#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ২৫ |
———————–
–“এই কোক আমার ছিলো নিদ্র ভাইয়া! তুমি কেন আমার কোক এভাবে খেয়ে ফেললা! তোমার নামে কোক চুরির মা!মলা করবো! এখুনই যাবো আমি পুলিশ কাক্কুদের জেলখানায়।”
এমন সময়ই নূরজাহান প্রবেশ করলো হাতে খুন্তি নিয়ে। চোখ দিয়ে গিলে ফেলবে এমন একটি চাহনি নিক্ষেপ করলো নিদ্র’র পানে। কাঠ কাঠ গলায় বললো,
–“ফ্রিজে কোক রাখা ছিলো সেটা কোথায়?”
ইরা’দ এবার যা বুঝার বুঝে নিলো। তাই নিদ্র কিছু বলার পূর্বেই ইরা’দ বলে ওঠে,
–“আসলে চাচী, খুব ক্লান্ত ছিলাম তাই আমি-ই কোকটা নিয়েছি। গলা ভেঁজানোও শেষ!”
নূরজাহান নরম হলেন। মূলত কোক এনেছিলেন মেহমানদের জন্য। যাতে যখন তখন মেহমান আসলে আপ্যায়নের বিষয়টি কভার করা যায়। ইরা’দ খেয়েছে বলে কিছু আর বললো না। চলে গেলো। নূরজাহান চলে যেতেই ইরা’দ প্রাণখোলা, শব্দের সাথে হেসে ওঠে। নিদ্র’র এতক্ষণে মুখটা একটুখানি হয়ে গেছে। মুখ ঘুঁচে দাঁড়িয়ে আছে। ইরা’দ হাসতে হাসতে বলে,
–“চুরি বিদ্যা মহা বিদ্যা যদি না পরো ধরা। তোকে তো আমি বাঁচিয়ে দিলাম, হারাম খাওয়া থেকে। এখন? কে চুরি করেছে বল তো? কার নামে মা!মলা দেয়া উচিত?”
নিদ্র শুকনো ঢোঁক গিলে ইরা’দের দিকে ভীতগ্রস্ত নজরে তাকালো। ইরা’দ শব্দহীন হাসি দিয়ে বলে,
–“এনে দিবো দু বোতল। সমস্যা নেই!”
নিদ্র এবার আনন্দে লাফিয়ে উঠলো। দুলতে দুলত্র চলেও গেলো। নওরি নিদ্র’র যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হাসলো। ইরা’দ এবার নওরির দিকে ফিরে বলে,
–“আপনিও তৈরি হয়ে নিন জনাবা।”
নওরি চমকে তাকালো ইরা’দের পানে। ইরা’দ যেন নওরির চাহনি বুঝলো।
–“সেদিন কী বলেছিলাম, মনে আছে? এত দ্রুত ভুললে চলে নাকি?”
নওরি আমতা আমতা করে বলে,
–“আ..আসলে!”
–“কোনো অযুহাত নয়। দশ মিনিট দিচ্ছি। রেডি হয়ে দ্রুত আসো! আমি অপেক্ষায় আছি।”
——————
নওরি মুগ্ধ হয়ে এক ফুলের দিকে তাকিয়ে আছে। এই ফুলগুলো ইরা’দের বাসাতেও আছে। হলুদ, ছোট ছোট ফুল। সবুজের মাঝে থোকা থোকা হলুদের প্রতীক। মূলত এগুলো ডেইজি ফুল। ডেইজি ফুল নানান রঙের হয়, গোলাপের মতো। নওরি গোলাপের সাথে এই ফুলকেও ভীষণ পছন্দ করে। নওরি এক মুঠো ফুল হাতে নিলো। ঠিক তখনই ইরা’দ এসে হাজির হয়। মুঠো ভর্তি ফুলগুলোর দিকে চেয়ে বলে,
–“আমায় দিবে এক মুঠো প্রেম রঙ্গনা? আমি তাদের প্রেম অনুভূতিতে আগলে নিবো আমার বুকপকেটে। ঘ্রাণ নিবো, প্রেমের ঘ্রাণ! তুমি চেয়ে দেখবে বুকপকেট রাঙানো প্রেম রঙ্গনাকে। কী সুন্দর হবে তাই না?”
নওরি অবাক নজরে চেয়ে রয় ইরা’দের দিকে। ইরা’দের চাহনিতে আজ অন্যকিছু আছে। একদম ভিন্ন কিছু। আবেদনময়ী চাহনিতে চেয়ে আছে সে নওরির পানে। কী বলবে বা বলা উচিত ভেবে পেলো না। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেলে ইরা’দ আর উত্তরের অপেক্ষা করে না। হৃদয়কে সান্ত্বনা দিলো, নওরির জন্যে উত্তর দেবার সময় হয়নি৷ এখনো তাঁর সময়ের প্রয়োজন। আরেকটু অপেক্ষা করলে কী-ই বা হয়? ইরা’দ ফোঁস করে কথা ঘুরিয়ে বলে,
–“আচ্ছা বাদ দাও। হসপিটাল এবং এতিমখানা থেকে ঘুরে এসে কেমন লাগলো।”
নওরির হুঁশ আসলো। ব্যথিত নয়নে চেয়ে রয় ইরা’দের পানে। মাঝেমধ্যে ছলছল-ও করে উঠছে দৃষ্টি জোড়া। মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে,
–“কেন আমায় ওসব জায়গায় নিয়ে গেলেন? আমার বিষণ্ণ মন যে আরও বিষণ্ণ হয়ে পরেছে।”
–“নিয়ে গেছি আমার কথাগুলোর সত্যতা প্রমাণ করার জন্যে। দেখো নৌরি ফুল, কোনো মানুষ-ই প্রকৃত সুখী নয়। “আমার মতো কষ্টের ভাগীদার আর কেউ নেই, কেন ভাগ্য একটু সুখ দেয় না, কেন আমার ভাগ্যে সুখ লেখা নেই” ইত্যাদি অনেক বাক্য-ই আমরা সচরাচর বলি। অথচ দেখো, কতশত মানুষ বাঁচার জন্যে লড়াই করছে, একটুখানি সুখ পাবার জন্যে কাঁতড়াচ্ছে কিন্তু তাও তাঁরা হাল ছাড়েনি।
এতিম বাচ্চাগুলোকে দেখেছো? তাঁরা বাবা-মা ছাড়াও হেসে, খেলে বেড়াচ্ছে। নিজের জন্য বাঁচছে তাঁরা। তাঁরা নিজেদের জীবনটাকে মেনে নিয়েই কিন্তু হাসছে, প্রাণখুলে। এমতাবস্থায় তুমি শক্ত হতে পারছো না? পাবলিক ভার্সিটি ছাড়াও আরও অপশন আছে তোমার জন্যে! সেখান থেকে একটা চুজ করে নাও। রুম বন্দী থাকলে কী তুমি পাবলিকে চান্স পেয়ে যাবে?”
নওরি ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে “না” জানায়। ইরা’দ তাঁর দিকে দুই ধাপ এগিয়ে যায়। মৃদু গলায় আওড়ায়,
–“যা বলেছি বুঝেছো?”
–“বুঝেছি।”
–“কতটুকু?”
–“এতদিন ভ্রমে ছিলাম। হাসপাতালে গিয়ে নিজের সুস্থ, সবল জীবন উপলব্ধি করেছি। এতিমখানার বাচ্চা গুলোকে দেখে মনোবল পেয়েছি।”
–“দ্যাট’স লাইক এ গুড গার্ল। তাহলে প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি হচ্ছো তো?”
নওরি নিশ্চুপ। ইরা’দ নওরির নিশ্চুপতা সম্মতি হিসেবে গ্রহণ করে নিলো। নওরির দিকে ঝুঁকে জানায়,
–“টাকার কথা চিন্তা করতে হবে না। বড়ো’রা আছেন। তাঁরা তোমায় পড়াবে। কখনো নিজেকে একা মনে করবে না, ঠিকাছে?”
