এক মুঠো প্রণয় পর্ব-০৭

0
767

#এক_মুঠো_প্রণয়
#পর্ব_০৭
লেখনীতেঃ একান্তিকা নাথ

তখন সন্ধ্যা।কিয়ৎক্ষন আগেই সামান্তা আপুরা আর নাবিলারা সবাই বাসায় ফিরেছেন।বেলকনিতে বসে সেসবই বলাবলি করছিল মেহু আপু।হঠাৎই বারকয়েক কলিং বেলের আওয়াজ পেয়েই আমি আর মেহু আপু ছুটে গেলাম।আমরা পৌঁছানোর আগেই সেখানে উপস্থিত হলেন মেহেরাজ ভাই।এতক্ষন ঘরেই ছিলেন উনি। বোধ হয় এতবার কলিং বেলের আওয়াজ হওয়াতেই এগিয়ে এসে দরজা খুললেন ।মুহুর্তেই চোখে পড়ল এক বিধ্বস্ত রমণীকে।রমণীটি আর কেউই নয়, সামান্তা আপুই।উনার লম্বা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে রইল মুখে।ফর্সা মুখ মলিন দেখাল।ফোলা চোখজোড়াও নিভু নিভু।আমি একনজর তাকিয়েই কষ্ট অনুভব করলাম।হৃদয়ে অপরাধবোধের অস্তিত্ব উপস্থিত হয়ে জানান দিল, আমিই অপরাধী।দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির এই অবস্থার জন্য আমিই দায়ী।আমার জন্যই আজ তারা এক থেকে দুই হলো।আমার জন্যই দুটো মানুষের মিল হওয়ার কথা থাকলেও তাদের মিল হলো না। অনুশোচনায় দগ্ধ হলাম আমি।তবে তা প্রকাশ করতে পারলাম না।আমি বরাবরই দাদীর মতোই।বাস্তবে কোন অনুভূতি প্রকাশ করতে পারি না।না ভালো লাগা, না ভালো বাসা আর না তো অনুশোচনা।কিন্তু ডায়েরীর পাতা হলে তা আলাদা।সেখানে নিজের সমস্তটা উজাড় করে দিতে পারি।বোধ হয় এই কারণেই ডায়েরীতে মেহেরাজ ভাই সম্পর্কিত অনুভূতি জেনে রেগে গিয়েছিলেন মেহেরাজ ভাই।ছোট্ট শ্বাস ফেললাম।ভাবনা ছেড়ে বের হয়ে চোখজোড়ার দৃষ্টি স্থির রেখে কেবল তাকিয়েই থাকলাম।সামান্তা আপু ঘরে ডুকলেন না।মেহেরাজ ভাইয়ের দিকে হতবিহ্বল চাহনীতে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকেই ঝট করে নজর সরালেন।অন্যদিকে তাকিয়েই নিঁখুতভাবে উপেক্ষা করলেন মেহেরাজ ভাইকে। মেহু আপুর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,

“মেহু আপু, আম্মু সবার জন্যই রান্না বসিয়েছে।আজ রাতের জন্য আর রান্না করতে বলোনা শিমা আপাকে।আম্মু সবাইকেই খেতে বলেছে বাসায়।”

সামান্তা আপু উনার বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে।ছোটবেলা থেকেই শহরে বড় হয়েছেন।আদব কায়দা, কথাবার্তা, শিক্ষায় সবকিছুতেই আমার থেকে এগিয়ে। এমনকি রূপ কিংবা সৌন্দর্যের দিক দিয়েও। সেই হিসেবে আমি বড্ড অযোগ্যই মেহেরাজ ভাইয়ের জন্য।অনেকটা বাঁধরের গলায় মুক্তোর মালা প্রবাদটার মতোই বোধ হলো এই অবস্থাটা।আমার নিজের উপর অভিমান হলো।এভাবে যোগ্যতা ছাড়া অন্য একজনের গলায় বোঝাস্বরূপ ঝুলে পড়া বোধহয় একদমই উচিত হয়নি।অন্তত যোগ্য মানুষটাকে যোগ্য কেউই পেত।সুখে থাকত।দিনশেষে কি আমায় অযোগ্য বিশেষণটা বয়ে বেড়াতে হতো তাহলে?লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেহেরাজ ভাইয়ের দিকে তাকালাম।টানটান গম্ভীর মুখে একরাশ বিষাদের ছোঁয়াই কেবল।যেন হতাশায় তার ভেতরটা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। তারই স্পষ্ট ছাপ চোখেমুখে।এটা অবশ্য অস্বাভাবিক নয়।এত বছরের প্রেম, এত বছরের মনের মানুষ ছেড়ে আসা কি এতই সহজ?কষ্ট হবে না?হবে।আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম মেহেরাজ ভাইয়ের মুখচাহনী।চোখজোড়ায় হয়তো প্রেয়সীর জন্য অভিমানও খেলা করল। বোধহয় সে জন্যই চোখজোড়া রক্তিম দেখাল। মেহেরাজ ভাই মুহুর্তেই নিরবে প্রস্থান করলেন সেই স্থান থেকে।হয়তো সামান্তা আপুর মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহসটা টিকিয়ে রাখতে পারলেন না।দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে তাকালাম। মেহু আপু এগিয়ে উত্তর দিলেন,

” আজই তো ফিরল সবাই।এতদূর থেকে এসে এখন আবার সবার জন্য রান্নার প্রয়োজন কি? চাচীর উপর দিয়ে দখল যাবে না?”

সামান্তা আপু হাসলেন হালকা। বললেন,

” আম্মু পারবে সামলাতে।তোমরা বাসায় এসো রাতে।আচ্ছা, আমি বরং রাতে আবার ডেকে যাব।নাবিলাদের বলে আসি গিয়ে।”

কথাগুলো বলেই সামান্তা আপু দুই পা বাড়িয়ে চলে যেতে নিলেন।পরমুহুর্তেই আবার কি বুঝে ফিরে এলেন।গাঢ় চাহনীতে আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কি যেন পরখ করলেন।আমি অস্বস্তিতে পড়লাম।শুকনো ঢোক গিলে বললাম,

” কিছু বলবেন আপু?”

সামান্তা আপু মাথা নাড়ালেন।ঠোঁট চওড়া করে উত্তর দিলেন,

” তোমাকে বলা হলো না তাই।তুমিও এসো জ্যোতি।আম্মু তোমার কথা বিশেষ করে বলেছে।”

আমি মাথা নাড়ালাম।হালকা গলায় জবাব দিলাম,

” হ্যাঁ, যাব।”

সামান্তা আপু আর দাঁড়ালেন না।দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে গেলেন। আমি নির্বিকার ভাবে চেয়ে থাকলাম সেদিক পানে।একটা মানুষের কতটা পরিবর্তন?সবার মুখে শুনে এসেছি এই সামান্তা আপু নাকি খুবই চঞ্চল।খুবই হাসিখুশি।আজ আমি তার মুখে একফোঁটাও হাসির রেশ দেখলাম না।একটুও চঞ্চলতা দেখলাম।সব কি আমিই কেড়ে নিলাম?

.

রাত আটটার দিকে হঠাৎই বাসায় এক অপরিচিত যুবকের আগমন ঘটল। তখন বাসায় আমি আর মেহু আপুই ছিলাম।আমি এই যুবককে চিনি না, জানি না।তবে মেহু আপুর ভাবমূর্তি বদলাল।দরজা খুলে এই যুবককে দেখেই জটফট নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকালেন আপু।হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলাম আমি৷ কি আশ্চর্য!এই ছেলেটা কে?আপুই বা হঠাৎ এমন করল কেন?আমি কি বলব বুঝে উঠলাম না।অপরিচিত ছেলেটিই মাথার চুলে হাত নাড়িয়েই প্রশ্ন ছুড়ল,

” তুমিই জ্যোতি?”

আমি অবাক হলাম।এই লোক আমায় চিনে কি করে?চেনার তো কথা নয়।চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে থাকতেই লোকটি আবারও বলল,

” বাসায় ডুকব? নাকি এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকব?”

আমি বুঝলাম না কি বলা উচিত।অপরিচিত ছেলে মানুষ।আর বাসায় আমরা দুটো মেয়ে মানুষ।উনাকে কি বাসায় আসতে বলা উচিত?আমি বোকাবোকা চাহনীতে তাকিয়ে থাকলাম। উনি হাসলেন। আবারও বললেন,

” আমি সাঈদ।মেহেরাজের কাছের বন্ধু। আজ থেকে তোমার টিউটরও।তুমি আমায় সাঈদ ভাইয়া বলেই ডাকতে পারো। আরো পরিচয় লাগবে কি?অবশ্য ভবিষ্যৎ এ আরো একটা পরিচয় দিতে পারব।তবে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।”

আমি তখনও নির্বিকার চেয়ে থাকলাম।কি বলা উচিত মাথায় এল না।কিয়ৎক্ষন চুপ থেকেই বললাম,

” আসুন।”

কথাটা বলেই এদিকওদিক চাইলাম।মেহু আপু এখনও ঘরের ভেতরে।সাঈদ ভাই নামক লোকটাকে বসার ঘরে বসতে বলেই ধীর পায়ে মেহু আপুর ঘরের সামনে গেলাম।দরজায় টোকা দিয়ে বললাম,

” আপু?মেহু আপু?তুমি ঠিক আছো?”

মেহু আপু কিয়ৎক্ষন সময় নিলেন।তারপর একদম ঠিকঠাকভাবে ঘর ছেড়ে বের হলেন।তবুও চোখমুখ অস্থির দেখাল।আমি বুঝলাম, আপু কেঁদেছেন।কিন্তু কেন?লোকটাকে দেখে কাঁদার কি আছে?বুঝলাম না।আপু ঠোঁট চওড়া করে বলে উঠলেন,

” উনি সাঈদ ভাইয়া। ভাইয়ার বন্ধু।সপ্তাহে তিনদিন রাত আটটায় পড়াবে তোকে।মাত্রই কল করে ভাইয়া জানাল বিষয়টা।তোর পড়ার টেবিল গোছানো হয়েছে?নাকি বইগুলো এখনো বড়োসড়ো ব্যাগটার ভেতরেই?”

আমি ছোট্ট শ্বাস ফেললাম।দাদী, মেহেরাজ ভাই সকলেই পড়ালেখায় গ্যাপ না দিতে বললেও আমি আজ সারাদিন বই ছুঁয়েও দেখিনি।এমনকি বইগুলো ব্যাগ থেকে বেরও করা হয়নি।দুপুর পর্যন্ত ঐ ঘরটা ঝাড়গোছ করতে করতেই কেঁটেছে।তারপরের সময়টা মেহু আপুর সাথেই কাঁটিয়েছি।এতকিছুর মাঝেই এত বই টই এর কথা মাথাতেই এল না। ছোট ছোট চোখে তাকিয়েই বললাম,

” শুধু রুমটাই গোছানো হয়েছে আপু।বইপত্র কিছুই এখনো ব্যাগ থেকে বের করাও হয়নি।”

” ঠিকাছে, তাড়াতাড়ি বই বের করে আমি আর তুই মিলে পড়ার টেবিল গুঁছিয়ে ফেলি চল।উনি বরং পাঁচ দশমিনিট বসার ঘরেই বসুক।”

কথাটা বলেই হাত চেপে নিয়ে গেলেন সে ঘরে। পড়ার টেবিলে দ্রুত বইপত্র গুঁছিয়েই দুইপাশে চেয়ার ঠিক করে রেখে গেলেন আপু।আমার দিকে তাকিয়েই বলে উঠলেন,

” উনি টিচার হিসেবে ভালো।অন্য টিচারের মতো ভয় পেতে হবে না। ভালো করে পড়বি জ্যোতি।আমি চাই তুই অনেক বড় হও।অনেক ভালো রেজাল্ট আসুক তোর।”

আমি ক্ষীন দৃষ্টিতে চাইলাম।বুকের ভেতর পরীক্ষা নামক ভয় বাসা বাঁধল।আসলেই কি অতো ভালো রেজাল্ট আসবে?দাদী, মিনার ভাই, মেহেরাজ ভাই, মেহু আপু এত এত জনের আশা পূরণ করতে পারব?নাকি দিনশেষে এটাই প্রমাণ হবে যে, আমি কিছুই না।আমার পড়ালেখার গন্ডিও কিছুই না।আব্বার সামনে কি অবশেষে মুখ থুবড়ে পড়তে হবে আমায়?ভাবতে ভাবতেই সাঈদ ভাই নামক লোকটা সামনে এসে বসলেন।হালকা হেসে বলে উঠল,

” পড়াব নাকি দাঁড়িয়েই থাকবে?”

আমি বসলাম।সামনে থেকে বই বের করে আড়চোখে চাইলাম উনার দিকে।মস্তিষ্কে ঘুরল অন্য প্রশ্ন, সাঈদ ভাই আর মেহু আপুর মধ্যে কি সম্পর্ক আছে?সম্পর্ক যদি থাকেও তবে উনাকে দেখে আপু এমন ছুটে ঘরে গিয়ে দরজা লাগাল কেন?আর সাঈদ ভাইও কেন আপুকে ছুটে ঘরে গিয়ে দরজা আটকাতে দেখে কোন প্রতিক্রিয়াই দেখালেন না?

.

রাতের খাবারটা খাওয়া হলো সামান্তা আপুদের বাসায়ই৷ সামান্তা আপুর আম্মু বরাবরই ভালো মনের মানুষ।প্রায়সই বাড়িতে গেলে আমায় বেশ স্নেহও করতেন।আজও ব্যাতিক্রম হলো না।মাথায় হাত বুলিয়ে খাবার বেড়ে দিলেন। যতক্ষন না খাওয়া শেষ হলো ততক্ষনই পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেন।আমি আসার সময় হালকা হাসলাম।দরজা দিয়ে বের হয়ে চলে আসব ঠিক তখনই নাবিলা আর নুসাইবাকে চোখে পড়ল।নাবিলারা তিনবোন। নাফিসা আপুর বিয়ে হয়েছে গতবছরই।বাকি দুইজন নাবিলা আর নুসাইবা।নুসাইবা বয়সের দিক দিয়ে মিথিরই সমান।এতদিনে মিথি বেঁচে থাকলে নির্ঘাত ওর মতোই বেড়ে উঠত।হাতে পায় ওর মতোই শরীর হতো।এমন গোলগোল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে নিশ্চয় হাসত।আমি এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলাম নুসাইবার দিকে। হঠাৎ ই নাবিলার কন্ঠ আসল কানে,

” জ্যোতি? সে সন্ধ্যা থেকে সুযোগ খুঁজে যাচ্ছি তোর সাথে কথা বলার।কথা আর বলাই হলো না।এখনও সবার শেষেই খেতে আসলাম আমি।সব এই নুসুর জন্য।এতক্ষন ধরে ঘুমাচ্ছিল।সামান্তা আপু এই পর্যন্ত তিনবার ডেকে এল।বুঝলি?”

আমি হাসলাম নাবিলার কথা শুনে।নাবিলা ছটফটে স্বভাবী। একদম মনপ্রাণ খুলে কথা বলে সবার সাথে।শুনেছি, সামান্তা আপুও সেই প্রকৃতির।প্রচুর চঞ্চল আর প্রাণবন্ত। আর সে চঞ্চল মেয়েটিকেই চোখের সামনে এমন নিরব হয়ে যেতে দেখে ক্ষণে ক্ষণে অনুশোচনায় দগ্ধ হলাম আমি।আসলেই কি সবকিছুর জন্য আমিই দায়ী?সবকিছু কি আমারই দোষ?জানি না।কিছুই জানি না।ঠোঁট নেড়ে উত্তরে বললাম,

” আমিও খাবার টেবিলে খুঁজেছি তোকে।ভাবলাম তুই বুঝি নেই বা আসবি না।”

” উহ তেমন না।আমি বরাবরই ছোট চাচীর হাতের রান্না পছন্দ করি।তার হাতের খাবারের লোভ সামলাতে পারি না।কিন্তু নুসু তখন থেকে মরার মতো ঘুমাচ্ছিল।আম্মু আবার ওকে নিয়ে না আসলে বকত।তাই।”

আমি হাসলাম।নুসাইবার মুখে আলতো হাত রেখেই বললাম,

” তুই, নুসাইবা, নাফিসা আপু তিনজনই একদম একরকম দেখতে।দেখলেই বুঝা যায় তোরা তিনজনই বোন।”

নাবিলা হাসল খিলখিলিয়ে। বলল,

” এই কথাটা গ্রামের বাড়িতে গেলেও তুই বলতি।এখনও বললি।এই পর্যন্ত তোর থেকে হাজারবার শুনে ফেলেছি কথাটা।”

আমি মলিন হাসলাম।আরো কিছুক্ষন ওর সাথে কথা বললাম।তারপর মেহু আপু ও বাসা থেকে বের হতেই দুইজনে একসাথে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম।বাসায় এসে নিজের ঘরে ডুকে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়েই পড়তে হবে।না পড়লে তো জীবন চলবে না।দাদীর স্বপ্নপূরণ হবে না।আব্বাকে জবাব দেওয়া হবে না।বিষয়গুলো মাথার মধ্যে ঘুরতেই দ্রুত শোয়া ছেড়ে উঠে বসলাম।টেবিলের সামনে গিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়তে লাগলাম।ঘড়িতে তখন সাড়ে এগারোটা।মেহেরাজ ভাই এখনও বাসায় ফেরেনি।কেন ফেরেনি?সামান্তা আপুদের বাসায় না যাওয়ার জন্য অযুহাত দেখাতেই কি ফেরেনি?

.

ঠিক রাত একটা বাঁজেই দরজা খোলার আওয়াজ আসল।আমি ঘাড় কাঁত করে তাকালাম। আমাকে যে ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছে সে ঘর থেকে মোটামুটি বসার ঘর থেকে সদর দরজা সবই দৃশ্যমান।আমি ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে দেখলাম মেহু আপু দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে।অথচ কোন কলিং বেল বাঁজে নি।কৌতুহল বশত তাকিয়ে থাকলাম আরো কিয়ৎক্ষন।দেখলাম মেহেরাজ ভাইকে ঘরে ডুকতে। কেমন ক্লান্ত আর মলিন মুখ।লম্বা- চওড়া, উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের মানুষটাকে কেমন উদাস দেখাল।সুদর্শন মুখটায় যেন সহস্র হতাশা ফুটে উঠল।যে হতাশা সমেতই তীব্র অসহায়ত্বের ছাপ ফুটে উঠল তার দৃষ্টিতে।যেন চোখের দিকে তাকিয়েই মুহুর্তে বুঝে ফেলা যায় মানুষটার ভেতরে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে সব।আমি চেয়ে থাকলাম।উনি হালকা গলায় মেহু আপুকে বললেন,

” ঘুমাসনি?ভাবলাম জেগে আছিস কিনা তাই নিচে থাকতেই কল করে জানিয়ে দিলাম।তুই যা ঘুমকাতুরে, সঙ্গে সঙ্গে কল ধরবি ভাবিনি।”

মেহু আপু বিনিময়ে প্রশ্ন ছুড়লেন,

” এতক্ষন কি করছিলে বাইরে?তুমি তো কোনদিন এত দেরি করে বাসায় আসো না।”

” কাল একটা চাকরির ইন্টারভিউ আছে না?তাই সাঈদের বাসায় গিয়েছিলাম৷ তাই দেরি হয়ে গেল।”

মেহু আপু শক্ত গলায় ফের বলল,

” মিথ্যে অযুহাত দিও না ভাইয়া।তুমি গম্ভীর হয়ে থাকলেও আমি তোমায় বরাবরই জেনে ফেলি এটা ভুলে যেও না।সামান্তার সম্মুখীন হবে না বলেই দেরি করে আসলে তাই না?কিন্তু ছোট চাচী অনেক কষ্ট পেয়েছে।উনি তো তোমাদের মধ্যকার এসবের কিছুই জানেন না।”

মেহেরাজ ভাই ঠোঁট গোল করে তপ্তশ্বাস ছাড়লেন।আমি সবটাই স্পষ্ট দেখতে পেলাম এই ঘর থেকে।রাতের নিরবতায় বসার ঘরের প্রত্যেকটা কথাও স্পষ্ট শুনতে পেলাম।তার মানে আমার ধারণাটাই ঠিক ছিল?মেহেরাজ ভাই সামান্তা আপুর সামনে পড়তে হবে বলেই পালিয়ে বেড়ালেন?আমি দৃষ্টি সরালাম দ্রুত।বইয়ের পাতায় নজর রাখতেই আবারও কানে আসল মেহেরাজ ভাইয়ের আহত কন্ঠ,

” তেমন নয় মেহু।বুকের ভেতরে যন্ত্রনা হচ্ছিল বড্ড।বন্ধুদের সাথে আড্ডা না দিলে সে যন্ত্রনা কমে আসত না।তাই। জ্যোতি কি ঘুমিয়ে গিয়েছে?”

আচমকা আমার নাম শুনেই কান খাড়া হলো।মস্তিষ্ক সচেতন হলো।মেহেরাজ ভাই আমার খোঁজ করছেন কেন?কি কারণে?ভ্রু বাঁকিয়ে আবারও বসার ঘরের দিকে তাকালাম।মেহু আপু বলল,

” না, ও পড়ছে ওর ঘরে।ঘুমাবে আরো পরে।”

মেহেরাজ ভাই মাথা নাড়ালেন।বললেন,

” ওহ,সাঈদ কেমন পড়িয়েছে?জিজ্ঞেস করেছিস?”

” না, করিনি।”

” আচ্ছা, ও পড়ুক।কাল সকালে জিজ্ঞেস করে নিব।আনোয়ার চাচাও কল করেছিল। বলেছিলাম বাসায় এসে কল দিয়ে কথা বলিয়ে দিব।এত রাতে বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছেস উনি।তার থেকে সকালেই বরং কল করব।তখন জ্যোতিও থাকবে।”

আমি অবাক হলাম।আব্বা? আব্বা কল করেছিল আমার সাথে কথা বলার জন্য?এটা ভাবনারও বাইরে।আব্বার কি সত্যিই এই আপদটাকে মনে পরে?নাকি শুধু লোক দেখানো দায়িত্ব দেখাতেই কল করলেন আব্বা?বুঝলাম না।সরু চোখে চাইতেই দেখলাম মেহেরাজ ভাই পা বাড়ালেন।মেহু আপু পেছন থেকে প্রশ্ন ছুড়ল তৎক্ষনাৎ,

” খেয়েছো তুমি?নাকি না খেয়েই আড্ডা দিলে এতক্ষন যাবৎ?”

মেহেরাজ ভাই বিনিময়ে উত্তর দিলেন না।পা জোড়া চালিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।মুহুর্তেই ধাম করে দরজার আওয়াজ আসল কানে।বুঝলাম, মেহেরাজ ভাই নিজের ঘরের দরজা লাগালেন।আমি শ্বাস ফেললাম।নিজেকে দুইদেশের সীমানায় আস্ত এক কাঁটাতার বোধ হলো।যে কাঁটাতার পেরিয়ে যেতে গিয়ে রক্তাক্ত হয় পা।ঠিক সেভাবেই যেন আমাকে কেন্দ্র করে দুই পাশে দুটো মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে।মানুষগুলো আর কেউ নয়।সামান্তা আপু আর মেহেরাজ ভাই।আর আমি তাদের মাঝে থাকা আস্ত এক কাঁটাতার!

#চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে