#এক_বুক_ভালোবাসা
#আইরাত_বিনতে_হিমি
#পর্বঃ১৪
নিশুতি রাত। কোনো আওয়াজ নেয়। চারপাশ নিস্তব্ধ নির্জীব। যেনো কোনো প্রাণ নেয়। রাফাত মেঝেতে পড়ে ঘুমাচ্ছে। মাঝে মাঝে শীতে কেঁপে উঠছে। মেঝেতে শুয়ার অভ্যাস নেয় যে। বনুলতা আস্তে আস্তে হেঁটে উপরে আসে। রাফাতের ঘরের দরজা টা আস্তে করে খুলে। তারপর যা দেখে তাতে তার কলিজা কেঁপে উঠে। একি দৃশ্য দেখছে সে। যেই ছেলেকে সে সোনার চামচ মুখে দিয়ে বড় করিয়েছে। কখনো কষ্টের ধারে কাছে যেতে দেয় নি। সে আজ মেঝেতে ঘুমাচ্ছে। এত সুন্দর বিছানা ছেড়ে সে নিজের সঙ্গী করেছে এই মেঝেকে। বনুলতা কাঁদে। তার চোখের পানি ঝরঝর করে পড়তে থাকে। আওয়াজ যেনো না বেড়োয় তার জন্য হাত দিয়ে মুখ চেপে কান্না করে। খুব ভালোবাসে সে তার এই ছেলেকে। ছোট বেলায় নিজের বোনের কারণে ছেলেকে নিজের কাছে পায় নি। যখন কাছে পেলো সবটা দিয়ে তাকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছে সফলও হয়েছে। তাহলে আজ কিসে কমতি পড়ে গেলো। বনুলতার হেঁচকি উঠে যায়। কারো হেঁচকির শব্দ শুনে রাফাতের ঘুম ভেঙে যায়। সে উঠে বসে। সামনে তাকিয়ে দেখে তার মা দরজার সামনে দাড়িয়ে কাঁদছে। রাফাত ম্লান হাসে। মাকে নিজের কাছে ডাকে।বনুলতা ছেলের পাশে গিয়ে বসে। রাফাত মায়ের কোলে মাথা রাখে। বনুলতা হাউমাউ করে কেঁদে দেয়। রাফাত মায়ের চোখের পানি মুঝে দিয়ে বলে,
– কম তো জীবনে কাঁদলে না। আর কত কাঁদবে। এইবার তোমার শক্ত হওয়া দরকার।
বনুলতা কান্না আটকে বলে,
– আমি সব সহ্য করতে পারি। মেনে নিতে পারি। কিন্তু আমার ছেলেদের কষ্ট আমি মেনে নিতে পারি না। বিশ্বাস কর বাবা আমার কাছে যদি এমন কোনো ঔষধ থাকতো যেটা দিয়ে তোর ক্ষত সারানো যায়। আমি আমার জীবন দিয়ে হলেও সেটা তোকে এনে দিতাম।
রাফাত রেগে বলে,
– মম। এইসব কি কথা। আমার জীবনে যেমন পূর্ণা ইমপোরটেন্ট। ঠিক তেমনি তুমিও ইমপোরটেন্ট। মম তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা আর পূর্ণা দ্বিতীয়। আমি প্রথম যদি কোনো নারীর প্রেমে পড়ে থাকি তাহলে সেটা তুমি। তবে অনুভূতি গুলো আলাদা। তুমি আমার মা জন্মদাত্রী যার জন্য আমি এই পৃথিবীর আলো দেখেছি। যে আমাকে ছোট্ট বেলা থেকে সকল বিপদ থেকে রক্ষা করেছে। যে আমার ভালোর জন্য নিজের সুখ বিসর্জন দিয়েছে। যে নিজে না খেয়ে আমায় খায়িছে। আমার অসুস্থতায় রাত জেগে আমার সেবা করেছে। তুমি আমার মা। আমার মা। আর পূর্ণা হচ্ছে আমার জীবনের অর্ধেক একটা অংশ। যাকে না দেখলে আমার ঘুম হয় না। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। মনে হয় এখনি দম বন্ধ হয়ে যাবে। আমার মৃত্যু হবে। কিন্তু মৃত্যু হয় না। জ্বালা দেয়। পিড়া দেয়। আমার মনে হয় আমার কলিজার কেউ ছুরি বসিয়ে মোচড়াচ্ছে। যানো মম যখন পূর্ণা পাশে থাকে মনে হয় জীবনের সব সুখ আমার কাছে। পৃথিবীর সব শান্তি আমার হৃদয়ে ঢেলে দিয়েছে। আর না থাকলে মনে হয় পৃথিবীর সব দুঃখ কষ্ট আল্লাহ্ আমার হৃদয়ে ঢেলে দিয়েছে। মৃত্যু মনে হয় এই যন্ত্রণার থেকে ভালো। ভালোবাসা চার অক্ষরের এই শব্দটি কেউ দূর থেকে দেখলে ভাববে। ভালোবাসায় কতই না শান্তি আছে। ভালোবাসা মানে ভালো থাকা ভাববে। সবাই এর স্বাদ গ্রহণ করতে চাইবে। কিন্তু মম যখন এর স্বাদ মানুষ গ্রহণ করবে তখন বুঝবে কতটা যন্ত্রণা দেয় এই ভালোবাসা। তুমি ভালোবাসার মানুষ পেয়েছো তো রাতের আকাশের ঐ চাঁদ পেয়েছো। আর ভালোবাসার মানুষ পাওনি তো আকাশের কালো ঐ মেঘ রাশি তোমার জীবনকে আকরে ধরবে। তোমাকে মৃত্যু যন্ত্রণা অনুভব করাবে। মনে হবে কেউ তোমার গলা চেপে ধরে আছে। যেকোন সময় মৃত্যু আসবে। কিন্তু আসছে না। মাঝপথে জমদূত এসে দাড়িয়ে আছে। তোমার জান কবজ করছে না। সে শুধু দূর থেকে তোমার যন্ত্রণা দেখছে আর আসছে। বলছে দেখো ভালোবাসছো তো মরছো। কেন ভালোবাসলে এখন যন্ত্রণা ভোগ করো। ধীকে ধীকে মরো। তোমার এই যন্ত্রণা যেনো তাকে শান্তি দিবে। ভালোবাসা এমন কেনো মম?
রাফাত এতদূর বলে থামলো। তার গলা ধরে আসছে। সে নিরবে কাঁদছে। তার চোখের পানি বনুলতার শাড়ি ভিজিয়ে দিচ্ছে। বনুলতা রাফাতের চোখের পানি মুঝে দিয়ে বলে,
– এত ভালোবাসিস।
রাফাত হেসে বলে,
– বিশ্বাস করো মম। যেনে বুঝে করেনি। কেন জানি হয়ে গেলো। কীভাবে হলো জানি না। শুধু জানি ভালোবাসি অনেক ভালোবাসি আমি ঐ মেয়েটাকে। যানো মম প্রথম যেদিন আমি ওকে দেখেছিলাম ওহ তখন ছোট্ট পূর্ণা। অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে ছিলো। সাড়া শরীর ভিজে আছে। সেইদিন ঐ মুহূর্তে ঐ ভেজা পান্ডুর মুখশ্রীর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম আমি। এক মুহূর্তের জন্য আমার হৃদয় থমকে গিয়েছিল। পায়ের তলায় শিরশির অনূভব হলো। মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গেলো। অন্যরকম একটা ভালো লাগা মনের মধ্যে কাজ করলো। কিছু নতুন অনূভুতির সাথে পরিচয় হলো রাফাত চৌধুরী। যেই অনুভূতি সে আগে কখনো দেখিনি। তাদের কথা শুনেনি। যাদের সাথে তার আগে কখনো দেখা হয়নি।
বনুলতা রাফাতের কপালে চুমু খেলো। তারপর বললো,
– ভালোবাসা এমনি হয় রে পাগল। তবে তুই বেশি পাগলামি করছিস। পূর্ণা জানলে খুব রাগ করবে তুই দেখে নিস।
রাফাত উঠে বসে। বিছানা থেকে একটা বালিশ নিয়ে জরিয়ে বসে। তারপর বলে,
– জানি আমি সে এখন অনেক বুঝে। কিন্তু অবুঝ পূর্ণার কথা শুনবে তুমি।
রাফাতের ইচ্ছুক দৃষ্টি দেখে বনুলতা বুঝলো রাফাত পূর্ণার গল্প বলতে চায় মাকে। তাই সে বললো,
– শুনি আমার মেয়ের কথা।
রাফাত হাসে। রাফাতের এই হাসি বনুলতার মন ছুয়ে দেয়। রাফাতকে সে একটু হাসাতে পেরেছে।
রাফাত বলতে শুরু করে,
– যেদিন আমি পূর্ণাকে প্রথম বলি পূর্ণা আমাকে বিয়ে করবো। পূর্ণা খিলখিল করে হেসেছিল আর শেষে বললো বিয়ে কি? আমি খুব অবাক হলাম পূর্ণার বয়স তো খুব কম না। তাহলে সে কেনো বিয়ে বুঝি না। তাও ওকে বুঝিয়ে বললাম। সব শোনার পর মেয়েটা হেসে বলে মাকে বলেনি। তারপর নাহয় দেখা যাবে। বুঝলাম পূর্ণার মায়ের আদেশ ছাড়া কিছু করে না। তারপর আরও অনেক কথা হয় পূর্ণা চলে যায়। বাসায় গিয়ে ওর মাকে সব বলে দেয়।ওর মা সোজা আমার কাছে আসে। প্রথমে আমি কিছু বুঝতে পারিনি। কিন্তু ভদ্রমহিলা কোনো ভনিতা না করেই আমায় জিঙ্গাসা করলো তুমি পূর্ণাকে কি বলছো। আমিও সব বললাম ভয় হয় নি যানো মম। আমি একটুও ভয় পায়নি।সাহস করে বলেছিলাম ছোট্ট পূর্ণাকে আমি বিয়ে করবো। আপনি আমার জন্য ওকে তৈরি করে রাখবেন। ভদ্রমহিলা সেদিন আমায় এমন কথা বলেছিল যা শোনার পর আমি বাক্যহারা হয়ে পড়েছিলাম কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। তাই সেদিন বোকার মতো পালিয়ে আসি। আর জীবনের সব থেকে বড় ভুলটায় আমি সেদিন করি। যদি সেদিন আমি পূর্ণার হাত না ছাড়তাম।যদি সেইদিন সাহস করে একবার বলতাম আমার কিছু যায় আসে না। তাহলে আজ হয়তো পূর্ণা জেলে নয় আমার সাথে থাকতো।
রাফাতের কন্ঠে অনুতপ্তের ছোয়া। সে মাথা নিচু করে আছে। বনুলতা জিঙ্গাসা করে,
– সেইদিন পূর্ণার মা তোকে কি বলে যা শুনে তুই পালিয়ে আসিস।
রাফাত জোরে শ্বাস নেয় তারপর বলে,
– মম পূর্ণার মা বাইজি ছিলো। পূর্ণার জন্মের হদিস সে জানতো কিন্তু ভয়ে মুখ খুলতে পারেনি। পূর্ণার জীবনের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য সে পূর্ণাকে নিয়ে পালিয়ে আসে।
বনুলতার আফসোস হয়। কি অভাগা কপাল নিয়েই না পূর্ণার জন্ম। নাহলে কি আর এমন হয় বাবার সান্নিধ্য পেলো না। সতেরো বছর বয়সে মাকে হারালো। জীবন দিয়ে যাকে ভালোবাসলো বিধির নিষ্ঠুর খেলায় আজ তার থেকেও দূরে। বনুলতা রাফাতকে বলে,
– এই কারণেই কি ঝুমু পূর্ণাকে তুলে নেয়।
– না মম। তোমার জন্য তুলে নিয়েছে।
রাফাতের অকপট জবাব। যা বনুলতাকে নাড়িয়ে দেয়। সে অবাক হয়ে বলে,
– আমার জন্য মানে। আচ্ছা রাফাত কোনো ভাবে তুই ঝুমুর গাড়ি উড়িয়ে দিসনি তো।
রাফাত বাকা হাসে তারপর বলে,
– যেই লোকটা আমার মাকে কষ্ট দিলো। আমার বাবাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিলো। আমার ভালোবাসার গায়ে কলঙ্ক লাগালো। তাকে কি করে ছেড়ে দেয়।
বনুলতা চিৎকার করে বলে,
– রাফাত উনি তোর মামনি ছিলো। যার জন্য তুই একসময় পাগল ছিলি।
রাফাতও রাগী কন্ঠে বলে,
– ভুল। ঝুমুর বাইজি আমার কিছু হয় না। ঝুমুর নামের একটি মেয়ে ছিলো যাকে আমি আমার মামনি ভাবতাম। এখন সে আর নেয় সে মরে গিয়েছে আরও অনেক আগে। আর তুমি কার জন্য কষ্ট পাচ্ছো ঐ মহিলার জন্য তুমি জানো বাবার ব্যবসায় কে ধ্বংস করছে ঐ মহিলা। তুমি জানো পূর্ণা কার জন্য জেলে ঐ মহিলার জন্য। ঐ মহিলা আমার মাকে শান্তিতে থাকতে দেয় নি। জীবন ভরে আমার মা ঐ মহিলার জন্য কষ্ট করছে। মুখ বুজে কান্না করছে। তাও উনি আমার মায়ের সুখ সহ্য করতে পারেনি। কি করছে সে জানো। সে তোমার দূর্বল জায়গায় আঘাত করতে চেয়েছে তোমার ছেলে তোমার রাফাতকে দুনিয়ে থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছে। রাফাতের ভালোবাসা পূর্ণাকে একজন বাইজি বানাতে চেয়েছে। কেন জানো যাতে তুমি আরও কষ্ট পাও। তিলে তিলে তুমি মরো আর তুমি এইসব বলছো।
বনুলতা অশ্রুসিক্ত নয়নে বলে,
– তুই ঝুমুর সাথে দেখা করেছিলি।
– হ্যা করেছিলাম। আমার আগেই মনে হয়েছিল এই মহিলা আর কেউ না তোমার আদরের বোন ঝুমুর ই হবে। তাই সন্দেহ দূর করতে জবা মাকে কল করি। সে বলে হ্যা এইটাই ঝুমুর। চলে যাত জেলখানায় কথা বলি তার সাথে। সেখানে সে তোমার নামে বানিয়ে বানিয়ে এত গুলা মিথ্যে কথা বলে। তোমার নামে মিথ্যে অপবাদ দেয়। আমি তোমার সন্তান। ছোট্ট বেলা থেকে তোমাকে কষ্ট পেতে দেখেছি। ঐ মহিলার মিথ্যে শুনে ইচ্ছে করছিলো ঐখানেই গলা টিপে ধরি। কিন্তু তা করিনি। আমি চেয়েছিলাম যেই রূপে উনি আমার বাবাকে বশ করেছে সেই রূপ আমি ঝলসে দিবো। তাই করছি ঝলসে দিয়েছি তার রূপ।
রাফাত জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। তার চোখ দিয়ে যেনো ওলকা বের হচ্ছে। এই ওলকা দিয়ে মনে হচ্ছে সে সব ভস্ম করে দিবো। তার এই দৃষ্টি দেখলে যে কেউ ছাই ছাই হয়ে যাবে। বনুলতা ছেলের পিঠে হাত রাখে। রাফাত শান্ত হয়। মাকে জরিয়ে ধরে। কেঁদে দিয়ে বলে,
– আমি সব পারব মম তোমার কষ্ট সহ্য করতে পারবো না। তুমি ভালো থাকো আমি চাই। তুমি আর পূর্ণা আমার জীবনের সব। এদেয কিছু হয়ৃ গেলে আমি নিঃশ্ব মম। আমার দুনিয়া নিঃশ্ব।
– থাম বাবা। এত পাগলামি কেউ করে না। আমার এখন আর কোনো কষ্ট নেয়। যেদিন থেকে আমার ছেলেরা বড় হয়েছে সেদিন থেকে আমার আর কোনো কষ্ট নেয়।
কারো কান্নার আওয়াজে রিয়ানের ঘুম ভেঙেছিল। কে কাঁদছে সেটা দেখতে এসে সে মা আর ভাইয়ের সব কথা শুনে নেয়। মায়ের জীবনের এত বড় একটা সত্যি সে জানতো না। আজ জানলো মা তার কাছে সবকিছু গোপন করে রেখেছিল। কিন্তু কেন? বনুলতা দরজার দিকে তাকায় দেখে রিয়ান দাড়িয়ে আছে। বনুলতা অবাক হয়ে বলে,
– রিয়ান তুই।
রিয়ান রাগ করে সেখান থেকে চলে যায়। রাফাত মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
– মনে হয় সব শুনে নিয়েছি।
– এইবার কি হবে।
– কিছু না। সব খুলে বলো রিয়ানকে। দেখবে সব ঠিক হয়ে গিয়েছে। তুমি যাও।
বনুলতা উঠে রিয়ানের পেছন পেছন যায়। রাফাত ভাবে তার এই ভাইটা বড্ড অভিমানি। রাফাত বেলকনিতে চলে যায়। এইদিকে রিয়ান নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করতে গেলে বনুলতা ধরে ফেলে। রিয়ান দরজা ছেড়ে দেয়। রাগের মাথায় মাকে আর যায় হোক আঘাত করতে চায় না। রিয়ান রুমে এসে বিছানায় বসে পড়ে। বনুলতাও রিয়ানের পাশে এসে বসে। রিয়ান ফুসছে। তার প্রতিটি নিঃশ্বাস বলে দিচ্ছে তার ভেতরে আগুন জ্বলছে। অভিমানের পাল্লা ভারী হচ্ছে। বনুলতা রিয়ানের হাত ধরলে সে এক ঝটকায় হায় সরিয়ে নেয়। বনুলতা রিয়ানের মাথায় হাত রেখে রিয়ান রেগে বলে,
– মম প্লিজ আমাকে একা থাকতে দাও।
বনুলতা হাসার চেষ্টা করে। সে বুঝতে পারছে এই মুহূর্তে তার ছেলের ভেতরে কি চলছে। সে রিয়ানের মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
– মায়ের প্রতি এত রাগ।
রিয়ান বনুলতাকে জরিয়ে ধরে বলে,
– মম তুমি এমন কেন? সব কষ্ট বুকে চেপে রাখো। কিছু বলার হলে ভাইকে বলো তাও আমাদের বলো না।
– বোকা ছেলে আমি কাউকেই কিছু বলি না। তোর ভাই তো খুব চালাক তাই সে বুঝে নেয়।
রিয়ান উঠে বসে। তারপর বলে,
– আব্বু কি করছো মম। যার জন্য ভাই এতো রেগে আছে। আমি সেই ছোট্ট বেলা থেকে দেখে আসছি ভাই কখনোই আব্বুকে আপন করতে পারেনি। আব্বুর সাথে মনে হতো জোর করে কথা বলে। হু হা ছাড়া কোনো প্রশ্নের জবাব দেয় না। কেন মম?
বনুলতা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তারপর শূণ্যে তাকিয়ে বলে,
– তোর বাবা আমার ছোট বোনকে ভালোবাসতো। তাকে বিয়েও করেছিল। তাদের সন্তান আছে কৌশিক। কৌশিক ওদের সন্তান।
রিয়ান অবাক হয়ে যায়। সে অবাক কন্ঠে বলে,
– এইসব কি বলছো মম।
– হ্যা ঠিকই বলছি।
তারপর বনুলতা এক এক করে সব কথা রিয়ানকে বলে। শুরো থেকে কীভাবে কী হয়েছে সব বলে। সব শোনার পর রিয়ানের মুখ দিয়ে শুধু একটা উচ্চারণ আসে,
– ছিঃ।
বনুলতা ছেলের মুখ চেপে ধরে বলে,
– এইভাবে বলতে নেয় বাবা উনি তোমার বাবা হয়। বাবাকে সম্মান দাও। আমি জানতাম তোমরা এইসব শোনার পর বাবাকে ঘৃণা করবে তাই কিছু বলতে চায় নি। রাফাতকেও কিছু বলতাম না। ওহ তখন খুব একটা ছোট ছিলো না তাই অনেক কিছু বুঝতো। সেই নিজের জীবনের কিছু ঘটকার পেছনে ওহ পড়ে থাকে। সেইখান থেকেই খুজে বের করে ওর মায়ের অতীত। ওর মামনির অতীত যেই মামনিকে ওহ খুব ভালোবাসতো। আমি ওকে কিছুই বলিনি সব কিছু ওকে আপা বলেছে।
– কেন মম তোমার মধ্যে কিসের কম ছিলো যে আব্বু ঐ মহিলার কাছে গেলো। আমার মা তো শ্রেষ্ঠ মা। রূপে গুনে সব দিক দিয়ে তাহলে কেন?
– হয়তো যেই ভালোবাসা টা উনি ঝুমুর মধ্যে দেখেছিল সেটা আমার মধ্যে পায়নি। তবে জীবনের এক পর্যায়ে নিজের ভুলটা তো বুঝতে পেরেছে। এখন উনি অনুতপ্ত। আর যারা নিজের ভুল বুঝতে পারে তাদের ক্ষমা আমাদের দায়িত্ব বুঝলি।
– মম ভাই ওদের খুন করছে না।
বনুলতা ঠোটে আঙুল বসিয়ে বলে,
– হুশ কেউ শুনে নিবে। রাফাত অন্যায়কে প্রশ্রয় কখনোই দেয় না। নিজের বাবাকে ছাড় তো না। যদি না আমার ঐ মানুষ টার উপর অগাধ ভালোবাসা থাকতো। ওহ ওর মায়ের কাছ থেকে সোহাগ কেড়ে নিবে না। তাই রশীদ চৌধুরী এখনো শ্বাস নিতে পারছে। বাকি রইলো ঐ তিনজন। তারা ওর প্রাণ ভোমরায় হাত দিয়েছে। পূর্ণা রাফাতের প্রাণ। আজ ওদের জন্য পূর্ণা জেলে তাই ওদের ওহ ছেড়ে দেয়নি। মিহুকে ওহ এই কেস থেকে সরিয়ে দিয়েছে। কারণ ভাইয়ের ভালোবাসার মানুষের ক্ষতি ওহ করতে চায় না তাই বুঝলি।
– মম ভাই অনেক ভালো। কিন্তু আল্লাহ্ কেন আমার ভাইটাকে এত কষ্ট দিচ্ছে। ভাইয়ের এই কষ্ট আমি আর সহ্য করতে পারছি না।মিহু বললো ভাই অনেক পাগলামি করেছে জেল খানায় গিয়ে। শুধু তাই নয় তুমি তো দেখলে বাসায় এইসব কি করছে। আচ্ছা তুমিই বলো এইসব দেখলে পূর্ণার কি ভালো লাগবে। ওহ যদি জানতে পারে ভাই এইসব করছে তাহলে কত কষ্ট পাবে একবার ভাবো।
– হুম। কিন্তু ওকে এইসব কে বুঝাবে। যে বুঝাবে সে এখন জেলে। আর ওকে বুঝানোর ক্ষমতা আমার নেয়। যেদিন থেকে পূর্ণাতে মত্ব হয়েছে সেদিন থেকে পূর্ণা ছাড়া কিছু বুঝে না সবকিছুতে শুধু পূর্ণা।
– এতটাও কাউকে ভালোবাসা যায় মম।
– কেন যাবে না তুই কি মিহুকে ভালোবাসিস না।
– খুব বাসি। কিন্তু হয়তো ভাইয়ের মতো কখনো বাসতে পারবো না। ভাইয়ের ভালোবাসা নিখুত একদম খাটি কোনো খাত নেয়। পূর্ণা ভাগ্যবতী মম ভাইয়ের মতো জীবনসঙ্গী পেয়ে। ওদের ভালোবাসা পূর্ণতা পাক।
– তোর কী মনে হয় পূর্ণা রাফাতকে ভালোবাসে না খুব বাসে। ওর জন্য জীবনও দিতে পারে। মেয়েটা কেমন জানি খুব চুপচাপ। অথচ মাথায় চলে অন্যকিছু। ঠাণ্ডা মাথায় কাছ করে। ওর মতো মেয়ে কাউকে খুন করবে আমি কল্পনাতেও আনি নি। জীবন বাজি রেখে রাফাতকে বাচিয়েছে। যতবার ওর ভালোবাসা বিপদে পড়বে আমার বিশ্বাস সবকিছুর বিনিময়ে হলেও ভালোবাসাকে রক্ষা করবে। যেই দহনে রাফাত পুড়ছে সেই একি দহনে পূর্ণা পুড়ছে। শুধু বুকের মধ্যে মাটি চাপা দিয়ে রেখেছে সেই যন্ত্রণা। ধীকে ধীকে মরছে মেয়েটা। খুব কষ্ট হয় মেয়েটার জন্য ছোট বেলা থেকে তো শুধু কষ্টই করলো। বাবার আদর চোখে দেখলো না। মাটাকেও কেড়ে নিলো আল্লাহ্। রাফাত ছাড়া ওর জীবনে আর কে আছে।
– হুম মম। ওদের দেখলে আমার খুব কষ্ট হয় কান্না পায়।
বনুলতা রিয়ানের কান ধরে বলে,
– এখন বল তো কবে থেকে মিহু ঠুকলো তোর মনে। মমকে কিছু জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না।
রিয়ান কান ধরে বলে,
– আহ মম ছাড়ো লাগছে। তোমাকে সব বলছি আগে আমার কান ছাড়ো। কান ছিড়ে গেলে মিহু আমায় বিয়ে করবে না।
বনুলতা অবাক হয়ে বলে,
– শুনছো ছেলের কথা কি বলে। ঠোঁট কাটা বজ্জায়ত ছেলে। আসুক মিহু তোর নামে আমি ওর কাছে বিচার দিবো।
রিয়ান কান ডলতে ডলতে বলে,
– কি পায়ছো কি তোমরা। মিহুকে কিছু বললে বলে মার কাছে বিচার দিবো আর তোমাকে কিছু বললে বলো মিহুর কাছে বিচার দিবে। তাহলে আমিও বলে দিচ্ছি তোমরা আমায় কিছু বললে আমি ভাইয়ের কাছে বিচার দিবো।
বনুলতা ছেলের কথা শুনে ফিক করে হেসে দেয়। রিয়ানও মায়ের হাসি দেখে হেসে দেয়। হাসতে হাসতে এমন অবস্থা যেনো তাদের দম বেড়িয়ে আসবে। বনুলতা হাসি থামিয়ে বলে,
– অনেক হয়েছে রঙ তামাশা এখন ঘুমা। আমি আসছি।
– আচ্ছা মম। তুমিও গিয়ে শুয়ে পড়ো।
– আচ্ছা। শুভ রাত্রি।
– শুভ রাত্রি।
#চলবে
#এক_বুক_ভালোবাসা
#আইরাত_বিনতে_হিমি
#পর্বঃ১৫
গোধূলি বিকেল। সূর্যটা ডুব ডুব। এখনো ডুবে যায়নি। সূর্যের হলদে আলোয় সবকিছু মায়াবি লাগছে। এমনি এক মায়াবি বিকেলে সমুদ্র পাড়ে পাশাপাশি হাটছে পূর্ণা আর রাফাত। পূর্ণা খালি পা সে সমুদ্রের পানিতে পা ভেজাচ্ছে। মাঝে মাঝে কিছু পানি রাফাতের মুখে ছিটিয়ে মারছে। রাফাত পূর্ণার বাচ্চামো দেখে মুচকি হাসছে। এমনি একটি বিকেলে হাটার শখ ছিলো পূর্ণার যা আজ রাফাত পূরণ করতে পেরেছে। এজন্য সে বেজায় খুশি। পূর্ণা শাড়ি পড়েছে নীল শাড়ি। নীল শাড়ি আর সূর্যের হলদে আলোতে পূর্ণাকে অপসরীর মতো লাগছে। তার সাদা শরীর চারদিকে আলো করে তুলছে। রাফাত মুগ্ধ হয়ে শুধু পূর্ণাকে দেখছে। সাগর গর্জে বড় বড় ঢেউ পাড়ে আছরে পড়ছে। হঠাৎ পূর্ণা রাফাতের হাত ছেড়ে দিয়ে বলে আমি ফুচকা খাব। রাফাত হেসে বলে,
– এখন?
– হুম এখন চলো না আমরা ঐ দিকে যায়।
রাফাতের হাত ধরে বায়না করে। রাফাত পূর্ণার হাত শক্ত করে ধরে বলে,
– চলো যায়।
তারপর দুজনে হাটতে হাটতে একটি ফুচকার দোকানের সামনে আসে। পূর্ণা ফুচকা দেখে পাগল হয়ে যায় লোভ সামলাতে পারে না। তাই দ্রুত বলে,
– মামা দু প্লেট ফুচকা দিন না।
রাফাত না ছিটকে বলে,
– আমি কিন্তু খাবো না।
পূর্ণা গাল ফুলিয়ে বলে,
– কেন?
– তুমি খাও আমি দেখি তোমাকে।
পূর্ণা রাফাতের নাক টেনে বলে,
– কেন দেখে মন ভরে না।
রাফাত গুনগুনিয়ে বলে,
– নয়ন ভরে দেখি তোমায়। তবু বুঝি দেখার শেষ নাই।
পূর্ণা খিলখিল করে হাসে। পূর্ণার ঐ হাসির দিকে রাফাত মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। ফুচকাআলা মামা ফুচকা দিলে পূর্ণা ফুচকা খেতে শুরু করে। পূর্ণা ফুচকা খাচ্ছে আর চোখ মুখ কুচকাচ্ছে যা রাফাতকে আরও দূর্বল করে তুলছে পূর্ণার প্রতি। রাফাত কলারটা ঠিক করে বলে,
– এই মেয়ে আমাকে জ্বালিয়ে মারছে। একে তো রূপ দিয়ে ভস্ম করছে। এখন আবার আকার ইঙ্গিতে হৃদয় হরণ করছে। হায়রে এইবার বুঝি দম আটকে যাবে।
পূর্ণা এইসবের কিছুই শুনতে পায় না। সে রাফাতের দিকে ফুচকা নিয়ে বলে,
– নাও হা করা খুব মজা একটা খেয়ে দেখো।
– এই না আমি খাব না।
কিন্তু পূর্ণা নাছর বান্দা সে জোরজবরদস্তি রাফাতের মুখে ফুচকা ঢুকিয়ে দেয়। রাফাত খুব কষ্টে ফুচকা খায়। তারপর পূর্ণা আরও একটি ফুচকা রাফাতের মুখের সামনে ধরে। রাফাত হা করে খেতে নিলে ফুচকা টা পূর্ণা নিজের মুখে পুড়ে নেয়। রাফাত হা হয়ে পূর্ণার দিকে তাকিয়ে থাকে। পূর্ণা প্লেটটা ফুচকা ওয়ালাকে দিয়ে রাফাতকে বলে,
– বিলটা দিয়ে দাও।
কথাটা বলে পূর্ণা চলে যায়। আর রাফাত বিল দিয়ে দৌড়ে পূর্ণার পিছে আসে। আর ওকে হেচকা টান দিয়ে বলে,
– খুব আমাজে আছো হুম। নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছো নাকি।
পূর্ণা রাফাতকে ছাড়িয়ে বলে,
– যে আমার প্রেমে আগে থেকেই ডুবে আছে তাকে আর কী ডুবাবো।
রাফাত পূর্ণার আরো কাছে এসে বলে,
– আমিতো আরও গভীর যেতে চায়। যতটা গভীরে গেলে তোমাকে ছাড়া সব ফাকা ফাকা লাগবে।
পূর্ণা রাফাতকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। তারপর হাসতে হাসতে বলে;
– পাবলিক প্লেসে ড্রামা করেন।
রাফাত বালিতে পড়ে যায়। তার পাঞ্জাবি বালি দিয়ে তলিতে গিয়েছে। সে পূর্ণা দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
– তবে রে দাড়া।
রাফাতের এমন কথায় পূর্ণা দৌড়ে পালায়। তার পেছন পেছন রাফাতও দৌড়াতে থাকে। দৌড়াতে দৌড়াতে পূর্ণা হাপিয়ে যায়। চোখ মেলে তাকায় পূর্ণা। ঘামছে সে। হাপাচ্ছেও খুব। চারপাশ অন্ধকার। চোখ বলিয়ে শুধু একজনকেই খুজছে। কিন্তু সে কথায়। এত অন্ধকার কেন? কোথায় আছে সে। আলো জালায় না কেন? হঠাৎ পূর্ণার মনে পড়ে সে জেলখানায় আছে। এখানে সব সময় অন্ধকারই থাকে। আলোর দেখা মিলে না। পূর্ণার বুক চিড়ে নিঃশ্বাস আছে। এতক্ষণ যা দেখলো সব স্বপ্ন ছিলো। ঘুমের রাজ্য তার কাছে রাফাত এসেছিলো। তাকে ছুয়েছিলো। তার সাথে আনন্দের সময় পার করেছে। ইসস যদি স্বপ্ন টা সত্যি হতো। খুব ভালো স্বপ্ন ছিলো। পূর্ণা কাঁদে। ঝরঝর করে পানি পড়ে তার দুচোখের গভীর পুকুর থেকে। শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতটা আবার তাজা হয়ে উঠে। মনের ক্যানভাসে ভেসে উঠে রাফাতের হাস্যজ্জৌল মুগশ্রী। পূর্ণাবতি ডাক। কত সুন্দর করে ডাকে রাফাত। ঘোর লাগনো ডাক তার। যেনো কন্ঠে আছে ধনুক ছোড়া তীর। যেই তীর তার বুকে এসে বিধে। বুকের ভেতরটা এফোর ওফোর করে দেয়। পূর্ণা এখনো কাঁদছে। তার কান্নার আওয়াজে পাশের কয়েদি জেগে যায়। পূর্ণার পাশে এসে বসে। তার মাথায় হাত রেখে। পূর্ণা আবারো ভুল ভাবে। সে ভাবে রাফাত। সে মেয়েটিকে জরিয়ে ধরে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
– রাফাত আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রাফাত আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তোমার বুকে একটু ঠায় দেও আমায়। একটু আগলে রাখো। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না। এই অন্ধকার আমায় গিলে খাচ্ছে। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না রাফাত। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। এই কোন দহনে পুড়ছি আমি। কোন বন্ধনে তুমি আমায় বাধলে। এই বাধন ছেড়ার ক্ষমতা যে আমার নেয়। আমি কি করবো বলে দাও বলে দাও প্লিজ। বাস্তব জগতে তুমি কল্পণার জগতে তুমি ঘুমের ঘরে তুমি। সর্বত্র তুমি আমি কীভাবে বাঁচি তোমারে ছাড়া।
মেয়েটি পূর্ণার মাথায় হাত রেখে। নিচু স্বরে ডাকে,
– বোন।
পূর্ণা থেমে যায়। তার কান্না থেমে যায়। সে মেয়েটিকে ছেড়ে দেয়। বড় বড় চোখ করে মেয়েটির দিকে তাকায়। সে আবারও ভুলে গিয়েছে সে জেলে। এখানে কোনোভাবেই রাফাত আসতে পারে না। পূর্ণা মেয়েটিকে বলে,
– সরি।
মেয়েটি পূর্ণার হাত ধরে বলে,
– কোনো বেপার না। তোমার কষ্ট দেখে আমার ভেতর পুড়ে যাচ্ছে। জীবনে অনেক খুনি দেখেছি কিন্তু তোমার মতো কাউকে দেখিনি। একজন খুনি কখনো কাউকে এত ভালোবাসতে পারে। তুমি সত্যি অন্যরকম বোন। তুমি যে বাধ্য হয়ে খুন করেছো তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অনুতপ্তের আগুনে পুড়ছো। আবার ভালোবাসার বিরহে জ্বলছো। আল্লাহ্ তোমার ভেতরে শান্তি দিক। আমি জানি না আমার মতো পাপীর ডাক আল্লাহ্ শুনবে কিনা। কিন্তু যদি আমার কথা আল্লাহ্ শুনে তাহলে আমি বলবো আল্লাহ্ তোমায় শান্তি দিক। তোমার ভালোবাসা তুমি অতি শীঘ্রই পেয়ে যাও।
– আপনি খুব ভালো। আমার জন্য আপনার ঘুম ভেঙে গেলো। আপনি ঘুমান আপু।
মেয়েটি কথা বাড়ায় না সে গিয়ে শুয়ে পড়ে। পূর্ণা উঠে দাড়ায়। হেটে এসে লোহার গারদে মাথা ঢেকায়। তারপর সুর ধরে,
– যায় দিন যায় একাকী
তার বিহনে কেমনে বলো থাকি।
যায় দিন যায় একাকী
তার বিহনে কেমনে বলো থাকি।
ভালোবাসা এই অন্তরে
অভিমানে কেঁদে মরে।
ও.এই বুকেতে দুঃখ বেধে রাখি।
যায় দিন যায় দিন একাকী।
আজ বিরহের অক্ষর দিয়ে
মন লিখেছে কবিতা।
সেই কবিতার নাম দিয়েছে
হৃদয়ের কথা।
ভালোবাসা এই অন্তরে
অভিমানে কেঁদে মরে।
ও.এই বুকেতে দুঃখ বেধে রাখি।
যায় দিন যায় দিন একাকী।
হুম..তারি আশায় প্রহর গুনে
দিনে এমনি ফুরাবে।
ও.না পাওয়ার ই মন আকাশে
স্বপ্ন একে যাবে।
ভালোবাসা এই অন্তরে
অভিমানে কেঁদে মরে।
ও.এই বুকেতে দুঃখ বেধে রাখি।
যায় দিন যায় একাকী
তার বিহনে কেমনে বলো থাকি।
যায় দিন যায় একাকী
তার বিহনে কেমনে বলো থাকি।
ভালোবাসা এই অন্তরে
অভিমানে কেঁদে মরে।
ও.এই বুকেতে দুঃখ বেধে রাখি।
যায় দিন যায় দিন একাকী।
পূর্ণা গান শেষ করে চোখ বন্ধ করে চোখের পানি ফেলে। গানের প্রতিটি কথা যেনো তার অন্তরে গিয়ে লেগেছে। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। মাথা ভন ভন করছে। বুকটা ফাকা ফাকা লাগছে। মনে মনে ভাবছে স্বপ্নটা যদি আর একটু দীর্ঘ হতো। তাহলে হয়তো সে আরও কিছুক্ষণ রাফাতের নিকট থাকতে পারতো। পূর্ণার গানে সকল কয়েদিরা জেগে গিয়েছে। সকলের চোখে পানি। পূর্ণার ব্যথায় তারাও ব্যথিত। এতটুকু একটা মেয়ে কত যন্ত্রণাই না বুকে নিয়ে খুরে বেড়াচ্ছে। পূর্ণার পাশের মেয়েটি এসে পূর্ণাকে শুয়িয়ে দেয়। তারপর মাথায় হাত রেখে বলে,
– তুমিও ঘুমাও বোন আর কেঁদো না। এত কাঁদলে অসুস্থ হয়ে পড়বে। তখন এইখান থেকে বেড়িয়ে ভাইয়ের কাছে যাবে কি করে। শান্ত হও বোন। একটু ঘুমানোর ট্রাই করো।
পূর্ণা ফুপিয়ে কাঁদছে। তার আর সহ্য হচ্ছে না। এই বিরহের যন্ত্রণা সে আর বয়তে পারছে না। খুব কষ্ট হচ্ছে। ভালোবাসা কেন এত যন্ত্রণা দেয় কেন? এইসব ভাবতে ভাবতে আর কান্না করে ক্লান্ত শরীর নিয়ে পূর্ণা ঘুমিয়ে পড়ে।
______________________________________
পাখির ডাক। সূর্য মামা এখনো উঠেনি। তবে পাখিরা তাদের দায়িত্ব পালন করতে দাঁড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিনকার নিয়ম অনুযায়ী তারা উঠে ডাকাডাকি শুরু করেছে। যেনো সবাই উঠে পড়ে। ভোর হয়েছে নামাজ আদায় করে। বেশি বেলা করে ঘুমানো যে ঠিক না। পাখিরা তারই ইঙ্গিত বহন করছে। পাখির ডাকে মিহুর ঘুম ভাঙে। আজ শুক্রবার তার ডিউটি নেয়। তবুও তাড়াতাড়ি উঠেছে। কারণ আজ সে চৌধুরী বাড়ি আসবে। এই বাড়ির মানুষের অবস্থা খুবই শোচনীয়। এক ছেলে হারিয়েছে। আর এক ছেলে প্রেমিকার শোকে পাগল প্রায়। সব দিক নিশ্চয় একা বনুলতা সামাল দিতে পারছে না। মিহু উঠে বিছানা থেকে নামতে নিলে তার ফোন বাজে। সে মোবাইল টা হাতে নিয়ে দেখে রিয়ানের কল। মিহু ভ্রু কুচকে বলে,
– এত সকালে এই বেকুবে কল করছে কেন? কিছু হলো না তো আবার।
মিহু দ্রুত কল রিসিভ করে। ওপাশ থেকে রিয়ান হাপাতে হাপাতে বলে,
– মিহু কোথায় তুমি?
মিহু চিন্তিত হয়ে বলে,
– রিয়ান তুমি হাপাচ্ছো কেন? কি হয়েছে?
– মিহু জলদি গার্ডেনে আসো। তোমাদের বাড়ির কুকুর আমার পেছনে ধাওয়া করছে। আল্লাহ্ বাঁচাও মিহু।
মিহু হাসবে না কাঁদবে বুঝতেছে না। এত সকালে রিয়ান ওদেয বাড়ি কি করে। আর এসেই বিপদে পড়ছে। নিশ্চয় টুলু মুলু ওর পথ আটকেছে। ( টুলু মুলু মিহুদের বাড়ির কুকুরের নাম)
মিহু গায়ে ওরনা নিয়ে দৌড়ে নিচে নামে। মিহুর মা মিহুকে এইভাবে দৌড়াতে দেখে হা হয়ে তাকিয়ে থাকে। এই মেয়ের কি হলো এইভাবে দৌড়াচ্ছে কেন? মিহু দৌড়ে গার্ডেনে যায়। গিয়ে দেখে রিয়ান বেঞ্চে বসে টুলু মুলুকে লেগ পিছ খাওয়াচ্ছে। যা দেখে মিহুর মেজাজটায় বিগড়ে যায়। সে হুঙ্কার দিয়ে বলে,
– রিয়ান এইটা কেমন মজা।
রিয়ানের হাত থেকে লেগ পিছ টা পড়ে যায়।সে ভয়ে দুকদম পিছিয়ে যায়। তারপর টুলু মুলুকে বলে,
– যাহ বাপ ঐদিকে যাহ। আমি তোদের ম্যাডামের সাথে প্রাইভেট টক শেষ করে আসি।
টুলু মুলু যেনো সব বুঝলো ওরা চলে গেলো। রিয়ান ছুটে মিহুর কাছে আসে। মিহু ধাক্কা দিয়ে রিয়ানকে সরিয়ে দেয়। রিয়ান কান ধরে বলে,
– সরি ম্যাম এইবারের মতো মাফ করে দেন।
মিহু উত্তেজিত হয়ে বলে,
– রিয়ান ইউ নো তুমি জানো আমার কতটা টেনশন হচ্ছিলো টুলু মুলু যদি কামড়ে দিতো তখন কী হতো।
রিয়ান একটু অভিনয় করে বলে,
– কি আর হতো হাইড্রোফোবিয়ায় ভুগতাম।
মিহু রেগে রিয়ানকে মারতে শুরু করে,
– ইডিয়েট অসভ্য আমাকে জালাতে খুব ভালো লাগে তাই না। আজ তোমার একদিন কি আমার। তুমি আমায় বললে না কেন তোমার টুলু মুলুর সাথে এখন সম্পর্ক ভালো। বলো কেন বলোনি।
মিহু মারতে মারতে রিয়ানকে ঘাসের মধ্যে ফেলে দেয়। রিয়ান দুহাত দিয়ে নিজেকে বাঁচানোর ট্রাই করছে কিন্তু সে পারছে না। রিয়ান মিহুর হাত ধরে ওকে নিচে ফেলে দেয় তারপর ওর উপরে উঠে বলে,
– এখন কোথায় যাবেন ম্যাডাম। খুব তো দিচ্ছিলেন।এখন আমি মারি।
– রিয়ান নামো কেউ দেখে ফেলবে। আব্বু চলে আসবে। তখন কিন্তু কেলেঙ্কারি হবে। প্লিজ রিয়ান কথা শুনো।
রিয়ান মিহুর দিকে ঝুকে বলে,
– আগে মনে ছিলো না। এখন কেন এত ভয় শুনি। আর তোমার ঐ খারুজ বাপকে আমি ভয় পায় না।
– আচ্ছা তাই নাকি। ডাকবো আব্বুকে। আব্বুর ভয়ে যে তুমি পেছনের গেইট দিয়ে পালিয়ে এই বাড়ি ঢুকছো তা কি আমি জানি না।
– তোমার বাপ আমার কুচু করবে। শালা খবিশ একটা সারাদিন পিড়া দেয়। একটু শান্তিতে প্রেমও করতে দেয় না।
হঠাৎ পেছন থেকে একটা গম্ভীর স্বর ভেসে আসে,
– কী হচ্ছে কি এখানে মিহু।
রিয়ান ভয়ে লাফ দিয়ে সোজা হয়ে দাড়ায়। চোখের সামনে মাহমুদ সাহেব কে দেখে রিয়ানের প্রাণ টা যেনো বেরুবার উপক্রম। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েক।সে ভয়ে কাচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে আছে। আর মিহু সে তো স্টেচু হয়ে গিয়েছে।তার হাত পা কাপাকাপি শুরু হয়ে গিয়েছে। সে যেইভাবে ওদের দেখছে না জানি তার বাবা এখন কী ভাববে। মাহমুদ সাহেব মেয়ের সামনে এসে রাগী কন্ঠে বলে,
– কী করছিলে তোমরা এখানে।
মিহু আমতা আমতা করে বলে,
– বাপি তেমন কিছু না। তুমি ভুল বুঝছো বাপি।
মাহমুদ সাহেব জোরে মিহুর গালে থাপ্পর মারে। মিহু কান্না করে দেয়। চোখ ভিজে উঠে দার। গাল ধরে সে দৌড়ে ঘরে চলে যায়। রিয়ান মিহুকে ডাকে,
– মিহু।
রিয়ানের ডাক শুনে মাহমুদ সাহেব বলে,
– চুপ বেয়াদব। আর একটা কথাও নয়। তুমি আমার ছাত্র হয়ে আমার মেয়ের সাথে নোংরামি করো। আমার নামে বাজে কথা বলো। এখুনি এখুনি এই বাড়ি থেকে তুমি বেড়িয়ে যাবে।
-স্যার স্যার আপনি ভুল বুঝছেন। আমাকে বলার সুযোগ দিন। আমরা তেমন কিছুই করছিলাম না।
মাহমুদ সাহেব চিৎকার করে বলে,
– এখন কি আমি আমার চোখকে অবিশ্বাস করবো তোমার কথায়। দারোয়ান দারোয়ান।
রিয়ান হাত উঠিয়ে বলে,
– থাক আর দারোয়ান ডাকতে হবে না। আমি চলে যাচ্ছি।
– হ্যা হ্যা যাও যাও আমি এখনি তোমার মাকে কল করছি। কি শিক্ষা দিয়ে সে তোমায় বড় করছে তা আমি একটু দেখি।
রিয়ান রেগে বলে,
– খবরদাম আমার মাকে যদি উল্টাপাল্টা কিছু বলছেন তো আপনার খবর আছে। আমি ভুলে যাব আপনি আমার শিক্ষক।
– রিয়ান। তুমি আমাকে শাসাচ্ছো।
– যেটা আপনি মনে করেন। আর আমি চলে যাচ্ছি মিহুর গায়ে যদি আর একটা হাত আপনি তুলেন তো আপনার হাত আমি ভেঙে দিবো।
মাহমুদ রাগে গজগজ করতে করতে বলে,
– বেয়াদব। অশিক্ষিত ছেলে। কোনো শিক্ষা নেয়। আমার মেয়েকে আমি মেরে পঙ্গু করে রাখবো তাতে তোমার কি?
– হ্যা আপনার মেয়ে তবে সে আমারও ভালোবাসা। খুব শীঘ্রই বিয়ে করে ঘরে তুলবো বলে দিয়ে গেলাম।
কথাটা বলে রিয়ান চলে যায়। মাহমুদের রাগে শরীর জ্বলছে। সে দ্রুত পায়ে ঘরে আসে। চিৎকার করে বলে,
– মাহমুদা মাহমুদা কোথায় তুমি?
মাহমুদা কাঁপতে কাঁপতে ডাইনিংয়ে আসে। এসে বলে,
– জ্বি ডাকছেন আমায়।
মাহমুদ সাহেব চিৎকার করে বলে,
– আজ থেকে তোমার মেয়ের বাইরে যাওয়া বন্ধ। ওর মোবাইলটা ওর কাছ থেকে নিয়ে নিবে। সব ধরনের যোগাযোগ থেকে ওহ বিচ্ছিন্ন থাকবে। নির্লজ্জ মেয়ে। ওর জন্য লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। শয়তান মেয়ে। ঠিক তোর মতো হয়েছে। যেমন ছিলি তুই।
– কী বলছেন এইসব।
মাহমুদ শাসিয়ে বলে,
– চুপ একদম চুপ। কথা বললে এইখানেই গেড়ে দিবো। যা বলছি তাই কর।
মাহমুদা কাঁপতে কাঁপতে উপরে চলে যায়।ঘরে গিয়ে দেখে মিহু রাগে ফুসছে। মাহমুদা মেয়ের হাত ধরে। মিহু রাগ দেখিয়ে বলে,
– আম্মু বাপি তোমায় আবার বকছে না। ঐ লোক নিজেরে কী ভাবে। সর্বেসর্বা। ওনার মুখোশ আমি সবার সামনে খুলে দিবো। শয়তান লোক একটা।
মাহমুদা মেয়ের মুখ চেপে ধরে বলে,
– হুশ মিহু। এইভাবে বলিস না মা। তোর বাপি শুনতে পাবে। ওনার ক্ষতি আমি চায় না।
– শুধু তোমার জন্য। তোমার জন্য আমি মুখ বুজে আছি। নাহলে ওনাকে আমি গারদে ভরতাম। আমার মাকে উনি কত আঘাত করে। কত মারে। নারী নির্যাতন কেসে আমি ওনাকে ফাসাতাম। বদ লোক একটা। কি দোষ ছিলো তোমার। একটাই তো তুমি বিয়ের পর তোমার বন্ধুর ছেলের সাথে দেখতে গিয়েছিলে। প্রেমিক ও তো ছিলো না জাস্ট বন্ধু ছিলো তাতেঈ এত দোষ।ঐ লোকটার মাও তো তোমায় কম মারেনি আম্মু। তুমি শুধু একবার বলো আমি উনার কিচ্ছা খতম করে দিবো।
মাহমুদা ভয় পেয়ে বলে,
– থাম মিহু আল্লাহর দোহায় লাগি তোর থাম। এইভাব বলিস না। উনি শুনতে পাবে। তখন আবার ঝড় উঠবে। আমার কথা শোন মিহু কয়েকদিন তুই বাড়ির বাহিরে যাস না। তোর মোবাইল টা আমাকে দিয়ে দে।
– কেন দিবো। দিবো না।
– লক্ষী মেয়ে আমার এমনটা করিস না।
– তুমি যাও আম্মু। আমি এগুলোর একটাও শুনবো না।
তখন সেইখানে উপস্থিত হয় মাহমুদ সাহেব। সে রেগে বলে,
– কি করবি তুই শুনবি না। দাড়া দেখাচ্ছি মজা।
কথাটা বলে সে মাহমুদা চুল খামছে ধরে। বল তোর মেয়েকে কথা শুনতে। মিহু চিৎকার করে বলে,
– বাপি প্লিজ আম্মুকে ছেড়ে দাও প্লিজ বাপি।
মাহমুদ কথা শুনে না। সে মাহমুদায় গলা চেপে ধরে বলে,
– তুই শুনবি কি না।
মিহু কি করবে বুঝতে পারে না। এইদিকে মাহমুদার চোখ উল্টে আসে।মিহু উপার না পেয়ে বলে,
– মানবো সব শুনবো তুমি এমন করো না।
মাহমুদ মাহমুদাকে ছেড়ে দেয়। মাহমুদা গলা ধরে বসে পড়ে। কাশতে থাকে। মাহমুদ মিহুর কাছে গিয়ে বলে,
– আমি জানি তো তোর দুর্বলতা কোথায়।কি করলে তুই সব কিছু করতে রাজী হবী।
কথাটা বলে মাহমুদ চলে যায়। মিহু মায়ের কাছে গিয়ে তাকে জরিয়ে ধরে,
– আম্মু।
মাহমুদা মিহু দুজনেই কাঁদতে থাকে।
#চলবে
বিঃদ্র ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন ধন্যবাদ