এক মুঠো প্রণয় পর্ব-১৫+১৬

0
797

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_১৫
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

এই কয়দিনে মেহেরাজ ভাইয়ের সাথে বহুবার কথা হলেও বরাবরই স্বল্প শব্দে উত্তর দিয়েছি।রান্নার কাজ সহ, খাওয়ার সময়ে প্রায়সময় আমি, মেহু আপু, মেহেরাজ ভাই একসাথেই কাজ করেছি।সময়ের ব্যবধানে এই একসাথে কাজ করা কিংবা অল্প সময় কাছ থেকে দেখাতে আমি বারবারই মুগ্ধ হলাম মেহেরাজ ভাই নামক মানুষটাতে।এই মানুষটার ব্যাক্তিত্বের মতোই মানুষটার মধ্যে যত্ন, ভালোবাসা কোনকিছুরই কমতি নেই।এ কয়দিনে কতটুকু কি বুঝেছি জানা নেই, তবে এইটুকু বুঝেছি মেহেরাজ ভাই মানুষটা ভীষণ যত্নশীল।এই তো সেদিন শিমা আপা নেই বলে ভাতের মাড় ফেলার জন্য পাতিলটা হাতে নিতেই ছোঁ মেরে কেড়ে নিলেন মেহেরাজ ভাই।শাসনের সুরে বলে উঠলেন,

” বলেছি না কাজ করবি না?এক্ষুনি যা।হাত পুড়ে গেলে তখন?”

মেহেরাজ ভাইয়ের এমন অনেক শাসানো বাণীই এই কয়েক দিনে শুনতে হয়েছে।প্রথম প্রথম কোন অনুভূতি না হলেও একটা সময় পর আমার কাছে এই বাণীগুলোই চমৎকার বোধ হলো।আজকাল কেমন জানি অদ্ভুত আলাদা ভালো লাগা হৃদয় ছুুঁয়ে যায় উনার এসব সচেতন বাক্য শুনে।সেদিনে পর হঠাৎ একদিন মেহেরাজ ভাই একসাথে অনেকগুলো জামাকাপড় কিনে আনলেন।শুধু জামা নয় অবশ্য, শাড়িও এনেছিলেন।মেহু আপু বলেছিল এসব নাকি মেহু আপুকে নিয়েই কিনেছিলেন।আমি সেইবার আপত্তি জানালেও মেহেরাজ ভাই রাগে টানটান মুখ আর শক্ত চোয়ালেই থামিয়ে দিলেন।এর কিছুদিন পর একদিন রাতে ক্লান্তিতে শরীর নুইয়ে আসতেই রাতের বেলা না খেয়েই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।মেহু আপু অনেক ডাকাডাকি করলেও কেন জানি না তখন ঘুমই আমার কাছে বেশি গুরুত্ব পেল। সেইদিন আমার বাটন ফোনে টানা ত্রিশবার কল দিলেন মেহেরাজ ভাই।বাসায় একা থাকি বলে নাম্বারটা একদিন মেহেরাজ ভাইই নিয়েছিলেন।তাই বলে এভাবে নাম্বারটাকে কাজে লাগাবেন আমি কখনোই ভাবিনি।মোবাইলের আওয়াজে শেষমেষ বিরক্ত হয়ে চোখ মেলে তাকাতেই হলো আমায়। কল রিসিভড করতেই ওপাশ থেকে মেহেরাজ ভাই গম্ভীর গলায় শুধালেন,

” দরজা খুল। খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।”

মেহেরাজ ভাইয়ের সে কথাটাও কেন জানি না আমার ভালো লাগল সেদিন।কিয়ৎক্ষন তব্দা মেরে বসে থেকে উঠে গিয়ে দরজা খুললাম।দেখলাম মেহেরাজ ভাই হাতে খাবার প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।মুখটা টানটান করা।চিবুক শক্ত!কপালে বিরক্তির ভাজ।চোখমুখে একবার তাকিয়েই বুঝলাম উনি রেগে আছেন। কেন জানি না সেইদিন এই রাগটাও আমার ভালো লাগল।তবে ভালো লাগাটা প্রকাশ করলাম না অবশ্য।মেহেরাজ ভাই খাবারের প্লেট সমেত ঘরে ডুকলেন।চেয়ারের উপর প্লেটটা রেখে গিয়েই আবারও বের হয়ে বাইরে গেলেন।তারপর হাতে করে এক গ্লাস পানি এনে পাশে রেখে ক্ষোভ নিয়ে গম্ভীর আওয়াজে বললেন,

” চুপচাপ খেয়ে নিবি জ্যোতি।তুই বাচ্চা নোস যে তোকে জোর করে খাওয়াতে হবে।”

কথাটুকু বলেই উনার দাম্ভিক চেহারায় রাগ ফুটিয়ে চলে গেলেন।আমি অবশ্য সেদিন চুপচাপ খেয়ে নিয়েছিলাম।এরপরও অনেকবার মেহেরাজ ভাই শাসন করেছেন, সচেতন করেছেন।আজকাল এসব ভালো লাগায় পরিণত হয়েছে।পৃথিবীতে নিজের খেয়াল রাখার মতো কাউকে পেলে নিঃসন্দেহে সবারই ভালো লাগে।আমার ক্ষেত্রেও ব্যাতিক্রম হলো না।এই যেমন পরশু যখন ছাদে গিয়েছিলাম তখন ছাদে মেহেরাজ ভাইও ছিলেন।উনাকে দেখে বেশিক্ষন না থেকে ছাদ ছেড়ে চলে আসতে নিতেই ছাদের দরজায় পা লেগে সাংঘাতিক ভাবে পড়ে গেলাম।হাতের তালুর দিকটা ছাদের খসখসে ফ্লোরে ঘষা খেয়ে বেশ খানিকটা কেঁটে গেল।সঙ্গে সঙ্গে ফিনিক রক্ত বের হলো। মেহেরাজ ভাই তা খেয়াল করেই রাগ ঝেড়ে চাপাস্বরে বললেন,

” দেখেশুনে হাঁটিস নাকি চোখ কপালে রেখে হাঁটিস?এত বড় মেয়ে হয়ে পড়ে যায় কিভাবে মানুষ?”

মেহেরাজ ভাইয়ের কথাটা চরম অপমানিত বোধ হলেও কেন জানি না আমার ভালো লাগল। নিজের দোষ স্বীকার করে স্পষ্টভাবে বলে বসলাম,

” খেয়াল করিনি। ”

মেহেরাজ ভাই ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন ছুড়লেন,

” কি খেয়াল করিসনি?”

নিরস গলায় বললাম,

” এভাবে পড়ে যাব বুঝে উঠিনি।”

” পড়ে গিয়ে হাত কেঁটে বুঝে উঠিনি বললে লাভ আছে?”

আমি একপলক তাকিয়ে গলা ঝেড়ে বললাম,

” কেউ পড়ে গেলে এভাবে রাগ ঝেড়ে কথা বললেও তো বিশেষ লাভ নেই মেহেরাজ ভাই।”

মেহেরাজ ভাই আমার কথাটায় বিরক্ত হলেন।কপাল কুঁচকে ঝুঁকে দাঁড়ালেন আমার দিকে। নিজের বলিষ্ঠ হাতটা বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে।তারপর শান্তভাবে বললেন,

” উঠ। ”

আমি উনার দিকে চাইলাম।হাতটা না ধরেই উঠে দাঁড়িয়ে পড়লাম।মেহেরাজ ভাই বুক টানটান করে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। হাত দুটো টাউজারের পকেটে গুঁজে সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতেই বললেন,

” গুড!নিজে নিজে যেমন দাঁড়ালি?ঠিক তেমনই নিজেকে নিজে সেইফ রাখাটাও শিখ।”

কথাটুকু বলে মেহেরাজ ভাই নেমে গেলেন।পিঁছু পিঁছু নামলাম আমিও।বাসায় পা রাখতেই দেখলাম মেহেরাজ ভাই সোফায় বসে আছেন।আমাকে দেখেই বলে উঠলেন,

” এদিকে আয়।”

আমি না গিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকলাম। কেন ডাকছেন তা বুঝার চেষ্টা করলাম।কিন্তু বুঝে উঠার আগেই মেহেরাজ ভাই দ্বিতীয়বার রাগ ঝেড়ে বলে উঠলেন,

” কি হলো কথা শুনতে পাসনি?”

মাথা নাড়িয়ে বললাম,

” পেয়েছি।”

উনি ডান ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

” তো দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”

আমি এবার কথা বাড়ালাম না।উনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মেহেরাজ ভাই মাথা তুলে তাকালেন একবার শীতল চাহনীতে। এরপর বললেন,

” কোন হাত কেঁটেছে?”

” ডান হাত।”

” হাত দে।”

আমি এবারও উনার কথা শুনলাম না।হাত না বাড়িয়ে দিয়ে সূক্ষ্ম চোখে উনাকে খেয়াল করলাম। মেহেরাজ ভাই বোধহয় এবারও বিরক্ত হলেন।ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

” কি হলো?”

বললাম,

” না মানে, কেন? ”

মেহেরাজ ভাই এবার জবাব দিলেন না।নিজ থেকেই আমার ডান হাতটা টেনে নিলেন।কাঁটা জায়গাটা পরিষ্কার করে মলম লাগিয়ে দিলেন।তারপর আর কোন কথা না বলে উঠে চলে গেলেন।আমি পুরোটা সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম আর সবকিছু খেয়াল করে গেলাম।একটা মানুষ এতটা যত্ন করতে পারে?ছোটবেলা থেকে যত্ন না পাওয়া আমার কাছে এইটুকু যত্নই বিশাল মনে হলো।এইটুকু খেয়াল রাখাও অনেক বেশি বোধ করলাম।মনে মনে মুগ্ধ হলাম।ভালোবাসার মানুষ থেকে স্বল্প যত্নও বৃহৎ খুশির কারণ হয়।মাঝে মাঝে আপসোস হয় কেন উনার ভালোবাসা পেলাম না।যদি উনার ভালোবাসা পেতাম তবে নাজানি কতোটা যত্নে আগলে রাখতেন উনি?আচ্ছা, সামান্তা আপুকে কতোটা যত্নে রাখতেন উনি?ইশশ!আমার ভাগ্যে যদি উনার ভালোবাসাটুকু জুটত?আনমনে এসব অহেতুক ভাবনা ভেবেই আবার সেই ভাবনাকে তীব্র জেদের অন্তরালে লুকিয়ে রাখি।

.

হঠাৎ হওয়া সেই সাদামাটা, যন্ত্রনাময় বিয়ের পর সেই বিধ্বস্ত রূপে এই বাসায় আসার পর মাস পার হলো।ধীরে ধীরে সময় কাঁটল।বাড়ি যাওয়ার সময় হয়ে আসল যেন খুব দ্রুত।টেস্ট পরীক্ষার এক সপ্তাহ আগেই বাড়ি যাওয়ার সময় ঠিক হলো।আমি ব্যাগ গুঁছিয়ে রাখলাম রাতেই।সকালে উঠে হাত মুখ ধুঁয়ে রুম ছেড়ে বের হয়েই মেহু আপুর ঘরে গেলাম।মেহু আপু তখনও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে দেখে আবারও ফেরত আসলাম নিজের ঘরে।জানালা দিয়ে কয়েক পলক তাকিয়েই ভাবলাম, এটাই হয়তো এই বাসায় কাটানো শেষ দিন।বাড়িতে যাওয়ার পর দাদীকে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে বুঝাতে হবে যাতে আমাকে আর এখানে ফেরত না আসতে হয়।বাড়িতে যন্ত্রনা, কষ্ট, অপমান যাই থাকুক তবুও একজনের ঘাড়ে দায়িত্ব হয়ে পড়ে থাকার থেকে স্বস্তি আছে।কথা গুলো ভাবতে ভাবতেই ঘন্টা পার হলো।জানালার ওপাশে তাকানো অবস্থাতেই কানে এল মেহেরাজ ভাইয়ের গলা ঝাড়ার আওয়াজ। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম মেহেরাজ ভাই আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছেন।মেহেরাজ ভাইয়ের নিঃশব্দে চলন সম্পর্কে জানা আছে বলেই অবাক হলাম না আর।বলল,

” কিছু বলবেন মেহেরাজ ভাই?”

মেহেরাজ ভাই তাকালেন। বুকে হাত গুঁজে বললেন,

” বিকালে রওনা দিব।ব্যাগ গুঁছিয়ে নিস। ”

” ব্যাগ গুঁছিয়ে ফেলেছি রাতেই।”

” এত তাড়া?”

” তাড়া তো একটু থাকবেই মেহেরাজ ভাই।ওখানে দাদী আছেন, মিথি আছে, মিনার ভাই আছে।সব আপন মানুষদের রেখে এসেছি ওখানে। তাড়া থাকবে না?”

মেহেরাজ ভাই ঠোঁট চওড়া করে কিছু বলতে নিতেই মোবাইলে আওয়াজ হলো। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। মিনার ভাই নামটা জ্বলজ্বল করছে বাটন ফোনের চারকোনা স্ক্রিনে।বোধহয় দাদীই কল দিতে বললেন।যাওয়ার কথা শোনার পর থেকেই কাল থেকে এই পর্যন্ত বেশ কয়েকবার কল দিয়ে ফেলেছেন দাদী। যেন অধীর আগ্রহে আমার যাওয়ার অপেক্ষা করে আছেন।আমি হাসলাম হালকা। মোবাইলটা তুলে নিতে নিতেই মেহেরাজ ভাইকে বললাম,

” কিছু বলবেন মেহেরাজ ভাই?বলে ফেলুন। ”

মেহেরাজ ভাই একনজর মোবাইলের দিকে তাকিয়েই বললেন,

” তেমন কিছু নয়।তুই কথা বলে নে। আর হ্যাঁ, বিকালে তৈরি হয়ে থাকিস।”

কথাটুকু বলেই চলে গেলেন উনি।আমি একনজর তাকিয়ে মিনার ভাইয়ের কল উঠালাম।বললাম,

” মিনার ভাই,এত সকালে কল দিয়েছো?দাদী বলল বুঝি?”

মিনার ভাই কয়েক মিনিট চুপ থাকলেন।তারপর বলল,

” না, দাদী বলেনি।”

ফের প্রশ্ন করলাম,

” তবে?তুমি কল দিয়েছো?”

” কেন?আমি বুঝি কল দিতে পারি না তোকে? ”

” তেমন ভাবে বলিনি মিনার ভাই।”

মিনার ভাই প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করল,

” কখন আসছিস?”

জবাবে বললাম,

” মেহেরাজ ভাই বলেছে বিকালে রওনা দিবে। আসতে আসতে রাত হবে। ”

” ওহ।আচ্ছা রাখছি।”

মিনার ভাই কথাটা বলেই কল রাখলেন।আমি ছোট্ট শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালাম।মেহু আপুর ঘরে গিয়ে মৃদু আওয়াজে ডাকলাম,

” আপু?উঠবে না?”

মেহু আপু চোখমুখ কুঁচকে তাকালেন।ঘুমজড়ানো কন্ঠে বললেন,

” জ্যোতি?এত তাড়াতাড়ি কি করে উঠিস ঘুম থেকে?”

কথাটা বলেই আপু আবারও চোখ বুঝে নিলেন। আমি হাসলাম কেবল। মেহু আপু বয়সে আমার থেকে বড় হলেও মাঝে মাঝে কেন জানি না আমার কাছে আপুকে বেশ প্রাণবন্ত তরুণী বয়সের কোন মেয়ে মনে হয়।যে হাসতে জানে, গাইতে জানে, মজা করতে জানে, আবার গম্ভীরভাবে কথাবার্তাও বলতে পারেন।কোন সময় বেশ প্রাণবন্ত তো কোনসময় বেশ গম্ভীর।

.

বিকাল হলো।মেহু আপুকে বিদায় দিয়ে রওনা হলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। রিক্সায় মেহেরাজ ভাই আর আমি পাশাপাশি একসাথেই বসলাম।মাঝেমাঝে রাস্তার আঁকেবাঁকে রিক্সার ঝাকড়ানোতে মেহেরাজ ভাইয়ের শরীর আর আমার শরীর মিলিয়ে গেল।সেই অপ্রত্যাশিত শরীরের ছোঁয়ায় তীব্র অস্বস্তিতে আমি আড়ষ্ট হয়ে থাকলেও মেহেরাজ ভাইয়ের মুখভঙ্গিতে তেমন কোন আড়ষ্টতার ছাপ পড়ল না।উনি বেশ স্বাভাবিক ভাবেই টানটান চাহনী নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।একপর্যায়ে রিক্সা থামল। মেহেরাজ ভাই নামার আগেই আমি নামলাম দ্রুত।এক হাতে ব্যাগটা নিতেই মেহেরাজ ভাই নামলেন।ভাড়া মিটিয়ে শীতল চাহনীতে এক নজর আমার দিকে তাকিয়েই ব্যাগটা কেড়ে নিলেন।পা বাড়াতে বাড়াতে বললেন,

” রিক্সা থেকে ওভাবে লাফিয়ে নামলি কেন?পড়ে গেলে কি হতো? তোর কাঁটাছেড়া হাত পা সমেত তোকে তোর দাদীর কাছে পৌঁছে দিয়ে আসতাম?”

আমি শুনলাম। পা চালিয়ে বললাম,

” আমাকে যথাযথ সুস্থ আর আঘাতবিহীন হিসেবে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন?”

মেহেরাজ ভাই আমার দিকে তাকালেন।ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠলেন,

” তো তোকে আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত করে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলাম?”

তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসলাম।বললাম,

” আজকের পর তো শেষই আপনার দায়িত্ব।এতদিন সুসম্পন্ন ভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারলে শেষ একদিনে আর এমন কি হয়ে যাবে?”

আমার কথার বিনিময়ে মেহেরাজ ভাই উত্তর দিলেন না।আমিও আর আগ বাড়িয়ে কথা বললাম না। অল্প সময় পর বাসে উঠলাম। পাশাপাশি বসলেন মেহেরাজ ভাইও।বাসের সিটে দুইজনের মাঝে অল্প দূরত্ব থাকায় এবার আর অস্বস্তি হলো না।চার কোণা জানালার ওপাশে চোখ রেখেই দৃষ্টি স্থির করলাম।যাত্রাপথের অর্ধেকটা পথই কাঁটল জানালার ওপাশের বাইরের দৃশ্যপট দেখতে দেখতেই।

#চলবে….

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_১৬
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

ঘুম ভাঙ্গল মেহেরাজ ভাইয়ের কাঁধে মাথা রেখেই।এপাশ ওপাশ তাকিয়ে জানালার ওপাশটায় চোখ পড়তেই বুঝলাম রাত হয়েছে।বাসে কখন যে চোখ লেগে এসেছিল বুঝেই উঠিনি আমি।তারপর ঘুমের ঘোরেই বোধহয় মেহেরাজ ভাইয়ের কাঁধে হেলে পড়েছিলাম।মেহেরাজের ভাই নির্ঘাত বিরক্ত হয়েছেন এই ব্যাপারে?বিষয়টা ভেবেই নিজের প্রতি রাগ জম্মাল।একটা মেয়ে হয়ে একজন পুরুষ মানুষের কাঁধে নিজ থেকে ঢলে পড়াটা নিশ্চয় খুব একটা ভালো দেখায় না।বরং চমৎকার বেহায়াপনা বোঝায় এতে।নিজেকে এই মুহুর্তে জঘন্যতম বেহায়া মানুষ বোধ হলো আমার।দ্রুত মেহেরাজ ভাইয়ের কাঁধ থেকে মাথা সরিয়ে সোজা হয়ে বসলাম।জানালার অপর প্রান্তে তাকাতে নিতেই মেহেরাজ ভাই নড়েচড়ে বসলেন। আমি এক পলক তাকালাম উনার দিকে।সঙ্গে সঙ্গেই মেহেরাজ ভাই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

” ঘুম শেষ? ”

আমি ইতস্থত বোধ করলাম উত্তর দিতে।পরমুহুর্তেই স্বাভাবিক হয়ে স্পষ্ট গলায় বলে উঠলাম,

” মেহেরাজ ভাই, আমি দুঃখিত।বিশ্বাস করুন আমি ইচ্ছে করে আপনার কাঁধে মাথা রাখিনি।বোধহয় ঘুমের ঘোরেই মাথা রেখেছিলাম।এমনটা হবে জানলে আমি সর্বোচ্ছভাবে সচেতন থাকতাম যাতে চোখে ঘুম না নামে।”

মেহেরাজ ভাই কুঁচকানো ভ্রু আরো কুঁচকে নিলেন।জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে উঠলেন,

” রাতে ঘুমাসনি?নাকি বাড়ি যাওয়ার আনন্দে সারারাত ঘুম হয়নি তোর?”

মেহেরাজ ভাই প্রশ্নটা অতি স্বাভাবিক ভাবে করলেও এই প্রশ্নটা দ্বারাই বুঝতে পারলাম উনি বিরক্ত হয়েছেন।শুধু বিরক্ত নয়, চরম বিরক্ত হয়েছেন।সহসা নিজের মধ্যে খারাপ লাগা কাজ করল।একটা মানুষ বিরক্ত হচ্ছে আমার কারণে বিষয়টাতে অবশ্যই খারাপ লাগার কথা। আমি চোখ ছোট ছোট করে আড়ষ্ট গলায় বলে উঠলাম,

” ঘুমিয়েছি।তবুও বাসে উঠার পর ঘুম আসল কেন জানা নেই।”

মেহেরাজ ভাই বিনিময়ে বললেন,

” ঝিমুতে ঝিমুতে তো তোর ঘাড়টা ভেঙ্গে জানালার অপর প্রান্তে যাচ্ছিল আরেকটু হলে।তার কিছুক্ষন পরে দেখি ঘুমিয়েই গেছিস।তাও আবার জানালা ঘেষে মাথা রেখে। কয়েকবার ঠাসঠাস করে মাথায় লাগল ও তোর।কিন্তু তোর ঘুম দেখি ভাঙ্গলই না।তখনই বুঝলাম গভীর ঘুম!তাই জিজ্ঞেস করলাম রাতে ঘুম গিয়েছিলি কিনা।”

মেহেরাজ ভাই বোধ হয় আমার আড়ষ্টতা কাঁটাতেই কৈফিয়তের সুরে কথাগুলো বললেন।তবুও আমার খারাপ লাগা কাঁটল না।মনে মনে নিজেকে হাজারবার সচেতন করলাম আর যাতে ঘুম না পায়।আর যাতে উনার কাঁধে ঘুমন্ত অবস্থায় হেলে পড়তে না হয়।পরমুহুর্তেই মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগল।মেহেরাজ ভাই মাত্রই বললেন ঘুমিয়েছিলাম জানালা ঘেষে মাথা রেখে।তার মানে উনার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাইনি।তবে?উনিই কি আমার মাথাটা উনার কাঁধে রেখেছেন?বিষয়টুকু ভেবেই সঙ্গে সঙ্গে মন থেকে মুঁছে নিলাম ভাবনাটা।এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীন।হয়তো ঘুমের ঘোরে আমিই মাথা রেখেছিলাম।বললাম,

” খেয়াল করিনি মেহেরাজ ভাই।আপনাকে ইচ্ছে করেই শুধু শুধু বিরক্ত করিনি।এটা সম্পর্ণ অনিচ্ছাকৃত।”

মেহেরাজ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন ছুড়লেন,

” কি?”

বললাম,

” আপনার কাঁধে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তাই।”

মেহেরাজ ভাই এবার আর কিছু বললেন না।কাঁধ ঝাকিয়ে সোজা হয়ে বসলেন। আমি ও আর তাকালাম না উনার দিকে। বাকিটা পথ জানালার ওপাশে অন্ধকার পথ দেখেই কাঁটালাম।

.

আমরা বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত নয়টা কি দশটা বাঁজল। দাদী তখনও ঘরের সামনে কাঠের চেয়ারে বসা।বোধ হয় আমাদেরই অপেক্ষা করছিল।বাড়িতে পৌঁছানো মাত্রই উঠোনে দাদীকে বসা অবস্থায় দেখে খুশিতে চকচক করে উঠল আমার চোখজোড়া।এগিয়ে গিয়ে সালাম দিয়েই জড়িয়ে ধরলাম দাদীকে।দাদীর শরীরে সেই পান চিবানো স্যাঁতস্যাঁত ঘ্রাণটা নিয়েই তৃপ্ত হলো মন।কতক্ষন জড়িয়ে রাখলাম জানি না।এক পর্যায়ে দাদীই ধমক দিয়ে বলে উঠলেন,

” হইছে তোর? আইয়াই এমনে ঝাপটাইয়া ধরছস ক্যান?ছাড়।দমবন্ধ হইয়া আইতাছে আমার।”

দাদী যে এটা সম্পূর্ণ মিথ্যে বলছে তা আমার জানা। তবুও ছেড়ে একপাশে দাঁড়ালাম।বলে উঠলাম,

” কেমন আছো দাদী? এত রাতে উঠানে চেয়ার নিয়ে বসে আছো যে?আমাদের অপেক্ষায়?”

দাদী নিখুঁত ভাবে গোপন রাখলেন নিজের ভালোবাসা।বললেন,

” বাইরেডায় বাতাস আছে দেহস না?তার লাইগাই বইসা ছিলাম।সর, রাজের লগে কথা কই।”

আমি সরে দাঁড়ালাম।দাদী দু পা এগিয়ে মেহেরাজ ভাইয়ের সামনে দাঁড়াতেই মেহেরাজ ভাই ঠোঁট চওড়া করে হেসে সালাম দিলেন। দাদী বোধহয় খুশিই হলো।সালামের উত্তর দিয়েই বলে উঠলেন,

” আইতে আইতে এত রাইত করলা।আরো তাড়াতাড়ি বাইর হইতে পারতা তো।”

মেহেরাজ ভাই ভদ্রভাবে উত্তর দিলেন,

” বিকালের বাসে উঠেছিলাম।রাস্তায় হালকা জ্যামও ছিল তাই দাদী।ভালো আছেন আপনি? ”

” হ, ভালাই আছি।চলো, ঘরে চলো।টিনের ঘরে ঘুমাইতে পারবা তো?নাকি তোমাগো বাড়ির চাবি আনছো?”

মেহেরাজ ভাই পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়ালেন।বললেন,

” আসলে দাদী, আমি তো থাকার প্রস্তুতি নিয়ে আসিনি।তাই বাড়ির চাবিও আনিনি।রাতের বাসেই ফেরত যাব।”

দাদী মুহুর্তেই ক্ষেপে উঠলেন।কিঞ্চিৎ গলা উঁচিয়ে বলে উঠলেন,

” তা কি কইরা হয়?আইছো যহন রাইতটা থাইকাই যাইবা।এই কথায় শেষ কথা।”

দাদীর কথায় মেহেরাজ ভাই চুপ থাকল কিয়ৎক্ষন।তারপর নিজ উদ্যমে বুঝাতে লাগলেন যে উনার রাতে ফিরে যাওয়াটাই উচিত কাজ হবে।মেহু আপুও বাসায় একা।কিন্তু দাদী মানতে নারাজ।অবশেষে ঠিক হলো মেহেরাজ ভাই রাতে থাকবেন।উঠোনে এই নিয়ে সিদ্ধান্ত ঠিক করে তবেই ঘরে ডুকলেন দাদী। পিঁছু পিঁছু আমি আর মেহেরাজ ভাইও গেলাম।স্যাঁতস্যাঁতে মাটির মেঝেতে পা রেখে মেহেরাজ ভাইয়ের কিরুপ প্রতিক্রিয়া হলে জানা নেই।তবে জুতোজোড়া খুলতে নিতেই আমি বলে উঠলাম,

” জুতো না খুললে কিছু হবে না মেহেরাজ ভাই।আপনার পায়ে ময়লা লাগবে নয়তো।”

মেহেরাজ ভাই একবার তাকালেন। কি বুঝে জুতা না খুলে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন।দাদী উনাকে বসালেন আমার ঘরের কাঠের খাটটায়।কিছুক্ষন সেখানেই গল্পগুজব করলেন দাদী আর মেহেরাজ ভাই। আমি ততক্ষনে দাদীর ঘরে নিজের পরনের জামাটা পাল্টে সুতির সালোয়ার কামিজ পরলাম।মাথায় ঘোমটা টেনে বের হয়েই বাইরের আলোটা জ্বালিয়ে কলে গিয়ে চোখমুখে পানি দিলাম।একবার চারপাশে তাকিয়ে অন্ধকারে গাছ গাছালিগুলো দেখলাম।কতদিন পর আবার সেই গ্রামে। আবার সেই প্রশান্তির বাতাস। আবার সেই গাছাগাছালি নড়েচড়ে উঠা সবুজ পাতার সান্নিধ্যের ছোঁয়া।চোখ বুঝে একবার অনুভব করলাম আশপাশের ঠান্ডা হাওয়া।তারপর আবারও ঘরে গেলাম।নিজের রুমের দরজা ঘেষে দাঁড়াতে কানে এল দাদীর গম্ভীর স্বর,

” হুনো রাজ, তোমারে ভালা ছেলে জানি বইলাই তোমার লগে ঐ দুর্দশায়ও বিয়া দিতে আমি এক মুহুর্তেই মত দিয়া ফেলছিলাম। রাইতের বেলায় ঘুমাইতে আইলে অন্তত এইটুকু বিষয় ভাইবা স্বস্তি পাইতাম যে জ্যোতিরে একজন ভালা মানুষের হাতে তুলে দিতে পারছি।জ্যোতিরে ছোড থেইকা বড় আমিই করছি।শরীরের অবস্থা এহন আমার ভালা যায় না।কয়দিন বাঁচি তারও ঠিক নাই।শরীর দুইদিন ঠিক থাহে যদি তো তিনদিন থাহে বেঠিক।ভাবছিলাম মইরা গেলেও স্বস্তি পামু।জ্যোতিরে অন্তত তোমার মতো একডা ভালা পোলার হাতে তুইলা দিছি। কিন্তু হাছা কইতে এহন আর সেই স্বস্তি পাই না যেইদিন থেইকা হুনছি তোমার লগে সামান্তার ভালোবাসার সম্পর্ক আছে।”

কথাগুলো শুনেই আমার পা থেমে গেল মুহুর্তেই। তারমানে দাদীও সবটা জানে?মেহেরাজ ভাই যে সামান্তা আপুকে ভালোবাসে এটা দাদীও জানে বোধ হতেই মস্তিষ্ক শূণ্য অনুভব করলাম।দাদী কি করে জানে?কে বলল?আব্বা এসেই কি দাদীকে বলেছে এসব?এসব ভাবতে ভাবতেই আঙ্গুলে ওড়না পেঁচিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকলাম সেখানে। মেহেরাজ ভাই গলা ঝাড়লেন। উত্তরে বলে উঠলেন,

” দাদী,এটা তো সত্যিই যে জ্যোতির সাথে আমার বিয়েটা স্বাভাবিক ভাবে হয়নি।তাই সংসারটাও স্বাভাবিক ভাবে হবে আশা করাটা বোকামো নয়?বিয়েটা আকস্মিক ভাবেই হয়েছে।তো আমার আগে একটা সম্পর্ক থাকা, কিংবা তখন অন্য কাউকে ভালোবাসাটা তো অস্বাভাবিক ছিল না দাদী।তাই না?আপনারা তো তখন খোঁজ নিলেন না আমি কাউকে ভালোবাসি কিনা।জোর করেই একটা সিদ্ধান্ত ছাপিয়ে দিলেন।তাও বিয়ের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে।”

দাদী প্রশ্ন ছুড়লেন,

” ভুলটা আমগোরই কইতে চাইতাছো তুমি?তার মানে তুমি এহনও ঐ সামান্তারেই ভালোবাসো?জ্যোতিরে মানবা না তাই তো?”

মেহেরাজ ভাই নরম গলায় বললেন,

” আমি এমন কোন কথা উল্ল্যেখ করিনি দাদী।বিষয়টা ভুল ভাবে নিচ্ছেন আপনি।আমার সাথে সামান্তার সম্পর্ক ছিল।কিন্তু এখনও সম্পর্ক আছে এমনটা বলিনি তো।জ্যোতির সাথে বিয়েটা আমি অস্বীকার করি না।জ্যোতিকেও অস্বীকার করি না।আর এমনও বলিনি যে আমি জ্যোতিকে মানব না বা মানি না।”

দাদী বলল,

“তো কি কইতে চাও?দুইজনরেই তুমি জীবনে রাখতাছো?একজনরে ভালোবাসতা, অন্যজন কেবল চাপাইয়া দেওয়া সিদ্ধান্ত হইয়াই থাকব গোটা জীবন?”

মেহেরাজ ভাইয়ের গলাটা এবার আরো শান্ত শুনালো।নরম কন্ঠে অল্প আওয়াজে বলতে লাগলেন,

” ভালোবাসা বিষয়টা তো অতোটা স্বস্তা নয় দাদী।একজনকে ভালোবেসেছিলামই যখন তখন তাকে সারাজীবন পাওয়ার স্বপ্নও দেখেছিলাম।তাকে মনে জায়গাও দিয়েছিলাম।সেসব কিছু কি এক মুহুর্তেই মুঁছে দেওয়া যায়? ভালোবাসা তো অতোটা ঠুনকো নয়।তবে এমনটাও নয় যে জ্যোতির প্রতি আমার কোনদিন অনুভূতি জম্মাতে পারে না।পারে, অবশ্যই পারে।তবে সেটা সময় সাপেক্ষ!ভালোবাসা কখনো কয়েক মুহুর্তেই সৃষ্টি হয় কখনও বা কয়েক যুগ লেগে যায়।কখনো একজনেই সীমাবদ্ধ থাকে, কখনো বা নতুন করে অন্য কাউকেও ভালোবাসা যায়।”

দাদী চুপ থাকলেন কিছুক্ষন। তারপর অনুরোধের সুরে বললেন,

” তোমারে ভরসা করি রাজ।ভরসাডা ভাইঙ্গা দিও না দয়া কইরা।জ্যোতির জীবনডা শেষ করার দায়টা বয়ে বেড়াইতে যে পারুম না আমি।”

মেহেরাজ ভাই গম্ভীর স্বরে বলল,

” আশা করি আপনার ভরসা ভাঙ্গবে না।”

তারপর আর কোন কথা আসল না ও ঘর থেকে।কয়েক মুহুর্ত পর দাদী বের হলেন ঘর ছেড়ে। আমায় ঘরের সামনে দেখে বলে উঠলেন,

” আজ তোর আব্বাগো ঘরে খাবি।তোর ছোট আম্মায় রান্না করতাছে কইয়া গেছিল আনোয়ার ঘন্টা দুই আগে।”

আমি চোখ ছোট ছোট করে তাকালাম। আব্বাদের ইটের প্রাচীরের ঘরে সেই ছোটবেলায় আম্মা চলে যাওয়ার পর দুয়েকটা বছর কেঁটেছে আমার।সেই দুয়েকটা বছর ছিল আমার কাছে অসহনীয় যন্ত্রনার। আম্মার প্রতি আব্বার তীব্র রাগ, ক্ষোভ আর ক্রোধের স্বীকার হতাম তখন আমি আর মিথি।মিথি তখন ছোট্ট শিশু।নরম তুলতুলে ঠোঁট উল্টে আওয়াজ তুলে কান্না করে উঠত আব্বার ধমকে।আর আমি নিরবে চোখের পানি ফেলতাম।কখনো বা আম্মুর প্রতি তীব্র অভিমান নিয়ে অনশন করতাম। আম্মার কাছে কি সেই অভিমান পৌঁছাত? পৌঁছাত না। আমার আম্মা আব্বা দুইজনই নিষ্ঠুর। একজন সন্তানের কথা না ভেবে অন্য পুরুষকে আপন করেছে। অন্যজন চিরকাল কেবল আমায় ধমক, চড়- থাপ্পড় আর অবহেলা দিয়েছেন।সেই চড়- থাপ্পড় থেকে বাঁচাতেই মূলত দাদী আমাদের এই টিনের ঘরে আনলেন।তারপর থেকে অবশ্য আর কখনো পা রাখা হয়নি আব্বার সেই ঘরে।সেই যে দাদীর এই টিনের ঘরে থাকা শুরু করেছিলাম। এখন পর্যন্তও সেই ঘরই আমার বাসস্থান।দাদীরও এই টিনের ঘরটা ভীষণ প্রিয়।কারণ এই ঘরটা দাদার থাকাকালীন ঘর।আব্বা, ফুফু সহ দাদা-দাদীর দাম্পত্য জীবন এই ছোট্ট টিনের ঘরেই কেঁটেছে।আব্বা, ফুফুরা সবাই ছোট থেকে বড় হয়েছেও এই টিনের ঘরটাতেই।মাঝেমাঝে টিন পাল্টানো হলেও দাদী নাকি এই ঘরে দাদার অস্তিত্ব খুঁজে পায়।খুঁজে পায় দাদার ভালোবাসা ও।তাই তো এই ঘর ছাড়া, এই বাড়ি ছাড়া দাদীকে কখনো একরাতও অন্য কোথাও থাকতে দেখিনি।ভাবনা ছেড়ে বেরিয়ে দাদীর কথায় মাথা নাড়ালাম।জিজ্ঞেস করলাম,

” উনাদের আবার এসব করার কি দরকার ছিল দাদী?তুমি যা রান্না করতে তাই নাহয় খেয়ে নিতাম।”

দাদী হালকা হাসলেন।বললেন,

” তুই যাওয়ার পর থেইকা তোর ফুফুই রাইন্ধা দিয়া যায়।আইজকা ও নাই বাড়িতে। তাই তোর ছোট আম্মায় খাবার দিয়া গেছে।”

দাদীর কথায় কষ্ট হলো।মানুষটার বয়স হয়েছে।চোখমুখ কেমন আগের থেকে শুকিয়ে গেছে।চোখের দৃষ্টিও কেমন ফাংসে হয়ে এসেছে যেন।আমার না থাকাকালীন না জানি কতোটা কষ্টে কেঁটেছে।আচ্ছা, দাদীর যে সকালে চা খাওয়ার অভ্যাস।সকাল সকাল চা করে দিত কি ফুফু?দাদীর যে মাথায় তেল দেওয়ার অভ্যাস আছে প্রতিদিন।প্রতিদিন তেল দিয়ে দিত কেউ?দাদীর যে প্রায়সই কোমড় ব্যাথায়, হাঁটু ব্যাথায় মলম লাগাতে হতো। কে লাগিয়ে দিত?দাদীকে যে প্রতিবেলায় বেলায় ঔষুধ দিতে হতো।কে দিত প্রতিবেলায় ঔষুধ?দাদীর মাথা ব্যাথা করলে যে উঠোনে বসে দাদীর চুলে সিঁথি কেঁটে দিতাম।কে দিত?আমি বিহীন দাদীর সময়গুলো কি আসলেই খুব ভালো কেঁটেছে?জানা নেই।মুহুর্তেই দাদীকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলাম।অস্ফুট স্বরে বললাম,

” এবার আর তোমায় ছেড়ে যাব না দাদী।রান্না, চলাফেরা সব আগের মতো খেয়াল রাখব। ”

দাদী ধমক দিয়ে বললেন,

” হ, তুই এহন পরীক্ষার পড়া ফালাইয়া আমার পেঁছনে পইড়া থাইকবি?”

বললাম,

” থাকলে কি সমস্যা?”

দাদী আমাকে অনুকরন করেই ব্যঙ্গ করে বললেন,

“এ্যাঁ,থাকলে কি সমস্যা? বহুত সমস্যা।তোরে কইত হইব ক্যান?”

দাদীর কথা শুনে আমি হেসে দিলাম আওয়াজ করে।কতদিন পর এভাবে আওয়াজ তুলে হাসলাম জানা নেই।কিয়ৎক্ষন সে হাসিতে মেতে থাকতেই চোখে পড়ল মেহেরাজ ভাইয়ের অদ্ভুত দৃষ্টি। মুহুর্তেই আমার হাসিটা থেমে গেল।

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে