#এক_বুক_ভালোবাসা
#আইরাত_বিনতে_হিমি
#পর্বঃ১২
রাফাত ঝুমুর বাইজির দিকে তাকিয়ে ডাকে,
– মামনি।
কারো ডাকে ঝুমুর বাইজি পেছন ফিরে তাকায়। চোখের সামনে দেখতে পায় রাফাতকে। রাফাত পাঞ্জাবি পড়ে পেছনে দুহাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে। ঝুমুর রাফাতের দিকে এগিয়ে এসে বলে,
– রাফাত চৌধুরী।
– হ্যা।
– তা হঠাৎ ঝুমুর বাইজির কাছে।
– মামনি তুমি নিজের পরিচয় ঢেকে রাখলেও আমি কিন্তু তোমাকে চিনতে ভুল করেনি।
রাফাতের কথায় ঝুমুর বাইজি কেপে উঠে। সে রাফাতের দিকে তাকিয়ে বলে,
– কে কইছে আমার পরিচয়?
রাফাত দাম্ভীকতার সাথে বলে,
– রাফাত চৌধুরী চাইলে সব জানতে পারে। আমার প্রশ্নের উত্তর দাও তুমি। আর এইসব আঞ্চলিক ভাষা ছাড়ো আমি জানি তুমি শুদ্ধ ভাষা পারো।
– এমন কোনো প্রশ্ন করিস না রাফাত যার উত্তর আমি তোকে দিতে পারবো না।
রাফাত রেগে বলে,
– কেন পারবে না। জবাব তোমাকে দিতে হবে। কেন তুমি বাইজি। কেন তুমি হারিয়ে গিয়েছো? কেন আমাকে ছেড়ে চলে গেছো? কেন আমার পূর্ণার ক্ষতি করার ট্রাই করছো? আমাকে জানে মারতে চাইছো? মামনি আমি তো তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। ছোট বেলায় মায়ের কাছে না গিয়ে আমি তোমার কাছে ঘুমাতে। তোমার হাত ছাড়া আমার খাওয়া হতো না। তুমি বুকে না নিলে আমার ঘুম আসতো না। তুমি জামা পড়িয়ে না দিলে আমার পড়া হতো না। শত মান অভিমান তো তোমার সাথে ছিলো। সবথেকে ভালো তো তুমি আমায় বুঝতে। আমার জেদ আমার রাগ তুমি সহ্য করতে তাহলে আজ কেন তুমি এইখানে। কোন যন্ত্রণায় আজ তুমি বাইজি। বলো স্পিক আপ ডেমেট।
ঝুমুর রাফাতের হুকারে কেপে উঠে। ছেড়ে দেয় চোখের পানি। অশ্রু শিক্ত নয়নে তাকায় রাফাতের দিকে। ছোট্ট রাফাত আজ কত বড়। সেই ছোট্ট ছোট্ট হাত পা আজ কত বড় হয়ে গিয়েছে। ঝুমুর বলে,
– এইসব প্রশ্ন গিয়ে নিজের মমকে কর।
– কেন মমকে কেন করবো তুমি বলবে। তুমি জানো তুমি চলে যাওয়ার পর আমি এক মাস জ্বরে ভুগছি। আমার খাওয়া হয়নি ঠিক মতো। তুমি কি এইসব জানো। আর জানলেই বা কি তুমি তো পাষাণ হয়ে গিয়েছো। তুমি তো জানতে না আমি তোমার মেজো আপার ছেলে তাহলে কেন আমাকে ঐভাবে একটা ঘরে বন্দি করে রেখেছিলে বলো।
ঝুমুর রাফাতের হাত ধরে বলে,
– বিশ্বাস কর রাফাত আমি তোকে মারতে চায়নি।
রাফাত এক ঝটকায় হাত সরিয়ে বলে,
– ডোন্ট টাচ। আমি কোনো বাইজির হাতের স্পর্শ চায় না।
– রাফাত। তুই আমাকে এইভাবে বলতে পারিস না।
– কেন পারি না। বাইজি কে বাইজি বলবো না তো কি বলবো।
– স্টোপেট রাফাত। আমি ইচ্ছে করে বাইজি হয়নি। আমাকে বাইজি বানানো হয়েছে। বাধ্য হয়ে আজ বাইজি হয়েছি।
– তাহলে শুনি কে তোমায় বাধ্য করলো।
– এতই যেহেতু পুরান ঘা নতুন করার শখ জেগেছে তোর তাহলে বলছি শোন। আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন মেজো আপার বিয়ে হয় রশীদ ভাইয়ের সাথে। বড় আপার দুইবছর আগে বিয়ে হয়েছে কিন্তু কোনো সন্তান হয়নি। তাই মেজো আপার বিয়ের বছরই সন্তান নেয়। তুই জন্মগ্রহণ করিস। তখন আমি দশম শ্রেণিতে উঠেছি। তোদের বাড়ি আগে থেকেই অনেক নামকরা ছিলো। চৌধুরী বাড়ি। তোর দাদা আমাদের এলাকায় বিচার সভা করতো। তাই তাদের অনেক নামডাক ছিলো। একদিন আম্মা বললো মেজো আপার নাকি জ্বর হয়ছে। তাই সবকিছু সামাল দিতে পারছে না। এইদিকে রশীদ ভাই কাছে ব্যস্ত তাই আসতেও পারছে না। তাই আমারে আম্মা তোদের বাড়ি পাঠাইলো নেমে আসলো আমার জীবনে অন্ধকার। আমি তোদের বাড়ি যাই। তুই তখন এক মাসের। আপা অসুস্থতায় শরীর টা বিছানার সাথে লেগে গিয়েছে। তাই আমিই তোর দেখভাল করতাম। যেই সময়টা তোর মায়ের কাছে থাকার কথা ছিলো সেই সময়টা তুই আমার সাথে থাকলি। তাই আমার অনেক বাধ্য হয়ে গেলি তুই। তোর বাপ খুব ভালো মানুষ নারে রাফাত। ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে থাকে। এখন অবশ্য বয়স হয়ছে ভালো পথে আসছে। তবে ব্যবসায় লোস আর চাকরি চলে যায় তিনি ভেঙে পড়ছেন। নাহলে কোনো সময়ই তোর মায়ের সাথে তার ভালো সম্পর্ক ছিলো না। এক রাতে আপা খুব অসুস্থ। আমি আপার পাশে বসে ছিলাম। আপা ঘুমায় ছিলো। তুই আমার ঘরে ছিলি। রশীর ভাই বাড়ি ছিলো না। হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠে। আমি গিয়ে দরছা খুলে দেখি রশীদ ভাই আসছে। আমি বলি ভাই আসছেন আপা অনেক অসুস্থ। সে ঢুলতে ঢুলতে আমার উপরে পড়ে যায়। বুঝতে পারি ভাই নেশা করে বাড়ি ফিরছে। তাই তাকে ছেড়ে নিজের ঘরে চলে আসতে যায়। কিন্তু সে সেদিন আমায় ছাড়েনি। তার দৃষ্টিতে ছিলো কিছু না পাওয়ার তৃষ্ণা। উনি আমাকে আমার ঘরে নিয়ে আসে। জোরজবরদস্তি আমার সাথে।
কথাটা বলে ঝুমুর আঁচল দিয়ে মুখ চেপে ধরে। রাফাত ঘেন্নায় চোখ বন্ধ করে ফেলে। ঝুমুর আবার বলতে শুরু করে,
– রাফাত তুই ছোট ছিলি আমার পাশেই ছিলি কিন্তু কিছু করতে পারিসনি। খুব কেঁদেছিলি তুই।
রাফাতের খুব কষ্ট হয় নিজের বাবার নামে এইসব শুনতে তাও বলে,
– কতদিন চলে এইসব?
