#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_১০
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ
কাঁটল আরো ছয় ছয়টাদিন।মেহেরাজ ভাইকে এখন আর অগোছাল চুল, রাঙ্গা চোখ নিয়ে দুঃখ যাপন করতে দেখি না।বুদ্ধিমান মানুষরা বোধ হয় দুঃখকে দীর্ঘস্থায়ী না করে স্বল্পমেয়াদী রাখতেই ভালোবাসে।যেমনটা মেহেরাজ ভাই।নিজের পরিপাটি রূপে ফিরতে দেরি হলো না তার।কিন্তু যতোটা পরিপাটি তার বাহিরের রূপ দেখাচ্ছে ততোটাই পরিপাটি আছে কি উনার অন্তরের রূপও?আমি নিশ্চিত উনার ভেতরটা অতোটা পরিপাটি নেই।দুঃখ যাপন না করলেও দুঃখ আগলে রাখার বিষয়টা বোধহয় উনার সাথে আমার মিল আছে বলেই এই বিষয়টা আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারলাম।অন্যদিকে সামান্তা আপুর পাগলামো ক্রমশ বাড়ল।ক্রমশ বেসামাল হয়ে উঠল একুইশ বছর বয়সী মেয়েটা।আবেগ, অনুভূতিকে সামলাতে না পেরে প্রায়সই ছুটে আসেন মেহেরাজ ভাইয়ের কাছে।নিজের ভেতরের দুঃখ গুলো উগড়ে দিয়ে ঝাপটে ধরেন নিজের শখের পুরুষকে।কখনো বা হাউমাউ করে কান্না করে উঠেন।এতসব কিছুর পরও মেহেরাজ ভাইয়ের প্রতিক্রিয়া শূণ্য!এতটা কঠিন হয়ে থাকা যায় নিজেরই শখের নারীর দুঃখে?হয়তো থাকা যায়।যদি সেখানে মেহেরাজ ভাই থাকে তবে বোধ হয় অবশ্যই থাকা যায়।কারণ মেহেরাজ ভাইকে কখনো নিজের দায়িত্বের উর্ধ্বে গিয়ে আবেগ-অনু়ভূতিতে গা ভাসাতে দেখিনি।দুইজন যেন সম্পূর্ণ দুরকম।এই দুইজন মানুষের সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম বিষয়গুলোও আমি খেয়াল করেছি এই কয়দিনে।সঙ্গে খেয়াল করেছি নিজের পরিবর্তনও।কেমন জানি একাকীত্বে ক্রমশ ডুবে মরছি আমি।বাড়িতে আর যায় হোক দাদীর সঙ্গ পেতাম, দাদীর সাথে মন খুলে কথা বলা হতো।কিন্তু এখানে কিছুই নেই।কেউই নেই। নিজের আপন মানুষের খুব অভাব বোধ করতে লাগলাম ক্রমশ।মেহু আপু,মেহেরাজ ভাই এদের সাথে কথা হয় মাঝে মাঝে তাও টুকটাক কথাবার্তা।সকালের দিকে দুইজনই বেরিয়ে যায়।তারপর আমি পুরোপুরি একা এই বাসায়।মাঝে শিমা আপার সাথে যদিও কথা হয় তাও অল্পক্ষনের জন্য। সন্ধ্যায় মেহু আপু ফিরলেও দুয়েকটা কথা বলেই ঘুম দেয়।আমি অবশ্য আগ বাড়িয়ে কথা বলার সময় চাই না ।আর মেহেরাজ ভাইয়ের সাথে কথা তখনই হয় যখন উনিই আগ বাড়িয়ে কথা বলেন।কেন জানি না উনার সাথে নিজ থেকে কথা বলা হয়ে উঠে না।তবে এই কয়দিনে সাঈদ ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছে।ভেবে দেখলাম শিমা আপা আর সাঈদ ভাইয়ের সাথেই যা কথা হওয়ার হয় আমার।বাকিটা সময় আমি একা।সম্পূর্ণ একা। আনমনে ভাবলাম গত ছয়দিনের ঘটনা।মেহেরাজ ভাইয়ের স্বাভাবিক রূপ, সামান্তা আপুর পাগলামো সবটা।তারপর অন্যমনস্ক ভাবেই ঘড়ির দিকে তাকালাম।রাত প্রায় সাড়ে বারোটা।অথচ সেই সন্ধ্যায় বই নিয়ে বসেও আমার এখনো কিছুই পড়া হয়নি।অতিরিক্ত ভাবনা আমায় ঘিরে ধরেছে আজকাল।কি ভাবছি, কি চিন্তা করছি তা বোধহয় আমার নিজেরই নিয়ন্ত্রনে নেই।খেয়াল করেছি আজকাল ঘুমোতে গেলেও ঘুম হয়না।সর্বক্ষন আমি কিছু ভাবছিই কেবল।শুধুই ভাবছি।কিন্তু কিসের এত ভাবনা?এসব ভাবনার আড়ালে কি আমি আমার জীবনের উদ্দেশ্যটা হারিয়ে ফেলছি?বিষয়টা ভেবেই আমি আৎকে উঠলাম।আমার জীবনের উদ্দেশ্য তো কখনোই মেহেরাজ ভাই ছিল না।তবে কেন তার বিষয়ে এত ভাবছি?তাকে নিয়ে কি ঘটছে তা নিয়েও বা কেন ভাবছি?আমি চোখ বন্ধ করলাম।জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে চোখ মেলে তাকাতেই বাটন ফোনটা বেঁজে উঠল আওয়াজ তুলে।ক্ষীণ চোখে চেয়ে মিনার ভাইয়ের নাম্বারটা দেখলাম।বিকালে কল দিয়েছিলাম আমি।কিন্তু মিনার ভাই নাকি তার কোন এক বন্ধুর বিয়েতে গিয়েছেন তাই আর দাদীর সাথে কথা বলা হয়ে উঠিনি।বলেছিলাম বাড়ি গিয়ে কল করতে।এখন হয়তো বাড়ি ফিরেই কল দিয়েছেন।আমি কল তুললাম।কানে নিয়ে বললাম,
” আসসালামুআলাইকুম মিনার ভাই।কেমন আছো?”
মিনার ভাই ওপাশ থেকে ব্যস্ততা দেখিয়ে বলে উঠলেন,
” তখন বিয়েবাড়িতে ছিলামরে জ্যোতি।মাত্রই ফিরলাম বাড়িতে।দাদীর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।তুই তখন বললি বাড়ি এসে কল করতে। কিন্তু দাদী তো ঘুমাচ্ছে।ডাকব?”
আমি ছোট্টশ্বাস ফেললাম।খেয়াল করেছি মিনার ভাই পাল্টে যাচ্ছেন ক্রমশ।তাকে কেমন আছে জিজ্ঞেস করলে কিছু না কিছু বলে সে প্রশ্নকে সুকৌশলে এড়িয়ে যায়।উত্তর দেয় না।কিন্তু কেন?কেমন আছে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কি খুব কঠিন নাকি?কে জানে।মৃদু গলায় বললাম,
” লাগবে না মিনার ভাই। পারলে কাল সকালে দাদী উঠলে একবার কল দিও।তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি শুধু শুধু।”
মিনার ভাই পাল্টা উত্তরে বলল,
” কি বললি?”
” কিছু নয় মিনার ভাই।এতরাতে বাড়ি ফিরলে। ক্লান্ত নিশ্চয়। ঘুমাও গিয়ে। ”
মিনার ভাই চুপ থাকলেন কয়েক সেকেন্ড।তারপর ভরাট গলায় বলে উঠলেন,
” আজকাল চোখে ঘুম নামে না রে।”
কথাটার মধ্যে কি ছিল কিজানি। আমার মন খারাপ হলো।চারদিকে সবার কেবল মন খারাপ।সবার জীবনে কেবল বিষাদের অস্তিত্ব।মিনার ভাইকেও কি বিষাদ ছুঁয়ে গিয়েছে?হয়তো।নাহলে তো এভাবে বলত না সে।কেন জানি না আমি তার বিষাদ জানার জন্য আগ্রহ দেখালাম না।তার বিষাদ লাঘবের জন্য সহানুভূতিও দেখানো হলো না।তার আগেই কল রেখে দিলেন মিনার ভাই।আমি চেয়ারে বসে চোখ বুঝলাম আবারও। এত এত বিষাদের মাঝে কেমন জানি দমবন্ধ অনুভব হলো।ঠিক তখনই মেহেরাজ ভাইয়ের গম্ভীর স্বর আমার কানে পৌঁছাল,
” না পড়ে এত রাতে কার সাথে কথা বলছিলি জ্যোতি?”
হঠাৎ মেহেরাজ ভাইয়ের গলা শুনেই বিস্মিত হয়ে চোখ মেলে চাইলাম।দেখলাম দরজার দ্বারে পানির বোতল হাতে নিয়ে মেহেরাজ ভাই দাঁড়িয়ে আছেন।রাত প্রায় সাড়ে বারোটা।ঘরের আলো জ্বালিয়ে পড়ছিলাম বলে আর দরজা ও লাগানো হয়নি।মেহেরাজ ভাই কি দরজায় দাঁড়িয়ে আমার আর মিনার ভাইয়ের কলে কথা বলাটা লক্ষ্য করেছেন?করলেও বা কি?নিজেকে স্থির করে স্পষ্ট গলায় উত্তর দিলাম,
” মিনার ভাইয়ের সাথে।”
মেহেরাজ ভাই মাথা নাড়ালেন।পরমুহুর্তেই বললেন,
” পড়ালেখা ঠিকঠাক মতো হচ্ছে তোর?পরিবেশ কিংবা পরিস্থিতি তোর পড়ালেখায় প্রভাব ফেলছে না তো জ্যোতি?যদি তেমনটা হয় আমায় জানাবি।”
আমি আগের মতোই স্বাভাবিক থাকলাম।কয়েক মুহুর্ত চুপ থেকে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজালাম।উত্তরে বলে উঠলাম,
” পরিবেশ পরিস্থিতি তো কতকিছুতেই প্রভাব ফেলল মেহেরাজ ভাই।শুধু কি পড়ালেখাতেই?আমার জীবনেও মস্ত বড় প্রভাব পড়ে নি?”
মেহেরাজ প্রগাঢ় দৃষ্টিতে চাইলেন আমার দিকে।গম্ভীর কন্ঠে উত্তর দিলেন,
” সেই প্রভাবের জন্য জীবন থামিয়ে রাখাটা বোকামো।পরিবেশ কিংবা পরিস্থিতির প্রভাবে প্রভাবিত না হয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখাটাই বুদ্ধির কাজ।আই হোপ তুই থেমে থাকবি না।রাইট?”
আমি হাসলাম।তাচ্ছিল্যের হাসি।আমি কোনকালেই বা থামতে পেরেছি?কোনকালেই বা দুঃখ দেখিয়েছি?জীবন আমায় একরাশ অস্বাভাবিকতার মাঝে মিশিয়ে দেওয়া স্বত্ত্বেও আমাকে প্রতিনিয়ত স্বাভাবিক থাকতে হয়েছে।ছোটবেলায় মা যখন ছেড়ে গেল তখনও।নয় বছর বয়সে যখন মিথিকে হারালাম তখনও।ষোড়শী বয়সে যখন এক যুবকের সামনে অজান্তেই নিজের অনুভূতি জানান পেয়ে অপমানিত হতে হলো তখনও।অবশেষে আজও!এত বেশি স্বাভাবিক থাকতে থাকতে আজ যেন হাঁপিয়ে উঠেছি আমি।অস্ফুট স্বরে কঠিন গলায় বললাম,
” পরিস্থিতিটা আপনার জন্য মেহেরাজ ভাই।নাহলে আজ আমি অন্তত এইটুকু হলেও ভালো থাকতাম দাদীর সাথে।শহুরে যান্ত্রিকতায় পিষে যেতাম না আমি।”
মেহেরাজ ভাই ভ্রুঁ কুঁচকে নিলেন।প্রশ্ন করলেন,
” তোকে তো জোর করে আনা হয়নি জ্যোতি।জিজ্ঞেস করেছিলাম তো?”
আমি আগের মতোই কঠিন গলায় উত্তর দিলাম,
” ওটা জোর না হোক, সম্মতিও বলা যায় না।”
মেহেরাজ ভাই যেন আমার কথাকে বিশেষ গুরুত্ব দিলেন না।শান্তস্বরে বললেন,
” এক্ষেত্রে তোর আমার কারোরই সম্মতি নেই,ছিল না।”
” বাধ্য হয়ে আমাকে আপনাদের বাসায় আনার তো প্রয়োজন ছিল না মেহেরাজ ভাই।সত্যি বলছি, এখানে আসার পর আমার দমবন্ধ অনুভব হচ্ছে।কেন অনুভব হচ্ছে তা আমার জানা নেই।সেদিন আপনি বিয়েটা না করলেই সব ঠিক থাকত।সবটা!”
মেহেরাজ ভাই মুহুর্তেই প্রশ্ন ছুড়লেন,
” তোর কি মনে হচ্ছে বিয়েটা আমি নিজ ইচ্ছায় করেছি?কিংবা তোকে দমবন্ধ করে মেরে ফেলার জন্য প্ল্যান করে বিয়ে করেছি?”
আমার ভেতরের স্বত্ত্বা রাগে রাগান্বিত হলো।নিজের চোখের সামনে অপ্রিয় মানুষটার সাথে কথা বাড়ানোর আর বিন্দুমাত্রও ইচ্ছে জাগল না।শুধু জানব, উনিই দায়ী।কেবল উনিই।উনি চাইলেই আমাকে বুঝতে পারতেন, আমার পরিস্থিতিটা বুঝতে পারতেন।উনি বুঝলেন না।উল্টো আমাকেই চাপা কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ছেন।আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিলাম,
” জানি না।শুধু জানি আজ আমার জীবনের এই হাল আপনার জন্যই মেহেরাজ ভাই।আমি মুক্ত থাকতে চাইছি, শুধুই মুক্তি চাইছি এসবের থেকে।”
মেহেরাজ ভাইয়ের দৃষ্টি এবার লালাভ হলো যেন।শীতল চাহনীতে আমার মুখে তাকিয়েই শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে বলে উঠলেন,
” মুক্ত হতে হলে সেভাবে নিজেকে গড়ে নে। তখন না তো সমাজ তোকে আটকাবে, আর না তো তোর কিংবা আমার পরিবার।এমনকি আমিও না। আর হ্যাঁ,এই পরিস্থিতির জন্য আমাকে দায়ী করা বন্ধ কর জ্যোতি।”
কথাগুলো বলেই মেহেরাজ ভাই আর দাঁড়ালেন না।আমি কথাগুলো শ্রবন করেই জ্বলজ্বল চাহনীতে তাকিয়ে থাকলাম।মুহুর্তেই অনুভব করলাম আমার ভেতরের স্বত্ত্বা জাগ্রত হয়ে তেজ ছড়াল।মেহেরাজ ভাই কি আমাকে অবজ্ঞা করেই বাক্যগুলো বলে গেলেন? ঠিক যেভাবে ষোড়শী বয়সে অবজ্ঞা করেছিলেন?মাথার মধ্যে ধপধপ করল।দুইজন পুরুষের প্রতি ক্ষনিকেই জেদ চাপল।প্রথম জন হলো আমার আব্বা, দ্বিতীয়জন হলো মেহেরাজ ভাই।
.
রাত হলো।প্রায় নয়টার ঘর ছুঁয়ে গেল।অথচ সাঈদ ভাই আজ পড়াতে আসলেন না।অন্যদিন আটটায় এসেই হাজির হন।আজ আসলেন না।টেবিল চেয়ারে বসে বসে বইয়ে মনোযোগ দিয়েছিলাম।তখনই মেহু আপু ঘুমুঘুমু চোখে সামনে এসে দাঁড়ালেন।বুঝলাম, উনি মাত্রই ঘুম ছেড়ে উঠেছেন।মেহেরাজ ভাইকেও কিছুক্ষন আগে বাসায় ডুকতে দেখেছিলাম।বোধ হয় নিজের ঘরেই আছেন।আমি মেহু আপুর দিকে তাকালাম।কিছু বলার আগেই আপু বলে উঠল,
” আজ বোধহয় সাঈদ ভাইয়া আসবে না।চল ছাদে যাই।লুডু খেলব। নাবিলা, তুই, সামান্তা আর আমি।সামান্তার মনও ভালো থাকবে বল?”
আমি সংকোচ বোধ করলাম।আমি গেলে সামান্তা আপুর প্রতিক্রিয়া কেমন হবে?এই কয়দিনে ঠিক বুঝেছি সামান্তা আপু মুখে না বললেও আমাকে তিনি খুব একটা পছন্দ করেন না।কিংবা আমাকে দেখলেই তার মুখ বিষাদে কালচে রূপ ধারণ করেন।এইটুকু বুঝেই মেহু আপুর প্রস্তাব নাকোচ করে বললাম,
” না আপু, পড়া আছে।পরে একদিন না হয় খেলব?”
আপু আমার কথা শুনলেন না।টেনেটুনে নিয় শেষ পর্যন্ত রাজি করিয়ে নিয়েই গেলেন।আপুর এই দিকটা ভালো।পাঁচ মিনিট সময়ও যদি মিশেন ঐ পাঁচ মিনিটই মনে হবে উনি আমাকে অনেক বেশি আপন ভাবেন।আমি ধীরে ধীরে মেহু আপুর পিছু পিছু ছাদে গেলাম।মুহুর্তেই ছাদে লুডুর আসর জমল।নাবিলা, আমি,সামান্তা আপু আর মেহু আপু। সামান্তা আপুর মানসিক অবস্থা সামাল দিতেই এই প্রচেষ্টা।আজকাল আর সামান্তা আপুকে একা কোথাও ছাড়াও হয় না।এমনকি রাতেও উনার সাথে নাবিলা গিয়ে ঘুমায়।ধীরে ধীরে এই বিষয়টা দৃষ্টিকটু ঠেকল সবার চোখে।মেহেরাজ ভাইয়ের চাচা, চাচীসহ মোটামুটি সকলেরই জানা হয়ে গেল তাদের কঠিন প্রেমের কথা।এতকিছুর পরও মেহেরাজ ভাই স্বাভাবিক।যেন কিছুই ঘটেনি তার জীবনে।কিছুই হারায় নি সে।বিপরীতে সামান্তা আপু ততোটাই অস্বাভাবিক।লুডু খেলার একপর্যায়েই সামান্তা আপুর একটা গুঁটি কাঁটা পড়ল।তাও আমার গুঁটির চালেই।সামান্তা আপু সঙ্গে সঙ্গেই কেঁদে দিলেন ছোট বাচ্চাদের মতো।চোখ বড়বড় করে আমার দিকে তাকিয়েই ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা চালালেন।আমি অবাক হলাম।সামান্য একটা গুঁটি কাঁটার জন্যই কি উনি বাচ্চাদের মতো করে কাঁদছেন এভাবে?প্রথম বুঝতে না পারলেও পরমুহুর্তেই সামান্তা আপুর কথায় স্পষ্ট বুঝে উঠলাম।সামান্তা আপু অস্ফুট স্বরে বললেন,
” এই লুডু খেলাটাও বুঝিয়ে দিচ্ছে আমি তোমার কাছে পরাজিত।আমি হেরে যাচ্ছি জ্যোতি।কেন জানি না, আমি তোমায় সহ্য করতে পারছি না।প্লিজ, আমায় শান্তি দাও জ্যোতি।আমার শান্তি এভাবে দিনের পর দিন কেড়ে নিচ্ছো কেন জ্যোতি?”
আমি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম।এমনিতেও ছাদে এসে লুডু খেলার খুব একটা ইচ্ছে আমার ছিল না।মেহু আপুই জোর করে টেনে এনেছিলেন।কিন্তু আমার উপস্থিতিতে যে অন্য কারোর এতটা কষ্ট হবে জানতে পারলে কখনোই আসতাম না আমি।কিংবা, আমি কারো শান্তি কেড়ে নিচ্ছি এটা জানলেও আসতাম না।ছোট্টশ্বাস ফেলে দ্রুত উঠে দাঁড়ালাম।হালকা হেসে বলে উঠলাম,
” আমি দুঃখিত আপু।ভীষণ ভাবে দুঃখিত।আপনি প্লিজ কাঁদবেন না।আপনার শান্তি আপনারই হোক আপু।আমি কোন হস্তক্ষেপ করব না।আমায় অপরাধী ভাববেন না আপু।”
কথা গুলো বলেই দ্রুত পায়ে ছাদ থেকে নেমে বাসায় আসলাম।একটা মেয়ের কষ্টের জন্য সে সম্পূর্ণ ভাবে আমাকে দোষীভাবে বিষয়টা ভাবতেই মন খারাপ হলো আবারও।আমি কি সত্যিই উনার শান্তি কেড়ে নিচ্ছি?আমার চোখ টলমল করল।ধীর পায়ে রুমে ডুকতেই চোখে পড়ল চেয়ারে বসে থাকা সাঈদ ভাইয়ের দিকে।আমি অবাক হলাম। ভেবেই নিয়েছিলাম উনি আসবেন না।এখন পড়াতে আসবেন তা আশাও করিনি।মুহুর্তেই টলমল করে উঠা চোখ জোড়াকে স্বাভাবিক করার জন্য অন্যদিকে তাকালাম। সাঈদ ভাই বোধ হয় হাসলেন।বলে উঠলেন,
” বোকা মেয়ে, কান্না পেলে কেঁদে নিতে হয়।জানো না?আপন মানুষদের সামনে কান্না লুকোতে হয় না।”
আমার কান্নারা এবার আরো অগ্রসর হলো। আমি প্রাণপন কান্না আটকানোর চেষ্টা চালিয়ে চোখ লাল করে চাইলাম। বললাম,
” এই শহরে আমার কোন আপন মানুষ নেই সাঈদ ভাই।যারা ছিল তাদের রেখে এসেছি বাড়িতে। আর এখানে যারা আছে তারা সবাই আমার পরমানুষ।”
সাঈদ ভাই অমায়িকভাবে হাসলেন।উত্তরে বললেন,
” এই কয়টা দিনে তোমার সাথে এত ভালোভাবে মিশলাম।টিচারের মতো এইটুকুও বিহেভ না করে একদম ভাইবোনের মতো খুনসুটিময় সম্পর্ক গড়ে তুললাম। আর তুমি বলছো আপন নয়?”
সাঈদ ভাইয়ের কথা শুনে বলতে ইচ্ছে করল, ” যাদের আপন মানুষের সংখ্যা কম থাকে, কিংবা আপন মানুষদের হারিয়ে ফেলার অভ্যাস থাকে তারা পুনরায় কাউকে আপন ভাবতে ভয় পায় সাঈদ ভাই।তারা খুব সহজেই আর কাউকে আপন ভাবতে পারে না।” কিন্তু বলতে পারলাম না।চোখমুখ স্বাভাবিক করে ঘনঘন শ্বাস ফেললাম কেবল।উনি আবারও বলে উঠলেন,
” আমি তোমায় আপন ভাবলাম জ্যোতি।ভাবলাম তুমি আমার বোন, এবার তোমার দিক থেকে কি আমাকে আপন ভাবতে সংকোচ আছে?আপন ভাবা যায় কি এই মেয়েবাজ ছেলেটাকে?”
সাঈদ ভাইয়ের কন্ঠ শুনে যেন আমি খুশি হলাম।কিন্তু সে খুশিটা দেখানো গেল না।মনে মনে বোধ হয় এই যান্ত্রিক শহরে আমিও কোন আপন মানুষ খুঁজছিলাম।কিন্তু আপন মানুষ পাওয়ার সেই খুশিটুকু প্রকাশ না করেই বললাম,
” যায়।”
” বেশ!তবে আমার বোনটার মন খারাপ হলো কেন?কেউ কিছু বলেছে?”
এড়িয়ে গিয়ে বললাম,
” না, এমনিতেই।পড়াবেন না আজ? ”
পড়ানোর অযুহাত দিয়ে কাঁটিয়ে গেলাম সেই মন খারাপের প্রশ্নকে।কাঁটিয়ে গেলাম আস্ত এক বিষন্নতাকে।সাঈদ ভাইও অবশ্য দ্বিতীয়বার আর প্রশ্ন করলেন না।তবে পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে ধীরে ধীরে আমার মন ভালো করে দিলেন ঠিকই।আমি হাসলাম।সত্যিই সাঈদ ভাই প্রাণবন্ত!এমন একটা ভাই পাওয়া গেলে খারাপ হয় না।
#চলবে….