#এক_বুক_ভালোবাসা
#আইরাত_বিনতে_হিমি
#পর্বঃ১০
চৌধুরী বাড়ি
বনুলতা মেঝেতে বসে চিৎকার করে কান্না করছে। তার পাশে বসে তাকে শান্তনা দিচ্ছে তার বড় বোন জবা বেগম। সাবা সাবার মা সালমা বেগমও এসেছে। সবাই বনুলতার পাশে বসে আছে। রশীদ চৌধুরী চিন্তিত মুখ নিয়ে সোফায় বসে আছে। সাবা বনুলতাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিয়ে বলে,
– মামী মনি দা ভাই ভালো আছে তো।
ওর কান্নায় যেনো বনুলতা আরও ভেগে পড়ে। সে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। এই সময় বাড়িতে প্রবেশ করে রিয়ান আর মিহু। রিয়ানকে দেখে বনুলতা দৌড়ে রিয়ানের কাছে যায়। আঁচল পেতে বলে,
– রিয়ানরে আমার ছেলে মেয়েরে আইনা দে। আমি আমার সন্তান হারাতে পারবো না। তোর মায়েরে দোয়া কর রিয়ান।
মিহু এসে বনুলতাকে ধরে। সে বনুলতার মাথাটা তার বুকে রেখে বলে,
– মামনি আপনি কাঁদবেন না প্লিজ। রাফাত ভাই পূর্ণাকে খুব দ্রুত খুজে পাওয়া যাবে।
বনুলতা হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে বলে,
– খবরদার আমারে মামনি বলবা না। এই ডাক টা শুধু পূর্ণার জন্য বরাদ্দ।
মিহু বনুলতার বাচ্চামো দেখে হাসে। সে বলে,
– ঠিকাছে তাহলে আমি মা বলি।
বনুলতা এতকিছুর মধ্যেও ছেলের দিকে তাকায়। রিয়ান মাথা চুলকে জায়গা ত্যাগ করে। বনুলতা ম্লান হেসে বলে,
– এমন সময় এই বাড়ি আসলে মা। আমি কিছুই করতে পারলাম না।
মিহু বনুলতাকে সালাম করে বলে,
– কিছু করতে হবে না মা। আমি আপনাদের সাহায্য করতে এসেছি। আমি অফিসার মিহু। রাফাত ভাইয়ের নিখোঁজ হওয়ার কেসটা আমি দেখছি।
– ওমা তুমি পুলিশ।
– জ্বি মা।
– আমার ছেলে মেয়ে কবে বাড়ি আসবে?
বনুলতার কন্ঠে বেকুলতা। মিহু দৃঢ় কন্ঠে বলে,
– চলে আসবে খুব শীঘ্রই। আমি খুজে বেড় করবো।
মিহু রশীদ চৌধুরীকে সালাম করে। তারপর সবার সাথে সোফায় বসে বলে,
– আচ্ছা মা আপনার আরেক ছেলে কোথায়?
– কৌশিক।
– জ্বি মা।
– ওহ তো বাসায় নেয়। কলেজ থেকে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গিয়েছে।
– ওহ আর জবা আন্টির ছেলে আহির।
জবা কড়া গলায় বলে,
– এখন কি তুমি আমার ছেলেকে সন্দেহ করছো নাকি।
– দেখুন আন্টি আমি সন্দেহ করছি না। আমি শুধু জানতে চায়ছে এই বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্য কোথায় আছে। হয়তো তাদেরও বিপদ হতে পারে। এই সময় সবাই একসাথে থাকা ভালো। আচ্ছা রাফাত ভাইয়ের কি কোনো শত্রু ছিলো।
রিয়ান এসে সোফায় বসে বলে,
– আমার ভাইয়ের কোনো শত্রু ছিলো না।
মিহু তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে রিয়ানের দিকে তাকায়। যার অর্থ যদি কেউ কিছু বুঝে তো তোমার খবর আছে। আসলে হাসপাতালে যখন পূর্ণা সবকিছু মিহুকে বলছিলো তখন সবকথা রিয়ান শুনে ফেলে। আর শোনার পর বলে তার ভাই কোনো দোষ করতে পারে না। আহির কৌশিককে পূর্ণা ফাসাচ্ছে। পূর্ণাকে বার বার খুনি বলে প্রস্টিটউট বলে। পূর্ণা খুব কান্না করে।অপমান বোধ করে। শেষে মিহুর কড়া কথায় রিয়ান চুপ হয়। মিহুর এক কথা আমি কেসটা দেখছি সো আমার কথাই শেষ কথা। রিয়ান চৌধুরী তুমি যদি তোমার ভাইকে সুস্থ অবস্থায় চাও তাহলে আমার কথা শুনো।
মিহুর কথায় রিয়ান চুপ হয়ে যায়।সুযোগ দেয় পূর্ণাকে নিজেকে প্রুভ করার।
______________________________________
বাইজি গৃহ
ঝুমুর বাইজি হাতে রিভালবার নিয়ে পর পর দুটি সুট করে সামনের দিকে। সাথে সাথে দুজন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আরও পাঁচ ছয়জন তার পা ধরে বলে,
– খালা এইবারের নাগাল মাফ কইরা দাও। কথা দিবার লাগছি ঐ ছেমড়িরে ধইরা লইয়া আহুম।
তখন ঐখানে আহির আর কৌশিক আসে। আহিরের পিঠে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। কৌশিক ঝুমুর বাইজির হাত থেকে রিভালবারটা কেড়ে নেয় তারপর লোকগুলোকে চলে যেতে বলে। ঝুমুর বাইজি কৌশিকের উপর বাঘিনীর মতো ঝাপিয়ে পড়ে। কৌশিক ঝুমুর বাইজির হাত ধরে তাকে থামিয়ে বলে,
– খালা খালা শান্ত হও তুমি। কেন এমন করছো।ভুলে যাচ্ছো কেন তোমার হাই প্রেশার। খালা আমার কথা শুনো খালা।
ঝুমুর ঠান্ডা হয়। সে আসনে বসে বলে,
– কৌশিক আমার পূর্ণারে চাই। এহহোন চাই। ঐ কু*ত্তা*র বাচ্চা আমার বড় কাস্টমাররে খুন করছে। আমি ওরে পাইলে কুটিকুটি করে কাটুম।
আহির বসে বলে,
– খালা কেন ভুলে যাচ্ছো রাফাত আমাদের কাছে।
তৃষ্ণার্ত কাক যেমন পানি পেয়ে খুশিতে তার চোখ চিকচিক করে ঠিক তেমনি ঝুমুর বাইজির চোখ চিকচিক করছে। সে বাকা হাসি দিয়ে বলে,
– পাখি স্বেচ্ছায় খাঁচায় আয়বো। টোপ তো আমারই হাতে।
কথাটি বলে ওরা তিনজনে একসাথে হেসে উঠে।
______________________________________
গভীর রাত। তিন জোড়া পা ধীরে ধীরে চৌধুরী বাড়িতে প্রবেশ করছে। একজনের পরনে সুতি থ্রী পিজ মুখটা ওরনা দিয়ে বাধা। আরেক জন সাদা শার্ট আর জিন্সে আছে। আর একজন পাঞ্জাবি পড়ে আছে। দরজার সামনে এসে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে তারা। মানুষগুলো আর কেউ না পূর্ণা, রিয়ান, মিহু। দরজা খুলে তিনজন সোজা উপরে চলে যায় কৌশিকের ঘরে। পূর্ণা কৌশিকের বিছানার দিকে তাকিয়ে বলে,
– খাট টা সরাতে হবে।
অনেক কষ্টে রিয়ান, পূর্ণা, মিহু খাট টা সরায়। কিন্তু খাট সরানোর পর পূর্ণা অবাক কন্ঠে বলে,
– একি দরজা কোথায়?
মিহু পূর্ণার কথায় বলে,
– আসলেই তো। পূর্ণা তোমার ভাস্যমতে এখানে দরজা থাকার কথা।
রিয়ান হেসে বলে,
– শুধু সময় লস। চলো মিহু।
পূর্ণা মিহুর হাত ধরে বলে,
– এক মিনিট।
পূর্ণা যেখানে দরজাটা ছিলো সেখানে গিয়ে হাত রাখে। কেন জানি মনে হচ্ছে দরজাটাকে লুকানো হয়েছে। ঐ পাশে রাফাত আছে মন বলছে। হঠাৎ পূর্ণা কিছুর ঘ্রাণ পায়। সে দেয়াল শুকতে থাকে। পূর্ণা বলে,
– এইটা কিসের গন্ধ। পূর্ণা ভালো ভাবে ঘ্রাণ নিয়ে দেখে রঙের গন্ধ। তারমানে এখানে নতুন রঙ করা হয়েছে।
সে রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলে,
– রিয়ান ভাই বাড়িতে কি নতুনে রঙ করা হয়েছে।
– কোথায় না তো।
পূর্ণার যা বোঝার বুঝে ফেলে। সে দৌড়ে মিহুর কাছে আসে তারপর বলে,
– আপু এইখানে দরজা আছে। আই এম সিউর। ওরা দরজা লুকানোর জন্য নতুন করে এইখানে রঙ দিয়েছে। তুমি একটা রড আনো আমি আস্তর ভাঙবো।
– কি বলছো পূর্ণা। বাড়ির সবাই জেগে যাবে।
– কেউ জাগবে আমি যতদূর জানি এই ঘর সাউন্ড প্রুফ। আমাকে রাফাত বলেছে।
রিয়ান বলে,
– হ্যা কৌশিকের ঘর সাউন্ড প্রুফ।ওর বেড হেবিড আছে চব্বিশ ঘন্টা লাউট মিউজিক শোনা।তাই বাড়ি তৈরির সময় ওহ ভাইকে বলছিলো ওর ঘরে সাউন্ড প্রুফ সিস্টেম করতে। তাছাড়া ওহ এইটাও বলেছিল ওর ঘরের ডিজাইন ওহ নিজে বলে দিবি।
মিহু বলে,
– আচ্ছা এই কথাটা তো তুমি আগে বলো নি।
– এতে বলার কি আছে।
পূর্ণা বলে,
– কথা বাড়িয়ে লাভ নেয়। যা করতে হবে তাড়াতাড়ি।
– ওকে রিয়ান রড নিয়ে এসো।
রিয়ান গিয়ে একটা রড নিয়ে আসে। তারপর দেয়ালে আঘার করলে কিছু আস্তোর ভেঙে আসে। তারপর দেখি যায় কালো রঙের দরজা। মিহু বলে,
– দরজা ভাঙো।
রিয়ান দরজা ভাঙে। ভাঙার পর তারা সিড়ি দেখতে পায়। তিনজন সিড়ি বেয়ে নিচে নামে। নামার পর পূর্ণা রাফাতকে খুজে,
– কোথায় রাফাত। এইখানেই তো পড়ে ছিলো।
মিহু পূর্ণা কাধে হাত রেখে বলে,
– পূর্ণা কুল। ওরা যেহেতু বুঝে গিয়েছে আমরা এইখানে আসবো।তারমানে রাফাত ভাইকে ওরা সরিয়ে দিয়েছে।
পূর্ণা পাগলের মতো রাফাতকে খুজতে থাকে। একটার পর একটা ঘর খুলে দেখে। সে এক ঘরে থেকে গোঙাোর আওয়াজ পায় পূর্ণা। সে ঐ ঘরের সামনে গিয়ে বলে,
– রিয়ান ভাই এই দরজাটা ভাঙো।
পূর্ণার ডাকে রিয়ান মিহু দৌড়ে পূর্ণার কাছে আসে। রিয়ান দরজা ভাঙার জন্য পা তুললে।দরজাটা ওপাশ থেকে খুলে যায়। ওরা তিনজনে অবাক হয়ে সামনে তাকায়। সামনে রাফাতের মাথায় বন্দুক ধরে দাড়িয়ে আছে কৌশিক আর আহির। তার পাশেই চেয়ারে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আছে ঝুমুর বাইজি। পূর্ণা চিৎকার করে বলে,
– রাফাত।
রাফাত আধো আধো চোখে পূর্ণাকে দেখে। ওর শরীরে বসে থাকার মতো শক্তি নেয়। গত দুদিন ধরে ওর শরীরে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করা হচ্ছে যেটা ওকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছে। রাফাত একবার তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলে। রাফাতের এই অবস্থা দেখে পূর্ণার ভেতরটা মুচড়ে উঠে। তার চোখে পানি জমে উঠে। রিয়ান অবাক হয়ে বলে,
– কৌশিক ভাইয়ের মাথায় তুই রিভালবার ধরেছিস।
কৌশিক একটু অভিনয় করে বলে,
– ওহ ওহ আমার বড় ভাই। আল্লাহ্ আমি তার মাথায় রিভালবার ধরেছি।হাই হাই কি করে ফেলেছি। তুমি বাঁচাও খোদা।
তারপর হেসে দিয়ে বলে,
– তুমি কি ভাবছো রিয়ান ভাই আমি এমনটা করবো। কখনোই না। ঐ বাড়িতে কখনো আমার কদর ছিলো। ঐ বাড়িতে আমি কখনো আম্মুর আদর পেয়েছি। সব সময় আম্মু রাফাত রিয়ান রাফাত রিয়ান করতো। আম্মুর কাছে আমার কোনো দাম ছিলো না। আমি একটু ভালোবাসা পাওয়ার আসায় দিনের পর দিন অপেক্ষা করতাম। কিন্তু আম্মু আমায় অবহেলা করতো।তাই সেদিনই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আম্মুর আদরের সন্তানদের আমি কুটি কুটি করবো।
রিয়ান চিল্লিয়ে বলে,
– কৌশিক।
– আরে চপ।গলা নামিয়ে এইটা ঝুমুর বাইজির আস্তানা এইখানে শুধু ঝুমুর বাইজি গলা উচিয়ে কথা বলে আর কেউ না।( কৌশিক )
রিয়ান এইবার নিজের রাগ ধরে রাখতে পারে না। সে কৌশিকে কলার চেপে ধরলে। কৌশিক বলে,
– ভাইয়ের জীবনের প্রতি মায়া থাকলে কলার ছাড়।
ছোট ভাইয়ের মুখ থেকে তুই সম্মোধন শুনে রিয়ান সরে আসে। বুকের মধ্যে কেউ যেনো হাতুরি পিটা করছে। চোখদুটো ছলছল হয়ে উঠে। রিয়ান দুকদম পিছিয়ে বলে,
– আম্মু নাহয় একটু কম আদর করেছে। কিন্তু কৌশিক আমাদের আদর টাও কি কম ছিলো ভাই। আমি ভাই তোকে কি ভালোবাসিনি। তোকে আদর করেনি।
কথাটা বলতে গিয়ে রিয়ানের গলা ধরে আসে। কৌশিক রিয়ানকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে বলে,
– ঐ বাড়িটা রাফাত চৌধুরীর। তাই অলয়েস তার কথা শুনে চলতে হয়। আমি কৌশিক চৌধুরীর রাফাত চৌধুরীর হাতের পুতুল হতে পারবো না। তাই ওর সম্পত্তি নিজের নামে করার জন্য ওকে এইখানে আটকে রেখেছি। কিন্তু বেটা মরে যাচ্ছে তাও শই করছে না।
মিহু রিয়ানকে ধরে উঠায়। আহির রিয়ানের কাছে এসে বলে,
– বাহ পুলিশ নিয়ে এসেছিস।
রিয়ান আহিরের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
– তোরা সবাই জা*নো*য়া*র।
– ঠিক বলেছিস হিংস্র পশু।
কথাটা বলে ওরা হেসে উঠে। পূর্ণা দূরে থেকে সব দেখছে। আর ভাবছে এই মানুষগুলোকে সে বিশ্বাস করেছিল। শুধু কি সে রাফাত রিয়ান ভাই সবাই। কিন্তু এরা কিসের মর্যাদা দিলো। পূর্ণার বুকটা হা হা করে উঠছে। রাফাতের ঐ মুখশ্রী সে দেখতে পারছে না। ঝুমুর বাইজি উঠে দাড়িয়ে বলে,
– আহ অনেক হয়েছে রঙ তামাশা। এখন আসল কাজ কর। এই তিনটারে বাধ ঐ চেয়ারের সাথে।
ঝুমুর কথাটা বললে। মিহু পেছন থেকে রিভালবার বের করে ঝুমুরের দিকে তাক করে বলে,
– এক পা এগোবি তো শেষ করে দিবো।
আহির মিহুর কাছে এসে হেসে বলে,
– মিহু তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো আমাদের কাছে রাফাত আছে। তোমাদের একটা ভুল স্টেপ রাফাতকে শেষ করে দিবে।
আহির রাফাতের চুলগুলো খামচে কথা গুলো বললো। পূর্ণা তা দেখে চিৎকার করে বলে,
– নাহ। আহির তুমি রাফাতের কিছু করবে না।
পূর্ণার কন্ঠে বেকুলতা। এর সাহসী একটা মেয়ে প্রিয় মানুষের এই অবস্থা সহজেই ভেঙে পড়েছে। ঝুমুর পানের পিক ফেলে বলে,
– আমি তো জানতাম। মাইয়াগো দুর্বল জিনিস কি? তাই তো রাফাতকে আটকাই রাখছি। তুই ধরা দে রাফাতরে ছাইড়া দিমু।
পূর্ণা চোখদুটো ছোট ছোট করে বলে,
– আগে ছাড় পরে আমি আসবো।
– উহুম দুজনে একসাথে।
পূর্ণা জোরে শ্বাস নিয়ে বলে,
– ওকে।
কৌশিক রাফাতকে নিয়ে দরজার দিকে আসছে। আর পূর্ণা গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। দুজন পাশাপাশি হতেই দুজনে থেমে যায়। কৌশিক পূর্ণার পাশে ছিলো। পূর্ণা কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বাকা হাসি হাসে। কৌশিক পূর্ণার হাসির মানে বোঝার আগে পূর্ণা কোমরে গোজা ছুড়ি দিয়ে কৌশিকের হাতে আঘাত করে। কৌশিক চিৎকার দিয়ে মাটিতে বসে পড়ে রাফাত মাটিতে পড়ে যায়। পূর্ণা রাফাতকে ধরে ফেলে। আহির রিভালবার বের করে সুট করতে নিলে মিহু আহিরের হাতে সুট করে আহির ব্যথায় বসে পড়ে। ঝুমুর বাইজি পালানোর চেষ্টা করলে কতগুলো পুলিশ এসে ওদের ধরে ফেলে। মিহু অনেক আগেই তার ফোর্স রেডি করে রেখেছিলো। ঝুমুর শাসিয়ে বলে,
– কাউকে ছাড়ুম না। সব কয়টারে খুন করুম। আমারে তোরা চিনস না।
মিহু ধমক দিয়ে বলে,
– সাট আপ।
আহির, কৌশিককেও পুলিশ নিয়ে যায়। পূর্ণা রাফাতের মাথা নিজের কোলে নিয়ে বারবার ডাকছে,
– রাফাত রাফাত চোখ খুলো। তাকাও আমার দিকে আমি আমি তোমার পূর্ণাবতি তোমার কাছে এসেছি। এইভাবে থেকো না। চোখ খুলো রাফাত।
পূর্ণা কাঁদছে। রাফাতের হুশ নেয়। রিয়ান এসে রাফাতের পালস চেক করে। তারপর বলে,
– ইমিডিয়েটলি হাসপাতালে নিতে হবে।
রিয়ান রাফাতকে নিয়ে হাসপাতালে যায়। সাথে মিহু পূর্ণাও যায়। এতক্ষণে বাড়ির সবাই জেনে গিয়েছে। রাফাতকে আটকে রেখেছিলো কৌশিক আর আহির। যা শোনার পর বনুলতা একবারে ভেঙে পড়ে। আরও বেশি ভেঙে পড়ে এইটা শুনে ওরা নষ্ট পল্লির সাথে জড়িত ছিলো। হাসপাতালের করিডোরে এখন দাড়িয়ে আছে বনুলতা, রশীদ চৌধুরী, রিয়ান, মিহু, পূর্ণা, সাবা,জবা বেগম, সালমা বেগম, সালমা বেগমের স্বামী। বনুলতা হাউমাউ করে কাঁদছে। কখনো আবার জ্ঞান হারাচ্ছে। জবা বেগম নিজের ছেলের প্রতি ধিক্কার জানাচ্ছে। আবার কষ্টে বুকটা হু হু করে উঠছে। রশীদ চৌধুরী খামোশ হয়ে বসে আছে। যখন শুনেছে ঝুমুর বাইজির নাম তখন থেকে সে চুপ। বনুলতা পূর্ণাকে বুকে নিয়ে বসে আছে। পূর্ণা কিচ্ছু বলছে না চুপ করে বসে আছে। যেনো শোকে শোকে সে পাথর হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ সেইখানে পুলিশ আসে। মিহু এগিয়ে যায়। একটা ছেলে বলে,
– ম্যাম ঝুমুর বাইজির আস্তানায় একটা লাশ পাওয়ার গিয়েছে। লাশটা কোনো বিদেশীর।
আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি উনি গত মাসে অস্ট্রেলিয়া থেকে বিডিতে এসেছে।
– আচ্ছা। নাম কি?
– স্টিফেন। ঝুমুর বাইজির রেকর্ড বের করে দেখলাম উনি স্টিফেনের সাথে মেয়ে বাহিরে পাঠিয়ে দিতো।
– আচ্ছা। খুনটা কে করেছে ঝুমুর বাইজি।
– নো ম্যাম ঝুমুর বাইজি বলছে পূর্ণা।
মিহু পূর্ণার দিকে তাকায়। পূর্ণা মিহুর চাহনি দেখে উঠে আসে। বনুলতা পূর্ণার হাতটা ছাড়তে চায়নি। পূর্ণা অনেক বুঝিয়ে উঠে এসেছে। আইসিইউ থেকে ডাক্তার বেড়িয়ে আসলে মিহু বলে,
– আমি আসছি।
পূর্ণার এইদিকে না এসে ডাক্তারের কাছে যায়। রিয়ান বলে,
– স্যার আমার ভাই কেমন আছে।
– আলহামদুলিল্লাহ্ উনি এখন ভালো আছে। এখন ঘুমোচ্ছে।
সবাই শুকরিয়া জানায়। পূর্ণা আল্লাহর কাছে অনেক শুকরিয়া জানায়। বনুলতা পূর্ণাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
– আল্লাহ্ মুখ তুলছে পূর্ণা। তুই আমার বুকে ফিরে এসেছিস এখন রাফাতও আসবো।
কথাটা বলে বনুলতা পূর্ণার কপালে চুমু খায়। মিহু পূর্ণার দিকে তাকিয়ে বলে,
– সময় হয়েছে আমাদের যেতে হবে।
মিহুর কথায় সবাই অবাক চোখে মিহুর দিকে তাকায়। রিয়ান বুঝতে পারে মিহু কেনো এইসব বলছে। সে মিহুর হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
– না মিহু।
মিহু হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলে,
– আইন আইনের পথে চলে রিয়ান আবেগ দিয়ে চলে না। আইনের চোখ বাধা। পূর্ণা তুমি কিন্তু আমায় কথা দিয়েছো।
পূর্ণা বনুলতাকে ছেড়ে দিয়ে নিজের হাতদুটি উঠিয়ে বলে,
– এ্যারেস্ট মি। আমি প্রস্তুত। আমার রাফাত ঠিকাছে এখন আমি যেতে পারি। এরপর দেড়ি হয়ে গেলে ওর সামনে দিয়ে আমি থানায় যেতে পারবো না মিহু আপু।
শেষের কথাটা পূর্ণা কেঁদে দিয়ে বলে। বনুলতা পূর্ণাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বিষ্ময় নিয়ে বলে,
– কি করেছিস তুই পূর্ণা। ওরা কেন তোকে নিয়ে যাবে।
পূর্ণা মাথা নিচু করে কাঁদছে। মিহু সবাইকে বলে,
– পূর্ণা স্টিফেন নামের একজনকে খুন করেছে। যে ওকে রেপ করতে চেয়েছিলো।
বনুলতার বুকটা অজানা ভয়ে কেঁপে উঠে। সে পূর্ণাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
– নাহ আমার মেয়ে খুন করতে পারে না। ওর মত শান্ত মেয়ে এত বড় ভয়াবহ কাজ করতে পারে না। তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে।
পূর্ণা বনুলতাকে ছেড়ে দিয়ে বলে,
– কোন ভুল হচ্ছে না মামনি কথাটা সত্যি। মামনি আমি যাচ্ছি আমার রাফাতকে দেখে রেখো। ওহ যে আমায় বলতে পাগল। তুমি ওর খেয়াল রেখো। আমি হয়তো আর নাও ফিরতে পারি।
বনুলতা পূর্ণার হাত শক্ত করে ধরে পাগলের মতো বলে,
– তোর কিছু হবে না কিচ্ছু না। আমি তোকে কোথাও যেতে দিবো না। আমি আমার মেয়েকে কোথাও যেতে দিবো না। কেন এসেছো তোমরা। পূর্ণা আমি বলে দিলাম তুই কোথাও যাবি না।
পূর্ণা খুব ইচ্ছে করছে এই মায়ের বুকে মাথা রেখে সারা জীবন কাটাতে কিন্তু এইটা তো সম্ভোব না। পূর্ণা কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছে। ওদের এই কাহিনি দেখে সবাই কাঁদছে। পূর্ণা বনুলতার হাত ছাড়িয়ে বলে,
– যাই মামনি। চলো আপু।
কথাটা বলে পূর্ণা আর এক পাও দাড়ায় না। পেছন ফিরে তাকায় না। বা হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে যায়। পূর্ণার পেছন পেছন মিহুও ওহ তার ফোর্স চলে আসে। বনুলতা ফ্লোরে পড়ে চিৎকার করে কাঁদছে বার বার বলছে,
– রিয়ান রিয়ান রে ওরা যে আমার মেয়েটারে নিয়ে গেলো। আমার রাফাতকে আমি কি জবাব দিবো। ওরা নিয়ে আয়। আমার রাফাত যে ওরে ছাড়া নিঃশ্ব। আল্লাহ্ আমার মেয়েরে আমার বুকে ফিরায় দাও।
বিলাপের এক পর্যায় বনুলতা অজ্ঞান হয়ে যায়। রিয়ান মাকে ধরে বলে,
– মাহ।
#চলবে
#এক_বুক_ভালোবাসা
#আইরাত_বিনতে_হিমি
#পর্বঃ১১
প্রভাত বেলা। মেঘের কারণে সূর্যের দেখা নেয়। আকাশ টা ঘুমোট ভাব নিয়ে আছে। যেনো ভয়ংকর কোনো কিছুর আভাস দিচ্ছে। রাফাতকে আইসিইউ থেকে বেডে শিফট করা হয়েছে। তবে এখনো জ্ঞান ফিরে নি। বনুলতা রাতে অসুস্থ হয়ে পরায় এই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এখন সুস্থ আছে। রিয়ান হাসপাতালের করিডোরে বসে আকাশ পাতাল চিন্তা করছে। কি থেকে কি হয়ে গেলো। কত সুন্দর সংসার এক ঝটকায় ভেঙে গুরিয়ে গেলো। বাকি সবাই বাড়ি চলে গিয়েছে।।বনুলতার সাথে সাবা আছে। হঠাৎ নার্স এসে বলে,
– আপনার ভাইয়ের জ্ঞান ফিরছে।
রিয়ানের ঠোঁটে হাসি ফুটে। পরক্ষণেই আবার তা মিলিয়ে যায়। বনুলতা তার কেবিন থেকে ছুটে আসে। রিয়ানের কাছে গিয়ে বলে,
– রাফাতের জ্ঞান ফিরছে।
– জ্বি মম।
সাবা বলে,
– রিয়ান ভাই আমরা দা ভাইকে দেখতে ভেতরে যাচ্ছি না কেন?
রিয়ান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
– ভাইকে কি বলবো আমি। কি জবাব দিবো। আমার ভালোবাসা তার ভালোবাসাকে জেলে বন্দি করে রাখছে। মম তুমি বলে দাও আমি কি করবো।
বনুলতার চোখে পানি। সে রিয়ানের হাত ধরে রাফাতের কেবিনে নিয়ে যায়। রাফাত চোখের উপরে ডান হাত উল্টো করে দিয়ে শুয়ে ছিলো। হঠাৎ কারো পায়ের আওয়াজে চোখ মেলে তাকায়। দেখে মা ভাই দাড়িয়ে আছে। রাফাত উঠে বসতে নিলে বনুলতা ধরে ফেলে বলে,
– থাক বাবা উঠতে হবে না। তুমি আরাম করো।
রাফাতের চোখ অন্যকিছু খুজছে। বনুলতার দিকে তাকিয়ে বলে,
– মম পূর্ণা কোথায়?
বনুলতার মুখ চুপসে যায়। চোখে জমা হয় নোনাপানি। মায়ের এমন মুখশ্রী দেখে রাফাত উতলা হয়ে পড়ে। মনে জাগে ভীষণ ভয়।সে উঠে বসে। মায়ের হাত ধরে বলে,
– মম বলো পূর্ণা কোথায়? আমার পূর্ণা ঠিক আছে তো।
রিয়ান রাফাতের কাধে হাত রেখে বলে,
– ভাই কুল ডাউন। তোমার সবে মাত্র জ্ঞান ফিরছে। তুমি অনেক উইক ভাই। প্লিজ উত্তেজিত হয়েও না।
রাফাত রিয়ানের হাত সরিয়ে দিয়ে বলে,
– মম লুক এট মি। আমার দিকে তাকাও মম।
বনুলতা ছলছল নয়নে ছেলের দিকে তাকায়। মায়ের এমন দৃষ্টি রাফাতের বুক এফোরওফোর করে দিচ্ছে। সে বনুলতার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
– এই চোখের জলের কারণ কি? আমার খুব টেনশন হচ্ছে মম। প্লিজ আমাকে আর টেনশনে রেখো না। বলো পূর্ণা কোথায়?
বনুলতা ছেলের পাশে বসে তার হাতে হাত রেখে বলে,
– যা বলবো সত্য বলবো তোমাকে ধোয়াশার মধ্যে রাখবো না। পূর্ণা আমাদের মাঝে নেয়।
রাফাত অবাক নয়নে বলে,
– নেয় মানে কোথায় ওহ।
বনুলতা ছেলের মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
– রাফাত রাফাত রাফাত আমার দিকে তাকাও কুল ডাউন। পূর্ণা বেঁচে আছে। ভয় পেয়ো না তোমাকে ছেড়ে সারাজীবনের জন্য চলে যায় নি।
– তাহলে আমার পূর্ণা কোথায়?
বনুলতা চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলে,
– ওহ ওহ জেলে আছে। আমার পূর্ণাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছে।
কথাটা শোনা মাত্র রাফাতের যেনো দুনিয়া উল্টে যায়। সে ঘামস হয়ে যায়। চোখের পলক পড়া যেনো বন্ধ হয়ে যায়। শ্বাস নেওয়া আটকে যায়। বনুলতা ছেলের এমন অবস্থা দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। ভয় পেয়ে যায়। বলে,
– রাফাত রাফাত কি হলো। রিয়ান রিয়ান ডাক্তার কে ডাকো। রাফাত তাকাও আমার দিকে। এমন করছো কেন?
রাফাত জোরে শ্বাস নেয়। ডাক্তার আসে। রাফাতের পালস চেক করে বলে,
– ওহ মাই গড। নার্স ইনজেকশন নিয়ে এসো।
নার্স ইনজেকশন নিয়ে এলে রাফাত ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। চিৎকার করে বলে,
– কোনো মেডিসিনের প্রয়োজন নেয় আমার।
ডাক্তার রাফাতকে আটকে বলে,
– মি চৌধুরী আপনার প্রেশার ফল করছে।
– ডাক্তার আপনাকে আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। ঠিক হয়ে যাবে। আর নয়তো অলয়েস এমন রবে।
– হোয়াট আপনি পাগল হয়ে গিয়েছেন। আপনি কতটা অসুস্থ আপনার খেয়াল আছে। আপনার স্ট্রোক হতে পারে মেডিসিন না নিলে। প্লিজ রিয়ান তোমার ভাইকে বোঝাও।
রিয়ান রাফাতকে আটকে বলে,
– ভাই প্লিজ পূর্ণার জন্য নিজেকে সুস্থ করো। সবটা শুনতে হবে তোমায়। ভাই মেডিসিনটা নাও তুমি বসে থাকতে পারছো না। কথা আটকে যাচ্ছে তোমার প্লিজ ভাই।
বনুলতা এই ভয় টাই পাচ্ছিলো। সে রাফাতের হাত ধরে বলে,
– বাবা আমার মেয়ে আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছে। তুই এমন পাগলামি করিস না যাতে করে তোকেও আমাকে হারাতে হয়।
রাফাত মায়ের কথা শুনে বেডে শুয়ে পড়ে। ডাক্তার ইনজেকশন পুশ করে। একটু পর রাফাত ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু মনের ভেতরে যে দহন চলছে সেই দহন যে আগের থেকে দ্বিগুন পরিমাণে বেড়েছে। এইখান থেকে সে কীভাবে রক্ষা পাবে তার মেডিসিন তো কয়েদিখানায় বন্দি। রিয়ান রাফাতকে বলে,
– ভাই এখন কেমন লাগছে।
রাফাত জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
– আমার পূর্ণা কি করেছিল যার জন্য তাকে জেলে যেতে হলো। তুই আটকাতে পারলি না। জামিন আনতে পারলি না। মেয়েটা ঐ রকম একটা পরিবেশে কীভাবে থাকবে।কী খাবে।
– ভাই তুমি শান্ত হও। আমি সব বলছি। তোমাকে আঘাত করে যেদিন পূর্ণাকে ওরা নিয়ে গেলো। জানো কে নিয়ে গিয়েছিল।
– আন্দাজ করতে পারি।
– বলোতো কে?
– আহির।
– শুধু আহির না ভাই। শত্রু আরও একজন বেড়িয়েছে। ঘর শত্রু। আপনজন।
রাফাত বিস্ময় নিয়ে বলে,
– কৌশিক ভাই। তোমার আমার আদরের ছোট ভাই। যাকে তুমি না খেয়ে খায়িছো। মা বকলে নিজে বুকে নিয়ে ঘুম পারিয়েছো। যে কোনো বায়না করলে তুমি নিজের রক্ত বির্সজন দিয়েও পূরণ করার চেষ্টা করেছো। যার জন্য তোমার জীবন হাজির ছিল। আব্বুর রাগ মমের অবহেলা সবকিছু থেকে যাকে তুমি আগলে রেখেছো। জানো ভাই তোমার আদরের ভাই তোমার মাথায় বন্দুক ধরেছে। জানো ভাই তোমার আদরের ভাই তোমাকে প্রতিদিন ঘুমের ঔষধ দিয়েছে যাতে তুমি ধীরে ধীরে মারা যাও। তোমার নার্ভ কাজ করা বন্ধ হয়ে পড়ে। তোমার প্রোপ্রাটী নিজের নামে করতে চেয়েছে। আমি আর বলতে পারছি না ভাই।
রিয়ান কাঁদছে।গলা আটকে আসছে তার। নিজের ভাই যাকে এত ভালোবাসলো যাকে এত বিশ্বাস করলো সে যখন বেইমানি করলো তখন কেমন লাগে। সবকিছু এলোমেলো লাগছে তার।বার বার কৌশিকের বলা কথা কানে বারি খাচ্ছে। আর রাফাত যেনো মূর্তি হয়ে গিয়েছে। রাফাতের সামনে এখনো কৌশিক বা আহির আসে নি। মুখোশ পড়ে আসতো। একের পর এক ঝটকা রাফাতকে ভেতর থেকে গুরোগুরো করে দিচ্ছে। রাফাত খুব কষ্টে গলা ভিজিয়ে বলে,
-তারপর।
রিয়ান চোখের পানি মুঝে বলে,
– ওরা পূর্ণাকে বাইজি গৃহে নিয়ে যায়।
কথাটা শোনার পর রাফাতের শরীরের রক্ত টগবগ করে উঠে। হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসে। রাগী কন্ঠে বলে,,
– কী হয়েছিল বাইজি গৃহে।
– ভাই ওরা পূর্ণাকে একটা ছেলের সাথে থাকতে দেয়। সেখানে কৌশিক ছিলো। পূর্ণা ভাবে কৌশিক ওকে সাহায্য করতে এসেছে। কিন্তু না কৌশিক ওকে ঐ ঘরে তালা বন্দি করে চলে যায়।পূর্ণা নিরুপার হয়ে পড়ে। লোকটা ওকে আক্রমণ করে পূর্ণা উপায় না পেয়ে লোকটাকে আঘাত করে লোকটা মাটিতে পড়ে যায়।পূর্ণা ভাঙা ফুলের টপের কাঁচের টুকরো লোকটার দিকে ছুড়ে মারে লোকটার চোখে গিয়ে লাগে। লোকটা আরও ভয়ংকর হয়ে উঠে। সে পূর্ণার দিকে ছুড়ি নিয়ে আসে। পূর্ণা সে ছুড়ি দিয়ে লোকটার বুকে আঘাত করে। বার বার আঘাত করে যতক্ষণ না লোকটা মারা যায়।
কথাটা বলে রিয়ান জোরে শ্বাস নেয়। আর রাফাত চোখ বন্ধ করে ফেলে। রাফাত জোরে শ্বাস নিয়ে বলে,
– তারপর।
তারপরের কথা রিয়ান সব বলে রাফাতকে। সব শোনার পর রাফাত বলে,
– তাই বলে ওতো ইচ্ছে করে খুন করেনি। ওর হাতে অন্য কোনো অপশন ছিলো না। ঐ মুহূর্তে ঐ কাজ ওহ না করলে ওর সতিত্বে দাগ পড়তো। যার জন্য ওর জীবনে এত লড়াই।
– কিন্তু ভাই আইন তো এইসব মানবে না।
রাফাত রেগে বলে,
– কেন মানবে না শুনি। মিহু চাইলে ঘটনাটা মাটি চাপা দিতে পারতো। খুন নয় দিস ইজ এক্সিডেন্ট। মিহু এইটা বলতে পারতো খুনটা কে করেছে সে জানে না অপরাধীকো খুজে পায়নি সে।
বনুলতা ছেলের মাথায় হাত রেখে বলে,
– মুহাব্বাত তোমার চোখ অন্ধ করে দিয়েছে। এখন তোমার কাছে মনে হবে পূর্ণা যা করেছি সব ঠিক করেছে। কিন্তু তোমার মতো সবাই তো পূর্ণাকে ভালোবাসে না তাই ওরা ভেবে নিয়েছে পূর্ণা দোষী। একবার মাথা খাটিয়ে চিন্তা করো।
রাফাত মায়ের হাত সরিয়ে বলে,
– কেন মম। তুমি পূর্ণাকে ভালোবাস না বলো। তোমারও কি মনে হয় পূর্ণা ইচ্ছে করে সব করছে।
– দেখো রাফাত দুনিয়াতে তোমার পরে যদি কেউ পূর্ণাকে খুব বেশি ভালোবেসে থাকে সেটা আমি। আমার ছেলের ভালোবাসা ভেবে ওকে ভালোবাসিনি। নিজের মেয়ে ভেবে ভালোবেসেছি। তাই আমি চাই না ওর সাজা হোক। কিন্তু কোন উকিল ওর কেসটা লড়বে তুমি বলতে পারো। যেই জায়গা ওহ নিজে জবান দিচ্ছে যে ওহ স্টিফেন নামের ঐ বিদেশীকে নিজে হাতে ছুড়িকাঘাত করে হত্যা করেছে বলো।
রাফাতের চোখে পানি টলমল করছে। সে তার মাকে জরিয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো ফুপিয়ে কেঁদে দেয়। কান্না করে বলতে থাকে,
– কেন মম। কেন বার বার আমার সাথে এমন হয়। আমি কেন বার বার পূর্ণাকে পেয়ে হারিয়ে ফেলি। কেন মম সেদিন ওর মায়ের কথা শুনে চলে আসলাম। কেন একটু সাহস করে নিজের সাথে পূর্ণাকে নিয়ে আসলাম না। কেন মম সেদিন আমি পূর্ণাকে খুজে পায়নি কেন কৌশিকের হাতেই ওকে পড়তে হলো।মম আমি কেন সেদিন নিজের সাথে করে পূর্ণাকে ঐখানে নিয়ে গেলাম কেনো ওর হেফাজত করতে পারলাম না। কেন নিজের ইজ্জত বাঁচাতে ওকে কাউকে খুন করতে হলো। কেন ঐ খুনটা আমার হাতে হলো না। মম আই লাভ হার মম। আই লাভ হার। পাগলের মতো ভালোবাসা ঐ মেয়েটাকে আমি। ছোট্ট বেলা থেকে বুকের মধ্যে ওর জন্য ভালোবাসা জমিয়েছি। এক বুক ভালোবাসা নিয়ে ওর জন্য আমি আমার রাজ্য তৈরি করেছি।নিজেকে তৈরী করেছি। কত ভালোবাসি আমি ওকে আমি তোমাকে বুঝাতে পারবো না মম।দিন দিন এই ভালোবাসা বেড়েই চলেছে। এই মেয়েটাকে ছাড়া আমার শ্বাষ নিতে কষ্ট হয় মম। দুম আটকে আসে। মনে হয় আমার জন্য এই পৃথিবীতে অক্সিজেন নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে।মম আমি পাগল হয়ে যাব মম। আমার ওকে চাই। আমার ওকে চাই।
বনুলতা চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছে। রিয়ান ভাইয়ের পাগলামি দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। সাবা হেচকি তুলে কাঁদছে। ছোটবেলা থেকে যেই মানুষ টাকে শক্ত পাথরে গরা মূর্তি ভেবে এসেছে। সে আজকে একটু ভালোবাসা পাবার জন্য পাগলের মতো চিৎকার করে কাঁদছে। বনুলতা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
– আমি তোমাকে পূর্ণার কাছে নিয়ে যাব। তুমি এইভাবে কান্না করো না রাফাত।। বুকের মধ্যে ঝড় বয়ে যায় আমার।
রাফাত চোখ মেলে তাকায়। মায়ের বুকে থেকে উঠে বলে,
– কাঁদের জন্য আমার পূর্ণাকে জেলে যেতে হলো মম। কোন পুলিশ ওকে গ্রেফতার করেছে।
রাফাতের এমন শান্ত দৃষ্টি ভয়াবহ কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাই রিয়ান রাফাতের পায়ে পড়ে বলে,
– ভাই প্লিজ মিহুর কোনো ক্ষতি করো না। ওহ একজন সৎ পুলিশ।ওহ শুধু ওর ডিউটি পালন করছে। তুমি ওকে ছেড়ে দাও।
– তুই কেন ওর জন্য মরছিস।
সাবা হেচকি তুলা অবস্থায় বলে,
– রিয়ান ভাই যে মিহু আপুকে ভালোবাসে। মিহু আপুও রিয়ান ভাইকে ভালোবাসে। মিহু আপু রিয়ান ভাই পূর্ণা এরা সবাই মিলে তোমাকে খুজে বের করছে দা ভাই।
রাফাত রিয়ানের মাথায় হাত রেখে বলে,
– চিন্তা করিস না। তোর ভালোবাসা আমি কেড়ে নিবো না। ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা অনেক। আমি চাইনা আমার ভাই সেই যন্ত্রণা ভোগ করুক। এখন বল তোর মিহু কি আমায় একবার আমার পূর্ণার সাথে দেখা করতে দিবে।
– ভাই আজ পূর্ণার কেসটা কোর্টে উঠছে। তাই ওকে নিয়ে সবাই কোর্টে যাবে। তুমি চাইলে কোর্টে যেতে পারো।
– ওর কেসটা কে দেখছে?
– ভাই দেশের বিখ্যাত উকিল এ্যাডভোকেট জলিল।
– ঠিকাছে তোরা সবাই উপস্থিত থাকিস। আমি থাকলে মেয়েটা হিম্মত হারাবে। ভয় পাবে। আমার সামনে যে খুবই দুর্বল। দুনিয়ার সামনে সে বাঘিনী হলেও আমার কাছে খোরগোশের বাচ্চা। আচ্ছা আজ কি ঝুমুর বাইজির কেসও কোর্টে উঠছে।
– জ্বি ভাই।
– আচ্ছা তোরা যা।
– হুম।
রাফাত একা একা কেবিনে বসে চিন্তা করছে। একজন বাইজির কি শাস্তি হতে পারে। সে কি একবার ঝুমুর বাইজির সাথে দেখা করবে। রাফাত মোবাইল হাতে নিয়ে একজনকে কল করে। কল রিসিভ হওয়ার সাথে সাথে সে বলে,
– জবা মা তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
– আমি জানতাম রাফাত তুই আমায় কল করবি। বল কি জানতে চাস।
– যেহেতু যান আমি কল করবো। তাহলে এইটাও জানো কেন করবো। বলে ফেলো আমার প্রশ্নের জবাব।
– ঝুমুর সম্পর্কে জানতে চায়ছিস।
– হ্যা গত বিশ বছর আগে যেই সত্য মাটি চাপা ছিলো এই ঝুমুর কি সেই ঝুমুর।
– হ্যা এইটাই আমার ছোট বোন ঝুমুর।
– ওহহ। তাহলে আমি রাখি।
– রাফাত হ্যালো তুই কিন্তু কিছু করবি না। রাফাত হ্যালো শুনছিস রাফাত।
জবা বেগম মোবাইল টা হাতে নিয়ে দেখে রাফাত কল কেটে দিয়েছে। সে মনে মনে প্রার্থনা করে,
– আল্লাহ্ সবকিছু যেনো ঠিক থাকে ঝুমুরের কিছু যেনো না হয় ওর শাস্তি আদালত দিক আমার কোনো সমস্যা নেয় কিন্তু রাফাত যেনো কিছু না করে।
রাফাত হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে সোজা পুলিশ স্টেশন আসে। এসেই মিহুর সাথে দেখা হয়। মিহু রাফাতকে দেখে বলে,
– আরে দা ভাই প্লিজ সিট। আপনি পূর্ণার সাথে দেখা করতে আসছেন। কিন্তু দা ভাই ওহ চাইনা আপনার সামনে দাড়াতে। ওর সেই শক্তি নেয়। আপনার মুখের যেই অবস্থা তা দেখলে ওহ আরো শেষ হয়ে যাবে দা ভাই। ওহ আমাকে সোজাসুজি বলছে রাফাত আসলে চলে যেতে বলবেন।ওর সামনে দাড়ানোর ক্ষমতা আমার নেয়।
– আমি জানি। তুমি ঝুমুর বাইজির সাথে আমার দেখা করানোর ব্যবস্থা করো।
– কিন্তু দা ভাই।
– যা বলছি করো।
– সরি দা ভাই একটু পরে আদালতে যাব। তখন কথা বলে নিবেন।
রাফাত ধমকে বলে,
– তুমি আমায় সরি বলছো।দেখো মিস মিহু আমার ভাইয়ের ভালোবাসা বলে তোমায় আমি কিচ্ছু বলছি না। এমিডিয়েটলি দেখা করানোর ব্যবস্থা করো।
মিহুও ধমকে বলে,
– সরি মিস্টার রাফাত চৌধুরী এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। আপনি আসুন।
– হোয়াট। ওকে দেখো আমি কি করি।
রাফাত মোবাইল বের করে একজনকে কল করে কিছু কথা বলে। একটু পর মিহুর মোবাইলে কল আসে। সে বলে,
– ওকে ওকে স্যার আমি করে দিচ্ছি। নো প্রবলেম স্যার নো প্রবলেম।
কলটা কেটে মিহু রাফাতের দিকে তাকিয়ে বলে,
– এত ক্ষমতা তাহলে পূর্ণাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যান। ওহ যে কষ্ট পাচ্ছে।
– ওহ সেচ্ছায় থাকছে। ওহ শাস্তি পেতে চায় তাই।এখন বলো কোথায় ঝুমুর বাইজি।
মিহু রাফাতকে নিজের সাথে নিয়ে যায়। ঝুমুর বাইজি উল্টো দিকে ঘুরে দাড়িয়ে আছে। এইখানে আর কোনো কয়েদি নেয়। শুধু ঝুমুর বাইজি একা। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে জেলখানার ছোট্ট ভেন্টিলাইটারের আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। মিহু রাফাতকে রেখে চলে যায়। রাফাত ঝুমুর বাইজির দিকে তাকিয়ে ডাকে,
– মামনি।
#চলবে
বিঃদ্র ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন ধন্যবাদ।