– যতদিন আমি তোদের বাড়ি ছিলাম। একসময় আমি সবটা মেনে নেয়। উনি আমাকে বিয়ের স্বপ্ন দেখায়। আবার ভয়ও দেখায় সবাইকে সব বলে দিবে। তাই মুখ বুজে সব সহ্য করি। কখনো আপা কিছু বুঝতে পারেনি। অসুস্থ ছিলো সারাদিন ঘরে থাকতো। বেঁচে থেকেও কেমন জানি একটা লাশে পরিণত হলাম। বাড়ি চলে আসি। কয়েকদিন পর খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি। বার বার বমি হয় মাথা ঘুরায়। আম্মা একদিন খুব বকে। বলে কার সাথে কি করে আসছোস। মুখে তো চুন কালি লাগায় দিলি। বড় আপা মারে। মেজো আপা বাড়ি থেকে বেড় করে দিতে চায়। আব্বা বটি নিয়ে উঠছিল মারার জন্য। আমি রশীদ ভাইয়ের কাছে যায় বলি,
– কেন এমন করলেন এখন আমায় বিয়ে করেন।আমি তো কাউকে বলতেও পারছি না। আপনি আমায় বিয়ে না করলে আমি সবাইরে সব বলে দিবো।
সেদিন সে আমায় অনেক মারে। বলে আমি কি জানি তোর যা ইচ্ছা তাই কর। বাড়ি আসি বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে। মেজো আপার কাছে যায় সব খুলে বলি। মেজো আপা প্রথমে রেগে গেলেও পড়ে খুব কাঁদে। কারণ সে তো জানে তার স্বামী কেমন। আপা আমার হাত ধরে বলে,
– কাউকে কিছু বলবি না। আমি সব ঠিক করে দিবো। দরকার পড়লে বাচ্চা নষ্ট করে দিবো।
আপার কথা শুনে সেদিন খুব অবাক হয়েছিলাম। বাচ্চা আসলো আমাদের দোষের কারণে অথচ সে না দোষ করে পৃথিবীর আলো দেখতে পারবে না। মানলাম না আপার কথা বললাম,
– আপা বাচ্চা আমি নষ্ট করবো না। আমার তো মান সম্মান গেছেই দরকার পরলে তোর জামাইয়ের মান সম্মানও আমি ধুলোয় মিশাবো। আমি পুলিশের কাছে যাব। বিচার চাইবো।
সেদিন ছুটে গিয়েছিলাম চৌধুরী বাড়ি। তোর দাদার কাছে সব বলেছিলাম সাহস করে। সে আমায় সান্ত্বনা দিয়ে বললো,
– সব ঠিক করে দিবে। রশীদকে বলবে আমাকে বিয়ে করার জন্য।
ভরশা পেলাম। খুব খুশী লাগছিলো সেদিন। কিন্তু তার ভালোমানুষীর আরালে যে অন্য কিছু ছিলো সেটা বুঝতে পারিনি। হঠাৎ রাস্তায় একটা গাড়ি থামে। কিছু বুঝার আগে আমাকে তুলে নেয়। নিয়ে আসে এই বাইজি গৃহে। বন্দি হয়ে যায় বাইজি গৃহে। কত নির্যাতন অত্যাচার সহ্য করেছি আমি। তবুও বাচ্চাটাকে আগলে রেখেছিলাম। একদিন আমার বাচ্চা হয়। তবে ছেলে সন্তান হয়। যা বাইজি গৃহের কোনো কাজে আসবে না। তাই আমার সন্তানকে বিক্রি করে দেয় এক বড়লোক ব্যবসায়ীর কাছে। খুব কেঁদেছিলা জানিস। সন্তান হারিয়ে বাবা মা হারিয়ে প্রিয়জন হারিয়ে কি দোষ ছিলো আমার কেন হারালাম আমি এইসব। কেন হলো আমার সাথে এইসব। তারপর থেকে নিজেকে পাল্টে ফেলি। নিজের ভালো মানুষের রূপটাকে খুন করে অমানুষ রূপ টা তৈরি করেছি। জানিস আমাকে সেদিন কে বাইজি গৃহে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল তোর মা। তোর মা ওর দাদা পরিকল্পনা করে আমাকে আটকে দিয়েছে। আমি নাকি তোর মার সংসার নষ্ট করতে চেয়েছি। কত বড় কথা ভাব। আমার জীবন টা নষ্ট হয়ে গেলে তাতে কারো কিছু হলো না। অথচ আমার জন্য নাকি তার স্বামী শেষ হয়ে গেলো। আমি কী দোষ করেছিলাম বল যার জন্য এত বড় শাস্তি। আমার সতেরো বছরের জীবনে কেন এত বড় ঝড় এসেছিল বল।
ঝুমুর কাঁদছে। রাফাত মাথা নিচু করে সব শুনছে। এর অনেক কিছুই সে জানতো না। ছোটবেলায় ঝুমুর ছিলো তার প্রাণ। সে নিজের মায়ের কাছে যতটুকু না ছিলো তার থেকে বেশি থাকতো ঝুমুরের কাছে। রাতে ঘুমাতো ঝুমুরের কাছে। সবকিছু ঝুমুরের কাজে করতো। একদিন ঘুম থেকে উঠে সে আর ঝুমুর কে পায়নি। ঝুমুরের জন্য সে অনেক কেঁদেছিলো। কাঁদতে কাঁদতে জ্বর বাধিয়েছিল। হাসপাতালে ভর্তি ছিলো এক মাস। জ্ঞান ফিরলেই মামনি মামনি করতো। একদিন ওর জবা মা এলো এসে বললো,
– ঝুমুর চলে গিয়েছে। ঝুমুর খুব বাজে। ওহ খারাপ কাজ করেছে। তাই ওহ চলে গিয়েছে।
ছোট্ট রাফাত সেদিন কিছু বুঝতো না। শুধু জানতো তার মামনি খারাপ কাজ করেছে। যে খারাপ কাজ করে সে কখনো ভালো হয় না। এই একটা কথা তার মনে গেথে দেওয়া হয়েছিলো। যেখান থেকে সে ঝুমুর কে ঘৃণা করতে শুরু করে। কিন্তু আজ সেই ঘৃণার পাল্লা ভেঙে চুরে শেষ হয়ে যায়। রাফাত ঝুমুরের হাত ধরে বলে,
– আচ্ছা মামনি আমি তো তোমার কোনো ক্ষতি করিনি। আমি তো তোমাকে ভালোবাসতাম। তোমার ছেলে হিসেবেই ছিলাম। তাহলে আমাকে কেন প্রাণে মারতে চায়লে বলো। পূর্ণার কেন এত বড় ক্ষতি করলে। আজ তোমাদের জন্য ওহ জেলে। এইখানে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত কে হলো আমি আর আমার ভালোবাসা। এইটা করে তুমি কিসের শান্তি পেলে বলো। না রশীদ চৌধুরী কষ্ট পেলো না বনুলতা চৌধুরী। ওদের তো সব ঠিক আছে। শুধু আমি ঠিক নেয়। আমার কলিজাটা এইখানে পড়ে আছে। আমার সাথে কেন এমন হয়। ছোট বেলায় তোমায় হারালাম।এখন আবার পূর্ণা। আমার উত্তর দাও।
ঝুমুর চোখ মুঝে বলে,
– আমি জানি তুই কোনো অন্যায় করিসনি। না করেছে পূর্ণা কোনো অন্যায়। কিন্তু আমি তোর মাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য এইসব করেছি। দূর থেকে খবর রেখেছি বনুলতার প্রিয় ছেলে কে? খবরটাও পেয়ে গেলাম তার প্রিয় ছেলে তার বড় ছেলে। সে নাকি বড় ছেলে ছাড়া কিছু বুঝে না। তাই ভাবলাম এইটা সুযোগ। তবে রশীদ চৌধুরীকে অনেক আগেই শাস্তি দিয়েছি। আমার এই ক্লায়েন্টকে দিয়ে ওর চাকরি কেরেছি। ব্যবসায় ধ্বংস করেছি। তারপর রইলো বনুলতা তাই এইবার তার পালা। কি করে তাকে শাস্তি দেওয়া যায়। তাই ভাবলাম সে যেমন আমার ছেলে কেড়েছে আমি তার ছেলে কেড়ে নিবো। ভাবলাম কি করে সম্ভব। তখন দেখলাম বড় আপার ছেলে একটু এইসব লাইনে আছে। ওকে আমার দলে টানলাম। ওকে দিয়ে কৌশিককে আমার দলে আনলাম। আনার পর শুনলাম কৌশিকের তোদের প্রতি অনেক রাগ। বিশেষ করে তোর উপর। ওহ তোকে খুন করতে চায়।কারণ একটায় বনুলতার চোখের মনি তুই। মনে মনে ভাবলাম যদি বনুলতার চোখের মনি উপরে ফেলি। কিন্তু আবার কষ্টও হয়েছে বিশ্বাস কর। এক সময় তো তুই আমার প্রাণ ছিলি। কিন্তু প্রতিহিংসার জ্বালায় তোকে বন্দি করতে চায়লাম। কিন্তু রাফাত চৌধুরীর যে অনেক ক্ষমতা তাকে বন্দি করা খুব কঠিন। তাহলে তার দুর্বল স্থান কোথায় কীভাবে তাকে বন্দি করা যায়। খুজে পেলাম পূর্ণাকে। কে এই পূর্ণা খোজ নিয়ে দেখি আমাদের আসমার মেয়ে। এ তো মেঘ না চাইতে বৃষ্টি পেয়ে গেলাম। আসমা আমাদের ডেরা থেকে পালিয়েছিল মেয়ে নিয়ে। আসমা অনেক সুন্দর ছিলো ওর ছন্য আমাদের অনেক ইনকাম হতো। ভেবেছিলাম ওর মেয়ে দিয়েও অনেক ইনকাম করবো। কিন্তু আসমা পালালো ওকে খুজে পাওয়া যায়নি। শেষমেষ খুজে পেলাম। তোর দুর্বল স্থান খুজতে গিয়ে। প্রথমে পূর্ণাকে তুলে আনতে গেলাম পারলাম না আসমা বাধা হয়ে দাড়ায়। আহির খুন করে আসমাকে। পূর্ণা পালায়। প্লান করি অন্যভাবে। পূর্ণাকে নিয়ে আসে কৌশিক তবে বন্ধু সেজে তোদের বাড়ি। কাজটা আরো সোজা হয়ে গেলো। তোকে আটকানো যাবে সাথে পূর্ণাকেও পাওয়া যাবে। ঠিক তাই হলো। কিন্তু মেয়েটা বড্ড চালাক। আমি ভাবিনি ওর মতো বাচ্চা মেয়ে ওমন একটা পুরুষ মানুষকে খুন করতে পারে। এই ক্ষমতা ঐ মেয়ের কাছে। স্টিফেনকে খুন করে পূর্ণা পালায়। মাঝ পথে আহিরকে আঘাতও করে। খুব অবাক হয় এই মেয়ের অস্ত্র চালানোর হাত এত পাকা। আসলে মানুষ বিপদে পড়লে রুখেই দাড়ায়। পূর্ণাও তাই করেছে। কৌশিক তোর সই নিয়ে নিজে সম্পত্তির মালিক হতে চেয়েছিলো। তারপর তোকে মেরে গুম করে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু সবকিছুর মধ্যে বাধা হয়ে দাড়ায় পূর্ণা। আজ ঐ মেয়ের জন্য আমি জেলে। ওকে আমি ছাড়বো না। একবার জেল থেকে বের হয়।
ঝুমুরের চোখ রাগে লাল হয়ে উঠেছে। এইদিকে রাফাত উচ্চস্বরে হেসে দিয়ে বলে,
– আল্লাহর কাছে দোয়া করো যাতে তোমাকে জেল থেকে বেরুতে না হয়।কারণ তুমি বের হলে আর পৃথিবীর আলো দেখতে পাবে না।
– তুই কি আমায় হুমকি দিচ্ছেস।
রাফাত চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
– হুমকি না সাবধান করছি।
কথাটা বলে রাফাত চলে যাওয়ার জন্য দুপায় বেড়িয়ে আবার ঝুমুরের দিকে ঘুরে তাকায় তারপর বলে,
– ঝুমুর বাইজি সব ঠিক ছিলো একটা চাল তুমি ভুল চেলেছো।
– মানে।
– তোমার ছেলে বেঁচে আছে। কোথায় আছে জানো।
ঝুমুর উৎসাহিত হয়ে বলে,
– কোথায়?
– এই জেল খানায়। তোমার ছেলে আর কেউ নয়। যাকে তুমি খারাপ পথে আনছো সেই কৌশিক চৌধুরী। হ্যা রশীদ চৌধুরী অন্যায় করছে। বনুলতা চৌধুরী তোমায় বাইজি গৃহে পাঠিয়েছে। কিন্তু তোমার ছেলেকে ভদ্র সমাজেই বড় করেছে। মা বাবার পরিচয় দিয়ে বড় করিয়েছে। কিন্তু তুমি আর তোমার ছেলে তা বুঝলে না। অবুঝের মতো নিজের ছেলের ভবিষ্যৎ নষ্ট করলে।
কথাটা বলে রাফাত বড় বড় পা ফেলে চলে যায়। এইদিকে ঝুমুর পা ভেঙ্গে মাটিতে বসে পড়ে। চিৎকার করে বলে,
– পাপের শাস্তি ভোগ করছি। আমার ছেলেকে আমি নিজেই…
কথাটা বলে ঝুমুর চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।
রাফাত চলে আসলে মিহু বলে,
– কথা শেষ।
– জ্বি পূর্ণা কোথায়?
– পূর্ণাকে এখন কোর্টে নিয়ে যাওয়া হবে। গাড়িতে উঠানো হয়েছে।
রাফাত দৌড়ে বাহিরে আসে। পূর্ণা মাথা নিচু করে মাথায় ঘোমটা টেনে গাড়িতে বসে আছে। পরিস্থিতি এমন সবাই পূর্ণাকে ঘিরে ধরেছে। সাংবাদিকরা পারছে তো গিলে খাচ্ছে। পূর্ণা চুপ করে বসে আছে। রাফাতে কলিজাটা ছিড়ে যাচ্ছে। শ্বাষ নিতে কষ্ট হচ্ছে। প্রেয়শিকে এইভাবে দেখতে হবে কখনো সে ভাবেনি। এর থেকে হয়তো মৃত্যুও সহজ। রাফাতের কাছে এই মুহূর্তে এইটাই মনে হচ্ছে। মিহু আসলে রাস্তা পরিষ্কার হয়ে যায়। মিহু গিয়ে গাড়িতে বসে। গাড়ি স্টার্ড দেয়। হঠাৎ পূর্ণার কি যেনো মনে হয় সে ডানদিকে তাকায়। দেখে রাফায় অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাফাতের এমন চেহারা দেখে পূর্ণার গলাটা শুকিয়ে আসে। চোখে নোনাপানির দেখা মিলে। চোখের ভাষায় অনেক কিছু বুঝায়। রাফাত দূর থেকে চোখের ভাষায় বুঝায়,
– আমি পারছি না পূর্ণা খুব কষ্ট হচ্ছে। এইভাবে চলে যেও না।
পূর্ণার গাড়িটা চলে যায়। পূর্ণা মাথা নিচু করে নিরবে চোখের পানি ঝড়ায়। রাফাত এখনো কাঁদছে। হঠাৎ সাংবাদিকরা তার দিকে যায়। তার দিকে ক্যামেরা ঘুরিয়ে বলে,
– মিস্টার চৌধুরী। আপনার শরীরের অবস্থা এখন কেমন? আপনি এইখানে কি করছেন? পূর্ণা আপনার কি হয়? আপনার সাথে কি তার কোনো গভীর সম্পর্ক আছে। আচ্ছা আপনি কি তার সাথেই এইখানে দেখা করতে আসছেন?
রাফাতের রাগ হয়। সাংবাদিকদের এত কথা তার গায়ে লাগে।সে সহ্য করতে পারে না। রেগে গিয়ে এক সাংবাদিকের কলার চেপে ধরে। রাগী কন্ঠে বলে,
– রাফাত চৌধুরীকে ঘাটতে আসবেন না। ফলাফল ভালো হবে না।
কথাটা বলে রাফাত সাংবাদিককে ছুড়ে মাটিতে ফেলে। তারপর গাড়িতে উঠে চলে যায়। গাড়িতে উঠে একজনকে কল করে ওপাশ থেকে কল রিসিভ করেই বলে,
– স্যার স্যার আপনি কোথায় ছিলেন? পাগলের মতো আপনাকে খুজছি স্যার। কোথাও পায়নি? আপনি কোথায় ছিলেন স্যার?
রাফাত বিরক্ত হয়ে বলে,
– ওহ সিয়াম স্টোপ। এই তোমাদের কাজের নমুনা। আমি যে চারদিন মিসিং ছিলাম খুজে বের করতে পারলে না।
সিয়াম মাথাটা নিচু করে বলে,
– স্যার বিশ্বাস করেন আমাদের সব ফোর্স কাজে লাগিয়েছি কিন্তু কোনো তথ্যই পায়নি। জানেন আপনার সব থেকে বড় শত্রুকে এইখানে ধরে আটকে রেখেছি। কিন্তু সে বার বার বলছে সে জানে না আপনি কোথায়?
– সিয়াম ওর কোনো দোষ নেয় ওকে ছেড়ে দেয়। আমার নতুন শত্রু আমায় কিডন্যাপ করে রেখেছিল। নিজের বাড়িতেই আমি ছিলাম।আচ্ছি বাদ দাও এইসব শোনো একটা কাজ দিবো তোমায় করে দেখাতে হবে।
– জ্বি স্যার বলুন আপনার জন্য জান হাজির।
– ওহ ওভার একটিং বন্ধ করো। কাজের কথায় আসো।
– বলুন স্যার।
তখন রাফাত ওদেরকে বুঝিয়ে দেয় কীভাবে কি করবে কাজটা কি। সিয়াম মুখটা হা করে বলে,
– স্যার ওদের সাথে আপনার কিসের শত্রুতা।
– সেটা তোমায় জানতে হবে না। যেটা বলছি সেটা করো।
– ওকে স্যার।
– আচ্ছা রাখছি
#চলবে
#এক_বুক_ভালোবাসা
#আইরাত_বিনতে_হিমি
#পর্বঃ১৩
তিনটি গাড়ি পর পর যাচ্ছে। প্রথম গাড়িতে মিহু বসে আছে আর দুজন অফিসার। মাঝখানের গাড়িতে চালক সহ ঝুমুর বাইজি, কৌশিক আর আহির বসে আছে। পেছনের গাড়িতে আবার কয়েকজন অফিসার। হঠাৎ বিকট আওয়াজ হয়। পেছনের গাড়িটা জোরে ব্রেক কসে। মিহু ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে। গাড়ি থামলেই মিহু দৌড়ে পেছনে আসে।দেখে আসামিদের গাড়িতে আগুন জ্বলছে। দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। মিহুর বুঝতে বাকি নেয় এইখানে কেউ বম ফিট করে রেখেছিলো। গাড়ি আসতেই উড়িয়ে দিয়েছে। মিহুর চিন্তাও ছিলো না এমন কিছু হতে পারে। ঝুমুর বাইজির এত বড় শত্রু কথা থেকে এলো। সে এখন কি জবাব দিবে প্রশাসনের কাছে। মিহু রাগে গাড়িতে লাথি মারে আর বলে,
– ডেমেট। আশেপাশে খুজে দেখো সন্দেহ ভাজন কাউকে পাওকিনা।
সবাই বলে,
– জ্বি ম্যাম।
কয়েকজন কনস্ট্রাবল আশেপাশে খুজে দেখে কিন্তু না কেউ নেয়। কোনো সন্দেহভাজন কিছু নেয়। হঠাৎ মিহুর মোবাইলে কল আসে। মিহু রিসিভ করে বলে,
– স্যার সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছে।
– শেষ হয়ে গেছে মানে।
– স্যার কেউ আসামিদের গাড়িটা উড়িয়ে দিয়েছে।
– হোয়াট। তোমরা কোথায় ছিলে? কোনো আন্দাজ আছে তোমার মিহু এখন আদালতে কি বলবো আমরা।
– সরি স্যার। আমাদের আরও সর্তক থাকা উচিৎ ছিলো। তবে স্যার যে এই কাজটা করছে তাকে খুজে বের করার দায়িত্ব আমার। আমি নিজে ওকে খুজে বের করবো।
– হয়ছে আর বড় বড় কথা বলতে হবে না। তুমি কি করতে জান বা পার তা আমার জানা হয়ে গিয়েছে। এখন কলটি কাটো।
– হ্যালো স্যার আমার কথাটা শুনোন স্যার।
কিন্তু ওপাশ থেকে কল কেটে দিয়েছে। মিহু এইবার রাগে ফুসছে। সে পারছে না তো নিজেকে নিজে গিলে খাচ্ছে। রাফাত অনেকক্ষণ ধরে নিজের রুমে বসে আছে। বনুলতা এসে খাবারের জন্য ডাকলেও সে যায়নি। ঘরটা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আছে। সবকিছু বন্ধ করে রেখেছে রাফাত। হঠাৎ মোবাইল টা বেজে উঠলে রুমটা আলোকিত হয়ে উঠে। রাফাত কল রিসিভ করে গম্ভীর কন্ঠে বলে,
– হ্যালো।
ওপাশ থেকে কেউ খুশি হয়ে বলে,
– স্যার কাজ হয়ে গিয়েছে। অফিসার মিহুর চেহারাটা দেখার মতো ছিলো। ওর নাকের ডগায় দাড়িয়েছিলাম স্যার তবুও কিছু বুঝতে পারেনি। স্যার এখন কি করবো।
– দেশ ছেড়ে চলে যাও। তোমার ভিসা আমি ঠিক করে রেখেছি। বিকেলে ফ্লাইট।
– ওকে স্যার ধন্যবাদ।
সিয়াম কল কেটে দেয়। রাফাত মোবাইল টা রেখে হা হা করে হেসে দেয়।কেমন একটা শান্তি লাগছে বুকের ভেতরে। অন্যরকম শান্তি। যে তার ভালোবাসাকে তার থেকে দূরে সরিয়েছে। তাকে সে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়েছে। এমনটা যে যে করবে তাকে সে এই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিবে। আবার পরক্ষণেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। কারণ পূর্ণার কেসের রায় হয়েছে। সেখানে প্রমাণিত হয়েছে পূর্ণা খুন করেছে। কিন্তু আত্মরক্ষাত্ত্বে খুন করার জন্য তার সাজা কম হয়েছে। তিন বছরের জেল হয়েছে। যেটা শোনার পর থেকে রাফাত নিজেকে ঘরে আটকে রেখেছে। রাফাত উঠে দাড়ায়। ড্রয়ার খুলে একটা এ্যালবাম বের করে যেখানে সে আর ঝুমুর বাইজি আছে। রাফাত প্রথমে ছবিটায় হাত বুলায় তারপর আস্তে করে বলে,
– আমি তোমায় জানে মারতাম না মামনি। কিন্তু তুমি শেষ বেলায় এসেও আমায় মিথ্যে বলেছো। আমি শুধু চেয়েছিলাম তুমি সত্যি বলো। কিন্তু সেটা তুমি বলোনি। তোমার প্রথম মিথ্যে তুমি ইচ্ছে করে আমায় আদর করোনি। আমায় বুকে টেনে নাওনি। নিজের স্বার্থে করেছো এই কাজ। তোমার দ্বিতীয় মিথ্যে আমার মায়ের জ্বরের কারণে তুমি ঐ বাড়ি আসো নি। এসেছিলে আমার আব্বুর কাছাকাছি আসার জন্য। কারণ আমার আব্বু ছিলো তোমার প্রেমিক। যাকে তুমি ভালোবাসতে। আমার আব্বুর দোষ ছিলো বিয়ের পর স্ত্রীর বোনকে ভালোবাসা। কিন্তু আমার মা সব জানার পরও তোমায় বিশ্বাস করে ঐ বাড়ি এনেছিল। কিন্তু তুমি প্রেগন্যান্ট হয়ে বসলে। আমার মা বুকে পাথর চেপে তোমার সাথে আমার আব্বুর বিয়ে দিলো। তাও তুমি শান্ত হলে না। আমার মাকে ঘর থেকে বের করে দিলে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে। তোমার পেটের সন্তান নাকি আমার মা মেরে ফেলতে চেয়েছে। তখন আমি খুব ছোট নয় মামনি তখন রাফাত চৌধুরীর ছয় বছল চলে। একটু হলেও অনেক কিছু বুঝে। আমি তোমার কাছে যাওয়ার জন্য ছটফট করতাম। কারণ প্রথমে তো তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসতে। আমি যে তোমার নেউটা হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেই আদরটা যে স্বার্থের ছিলো সেটা বুঝিনি। আমার মাকে ঘর থেকে বের করে দিলে। আমার মা তখন অন্তঃশত্বা। রিয়ান তার গর্ভে। কি ঝড় তুফানের রাত ছিলো সেইদিন। অপদার্থ বাবাও সেদিন তোমার কথা শুনেছিল। আমি ঐখান থেকে চলে আসার পরে জ্বরে ভুগেছিলাম। তোমার জন্য। তোমার বুকে ঘুমানোল জন্য। কিন্তু তুমি তুমি ছিলে স্বার্থবাদী। তুমি তো ভালো মানুষ ছিলে না। তোমার চরিত্রে তো আগেই দোষ ছিলো। তাই তুমি আমাদের বাড়ির চাকরের সাথে খারাপ কাজ করতে গিয়ে ধরা খেলে। চোখ খুললো আমার আব্বুর। সে তোমাকে ছুড়ে মারলো বাইজি গৃহে। আর যখন কৌশিক হলো তখন তাকে নিয়ে আমাদের কাছে চলে আসলো। প্রথমে মা মানতে চায় নি। কিন্তু স্বামী তো তাই ফেলে দিতে পারেনি। গ্রহণ করেছিল তোমার সন্তান। মামনি আমি সত্যি তোমায় মারতে চায়নি। যেমনটা তুমি আমায় বলেছিলে তুমি আমায় মারতে চাওনি। মিথ্যেবাদী, চরিত্রহীন, স্বার্থবাদী মহিলা একটা। তুমি আমার পূর্ণার গায়ে হাত তুলছো। আমার মাকে সারাজীবন কষ্ট দিয়ে আসছো। অভিনয়টা তুমি ভালোই করতে যান। আমাকেও তো প্রায় সব বিশ্বাসই করিয়ে ফেলেছিলে। যদি না আগে থেকে সবকিছু আমার জানা না থাকতো। তোমার জন্য এই মৃত্যুই ঠিক আছি। ছাই হয়ে গেছো। রূপের যে বড় গৌরব ছিলো তোমার। এই রূপ দিয়ে তো আর কম মেয়ের সংসার ধ্বংস করোনি তুমি।
কথা শেষ করে রাফাত অ্যালবাম টা ফ্লোরে ছুড়ে মারে। তারপর ছবিগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেয়।
______________________________________
রিয়ান দৌড়ে বাড়ি আসে। ড্রয়িং রুমে এসে হাপাতে থাকে। তাকে হাপাতে দেখে বনুলতা বলে,
– কিরে কি হয়েছে এইভাবে হাপাচ্ছিস কেন?
রিয়ান হাপাতে হাপাতে বলে,
– মম কৌশিক।
– কৌশিক কৌশিকের কি হয়েছে।
– মম ওদের গাড়িটা কেউ উড়িয়ে দিয়েছে। লাশের কঙ্কাল ছাড়া আর কিচ্ছু নেয় মম।
বনুলতা সোফায় বসে পড়ে। জবা বেগম হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। কারণ সেখানে তো তার ছেলে আহির ছিলো। কৌশিক বনুলতার ছেলে না হলেও নিজে হাতে তো বড় করেছে। আম্মু আম্মু বলে বাড়ি মাথায় করেছে। বনুলতার বুকের বা পাশটায় কেমন চিনচিন ব্যথা অনুভব হয়। এই ব্যথা শুধু কি ছেলের জন্য নাকি ঝুমুর নামের সেই বোনের জন্যও আছে। হয়তো আছে নয়তো বা না। জবা কেঁদে কেঁদে জ্ঞান হারিয়েছে। বনুলতা নিজেকে শক্ত রেখেছে। অনেকক্ষণ যাবৎ বাইরে কান্নাকাটির আওয়াজ শুনে রাফাত নিচে যায়। পরণে কালো পাঞ্জাবী পায়জামা। চাদর দিয়ে উপরটা ঢেকে রেখেছে। রাফাত নিচে গিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,
– কোন শোকে এই বাড়িতে এত কান্নাকাটি শুনি।
রাফাতের কন্ঠস্বর শুনে সবাই চুপ হয়ে যায়। বনুলতা ছেলের কাছে এসে বলে,
– তুই মাথা ঘামাস না এইসব নিয়ে আমি আছি তো।আই বাবা তোকে কিছু খেতে দেয়।
রাফাত বনুলতাকে থামিয়ে বলে,
– সরি মম আমি কিছু খাব না। খিদে নেয়। আমি একটু বের হচ্ছি। আর বাড়ি এসে যেনো না দেখি এইসব কান্নাকাটি মনে যেনো থাকে।
কথাটা বলে রাফাত চলে যায়। যাওয়ার আগে একবার রশীদ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে যায়। রশীদ চৌধুরী ছেলের চোখের দিকে তাকাতে পারে না। সাথে সাথে চোখ নামিয়ে ফেলে। কারণ সে জানে তার জীবনের জঘন্য অতীত আর কেউ না জানলেও তার বড় ছেলে ঠিকই যেনে নিয়েছে।
________________________________________
রাফাত কারগারে এসেছে। এসেই মিহুর কাছে গিয়েছে। মিহু রাফাতকে দেখে বলে,
– আবার কেন এসেছেন?
– কেন আসতে পারি না।
– নাহ আসতে পারেন না। কারণ আপনার সাথে ঝুমুর বাইজির দেখা হওয়ার পর উনার গাড়ি ব্লাস্ট হয়েছে। তাই আমি চাই না আপনি আর কারো সাথে দেখা করেন।
রাফাত আয়েশ করে চেয়ারে বসে। তারপর মিহুর দিকে তাকিয়ে বলে,
– তুমি কি কোনো ভাবে আমাকে সন্দেহ করছো।
– না করার কি আছে। আমি সবাইকে সন্দেহের তালিকায় রেখেছি।
– আচ্ছা। তাহলে খুজে বের করো কার্পিটকে। এখন আপাদত আমাকে পূর্ণার সাথে দেখা করতে দাও।
– নাহ। বললাম তো হবে না।
– মিহু তুমি কি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো।
– মিস্টার রাফাত চৌধুরী এইটা আপনার অফিস না যে আপনি চিল্লিয়ে কথা বলবেন এইটা পুলিশ স্টেশন।
– মিহু আমাকে ক্ষেপিও না বলে দিলাম।
– কি করবেন আপনি শুনি।
– কিছু করতে চায় না তোমার সাথে। বিকস তুমি আমার ভাইয়ের ভালোবাসা। তাই আমার পথের কাটা হয়েও না। আমি পূর্ণার সাথে দেখা করবো।
– ভিজিটিং আওয়ারে আসবেন।
– আমি পূর্ণার সাথে দেখা করবো।
– নো।
– ইয়েস।
– নো।
– ইয়েস।
মিহু রেগে চিৎকার করে বলে,
– বললাম তো নাহ।
তখন ঐ জায়গায় মিহুর বস আসে। আর মিহুকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– এইসব কি মিহু। তুমি চেচামেচি করছো কেন? আর রাফাত চৌধুরী এখানে কি করে?
– সরি স্যার। উনি পূর্ণার সাথে দেখা করতে এসেছে।
– তো দেখা করতে দাও। এর জন্য কেউ এইভাবে চেচায়।
– কিন্তু স্যার।
– কোনো কিন্তু না মিহু। আপাদত তুমি এই কেসে নেয়। তাই তুমি কোনো ডিসিশন নিবে না।
– মানে স্যার।
– হ্যা এআ কেস অন্য অফিসারের সাথে হ্যান্ডেল করা হয়েছে। মিস্টার চৌধুরী আপনি যান।
– ধন্যবাদ অফিসার।
কথাটা বলে রাফাত ভেতরে চলে যায়। পূর্ণা সাদা রঙের শাড়ি পরে মাথা হাটুতে মুখ গুজে বসে আছে। দূর থেকে দৃশ্য টা দেখে রাফাতের বুকটা কেঁপে উঠে। হাত পা অবশ হয়ে আসে। কোনো এক যন্ত্রণায় ভেতরটা কুড়ে খাচ্ছে। রাফাত একটু কাছে এসে বলে,
– পূর্ণাবতি।
পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে পূর্ণা উপরে চোখ তুলে তাকায়। দেখে রাফাত দাড়িয়ে আছে। পূর্ণার চোখে পানি হয়তো কাঁদছিলো। পূর্ণা চোখের পানি মুছে ফেলে। উঠে দাড়ায়। মন পিঞ্জিরায় ব্যথা হচ্ছে। মাংস পিন্ডের পেছনের যন্ত্রণা তিনগুর বেশি দ্রুত গতিতে চলছে। পূর্ণা চোখ বাধা মানছে না। না চাইতেও চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানো বৃথা চেষ্টা করছে। পূর্ণা ধীর পায়ে রাফাতের দিকে এগিয়ে আসছে। রাফাত গারদের লোহাটা ধরে রেখেছে। পূর্ণা রাফাতের কাছে আসলে রাফাত কেঁদে দেয়। পূর্ণা কাঁদছে রাফাত কাঁদছে। দুজনেই নিঃশব্দে কাঁদছে। আশেপাশের কয়েদিরা তাদের কান্ড দেখছে। পূর্ণা লোহার মধ্যে মাথা ঠেকিয়ে দেয়। রাফাত পূর্ণার মাথার জায়গায় মাথা ঠেকিয়ে দেয়। রাফাত লোহার মধ্যখানের ফাক দিয়ে হাত গলিয়ে পূর্ণার হাত ধরে। পূর্ণা ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। রাফাত সেই হাতে চুমু খায়। পূর্ণা চোখ বন্ধ করে ফেলে। তাদের মধ্যেখানে দেয়ালের মতো কাজ করছে এই লোহার বেড়া। পূর্ণা এখনো কেঁদেই যাচ্ছে কোনো কথা বলছে না। রাফাত পূর্ণার হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে মনে হচ্ছে ছেড়ে দিলে দূরে কোথাও চলে যাবে। পূর্ণা হেচকি তুলে বলে,
– কেন এসেছো?
রাফাত কান্না আটকে বলে,
– আমার মায়া পরীকে দেখতে। আমার মায়া পরীর একি চেহারা হয়েছে। কেঁদে কেঁদে চোখের নিচে কালি পড়িয়ে ফেলছে। সুন্দর সুশ্রী মুখটা লালচে হয়ে গিয়েছে। একি করছো পূর্ণা।
পূর্ণা হাসার চেষ্টা করে। তারপর বলে,
– পাপ করেছি তার শাস্তি ভোগ করছি এখন।
– পূর্ণা এইভাবে বলো না প্লিজ। তুমি ইচ্ছে করে কোনো পাপ করোনি।
– যেভাবেই করেছি করছি তো।
– আমি যে আমার আগের পূর্ণাকে চাই। এই পূর্ণাকে তো আমি কখনো দেখি নি। পূর্ণা বতি তোমার মুখের এই গরন আমার ভেতরটা পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে।
– তুমি এমন করো না।
– আমি দহনে পুড়ে যাচ্ছি পূর্ণা। আমার ভেতরে শান্তি নেয়।
পূর্ণা কেঁদে দিয়ে বলে,
– আমি কী ভালো আছি তোমাকে ছাড়া।
– কেন এমনটা করলে। আমি চাইলে তোমাকে এখনো ছাড়িয়ে নিতে পারি পূর্ণা।
– নাহ এমনটা তুমি করবে না।
রাফাত বাচ্চাদের মতো কাঁদছে। সাথে পূর্ণাও। দুজনে বিরহের জালায় পুড়ছে। রাফাত কাঁদতে কাঁদতে বলে,
– আমি কেন বার বার তোমায় হারিয়ে ফেলি।
– নিয়তিতে আছে তাই।
– পূর্ণা আমার কষ্ট হচ্ছে খুব আমি আর পারছি না। দেখো দেখো আমার বুকে হাত দিয়ে কতটা পুড়ছে এইখানে। পূর্ণা আমি এই জীবন চাইনি পূর্ণা। তোমার জন্য আমি আমার রাজ্য সাজিয়েছি। আর সেই রাজ্য ছেড়ে তুমি আজ এইখানে। ঐ রাজ্যটা আমার গিলে খাচ্ছে পূর্ণা। রাণী ছাড়া রাজা যে অসহায় পূর্ণা। পূর্ণা আমি পাগল হয়ে যাব পূর্ণা। আমার কষ্টটা যদি তোমাকে দেখাতে পারতাম।
কথাগুলো বলতে বলতে রাফাত নিচে বসে পড়ে।পূর্ণা বুঝে রাফাতকে সামলাতে হবে নয়তো পাগলামি করবে। পূর্ণাও নিচে বসে তারপর বলে,
– আমার জন্য অপেক্ষা করবে তো।
– এক বুক ভালোবাসা নিয়ে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো পূর্ণা।
– আমিও এক বুক ভালোবাসা নিয়ে তোমার কাছে ফিরে আসবো।এখন এসো আর কখনো এইখানে এসো না প্লিজ।
– পূর্ণা।
– হ্যা আমি চাই না তুমি আমাকে এইভাবে দেখো। আমি আমার রাফাতকে এইভাবে দেখতে পারি না। আমি যেই রাফাতকে চিনে সে খুব স্ট্রোঙ্গ এত দুর্বল না। তাই তোমার এই দুর্বল স্বত্তাটা আমাকে দেখিও না রাফাত।
হঠাৎ একজন এসে পূর্ণার খাবার দিয়ে যায়। রাফাত তাকিয়ে দেখে পুরা রুটি। রাফাতের মেজাজটা বিগড়ে যায়। সে কিছু বলার জন্য উদ্দোত হবে তখন পূর্ণা আটকে দিয়ে বলে,
– এইটা জেলখানা রাফাত। তুমি যাও ঝামেলা করবে না যাও প্লিজ।
– আমি চলে যাচ্ছি। কিন্তু তোমার জন্য অপেক্ষা থাকবো তুমি আসবে তো।
– ইনশাআল্লাহ আসবো। তোমার পূর্ণা কি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারে। যদি নিঃশ্বাস থাকে তাহলে তোমার কাছে ঠিকই যাব।
– পূর্ণা।
– হ্যা।
রাফাত চলে যায়। পূর্ণা রাফাতের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে চোখের পানি ফেলে। আর একজন কয়েদি পূর্ণাকে বলে,
– ভাই তোমাকে খুব ভালোবাসে বোন। কখনো তার ভালোবাসা উপেক্ষা করো না।
– তার ভালোবাসা উপেক্ষা করার মতো শক্তি আমার নেয়।
______________________________________
বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে রাফাত বাড়ি ফিরে। তার এমন করুণ অবস্থা দেখে বনুলতা এগিয়ে আসে। রাফাত মাকে সরিয়ে দিয়ে উপরে চলে যায়। রিয়ান মায়ের কাছে এসে বলে,
– মম ভাই পূর্ণার কাছে গিয়েছিল। মিহু বললো আমায়। খুব পাগলামি করেছে সেখানে গিয়ে।
বনুলতার বুকটা হা হা করে উঠে মেয়ে তুল্য পূর্ণা জেলে বন্দি। তার জন্য ছেলে দেবদাস হয়ে আছে। বনুলতার কিছু ভালো লাগছে না। সে সোজা উপলে চলে যায় গিয়ে দেখে রাফাত সার্ভেন্টকে বলছে,
– আমার জন্য দুটো পুড়া রুটি নিয়ে এসো।
সার্ভেন্ট কথাটা শোনার পর হা হয়ে তাকিয়ে আছে। বনুলতা রাফাতের কাছে গেলে রাফাত বনুলতার দিকে তাকায়। বনুলতা বলে,
– এইসব কি রাফাত তুই পুড়া রুটি দিয়ে কি করবি।
– মম আমি পুড়া রুটি খাবো। আমার পূর্ণা ঐখানে বসে পুড়া রুটি ডাল ভাত খাবে। আর আমি এখানে বসে লেগ পিছ খাব। সরি মম আমি পারবো না। তুমি এইগুলোর ব্যবস্থা করো। এখন থেকে আমি এইসবই খাব।
– রাফাত কেন পাগলামি করছিস।
– আমি পাগলামি করছি না মম। যা বলছি তাই কর। নয়তো আমি বাগান বাড়ি চলে যাব।
– বাগান বাড়ি।
– হ্যা।
বনুলতার পাগল পাগল লাগছে এই ছেলেকে সে কীভাবে সামলাবে। বনুলতা সার্ভেন্টকে বলে,
– যাও পুড়া রুটি নিয়ে আসো।
সার্ভেন্ট নিচে আসতে আসতে বলে,
– এইসব কি হচ্ছে আল্লাহ্। কেউ কারো জন্য এত পাগল হতে পারে। স্যারে তো পুরাই দিওয়ানা হয়ে গেছে।
বনুলতা ছেলের মাথায় হাত রেখে বলে,
– রাফাত কেন এমন করছিস। তুই কি ঐসব খেতে পারবি। কখনো কী খেয়েছিস।
– কেন পারবো না। আমার পূর্ণা পারলে আমিও পারবো। আমার কোনো কষ্ট হবে না।
কিচ্ছুক্ষণ পর সার্ভেন্ট পুড়া রুটি নিয়ে আসলে রাফাত রুটির প্লেট নিয়ে নিচে বসে পড়ে। যেটা দেখে বনুলতা এবং সার্ভেন্ট দুজনেই অবাক হয়ে যায়। রাফাত নিচে বসে রুটি ছিড়ে ছিড়ে খাচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে তার এই রুটি খেতে। কখনো কখনো গলায় আটকে যাচ্ছে। বনুলতা ছেলের এই হাল আর সহ্য করতে পারে না। তাই আঁচলে মুখ গুজে কাঁদতে কাঁদতে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। সার্ভেন্টও চলে যায়। রাফাত মায়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,
– হায়রে মা জননী। মারা সব সময় এমনি হয় বুঝি সন্তানের দুঃখ কষ্ট দেখতে পারে না। মাগো তুমি জনম দুঃখীনিই রয়ে গেলে।
#চলবে
বিঃদ্র ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন ধন্যবাদ।