——————–
অবশেষে নওরি প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি হলো। ভার্সিটি বাসা থেকে প্রায় পঁচিশ, ছাব্বিশ মিনিটের পথ। রিকশা করে গেলে পনেরো মিনিট লাগে। ইরা’দ প্রতিদিন রিকশা ঠিক করে দেয় আর নওরি প্রতিদিন সেই রিকশা করে যায় এবং আসে। ভার্সিটি ছুটি হলে নওরি প্রায়-ই দেখে ইরা’দ রাস্তার ওপারে বাইক নিয়ে বসে আছে। অবশ্য মাস্ক এবং সানগ্লাস থাকে। তবে নওরির তাকে চিনতে অসুবিধা হয় না। নওরি নিকাবের আড়ালে মুচকি হেসে একটি রিকশা ডেকে উঠে পরে। মনের মধ্যে বিরাট প্রশান্তি অনুভব হচ্ছে। অনুভূতি’রাও কেন যেন আজকাল ভীষণ জ্বালাচ্ছে নওরিকে। নওরি রিকশা করে প্রায় কিছুটা চলে আসতেই তাঁর ফোন ভাইব্রেট করে উঠলো। বয়াগ থেকে ফোন বের করে দেখলো ইরা’দ কল করেছে। মুচকি হেসে কল রিসিভ করে কানে লাগিয়ে বলে,
–“হ্যাঁ, নিদ্র সাহেব বলুন!”
নওরির এরূপ ব্যবহারে ইরা’দ বেশ চমকালো। চমকানো সুরে বললো,
–“আবার বলো তো, শুনতে পাইনি!”
–“আবার মানে?” ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসলো নওরি।
–“যা বলেছো সেটা রিপিট করো কুইক!”
নওরি নিঃশ্বাস ফেলে আলতো স্বরে বলে,
–“হ্যাঁ নিদ্র সাহেব বলুন!”
ইরা’দ সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে ফেললো। তাঁর হৃদয়ের বাগানে যেন শত রঙিন প্রজাপতির আনাগোণা হয়েছে। হৃদয় উড়ছে যেন তাঁর। নিজেকে সামাল দিয়ে ইরা’দ বললো,
–“চলে গেছো?”
–“হ্যাঁ।”
–“আমি তো দেখলাম না।”
–“আপনি-ই তো বলেছেন আমাদের দেখা করাটা সম্ভব না।”
–“হ্যাঁ তা ঠিক। আচ্ছা, সাবধানে যাও৷ বাসায় গিয়ে কল দিবে, আচ্ছা?”
———-
এভাবে দেখতে দেখতে নবীন বরণের প্রোগ্রাম চলে আসলো। চিফ গেস্ট হিসেবে আসছে ইরা’দ। এমনটাই শুনেছে নওরি। আজ নওরি অনেকদিন পর বাগানে আসলো। মালি একপাশে ঘাস কাটছে। ওনাকে দেখে মুচকি হাসলো নওরি। ওনার সাথে বেশ ভাব জমেছে নওরির। সেই প্রথম দিনের পর বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। তবে ঘনঘন বাগানে আসতে পারে না নওরি। ফ্রিশা তো এতদিন পর বের হতে পেরে এদিক সেদিক দৌড়াচ্ছে।
নওরি মালির সাথে কুশল বিনিময় করে সেও ডেইজি ফুলগুলোর কাছে গেলো। কয়েকটা ছিঁড়েও নিলো। ছিঁড়ে পিছে তাকাতেই দেখলো কিছু জামা-কাপড় রশিতে টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে। সেখান থেকে একটি শার্ট নওরি চিনতে পারলো। এটা ইরা’দের। নিশ্চয়ই মৌসুমি এখানে জামা-কাপড় রোদে দিয়ে গেছে। হাঁটুর সমস্যার কারণে ছাদে উঠতে পারেন না তিনি। তাইতো এই বাগান-ই তাঁর স্বস্তি।
ছেলের জামা-কাপড় সে নিজেই ধোঁয়। বাদ-বাকী জামা-কাপড় কাজের মেয়ে ধুঁয়ে দেয় এবং ছাদেও দিয়ে আসে। নওরি শার্টের বুকপকেটের দিকে তাকাতেই তাঁর মস্তিষ্কে তরঙ্গিত হলো ইরা’দের বলা সেই কথাগুলো। নওরি কল্পনা করলো, কেমন হবে ইরা’দের বুকপকেটে ফুলগুলো রাখলে? আপনমনে হেসে বললো নওরি।
ইরা’দ হাই তুলতে তুলতে বারান্দায় এসেছিলো। যেই নওরিকে দেখলো তখন থেকে ইরা’দের স্থির দৃষ্টিপাত নওরির পানে। নওরির চাল-চলন, ভাব-ভঙ্গি ইরা’দ নিবিড়ভাবে দেখছে। কতটা মনোযোগী সে। যখন দেখলো নওরি হাতে ফুল নিয়ে তাঁর-ই শার্টের দিকে তাকিয়ে আছে। ইরা’দ কিছু একটা আন্দাজ করে হাসলো। নওরির হঠাৎ বারান্দার দিকে চোখ গেলে নওরি অপ্রস্তুত হলো। ইরা’দ মুচকি হাসি দিয়ে হাত নাড়িয়ে নওরিকে “হাই” জানালো। নওরি বিষম খেলো। ফুলগুলো নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব হলো নওরি কেটে পরলো। ফ্রিশাও তাঁর পিছু নিলো। ইরা’দ নওরির হন্তদন্ত হয়ে চলে যাওয়া দেখে প্রাণখুলে হাসলো।
——————–
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।
#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
| পর্ব ২৬ |
—————–
নবীন বরণের অনুষ্ঠানের জন্যে নওরি আজ শাড়ী পরেছে। নূরজাহান সাহায্য করেছে তাকে। নওরির বান্ধুবী’রা একপ্রকার জোর করেই ড্রেস কোড হিসেবে শাড়ি দিয়েছে। নওরি প্রথমে ওদের মাঝে থাকতে চায়নি। কিন্তু পরে উপায়ন্তর না পেলো না। কঠিন জোরা-জুরিতে রাজি হয়েছে। তাইতো গতকাল সারিফাকে সঙ্গে নিয়ে শাড়ি কিনতে গিয়েছে। শাড়ির রঙ হচ্ছে গাঢ় নীল। শাড়িটা নওরি নিজের উপার্জনের টাকা দিয়েই কিনেছে। সারিফাকেও ঝুমকো কিনে গিফট করেছে। এতে সারিফাও খুশিতে গদগদ।
নূরজাহান নওরির কুচি ঠিক করে দিতে দিতে বলে,
–“শাড়ি সামলে হাঁটতে পারবে তো?”
–“চেষ্টা অবশ্যই করবো আন্টি।”
–“প্রথম শাড়ি পরলে?”
নওরি ইতস্তত হয়ে আলতো স্বরে বলে,
–“জ্বী!”
নূরজাহান নৈঃশব্দে হাসলো। উঠে দাঁড়িয়ে নওরিকে আপাদমস্তক দেখে নিলো সে। অবাক নয়নে চেয়ে রইলো নূরজাহান। নওরি কাচুমাচু ভঙ্গিতে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ নূরজাহান দোয়া পড়ে নওরিকে ফুঁ দিলো।
–“মাহ-শা-আল্লাহ্। কারো নজর না লাগুক। কী সুন্দর লাগছে তোমায়!”
উত্তরে নওরি হাসলো শুধু। অতঃপর আলতো স্বরে বলে,
–“আমি আসছি আন্টি। দোয়া করবেন!”
–“অবশ্যই মা!”
নওরির মাথায় পরম স্নেহের হাত বুলিয়ে নওরিকে নিয়ে রুম থেকে বের হলেন৷ সারিফা সোফায় বসে ফোন টিপছিলো৷ সৈকত সাহেবও টিভিতে একমনে নিউজ দেখছেন। এমতাবস্থায় সারিফার হঠাৎ নওরির দিকে চোখ গেলো। তাঁর মুখ তো একদম হা হয়ে গেলো। নওরিকে সাজিয়ে দিয়েছে সারিফা-ই। হালকা ফেস পাউডার, আই লাইনার, গাল নাক জুড়ে ব্লাশ এবং হালকা লিপস্টিক। দীঘল সিল্কি চুলগুলো খোলা। গলায়, কানে ফিতার জুয়েলারি; শাড়ির সাথে ম্যাচ করে। সারিফা অলরেডি এক দফা প্রসংশা করে ফেলেছে। কিন্তু শাড়ি পরিহিত পূর্ণ নওরিকে দেখে সে মুগ্ধ। ভেতরে ভেতরে গর্ববোধও করলো; যতই হোক, নওরিকে সারিফা সাজিয়ে দিয়েছে বলে কথা। সারিফা অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,
–“কী মারাত্মক লাগছে তোমায় আপু। শুধু চেয়েই থাকতে মন চাচ্ছে। এত সুন্দর কেন তুমি?”
নওরি বিস্মিত হয়ে চুপ করে রইলো। সারিফার প্রসংশা বাণী শুনে সৈকত সাহেবও নওরির দিকে তাকালো। নওরি তাকে দেখতেই চোখ নামিয়ে ফেললো। সৈকত সাহেব কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। এগিয়ে এলেন নওরির কাছে। নওরি নিঃশ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে রইলো। নিশ্চয়ই নওরির পাশ কাটিয়ে সৈকত সাহেব চলে যাবেন। কিন্তু নওরির ভাবনাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে সৈকত সাহেব পরম স্নেহের হাত রাখলেন নওরির মাথায়। যেন বাবার হাত, একটি ভরসার হাত। নওরির বিস্ময় আকাশচুম্বী। চোখ বড়ো বড়ো করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। সৈকত সাহেব বললেন,
–“সুন্দর লাগছে। এখন চলো, আমি দিয়ে আসছি তোমাকে এবং সারিফাকে।”
নওরি চমকে তাকায় সৈকত সাহেবের পানে। সৈকত সাহেব নির্বিঘ্নে হাসলেন। সারিফা ততক্ষণে ফোন হাতে এগিয়ে এসে বলে,
–“এক মিনিট বাবা, সেল্ফি তো তুলে নিই; আমাদের পরীর সাথে!”
——————–
নওরি এবং সারিফা আস্তে-ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নামছে। নওরির সাথে সারিফাও আগ্রহী নবীন বরণ অনুষ্ঠান দেখার জন্যে, এজন্যই নওরি তাকেও সঙ্গে নিয়ে নিয়েছে। আসার সময় তো ফ্রিশা তৈরি হয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়েই ছিলো। ভীষণ উৎসুক ছিলো আসার জন্যে। কিন্তু নওরি নিরুপায়। এত ভীড়ের মাঝে ফ্রিশাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। এছাড়া কত সময় লাগে সেটাও তো বলা যায় না। এজন্য ফ্রিশাকে ছাড়াই তাকে আসতে হয়েছে।
সৈকত সাহেব ওদের আগেই নিচে চলে গেছে সিএনজি ঠিক করতে। দুই বোন নানান আলোচনা করতে করতে দো’তলায় আসতেই দেখতে পেলো মৌসুমিকে। মৌসুমি দুধওয়ালীর সাথে কিছু কথা বলছেন। এই দুধওয়ালী প্রতিদিন ইরা’দদের বাসায় দুধ দিয়ে যায়। মৌসুমির হঠাৎ চোখ আটকায় নওরির দিকে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়। মৌসুমিকে অতিক্রম করতে নিলে নওরি আলতো হেসে সালাম দিয়ে চলে যায়। মৌসুমি অবাক হয়ে চেয়েই থাকে। পরবর্তীতে মিনমিন করে বলে,
–“মাইয়া ভালোই ঢঙের আছে। আমার ছেলের নজরে না পরলেই হয়। আমি তো আমার ছেলের জন্যে উচ্চ বংশের মেয়ে নিয়ে আসব, হুঁ!”
–“নওরি আপু, তুমি চাচীর সামনে থেকে এভাবে ছুটে চলে আসলে কেন?”
–“তোমার চাচীকে কেমন ভয় লাগে আমার।”
নওরির কথা শুনে সারিফা ফিক করে হেসে দিয়ে বলে,
–“ভয়ের কিছু নেই। চাচী কঠিন হলেও তাঁর ভেতরটা নরম। উনি নরম না হলে কী ইরা’দ ভাই ওনার জন্যে এমনি এমনি জান-প্রাণ দিয়ে দেয়? তুমি জানো চাচীর জন্যে ইরা’দ ভাইয়ার ভালোবাসা কতটা অসীম!?”
ইরা’দের নামটি শুনে নওরির ভেতরটা নাড়া দিয়ে উঠে। পরবর্তীতে নওরি আলতো স্বরে বলে,
–“তাহলে বারবার বিয়ে ভেঙে মাকে কষ্ট দেয় কেন?”
–“কষ্ট দেয় না আপু। আসলে ভাইয়ার কাহিনী আলাদা। মানুষ যাকে বেশি ভালোবাসে তাঁর কাছেই ন্যায়-অন্যায় আবদার বেশি রাখে। তেমন-ই ভাইয়ার আবদার হচ্ছে সে এত দ্রুত বিয়েও করবে না, রাজনীতিও ছাড়বে না। শিরায় শিরায় রক্ত, ইরা’দ ভাই রাজনীতির ভক্ত!”
সারিফার কথায় উভয়েই এক সাথে করে হেসে দেয়। এবং সেই হাসি চললো বেশ কিছুক্ষণ।
———————
সৈকত সাহেব নওরিদের নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো। নওরি এবং সারিফা মেইন গেটের কাছাকাছি যেতেই দেখলো ভার্সিটির গেট বরাবর একটি গাড়ি এসে থেমেছে। সারিফার হাত ধরে নওরি থমকালো। উৎসুক হয়ে চেয়ে রইলো সেখানে। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে গাড়ি থেকে নেমে আসলো ইরা’দ। কালো পাঞ্জাবি এবং কালো প্যান্ট পরিহিত। চোখে আবার হলুদ সানগ্লাস। সুপুরুষটিকে আজ যেন আরও সুদর্শন লাগছে। নওরি পিটপিট করে চেয়েই রইলো। ইরা’দের মুখশ্রীতে আলাদা গাম্ভীর্য ফুটে উঠেছে। বিভিন্ন প্রতিনিধি, লোকজন তাকে ঘিরে ধরেছে। প্রিন্সিপাল নিজে এসে তাকে স্বাগতম জানালো।
সারিফা হঠাৎ উচ্ছ্বাসের সাথে বলে ওঠে,
–“ওয়াও, ইরা’দ ভাইয়া গেস্ট হিসেবে এসেছে?”
নওরির যেন হুঁশ নেই। ভ্রমে বিচরণ করছে সে। আদৌ এটা তাঁর দেখা ইরা’দ নাকি রাজনীতিবিদ ইরা’দ। দুই সত্ত্বার মাঝে কত পার্থক্য। হুট করেই নওরি নিজের সাথে ইরা’দকে তুলনা করে বসলো। ইরা’দের নাম, জোশ, খ্যাতি সব আছে। তাঁর কী আছে? তাঁর সামান্য পরিবার পর্যন্ত নেই। সে কেন ইরা’দকে নিয়ে বেশি ভেবে ফেললো? নওরি যখন তুলনার মাঠে নেমেছে তখন সারিফা জোর করে নওরিকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলে,
–“এখনো দাঁড়িয়ে থাকবে? চলো আপু, আমরা ইরা’দ ভাইয়ার সাথেই ভেতরে ঢুকে যাই।”
নওরির ধ্যান ভাঙে। সারিফা নওরিকে ইরা’দের পেছনে যেতে নিলে দারোয়ান ওদের আটকে ভার্সিটির বামপাশের ছোট গেট দিয়ে ঢুকতে বলে। কারণ এখান দিয়ে মাত্র-ই অতিথি প্রবেশ করেছে। দারোয়ানের মুখে এরূপ উক্তি সমূহ শুনে সারিফার মুখ কালো হয়ে যায়। নওরি আলতো করে হাসে। অতঃপর ওরা দু’জন ছোট গেট দিয়ে-ই প্রবেশ করলো।
–“এটা কী হলো আপু? আমার ভাইয়ের সাথে ঢুকতে পারলাম না? কিসের অতিথি? ওটা আমার আপন চাচাতো ভাই! এই মাথামোটা দারোয়ান কী বুঝলো না?”
–“তুমি না বললে জানবে কীভাবে?”
–“তাইতো! আচ্ছা, যাওয়ার সময় বলে যাবো!”
নওরি হাসতে হাসতে বলে,
–“দরকার নেই!”
নওরি এবং সারিফা ডেকোরেশনের ওদিকে চলে গেলো। এখনো কিছু সিনিয়র এদিক সেদিক ছুটছে। মানুষে গিজগিজ করছে সম্পূর্ণ বসার স্থান। নওরির দুজন বান্ধুবী ওদের দুজনের জন্যে চেয়ার খালি রেখেছিলো বলেই রক্ষা। নয়তো পুরো প্রোগ্রাম দাঁড়িয়েই থাকতে হতো। অবশ্য দাঁড়িয়ে থাকাও যেত না। কারণ, পেছনের দিকটায় সিনিয়র’রা আরও অতিরিক্ত চেয়ারের ব্যবস্থা করছে। প্রোগ্রামটি অডিটোরিয়ামে করার কথা থাকলেও কিছু সমস্যার কারণে বাহিরে বিশাল মাঠেই করতে হয়েছে। নওরি সারিফাকে নিয়ে তাঁর বান্ধুবীরের কাছে বসেছে। এতক্ষণ নওরির দুই বান্ধুবী রাইসা এবং তৃণা দুজন সিনিয়র ভাইয়াকে জোর করে বসিয়ে রেখেছিলো। তৃণা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
–“কত কষ্টে সিট ধরে রেখেছি, একটু ধন্যবাদও তো জানালি না! থাক, লাগবে না ধন্যবাদ বলে আমাদের ছোট করার!”
নওরি স্মিত হাসলো। সারিফা নওরির দুই বান্ধুবীর সাথে পরিচিত হলো। ওদের সাথে নওরি নিজ থেকে বন্ধুত্ব করেনি। ওরা নিজে থেকেই এসেছে এবং একপ্রকার ধরে বেঁধে ফ্রেন্ডশিপ করেছে। নওরি বন্ধুত্ব করতে জানে না, এজন্যই তাঁর স্কুল এবং কলেজ জীবনে সেরকম কাছের কোনো বান্ধুবী ছিলো না। পড়ার খাতিরে দু একটা কথা হতো এইটুকুই। এছাড়া তাঁর অবস্থাও ছিলো না বন্ধুত্ব করার মতোন। তখন তো বন্ধুত্ব করার স্বাধীনতাও ছিলো না তাঁর।
–“তোকে খুব সুন্দর লাগছে রে নওরি, একদম নীল পরী!”
রাইসার প্রসংশায় নওরি শুধু মুচকি হাসলো। হঠাৎ তৃণা বলে ওঠে,
–“নীল পরী আমার, রাস্তা দিয়ে হেঁটে এসেছো; কোনো ছেলের প্রপোজ পাওনি?”
নওরি বো!কা চাহনি নিক্ষেপ করলো তৃণার পানে। অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,
–“না তো!”
অষ্টম আশ্চর্য শুনলো যেন তৃণা। উৎকন্ঠা হয়ে বললো,
–“মজা নিচ্ছিস? কেউ প্রপোজ করেনি? বাঙালি ছেলে’রা কবে থেকে আবার এত ভদ্র হলো?”
সারিফা হাসতে হাসতে বললো,
–“আমার বাবা আমাদের ভার্সিটিতে দিয়ে গেছে। ভার্সিটিতে ঢোকার পর বেশ কয়েক জন ছেলে আপুর দিকে তাকিয়েছে অবশ্য, কিন্তু কেউ সামনে আসেনি। বুঝেছো তৃণা আপু?”
–“হ্যাঁ বুঝেছি। তাহলে প্রপোজাল দেরী করে হলেও আসবে !”
এমন সময়ই ইরা’দ স্টেজে উঠলো। সকল স্টুডেন্ট তখন বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তাকে স্বাগতম জানালো। ইরা’দ হেসে সকলকে হাত নাড়িয়ে বসার ইশারা করে নিজেও তাঁর আসনে বসে পরলো। তৃণা বসতে বসতে বললো,
–“এইসব ইয়ং জেনারেশন ক্যান যে পলিটিশিয়ান হয়?”
নওরি ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে বলে,
–“মানে?”
–“এইযে, সুন্দর পোলাপান রাজনীতিতে! এখন একটা মেয়ে তারে পছন্দ করে, কিন্তু তাঁর প্রপোজ করার আগেই পুলিশ, শ!ত্রু পক্ষের গু!লি খেয়ে ওখানেই ম!রবে! কী রইলো আর প্রেমের? প্রেম হওয়ার আগেই শহীদ! এরা কী বুঝে না মেয়েদের ফিলিং?”
রাইসা ফিক করে হেসে দিয়ে বলে,
–“নওরি, তৃণা নিজের কথা বলছে; বুঝলি?”
তৃণা রাগান্বিত হয়ে রাইসার পিঠে এক ঘা বসিয়ে দিলো। সারিফা এবং নওরিও মুখ টিপে হাসলো। তবে নওরি সারিফাকে সাবধান করতে ভুললো না।
–“সারিফা, ইরা’দ যে তোমার ভাই এটা তুমি কাউকে বলবে না!”
সারিফস অবাক চোখে নওরির দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,
–“কেন?”
–“তোমার ভাইয়া নিষেধ করেছে। এতে অনেক সমস্যা। বুঝেছো?”
ইরা’দের নিষেধাজ্ঞা শুনে সারিফা দমে গেলো। নওরি কেন বারণ করলো জানে না। তবে সেই উবারে বলা ইরা’দের কথাগুলো তাঁর কানে তীব্র আকারে বাজছে। এজন্য-ই মূলত সাবধান করা।
একের পর এক বক্তব্য দিচ্ছে প্রিন্সিপাল সহ আরও কয়েজন। এর মাঝে হঠাৎ ইরা’দের নওরিতে আটকে যায়। তাঁর বরাবর মাঝামাঝিতে নওরি বসেছে। প্রথমে চিনতে অসুবিধা হলেও পরমুহূর্তে নওরিকে দেখে থমকালো। এ কোন নওরি? হার্টবিটের তীব্র ওঠা-নামা শুনতে পেলো ইরা’দ। মাথাটাও কেমন ভনভন করছে তাঁর। ঠিক দেখছে নাকি ভ্রম? স্তব্ধ হয়ে চেয়েই রইলো বেশ কিছুক্ষণ। হঠাৎ ইরা’দের স্পিচ দেয়ার সময় এলো। না চাইতেও উঠে দাঁড়ায় সে৷ হাতের ফোন পকেটে পুরে এগিয়ে যায় স্পিচ বোর্ডের কাছে।
——————–
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।