এক মুঠো প্রণয় ২ পর্ব-০৮

0
521

#এক_মুঠো_প্রণয়
#সিজন_টু
#পর্ব_০৮
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ

পুরো একসপ্তাহ মেহু ঘরবন্দি হয়েই কাঁটাল। না হোস্টেলে ফিরে গেল না তো ভার্সিটিতে গেল এই সাতটা দিন।চারদিন হলো মেয়েটা জ্বরও বাঁধিয়েছে শরীরে।এর মাঝে অবশ্য জ্যোতি এসেছিল একবার। মেহুর সাথে অনেকক্ষন সময় কাঁটিয়ে চলে গিয়েছিল।মেহেরাজ চিন্তিত হলো বোনের এই বেহাল দশা দেখে। হঠাৎ কিই হলো? কেন এমন হয়ে গেল মেহু? কিছু বুঝে আসল না৷ তবে এইটুকু বুঝল যে মেহুর সম্বন্ধে সবটাই জ্যোতি জানে। তবুও ইচ্ছে করেই তাকে কিছু বলছে না। মেহেরাজ মনে মনে বিরক্ত হলোও জ্যোতির উপর। চোখেমুখে সে বিরক্তির রেশ ফুটিয়েই রিক্সা থেকে নামল সে। ভাড়া মিটিয়ে বোনের জন্য কিনে নিল ফুসকা,কাঁচের চুড়ি আর বেলিফুলের সুগন্ধী মালা। সে জানে এসব পেলে তার বোন কিছুতেই মন খারাপ করে থাকতে পারবে না। হাসিমুখে সেসব নিয়ে পুণরায় রিক্সা নিয়ে বাসায় পৌঁছাল। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে কলিং বেল বাঁজাতেই দরজা খুলল মেহু। পরমুহুর্তে মেহুর থেকে কিছুটা পেঁছনে দেখা মিলল এক অনাকাঙ্খিত মুখের। জ্যোতি দাঁড়িয়ে৷সদ্য অফিস থেকে ফেরা মেহেরাজ একবার তাকিয়েই নজর সরাল সঙ্গে সঙ্গে।আলতো হাতে বোনের কপাল ছুঁয়ে বুঝার চেষ্টা করল জ্বর আছে কি নেই। বোধ হলো এখন মেহুর শরীরে জ্বর নেই৷ তাই আগ বাড়িয়ো কিছু জিজ্ঞেস না করে চোখমুখে ক্লান্তি নিয়ে হাতের জিনিসগুলো মেহুর হাতে ধরিয়ে দিল।পা বাড়িয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল জ্যোতিকেও।যাওয়ার আগে শুধু মেহুকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“ ফুসকা, চুড়ি আর বেলিফুলের মালা পেয়েও মন খারাপ করতে নেই মেহু। তাহলে ভাবব তুই এসব পেয়ে খুশি হসনি৷”

কথাটা বলেই চলে গেল নিজের ঘরে। শার্ট খুলে, তোয়ালে নিয়ে ডুকল ওয়াশরুমে৷ এই শীতের মধ্যেও গোসল সারল।পরমুহুর্তে টাউজার আর ছাঁইরঙ্গা টিশার্টের উপর জ্যাকেট পরে রুম ছেড়ে বের হলো৷ ভেজা চুল গুলোতে ঝাড়া দিয়ে বসার ঘরে চোখ বুলিয়ে চলে গেল মেহুর ঘরে। গম্ভীর গলায় বলে উঠল,

“মেহু? তোকে কিছু কথা জিজ্ঞেস করব।আমার ঘরে আয় তো। ”

জ্যোতি তাকাল একবার দুইজনের দিকে। ভাবল তার সামনে বলতে পারবে না বলেই হয়তো মেহেরাজ মেহুকে নিজের ঘরে ডাকছে৷ এর থেকে ওকে ঘর ছেড়ে যেতে বললেই তো হতো। সে কি দাঁড়িয়ে থাকত কথা শোনার জন্য? তাই আর দাঁড়াল না৷ যেখানে নিজের উপস্থিতি অস্বস্তিজনক সেখান থেকে সরে আসাটাই উত্তম।তাই পা বাড়িয়ে নিয়েই বলল,

“ আপনারা কথা বলুন মেহোরাজ ভাই। আমি বাইরে আছি। ”

মেহেরাজ ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিল এবারে। গম্ভীর স্বরে জ্যোতির দিকে তাকিয়ে শুধাল,

“ তোকে যেতে বলিনি আমি। ”

জ্যোতি মাথা নাড়াল।উত্তরে বলে উঠল,

“জানি। কিন্তু আমার কারণেই তো নিজের ঘরে ডাকছেন আপুকে। আপুর শরীর খারাপ তাই মনে হলো এখানে কথা বললেই ভালো হবে। ”

মেহেরাজ ছোট শ্বাস টানল।তখন মেহুর কপালে হাত রেখেই বুঝেছল মেহুর শরীরে জ্বর নেই।তাই ডেকেছিল।কিন্তু নির্দিষ্ট ভাবে জ্যোতির জন্যই তো ডাকেনি। ভরাট গলায় শুধাল,

“ তোর কারণে কেন ওকে ঘরে ডাকব?”

জ্যোতি তাকাল মেহেরাজের দিকে৷ সরাসরি দৃষ্টি মিলিয়েই বলে উঠল,

“ আমাকে এই ঘর ছেড়ে বের হওয়ার কথা বলতে পারছেন না বলেই হয়তো।”

রাশভারী কন্ঠে উত্তর এল,

“ বলার হলে তোকে সরাসরিই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বলতাম আমি। ”

জ্যোতি অল্প হাসল। মৃদু আওয়াজে বলল,

“ হয়তো ভদ্রতা দেখাতে গিয়ে বলেননি। হতেই পারে।”

মেহেরাজ বিরক্ত হলো। বিরক্তির মাত্রটা বেশি বলেই কপালে ভাজ নিয়ে চাইল জ্যোতির দিকে। তাচ্ছিল্য নিয়ে ভরাট স্বরে বলল,

“ যার মাঝে ভদ্রতার ভ নেই সে মেয়ে যে ভদ্রতা দেখাতে গিয়ে কি বলা উচিত-অনুচিত তা নিয়ে উল্টোপাল্টা ভাববে এটা স্বাভাবিক।”

জ্যোতি তীক্ষ্ণ চাহনিতে চাইল এবারে।ভদ্রতার ভ নেই? মানে সে কি চরম মাত্রার অভদ্র?মেহেরাজ তার সম্বন্ধে এই কথাটা কেন বলল? কি অভদ্রতা করেছে সে?চোখমুখে হঠাৎ তেজ দেখা গেল। শক্ত গলায় স্পষ্ট স্বরে বলে উঠল,

“ হ্যাঁ, আমি অভদ্র। ”

কথাটা বলেই পা ঘুরিয়ে চলে যেতে নিলেই মেহু বলে উঠল,

“ ভাইয়া তো তোকে যেতে বলেনি জ্যোতি। বস এখানে।”

জ্যোতির গলা মুহুর্তেই পাল্টে গেল। নরম গলায় বলল,

“ বাইরেই তো আছি। একটু হেঁটে আসি না আপু?”

মেহু হাসল এইবারে। মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বলতেই জ্যোতি বেরিয়ে গেল নিজের মতো। মেহেরাজ সেদিক পানে একবার তাকিয়েই নজর সরাল। ধীর পায়ে বোনের দিকে এগিয়ে এসেই ফের হাত রাখল মেহুর কপালে।ত্বকের উষ্ণতা অনুভব হলো না খুব করে। মৃদু কন্ঠে বলল,

“জ্বর ছেড়েছে মেহু?”

মেহু মাথা নাড়াল।উত্তরে বলল,

“হ্যাঁ ভাইয়া। ”

মেহেরাজ মৃদু হাসল।বিছানার উপরই অবহেলায় পড়ে আছে তার আনা বেলিফুলের মালাটা আর চুড়িগুলো। একবার সেগুলো দেখে নিয়েই বলল,

“ এতোটা মন খারাপ? এসবেও মন খারাপ সারল না?ভাইয়াকে বল না কেন মন খারাপ। ”

মেহু চুপ রইল এবারে। এই কটাদিনে সবসময়ই মেহেরাজ জানতে চেয়ে তার কাছে মন খারাপ কেন, কি কারণে। তবুও বলা হয়নি। ভাইয়ের এমন আকুলতা দেখে আপসোস হলো মেহুর।মন খারাপ ভুলানোর এত চেষ্টা, এত ভালোবাসা, এত যত্ন সবকিছুর পরেও কিনা সে একজনের ভালোবাসা না পাওয়ার অভাবে হা-হুতাশ করছে?তার কি ভালোবাসার মানুষের অভাব আছে?জ্যোতি মেয়েটাও কতো ভালোবাসে তাকে, তার চাচা-চাচীরা কতোটা ভালোবাসে, তার ভাই কতোটা ভালোবাসে৷ এতজনের ভালোবাসার পরও তার কাছে কিনা গুরুত্ব পেল শুধু একজনের ভালোবাসাটাই? মেহু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মেহেরাজ ফের জিজ্ঞেস করল,

“তুই কি অন্য কাউকে ভালোবাসিস মেহু? কারোর সাথে সম্পর্কে আছিস?আমাকে বল। ট্রাস্ট মি, আমি না করব না। মেনে নিব তোদের সম্পর্কটা। প্লিজ বল,তবুও এভাবে মনমরা হয়ে থাকিস না। বল না, কাউকে ভালোবাসিস?”

মেহু চমকাল।উত্তর না দিয়ে ফের জিজ্ঞেস করল,

“হঠাৎ এই প্রশ্ন করলে? ”

মেহেরাজ চিন্তিত চাহনিতে তাকাল। নরম স্বরে বলতে লাগল,

“ আমি তোকে নিয়ে চিন্তিত মেহু। এই কয়দিন দিনরাত ভেবে চলেছি তোর এই অসুস্থতা, ঘরবন্দি জীবন নিয়ে৷কি হয়েছে হঠাৎ?কেউ কিছু বলেছে মেহু?কেন এমন করছিস? কারো সাথে কিছু হয়েছে? নাকি মেঘের সাথে বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে? আমিই তো প্রথম থেকেই বলেছি তুই না বললে কিছুই হবে না মেহু। ভাইয়ার উপরে এটুকুও বিশ্বাস নেই? আমি মেঘকে বলেই দিয়েছি এটা সম্ভব নয়। তবুও এভাবে থাকিস না। প্লিজ!”

“ওটাতো বাবামায়ের ইচ্ছে ছিল ভাইয়া। তুমি নিষেধ করলে কেন? আমি কি একবারও অমত জানিয়েছিলাম?

“ মনের বিরুদ্ধে বিয়ে করে সুখী হতিস না মেহু। বাবা মায়ের ইচ্ছে ছিল ঠিক তবে বাবা মায়ের এও ইচ্ছে ছিল যাতে তাদের মেয়েটা সুখে থাকে, ভালো থাকে। তো কোনটাকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত? ”

মেহু এবারে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।বলল,

“আমি কখনোই কাউকে বিয়ে করতে চাইনা ভাইয়া।”

বোনের কান্না দেখে মাথায় হাত বুলাল মেহেরাজ। আলতো স্বরে বলল,

“ আমার প্রশ্নের উত্তরটা দিলি না যে? কাউকে ভালোবাসিস?”

মেহু এবারেও উত্তর দিল না। কি উত্তর দিবে? সে ভালোবাসে ঐ সাঈদ নামক লোকটাকে এই কথাটা?

.

বাসার দরজাটা খোলাই ছিল। জ্যোতি কিয়ৎক্ষন সোফায় বসে পুরো বাসাটা চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিল। বেশ গোছাল।শুনেছে মেহেরাজ চাকরীতে জয়েন করার পর এই একবছরই হয়েছে মেহু বাসা ছেড়ে হোস্টেলে থাকে। অবশ্য এতে নাকি প্রথমে মেহেরাজ ভাই রাজি হয়নি। পরে অবশ্য বোনের প্রস্তাবে রাজি না হয়ে পারেননি বলেই বোনকে হোস্টেলে থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন। সেই অনুযায়ী ধরতে গেলে প্রায় একবছর হলো মেহেরাজ একাই এই বাসাতে থাকে। অথচ বাসা দেখে বুঝা যায় না এখানে একটা ছেলে থাক । সবকিছুই কতোটা গোছাল রেখেছে ছেলে হয়েও৷জ্যোতি মনে মনে বোধহয় প্রশংসাও করল মেহেরাজের এই গুণটার। সবকিছুতেই পার্ফেক্ট! শুধু তার সাথেই গ্রামের সেই ওড়নার ঘটনার পর থেকে কেমন একটা ব্যবহার করে।ভুল বুঝেই বলে ফেলেছিল নাহয়। তার বিনিময়ে কি সে কম কিছু শুনেছে?জ্যোতির মস্তিষ্ক উত্তর দিল, না। বরং তার চেয়ে বেশিই শুনেছে সে৷ তাও এই ব্যাক্তির গুণে মুগ্ধ হচ্ছে সে?প্রশংসা করছে মনে মনে?কথাগুলো একবার ভাবতেই জ্যোতির রাগ হলো। শুধু শুধুই রাগ হলো। বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল তৎক্ষনাৎ।চোখে পড়ল দরজা পেরিয়ে আসা সামান্তাকে। চোখেমুখে উৎফুল্লতা। হাতে একটা বক্স। বোধহয় খাবারের বক্স। জ্যোতি মিনমিনে চোখে চেয়ে থাকতেই সে এগিয়ে এল। মৃদুস্বরে শুধাল,

“জ্যোতি?তুমি এখানে?”

জ্যোতি মৃদু হাসল।ভদ্রভাবে উত্তর দিল,

“মেহু আপুর জ্বর শুনেছিলাম৷ তাই দেখতে এলাম। কেমন আছেন আপু?”

সামান্তা উত্তরে বলল,

“ ভালোই আছি। তুমি?”

“আলহামদুলিল্লাহ।”

সামান্তা উৎসুক দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“মেহু আপু কোথায়?আর রাজ ভাইয়াই বা কোথায়?দেখেছো জ্যোতি? ”

“মেহু আপুর ঘরেই আছে আপু৷ উনারা হয়তো কোন প্রয়োজনীয় বিষয়ে কথা বলছেন তাই এখানে বসে আছি আপু।”

সামান্তার মুখ চুপসে এল বোধহয়।বলল,

“ আমি তো রাজ ভাইয়াকে ফিরতে দেখেই তড়িঘড়ি করে আম্মুর বানানো খাবার বক্সে করে নিয়ে আসলাম। ঠান্ডা হয়ে যাবে যে।”

জ্যোতি বিস্ময় নিয়ে চাইল। সামান্তা আর মেহেরাজ ভাইয়ের মাঝে যে কিছু আছে তা সে সেদিন ছাদের সে চিঠিটা, মেহেরাজের প্রতি সামান্তার চাহনী থেকেই আন্দাজ করেছিল। তবে এখন এই যে মেহেরাজকে দেখার আকুলতা, কতক্ষনে ফিরছে তা খেয়াল করেই ছুটে আসা এসব থেকে নিশ্চিত হলো। উত্তর দিল,

“উনারা রুমেই। ডাকতে পারেন আপু৷ ”

“প্রয়োজনীয় কথা বলছেন বললে না?যদি রাগ করে?”

“আপনার উপস্থিতিতে কিছু বলবে না হয়তো মেহেরাজ ভাই।”

সামান্তা উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“ কেন বলবে না? ”

“ভালোবাসার মানুষদের উপর আমরা বিরক্ত হতে পারিনা কখনো তাই।”

“মানে?”

জ্যোতি আচমকা প্রশ্ন করল স্পষ্ট গলায়,

“মেহেরাজ ভাইকে ভালোবাসেন তো আপনি? ”

সামান্তা চমকাল, অবাক হলো খুব করে।মুহুর্তেই জিজ্ঞেস করল,

“ তুমি কি করে জানলে ? ”

জ্যোতি স্মিত হাসল৷ গম্ভীর স্বরে বলল,

“জেনে গেলাম কোনভাবে৷আপনি রুমে গিয়ে দেখুন আপু। আমি একটু ছাদ থেকে আসছি। ”

সামান্তা মিনমিনে চোখে তাকিয়ে থাকল। কি আশ্চর্য!কি করে জানল জ্যোতি?

.

জ্যোতি সিঁড়ি বেয়ে ছাদে গেল।একনজর ঘড়িতে তাকিয়ে সময় দেখল।সন্ধ্যা সাতটা। আশপাশে আঁধার নামলেও ছাদে মিটমিট করা আলো। একনজর তাকাল আশপাশে৷ ছাদটা নিঃসন্দেহেই সুন্দর। সন্ধ্যানামা শহরে তিনতালা বাড়ির ছাদ থেকে রাস্তার যানবাহনগুলো চোখে পড়ল সর্বপ্রথম।শীতল বাতাসে শিহরন বইল লোমকূপ জুড়েও।সে কারণেই পরনের শালটা ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়েই কিয়ৎক্ষন তাকিয়ে থাকল আঁধার ঘেরা আকাশে। পরমহুর্তেই কি মনে করে বাড়িতে কল করল। কিন্তু কল তুলল না দাদী বা মিথি কেউই। জ্যোতি পরপর দুবার কল দিল। পরে বাধ্য হয়ে মিনারকেই কল দিল। কল রিসিভড হলো প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। বলল,

“আসসালামুআলাইকুম মিনার ভাই,বাড়ি ফিরেছো?”

মিনার অল্প হেসে উত্তর দিল,

“ ফিরলাম মাত্র, কিছু বলবি? ”

“ মিথিটা বোধহয় ঘুমোচ্ছে। কল তুলছে না। বাড়ির সবাই কেমন আছে? ”

“ ভালোই আছে সবাই৷ মিথি তো আজ পড়ছে দেখে আসলাম। খুব মন দিয়ে৷ দাদী বোধহয় পড়া নিয়ে বকেছে।”

জ্যোতি ছোট শ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করল,

“ ওহ, আব্বা কেমন আছে জানো? ”

“ভালো আছেন যদিও দেখা হয়নি মামার সাথে তিনদিন যাবৎ। তুই শুধু শুধু চিন্তা করিস না৷ ওরকম বুকে ব্যাথা তো গ্যাস্ট্রিকের প্রবলেমের কারণেও হতে পারে৷ সিরিয়াস কিছু না।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ ছোটছোট করে চাইল জ্যোতি। মৃদুস্বরে বলল,

“তেমনটা হলেই ভালো মিনার ভাই। ”

“হ্যাঁ।”

“ তোমার চাকরির ইন্টার্ভিউ ছিল না কয়েকদিন আগে? কি হলো তার মিনার ভাই?”

মিনার তিক্ততা প্রকাশ করল। বিরক্ত সুরে বলল,

“চাকরি করার ইচ্ছে চলে গেছে।ব্যবসায় হাত দেব।”

“আচ্ছা, রাখলাম তাহলে মিনার ভাই? নিজের যত্ন নিও। ”

“ হু রাখ।”

জ্যোতি রেখে দিল কল৷ পরমুহুর্তেই অনুভব করল তার পেছনে কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে। একমুহুর্তের জন্য বোধহয় শিউরেও উঠল। সন্ধ্যার আঁধারনামা শহরে একা ছাদে মিটমিটে আলোর মধ্যে হুট করে কেই বা উপস্থিত হবে তার পেছনে? শুকনো ঢোক গিলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পেছন ঘুরে চাইল সে। মানুষটা মেহেরাজই। বুকে হাত গুঁজে ছাদের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।কালো রংয়ের জ্যাকেট আর টাউজার পরনে৷ ভেজা চুল থেকে টপাটপ পানিও গড়াচ্ছে কপালে।কেন জানি মিটমিটে আলোতে এই পুরুষটাকে এই রূপে বিমুগ্ধ মনে হলো জ্যোতির কাছে।পরমুহুর্তেই কি যেন বুঝে উঠে নজর সরাল দ্রুত। কানে আসল মেহেরাজের গলায় বলা,

“ সব ছেড়েছুড়ে এই অন্ধকারে ছাদে এসে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আশ্চর্য!”

জ্যোতি তাকাল না এইবারে। উত্তরে বলল,

“ দেখতে এলাম আপনাদের ছাদটা।”

বিরক্ত স্বরে ফের কথা আসল,

“ দেখার প্রয়োজনটাই বা কি?তোর জন্য শুধু শুধু আমায় এতদূর আসতে হলো। ”

জ্যোতি স্পষ্টভাবেই জিজ্ঞেস করল,

“কেন আসলেন?”

“ মেহু খুঁজছিল তোকে৷ তুই তো আর বলে আসিসনি যে তুই এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকবি। আর মেহু অসুস্থ বলে তুই রুম ছেড়ে বেরিয়ে এসে আমায় ধন্য করলি। এখন কি অসুস্থ মেহুকে পাঠাতাম তোকে খুঁজতে?”

জ্যোতির খারাপ লাগল। শুধু শুধুই খাটাল ওদের।বোধহয় বলে আসাটা উত্তম হতো। তাই মৃদু আওয়াজে বলল,

“ বলে আসাটা উচিত ছিল হয়তো আপুকে।কিন্তু সামান্তা আপুকে তো বলেছিলাম আমি।”

মেহেরাজ ফের বিরক্ত হলো যেন। বলল,

“ সামান্তা সহজ সরল মেয়ে, তোর কথা হয়তো অতো মন দিয়ে শুনেইনি। তাই ভুলে গিয়েছে হয়তো।”

জ্যোতি ঠোঁটে ঠোঁট চাপল। এক মুহুর্তের জন্য তার ভাবা হয়ে গেল যে মেহেরাজ ভাই আর সামান্তা আপুর ভালোবাসাটা খুবই চমৎকার ভালোবাসা। তাইতো নির্দ্বিধায় ভালোবাসার মানুষটার সম্বন্ধে সহজ সরল সম্বোধন নিয়ে কথা বললেন। অবশ্য মেহেরাজ দায়িত্ববান ছেলে। ভালোবাসার মানুষকে নিশ্চয় অন্যের সামনে দোষী প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লাগবে না।মৃদু হাসল জ্যোতি এসব ভেবে।বলল,

“হতেও পারে। উনি আপনার জন্য তখন খুবই উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিলেন।”

ভ্রু জোড়া কুঁচকে রেখে মেহেরাজ শুধাল,

“মানে? ”

“ আপনি তো জানেন সবটা৷ তবুও এমনভাবে মানে জিজ্ঞেস করছেন যেন কিছুই জানেন না।”

মেহেরাজ দৃঢ় চাহনিতে তাকাল জ্যোতির মুখপানে। তার দিকে মেয়েটার দৃষ্টি নেই। গম্ভীরে স্বরে শুধাল,

“আমি যা জানি তা তোর জানার কথা নয়। ”

জ্যোতি ঠোঁটে ঠোঁট চাপল। দুইজন মানুষের প্রেম নিয়ে কথা বলাটা বোধহয় ব্যাক্তিত্বহীনতা বোঝায়। আর যায় হোক যেকোন জায়গা দুইজনের ব্যাক্তিগত প্রসঙ্গে নাক না গলানোটাই উত্তম। তাই প্রসঙ্গ বাদ দেওয়ার উদ্দেশ্যে বলল,

“ সেই প্রসঙ্গ বরং বাদ দিন মেহেরাজ ভাই।আপনি আমায় একটা কথা বলবেন?সাঈদ ভাই কি কাউকে ভালোবাসেন? কারোর সাথে প্রেম আছে উনার ? ”

হুট করেই মুখভঙ্গি পাল্টে গেল মেহেরাজের। বিরক্তির ছাপের জায়গায় এবার রাগ এসে ভীড় করল যেন। মুখ টানটান হলো। মনে পড়ল সেদিন রাতে রেস্টুরেন্টের সামনে সাঈদ আর জ্যোতি সহ সাক্ষাৎয়ের কথাটা। মনে মনে কি রাগ হলো? ইর্ষা করল নিজেরই প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে? এত মানুষ থাকতে জ্যোতিকেই বা কেন তারই বন্ধুর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে হবে? আর কেউ কি নেই? মেহেরাজ রাগ সামলে নিল। চেহারা শিথীল করে ঠান্ডা গলায় শুধাল,

“ কেন?কারোর সাথে প্রেম থাকলে কি তুই কষ্ট পাবি? ”

জ্যোতি উত্তর দিল,

“হয়তো পাব।পাওয়ারই কথা।”

কথাটা বলেই চলে গেল জ্যোতি। মেহেরাজ সে যাওয়ার পানে তাকিয়ে কপাল কুঁচকাল। সাঈদের প্রেম থাকলে জ্যোতি কেন কষ্ট পাবে ?পরমুহুর্তেই এক ভয়ানক চিন্তা আসল মাথায়। জ্যোতি কি কোনভাবে সাঈদকে ভালোবাসে?কোনভাবে ও সাঈদের প্রতি দুর্বল? মেহেরাজ মাথা চাপল দুইহাতে। চোখ বুঝে নিল জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে ফেলতে। আশ্চর্য জনক ভাবে তার নিজের উপরই হঠাৎ রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে হলো নিজের দুইগালে দুই থাপ্পড় বসাতে৷ কোথাও বোধহয় যন্ত্রনাও অনুভব হলো।বিষাদময় যন্ত্রনা।হৃদয়ে বুনা সদ্য প্রস্ফুটিত প্রণয় ঝরে যাওয়ার যন্ত্রনা।

.

জ্যোতি মেহুদের বাসা থেকে হোস্টেলে নিজের রুমে ফিরল সাড়ে আটটায়। মেহু ব্যাতীতও সেই রুমে আরো একটা মেয়ে ছিল। মেয়েটার নাম রিতু। বয়সে তার বয়সীই। ভাগ্যক্রমে একই ভার্সিটিতে, একই ইয়ারে হলেও তাদের ডিপার্টমেন্টটাই শুধু ভিন্ন। রিতু মেয়েটাও মেহুর মতোই সহজ সরল। আর সহজ সরল বলেই হয়তো জ্যোতির কাছে এই দুটো মেয়ে এতোটা পছন্দের। তাই ফিরতে না ফিরতেই মেহুর সব খবর জানাল রিতুকেও। রিতু হাসল মৃদু। বলল,

“ পরেরবার আমি আর তুই একসাথেই মেহু আপুকে নিয়ে আসতে যাব জ্যোতি। কতদিন একসাথে আড্ডা হয় না।”

জ্যোতি মাথা নাড়াল সম্মতি জানিয়ে। কিন্তু কিছু একটা বলতে নিতেই নিজের ফোনটা বেঁজে উঠল। জ্যোতি স্ক্রিনের চাইল। বাড়ির নাম্বার। মুহুর্তে কল তুলতেই ওপাশ থেকে শোনা হেল মিথির কান্নারত স্বর। জ্যোতির বুকটা ধ্বক করে উঠল। অস্থিরতা, আতংক সব যেন ঘিরে ধরল এক মুহুর্তেই। দ্রুততার সঙ্গে বলল,

“ এই মিথি? এই?কাঁদছিস কেন এভাবে?কি হয়েছ?এই উত্তর দে।”

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে