#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_৩১
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ
মাঝখানে কয়েকটা দিন কেঁটে গেল এভাবেই।জ্যোতির পা এখনও সারেনি তবে কাঁটা আঘাত গুলো সেরে উঠেছে। মেহেরাজের আচরণে এই কয়েকদিন স্পষ্ট অজানা অনিভূতির আভাস টের পেলেও জ্যোতি সরাসরি জিজ্ঞেস করে উঠতে পারেনি। সরাসরি জেনে নিতে পারে নি সে সব চাপা কথা, চাপা অনিভূতি আর জটিল স্বীকারোক্তি। পরনের ওড়নাটা মাথা অব্দি টেনে নিয়ে জানালা দিয়ে রাতের আকাশে চোখ রাখল জ্যোতি। নিঃশব্দে ভাবল কেবল একজনকে নিয়েই।হঠাৎই কি মনে করে মোবাইলটা হাতে নিয়ে একবার কল করে বসল মেহেরাজকে।মেহেরাজ কল তুলল না। পরক্ষনে কলও করল না। জ্যোতির মন হঠাৎ উদাস হলো। কয়েকটা দিন একইভাবে বসে, শুঁয়ে থেকে বিষন্ন অনুভূতিতে মনে বিষন্নতা বাঁধা বেঁধেছিলই।এই মুহুর্তে সেই বিষন্নতার সুর যেন গাঢ় হলো।জ্যোতি চোখ বন্ধ করে হেলান দিল বিছানার সাথে। জানালা দিয়ে আসা ফিনফিনে বাতাসে শীতল অনুভূত হলো শরীর।কিয়ৎক্ষন সেভাবেই কাঁটল বোধ হয়।তারপর হঠাৎ সে শীতল অনুভূতি কাঁটিয়ে তার কানে আসল মেহেরাজের জমাট গলা,
” তুই কি চোখ বুঝে রেখে ভুলবশত আমায় কল দিয়ে দিয়েছিস জ্যোতি?”
জ্যোতি সঙ্গে সঙ্গেই চোখ মেলে তাকাল। অফিস থেকে মাত্র ফেরা যুবকটিকে দেখে নিল সূক্ষ্ম চাহনিতে। ঘর্মাক্ত শার্ট আর ক্লান্ত মুখ থেকে নজর সরিয়ে বলল,
” ঠিকবশতই দিয়েছি।বিরক্ত হয়েছেন আপনি ? ”
মেহেরাজ এগিয়ে এল।জ্যোতির পাশে খাটের এককোণ বসে পায়ের মোজা খুলতে ব্যস্ত হয়েই ত্যাড়া গলায় জবাব দিল,
” তা জেনে কি করবি?”
জ্যোতির মুখের উদাস ভাব এবার আরো ঘন হলো। মনে মনে ভেবেই নিল মেহেরাজ বিরক্ত হয়েছে। বিরক্ত হয়েছে বলেই কল তুলে নি। স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠল,
” কিছুই নয়।বিরক্ত হলে পরে আর কল দিব না।তাই জিজ্ঞেস করছি।”
মেহেরাজ ভ্রু উঁচু করে একনজর তাকাল। মোজা জোড়া খুলে একপাশে রেখে হাত দিল গলার টাইয়ে। ভ্রু নাচিয়ে শুধাল,
” তুই তো দরকার ছাড়া কল দিস না।তো কি দরকারে কল দিয়েছিলি?”
জ্যোতি তাকাল। স্পষ্ট স্বরে প্রশ্ন ছুড়ল,
” দরকার ছাড়া কি আপনাকে কল করা যাবে না মেহেরাজ ভাই?”
মেহেরাজ খানিকটা ত্যাড়া গলায় দাঁতে দাঁত চেপ বলে উঠল,
” দরকার ছাড়া তুই কেন কল করবি?প্রেমালাপ করার জন্য?”
জ্যোতির মুখ থমথমে হয়ে গেল। উত্তর দিল না। কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে মেহেরাজকে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতে দেখেই গলা ঝাড়ল। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে উঠল,
” একটা প্রশ্ন করব মেহেরাজ ভাই?”
মেহেরাজ পেছন ঘুরে চাইল। গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,
” কয়েক মিনিট পর এসে শুনছি।”
কথাটা বলেই ওয়াশ রুমে ডুকল। বের হলো বেশ খানিকটা পর। চুলগুলো ভেজা৷ পরনের শার্টটার বোতাম গুলো লাগানো নেই, হাতাগুলোও গুঁটানো নেই। মুখে ফোঁটাফোঁটা পানির অস্তিত্ব।জ্যোতি একনজর তাকাতেই প্রথমে চোখে পড়ল বোতাম না লাগানো শার্টের মাঝের উম্মুক্ত পুরুষালি বক্ষ।মুহুর্তেই চোখ নামাল। মেহেরাজ তা খেয়াল করেই বোধহয় হালকা হাসল। হাত দিয়ে বোতাম লাগাল সময় নিয়ে।তারপর হাতাগুলো গুঁটিয়ে নিয়েই আচমকা ভেজা চুল নিয়ে জ্যোতির পাশের জায়গাটুকুতে গা এলিয়ে দিল।বালিশে মাথা রেখে চোখ বুঝে বলে উঠল,
” এবার বল, ভালো করে শুনব। ”
জ্যোতি প্রশ্নটা করতে পারল না।কেন জানি না গলা পর্যন্ত এসেও মুখ পর্যন্ত এসে পৌঁছাল না তার প্রশ্নটা।এই মুহুর্তে প্রশ্নটা কিভাবে করা উচিত তাও বুঝে উঠল না ঠিক। সবসময় স্পষ্ট ভাবে কথা বলে আসলেও এখন যেন প্রশ্নটা স্পষ্ট ভাবে করতে বাঁধল কোথাও। যার দরুণ চুপ হয়েই থাকল সে।মেহেরাজ সেই চুপ থাকার কারণেই চোখ মেলে তাকাল। জ্যোতি জড়োসড়ো চাহনী আর ভাবুক মুখ দেখে শান্ত স্বরে বলল,
” প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করে নিলে যদি অস্বস্তি কমে তো জিজ্ঞেস করে নেওয়া উচিত। বলে ফেল। ”
জ্যোতি মেহেরাজের মুখের দিকে তাকাল৷ ভেজা আর শীতল চাহনীতে চোখ রেখেই বলে উঠল,
” পরে করি?আমি ঠিক বুঝে উঠছি না কি প্রশ্ন করা উচিত।”
মেহেরাজ ভ্রু উচাল৷টানটান মুখে গম্ভীর অথচ দৃঢ় গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
” কেন? প্রশ্নগুলো প্রেমবিষয়ক? ”
মেহেরাজ প্রশ্নটা ছোড়া মাত্রই জ্যোতির মুখভঙ্গি ফ্যাঁকাসে হলো যেন। মেহেরাজ তা দেখেই মনে মনে হাসল। প্রশ্নটা সে যতোটা টানটান মুখ করে আর দৃঢ় ভাবে বলেছে ভেতরে ঠিক ততোটাই উৎফুল্ল অনুভব করল।ভ্রু নাচিয়ে ফের বলে উঠল,
” কি হলো?”
জ্যোতি অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠল,
” হ্ হু?”
মেহেরাজ আড়ালে চাপা হাসল। পরমুহুর্তেই গম্ভীর গলায় বলে উঠল,
” মানুষ প্রেম নিয়ে নিজের প্রেমময় মানুষের কাছে বলতে গেলে কিছুই বুঝে উঠে না, কিছুই খুঁজে পায় না বলার জন্য। ভুল না হলে তুইও প্রেমময় বাক্য ছুড়বি?”
তৎক্ষনাৎ জ্যোতির উত্তর এল,
” না, ঠিক তেমন নয়।”
মেহেরাজ অতি উৎসাহ নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,
” তাহলে কেমন? ”
মৃদু আওয়াজে জ্যোতি বলল,
” কৌতুহল। শুধুই কৌতুহল। ”
মেহেরাজ উঠে বসল। জ্যোতির চোখের দিকে কিয়ৎক্ষন তাকিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল।তারপর দাম্ভিক স্বরে বলে উঠল,
” তোর চোখ শুধুই কৌতুহল বলছে না। মিথ্যে বলতে ও পারিস না জ্যোতি?”
জ্যোতি চোখ তুলে তাকাল। নরম গলায় বলতে লাগল,
” তেমন নয় মেহেরাজ ভাই। কিছু কৌতুহল খুব আকাঙ্ক্ষার হয়। কিছু কৌতুহল খুব আশার হয়। আমার চোখে হয়তোবা সেই সুপ্ত আশা কিংবা আকাঙক্ষাটাই ফুটে উঠছে। ”
মেহেরাজ আর তাকাল না জ্যোতির দিকে।পা বাড়িয়ে যেতে যেতেই রুমের দরজার কাছে গিয়ে থামল। তারপর ভরাট গলায় শুধাল,
“হুট করে সেই আশা কিংবা আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়ে গেলে তোর প্রতিক্রিয়া কি হবে জ্যোতি?”
জ্যোতি স্তব্ধ হয়ে চাইল।মেহেরাজ অবশ্য ততক্ষনে আর রুমে দাঁড়িয়ে নেই।দরজা পার হয়ে চোখের অদৃশ্য হয়েছে মুহুর্তেই। জ্যোতি তখনও তাকিয়ে রইল সেদিক পানে৷ সত্যিই কি করবে? যদি সে আকাঙ্ক্ষা বা আশাটা ইতিবাচক উত্তর দিয়ে পূরণ হয়ে যায়? তখন তার প্রতিক্রিয়া আসলেই কি হবে?
.
মেহু বিছানায় গা এলিয়ে দিল মাত্রই। নাবিলাদের সাথে ফিরবে ভেবেও পরে জ্যোতির পায়ের অবস্থার কথা ভেবে আর যাওয়া হয়নি নিজ শহরে। জ্যোতির পা ঠিক হলেই একবার ঘুরে আসবে৷ পথে প্রান্তরে কোথাও সাঈদকে দেখার প্রার্থনাও বুকে পুষে নিয়ে যাবে। কথা না হোক, অন্তত একবার চোখের দেখা তো হোক।ক্ষতি তো নেই?বালিশে মাথা রেখে মোবাইল হাতে নিতেই চোখে পড়ল সাঈদের কিছু ছবি। সোশ্যাল মিডিয়ায আপলোড করা ছবি। সাঈদের পাশে অত্যন্ত সুন্দর এক রমণী। পরনে বিদেশিনীদের মতো লং শার্ট,জিন্স।চুলগুলো লালচে অনেকটা। দেখতে ধবধবে সাদা। মেয়েটার চোখ,মুখ, গায়ের রং,গড়নে সবকিছুতেই ফরেইনার ভাব স্পষ্ট আন্দাজ করা গেল। মেহু সুচালো চাহনীতে তাকাল ছবিগুলোর দিকে। দুয়েকটা ছবিতে সাঈদের সাথে একটু বেশিই ক্লোজ দেখাল যেন।লোকেশন আর ছবির দৃশ্য দেখে বুঝা গেল সাঈদ দেশে নেই। মেহুর বুকের ভেতর জ্বলে উঠল হঠাৎ। চোখ বুঝে নিয়ে বারকয়েক জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিয়ে হঠাৎই মোবাইল বন্ধ করে ছুড়ে রাখল একপাশে। জানালা মেলে অপর পাশের জানালাটায় তাকাতেই চোখে পড়ল বাচ্চা মতো একটা ছোট্ট ছেলে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে।মেহু অবাক হলো। ঘড়িতে রাত তখন এগারোটা।এতো রাত অব্দি একটা বাচ্চা জেগে থাকবে কেন? মেহু ভ্রু কুঁচকাল। কিয়ৎক্ষন একই চাহনীতে তাকিয়ে থাকতেই বাচ্চাটা লাফ দিয়ে নেমে গেল জানালা ছেড়ে৷ তারপর আর দেখা গেল না বাচ্চাটাকে। মেহু অবশ্য সেভাবেই তাকিয়ে থাকল ঘন্টার পর ঘন্টা।
.
জ্যোতির দিকে ফিরেই মেহেরাজ চোখ বুঝে আছে।অথচ পাশে শুঁয়ে থাকা জ্যোতির চোখে ঘুম নেই। চোখেমুখে শুধু ব্যাপক অস্থিরতা।পেটের উপর মেহেরাজের ভারী হাতটা বারকয়েক সরালেও মেহেরাজ সরিয়ে নিল না। একইভাবেই হাতটা দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে। জ্যোতি চোখ বুঝল। ঘুমানোর চেষ্টা চালাল। লাভ হলো না।প্রশ্নটা না করা পর্যন্ত অস্থিরতা মিলিয়ে যাবে না ভেবেই মৃদু আওয়াজে ডেকে উঠল,
” মেহেরাজ ভাই?”
মেহেরাজ চোখ মেলে তাকাল না৷ ঘুম জড়ানো গলায় শাসিয়ে বলে উঠল,
“উহ্ হাত সরানোর কথা বলবি? ”
জ্যোতি উত্তরে বলল,
” আমার কিছু কথা আছে মেহেরাজ ভাই৷ ”
মেহেরাজ শুনল ঠিক। তবে উত্তর দিল না সাথে সাথে। কিয়ৎক্ষন পর চোখজোড়া অল্প মেলে চাইল। ভরাট কন্ঠে শুধাল,
” ঘুমাবি না? ”
জ্যোতি স্বাভাবিক স্বরে উত্তর দিল,
” ঘুমাব।”
” তবে?”
জ্যোতি এবারে উত্তর দিল না। কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে কিছু ভবল। বার কয়েক শ্বাস ফেলে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজাল দ্রুত।তারপর মেহেরাজের চাহনীতে চাহনী রেখে শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করল,
” ভালোবাসার আগমন কি জীবনে দুবার হতে পারে মেহেরাজ ভাই?”
মেহেরাজ এবার সচেতন হয়ে চাইল। শুধাল,
” এই প্রশ্ন?”
জ্যোতি এবার থামল না। সরাসরি বলে দিল,
” আপনি কি সত্যিই আমায় ভালোবাসেন?এতোটা সময় পর সত্যিই কি আমার প্রতি আপনার কোন অনুভূতি জম্মেছে মেহেরাজ ভাই?যদি না জম্মায় তবে নিশ্চয় আপনার ব্যবহার, আচরণে এসবে এমনকিছুর আভাস পাওয়া যেত না। ”
মেহেরাজের ঘুমঘুম ভাব যেন কেঁটে গেল। জ্যোতির দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে শুধাল,
” উত্তরটা ঠিক কি দেওয়া উচিত আমার? ”
জ্যোতির স্পষ্ট কন্ঠে ভেসে এল,
” যেটা সত্যি। ”
মেহেরাজ আড়ালে ঠোঁট চওড়া করে নিঃশব্দে হাসল। পরমুহুর্তেই মুখে গম্ভীরতা টেনে ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করল,
” তোর কি মনে হয়? উত্তরটা কি হবে?”
জ্যোতি মৃদু আওয়াজে বলল,
” আমার মন যা বলছে তা সত্য ভাবার সাহস করে উঠতে পারছি না৷ তা বাস্তব ভাবারও সাহস নেই। সত্যি বলতে আমি যা ভাবছি তা আমি বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না।পরমুহুর্তেই যদি তা মিথ্যে প্রমাণিত হয়? আর আমার ভাবনাটা যদি শুধুই ভাবনা এটা প্রমাণিত হয়?”
মেহেরাজ এবার দৃঢ় স্বরে উত্তর দিল,
” হবে না। আমি তা প্রমাণিত হতে দিব না।”
জ্যোতি ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” মানে?”
মেহেরাজ প্রশ্নটাকে অতোটা গুরুত্ব দিল না যেন।আকস্মিক আগের মতো চোখ বুঝে নিল। হাতের বাঁধনটা কিছুটা শক্ত করে নিজের শরীরটা আরেকটু এগিয়ে জ্যোতির গা ঘেষে রাখল।জ্যোতির কানের কাছে শীতল স্বরে সেভাবে চোখ বুঝে রেখেই বলল,
” ভেবে নে তা বাস্তব।চোখ বুঝে বিশ্বাস করে নে তোর ভাবনা গুলো সত্যি। এবার বল, এসব জেনে তোর ভেতর কেমন অনুভূতি কাজ করছে এখন?”
জ্যোতি চোখের চাহনী কিঞ্চিৎ বড় করল। এতোটা কাছে পুরুষালি অস্তিত্ব আর কানের কাছে উষ্ণ নিঃশ্বাস উপচে পড়তেই আঙ্গুল খিচে বিছানা জড়িয়ে ধরল। পরমুহুর্তেই কথাগুলো বোধগম্য হতেই বোধহয় বুকের ভেতর ছলাৎ করে উঠল। অস্ফুট স্বরে কেবল বলল,
” হ্ হু?”
মেহেরাজ দাঁতে দাঁত চাপল এবারে। গুরত্বপূর্ণ প্রশ্নের গুরুত্বপূর্ণ উত্তরের বিনিময়ে হুহ শব্দটা বলা নিঃসন্দেহেই রাগের কারণ হবে। বলল,
” শুনিস নি?”
জ্যোতি নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল।শান্ত কন্ঠে উত্তর দিল,
” শুনেছি।”
মেহেরাজ ত্যাড়া সুরে বলে উঠল,
” তবে?”
জ্যোতি ফের চোখের সামনে জ্বলজ্বল করা সত্যটাকে অবজ্ঞা করে শুধাল,
” আমার ভাবনাটা বোধ হয় আপনি বুঝে উঠতে পারেননি মেহেরাজ ভাই। ”
মেহেরাজ মুহুর্তেই জড়ানো স্বরে উত্তর দিল,
” যদি বলি তোর মনের সবটুকু ভাবনাই বুঝে নিয়েছি?”
জ্যোতি এবারে আর কিছু বলতে পারল না। অনাকাঙ্ক্ষিত অনুভূতিতে হৃদয়ে ছুুঁয়ে গেল খুব গভীরভাবে৷ এতোটাই গভীর ভাবে যে সে অনুভূতি শরীরের রক্তকণিকায় কণিকায় ছেয়ে গেল মুহুর্তেই। সুখ নাকি আনন্দ ঠিক বুঝা গেল না। বুঝা গেল না দুঃখ নাকি কষ্ট তাও। শুধু বোধ হলো পাশের পুরুষটির হৃদয়ে তার স্থান হয়েছে।পাশের পুরুষটির উপর তার অধিকারের স্বীকারোক্তি পেয়েছে। পাশের পুরুষটিকে স্বামী ভাবতে এবার বোধ হয় আর জড়তা নেই, শঙ্কা নেই, ভয় নেই। নেই তৃতীয় ব্যাক্তির সম্বোধন।
.
মেহুর ঘুম ধরল জানালার পাশে বসেই।জানালাটা খোলাই থাকল। মাথাটা জানালার গ্রিলে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে গিয়েছিল। আকস্মিক ঘুম ভাঙ্গল মাথায় কিছু একটার আঘাত পেয়ে। মেহু তৎক্ষনাৎ চোখজোড়া মৃদুভাবে মেলে তাকাল।ঘুমুঘুমু চোখে দেখল একটা স্টেথোস্কোপড! চোখজোড়ায় বিস্ময় টেনে তাকিয়ে থাকতে পরমুহুর্তেই আবারও ওপাশে জানালা থেকে কেউ ছুড়ে দিল একটা ঘড়ি। মেহু অবাক হলো। চোখ জোড়া দিয়ে ওপাশের জানালায় কাউকেই দেখা গেল না।মেহু বিরক্ত হলো। কিঞ্চিৎ গলা উঁচিয়ে বলে উঠল,
” কি আশ্চর্য! এসব এখানে ছুড়ে ফেলছেন কে?কেনই বা ছুড়ে ফেলছেন? ”
মেহুর কথায় দম মানল না ওপাশের ব্যাক্তিটি।আবারও ছুড়ে মারল একটা ব্রাশ আর টুথপেস্ট। টুথপেস্টটা ঠিক মেহুর কপালে এসেই লাগল। মেহুর বিরক্তি এবার তুঙ্গে উঠল। একে এসব করে ঘুম ভাঙ্গাল, দ্বিতীয়ত মাথায় আঘাত পাওয়া সব মিলিয়ে রাগে ঝাড়ি দিয়েই বলে উঠল,
” কথা বললে শুনতে পাননা? আপনাদের জন্য তো দেখা যাচ্ছে জানালা মেলে বসাই যাবে না।ভদ্রতার কিছু শিখছে বলেই মনে হচ্ছে না।”
এবারে মেহুর জোরালো আওয়াজ শুনেই বোধ হয় মুহুর্তেই এক যুবক ছুটে এল। যুবকটির অগোছাল চুল আর ঘুমঘুম চোখ-মুখ দেখে বোধ হলো মাত্রই ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে এসেছ। নিভু নিভু চোখে তাকিয়েই ঘটনা বুঝে উঠার চেষ্টা করে যুবকটি শুধাল,
” এক্সিউজ মি, আপনি কি আমাকেই বলছেন?”
মেহু চোখ তুলে তাকাল। পরমুহুর্তেই অবাক হলো।যুবকটিকে সে চেনে।অনেক আগে থেকেই চেনে। একমুহুর্তের জন্য অবাক হয়ে তাকালেও পরমুহুর্তেই ঝাঝালো স্বরে বলে উঠল,
” আপনার মধ্যে এখনো কোন ভদ্রতা তৈরি হয়নি? এখনো মানুষকে বিরক্ত করে বেড়ান আগের মতো?এভাবে সকাল সকাল মানুষের ঘরে জিনিসপত্র ছুড়ে মারছেন কোন আক্কেলে? শিক্ষিত হয়েছেন ঠিক তবে ভদ্রতা শিখলেন না।”
যুবকটির মুখ হঠাৎ থমথমে হয়ে গেল। গোল গোল চোখে কিয়ৎক্ষন মেহুর দিকে তাকিয়ে থেকেই জানালার পাশ থেকে সরে গেল। পরমুহুর্তেই চোখে চশমা পরে হাজির হলো।অবিশ্বাস্য চাহনীতে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে উঠল,
” তুমি? তুমি এখানে? ”
মেহু দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” হ্যাঁ, আমি।মেহু। আমি বলেই আপনি এই বেয়দবিটা করার সাহস পেয়েছেন? ”
যুবকটি ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিল। বলল,
” কি বেয়াদবি?”
মেহু রাগ নিয়ে বলল,
” স্টেথস্কোপড ছুড়ে মেরেছেন কেন? আমি কি ডাক্তার আপনার মতো?ছেলেদের ঘড়ি পরে ও তো আমার কাজ নেই।সর্বশেষ, ব্রাশ আর টুথপেস্ট!আমার বাসায় কি ব্রাশ আর টুথপেস্ট নেই যে দাঁত ব্রাশ করতে পারব না?”
যুবকটি চমৎকার হাসল। বলে উঠল,
” নাও থাকতে পারে। তুমি তো দশটা এগারোটায় ঘুম ছেড়ে উঠতে। আধৌ ব্রাশ করো ততোক্ষনে ঘুম ছেড়ে উঠে? আমার সন্দেহ হয়।”
মেহু রেগে উঠল আবারও।বলল,
” আমাকে দেখে কি মনে হয় আমি দাঁত ব্রাশ করি না?”
” তোমাকে দেখে তো কতকিছুই মনে হয় না। অথচ অনেককিছুই তো করে বেড়াচ্ছো। তাই না?”
” আমি যাই করি, আপনার মতো মানুষের বাসায় জিনিস ছুড়ে ফেলছি না।”
যুবকটি হঠাৎ ত্যাড়া সুরে উত্তর দিল,
” বেশ করেছি ছুড়ে মেরেছি। কি করবে তুমি?”
মেহু অবাক হয়ে শুধাল,
” কোন অনুশোচনাবোধই নেই আপনার মাঝে। আশ্চর্য!”
” না, নেই। ”
কথাটা দাম্ভিক স্বরে বলেই যুবকটি ঝুকল জানালার নিচের দিকে। মুহুর্তেই একটা বাচ্চা ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে মেহুর মুখের উপর জানালাটা বন্ধ করে দিল। মেহু অবাক হলো। এই লোকের সাহস দেখে কিঞ্চিৎ রাগও হলো ভেতরে ভেতরে। একবারও স্যরি বলল না?
#চলবে…
#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_৩২
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ
আজ মেহেরাজ বাসায়ই থেকে গেল। নাস্তা করে গোসল সেরে ভেজা চুল নিয়ে বের হয়ে জ্যোতির সম্মুখে এসে দাঁড়াল।পরনে কালো রংয়ের একটা টাউজার থাকলেও বক্ষ উম্মুক্ত।ফোঁটা ফোঁটা পানি এখনো লেপ্টে আছে ফর্সা, লোমহীন বুকে । জ্যোতি একনজর সেদিক পানে তাকিয়েই দ্রুত নজর সরাল৷ বিছানায় হেলান দেওয়া ছেড়ে সোজা হয়ে বসল এবার। মুখচোখ কুঁচকে ওয়াশরুমের দরজার দিকে একনজর তাকিয়ে আবার তাকাল রুমের দরজার দিকে। মেহুকে ডাক দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেই ইতস্থত করে মেহেরাজকএ বলে উঠল,
” আজ কি আপনি ছুটি নিয়েছেন মেহেরাজ ভাই?যাবেন না? ”
মেহেরাজ এবারে একদম খাটের কিনারায় ঘেষে দাঁড়াল। জ্যোতির দিক একনজর তাকিয়ে নিজের ভেজা চুলগুলোতে হাত দিয়ে ঝাড়া দিল৷ সঙ্গে সঙ্গেই পানির ছিটে এসে পড়ল জ্যোতির চোখ মুখে।জ্যোতি চোখ তুলে মেহেরাজের দিকে তাকাতেই মেহেরাজের ভ্রু উঁচু করল। জিজ্ঞেস করল,
” না গেলে তোর কোন অসুবিধা হবে? ”
জ্যোতি সূক্ষ্ম চাহনীতে চেয়ে শুধাল,
“অসুবিধা কেন হবে?আপনার বাসা আপনি থাকবেন। আমার কেন অসুবিধা হবে ? ”
মেহেরাজ ত্যাড়া কন্ঠে শুধাল,
” তাহলে এভাবে মুখচোখ কুঁচকে আছিস কেন?”
নিরস কন্ঠে উত্তর আসল,
” কিছু নয়। ”
মেহেরাজ তাকাল।গম্ভীর স্বরে বল উঠল,
” অসুবিধা না হলেও তুই যে খুশি নোস তা বুঝা যাচ্ছে জ্যোতি।”
” তেমন কিছু নয়। ”
মেহেরাজ ভ্রু নাচিয়ে শুধাল,
” তাহলে কেমন? তুই কি খুশি হবি খুব? ”
জ্যোতি উত্তর দিল না। চুপচাপ বসে থাকল আগের ন্যায়। মেহেরাজ এবারে দু পা এগিয়ে নিজের হাতে টিশার্টটা নিল। পরতে যাবে ঠিক তখনই জ্যোতি বলল,
” মেহু আপুকে ডেকে দিতে পারবেন? প্রয়োজন আছে একটু।”
মেহেরাজ কপাল কুঁচকাল। পরমুহুর্তেই কিছু একটা বুঝে উঠতেই কপালের ভাজ মিলিয়ে গেল।হাতের টিশার্টটা বিছানার এককোণে রেখে পা এগিয়ে জ্যোতির সামনে এসে দাঁড়াল। বেশ খানিকটক ঝুঁকে জ্যোতির মুখপানে তাকাল। ভেজা চুলগুলো জ্যোতির কপালে ঠেকাতেই দুয়েকফোঁটা পানি গড়িয়ে গেল জ্যোতির কপালে। ফিসফিসিয়ে বলল,
” মেহু কি তোকে ওয়াশরুম পর্যন্ত কোলে করে নিয়ে যেতে পারবে?মেহুর থেকে ভালো সাহায্য আমি করতে পারব।
বুঝলি?”
কথাটা বলেই একহাত জ্যোতির কোমড়ে নিয়ে ঠেকাল খুব দ্রুত। এক মুহুর্তও অপেক্ষা না করে জ্যোতির একটা হাত নিজের কাঁধে রাখল।তারপর হাত দিয়ে শক্ত করে কোমড় আঁকড়ে ধরে কোলে তুলল জ্যোতিকে।মুহুর্তেই ভেজা উম্মুক্ত বুকের শীতল স্পর্ষে কেঁপে উঠল জ্যোতি। শরীরের লোমকূপ জুড়ে শিহরন বইল খুব দ্রুত। বার কয়েক ঘনঘন শ্বাস টেনেই অস্বস্তিতে মুখ কালো করল। মেহেরাজ চাপা হাসল৷ পরমুহুর্তেই স্বাভাবিক মুখ করে মৃদু আওয়াজে বলে উঠল,
” কি আশ্চর্য! এমন করার কি আছে? কিছু করেছি আমি?”
জ্যোতি তাকাল না। বিনিময়ে কোন উত্তর ও দিল না৷ হাত চেপে ধরে রাখল মেহেরাজের কাঁধের অংশটুকু। কিয়ৎক্ষন পর ওয়াশরুমের দরজার সামনেই নামিয়ে দিল মেহেরাজ। ফিসফিসিয়ে বলল,
” বাকিটুকু তুই এই ভাঙ্গা পা নিয়েই যা। ”
জ্যোতি পাশ ফিরে তাকাতেই মেহেরাজের মুখে সূক্ষ্ম হাসির রেশ দেখতে পেল। মুহুর্তেই কেমন এক লজ্জ্বা আর অস্বস্তিময় অনুভূতি অনুভব হলো।এভাবে মেহেরাজের কোলে উঠে সাহায্য নেওয়াটা বোধহয় আসলে তার বোকামো হলো ভেবে মনে মনে বারকয়েক ঝেড়ে নিল নিজেকে। নিরস মুখে বলে উঠল,
” ধন্যবাদ মেহেরাজ ভাই। ”
মেহেরাজ তাকাল। অন্যমনস্ক ভাবে মুখ ফসকেই বলে উঠল,
” তোকেও ধন্যবাদ।”
জ্যোতি সূক্ষ্ম চাহনীতে চাইল। প্রশ্ন ছুড়ল ক্ষনিকেই,
” কেন? ”
মেহেরাজ অপ্রস্তুত হলো। সেই অপ্রস্তুত ভাব আড়াল করতেই গম্ভীর কন্ঠে শুধাল,
” কিছু নয়। তুই যা, আমি মেহুকে পাঠাচ্ছি।”
কথাটুকু বলেই আর দাঁড়াল না মেহেরাজ। বিছানার উপর থেকে নিজের টিশার্টটা নিয়ে দ্রুত গায়ে জড়াল।তারপর খুব দ্রুতই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।মেহুর রুমে গিয়ে মেহুকে জ্যোতির কাছে পাঠিয়েই বাসা ছেড়ে বের হলো।
.
মেহেরাজ বাসায় ফিরল কিছুটা সময় পরই৷জ্যোতিকে আর মেহুকে একসাথে বিছনায় বসে থাকতে দেখে মৃদু হাসল৷ এগিয়ে এসেই শুধাল,
” কি করছিস তোরা?”
মেহু হাসল ঠোঁট চওড়া করে৷ বলে উঠল খুব দ্রুত,
” তুমি না আজ বাসায় থাকছো ভাইয়া? তো হঠাৎ বেরিয়ে কোথায় গেলে?”
মেহেরাজ উত্তরে বলল,
” তেমন কোথাও নয়। এখানে একজন জুনিয়র ভাই আছে। তাই ভাবলাম, দেখা করে আসি। ”
” ভালো করেছো।”
মেহেরাজ হাসল বিনিময়ে। বলল,
” মেহু? বেলিফুলের মালা লাগবে তোর?”
মেহুর মুখ চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল এক মুহুর্তেই।চকচকে চোখে তাকিয়ে মুহুর্তেই বলে উঠল,
” কোথায়? দাও জলদি। ”
মেহেরাজ আবারও হাসল। একহাতে এগিয়ে দুটো বেলিফুলের মালা এগিয়ে দিল মেহুর দিকে। ঠোঁট চওড়া করে বলল,
” আমি জানি, আমার বোন বেলিফুলের মালা কতোটা পছন্দ করে। তবে এটা আমি নই, অন্য কেউ পাঠিয়েছে। ”
মেহু ভ্রু কুঁচকে নিল। প্রশ্ন ছুড়ল,
” কে সে?”
” তোর চেনা। কিন্তু সে তার পরিচয় বলতে নিষেধ করেছে। ”
মেহু থমকাল। কিছু বলতে গিয়েও বলল না। আবার পরমুহুর্তেই হেসে বলে উঠল,
” তাকে আমার তরফ থেকে ধন্যবাদ জানিয়ে দিও ভাইয়া। সত্যিই অনেক পছন্দ করি। তাই পরিচয় না জানালেও নিয়ে নিচ্ছি। ”
কথাটুকু বলেই মেহু হেসে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। বিনিময়ে মেহেরাজ ও হাসল। পরক্ষনে মুখ ফিরিয়ে জ্যোতির দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকাল। নিরস গলায় বলে উঠল,
” কতদিন হলো চুল আঁছড়াস না তুই?কি অগোছাল হয়ে আছে তোর চুল!”
জ্যোতি অবাক হলো।কিছুটা সময় আগেই চুল বেঁধেছে সে। খোপা করে মাথায় ওড়না দিয়ে বসে ছিল এতক্ষন।হঠাৎ এমন প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“অগোছাল? কিছুক্ষন আগেই চুল বেঁধেছি মেহেরাজ ভাই।”
মেহেরাজ এগিয়ে এল। হাত দিয়ে জ্যোতির মাথা থেকে ওড়নাটা সরিয়েই মুখ চোখ কুঁচকে নিল। এমন ভাব করল যেন জ্যোতির চুলের অবস্থা বিচ্ছিরি থেকেও বিচ্ছিরি অবস্থা। চাপাস্বরে বলল,
” তোর চুল দেখে তো তা মনে হচ্ছে না তা। ”
জ্যোতি পুনরায় অবাক হলো। হাত দিয়ে চুলে হাত রাখল মুহুর্তেই। খোঁপা করা চুলগুলো মোটেও তার কাছে অগোছাল বোধ হলো না। স্পষ্ট স্বরে বলল,
“আপনি কি মিথ্যে বলছেন মেহেরাজ ভাই?”
মেহেরাজ মুখ চোখ গম্ভীর করল। হাত দিয়ে জ্যোতির খোঁপা করা চুল খুলে দিতে দিতেই ধমকের সুরে বলে উঠল,
” তোর কি মনে হচ্ছে? আমি মিথ্যে কথা বলি? আমি মিথ্যুক?”
” তা বলিনি। ”
আবারো ধমকের সুরে বলল মেহেরাজ,
” তাহলে কি বলেছিস? ”
জ্যোতি উত্তর দিল না এবার। থমথমে মুখ করে বসে থাকল কেবল। মেহেরাজ অন্যপাশ ফিরে আড়ালে হাসল। বুক টানটান করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েই আদেশের সুরে বলল,
” সোজা হয়ে বস। তোর চুল সুন্দর করে বেঁধে দিব। ”
জ্যোতি যেমন ভাবে বসা তেমন ভাবেই থাকল। কয়েক পলক তাকিয়ে ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,
” আমি পারব মেহেরাজ ভাই।আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।”
মেহেরাজ শুনল না কথাটা।কড়া স্বরে বলে উঠল,
” তোকে কি জিজ্ঞেস করেছি তুই পারবি কি পারবি না? ”
কথাটুকু বলেই জ্যোতির পাশেই বিছানায় বসল মেহেরাজ। হাত এগিয়ে জ্যোতির ছেড়ে দেওয়া চুলগুলোতে স্পর্শ করাল।চিরুনি দিয়ে না আঁচড়িয়েই অদক্ষ হাতে বেনুনি গাঁথল অতি সাবধানে। তারপর বেনুনির শেষ প্রান্তের দিকে পেঁচিয়ে দিল একটা বেলি ফুলের মালা। অস্ফুট স্বরে বলল,
” পার্ফেক্ট! ”
কথাটা বলে উঠে যেতে নিয়েই আবার বসে গেল। জ্যোতির কানের কাছে মুখ নিয়েই ভরাট কন্ঠে বলল,
” এই মালাটা আমার আনা। চুল বাঁধা যেমনই হোক, মালাটা যদি খুলে নিয়েছিস তো ঠাস করে দোতালা থেকে নিচে ফেলে দিয়ে হাত, পা, কোমড় ভাঙ্গার ব্যবস্থা করে দেব কিন্তু ফ্রিতে।”
জ্যোতি নিশ্চুপ।চোখজোড়া বড় করে মেহেরাজের দিকে তাকাতেই মেহেরাজ বাঁকা হাসল। বসা ছেড়ে উঠে যেতেই চোখ পড়ল জ্যোতির পায়ে।তার দেওয়া নুপূর নেই দেখেই ভ্রু উঁচু করল সঙ্গে সঙ্গে। গম্ভীর স্বরে বলল,
” তোর পায়ে নুপূর নেই কেন জ্যোতি? ”
জ্যোতি অবাক হলো আবারও। নুপূর তো তার পায়ে এতদিনও ছিল না।বোধহয় মেহেরাজ খেয়াল করেনি এতগুলো দিন। পরমুহুর্তেই মনে পড়ল মেহেরাজের দেওয়া নুপূরের কথা।নুপূর গুলো সেদিনই সযত্নে তুলে রেখেছিল সে যেদিন মেহেরাজ পরিয়ে দিয়ে এসেছিল। শুধু নুপূর নয়, মেহেরাজের দেওয়া প্রত্যেকটা উপহারই সে তুলে রাখে। প্রিয় মানুষের উপহার ব্যবহার করলে যদি ফুরিয়ে যায়? তার থেকে ব্যবহার না করে সযত্নে, গোপনে তুলে রাখা ভালো নয়? অস্ফুট স্বরে বলল,
” নু্ ্পূর?”
মেহেরাজের কন্ঠ এবার কিছুটা দৃঢ় শোনাল। বলল,
” হ্যাঁ, শুনতে পাস না? ”
জ্যোতি গলা ঝাড়ল। তার পায়ে যে নুপূর নেই এটা বোধহয় মেহরাজ এতগুলো দিনে খেয়াল করেনি। তাই বলল,
” নুপূর তো আমি এতগুলো দিনও পরিনি । এই বাসায় আসার পরও ছিল না। আপনি বোধ হয় খেয়াল করেননি!”
মেহেরাজ মুখ টানটান হলো মুহুর্তেই। চোয়াল শক্ত হলো।দাঁতে দাঁত চেপে শীতল কন্ঠে রাগ নিয়ে বলে উঠল,
” তো ফেলে দিয়েছিস ওগুলো?আমি দিয়েছি বলেই তো খুলে নিয়েছিস তাই না? ”
জ্যোতি জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজাল।উত্তর দিল,
“ফেলে দিইনি।”
মেহেরাজ এবারেও রাগ ঝেড়ে বলে উঠল,
” তো?যত্ন করে নিজের সাথে সবসময়ের জন্য রেখেও তো দিসনি। তার থেকে ফেলে দিতি।”
” ড্রয়ারে রেখেছিলাম। আসার সময় তো রিতুরা ব্যাগ গুঁছিয়ে দিয়েছিল। তাই আর নেওয়া হয়নি। ”
দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” আমি কি বলেছিলাম ড্রয়ারে তুলে রাখতে তোকে?”
জ্যোতি গলা ঝাড়ল। স্বাভাবিক স্বরে বলতে লাগল,
” আমার মন বলেছিল। চোখের সামনে তো আমাদের জীবন থেকে অনেকেই ফুরিয়ে যায়, অনেকেই হারিয়ে যায়। তাদের উপহার গুলো নাহয় ফুরিয়ে নাই যাক? তাই রেখে দিয়েছি।ফুরিয়ে গেলে যদি দ্বিতীয়বার না পাই?শুধু আপনার ক্ষেত্রে নয়, দাদীর দেওয়া বাটন ফোনটাও তুলে রেখেছি আমি। ”
মেহেরাজের মুখের টানটান ভাবটা এবার মিলিয়ে গেল। রাগটা এবার কমে আসল। ঠোঁট গোল করে লম্বা শ্বাস ফেলে আর কিছু না বলেই হঠাৎ বেরিয়ে গেল।
.
মেহু মন খারাপের সময়টায় শাড়ি পরতে ভালোবাসে। ছোটবেলা থেকে মা বাবা ছাড়া বড় হওয়া মেয়ে হিসেবে অধিকাংশ সময়ই তাকে একা কাঁটাতে হয়েছে। সে একাকীত্বতেই মূলত সেই শাড়ি আর সাঁজগোজকে সঙ্গী করেছিল। আজও ব্যাতিক্রম হলো না। পরনে লাল টকটকে শাড়ি, চোখে গাঢ় কালো কাজল আর চুলে বেলিফুলের মালা। হাত ভর্তি লাল আর কালো রাঙ্গা কাঁচের চুড়ি। সে চুড়িরই রিনিঝিনি আওয়াজ করল জানালার ধারে বসে। অপর প্রান্তের জানালায় আজও ছোট বাচ্চাটা ঝুলে আছে।বয়স হয়তো আনুমানিক চার বা পাঁচবছর হবে। ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়েই আধো সুরে বলল,
” তুমি মেহু? ”
আকস্মিক মিষ্টি গলায় মেহু চমকাল। একনজর তাকিয়েই উত্তরে বলল,
” হ্যাঁ, তুমি কি করে জানলে? ”
বাচ্চাটা গম্ভীর ভাবে চাইল। বিনিময়ে বলল,
” বলা যাবে না। ”
মেহু পুনরায় চমকাল। এইটুকু বাচ্চার এমন গম্ভীর উত্তরে কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলেও পরমুহুর্তেই বলল,
” তোমার নাম?”
” সানশাইন। ”
মেহু ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ভাবল। সাইনশাইন? সুন্দর নাম। পরমুহুর্তেই বলল,
” কে রাখল এই নাম?”
” মেঘ। ”
ছোট বাচ্চাটার কন্ঠে মেঘ শব্দটা যতোটা দৃঢ় শোনাল ততোটাই দৃঢ় ভাবে মেহুর মস্তিষ্কে পৌঁছাল। অস্ফুট স্বরে ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,
” মে ্ ঘ?”
বাচ্চাটা এবারে উত্তর দিল না। মেহু মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করল বাচ্চাটাকে। চেহারাটা সেদিনকার সে যুবকের মতোই দেখতে। যুবকটির নাম আবিদ। ডাকনাম মেঘ। যুবকটির সাথে তার পরিচয় হয়েছিল কোন এক গ্রন্থাগারে সেই কিশোরী বয়সে।ছেলেটি তখন মেডিকেলে পড়ুয়া ছাত্র।তারপরের বার পরিচয় হয়েছিল একদম নতুনভাবে। তারই বান্ধবীর প্রেমিকের বন্ধু হিসেবে। বান্ধবী আর বান্ধবীর প্রেমিক প্রেমে মত্ত হতেই সে আর আবিদ নামক লোকটা অন্যপ্রান্তে এসে বসেছিল। তখন থেকেই টুকটাক কথোপকোথন, গল্প।প্রায়সই ঝগড়া আর একে অপরের পেঁছনে লেগে থাকা। কখনো সরাসরি দেখা হলে মেহুর চুল টানা অথবা পেঁছনে থেকেই মাথায় চাটি মারা। একবার বাদাম খাওয়ার পর বাদামের খোসা গুলো আড়াল করেই মেহুর ব্যাগে রেখে দিয়েছিল যুবকটি। মেহু সে বিষয়টা টের পেল একেবারে বাসায় পৌঁছে।আরো হরেক রকম কাহিনী আছে তাদের। এত এত কাহিনীর পরই ইন্টার্নী শেষে হঠাৎই আকস্মিকভাবে ছেলেটা হারিয়ে যায়।এরপর না তো মেহু কখনো খোঁজ করেছে ছেলেটার, আর না তো ছেলেটাও কোন খোঁজ নিয়েছে তার। মেহু ঠোঁট চওড়া করে কিঞ্চিৎ হাসল৷ বলল,
” মেঘ তোমার কি হয়? ”
বাচ্চাটা উত্তর দেওয়ার আগেই সেখানে উপস্থিত হলো মেঘ নামক যুবকটি। বলল,
” মেঘ ওর কি হয় তুমি জেনে কি করবে?”
মেহু চোখ তুলে চাইল। আকস্মিক চমকালেও ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
” আমি অতো বোকা নাকি?ও না বললেও আমি জানি ও আপনার কি হয়।”
যুবকটি ভ্রু নাচিয়ে শুধাল,
” কি হয়?”
মেহু উত্তরে বলল,
” ছেলে।বাবার সাথে ছেলের নাম কিন্তু দারুণ মানিয়েছে। মেঘ- রোদ। সুন্দর না?”
মেঘ হাসল। দাম্ভিক স্বরে বুক টানটান করে বলল,
” সুন্দর না হলে কি করে হয়?আমিই তো রাখলাম নামটা। তাই না?”
মেহু মাথা নাড়াল। বলল,
” চার বছর আগে হঠাৎ উধাও হয়ে গেলেন কেন? ভুল না হলে আপনার বাচ্চার বয়স পাঁচ বছর তো হবে।রাইট? আপনি আপনার বাচ্চার কথাটা লুকালেন কেন? আর বাচ্চার মা কোথায়? আলাপ করিয়ে দিন । আমি আপনার নামে কিছু সুবক্তব্য দিই। ”
মেঘ ত্যাড়া কন্ঠে শুধাল,
” বাচ্চার মাকে দিয়ে তুমি কি করবে?”
” আপনার মাথা করব। ডেকে দিন না। ”
” বাচ্চার মা পাশে রুমে। ”
মেহু ভ্রু কুঁচকাল। বলল,
” পাশের রুমে কেন থাকবে? হিসেব মতো বর বউ একরুমে থাকবেন না আপনারা? ”
মেঘ নামক যুবকটি হঠাৎই কেঁশে উঠল। গলা ঝেড়ে বলল,
” সেসব বাদ দাও।তুমি বিয়ে করলে না কেন? মাঝখানে এতবছর পেরিয়ে গেল। ”
মেহু নিরস গলায় বলল,
” সুপাত্র পাচ্ছি না। ”
মেঘ নামক যুবকটি মাথা নাড়াল৷ ছোট বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়ে মুখে চমৎকার হাসি ঝুলিয়ে বলল,
” তাহলে খুঁজে নাও। পেয়ে গেলে বিয়েটা করে বাচ্চাকাচ্চার মা হয়ে যাও দ্রুত।”
কথাটুকু বলেই পেঁছন ঘুরল। কিয়ৎক্ষনের মধ্যে চলেও গেল। মেহু তাকিয়ে থাকল। আসলেই কি সুপাত্র পেলে বিয়েটা করে নিতে পারবে সে? সাঈদ নামক ব্যাক্তিকে ভুলে অন্য কারো নামে নিজের জীবন লিখে দিতে পারবে? আসলেই কি পারবে? বিষয়টা কি এতটুকুই সহজ?
#চলবে…