ এর আয়ুষ্কাল আনুমানিক দুবছর হতে পারে অথবা তারও কম। এটি সম্পূর্ণ আল্লাহর উপর নির্ভর করে। এতে বাচ্চা পাবেন ঠিক তবে স্ত্রী হারাতে হবে। দ্যাটস ইট।”
ডক্টরের কথায় শেরহাজ টলে পড়ল মাটিতে। শারফান আর শ্বশুর আব্বু মিলে নার্স সমেত শেরহাজকে কেবিনে শুয়ে দেয়। ডক্টর পালস চেক করে সবাইকে কিছুক্ষণের জন্য শেরহাজকে কেবিনে রেখে বের হতে বলেন। যাওয়ার আগ মুহূর্তে থামিয়ে বলেন,
“আপনার ভাই চাপ সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারিয়েছে। নার্থিং ডেঞ্জারাস।”
শারফান মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেলো। বাহিরে এসেই জ্বলন্ত চোখে মিসেস জাহানারার কাছে গিয়ে তার গলা টিপে ধরল। শারফানের রাগের বশে করা কাজটা দেখে হতভম্ব হয়ে দ্রুত তার হাত সরিয়ে নিলাম। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)মিসেস জাহানারা কান্নার সঙ্গে গলার ব্যাথায় কাঁদতে কাঁদতে সিটের উপর বসে পড়লেন। আমি শারফানকে চেপে ধরে রেখেছি। কিন্তু তার হিংস্রতা কমছে না। তাকে চেপে ধরে কান্নার সুরে বলে যাচ্ছি।
“প্লিজ প্লিজ নিজেকে সামলে নেন। এখন লড়াইয়ের সময় নয়। শেরহাজকে আপনার থেকে সামলাতে হবে।”
“আরে কি সামলাবো তুমিই বলো? শেরহাজের আগের অভ্যাসের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। ছেলেটা তার ভালোবাসা কে হারিয়ে পাগলপ্রায় হয়ে নেশায় মগ্ন হয়ে ছিল। সেই কারণটাও এই মহিলার জন্য। ডাইনি কোথাকার তোর নাকি সংসার আছে যে শুধু। ছিঃ তোর মুখে তো থুথু মারি। আপনি বলতেও ঘৃণ লাগে আপনাকে। মিমলির জীবনটা একেবারে নষ্ট করে দিয়েছেন আপনি। শুনছেন আপনি নষ্ট করেছেন।”
মিমলির বাবা সেই জায়গার থেকে উঠে ধীরপায়ে মেয়ের কেবিনের গ্লাস দিয়ে ভেতরে নজর দেন। মেয়েকে নিস্তেজ পড়ে থাকতে দেখে চোখের সামনে মেয়েটির বাচ্চাকালীন সময়ের দৃশ্য চোখে ভাসে। তিনি নিজ হাতে মেয়েকে খাওয়ে দিতেন,খেলতেন,আদর করতেন। কিন্তু যত মেয়ে বড় হতে লাগে তত তিনিও দূরত্ব টেনে পর করে দিলেন একেবারে। আজ তারও বুক ফাটছে মেয়ের করুণ কষ্টে। আচমকা তিনি বুকে হাত চেপে ঢলে পড়লেন। জয়নাল মিয়া তাকে ধরে জোরে জোরে শারফানকে ডাকেন। শারফান তৎক্ষণাৎ ডক্টর নিয়ে এলেও কাজ হলো না। তিনি আফসোসের গলায় বলেন,
“সরি মিস্টার শারফান। উনি হার্ট অ্যাটাক করেছেন। হয়ত মেয়ের সাথে হওয়া রোগের করুন দৃশ্য সহ্য করতে পারবেন না দেখেই তিনিও…।”
জয়নাল মিয়া মাথায় হাত চেপে চোখের পানি ঝরাচ্ছেন। আমি নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে আছি। আজ পুরো পরিবার মাতমে পূর্ণ। কান্না আর কান্নার রোল চলছে। শারফান চুপটি করে চাচার শরীরকে দাফনের জন্য তৈরি করতে বলেন নার্সদের। কিন্তু মিসেস জাহানারা এসে থামিয়ে দিলেন। করুণ গলায় বলেন,
“স্বামী আমার মরেছে তার দাফনের কার্য আমাকে করতে দাও বাবা। আমার পাপের শাস্তি আমার পরিবার ভোগে ফেলেছে। হয়ত আমারও ভোগতে হবে তবে দেরিতে।”
মৃদু হেসে তিনি নার্সদের সাহায্যে লাশ নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। শারফান দেখে গেলো শুধু। থামালো ও না সাহায্য ও করল না। আমি এগিয়ে শারফানের কাঁধে হাত রাখলাম।
ঘণ্টাখানেক পর মিমলির জ্ঞান ফেরে। সে নিথর দৃষ্টিতে পুরো পরিবারের দিকে তাকায়। কেউ তাকে তার বাবার মৃত্যুর খবর এখন দিলো না। নাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে। মিমলি উঠতে চাইলে শেরহাজ চোখ রাঙালো। আমি গিয়ে মিমলির পেটে হাত রেখে বললাম।
“এত বড় রোগ নিয়ে আমাদের জানালে না। আমরা কি এতটাও পর?”
মিমলি কেঁদে ফেলল। সে শেরহাজ এর হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলে,
“ভাবী আমার স্বামীকে দেখে রাখিয়েন। আমার যাওয়ার পর সুন্দর এক মেয়ের সাথে তার সংসার পাতিয়ে দিয়েন ভাবী। আমি যে বড্ড অবেলায় তাকে ছেড়ে চলে যাবো।”
কথাটা সে শেরহাজের দিকে তাকিয়ে বলে। আমি শারফান আর শ্বশুর নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। স্বামী স্ত্রী মধ্যকার কান্নার মাঝেও যেনো সুখ খুঁজে পায় সেই প্রত্যাশায়। শেরহাজ মিমলিকে বুকে নিয়ে বলে,
“এই মেয়ে তুই ভাবলিও কেমনে তোকে আমি ছেড়ে দেবো? হুম আমাকে ছেড়ে চলে যাবি তাই বলে আরেকজন কে তোর জায়গায় বসাবো। তোর জ্বলবে না?”
মিমলি শুনেই কুটিকুটি কেঁদে শেরহাজের বুক ভাসাতে থাকে। শেরহাজও মনকে মানিয়ে নিলো।
এভাবে বছর ঘুরতে লাগল। একবছর পর মিমলির বাচ্চা সুস্থ ভাবে হলেও মিমলি অসুস্থ থাকে প্রায়। তার শরীর আর কেমোথেরাপি নেওয়ার মত অবস্থায় নেই। বুকে দুধ খুব কম আসে তার। খাওয়া দাওয়া করলেও বেশিক্ষণ পেটে রাখতে পারে না। বমি করে দেয়। তার সদ্য জম্মানো শিশু। যার নাম মায়া রেখেছে শেরহাজ। তাকে নিয়ে খুব কষ্টে দিনযাপন করতে থাকে। নার্স রেখেছে মিমলির অসুস্থ শরীরকে পরিষ্কার রাখার জন্য। কেননা আমি আর শেরহাজ মিলে বাচ্চা সামলায়। মিমলির রুমে গিয়ে দেখি। মায়া মিমলির বুকের কাছে মুখ দিয়ে রেখেছে। মিমলির চোখ থেকে পানি পড়ছে। যা দেখে তৎক্ষণাৎ মিমলিকে টেনে বিছানায় শরীর হেলিয়ে বললাম।
“কি করছো তুমি মিমলি? মায়া কে এই অসুস্থ শরীরে খাওয়াছো কেনো? তোমার শরীর আরো দূর্বল হয়ে যাবে।”
মিমলি কান্নার মাঝেও তৃপ্তির গলায় বলে,
“ভাবী মারাই তো যাবো। যাওয়ার আগে অন্তত মেয়েটাকে শেষ কয়েকদিন বুকের দুধ খাওয়ে নেয়। আপনাকে একটা অনুরোধ করব ভাবী। আপনিও তো গর্ভবতী এখন। আমার মারা যাওয়ার পর আমার মেয়েটার দুধমাতা হবেন প্লিজ ভাবী। মেয়েটাকে শেরহাজ যতই পাউডার দুধ খাওয়াক না কেন! সেগুলোতে মায়ের মমতা থাকে না। একপ্রকার কেমিক্যাল সেগুলো। আপনি আমার অনুরোধটা রাখিয়েন ভাবী প্লিজ। কবে মরে যায় ঠিক নেই। ডক্টরে তো দুবছর বলেছিল অথবা যখন আল্লাহ চাই চলে যেতেই হবে। এখন আর শরীর মানতে চাইনা ভাবী। কখন না কখন শরীর নেতিয়ে পড়ে আল্লাহ জানেন।”
মিমলির কথায় নিজেও উদাসী হয়ে পড়লাম। পেটে হাত রেখে মায়ার সদ্য এগারো মাসের কন্যার দিকে তাকিয়ে আছি। মায়া মায়ের বুকের দুধ কতটা তৃপ্তি সহকারে গ্রহণ করছে। আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম।
“তুমি একেবারে চিন্তা করো না। মায়া আমারো মেয়ে ও আমার বড় সন্তান।”
“ভাবী মায়ার জন্ম তো দেখে ফেলেছি। তার বাড়ন্ত সময় হয়ত আমার আর দেখা হবে না। ওর একটা সুন্দর জীবন গড়িয়েন। তার রুপ নিয়ে কখনো তিরস্কার করিয়েন না। আমার মেয়েটা শ্যামী কিন্তু কালো নয়। শেরহাজের মাথার তাজরাণী মায়া।”
“এই মেয়ে তুমি আবারো আগের কথা শুরু করেছো। তোমার মায়ের কথা মনে পড়ছে?”
মিমলির চোখজোড়া ভিজল পুনরায়। জানি তার মন খারাপ হয় মায়ের জন্য। তার মা যাবত কয়েকদিন বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে আছেন। তিনিও মৃত্যুর দিন গুণছেন। চাচী শ্বাশুড়ির চিকিৎসার পূর্ণ দায়িত্ব পালন করে চলেছে শেরহাজ। মিমলিকে মাঝেমধ্যে শেরহাজ মায়ের সাথে দেখা করিয়ে আনে। এতে মা-মেয়ের মধ্যকার মনোমালিন্যের সমাপ্তি হয়ে যায়। মায়াকে খাওয়ে বিছানায় শুয়ে দিলো। কি সুন্দর ঘুমিয়ে গেলো মেয়েটা। আমি মিমলির পাশেই বসা রইলাম।
তিনবছর পর….
মায়া ধীরে সুস্থে কথা বুঝতে শিখেছে। বড় মা বলতেই সে পাগল। তবে খুব কম কথা বলে। শেরহাজের সাথে থাকলে একে বারে কথার ঝুড়ি নিয়ে বসে। মায়ার মা মিমলি আচমকা শেরহাজের পাশে বসারত অবস্থায় মেয়েকে বুকের দুধ খাওয়ানোর মাঝে শরীর কেঁপে ঢলে পড়ে। তখনি কান্নার রোল ছেয়ে যায় পুরো বাড়িতে। মিমলি সেসময় মারা গেলেও মায়া চোখ পিটপিট করে খালি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি গিয়ে তাকে বুকে নিয়ে ঘুম পাড়ায়। তারপর থেকে খাওয়ার সময় আমিই তাকে খাওয়ে দেয়। আমার দুবছরের পুত্রসন্তান শাহেদ ততটা কান্না করে না। খাওয়ার সময়ই কাঁদে। তখন আমি খাওয়ে দিলি সে ঘুমিয়ে যায়। মায়া তো ছোট বাবু পেয়ে খুশিতে প্রাণভরা হাসে খেলে থাকে।
বর্তমান….
হঠাৎ কারো ডাকে চমকে অতীত থেকে ফিরলাম। তেল পাতিলে লেগে ছাইছাই হয়ে গেলো। কাজের বুয়া আমাকে সরিয়ে পাতিলটি বেসিনে রেখে নতুন পাতিল বসায়। আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
“আপা আপনি ভাবনায় এতো ডুব্বা গেলেন। যে গন্ধ অব্দি পেলেন না। আজ অঘটন ঘটে যাইতো।”
“ক্ষমা করবে আন্টি। আপাতত আপনিই কাজগুলো করে রাখুন। আমি একটু মায়ার কাছে যায়।”
“হই আপা যান সমস্যা নাই।”
মায়া আর শাহেদকে নিয়ে সোফার রুমে বসে আছি। মায়া শাহেদের দোলনার পাশে ছুটাছুটি করে হাঁটছে। কাজের বুয়া রান্না শেষ করে চলে গেলো। আমি অপেক্ষা করছি শারফানদের জন্য। তিনি আর শ্বশুর মিলে শেরহাজকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্ট গিয়েছেন। মায়ার কাছে শাহেদকে রেখে চটজলদি শরবত বানিয়ে রাখলাম।
একঘণ্টা পর বাড়ির বেল বেজে উঠে। আমার আগেই মায়া গিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করে। কিন্তু ছোট হাত হ্যান্ডেল পর্যন্ত পৌঁছে না দেখে আমিই তাকে কোলে নিয়ে হ্যান্ডেল চেপে দরজা খুলে দিলাম। শেরহাজ কে দেখে মেয়েটা ‘বাবাবাবা’ বলে কোলে উঠার জন্য পাগলাটে ভাব ধরল। মেয়েকে অনেক দিন পর দেখে শেরহাজের চোখে জল চলে আসল। সেও মেয়েকে কোলে উঠিয়ে হেঁটে সোফার রুমে এসে বসে পড়ে। বাপ-মেয়ে নানান কথায় মশগুল হলো। আমি তার মাঝে খাবার পরিবেশন করতে গেলাম। শাহেদকে দেখে শেরহাজ খুলে নিয়ে চুমু খেয়ে ভাইয়ের হাতে দিয়ে দেয় ফ্রেশ হবার জন্য। মায়াও আজ বাবার সাথে খেতে বসবে বলে টেবিলের কাছে এসে বসে গেলো। তার জন্য টেবিলে তেমন কোনো খাবার রাখা নেয়। তবে আমি বুদ্ধি করে খিচুড়ি ব্লেন্ড করে ফিডারে ভরে রেখেছি। শেরহাজ সেটাই খাওয়ে দেবে মায়াকে। হঠাৎ আমাকে টেনে দেওয়ালে চেপে ধরল শারফান। তার কান্ডে ভয় পেলেও পরক্ষণে স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। সে প্রতিবার আমার সাথে এমনটা করে। আমার চুলের কানের পেছনে গুঁজে ফিসফিসিয়ে বলে,
“আলমারির ড্রয়ারে যে স্লিভলেজ ব্লাউজের সাথে শাড়ি দেখবে সেটাই পড়িও আজ রাতে।”
আমি চুপটি করে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে চলে আসলাম। নাহলে লোকটার অসভ্যতামি থেকে রেহাই পাবো না।
রাত বারোটা
শেরহাজ মায়াকে কোলে নিয়ে বেলকনিতে বসে আকাশের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে। মিমলি তাকে ছেড়ে গেলেও সে তো নিজেকে সামলে নিয়েছিল। কিন্তু তবুও তার ভাগ কাউকে দেয়নি। মেয়েকে নিয়েই তার যতস্বপ্ন। শেরহাজকে তার মেয়ের সাথে বেলকনিতে দেখে রুমের দরজা আলগা করে চলে এলাম রুমে। ঘুমন্ত শাহেদের কপালে চুমু এঁকে ছাত্রদের খাতা কাটা অবস্থায় শারফানের দিকে নজর দিলাম। ইচ্ছে করছে লোকটার কাজে বাঁধা দিতে। ইতস্তত বোধ না করে তার কাছে গিয়ে খাতা বন্ধ করে তার কোলে বসে গেলাম। তার বুকে মাথা রেখে বললাম।
“আমি খু*নি জেনেও কেনো আপনি প্রতিবাদ করলেন না?”
“সেটা তোমার অতীত ছিলো। এখন তুমিই বর্তমান তুমিই ভবিষ্যৎ। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শাহেদ পরবর্তীতে আরো আসলে আসবে।”
লাজুক হেসে তার বুকে মৃদু চাপড় মেরে মুখ গুঁজে রইলাম। বিড়বিড় করে বললাম।
“আমার এক ফালি রোদ্দুরের বিনিময়ে আপনার কাছে আমি সমর্পণ করলাম নিজেকে।”
শারফান কথাটির ধারে আমায় কোলে উঠিয়ে বিছানায় শুয়ে তার বুকে রেখে বলে,
“আপনার আগমনে আমি স্বার্থক বাবা। আপনার কাছ থেকে #এক_মুঠো_সুখপ্রণয় পেয়ে আমি সুখের রাজ্যে রাজত্ব করি গো।”
মুচকি হেসে চোখ বুজে নিলাম দু’জনে। এভাবেই হয়ত এক মুঠো সুখপ্রণয় তাদের মাঝে চলতে থাকবে।
সমাপ্ত