এক ফালি চাঁদ পর্ব-০৭

0
1212

#এক_ফালি_চাঁদ
#পর্ব_৭
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
অনলকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে মুক্ত হয়ে নিল অনু। ভেংচি কেটে বলল,’হুহ্! আসছে। ভালোবাসিস আমায়! ঢং যত্তসব।’
‘ঢং?’
‘তা নয়তো কী?’
‘আচ্ছা যদি ঢং-ই হয় তাহলে তুই সাথীর প্রতি জেলাস হচ্ছিস কেন?’
‘আমি মোটেও জেলাস হইনি। আপনি আমায় জ্যাকেট দেননি অথচ ওকে দিয়েছেন এজন্যই আমার রাগ হয়েছিল।’
‘নিকুচি করি তোর রাগের।’
‘আর আপনার রাগকে আমি নিমকুচি করি। সারাজীবন অনু সিঙ্গেল থাকবে দরকার হলে। তবুও তো আপনাকে ভালোবাসবে না, না, না! কখনো না।’

অনু চলে যায় ভেতরে। অনল হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছু্ক্ষণ। এই মেয়ে সাংঘাতিক লেভেলের হিংস্র! তবে টোপ দিলে গিলবে নির্ঘাৎ। পরেরদিন ভার্সিটিতে যাওয়ার পর একদম অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই সাথীর সাথে দেখা হয়ে যায়। পারতপক্ষে বলা যায় সাথী নিজ থেকে পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে। ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি। মিষ্টি করে হেসেই সাথী জিজ্ঞেস করল,’ভালো আছেন?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো। তুমি?’
‘আমিও আলহামদুলিল্লাহ্‌।’
অনুকে তখন দেখা গেল জেসি আর শুভার সাথে এদিকে আসছে। আড়চোখে ওদের দিকেও তাকাচ্ছে। অনল বেশ মজা পাচ্ছে। সে ঠোঁটে চওড়া হাসি টেনে বলে,’কফি খাবে?’
‘হ্যাঁ, খাওয়া যায়।’ মাথা দুলিয়ে বলল সাথী।

ওদের দুজনের কথোপকথন শুনতে না পেলেও দুজনকে ক্যান্টিনের দিকে যেতে দেখা গেল। অনু নাকমুখ কুঁচকে ফেলে। শুভা বলে,’এদের কাহিনীটা কী রে?’
‘আমি কী করে বলব?’ অনুর কথায় ক্রোধ। শুভা বলল,’রাগ করছিস কেন? আমি তোকে জিজ্ঞেস করলাম নাকি?’
‘তুই চুপ করে থাক।’
‘কথায় না পারলেই চুপ করে থাক!’
অনু এবার দাঁত কিড়মিড় করে বলে,’জেসি ওকে চুপ করতে বল। নয়তো একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে বলে দিলাম।’
‘সকাল সকাল এত চটে যাচ্ছিস কেন? শুভা এমন কী বলল?’
‘ওহ! এখন তুইও তাহলে শুভার দলে? ভালো। খুব ভালো।’
রাগ দেখিয়ে হনহন করে অনু ক্লাসে চলে যায়। পিছু পিছু জেসি আর শুভাও আসে। কলম কামড়াচ্ছে অনু। আর একটু পরপর দরজার দিকে তাকাচ্ছে। হয়তো সাথীর আসার জন্যই অপেক্ষা করছে। কিন্তু সেই যে ক্যান্টিনে গিয়ে ঘাপটি মেরে রইল! এখনও তো আসার কোনো নামই নেই। অদ্ভুত! কী রসের আলাপ দুজনে শুরু করেছে কে জানে!

‘সরি।’ মৃদুসুরে বলল শুভা। অনু না তাকিয়েই বলল,’আমিও সরি। শুধু শুধু রাগ দেখিয়েছি।’
‘বাহ্। দুজনের তো মিল হয়েই গেল। চল ক্যান্টিনে যাই। কিছু খেয়ে আসি।’ প্রস্তাব করল জেসি। জেসির প্রস্তাবে সবচেয়ে বেশি খুশি অনুই হলো। সঙ্গে সঙ্গে হ্যাঁ…বোধক ঘাড় নাড়িয়ে ক্যান্টিনে যাওয়ার জন্য ক্লাস থেকে বের হলো। ওরা ক্যান্টিনে ঢুকেছে, সাথী আর অনল ক্যান্টিন থেকে বের হয়েছে। অনুর মুখোমুখি হয়ে ফিচেল হাসে অনল। দাঁত কেলিয়ে বলে,’কিছু খাবি অনু? খেলে খা। বিল আমি দেবো।’

রাগে শরীর জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে অনলের কথা শুনে। অনু কটমট করে বলে,’আমার টাকা আছে। আপনার টাকা আমার লাগবে না।’
‘আরে এমন করিস কেন? তুই আমার ছোটো বোন। তোকে তো আমি খাওয়াতেই পারি।’
অনুর মাথা ভনভন করছে। শালা বললটা কী! অনুর চোখে-মুখে রাগ থাকলেও সাথী বেশ খুশি হলো। অনুকে জিজ্ঞেস করল,’তুমি আর অনল আপন ভাই-বোন?’
রাগের চোটে অনুর মুখ থেকে কথাই বের হচ্ছে না। অন্যদিকে অনল বেশ মজা নিচ্ছে। জেসি তখন কাঠকাঠ গলায় বলে,’না সাথী। অনল ভাইয়ার আম্মু আর অনুর আম্মু বেষ্টফ্রেন্ড। সেই সূত্রে ওদের পারিবারিক বন্ডিং আছে। অনু যেহেতু অনল ভাইয়ার থেকে বয়সে ছোটো সেহেতু অনু তো তাকে ভাইয়া বলেই সম্ভোধন করবে তাই না?’
‘ও।’ ছোটো উত্তর সাথীর।
সাথী সৌজন্যমূলক হাসলো। অনু, জেসি এবং শুভা আর কথা না বাড়িয়ে ক্যান্টিনের ভেতর চলে যায়। অনল বিড়বিড় করে বলে,’জ্বল জ্বল! আরো জ্বল। দেখবি আর জ্বলবি লুচির মতো ফুলবি।’
_______________

সূর্যের দেখা আজ প্রায় নেই বললেই চলে। ঘন শুভ্র কুয়াশার আড়ালে আচ্ছাদিত অবস্থায় আছে এখন সূর্য। ল্যাপের নিচে অনেকক্ষণ বসে থেকে এক মিনিটের জন্য বের হলেই আবারও শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। তাই প্রয়োজন ব্যতীত আজ কেউই বাইরে যাচ্ছে না। তিনু কলেজ থেকে এসে সেই যে ল্যাপের ভেতর ঢুকেছে, আর বের হয়নি।
সন্ধ্যায় খালেদ রহমান বাড়ি ফিরেন। সচারচর বাড়ি ফিরতে তার দশটা বাজে।সেই তুলনায় আজ অনেক আগেই ফিরেছেন। চোখে-মুখে গাম্ভীর্যের সঙ্গে রয়েছে অন্য এক খুশির আভাস। আমেনা বেগমের উদ্দেশ্যে বলেন,’এক কাপ চা নিয়ে ঘরে আসো তো।’

আমেনা বেগম চা নিয়ে ঘরে আসেন। খালেদ রহমান চায়ের কাপ নিয়ে বললেন,’বসো এখানে।’
আমেনা বেগম বিছানার এক পাশে বসলেন। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে খালেদ রহমান বলেন,’অনুর জন্য ভালো একটা পাত্র পেয়েছি। দেখতে-শুনতে সবদিক দিয়েই ভালো। পরিবার-ও মাশ আল্লাহ্।’
‘এত তাড়াতাড়ি অনুর বিয়ে দিতে চাচ্ছ যে?’
‘এত তাড়াতাড়ি কোথায় দেখলে? অনু এখন ভার্সিটিতে পড়ে। সেই ছোটোটি নেই এখন। আর মেয়েদের বেশি বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া উচিত।’
‘অনুকে একবার বলা উচিত না?’
‘হ্যাঁ, বলবে। আমার মনে হয় না ছেলেকে কোনোদিক থেকে ওর বা তোমার অপছন্দ হবে। ছেলে কে সেটা জানলে তুমি অবাক হবে।’
‘আমি চিনি?’
‘হ্যাঁ। ইউসুফের কথা মনে আছে না? তোমার তো ভালো করে মনে থাকার কথা।’
‘অনিকের মামাতো ভাই?’
‘হ্যাঁ। দশ, পনের দিন হবে সুইজারল্যান্ড থেকে দেশে ফিরেছে। বেড়াতে এসেছে। আমাদের অনুকে দেখে পছন্দ করেছে। কী ভদ্র ছেলে! মেয়ে পছন্দ হয়েছে ডিরেক্ট ওর বাবাকে দিয়ে আমায় বলিয়েছে। এখনকার যুগে এমন ছেলে পাওয়া যায়? আজ এই বিষয়েই আমি, ইউসূফের বাবা আর অনলের বাবা কথা বললাম। ইউসূফকে তো আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। তিন মাস থাকবে। এর মাঝেই বিয়ে করতে চায়। অনুকে নিয়ে সুইজারল্যান্ডেই সেটেল হবে। বলো এবার আপত্তি আছে?’

আমেনা বেগম কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি একটা ঘোরের মাঝে আছেন। ইউসূফ অনলদের বাসায় এসে তার সাথেও দেখা করে গেছে। কিন্তু হাভভাবে এমন কিছুই মনে হয়নি। এমনকি কিছু বলেওনি। তিনি জড়তা রেখে বললেন,’অনু আমাদের ছেড়ে এত দূরে থাকবে! মানে বলছিলাম যে…’

এ কথা শুনে খালেদ রহমান কপালে ভাঁজ টেনে বলেন,’এইটা আবার কী কথা বললে? মানুষ কি বিদেশে থাকছে না? তোমার তো আরও খুশি হওয়ার কথা। ক’জন মেয়ে এমন ভাগ্য পায়?’
এমন কথার প্রত্যুত্তরে আমেনা বেগম আর কিছু বলতে পারলেন না। কাপের অবশিষ্ট চা’টুকু সম্পূর্ণ শেষ করে খালেদ রহমান বললেন,’যাও অনুকে গিয়ে খবরটা দাও।’

সম্পূর্ণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও বসা থেকে উঠলেন আমেনা বেগম। ধীর পায়ে অনুর রুমে এগিয়ে যান। বিছানায় শুয়ে শুয়ে তখন ফেসবুকিং করছিল অনু। শান্ত মুখটা দেখে তার বড্ড মায়া হচ্ছে। যদি সত্যি সত্যিই অনুর ইউসূফের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায়? তাহলে এই মুখটা প্রতিদিন কাছ থেকে দেখা হবে না। অনেক দূরে চলে যাবে। কত রাগই না তিনি অনুকে দেখান। সেসব স্মৃতি রোমন্থন করে দু’চোখের পাতা তার ভিজে উঠে। গলু ম্যাও ম্যাও শব্দ করলে তিনি চোখের পানি মুছে নেন। ফোন রেখে গলুকে পেটের ওপর বসিয়ে অনু বলে,’এমন চিল্লাচ্ছিস কেন বদ?’
এবারও উত্তরে গলু ম্যাও ম্যাও করছে। গলুর দৃষ্টি দরজার দিকে। অনুও দরজার দিকে তাকায়। আনমনে আমেনা বেগমকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে,’মা তুমি! ওভাবে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভেতরে আসো।’

এই মুহূর্তে তার নিজেকে বড্ড ভারী মনে হচ্ছে। শরীর একদম চলতে চাচ্ছে না। তিনি এগিয়ে গিয়ে অনুর পাশে বসেন। চুলে হাত বুলিয়ে দেন। অনু মুচকি হেসে বলে,’কী ব্যাপার হু? হঠাৎ এত আদর কেন?’

অনুর ভ্রুঁ নাচানি আর দুষ্টু হাসি দেখে হেসে ফেলেন আমেনা বেগম। গালে হাত বুলিয়ে বলেন,’তুই কত বড়ো হয়ে গেছিস অনু।’
‘ওমা! তো বড়ো হব না?’
‘হবি তো! কিন্তু তাই বলে এত বড়ো? বউ হওয়ার মতো?’
‘বুঝলাম না মা। কীসের বউ? কার বউ?’
‘আমাদের ছোটো অনু চোখের পলকেই বড়ো হয়ে গেছে অথচ খেয়ালই হয়নি। এখনও মনে হয় তুই আমার ছোট্ট অনু।’

‘একটু ঝেড়ে কাঁশো মা। আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না।’ ভ্রুঁ কিঞ্চিৎ বাঁকা করে বলল অনু। তিনি বললেন,’ইউসূফের কথা মনে আছে? অনল, অনিকের মামাতো ভাই।’
‘একটু একটু! অনেক বছর আগে দেখেছিলাম। তো কী হয়েছে?’
‘তোকে পছন্দ করেছে ইউসূফ। বিয়ে করতে চায়।’
‘এসব তুমি কী বলছ মা? আমি তো এখন বিয়ে করব না।’
‘তোর আব্বুর কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। সে রাজি। তাই তোকে বলতে বলল।’
‘কী আজব! আমার বিয়ে অথচ আমার মতামত নেবে না?’
‘অসুবিধা কী? ছেলে তো ভালো।’
‘হোক ভালো। আমিও তো খারাপ নই। কিন্তু আমি বিয়ে করব না। তুমি আব্বুকে বলে দাও।’
‘আমি কী বলব? তুই গিয়ে বল।’
‘কাউকেই বলতে হবে না। এই বিয়ে ভেঙে দেবো।’
আর কিছু না বলেই অনু বাড়ি থেকে বের হয় অনলের কাছে যাওয়ার জন্য। এর বিহিত একমাত্র অনলই করতে পারবে। ইউসূফকে জানালে অবশ্যই সে বিয়ে ভেঙে দেবে।

অনলদের বাড়ি যাওয়ার পর দরজা খুলে দেন শিমুল বেগম। অনল এবং অনিকের মা তিনি। অনুকে দেখেই এক গাল হেসে বলেন,’আরে অনু! তোর কথাই হচ্ছিল। আয় ভেতরে আয়।’
‘অনল ভাইয়া কোথায় আন্টি?’ ভেতরে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করল অনু।
‘সেই যে সকালে ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিল। আর আসেনি এখনও। কই কই যে থাকে ছেলেটা! বাদ দে ওর কথা। তুই বোস। তোর সঙ্গে কথা আছে।’

অস্বস্তি নিয়েই বসতে হলো অনুকে। ফোনটাও বাসায় রেখে এসেছে। নয়তো ফোন করে তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে বলা যেত। আচ্ছা অনিককে বললেই তো ফোন করার কথা। তখন শিমুল বেগম বললেন,’আমি চা নিয়ে আসি দাঁড়া।’
‘আচ্ছা। আন্টি অনিক কি বাসায়?’
‘হ্যাঁ, অনিক ওর ঘরেই আছে।’

শিমুল বেগম রান্নাঘরে যাওয়ার পর অনু অনিকের ঘরে আসে। ল্যাপ গায়ে দিয়ে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে অনিক। অনু ওকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে ডাকে,’এই অনিক ভাইয়া। অনিক ভাইয়া? এই ভর সন্ধ্যায় ঘুমিয়েছেন নাকি? উঠুন।’

প্রচণ্ড ধাক্কাধাক্কিতে মনে হচ্ছিল ঝড় হচ্ছে। ঘুমে ঢুলুঢুলু হয়ে ল্যাপের ভেতর থেকে মাথা বের করে। সমস্ত ঘুমের নেশা তার কেটে যায়। এদিকে অনুও অপ্রস্তুত হয়ে তাকিয়ে রয়েছে।
‘অনিক ওয়াশরুমে। আমি ইউসূফ।’ মিষ্টি হেসে কথাটি বলল ইউসূফ।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে