এক ফালি চাঁদ পর্ব-০৮

0
1280

#এক_ফালি_চাঁদ
#পর্ব_৮
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
‘একটা বিয়ে ভাঙতে হবে অনল ভাই। আমি কিছুতেই এখন বিয়ে করব না। এই বিয়ে করা আমার পক্ষে একদম অসম্ভব।’

হন্তদন্ত হয়ে হড়বড় করে বলল অনু। অনিকের ঘরে ইউসূফকে দেখেই একছুটে দৌঁড়ে ঘর থেকে বের হয়েছিল অনু। মেইন দরজার কাছে এসে অনলের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। তখনই অনলের হাত ধরে ছাদে নিয়ে এসেছে অনু। বাইরে থেকে এসে অনল ক্লান্ত। অনুর হুট করে বলা বিয়ের কথাও অনলের মাথায় ঢুকছে না। তবে অনুর পেরেশানি মুখ দেখে মনে হচ্ছে ঘটনা সিরিয়াস কিছু। অনল গায়ের জ্যাকেটটা খুলে ফেলে। শীতের মধ্যেও ওর এখন গরম লাগছে। জ্যাকেটটা অনুর দিকে ছুঁড়ে মেরে বলে,’তোর বিয়ে?’
‘তো এতক্ষণ কি আমি আপনার বিয়ের কথা বললাম নাকি?’
‘ত্যাড়াব্যাড়া কথা বলবি না অনু। মাত্র বাইরে থেকে এসেছি। ক্লান্ত আমি। তবুও যে তোর কথা শুনছি, এটা তো তোর ভাগ্য।’
‘আচ্ছা সরি। বিয়েটা ভেঙে দেন না প্লিজ!’
‘বিয়ে ভাঙলে আমায় কী দিবি?’
‘৫০ টাকা দেবো।’

অনল চোখ পাঁকিয়ে তাকায়। অনু তখন তাড়াহুড়ো করে বলে,’আচ্ছা একশো টাকা দেবো।’
‘পঞ্চাশ টাকা দিবি, একশো টাকা দিবি এসবের মানে কী? আমায় কি তোর ছোটো লোক মনে হয়?’
‘না, না। আমি তো সে কথা বলিনি।’
‘তাহলে তুই কী বলেছিস আমায় বোঝা।’
‘এখন এতকিছু বোঝানোর সময় নেই। প্লিজ এই সাহায্যটা করেন।’
‘হয়েছে থাম। ন্যাকা কান্না কাঁদবি না। মেরে ছেলেটার হাত-পা ভেঙে দেবো?’
‘না, না। এসবের কোনো দরকার নেই। পরে আপনারই সমস্যা হবে।’

অনল তাচ্ছিল্য করে হেসে বলে,’হাহ্! আমার সমস্যা হবে? আমার গায়ে হাত তোলার সাহস কারো নেই।’
‘কিন্তু সে আপনার পরিচিত। আর কাছেরও অনেক।’
‘কে সে? এনামুল নাকি রাজীব?’
‘আরে ধুর না। তারা কেন বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে? ইউসূফ ভাইয়ার কথা বলছি।’
‘ইউসূফ ভাইয়া! মানে আমার মামাতো ভাই?’
‘হ্যাঁ।’
‘তুই মজা নিচ্ছিস না অনু?’
‘একদম না। আমি সত্যি বলছি।’
‘কিন্তু আমি বিশ্বাস করছি না। দুনিয়াতে এত মেয়ে থাকতে তোর মতো গবেটমার্কা একটা মেয়েকে ভাইয়া বিয়ে করতে চাইবে? অসম্ভব!’

‘শুনেন কথায় কথায় এত গবেট গবেট বলবেন না। আমি মোটেও গবেট নই। আপনার চোখে আমার গুণ, সৌন্দর্য চোখে পড়েনি বলে যে আর কারো চোখে পড়বে না এমনটা তো নয়। আর আপনার যদি আমার কথা বিশ্বাস না হয় তাহলে নিচে গিয়ে আন্টিকে জিজ্ঞেস করেন।’
‘তার কোনো প্রয়োজন নেই। তোর এসব ঢপবাজিতে আমি গলছি না। তুই সাথীকে নিয়ে জেলাস হয়েছিস বলে এখন ভাইয়াকে নিয়ে আমায় জেলাস ফিল করাতে চাচ্ছিস আমি জানি।’ কথাগুলো বলে অনুর হাত থেকে জ্যাকেটটা নিয়ে অনল নিচে নেমে যায়। হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে অনুর। অনল তো বিশ্বাসই করল না!

অনল বাসায় গিয়ে ইউসূফকে দেখে রীতিমতো চমকে যায়। কুশল বিনিময় করে বলে,’ভাইয়া তুমি! কেমন আছো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভাই। তুই ভালো আছিস?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌। কখন আসলে?’
‘সকালেই। তুই কি সারাদিন বাড়ির বাইরেই থাকিস নাকি?’
‘ঐতো একটু যাওয়া হয় ঘুরতে।’
শিমুল বেগম ইউসূফকে জিজ্ঞেস করেন,’অনু চলে গেল কেন রে?’
‘আর বোলো না ফুপি! আমায় দেখে লজ্জা পেয়েই দিল দৌঁড়।’ হাসতে হাসতে বলল ইউসূফ।

এবার অনলের টনক নড়ল। ছাদে বলা অনুর কথাগুলো মনে পড়ে যায়। তার মানে অনু মিথ্যে বলেনি? শিমুল বেগম অনলকে বললেন,’খবর কিছু শুনেছিস?’
অনল বোকার মতো তাকিয়ে রয়েছে। তিনি মুচকি হেসে বলেন,’আমাদের ইউসূফ ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে।’
‘বুঝিনি মা।’
‘ইউসূফ অনুকে বিয়ে করতে চায়। তোর বাবা কথাও বলেছে। অনুর বাবা তো রাজি।’

শীতকাল। বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবুও অনলের মনে হচ্ছে বাইরে বাজ পড়ছে। অথচ বৃষ্টি নেই। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে অনল। অনুর বিয়ে হলে ওর কী? এত অস্থির তো লাগার কথা না। শিমুল বেগমের লাস্ট কথা শুনে অস্থিরতা যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল। তিনি বললেন,’তোর মামা-মামি দোকানে গেছে। আংটি কিনতে। যেহেতু দুই পরিবার-ই রাজি তাই এঙ্গেজমেন্ট আজই হবে।’

সবকিছু অনেক তাড়াতাড়ি হয়ে যাচ্ছে। চোখের পলক পড়ার আগেই। কথাটি বলতে চেয়েও বলতে পারছে না অনল। অজানা কোনো শক্তি যেন গলা চেপে ধরে রেখেছে। সত্যিই কি অনুর বিয়ে হয়ে যাবে?
____________
আয়নার সামনে নির্জীব হয়ে বসে রয়েছে অনু। পরনে ওর নীল সুতী শাড়ি। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, আর চোখে গাঢ় কাজল। এইটুকু সাজ তিনুই সাজিয়ে দিয়েছে। অনলের বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর খালেদ রহমান যখন বললেন ইউসূফ ওর বাবা-মাকে নিয়ে আজ বাসায় আসবে এবং এঙ্গেজমেন্ট হবে তখন থেকেই একদম নিশ্চুপ হয়ে গেছে অনু। বাবার মুখের ওপর কথা বলার মতো সাহস অনুর নেই। তাছাড়া কী বলবে? বলার মতো কী-বা আছে? অনু কাউকে ভালোবাসে না। কোনো পছন্দও নেই। পড়াশোনা? সে তো ইউসূফ নিজেই পড়াবে বলেছে। তাহলে আপত্তিটা কোথায় দেখাবে? খালেদ রহমান কোনো সুযোগও দিলেন না অনুকে।

ইউসূফদের আসতে রাত একটু বেশিই হলো। এর মাঝেই আমেনা বেগম খাবারের বিশাল বন্দোবস্ত করে ফেলেছে। যদিও এখন ডিনার করার সময় কিন্তু এসেই তো ডিনার করা যায় না। তাই হালকা-পাতলা নাস্তা দিলেন আগে। কিছুক্ষণ পর অনুকে নিয়ে এলো তিনু। মাথায় ঘোমটা টানা। ইউসূফের পাশে বসানো হয় অনুকে। ওদের মুখোমুখি সোফায় অনিকের পাশে অনল বসা। হুট করে অনুকে দেখে বুকটা কেমন যেন মোচর দিয়ে ওঠে অনলের। এরকম অনুভূতি ওর আগে কখনো হয়নি। অস্বস্তিতে ঘিরে আছে সে। সাবলীল বা স্থির কোনোটাই থাকতে পারছে না। ইউসূফের বাবা হেসে বলেন,’বেয়াই সাহেব মেয়ে কী দেখব বলেন? ছোটো মেয়েটা যে এত বড়ো হয়ে গেল টেরই পেলাম না। ইউসূফ হুট করে আবদার করে বসে অনুকে বউ করে আনবে। অনুকে তো আমাদের শুরু থেকেই পছন্দ। আপত্তি করার প্রশ্নই আসেনি। আমার ছেলের পছন্দ কিন্তু মানতে হবে মশাই।’

উত্তরে খালেদ রহমান হাসেন। তাড়া দিয়ে বলেন,’তা যা বলেছেন! আপনার ছেলেও কম নয়। একি! চা নিচ্ছেন না কেন? চা নিন।’
‘তা নিচ্ছি। আগে এঙ্গেজমেন্টটা হয়ে যাক? আচ্ছা এত ঘরোয়াভাবে সবকিছু হওয়াতে আপনাদের কোনো সমস্যা নেই তো?’
‘একদম না।’ বললেন খালেদ রহমান।
‘তাহলে তো ঝামেলা চুকেই গেল। বুঝলেন সবই ছেলের পাগলামি!’

ইউসূফ একটু লজ্জা পেল। এর মাঝে একবারও অনু মুখ তুলে তাকায়নি।
‘দেখি আংটিটা দাও তো ইউসূফের মা।’ বললেন ইউসূফের বাবা। তিনি আংটিটা ইউসূফকে দিয়ে বললেন,’নে আংটিটা পরিয়ে দে।’
ইউসূফ ডান হাতে আংটি নিয়ে বাম হাত বাড়িয়ে দেয় অনুর দিকে। অনু সরাসরি অনলের দিকে তাকায়। তার চক্ষু ভরে অশ্রু জমা হয় মুহূর্তেই। অনল দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। অনু ঠোঁট বাঁকিয়ে কেঁদে ফেলে মাথা নত করে। আমেনা বেগম ছুটে এসে অনুর মাথাটা বুকে চেপে ধরেন। মাকে কাছে পেয়ে আরও হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে অনু। তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,’পাগলী মেয়ে! কাঁদছিস কেন? এখনই কি তোকে নিয়ে যাচ্ছে নাকি?’

জরুরী ফোন এসেছে বলে তখন বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে অনল। অশ্রুশিক্ত নয়নে অনলের চলে যাওয়া দেখে অনু। সকলে মিলে কী কী বোঝাচ্ছে তার কোনো কথাই অনুর কর্ণকুহরে পৌঁছাচ্ছে না। আমেনা বেগম অনুর বাম হাতটা ধরে এগিয়ে দেওয়ার পর ইউসূফ ওকে আংটি পরিয়ে দেয়।

রাতে খাওয়া-দাওয়া করে ইউসূফরা ওদের বাড়িতে চলে যায়। তারা গাড়ি নিয়েই এসেছিলেন। ঘরের বারান্দায় গলুকে কোলে নিয়ে চুপ করে বসে আছে অনু। বাবা-মা আত্মীয়দের ফোন করে সু-খবর জানাচ্ছে। তিনু অনিকের সঙ্গে ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত। বড়ো বোনের বিয়েতে কী পরবে, কীভাবে সাজবে কতশত জল্পনা-কল্পনা তার! এদিকে মনের সাথে যুদ্ধ করে চলেছে অনু। মনে পড়ে যায় অনলের সাথে কাটানো মুহূর্তের কথাগুলো। একসাথে ঘোরাফেরা, ঝগড়া করা। এসবকিছুর আড়ালে কি ভালোবাসা নামক কোনো শব্দ ছিল?
.
.
আকাশে চাঁদ নেই। তারা নেই। নাকি আছে? হতে পারে মেঘে ঢেকে আছে। পুরো আকাশজুরে অন্ধকারের বিচরণ। ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে অনল। অনুদের বাড়ি থেকে চলে আসার পর থেকেই ছাদে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাড়িতে কেমন জানি দম বন্ধ হয়ে আসে। জানালা, ব্যলকোনি থেকে অনুর ঘর দেখলে কষ্টে মূর্ছা যেতে ইচ্ছে করে। অথচ এরকমটা কখনো হওয়ারই কথা ছিল না।

‘অনল!’
নিজের নাম কারো ক্রন্দনরত কণ্ঠে শুনে পেছনে ফিরে তাকায় অনল। সামনে দাঁড়িয়ে অনু। অন্ধকারে মুখ বোঝা না গেলেও চিনতে অসুবিধা হয়নি একটুও। শাড়ির আঁচল এলোমেলো। খোঁপা করা চুলগুলো খুলে যাওয়ার উপক্রম। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে।

‘কাঁদছিস কেন অনু?’ জিজ্ঞেস করে অনল।

অনু দৌঁড়ে এসে ঝড়ের বেগে আছড়ে পড়ে অনলের বুকে। জ্যাকেট খামচে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,’প্লিজ বিয়েটা ভেঙে দেন! আমি অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না।’

অনলের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। অনুকে সে বহুবার কাঁদতে দেখেছে। কিন্তু কখনো তার এরকম অনুভূতি অনুভূত হয়নি। আজ মনে হচ্ছে বুকের পাঁজর ভেঙে চূড়ে যাচ্ছে। অনু অনলের শার্টের কলার চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,’ভেঙে দিবেন তো এই বিয়ে?’
‘শুধু শুধু পাগলামী করছিস অনু। ইউসূফ ভাইয়া অনেক ভালো ছেলে। তোকে অনেক সুখে রাখবে। তবে তোকে খুব মিস করব রে। তোর সাথে আর ঝগড়া করা হবে না, তোর পেছনে লাগা হবে না। সুইজারল্যান্ড গিয়ে কি আমায় ভুলে যাবি অনু?’

অনু এবার আরও জোড়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। ঐভাবেই শক্ত করে শার্টের কলার চেপে ধরে বলে,’আপনি বলেছিলেন না আমি বোকা? সত্যি ভালোবাসা কোনটা আবেগ কোনটা আমি বুঝি না? সত্যিই এতদিন আমি বুঝিনি। আমি বুঝিনি যেই মানুষটা সারাক্ষণ আমার সাথে ঝগড়া করে সেই মানুষটাকেই আমি ভালোবাসি। আমি বুঝিনি যে এই মানুষটাকে ছাড়া আমার চলবে না। হ্যাঁ,আমি আপনাকে ভালোবাসি। আপনার সাথেই সারাজীবন আমি ঝগড়া করতে চাই। আপনার সাথেই আমি সারাজীবন কাটাতে চাই।’

অনুর হাত ছাড়িয়ে নেয় অনল। চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,’একদিন তোর বিয়ে হবে জানতাম। তোর বিয়েতে খুব নাচব, আনন্দ করব ভেবে রেখেছিলাম। কিন্তু সেই দিনটা যে এত দ্রুত চলে আসবে সেটা ভাবিনি। মিস করব অনু। ভীষণ মিস করব!’

এরপর জ্যাকেটটা খুলে অনুর গায়ে দিয়ে বলে,’শীতের মধ্যে আর এখানে থাকিস না। বাড়ি চলে যা।’
অনু কান্না বাঁধ মানে না। অনলকে খাঁমচে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,’আপনি কি বুঝতে চাচ্ছেন না? নাকি বুঝতে পারছেন না? এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন? এড়িয়ে যাবেন না প্লিজ! দয়া করে আমার মনের অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করুন। আমার আপনাকে প্রয়োজন। শুধুই আপনাকে।’
কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে যায়। আস্তে আস্তে শরীরটাও নিস্তেজ হয়ে আসে। কথাগুলো কেমন জড়িয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। একসময় সেন্সলেস হয়ে অনলের ওপরেই পড়ে যায় অনু। দু’হাতে আঁকড়ে ধরে সে অনুকে। বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে বলে,’সরি।’ দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে অনলের চোখ থেকে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে